ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট ফকির-সন্ন্যাসীদের প্রভাব

ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০) Fakir - Sannyasi rebellion (1763-1800)
ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই বিশেষ করে বাংলায় দীর্ঘদিন ধরে চলে স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলন ও কৃষক বিদ্রোহ। ১৭৬৩ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনের অবসান পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে ও মাত্রায় এসব আন্দোলন চলতে থাকে । ঔপনিবেশিক ভূমিব্যবস্থা, ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ, জোর করে ধানের জমিতে নীল চাষে কৃষকদের বাধ্য করা- এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এই আন্দোলনসমূহের উদ্দেশ্য হলেও সামগ্রিকভাবে এগুলো সবই ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনগুলোর মধ্যে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য ।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ
১৭৫৭ খ্রি. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর থেকে আস্তে আস্তে বাংলার অর্থনীতি, সামাজিক কাঠামো ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব পড়তে থাকে। প্রতিটি ক্ষেত্রে কোম্পানি হস্তক্ষেপ করে বা নতুন নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ফলে অনেকক্ষেত্রেই এদেশের বিভিন্ন শ্রেণির অধিবাসীরা এতদিন ধরে যেসব অধিকার বা সুযোগ পেয়ে আসছিল, তাতে আঘাত আসে। এসবের বিরুদ্ধেই তারা গড়ে তোলে বিভিন্ন আন্দোলন বা বিদ্ৰোহ ৷
ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ ছিল বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ। ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রি.- এই দীর্ঘ সময় ধরে চলে ফকির- সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ ।

এই ফকির-সন্ন্যাসীরা ছিলেন বাংলারই অধিবাসী। ফকিরেরা ছিলেন সুফি সম্প্রদায়ের মাদারিয়া শ্রেণিভুক্ত। আর সন্ন্যাসীরা ছিলেন বৈদান্তিক হিন্দু যোগী। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা মুঘল সাম্রাজ্যের সৈন্যদল থেকে বাদ পড়া সদস্য, আবার অনেকে ছিলেন ভূমিহীন কৃষক। তবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই ফকির- সন্ন্যাসীরা ছিলেন এদেশের স্থায়ী অধিবাসী। ধর্মীয় দিক থেকে ফকির-সন্ন্যাসীদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ফকির- সন্ন্যাসীদের মধ্যে মিলনের সাধারণ ক্ষেত্র তৈরি করে এবং তারা একই পতাকাতলে সমবেত হন।
বাংলায় ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পেছনে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল এবং এটি ছিল সে সময়কার বাংলায় কোম্পানি কর্তৃপক্ষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ও প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, কোম্পানি কর্তৃক লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিষয়টি ফকির-সন্ন্যাসীদেরকে বিদ্রোহী করে তোলে । প্রকৃতপক্ষে বাংলায় কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ফকির ও সন্ন্যাসীদের কার্যকলাপ ছিল মুক্ত ও স্বাধীন। তবে কোম্পানি শাসনের শুরু থেকেই তাদের স্বাধীন গতিবিধি বাধা পায়। তারা বাধা পেতে থাকে বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে। ধর্মস্থান বা তীর্থস্থান পর্যটন ভারতবর্ষের একটি অতি প্রাচীন সামাজিক ও আত্মিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত ছিল। ফকিরেরা যেমন বাংলার বিভিন্ন দরগা বা মাজার জিয়ারত করতেন, তেমনি সন্ন্যাসীরাও পুণ্যকর্ম করার অভিলাষে বাংলার বিভিন্ন তীর্থস্থানগুলোতে ঘুরে বেড়াতেন। কোম্পানির স্থানীয় প্রশাসন প্রথমে ফকির- সন্ন্যাসীদের তীর্থযাত্রায় বাধা দেয় এবং পরে আইন করে এই নিষেধাজ্ঞাকে দৃঢ় করা হয়। সামাজিক ও আত্মিক অধিকার হরণের পাশাপাশি ফকির-সন্ন্যাসীদের অর্থনৈতিক অধিকার হরণের অভিযোগও এর সাথে সংযোজিত হয়। কোম্পানি শাসনপ্রসূত অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে ফকির-সন্ন্যাসীরা বঞ্চিত হন তাদের চিরাচরিত ভিক্ষা সংগ্রহের অধিকার হতে। নিম্নশ্রেণির রায়তদের অবলুপ্তির ফলে ফকির-সন্ন্যাসীদের দাবি অগ্রাহ্য হয় এবং তারা জমিদারদের বাড়ি, কাছারি ও কোম্পানির কুঠি আক্রমণ করেন ।
ফকির-সন্ন্যাসীদের প্রাথমিক প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত হয়। ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রি. পর্যন্ত চলতে থাকা তাদের এই সশস্ত্র আন্দোলন ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ ও পুর্ণিয়া জেলায় সম্প্রসারিত হয়েছিল। ফকির-সন্ন্যাসীদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল কোম্পানির কুঠি, জমিদারদের কাছারি ও নায়েব-গোমস্তাদের বাড়ি। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় দেশীয় সহযোগীদেরকেও ফকির-সন্ন্যাসীরা শত্রু হিসেবে মনে করেন এবং তাদের ওপর আক্রমণাত্মক তৎপরতা পরিচালনা করেন। এছাড়া কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যের সহযোগী দেশীয় বেনিয়াদের নৌকা আক্রমণ, * সৈন্যবাহিনীর রসদ পরিবহন বন্ধ করা এবং যোগাযোগে বিঘ্ন সৃষ্টি করা- এগুলোও ছিল কোম্পানির বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের গৃহীত ব্যবস্থা। ফকির-সন্ন্যাসীরা অস্ত্র হিসেবে বর্শা, তরবারি ও গাদা বন্দুক ব্যবহার করতেন। মূলত নেতৃস্থানীয়রা ব্যবহার করতেন ঘোড়া। ফকিরদের নেতা ছিলেন মজনু শাহ। পরবর্তী সময়ে তার উত্তরাধিকারীরা ছিলেন মুসা শাহ, পরাগল শাহ, চেরাগ আলী শাহ, সোবাহান শাহ, মাদার বকস, জরি শাহ, করিম শাহ প্রমুখ। সন্ন্যাসীদের নেতা ছিলেন ভবানী পাঠক।
১৭৬৩ খ্রি. সর্বপ্রথম বাকেরগঞ্জে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কুঠি ফকির- সন্ন্যাসীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এবং সন্ন্যাসীরা সেখানকার ফ্যাক্টরি প্রধান কেলিকে ঘেরাও করে রাখেন। ঐ বছরই ফকিরেরা ঢাকা ফ্যাক্টরি আক্রমণ করেন; আক্রমণের তীব্রতা দেখে এই ফ্যাক্টরির প্রধান লেস্টার কর্মস্থল ত্যাগ করে পালিয়ে যান। পরে অবশ্য ক্যাপ্টেন গ্রান্ট ফ্যাক্টরিটি পুনরুদ্ধার করেন। সন্ন্যাসীরা ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দেই রাজশাহীর রামপুর-বোয়ালিয়ায় কোম্পানির কুঠি আক্রমণ করেন। ১৭৬৯ খ্রি. উত্তরবঙ্গে ফকির-সন্ন্যাসীদের তৎপরতা প্রতিহত করার জন্য ক্যাপ্টেন ডি. ম্যাকেনজিকে একদল সৈন্যসহ রংপুরে পাঠানো হয়। ১৭৭০ খ্রি. বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের (যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হিসেবে পরিচিত) সময় ও মন্বন্তর পরবর্তী সময়ে ফকির-সন্ন্যাসীদের আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। এ সময় দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়ায় এই আন্দোলনের তীব্রতা লক্ষ করা যায়। ১৭৭২ খ্রি. রাজশাহী জেলায় ফকির- সন্ন্যাসীদের তৎপরতার প্রচণ্ডতা দেখা যায়। ঐ বছরই রংপুরে সন্ন্যাসীদের হাতে নিহত হন রংপুরের সুপারভাইজার পালিং। ১৭৭৬ খ্রি. আবার উত্তরবঙ্গের বগুড়া, রাজশাহী ও দিনাজপুরে ফকির-সন্ন্যাসীদের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ময়মনসিংহের আলাপসিংহ পরগণায় এদের তৎপরতা তীব্র আকার ধারণ করে। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মজনু শাহ মহাস্থানগড়ের দিকে অগ্রসর হন। ১৭৮৬ খ্রি. মজনু শাহের সাথে কোম্পানির সৈন্যদলের পরপর দু'টি সংঘর্ষ ঘটে। এ সময়ের সংঘর্ষে মজনু শাহ তাঁর বহুসংখ্যক অনুসারীকে হারান। ১৭৮৭ খ্রি. মজনু শাহ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য উত্তরসূরীরা পুরো আঠারো শতক পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। তবে আস্তে আস্তে এর গতি স্তিমিত হয়ে পড়ে। কোম্পানির উন্নততর রণকৌশল, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সামরিক প্রযুক্তির কাছে ফকির-সন্ন্যাসীদের পরাজয় ছিল অনিবার্য। অন্যদিকে যথোপযুক্ত ও শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের অভাব শেষ পর্যন্ত ফকির-সন্ন্যাসীদের পরাজয় এবং বিদ্রোহ স্তিমিত হয় যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে ।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, কোম্পানি আমলের শুরু থেকে বাংলায় শুরু হয়েছিল ফকির এবং সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই বিদ্রোহ চলেছিল। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ওয়াট ও হার্ডউইট এক অভিযোগে প্ৰকাশ করেন যে তারা বর্ধমান ও নদীয়ার কৃষ্ণনগর অঞ্চলে বর্গী এবং সন্ন্যাসীদের আক্রমণের কারণে রাজস্ব আদায় করতে পারছেন না এবং ফকির-সন্ন্যাসীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ।
১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ক্লাইভ লিখেছিলেন যে একদল ফকির কোম্পানির ঢাকা কুঠির হামলা চালিয়ে দখল করে নিয়েছে এবং প্রভাব বিস্তার করেছে।
১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ফকিররা রংপুর দখল করেছিল এবং লেঃ কীনের নেতৃত্বে পরিচালিত এক ইংরেজ সৈন্য বাহিনী পরাজিত করেছিল। ওই যুদ্ধে কিন নিহত হন। এভাবে ফকির-সন্ন্যাসীরা সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত হয় ।
১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ফকির বিদ্রোহ আরও প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। ফকির- সন্ন্যাসীরা সংগঠিত হয় এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলে ।
এরপর ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের ৩০ তারিখে প্রায় দেড় হাজার বিদ্রোহী ফকির এবং সন্ন্যাসী রংপুর শহরের নিকটবর্তী শ্যামপুর নামক স্থানে সমবেত হয়। ক্যাপ্টেন টমাস একদল সৈন্য নিয়ে তাদেরকে আক্রমণ করলে ফকির এবং সন্ন্যাসীরা ইংরেজ বাহিনীকে পরাস্ত করে এবং তাদের সেনাপাতি টমাসকে তরবারির আঘাতে নিহত করে। শ্যামপুরের যুদ্ধে ফকিররা বিজয়ী হয়ে ঢাকার দিকে যাত্রা করে। ঢাকায় তাদেরকে ইংরেজরা বাধা দেয়। এ যুদ্ধে ইংরেজবাহিনীর অনুগত এদেশীয় সেপাইরা ফকিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে। ইংরেজ সেনাপতি দেশীয় সৈন্যদের অবাধ্যতার জন্য তাদেরকে অভিযুক্ত করে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে তোপের মুখে উড়িয়ে দেয়। এতে ফকির-সন্ন্যাসীদের আন্দোলন আরও প্রকট আকার ধারণ করে।
বিখ্যাত ফকির বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন ফকির মজনু শাহ। মজনু শাহের প্রধান প্রধান অনুচরদের মধ্যে ছিলেন- যথাক্রমে মুশা শাহ, চেরাগ আলী শাহ ও পরাগল শাহ। মুশা শাহ ছিলেন মজনু শাহের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং পরাগল শাহ ছিলেন তার পুত্র। এরা সবাই ফকির বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অপর দিকে সন্ন্যাসীরাও ইংরেজদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিল এক বিরাট সংগঠন। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী । মূলত ফকির এবং সন্ন্যাসীরা একত্রিত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতেন। ফকির মজনু শাহের সঙ্গে ভবানী পাঠক এবং দেবী চৌধুরানীর ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পরে মুসলিম ফকির ও হিন্দু সন্ন্যাসীদের যৌথ প্রচেষ্টায় ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে ।
অবিভক্ত বাংলায় ফকিরদের বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে স্বয়ং মজনু শাহই নাটোরের রাণী ভবানীর কাছে এক আবেদন জানিয়েছিলেন : ‘আমরা বহুদিন থেকে বাংলাদেশে ভিক্ষা করে বেড়াই এবং জনগণও আমাদেরকে ভিক্ষা দিয়ে থাকেন। আমরা বহুকাল ধরে বিভিন্ন ধর্মস্থানে ও দরগায় আল্লার নিকট নামাজ আদায় করে আসছি। আমরা কখনো কারো বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন করিনি এমনকি কারোর উপর ‘অত্যাচারও করিনি। তবুও গত বছর আমাদের ১৫০ জন ফকিরকে বিনা অপরাধে খুন করা হয়েছে।... ইংরেজরা আমাদের দলগতভাবে ধর্মস্থান ও অন্যান্য দরগায় যেতে বাধা প্রদান করে থাকে । ইংরেজদের এই কাজ সম্পূর্ণ অন্যায় । আপনি দেশের শাসক । আমরা ফকির। আমরা সব সময় আপনার মঙ্গল কামনা করি। আমরা আপনার সাহায্যপ্রার্থী।
এই আবেদনেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ফকিরদের বৃটিশ বিরোধী বিদ্রোহের মূল কারণ। তৎকালে ফকির এবং সন্ন্যাসী বিদ্রোহের যারা সমর্থন দিয়েছিলেন, তারা ছিলেন অধিকাংশই গ্রামের সাধারণ মানুষ। জনগণ তাদের গতিবিধি এবং গোপন কার্যক্রম কখনো কারোর কাছে প্রকাশ করতো না ।
তবে দেশের মধ্যে যারা জনগণের স্বার্থ বিরোধী কার্য কলাপে জড়িত ছিলো, সেই সব অবস্থাপন্ন জমিদাররা সব সময় আতঙ্কিত থাকতেন সন্ন্যাসীদের ভয়ে। তারা সন্ন্যাসীদেরকে অভিহিত করতেন ডাকাত এবং দস্যু বলে। ওয়ারেন হেস্টিংস নিজেও মন্তব্য করেছেন : তারা দস্যুগিরি করে ভিক্ষাবৃত্তির নামে। কোনো কোনো জমিদার সন্ন্যাসী এবং ফকিরদের নানাভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করতেন। পুর্নিয়ার রামকুঠি আক্রমণ কালে সেখানকার স্থানীয় জমিদার বিদ্রোহী ফকিরদের সাহায্য করেছিলেন । উক্ত জমিদার ইংরেজ সেপাইদের বিন্দুমাত্র সাহায্য করেননি। ইংরেজরা এ দেশীয় জমিদারদের সব সময় সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। বগুড়া জেলার সিলবারিস পরগনায় লেঃ টেলর সন্দেহের বশবর্তী হয়ে সেখানকার কয়েকজন জমিদারকে গ্রেফতার করেন। বিদ্রোহী ফকির এবং সন্ন্যাসীদের মধ্যে একটা সৈনিকসুলভ শৃঙ্খলা গড়ে উঠেছিল। দলের নেতৃবৃন্দকে ফকির এবং সন্ন্যাসীরা গভীর শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করতো। নেতৃবৃন্দকে তারা ডাকতো হাকিম বলে। সাধারণ জনগণের সঙ্গে ফকির এবং সন্ন্যাসীদের একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যে সকল স্থানে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে ফকির এবং সন্ন্যাসীদের লড়াই সংঘটিত হয়েছিল- সেই সকল স্থানের অধিবাসীরা কখনো ইংরেজদেরকে সাহায্য করেনি। বরং ফকির এবং সন্ন্যাসীদের পক্ষাবলম্বন করে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং লাঠি দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিল । দিনাজপুর জেলার মুশা শাহের নেতৃত্বে ফকিররা যে সমস্ত অভিযান ইংরেজদের বিরুদ্ধে পরিচালিত করেছিল, ওই সকল অভিযানে কোম্পানী কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের কাছে সাহায্য চেয়েও তারা কোনো সাহায্য পায়নি। এ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদনে আক্ষেপ করে লেখা হয়েছিল : “স্থানীয় গ্রামবাসীরা সাহায্য করলে মুসা শাহকে গ্রেফতার করা সম্ভব হতো কিন্তু তারা সাহায্য করাতো দূরের কথা বরং লুটপাট করার কাজে অংশ নিয়েছে। এভাবে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।”
কোম্পানির স্বেচ্ছাচারী আচরণ এবং নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণে উত্তর বাংলার জনগণের মধ্যে ব্যাপক একটা বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিল । সেই বিক্ষোভই ফকির এবং সন্ন্যাসীরা কাজে লাগিয়ে বিদ্রোহে পরিণত করেছিল। মজনু শাহের সাংগাঠনিক দক্ষতা ও ইংরেজ বিরোধী নেতৃত্ব এবং ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীর মেধা ও কর্মতৎপরতা শক্তির সম্মেলনে পরিণত করে তুলেছিল। অর্থাৎ এটা ছিল ফরাসি প্রজাতন্ত্রেরই মতো একটা সুশৃঙ্খলাবদ্ধ সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, যা ব্যাপকভাবে বাংলায় প্রসার ঘটে।
ফকির এবং সন্ন্যাসীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার কোনো লেশমাত্র চিহ্ন ছিল না। তাদের কাজের মধ্যেও ছিল না কোনো পার্থক্য। চলনে-বলনে পোশাক পরিচ্ছদ এতই মিল ছিল যে কে হিন্দু কে মুসলমান তা একটুও বুঝার উপায় ছিল না। তদানীন্তনকালে সেই ঐতিহাসিক পর্বে যখন বাংলার মানুষ যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্যরক্ষা এবং বিচারকার্যের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখত না- কেবল বিদ্যাদান থেকে জলদান পর্যন্ত কার্যের সঙ্গে মাত্র সম্পর্ক রাখত এবং রক্ষা করতো নিজেদের সমাজ ধর্ম- যে সমাজ ধর্ম শতাব্দীর পর শতাব্দী কোনো শাসকই নষ্ট করতে পারেনি- এমনকি সমাজ বিনষ্ট করে কাউকে লক্ষ্মীছাড়া করে দিতে পারেনি, নিশ্চয়ই সেই সমাজ ধর্মের উপর কোম্পানি শাসকরা এমন কিছু অত্যাচার ও অবিচার চালিয়েছিল- যার ফলে ফকির এবং সন্ন্যাসীরা হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল অস্ত্র। এভাবেই ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রেক্ষপট রচিত হয়েছিল।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ঘটনা
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্ৰোহ খুবই ঘটনাবহুল। বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্যের বিরুদ্ধে অষ্টাদশ শতাব্দীর ষাটের দশকে শুরু হয় এবং নব্বইয়ের দশকে স্তিমিত হয়ে পড়ে। কোম্পানি প্রবর্তিত রেগুলেশন দ্বারা মুসলিম ফকির ও হিন্দু সন্ন্যাসীদের জীবনযাত্রা বিভিন্নভাবে ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হয়। ফকির ও সন্ন্যাসীরা তাদের অনুসারী ও সহমর্মী জনসাধারণের নিকট থেকে দান গ্রহণ করে তার উপর ভিত্তি করেই জীবনধারণ করতেন। কোম্পানি শাসকরা দেশের ধর্মীয় রীতিনীতি ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে মোটেও ওয়াকেবহাল ছিল না; আর সে কারণেই ফকির-সন্ন্যাসীদের দান গ্রহণকে তারা জনসাধারণের নিকট থেকে অননুমোদিত অর্থ আদায় বলে মনে করতো। কাজেই কোম্পানি সরকার ফকির সন্ন্যাসীদের সংগঠিত দল কর্তৃক দান গ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। একই ফলশ্রুতিতে ফকির-সন্ন্যাসীরা ফিরিঙ্গি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে। এই প্রতিরোধ আন্দোলন দেশের কৃষককুলের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লাভ করে, কারণ তারাও কোম্পানি সরকারের নতুন ভূমি রাজস্ব নীতির অধীনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এতে ব্রিটিশ বিরোধী ফকির-সন্ন্যাসী প্রতিরোধ আন্দোলন সর্বাত্মক রূপ লাভ করে ।
বাংলায় আন্দোলনকারী ফকিররা ছিলেন মাজরিয়া সুফি তরিকার অনুসারী। এই সুফি তরিকা সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শাহ সুলতান সুরীয়া বুরহানার নেতৃত্বে বাংলায় প্রসার লাভ করে। সন্ন্যাসীরা ছিলেন বেদান্তীয় হিন্দু যোগী এবং একদণ্ডী সন্ন্যাসবাদের গিরি ও পুরী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ফকির ও সন্ন্যাসীরা যথাক্রমে খানকাহ ও আখড়ায় বাস করতেন। সুফী ফকির ও যোগী সন্ন্যাসীদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও ধর্মাচরণে যথেষ্ট সাদৃশ্য ছিল। এই সাদৃশ্য ও একাত্মতা কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথে সহায়ক হয়েছিল। তাদের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের বহু ঘটনা ঘটেছিল ।
বাংলায় ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সংগঠক ও নেতা ছিলেন মাদারিয়া তরিকার সুফি সাধক মজনু শাহ। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিহার ভিত্তিক মাদারিয়া সুফী তরিকার নেতা হিসেবে শাহ সুলতান হাসান সুরীয়া বুরহানার স্থলাভিষিক্ত হন। বিদ্রোহের নেতৃত্ব দানে তাঁর খলিফা ছিলেন সুফী সাধক মুসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ, পরাগল শাহ, সোবহান শাহ, করিম শাহ প্রমুখ। ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহে সম্পৃক্ত জনৈক ভোজপুরী ব্রাহ্মণ ভবানী পাঠক তখন মজনু শাহের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ছোটখাট জমিদার দেবী চৌধুরানীর সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। তিনি বিদ্রোহী সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব দেন বলেও ধারণা করা হয় ।
১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে বিচ্ছিন্নভাবে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ঘটনা শুরু হয়। ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তা পূর্ণাঙ্গ বিদ্রোহের রূপ নেয় এবং জোরদার হয়ে ওঠে। বিদ্রোহীদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যস্থল ছিল কোম্পানির কুঠি, ফিরিঙ্গি শাসকের অনুগত জমিদারদের কাচারি এবং জমিদারি আমলাদের আবাসস্থল। বিদ্রোহীরা যুদ্ধ তরবারি, বর্শা ও বল্লম, বন্দুক, অগ্নি নিক্ষেপক যন্ত্র, হাওয়াই ও ঘুর্ণায়মান কামান ব্যবহার করতো।
বাংলার ফকিরদের মধ্যে শুধু শাহ ও তাঁর কয়েকজন খলিফা ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করতেন। যুদ্ধের সময় খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী এবং যুদ্ধাস্ত্র ও গোলা বারুদ পরিবহণের জন্য উট ব্যবহার করা হতো। বিদ্রোহীদের আক্রমণের গেরিলা রণ পদ্ধতি কোম্পানির কর্মকর্তাদের অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তোলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদ্রোহীরা কোম্পানির লোকজন এবং তাদের দপ্তর ও আবাসনের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালাত। সুপরিকল্পিত আক্রমণ পরিচালনা ও নির্ধারিত যুদ্ধে কখনও কখনও পাঁচ থেকে ছয় হাজার ফকির-সন্ন্যাসীর সমাবেশ ঘটত। সত্তরের দশকে ফকির ও সন্ন্যাসীদের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজারে উপনীত হয়। গ্রামের সাধারণ লোকেরা বিদ্রোহীদের গুপ্তচররূপে কাজ করতো এবং তারা কোম্পানির সেনাবাহিনীর গতিবিধি পূর্বাহ্নেই বিদ্রোহীদের জানিয়ে দিত ।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহীরা ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে বাকেরগঞ্জে কোম্পানির বাণিজ্য কুঠি আক্রমণ করে। তারা তথাকার কুঠিয়াল ক্যালীকে কয়েকদিন আটক রাখে এবং কুঠি দখল করে নেয়। কুঠির ইংরেজ সুপারভাইজার র‍্যালফ লেস্টার পালিয়ে যান। অবশ্য পরে ক্যাপ্টেন গ্র্যান্ট কুঠি পুনরুদ্ধার করেন। ঐ একই বছর বিদ্রোহীরা রাজশাহীর রামপুর বোয়ালিয়ায় কোম্পানির কুঠি আক্রমণ করে কুঠিয়াল বেনেটকে আটক করে। বন্দি অবস্থায় বেনেটকে পাটনায় পাঠানো হলে সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। ১৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রংপুর, রাজশাহী, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি ও কুমিল্লা জেলায় বিদ্রোহীদের আক্রমণ তীব্রতর হয়ে ওঠে। উত্তরবঙ্গে বিদ্রোহীদের তৎপরতা প্রতিহত করার জন্য ১৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাপ্টেন ম্যাকেঞ্জির অধীনে রংপুরে ইংরেজ বাহিনী প্রেরিত হয়। এই সময় মালদহের ইংরেজ রেসিডেন্ট বারওয়েল কর্তৃক মার্টলের নেতৃত্বে প্রেরিত একটি ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের নিকট পরাজিত হয় এবং সেনাপতি মার্টল নিহত হন। ম্যাকেঞ্জির বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে বিদ্রোহীরা নেপালের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। ১৭৬৮ থেকে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রধানত শরন (বিহার), বেনারস, পুর্নিয়া, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলায় ফকির-সন্ন্যাসীদের আক্রমণ অব্যাহত ছিল। এভাবেই অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন স্থানে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অসংখ্য ঘটনা ঘটে।
অন্যদিকে ফেলথামের অধীনে এক ইংরেজ বাহিনী ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে ঘোড়াঘাট ও রংপুরের গোবিন্দগঞ্জের পথে ফকির-সন্ন্যাসীদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় । বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে পালিয়ে যায়। মজনু শাহ শতাধিক আহত অনুসারী নিয়ে মহাস্থানে ফিরে যান। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে মজনু শাহ রংপুর, রাজশাহী ও বগুড়া জেলায় কোম্পানির বাণিজ্য কেন্দ্র ও আবাসন আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেন। এক সময় তিনি কয়েকশ' সশস্ত্র অনুসারী নিয়ে রাজশাহীতে কোম্পানির রাজস্ব-অফিস কিছুকাল দখল করে রাখেন। তথাকার সংগৃহীত সমুদয় অর্থ তাঁর হস্তগত হয়। ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্রোহীরা পুর্নিয়া, বর্ধমান, কুমারখালি, যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা, মেদিনীপুর, বীরভূম, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও জলপাইগুড়ি এলাকায় ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করে। এসব ঘটনা থেকে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের তীব্রতা অনুধাবন করা যায় ।
এরপর ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুর ও চট্টগ্রাম জেলায় ফকির- সন্ন্যাসীদের আক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করে। ১৭৭৭ থেকে ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ফকির-সন্ন্যাসীদের আক্রমণ প্রধানত বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ এলাকায় পরিচালিত হয়। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহের আলপসিং পরগনার বিদ্রোহীদের তৎপরতা প্রকট আকার ধারণ করে। পুখুরিয়ায় এক তীব্র সংঘর্ষের পর মজনু শাহ তার অনুসারীদের নিয়ে মধুপুর জঙ্গলে পশ্চাদপসরণ করেন। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মহাস্থানগড় অভিমুখে অগ্রসর হন এবং সেখানে এক যুদ্ধে পরাজিত হন। পরের বছর মজনু শাহ পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গে যুগপৎ আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি নিজে পূর্ববঙ্গে আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং উত্তরবঙ্গে অভিযানের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় তাঁর খলিফা মুসা শাহের উপর। কালেশ্বর এলাকায় লেফটেন্যান্ট সেনানের বাহিনীর সঙ্গে এক যুদ্ধে (৮ ডিসেম্বর ১৭৮৬) মজনু শাহের বিপুল সংখ্যক অনুসারী নিহত হন। এরপর থেকে মজনু শাহকে আর কোনো যুদ্ধ পরিচালনা করতে দেখা যায়নি। সম্ভবত কালেশ্বরের যুদ্ধে তিনি নিজে আহত হন। এবং ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে অথবা ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে কোনো এক সময় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের এক ঘটনাবহুল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।

ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের তাৎপর্য


প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দৃশ্যত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক বিদ্রোহগুলোর মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলো ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। আর এ বিদ্রোহকেই বাংলার প্রথম কৃষক বিদ্রোহ বলা যায়। এ বিদ্রোহের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৭৬০-১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। মুঘল শাসনের শেষভাগে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায় স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করে। কালক্রমে এ সন্ন্যাসী ও ফকিরগণ কারিগর ও কৃষকে পরিণত হয়। তারা সবসময় অধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন থাকতো। তবে ফকির ও সন্ন্যাসীগণ আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন থাকলেও অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে এ নিরীহ সাধক সম্প্রদায় তাদের পার্থিব আকাঙ্ক্ষা মিটাতে সুযোগ পায়। তারা নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারের জন্য সংঘবদ্ধভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। ফকিরগণ ছিল সুফি সম্প্রদায়ভুক্ত সাধক। তারা সুফি মতবাদের সাথে হিন্দু যোগীদের ভাবধারা গ্রহণ করে। ফলে, সুফিবাদের সাথে সন্ন্যাসীদের মত লম্বা চুল রাখত, শরীরে ভস্ম মাখত, হাতে ও গলায় লোহার শিকল পরত এবং কালো পাগড়ি ও কালো পতাকা ধারণ করতো। তারা সর্বদা আগুন জ্বালিয়ে বসত এবং খুব ভাঙ খেত । সাধনায় সিদ্ধ ফকিরগণ প্রায় নগ্ন থাকত এবং এ অবস্থায় প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও কাশ্মীর, কাবুল ও অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। কথিত হয়, শাহ মাদার হিন্দুস্থানে যোগী হয়েছিলেন এবং অনেক হিন্দুও তাঁকে ভক্তি করতো। তিনি গোরক্ষপুর জেলার মোখনপুরে আস্তানা পাতেন। মাখনপুর মাদারি ফকিরদের তীর্থক্ষেত্রেও পরিণত হয়। এই ফকির-সন্ন্যাসীরাই ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কলন্দর ফকিরগণও কিছুটা যোগীদের ভাবধারা গ্রহণ করে। উত্তরবঙ্গে এদের খুব প্রভাব পড়ে। দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত বালিয়াদি গ্রামে ফকিরদের আস্তানা ছিল। তারা বুরহানা নামে কথিত এক টুকরা কাপড় পরত বলে ‘বুরহানা ফকির' নামে পরিচিত ছিল। যোগীদের মতো এরাও লম্বা চুল রাখত এবং পায়ে লোহার বলয় পরত । এদের অন্যতম গুরু ছিলেন শাহ সুলতান হাসানি মাদিয়া বুরহানা । শাহজাদা সুজা যখন বাংলার সুবাদার ছিলেন তখন বুরহানা ধর্ম গুরুকে তিনি কয়েকটি বিশেষ অধিকার দান করে সনদ দেন। ফলে বাংলার সর্বত্র বুরহানা ফকিরদের প্রভাব বেড়ে যায়। উরস বা বাৎসরিক উৎসবের সময় তারা পাণ্ডুয়া দিনাজপুর ও মহাস্থান গড়ের দরগার মিলিত হতো। এ সকল ফকিরগণ ভিক্ষা করে বেড়াত। তারা কালক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং জনসাধারণের কাছ থেকে জোরপূর্বক নজরানা আদায় করতে আরম্ভ করে। এভাবে তারা একটি তহবিল গড়ে তোলে । ফকিররা সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে ক্রমেই প্রতিরোধ আন্দোলন জোরদার করে। তাদের সবাত্মক প্রতিরোধ ব্রিটিশদের বিপদে ফেলে দেয়।
অন্যদিকে সন্ন্যাসীরা ছির ভারতের মহান ধর্মীয় দার্শনিক শ্রীশংকরাচার্যের অনুগামী। শংকরাচার্যের অনুগামীরা ১০টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। বিদ্রোহী সন্ন্যাসীরা ছিল ‘গিরী' (Giri) সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন থাকত। তবে কালক্রমে সন্ন্যাসীরাও আধ্যাত্মিক সাধনা থেকে বিচ্যুত হয়ে জাগতিক সুখভোগের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। সন্ন্যাসীদের একটি দল তীর্থক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াত, আরেকদল সন্ন্যাসী মঠে বাস করত। মঠের আবাসিক সন্ন্যাসীগণকে সবকিছু ত্যাগ করে সাধনায় নিয়োজিত থাকার ব্রত গ্রহণ করতে হতো। কিন্তু সন্ন্যাসীদের অনেকে লোভের বশবর্তী হয়ে ব্যবসায় ও সুদের কারবারে লিপ্ত হয় তারা স্বর্ণের কানবালা, হীরকখচিত শিকল এবং স্বর্ণ ও রৌপ্যের বালা পরত। তাদের মঠ প্রাচীর বেষ্টিত ও সুরক্ষিত থাকত। অনেক সময় সন্ন্যাসীরা গুপ্তচরের কাজ করত ও গোপন সংবাদ সরবরাহ করত। মহাস্থান, চিলমারি, সিংজানি (ময়মনসিংহের জামালপুর), লাঙ্গলবন্ধ (নারায়ণগঞ্জ) প্রভৃতি স্থানে তারা বাৎসরিক স্নানোৎসবে মিলিত হতো। এভাবে তারা সংগঠিত হয়ে তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। এতে ব্রিটিশদের টনক নড়ে এবং ফকির-সন্ন্যাসীদের ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করে ।
প্রহসনমূলক পলাশীর যুদ্ধের পর রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে ফকির ও সন্ন্যাসীরা বিদ্রোহী হয় এবং বাংলায় তাদের প্রাধান্য স্থাপনে নিয়োজিত হয়। দরিদ্র কৃষক,
সম্পত্তি ভ্রষ্ট জমিদার ও বেকার সৈন্যদল এদের সাথে যোগ দেয় । ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করতে মীর কাশিম ফকির সন্ন্যাসীদের আহ্বান করেছিলেন এবং তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে বহু ফকির সন্ন্যাসী তাঁর পক্ষে যুদ্ধও করেছিল। যুদ্ধে মীর কাশিম পরাজিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তাতে ফকির সন্ন্যাসীরা ইংরেজ বিরোধী তৎপরতা বন্ধ করেনি। কারণ ইংরেজগণ ফকির সন্ন্যাসীদের অবাধ চলা ফেরায় বাধা প্রদান করে, ভিক্ষা ও মুষ্টি সংগ্রহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, দস্যু বলে আখ্যায়িত করে এবং তাদের শায়েস্তা করার জন্য সরকার জমিদারদের সাহায্য কামনা করে। উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে ফকির সন্ন্যাসীরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ফকিরদলের নেতৃত্ব দেন মজনু শাহ বুরহানা এবং সন্ন্যাসী দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ভবানী পাঠক । ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে সন্ন্যাসীরা বর্ধমান জেলায় প্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এতে ব্রিটিশরা অনুধাবন করে যে, ভারতে সহজে ব্রিটিশ কৰ্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস প্রভৃতি রাজপুরুষরা এ বিদ্রোহকে “হিন্দুস্থানের যাযাবর, পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব” অর্থাৎ “বহিরাগত ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসী ও ফকির দস্যুদের বাংলা আক্রমণ” বলে বর্ণনা করেছেন। যামিনী মোহন ঘোষ ও ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি ও বাংলার বাইরে থেকে আগত নাগা ও ভোজপুরী দস্যু বলে সন্ন্যাসীদের অভিহিত করেছেন। কিন্তু সরকারি, বেসরকারি দলিল থেকে জানা যায় যে, এ বিদ্রোহ ছিল বাংলা ও বিহারের কৃষক শ্রেণির বিদ্রোহ। বিদ্রোহীরা সকল স্থানেই ভূমিহীন, নিরন্ন কৃষকদের সমর্থন পায়। বিদ্রোহীরা কেবলমাত্র জমিদার মহাজনদের গৃহ লুটপাট করে, ইংরেজের রাজকোষ লুট করে, কৃষকদের উপর কোনো উৎপীড়ন করেনি। উইলিয়াম হান্টারই সর্বপ্রথম সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ বলেন। তিনি এ বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের শ্রেণি বিচার করে বলেন যে, বিদ্রোহী সন্ন্যাসীদের দলে ছিলেন, (১) মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙনের ফলে বেকার সেনাগণ; (২) ভূমিহীন দ্ররিদ্র কৃষক শ্রেণি; (৩) সন্ন্যাসী ও ফকিরদের বিভিন্ন সম্প্রদায় যারা কৃষিকার্য করে জীবিকানির্বাহ করত। এ সন্ন্যাসী বিদ্রোহীদের সংখ্যা এক সময় ৫০ হাজারে পৌঁছায়। হান্টার যে বেকার মুঘল সেনার কথা বলেছেন তারাও ছিল বাংলা বিহারের কৃষক সন্তান। অন্নবস্ত্রের জন্য তারা বিদ্রোহের ধ্বজা তোলে। এ বিদ্রোহীরা অনেকে সন্ন্যাসী ও ফকিরের বেশ নেয়। এঁরা ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বদেশকে মুক্ত করার ব্রত নেন । এটি ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের গুরুত্ব বা তাৎপর্য প্রমাণ করে ।
বাংলার বিভিন্ন স্থানে ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহীরা সশস্ত্র দলে সংগঠিত হয়ে ইংরেজ বণিকদের কুঠি, কাচারী এবং দেশীয় জমিদার ও ধনীদের উপর আক্রমণ চালায়। উইলিয়াম হান্টারের মতে, এ কৃষক কারিগর, ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহে উৎসাহিত হয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর বেকার ও বুভুক্ষ সৈন্যগণও ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল। ওম্যালের মতে, বিদ্রোহীদের সংখ্যা এক সময় পঞ্চাশ হাজারে উন্নীত হয়েছিল। ফকির মজনুশাহ বুরহানা ও ভবানী পাঠক ছাড়াও এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন মুসাশাহ, চেরাগ আলী শাহ, সোবহান শাহ, করিম শাহ, মাদার বক্স, নুরুল মোহাম্মদ, দেবী চৌধুরানী, কৃপানাথ, রামানন্দ গোসাঁই, পৃতাম্বর, অনপ নারায়ণ, শ্রীনিবাস প্রমুখ ফকির-সন্ন্যাসী ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ। এদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে বাংলায় ব্রিটিশ কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ।
এরপর ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমান জেলার 'সন্ন্যাসীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। বিদ্রোহী ফকিরগণ ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে বাকেরগঞ্জ এবং ঢাকার ইংরেজ কুঠি আক্রমণ ও দখল করে নেয়। ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মার্চ মাসে বিদ্রোহীরা রাজশাহী জেলার রামপুর বোয়ালিয়ার ইংরেজ কুঠি আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে এবং কুঠির পরিচালক বেনেট সাহেবকে বন্দি করে পাটনায় নিয়ে হত্যা করে। ১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ অক্টোবর বিদ্রোহী বাহিনী ক্যাপ্টেন রেনেল ও মরিসনের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করে কুচবিহার দিনহাটা এলাকায় তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্রোহীরা পাটনার আশপাশে ইংরেজ সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে এবং ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নেপালের সীমান্তে মোরাং অঞ্চলে সেনাপতি কিথের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়। কিথ এ যুদ্ধে নিহত হন। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে 'মহাদুর্ভিক্ষ' বা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের' ফলে ক্ষুধার জ্বালায় এ দেশের হতভাগ্য কৃষকরা বিদ্রোহী ফকির সন্ন্যাসীদের সাথে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে যোগদান করে। ফলে ১৭৭০-৭২ খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র বাংলা ও বিহার এক মহাবিদ্রোহের রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এরূপ সর্বাত্মক প্রতিরোধের ফলে ব্রিটিশরা দিশেহারা হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে ১৭৭০-৭১ খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে রংপুর দিনাজপুর ফকির মজনুশাহ বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ সময় বিদ্রোহের মূল কেন্দ্রস্থল ছিল পাটনা ও উত্তরবঙ্গের মহাস্থানগড়। ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে বিদ্রোহীদের প্রধান কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয় উত্তরবঙ্গের বংপুর জেলা। এখান থেকে বিদ্রোহীরা দিনাজপুর ও বগুড়া অঞ্চলে জমিদারদের কাচারী ও ইংরেজদের নীল কুঠিগুলো লুণ্ঠন করতে থাকে। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ ডিসেম্বর বিদ্রোহীরা রংপুর শহরের নিকটবর্তী শ্যামপুরে ইংরেজ সেনাপতি টমাসকে এবং ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ ময়মনসিংহ জেলার মধুপুরের জঙ্গলে বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড ও মেজর ডগলাস ৩০০ জন সৈন্য নিহত হয়। ওয়ারেন হেস্টিংস এদের দমনের জন্য ভুটানের সাহায্যসহ প্রার্থনা করেন এবং হেস্টিংসের অনুরোধে কাশিয়ব রাজা চৈৎ সিং সন্ন্যাসীদের দমনের জন্য ৫০০ অশ্বারোহী সৈন্য পাঠান। ক্যাপ্টেন ক্রক একদল পদাতিক সৈন্য নিয়ে সন্ন্যাসীদের দমনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কয়েক বছর পর্যন্ত সন্ন্যাসীদের এ উপদ্রব চলে। পরে তারা বাংলা-বিহার ত্যাগ করে মহারাষ্ট্রের দিকে চলে যায়। কিন্তু ফকির-সন্ন্যাসীদের এরূপ ভয়াবই আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড ব্রিটিশদের বিপদে ফেলে দেয়।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের 'দেবী চৌধুরানী' নামক উপন্যাসে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের এক মনোজ্ঞ বিবরণ আছে। এ উপন্যাসের দস্যুসর্দার ভবানী পাঠকের নাম সুপরিচিত। মজনু শাহের সাথে ভবানী পাঠকের যোগযোগ ছিল। রংপুর, রাজশাহী ও বগুড়া জেলার জঙ্গলে ভবানী পাঠকের কর্মস্থল ছিল। গভীর জঙ্গলে তাঁর অনুচরগণ সুরক্ষিত আশ্রয়স্থল নির্মাণ করেছিল। সেখান হতে তারা বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করত। রংপুর, বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলাগুলোতে সাধারণত তাদের লুটতরাজ চলত। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ভবানী পাঠকের অনুচরগণ কয়েক জন সওদাগরের কয়েকটি তামাক বোঝাই নৌকা লুট করে। এর পর সরকার ভবানী পাঠকের বিরুদ্ধে লেফটেনান্ট ব্রেনারের অধীনে একদল সৈন্য পাঠায়। অনেক অনুসন্ধানের পর সৈন্যগণ ভবানী পাঠকের খোঁজ পায়। ভবানী পাঠক তখন ৬০ জন অনুচরসহ নৌকায় ছিলেন। সৈন্যগণ হঠাৎ তাদেরকে আক্রমণ করে। যুদ্ধে ভবানী পাঠক ও তাঁর দুজন সহকারী নিহত হন, ৮ জন আহত হয় এবং ৪২ জন বন্দি হয়। ভবানী পাঠক বাজপুরের অধিবাসী ছিলেন। লেফটেনান্ট ব্রেনারের রিপোর্ট হতে দেবী চৌধুরানী নাম্নী একজন মহিলা দস্যুসর্দারের সম্বন্ধে জানা যায়। দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠকের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। দেবী চৌধুরানী নৌকায় থাকতেন এবং বেতন ভোগী বহু অনুচর রাখতেন। তাঁর অনুচরগণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থাকত। তিনি ডাকাতি করতেন। ভবানী পাঠকের ডাকাতির অর্থ সামগ্রীতেও তাঁর অংশ ছিল। লেফটেনান্ট ব্রেনার নিজে দেবী চৌধুরানীকে দেখেন নি, তিনি তাঁর সম্বন্ধে শুনেছেন। ব্রেনার মনে করেন যে, ‘চৌধুরানী' উপাধি হতে বুঝা যায় যে, দেবী চৌধুরানী একজন জমিদার ছিলেন। তিনি অবশ্যই সুন্দরী ছিলেন। বঙ্কিমের ‘দেবী চৌধুরানী' উপন্যাস দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠককে বাংলাদেশে অমর করে রেখেছেন। কিন্তু বঙ্কিমের এ লেখায় ব্রিটিশ মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে। ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশপ্রেমিক ফকির-সন্ন্যাসীদের ভূমিকা খর্ব করা হয়েছিল।
গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ফকির সন্ন্যাসীদের দমনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ঐ বছর কোম্পানির সৈন্যবাহিনীর সাথে মজনু শাহের কয়েকবার সংঘর্ষ হয়। কিন্তু তাঁকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা কোম্পানির পক্ষে সম্ভব হয়নি। মজনু শাহের রণকৌশল ছিল অতর্কিত আক্রমণ ও নিরাপদে পলায়ন। ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর বগুড়া জেলার কালেশ্বর নামক স্থানে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে মজনু শাহ আহত হন এবং ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বিনা চিকিৎসায় প্রাণত্যাগ করেন। তাঁর অনেক সহকারী ছিল। তাদের নাম ছিল চেরাগ আলী শাহ, পরাগল শাহ, সোবহান শাহ, মাদার বখশ, জরিশাহ, করিম শাহ ও রওশন শাহ। মজনু শাহের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই মুসা শাহ ফকিরদের নেতা হন এবং তাঁর নেতৃত্বে ফকিরগণ রংপুর ও দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজ কুঠিও কাচারিতে আক্রমণ করে। কিন্তু মজনু শাহের মৃত্যুর পর থেকেই ফকিরদের মধ্যে দলীয় কোন্দল শুরু হয়। অপর দিকে ইংরেজদের সৈন্যবাহিনী বৃদ্ধি পেতে থাকলে ফকিরগণ ইংরেজদের কাছে বিভিন্ন স্থানে পরাজিত হতে তাকে। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ফকিরেরা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। ফকির মজনু শাহ বাঙালি ছিলেন না এবং ফকিরদের অপারেশনে স্থানীয় জনগণেরও খুব একটা সহযোগিতা ছিল না। ফকিরেরা পরাজিত হলেও তাদের প্রদর্শিত সংগ্রামী পথ অনুসরণ করে বহু সংগ্রামী ও দেশপ্রেমিকের রক্তাক্ত আন্দোলনের ফলে ১৯৪৭ খ্রি. ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে।
বাংলার বিভিন্ন স্থানে ফকির ও সন্ন্যাসীরা পৃথক পৃথক ভাবে তাদের অভিযান চালাত। প্রায়ই তারা পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে হেনরিলজ লেখেন, ময়মনসিংহে ফকির ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে একটি সংঘর্ষ হয়। এতে সন্ন্যাসীরা পরাজিত হয় এবং কোনো কোনো সন্ন্যাসী ফকিরদের দলে যোগ দেয়। ফকির ও সন্ন্যাসীরা নিজ নিজ স্বার্থের খাতিরে ব্রিটিদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। দেশ রক্ষা বা জাতীয়দতাবাদ তাদের লক্ষ্য ছিল না। সাধারণ মানুষের সাথে তাদের অবাধে মেলামেশার সুযোগ ছিল না। দেশের সাধারণ মানুষ ফকির সন্ন্যাসীদের ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপে কখনও যোগ দেয়নি। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক শোষনের ফলে বাংলা বিহারের কৃষকরা যখন বিপর্যস্ত, সে সময় ইংরেজদের শোষণ হতে তাদের রক্ষার জন্য সন্ন্যাসী ও ফকিরদের আবির্ভাব ঘটে। তাদের অসফলতার প্রধান কারণ হলো অভিজ্ঞতা, যোগাযোগ ও নেতৃত্বের অভাব। এ ভিন্ন ধর্মীয় ভেদাভেদও তাদের অসফলতার অপর কারণ। তথাপি ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ও সমাজব্যবস্থাকে বাংলার কৃষক শ্রেণি ও গ্রামীণ মানুষ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে পারেনি। তারাও সংগ্রামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এভাবে ব্রিটিশ বিরোধী সবাত্মক আন্দোলন গড়ে ওঠে। সুতরাং ব্রিটিশ বিরোধী ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
ফকির-সন্ন্যাসীদের প্রভাব
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ফকির-সন্ন্যাসীদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ফকির ও সন্ন্যাসীগণ আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন থাকলেও অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে এই নিরীহ সাধক সম্প্রদায় তাদের প্রার্থিব আকাঙ্ক্ষা মিটাতে সুযোগ পায়। তারা নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারের জন্য সংঘবদ্ধ ভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। ফকিরগণ ছিল সুফি সম্প্রদায়ভুক্ত সাধক। তারা সুফি মতবাদের সঙ্গে হিন্দু যোগীদের ভাবধারা গ্রহণ করে । ফলে, সুফিবাদের সঙ্গে সন্ন্যাসীদের যোগ প্রক্রিয়ার সমন্বয় ঘটে। মাদারি সম্প্রদায়ের ফকিরদের মধ্যে এই মিশ্র মরমিবাদ প্রসার লাভ করে। মহসিন ফানির 'দাবিস্তান' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মাদারি ফকিরগণ অবধৃত সন্ন্যাসীদের মত লম্বা চুল রাখত, শরীরে ভস্ম মাখত, হাতে ও গলায় লোহার শিকল পরত এবং কালো পাগড়ি ও কালো পতাকা ধারণ করত। তারা সর্বদা আগুন জ্বালিয়ে বসত এবং খুব ভাঙ খেত। সাধনায় সিদ্ধ ফকিরগণ প্রায় নগ্ন থাকত এবং এই অবস্থায় প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও কাশ্মীর, কাবুল ও অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। কথিত হয়, শাহ মাদার হিন্দুস্থানে যোগী হয়েছিলেন এবং অনেক হিন্দুও তাঁকে ভক্তি করত। তিনি গোরক্ষপুর জেলার মাখনপুর আস্তানা পাতেন। মাখনপুর মাদারি ফকিরদের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়। এখান থেকেই ফকিরেরা তাদের প্রভাব বিস্তার করে এবং বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
অপরদিকে কলন্দর ফকিরগণও কিছুটা যোগীদের ভাবধারা গ্রহণ করে। উত্তরবঙ্গে এদের খুব প্রভাব পড়ে। দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত বালিয়াদি গ্রামে ফকিরদের আস্তানা ছিল। তারা বুরহানা নামে কথিত এক টুকরা কাপড় পরত বলে ‘বুরহানা ফকির' নামে পরিচিত ছিল। যোগীদের মত এরাও লম্বা চুল রাখত এবং পায়ে লোহার বলয় পরত। এদের অন্যতম গুরু ছিলেন শাহ সুলতান হাসানি মাদিয়া বুরহানা। শাহজাদা সুজা যখন বাংলার সুবাদার ছিলেন তখন বুরহানা ধর্ম গুরুকে তিনি কয়েকটি বিশেষ অধিকার দান করে সনদ দেন। ফলে বুরহানা ফকিরদের প্রভাব বেড়ে যায়। উরস বা বাৎসরিক উৎসবের সময় তারা পাওয়া দিনাজপুর ও মাহস্থান গড়ের দরগায় মিলিত হতো। এই সকল ফকিরগণ ভিক্ষা করে বেড়াত। তারা কালক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং জনসাধারণের কাছ থেকে জোরপূর্বক নযরানা আদায় করতে আরম্ভ করে। অপরদিকে সন্ন্যাসীরাও আধ্যাত্মিক সাধনা থেকে বিচ্যুত হয়ে জাগতিক সুখভোগের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। সন্ন্যাসীদের একটি দল তীর্থক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াত, আরেকদল সন্ন্যাসী মঠে বাস করত। মঠের আবাসিক সন্ন্যাসীগণকে সবকিছু ত্যাগ করে সাধনায় নিয়োজিত থাকার ব্রত গ্রহণ করতে হতো। কিন্তু সন্ন্যাসীদের অনেকে লোভের বশবর্তী হয়ে ব্যবসায় ও সুদের কারবারে লিপ্ত হয়। তারা স্বর্ণের কানবালা, হীরকখচিত শিকল এবং স্বর্ণ ও রৌপ্যের বালা পরত। তাদের মঠ প্রাচীর বেষ্টিত ও সুরক্ষিত থাকত। অনেক সময় সন্ন্যাসীরা গুপ্তচরের কাজ করত ও গোপন সংবাদ সরবরাহ করত। মহাস্থান, চিলমারি, সিংহজানি (ময়মনসিংহের জামালপুর), লাঙ্গল বন্দ (নারায়ণগঞ্জ) প্রভৃতি স্থানে তারা বাৎসরিক স্নানোৎসবে মিলিত হতো। এসময় তারা নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় করতো। ফকির-সন্ন্যাসীরা ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করে । ক্রমেই তারা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।
অবিভক্ত বাংলায় অষ্টাদশ শতকের রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবেশে ফকির- সন্ন্যাসীদের সামরিক কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। দরিদ্র কৃষক, সম্পত্তি-ভ্ৰষ্ট জমিদার ও বেকার সৈন্যদল এদের সঙ্গে যোগ দেয়। ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে মীর কাশিম ফকির-সন্ন্যাসীদের আহ্বান করেছিলেন এবং তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে বহু ফকির- সন্ন্যাসী তাঁর পক্ষে যুদ্ধও করেছিল। যুদ্ধে মীর কাশিম পরাজিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তাতে ফকির-সন্ন্যাসীরা ইংরেজ বিরোধী তৎপরতা বন্ধ করেনি। কারণ ইংরেজরা ফকির-সন্ন্যাসীদের অবাধ চলা ফেরায় বাধা প্রদান করে, ভিক্ষা ও মুষ্টি সংগ্রহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, দস্যু বলে আখ্যায়িত করে এবং তাদের শায়েস্তা করার জন্য সরকার জমিদারদের সাহায্য কামনা করে। উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে ফকির-সন্ন্যাসীরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ফকিরদলের নেতৃত্ব দেন মজনু শাহ বুরহানা এবং সন্ন্যাসী দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ভবানী পাঠক। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে সন্ন্যাসীগণ বর্ধমান জেলায় প্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এভাবে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ফকির-সন্ন্যাসীরা নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে এবং কোম্পানি সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দমন
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দমন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ফকিরগণ বরিশালে ইংরেজ কোম্পানির কুঠির উপর হামলা করে। কিন্তু তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়। রবার্ট ক্লাইভের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ফকিরেরা ইংরেজদের ঢাকা কুঠি আক্রমণ করে এবং তারা কুঠি দখল করে লুণ্ঠন করে। ইংরেজগণ পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। পরে ইংরেজগণ শক্তিবৃদ্ধি করে ফকিরদেরকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে কুঠি পুনরুদ্ধার করে। একই বছর সন্ন্যাসীরা রাজশাহীতে কোম্পানির ফ্যাক্টরি আক্রমণ করে লুণ্ঠন করে। তারা (ফক্টরির অধিকর্তা মিঃ বেনেটকে ধরে নিয়ে যায় এবং পাটনায় নিয়ে পরে হত্যা করে। ফকির ও সন্ন্যাসীরা উত্তর বাংলা ছেয়ে ফেলে। ফকির সন্ন্যাসীদের কার্যকলাপে ভাতঙ্কিত হয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস তাদের দমনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং ফলশ্রুতিতে মজনু শাহের সঙ্গে ১৭৬৭ ও ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানির সৈন্যদের কয়েকটি সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ইংরেজ সৈন্যাধ্যক্ষ মার্টল ও লেফটেন্যান্ট কিথ সহ বহু সৈন্য নিহত হয়। এই সাফল্যে ফকির ও সন্ন্যাসীদের সাহস আরও বেড়ে যায়। ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে ফকির মজনু শাহ সমগ্র উত্তর-বাংলাব্যাপী এক বড় রকমের ব্রিটিশ বিরোধী তৎপরতা আরম্ভ করেন। তাঁকে দমন করার জন্য দিনাজপুর ও রংপুরে অতিরিক্ত ব্রিটিশ সৈন্য ও সিপাহী পাঠান হয়। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে ফকির মজনু শাহ দু হাজার সৈন্য নিয়ে রাজশাহী আক্রমণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে ফকিরগণ বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় লুটতরাজ চালাতে থাকে। মধুপুর জঙ্গলে ফকিরদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। জমিদারগণ তাদের আক্রমণের ভয়ে সৰ্বদা সন্ত্রস্ত থাকতেন। সন্ন্যাসীরাও এক এক অঞ্চলে উপস্থি হয়ে গৃহস্থদের নিকট অর্থ দাবি করত এবং তা না পেলে লুটপাট করত। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে সন্ন্যাসীরা রংপুরে সিপাহিদের যুদ্ধে পরাস্ত করে এবং তাদের নায়ক ক্যাপ্টেন টমাসকেও হত্যা করে। এতে উৎসাহিত হয়ে সন্ন্যাসীরা নানা দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চল আক্রমণ করে। প্রতি দলে একজন নায়কের অধীনে প্রায় পাঁচ সাত হাজার নাগা সন্ন্যাসী ও অন্যান্যরা থাকত। ফলে ব্রিটিশ সরকার ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
ফকির-সন্ন্যাসীদের দমনের জন্য ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস ও সার্জেন্ট মেজর ডগলাস ৩০০ সৈন্য নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন, কিন্তু পরাস্ত হয়ে উভয়েই নিহত হন। এদের দমনের জন্য হেস্টিংস ভূটানের সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং হেস্টিংসের অনুরোধে কাশিম রাজা চৈৎ সিং সন্ন্যাসীদের দমনের জন্য পাঁচশ অশ্বারোহী সৈন্য পাঠান। ক্যাপ্টেন ব্রুক একদল পদাতিক সৈন্য নিয়ে সন্ন্যাসীদের দমনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কয়েক বছর পর্যন্ত সন্ন্যাসীদের এই উপদ্রব চলে। পরে তারা বাংলা বিহার ত্যাগ করে মহারাষ্ট্রের দিকে চলে যায়। এতে বাংলায় ফকির-সন্ন্যাসীদের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার ফকির-সন্ন্যাসীদের দমনের জন্য আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফকির-সন্ন্যাসীরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করে। ভারতীয়দের দৃষ্টিতে ফকির-সন্ন্যাসীরা দেশপ্রেমিক বিদ্রোহী। কিন্তু ফকির- সন্ন্যাসীদেরকে দস্যু বা ডাকাত বলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিহিত করে, যা খুবই বিতর্কিত ‘দেবী চৌধুরানী' নামক উপন্যাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের এক মনোজ্ঞ বিবরণ আছে। বাংলায় সন্ন্যাসী বিদ্রোহের বিখ্যাত নায়ক ও নায়িকা-ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীর নাম পাওয়া যায়। ভবানী পাঠক বাঙালি ছিলেন না। বাজপুর তাঁর জন্মস্থান । তিনি মূলত একজন দস্যু সরদার ছিলেন। লেফটেন্যান্ট ব্রেনারের রিপোর্ট থেকে দেবী চৌধুরানী নামক দস্যু সর্দারের কথা জানা যায়। ভবানী পাঠকের সঙ্গে দেবী চৌধুরানীর যোগাযোগ ছিল। দেবী চৌধুরানী নৌকায় থাকতেন এবং বেতনভোগী বহু অনুচর রাখতেন। তাঁর অনুচরগণ অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত থাকত। তিনি ডাকাতি করতেন। ভবানী পাঠকের ডাকাতিতেও তাঁর অংশ থাকত। দেবী চৌধুরানী সম্ভবত বাঙালি ছিলেন। ব্রেনারের মতে, চৌধুরানী উপাধি থেকে বুঝা যায়, দেবী চৌধুরানী একজন জমিদার ছিলেন। তিনি অবশ্যই সুন্দরী ছিলেন। তবে ব্রিটিশ সরকার তাদেরকে কঠোরহস্তে দমন করেন।
গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ফকির-সন্ন্যাসীদের দমনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ঐ বছর কোম্পানির সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে মজনু শাহের কয়েকবার সংঘর্ষ হয়। কিন্তু তাঁকে চূড়ান্ত ভাবে পরাজতি করা কোম্পানির পক্ষে সম্ভব হয়নি। মজনু শাহের রণকৌশল ছিল অতর্কিত আক্রমণ ও নিরাপদে পলায়ন। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ফকির মজনু শাহ প্রাণ ত্যাগ করেন। তাঁর অনেক সহকারী ছিল। তাদের নাম ছিল চেরাগ আলী শাহ, পরাগল শাহ, সোবাহান শাহ, মাদার বখশ, জরিশাহ, করিম শাহ ও রওশন শাহ। মজনু শাহের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই মুসা শাহ ফকিরদের নেতা হন এবং তাঁর নেতৃত্বে ফকিরগণ রংপুর ও দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করে। কিন্তু মজনু শাহের মৃত্যুর পর থেকেই ফকিরদের মধ্যে দলীয় কোন্দল শুরু হয়। অপরদিকে ইংরেজদের সৈন্যবাহিনী বৃদ্ধি পেতে থাকলে ফকিরগণ ইংরেজদের কাছে বিভিন্ন স্থানে পরাজিত হতে থাকে। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ফকিরেরা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। ফকির মজনু শাহ বাঙালি ছিলেন না এবং ফকিরদের অপারেশনে স্থানীয় জনগণেরও খুব একটা সহযোগিতা ছিল না। ফলে ব্রিটিশ সরকার ফকির-সন্ন্যাসীদের দমন করতে সক্ষম হয়।
বাংলার বিভিন্ন স্থানে ফকির ও সন্ন্যাসীরা পৃথক পৃথক ভাবে তাদের অভিযান চালাত। প্রায়ই তারা পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে হেনরিলজ লেখেন, ময়মনসিংহে ফকির ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে একটি সংঘর্ষ হয়। এতে সন্ন্যাসীগণ পরাজিত হয় এবং কোনো কোনো সন্ন্যাসী ফকিরদের দলে যোগ দেয়। ফকির ও সন্ন্যাসীরা নিজ নিজ স্বার্থের খাতিরে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়েছিল। “দেশরক্ষা বা জাতীয়তাবাদ তাদের লক্ষ্য ছিল না। তারা বনজঙ্গলে তাদের আস্তানা গাড়তো। তাই সাধারণ মানুষের সাথে তাদের অবাধ যোগাযোগের সুযোগ ছিল না। দেশের সাধারণ মানুষ ফকির-সন্ন্যাসীদের ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপে কখনো যোগ দেয়নি। ফলে ব্রিটিশ সরকার তাদেরকে সহজে দমন করেন।
ময়মনসিংহ অঞ্চলে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ব্যাপকতা এবং জেলা স্থাপনের মাধ্যমে দমন
১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধ-প্রহসনের পর বঙ্গ-ভারত সুদীর্ঘকালের জন্য বিদেশি ঔপনিবেশিক আধিপত্যের আগ্রাসনে পতিত হয়। এর মাত্র ৩ বছরের মাথায় ঔপনিবেশিক শক্তির নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠে। এরও তিন বছর পর ঐ ঔপনিবেশিক শক্তির নিপীড়নের বিরুদ্ধে ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম কৃষক বিদ্রোহরূপে দেখা দেয় ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। বিদেশী শাসন-শোষণ এবং তাদের পৃষ্ঠপোষিত জমিদার- জোতদারদের অমানবিক জুলুমের প্রতিবাদেই ঐ বিদ্রোহের সূচনা হয়। একই সাথে প্রাকৃতিক ও বৃটিশ সৃষ্ট ১১৭৬ বঙ্গাব্দের মন্বন্তর, ফকিরদের লাখেরাজ ভূসম্পত্তি ভোগ এবং বাংলার সুবাহদারের প্রদত্ত স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার বাধাগ্রস্ত করার কারণও সহযোগী অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। সংসার বিরাগী মাদারী ফকির মজনু শাহর নেতৃত্বে এ ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। তার সাথে যোগ দিয়েছিল অধিকার বঞ্চিত অন্যান্য ফকির ও জমিদার-তালুকদার শোষিত কৃষককুল ।
বগুড়া জেলার কড়াই গ্রামের জমিািদর শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী ময়মনসিংহ পরগনা ও জাফরশাহী পরগনায় ধনসম্পত্তি ক্রয় করে এখানেও জমিদারির পত্তন করেন। এই জমিদার ও তাঁর বংশধরদের ভোগবিলাস এবং অতিরিক্ত অর্থ আয় করার প্রবণতার দরুণ এই পরগনাগুলোর রায়তেরা শোষিত ও অত্যাচারিত হতে থাকে। প্রতিকারহীন জুলুমের স্বীকার প্রজাবর্গ যখন শোষণমুক্তির জন্য হাঁসফাঁস করছিল, সেসময় ময়মনসিংহ ও জাফরশাহী পরগনায় আগমন ঘটে সংসারবিরাগী ফকিরদের। ফকির নেতা মজনু শাহ শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীকে পত্র পাঠিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়ার দাবি করেন। দাবিকৃত অর্থ পরিশোধে কোনো রকমের গাফলতি করতেও নিষেধ করা হয়। শ্রীকৃষ্ণ এ ধরনের হুমকিতে ভীত হয়ে প্রতিবেশী প্রজাদের সাহায্যে রাতারাতি একটি খাল খনন করে পার্শ্ববর্তী নাগর নদীর সাথে সংযোগ সাধন করে জাফরশাহী পরগনার নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যান। ঐ পরগণার তদীয় আশ্রয়স্থল কৃষ্ণপুর ও মালঞ্চা গ্রামদ্বয়ে স্থায়ী বাসস্থান তৈরি করেন ।
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সমসাময়িক আরেক জমিদার ছিলেন শ্রীকৃষ্ণঅ আচার্য। তিনি বগুড়া জেলার টেপা ঝাকৈড়ের গ্রাম থেকে আলেপশাহী পরগণা পর্যন্ত অনেক ভূসম্পত্তি খরিদ করেন। ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে ফকির সন্ন্যাসীরা জাফরশাহী ও আলেপশাহী পরগণায় প্রবেশ করে প্রজাদের উৎপাদিত জমিদারদের প্রাপ্য শস্য লুট করে নেয়। জমিদারি আয় বৃদ্ধির অন্যতম এ খাত আক্রান্ত হওয়ায় এর প্রতিকারার্থে স্থানীয় জমিদারগণ ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি ব্রিটিশ রেভিনিউ বোর্ডে আবেদন জানান। সে আবেদনের প্রেক্ষিতে রেভিনিউ বোর্ড ১৪ ফেব্রুয়ারি জমিদারদের নিরাপত্তাদানে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করার জন্য ঢাকা কুঠি প্রধানকে নির্দেশ প্রদান করে। নির্দেশ পেয়ে কুঠিপ্রধান আক্রান্ত জাফরশাহী অভিমুখে একটি সৈন্যদল প্রেরণ করে। কিন্তু তারা ফকিরদের না পেয়ে বিফল হয়ে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করে। ফকিরগণ পরের মার্চ মাসেই মালঞ্চার কাচারি লুট করে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধিও ভবিষ্যৎ খুব সুবিধার নয় ভেবে ঐ পরগণার ইজারাদার রামজীমাল ফকিরদের উৎপাত থেকে রেহাই পেতে পুনরায় রেভিনিউ বোর্ডের নিকট আবেদন জানান। তাঁর এ আবেদনের প্রেক্ষিতে রেভিনিউ বোর্ড বেলুহার (ভুলুয়া বা বর্তমানের বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা) রেসিডেন্টকে নাসিরাবাদ (পরবর্তীকালের ময়মনসিংহ) অঞ্চলে নতুন জেলা স্থাপনের নির্দেশ দেণ। এরই মাঝে ফকিরগণ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিভিন্ন জমিদারি কাচারিতে ফের লুটপাট শুরু করে। জাফরশাহী, আলেপশাহী, মোমেনশাহী ও শেরপুরের জমিদারগণ ফকিরদের উৎপাত থেকে রেহাই পেতে রেভিনিউ বোর্ডে প্রার্থনা করেন। বোর্ড ব্রিটিশ কর্মকর্তা হেনরি লজকে ফকিরদের দমনে ময়মনসিংহে প্রেরণ করে।
হেনরি লজ ব্রহ্মপুত্র তীরে অবস্থিত বেগুনবাড়ি কুঠিতে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি বেগুনবাড়ি কুঠিতে পৌঁছেই জমিদার ও ফকিরদের নিজ নিজ অভিপ্রায় জানাতে ঘোষণা জারি করেন। জমিদাররা নির্দিষ্ট তারিখে কুঠিতে এসে ফকির উপদ্রব বিষয়ে জানালেও কোনো ফকির সেখানে উপস্থিত হয়নি। লজ ফকিরদের অনুপস্থিতির কথা উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে মতামত দিয়ে রেভিনিউ বোর্ডে রিপোর্ট করেন ।
১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মজনু শাহ তাঁর দলবল নিয়ে ময়মনসিংহের সন্নিহিত জাফরশাহী পরগণায় পুনরায় হাজির হন। মজনু শাহ তখন বেশিরভাগ সময় ব্রহ্মপুত্রর বুকে নৌকায় অবস্থান করতেন, আর সময় ও সুযোগ বুঝে জমিদারি কাচারি লুট করতেন। ময়মনসিংহের মজনু শাহর পুনঃউপস্থিতির সংবাদে বাংলার সেই সময়কার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সংক্ষুব্ধ হন। জাফরশাহীতে মজনু শাহর জমিদারবিরোধী তৎপরতা প্রতিহত করতে হেনরি লজের নেতৃত্বে একদল ব্রিটিশ সৈন্য তাঁর পিছু ধাওয়া করে। ফকির নেতা মজনু পরিস্থিতি টের পেয়ে রংপুরের চিলমারী হয়ে বিহারে চলে যান। কিছুদিনের ব্যবধানে মজনু শাহর অনুসারী ও অন্যতম ফকির নেতা শাহ মুজাররাদ জাফরশাহীতে এসে জমিদারদের রাজস্ব কাচারি লুট করতে থাকেন। এতে ভীত হয়ে হেনরি লজ আরও সৈন্য পাঠাতে রেভিনিউ বোর্ডকে অনুরোধ জানান। হেনরি লজের প্রার্থনানুসারে রেভিনিউ বোর্ড নিজেদের আপত্তি সত্ত্বেও লজকে সহযোগিতা করতে ঢাকার ফ্যাক্টরি চিফকে নির্দেশ দেয়। ফকির উৎপাত দমনে প্রার্থিত অতিরিক্ত সৈনিক প্রাপ্তির অপেক্ষায় না থেকে লজ তাঁর সীমিত সিপাহিদের নিয়েই প্রতিরোধযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এর লড়াইয়ে শাহ মুজাররাদ তাঁর দলবলসহ গড়ারণ্যে আত্মগোপন করেন। লজ ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় অতিরিক্ত সৈন্য সরবরাহের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে পুনরাবেদন জানান। সেমতে স্যার প্যাট্রিক বেলফোরের নেতৃত্বে ফোর্থ রেজিমেন্টের ৫০ জন সৈনিক ময়মনসিংহে প্রেরিত হয় ।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দমনের জন্য ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জামালপুর সদরে একটি ব্রিটিশ সেনানিবাস স্থাপিত হয়। জামালপুর সদরের যেখানে ইংরেজ ক্যান্টনমেন্ট স্থাপিত হয়েছিল সে স্থানটি এখনো ‘পল্টন' নামে লোকমুখে পরিচিত ।
১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ডানকানসন ফকির-সন্ন্যাসীদের দমনে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে রংপুরে যান। তাঁর তৎপরতায় শাহ মুজাররাদ পূর্ববাংলা থেকে অন্যত্র সরে যান। তাঁর অবর্তমানে ময়মনসিংহের মধুপুরে জয়সিংগীর এবং শেরপুরে ভূপালগীর সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের আগমনে এই অঞ্চলের সামন্ত ভূস্বামীদের মনে ফের আতঙ্ক উপস্থিত হয়। প্রতিকারার্থে স্থানীয় ভূম্যাধিকারীগণ রেভিনিউ বোর্ডে আবারো আবেদন জানান । ফকির-সন্ন্যাসীদের দমনের উদ্দেশ্য সামনে রেখে অবশেষে ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল ময়মনসিংহ জেলার কার্যক্রম শুরু করা হয় এবং বেলুহার কালেক্টর উইলিয়াম রটন নবসৃষ্ট জেলা ময়মনসিংহের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ৷
ময়মনসিংহে নতুন প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার পর লজের নেতৃত্বাধীন সৈন্যদল ও জমিদারদের বরকন্দাজদের সম্মিলিত অভিযানে ভূপালগীর পরাজয় মেনে নেন। পরাজয় মেনে ভূপালগীর সন্ন্যাসী শেরপুর জমিদারদের সাথে আপস-মীমাংসা করে তাঁর পুরানো তৎপরতা পরিহার করে শেরপুর এলাকা ছেড়ে চলে যান। আর মধুপুরে তখনো জয়সিংগীরের দল লুটপাট তৎপরতায় সক্রিয় থাকেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন জেলা কালেক্টর স্টিফেন বেয়ার্ড একদল সৈন্য পাঠিয়ে জয়সিংগীরকে গ্রেফতার করেন। বিচারে জয়সিংগীরকে ফাঁসি দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর থেকে মধুপুর অঞ্চলে সন্ত্রাসী তৎপরতার অবসান ঘটে।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সার্বিক বিশ্লেষণ
পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭ খ্রি.) মাধ্যমে বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। মুঘল রাজত্বের ধ্বংসস্তূপের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন। নতুন শাসনের চাহিদা মোতাবেক পরিবর্তত হয় দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো, শাসনতন্ত্র ও ক্ষমতাবিন্যাস। এ প্রক্রিয়ার পর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র গঠন করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়া যেভাবে দৃষ্ট হয় ঠিক সেভাবে এর ইতিহাস তৈরি করার প্রয়াস কঠিন। এই সব পরিবর্তনে দেশবাসীর প্রতিক্রিয়া কী ছিল? দেশবাসী কী ঐ সব পরিবর্তনে ব্রিটিশ আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছিল? যদি করে থাকে তবে এর বৈশিষ্ট্য ও ব্যাপ্তি কি ছিল? এই সব প্রশ্নের উত্তর এত দিন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান করা হয়নি। এর কারণ হলো ইতিহাসচর্চা দীর্ঘদিন ছিল ইউরোপীয় সিভিলিয়ান নির্ভর। পরবর্তীতে পেশাগত এদেশীয় ঐতিহাসচর্চা দীর্ঘদিন ছিল ইউরোপীয় সিভিলিয়ান নির্ভর।
পরবর্তীতে পেশাগত এদেশীয় ঐতিহাসিকগণও এ ব্যাপারে অবহেলার আশ্রয় নিতে কার্পণ্য করেননি। আধুনিক গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায় যে, দেশবাসী (কৃষকশ্রেণি-সমকালীন রাজনৈতিক পরিবেশে সম্পূর্ণ উদাসীন বা নির্লিপ্ত ছিল না। প্রয়োজনে সরকারি নীতির প্রতিরোধ এমনকি সশস্ত্র সংগ্রামে পর্যন্ত লিপ্ত হতে তারা দ্বিধা করেনি। বাংলার ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহী (১৭৬৩-১৮০০ খ্রি.) এর অন্যতম প্রমাণ ।
অষ্টাদশ শতক বাংলার ইতিহাসে এক যুগসন্ধিক্ষণ। এ শতকে মহান মুঘল সাম্রাজ্যের মানসিক বিপর্যয়, ইংরেজদের দেওয়ানি গ্রহণ (১৭৬৫ খ্রি.) ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৭০ খ্রি.) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩ খ্রি.) ইত্যাদি ঘটনা সৃষ্টি হয়। বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার সূচনা পর্বে
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ। বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রসূত অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক উৎপীড়নের বিরুদ্ধে যে ফকির ও সন্ন্যাসীরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, তাদের পরিচয় নিয়ে যেমন সংশয় সৃষ্টি হয়েছে তেমনি এটি কৃষক বিদ্ৰোহ ছিল কিনা তা নিয়েও মত পার্থক্য বিদ্যমান ।
বাংলার ফকিরগণ ছিলেন সুফি সম্প্রদায়ের মাদারীয়া শ্রেণিভুক্ত এবং এই শ্রেণির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সিরিয়া হতে আগত সূফী সাধক বদি উদ্দীন শাহ-ই-মাদার। শাহ মাদারের সূফী মতবাদ বাংলায় প্রসার লাভ করেছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশে এই সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শাহ সুলতান হাসান সুরিয়া বুরহানা । সম্রাট শাহ জাহান-পুত্র সুবাদার শাহ সুজা ১৬৫৮ খ্রি. বাংলায় মাদারীয়া সূফী নেতা শাহ সুলতান হাসান সুরিয়া বুরহানাকে বিশেষ অধিকার সংবলিত একখানা সনদ দিয়েছিলেন। এই সনদে উল্লিখিত অধিকারসমূহের প্রকৃতি ও চরিত্র এই মাদারীয়া সূফী সম্প্রদায়ের প্রবল প্রভাবও প্রতিপত্তির কথা প্রমাণ করে। দিনাজপুর জেলার হেমতাবাদ থানায় হাসান শাহ সুরিয়ার আধিপত্য বিস্তার সম্পর্কে কিংবদন্তি রয়েছে। এই সূফী ফকিরদের অস্তিত্ব প্রাচীন সূফীবাদ ও হিন্দুযোগী আচার-আচরণের মিশ্রণের মধ্যে নিহিত ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলার ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মজনু শাহ বুরহানা। জনাব এম. এম. হক অবশ্য মজনুর বুরহানা হবার দাবি নাকচ করে দিয়েছেন ।
অন্যদিকে সন্ন্যাসীরা ছিলেন বৈদান্তিক হিন্দু-যোগী। অষ্টম শতকে বেদান্ত দার্শনিক শনকরাচার্য দশনামী সন্যাসবাদের প্রবর্তন ঘটান। এদের বিভিন্ন শাখা ছিল। সূফী ফকিরদের মত সন্ন্যাসীরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ শাখা অনুযায়ী তাদের নামের শেষে ‘গিরী’ বা ‘পুরী' উপাধি ধারণ করতেন। সন্ন্যাসীদের অবস্থান ও জীবিকা নির্বাহের প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সরকারি বিবরণীতে রয়েছে। সমসাময়িক উৎসসমূহে এবং সরকারি দলিল দস্তা-বেজে আচরণগত ও প্রকৃতিগত কারণে ফকির ও সন্ন্যাসীদের এক করে দেখানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের কেবল মাত্র ‘ফকির’ অথবা ‘সন্ন্যাসী' নামে অভিহিত করা হয়েছে। এর কারণ ছিল এদের আচরণগত সাদৃশ্য ।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে সূফীবাদ ভারতে হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে এক সেতুবন্ধন রচনা করে। কেননা বেদান্ত দর্শন ও সূফীবাদের মধ্যে তত্ত্বগণ সাদৃশ্যের জন্য হিন্দু-মুসলমান সাধকেরা একে অভিন্ন হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এই ফকির ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল খুবই প্রকট যা তাদের ঐক্যের ভিত্তিমূল প্রতিষ্ঠা করে। সুতরাং কোনো কোনো ঐতিহাসিক হিন্দু ও মুসলমান ফকিরের আচার-আচরণ এবং ভক্তি ও বিশ্বাসে যে পার্থক্য টানার চেষ্টা করেছেন তা যথার্থ নহে। প্রকৃতপক্ষে ফকির ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর বৈশিষ্ট্য তথা ধর্মীয় ও সামাজিক সম্মিলনের প্রভাব ।
সন্ন্যাসীদের অবস্থান ও বসবাস সম্পর্কে যামিনী মোহন ঘোষ বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন এবং সরকারি বিবরণীতেও ফকির-সন্ন্যাসীদের বাংলায় স্থায়ী অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। ফলে রমেশ চন্দ্র মজুমদারের বক্তব্য সঠিক নয় যে, বিহার ও মধ্য
প্রদেশ হতে আগত একদল নাগা সন্ন্যাসী উত্তর বঙ্গের নানা স্থানে লুটতরাজ করে ফিরত। এ বক্তব্য গ্রহণ করলে ধরে নিতে হয় ফকির-সন্ন্যাসীরা ছিল যাযাবর শ্রেণির। প্রকৃতপক্ষে সন্ন্যাসীদের মধ্যে কেউ কেউ মহাজনি ব্যবসায় করতেন। আবার কেউ কেউ ধর্মীয় আখড়া রক্ষণাবেক্ষণ ও ভিক্ষা বৃত্তির (মুষ্টি ভিক্ষা) মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করতেন।
অন্যদিকে ফকিরদের সম্পর্কে জানা যায় যে, রংপুর জেলায় বহু সংখ্যক মাদারীয়া সূফী স্থানীয় কৃষক-অধিবাসী হিসেবে বাস করতেন এবং তাদের মধ্যে কারো কারো আচরণ ছিল হিন্দু সন্ন্যাসীদের মতো। এছাড়া ফকিরদের একাংশই ছিল বিবাহিত এবং কিছু লাখেরাজ সম্পত্তির মালিক ।
ফকির-সন্ন্যাসীরা ছিলেন হিন্দু-মুসলমান ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটি দল। তাই সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত যে, ফকির-সন্ন্যাসীগণ ছিলেন বাংলারই অধিবাসী ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে তাদের জীবন শুরু হলেও কালক্রমে তাদের জীবন পদ্ধতি স্বাভাবিক ও স্থায়ী বসতি লাভ করে। ধর্মের অনুশাসনের দিক হতে ফকির-সন্ন্যাসীদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও উভয়ের মধ্যে কালক্রমে আদর্শগত ও সংস্কৃতিগত ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ধর্মীয় ও সামাজিক অভিযোগসমূহ ফকির-সন্ন্যাসীদের মধ্যে মিলনের সাধারণ ক্ষেত্র তৈরি করে (উভয় সম্প্রাদায় একক সংগঠনে পরিণত হন)।
জনাব মুহাম্মদ আবু তালিব মনে করেন যে, লাখেরাজ সম্পত্তির বাজেয়াপ্তির সরকারি সিদ্ধান্ত ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহী করে তোলে। তবে এই কারণটি ১৭৯৩ খ্রি. পূর্বে খুব জোরালো কারণ ছিল বলে মনে হয় না। তা ছাড়া মুঘল সরকার মদদ-ই মাস, ব্রহ্মেত্তর, দেবোত্তর ও পীরপাল প্রভৃতি লাখেরাজ প্রদান করতেন। কিন্তু সেখানে বাংলার প্রত্যেক ফকির যে তার অধিকারী ছিলেন এমন প্রমাণও বিরল ।
বাংলার ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিল ১৭৬৩ খ্রি. হতেই । প্রকৃতপক্ষে বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার শুরুতেই ফকির-সন্ন্যাসীদের মুক্ত ও স্বাধীন গতিবিধিও কার্যকলাপে বাধা আরোপিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে ব্যাহত হতে থাকে ফকির-সন্ন্যাসীদের ধর্মাধিষ্ঠানে যাতায়াতের অবাধ স্বাধীনতা। ধর্মস্থান বা তীর্থস্থান পরিদর্শন ভারত উপমহাদেশের একটি অতি প্রাচীন সামাজিক ও আত্মিক অধিকার। হিন্দু সন্ন্যাসীদের কুম্ভ মেলায় যোগদান, গঙ্গা ও করতোয়ায় স্নান, অশোক অষ্টমীতে ব্রহ্ম নদে স্নান এবং বগুড়ার বারুণী উৎসবে যোগদান ছিল পবিত্র ধর্মীয় কর্তব্য। অন্যদিকে পূর্ণিয়ার নেক সর্দারের দরগা, দিনাজপুরের পীর বদর উদ্দিনের মাজার, মালদহের আদিনা মসজিদ, সৈয়দ মখদুম জালাল-তাবরিজির দরগা, সিলেটে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার, বগুড়ার মহাস্থানগড় ও কানপুরর মাজার জিয়ারত ইত্যাদি ছির ফকিরদের পুণ্যকর্মের অন্তর্ভুক্ত। কোম্পানির কর্মচারীগণ ফকির- সন্ন্যাসীদের এই সকল তীর্থ স্থান পরিদর্শনের বিষয় সন্দেহের চোখে দেখতেন। সরকারি জরিপকর্মের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব মেজর জেমস রেনেল (১৭৭৭ খ্রি.) মহাস্থান দরগা পর্যবেক্ষণ করে মন্তব্য করেন যে, এই সমস্ত দরগা ছিল প্রকারান্তরে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের কেন্দ্রস্থল। সম্ভবত কোম্পানির বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের সশস্ত্র বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে এই সমস্ত তীর্থস্থান পরবর্তীকালে অস্ত্র লেনদেনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, ফকির-সন্ন্যাসীরা প্রতি বছর তীর্থ গমনের উদ্দেশ্যে ভারত ও বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে ভ্রমণ করেন ।
১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে ফকির নেতা মজনু শাহ নাটোরের রাণী ভাবানীকে এক চিঠিতে জানান যে, ইংরেজ কোম্পানি তাদের তীর্থ যাত্রাতে বাধা দিচ্ছে। এ আবেদন ফকির- সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ব্রিটিশ বিরোধী চরিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং মজনু শাহ-এর নেতৃত্ব প্রকাশ পায়। ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন মজনু শাহ। পূর্বেই বলা হয়েছে যে মজনু শাহ ছিলেন মাদারীয়া সুফী সম্প্রদায়ের নেতা। ফকির- সন্ন্যাসীদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা এবং তার অপ্রতিহত নেতৃত্বের প্রতি কোম্পানি সরকারের চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হয়েছেন এরূপ ধারণা এখন প্রমাণিত।
বাংলার ইতিহাসে বিভিন্ন প্রকৃতির আন্দোলনে ধর্মীয় নেতাদের নেতৃত্ব প্রদানের উদাহরণ সর্বজনবিদিত। প্রকৃত পক্ষে কোম্পানি প্রশাসন প্রথমে ফকির-সন্ন্যাসীদের তীর্থযাত্রায় বাধা দেয় এবং পরে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই নিষেধাজ্ঞা সুদৃঢ় করে । ফকির-সন্ন্যাসীরা এ ব্যবস্থাকে ধর্মীয় ও সামাজিক অত্যাচার বলে মনে করত। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পর এই ধর্মীয় ও সামাজিক অত্যাচারের সাথে যুক্ত হয় ফকির-সন্ন্যাসীদের অর্থনৈতিক অভিযোগের। চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী ফকির- সন্ন্যাসীরা ভিক্ষা বৃত্তির (মুষ্টি সংগ্রহ) মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং কালক্রমে তা অধিকারে পরিণত হয়। বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পর একদিকে রাজস্ব আদায়ে অত্যাচার এবং অন্যদিকে দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির ফলে পল্লি জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। এরই ফলে ফকির-সন্ন্যাসীরা দু'দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হন। ক) সাধারণ হিন্দু-মুসলমান জনগণ বিভিন্ন দরগা, মাজার ও হিন্দুদের তীর্থ স্থান পরিদর্শন শেষে কিছু অর্থকরী দান করতেন। কিন্তু ব্রিটিশ নীতিতে সে সামর্থ জনগণ হারিয়ে ফেলে এবং খ) আর্থিক দৈনতার কারণে পল্লি অঞ্চলের কৃষকের মুষ্টি ভিক্ষা প্রদানের ক্ষমতা হ্রাস পায় যা থেকে ফকির-সন্ন্যাসীদের নিয়মিত আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। এ পরিস্থিতির জন্য ফকির-সন্ন্যাসীরা সরকার ও জমিদারদেরকে দায়ী করেন। তারা জমিদার ও সরকারের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেন। এ ব্যাপারে আবাসিক ফকিরেরা জমিদারদের কাছ থেকে তাদের দাবিদাওয়া আদায়ে অধিকতর তৎপর হয়ে উঠেন ফকির-সন্ন্যাসীরা ছিল এমন একটি শক্তি যার বিরোধিতার লক্ষ ছিল স্থানীয় অভিজাতশ্রেণি ও ঔপনিবেশক শক্তি উভয়ই ।
আঠারো শতকের শেষে উত্তরবঙ্গে অনেক পরস্পর বিরোধী শক্তি ছিল। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এদের একটি। সব মিলে গঠন করে একটি জটিল ও অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা। কৃষি উৎপাদনের উপর দাবি ছিল কৃষক, জমিদার, রাষ্ট্র, আমলাশ্রেণি, ফকির-সন্ন্যাসীদের এবং ঐ দাবির মধ্যে নিহিত ছিল তথাকার রাজনৈতিক অস্থিরতার বীজ। দিনাজপুরের তৎকালীন কালেক্টর হ্যাচ স্বীকার করেছেন যে, নিম্নশ্রেণির রায়তদের অবলুপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে ফকির-সন্ন্যাসীদের দাবি অগ্রাহ্য হয়। প্রতিবাদস্বরূপ তারা জমিদারদের বাড়ি, কাচারি ও কোম্পানির কুঠি আক্রমণ করে। এসময় ফকির-সন্ন্যাসী-বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয় নিঃস্ব কৃষক, তাঁতি, পতিত জমিদার ও মুঘল সরকারের বেকার সৈন্যদল। প্রকৃতপক্ষে বেকার সৈন্যদল ও ভূমিহীর কৃষক জীবিকানির্বাহের শেষ উপায় হিসেবে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে যোগদান করেছিল।
১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শুরু হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (১৭৭০ খ্রি.) পূর্বে এই আক্রমণের তীব্রতা তেমন ব্যাপক না হলেও দুর্ভিক্ষের পরে উদ্ভূত মারাত্মক অর্থনৈতিক দুরবস্থায় ফকির-সন্ন্যাসীদের আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় । উল্লেখ যে কোম্পানির কুঠি, জমিদারদের কাছারি ও নায়েব গোমস্তার বাড়ি আক্রমণ ছাড়াও কোম্পানির সহযোগী এদেশীয় প্রতিনিধিরাও ছিলেন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু । ফকির-সন্ন্যাসীদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল তরবারী, বর্শা, গাদাবন্দুক ও লাঠি ইত্যাদি ।
ফকিরদের মধ্যে কেবল মাত্র মজনু শাহ সহ কয়েকজন নেতা ঘোড়ায় চড়তেন, যা ছিল বিদ্রোহীদলের নেতৃত্বের প্রতীক। দলের সর্দারদেরকে ‘হাকিম' বা ‘শাসনকর্তা’ বলে অভিহিত করা হতো ।
আকস্মাৎ আক্রমণে কোম্পানি সৈন্যদলকে বিব্রত করা ছিল ফকির-সন্ন্যাসীদের রণকৌশলের একটি প্রধান অংশ। কোম্পানির সৈন্যদলের সাথে যুদ্ধে পরাজয় ঘটলে যুদ্ধের শেষে অথবা ফকির-সন্ন্যাসীগণ বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে দ্রুত ঐ অঞ্চল ত্যাগ করতেন। মজনু শাহ প্রয়োজন না হলে কোম্পানির সৈন্যদলের সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলতেন।
ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহী তৎপরতা পরিচালনার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সংগঠন ও সমাবেশ ইত্যাদি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তাদের বিদ্রোহের গতিপ্রকৃতি, দীর্ঘকালীন বিদ্রোহাত্মক তৎপরতা, তাদের পরিকল্পনা, সমাবেশ ও তৎপরতা সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে সুদৃঢ় করে ।
কোম্পানির সৈন্যদল সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য ফকির-সন্ন্যাসীদের গুপ্তচর ছিলেন গ্রামের সাধারণ মানুষ। ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ফকির- সন্ন্যাসীদের সশস্ত্র বিদ্রোহ সম্প্রসারিত হয়েছিল ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ ও পুর্ণিয়া জেলায়। তবে সমগ্র উত্তরবঙ্গ ছিল ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মূলকেন্দ্র। এই আন্দোলনের তীব্রতা এতই বেশি ছিল যে কোম্পানিকে বাংলার প্রতিটি জেলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হয়েছিল।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন মজনু শাহ ও ভবানী পাঠক। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে কানপুর জেলার মাখনপুরে মজনু শাহের মৃত্যু হলে পরবর্তীকালে মুসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ ও পরাগল শাহ প্রমুখ বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম বাখেরগঞ্জে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কুঠি ফকির-সন্ন্যাসীরা কর্তৃক আক্রান্ত হয় এবং সন্ন্যাসীরা তথাকার ফ্যাক্টরি প্রধান কেলীকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। একই বছর ফকিরগণ ঢাকার ফ্যাক্টরি আক্রমণ করে তা দখল করেন। এই আক্রমণের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে ঢাকার ফ্যাক্টরি প্রধান লেস্টার কর্মস্থল ত্যাগ করে পালিয়ে যান। শেষে ক্যাপ্টেন গ্রান্ট ফকিরদের হাত থেকে ঢাকা ফ্যাক্টরিকে পুনরুদ্ধার করেন। এক বছর সন্ন্যাসীগণ রাজশাহীর রামপুরের বোয়ালিয়ায় কোম্পানির ফ্যাক্টরি প্রধান বেনেটকে হত্যা করেন ।
উত্তরবঙ্গে ফকির-সন্ন্যাসী তৎপরতা প্রতিহত করার জন্য ১৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাপ্টেন ডি. ম্যাকেঞ্জিকে প্রেরণ করা হয়। এসময় সন্ন্যাসীরা মালদহের রেসিডেন্ট বারওয়েল কর্তৃক প্রেরিত এজেন্ট মার্টেলকে হত্যা করেন। ক্যাপ্টেন ডি. ম্যাকেঞ্জির এই সন্ন্যাসী দলের বিরুদ্ধে অভিযানের ফলে সন্ন্যাসীদল নেপালের দিকে পালিয়ে যায় ।
১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় দুর্ভিক্ষ পরবর্তী পরিস্থিতিতে দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়ায় ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের তীব্রতা লক্ষ করা যায়। ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ক্যাপ্টেন জেমস রেনেল ছিলেন পাবনা অঞ্চলে জরিপের কাজে নিয়োজিত। তিনি পাবনার সিরাজগঞ্জের নিকটস্থ বেলকুচি হতে জানান যে, ফকিরগণ সংখ্যায় অনেক এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ এই জেলার বিভিন্ন স্থানে সমবেত হচ্ছে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এই তথ্য অবগত হয়ে রাজশাহী ও দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে সৈন্য মোতায়েন করেন। ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে লেফটেন্যান্ট ফেলথামের নেতৃত্বে একদল সৈন্য ঘোড়াঘাট ও গোবিন্দগঞ্জের পথে ফকির-সন্ন্যাসীদের আক্রমণ করেন। হঠাৎ আক্রমণে ফকির-সন্ন্যাসীরা পরাজিত হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে পলায়ন করেন। এ সময় অশ্বপৃষ্ঠে মজনু শাহ শতাধিক নিরস্ত্র ও আহত অনুসারী নিয়ে মহাস্থানগড়ের দিকে অগ্রসর হন। এই ঘটনার পর মহাস্থানগড় এলাকায় স্থায়ীভাবে কোম্পানির সৈন্য মোতায়েনের প্রয়োজন হয়। রাজশাহী জেলায় ফকির-সন্ন্যাসীদের তৎপরতার প্রচণ্ডতা লক্ষ্য করা যায় ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে, যখন মজনু শাহ সশস্ত্র অনুচর নিয়ে উত্তরবঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত । রাজশাহীতে অবস্থানরত কোম্পানির আদায়কৃত খাজনার অর্থ লুট করে নিয়ে যায়, এমনকি তাদের পক্ষে পরগণার কাচারি দখল করে রাখাও অসম্ভব ছিল না। নাটোরে অবস্থানরত কোম্পানির সুপারভাইজারের পত্রানুযায়ী ফকিরদল ছিল তলোয়ার, বর্শা, বন্দুক ও কামানে সজ্জিত। এ বক্তব্য কিছুটা অতি রঞ্জিত। কেননা কামানের ব্যবহার ফকিরদের পক্ষে অকল্পনীয় মনে হয়। একই বছর রংপুরে সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহাত্মক তৎপরতার তথ্য প্রদান করেন রংপুরের সুপারভাইজার পার্লিং, যিনি এই ঘটনার কয়েক মাস পরই সন্ন্যাসীদের হাতে নিহত হন। ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় উত্তরবঙ্গের বগুড়া, রাজশাহী ও দিনাজপুরে ফকির-সন্ন্যাসী তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। এসময় বগুড়া জেলায় কোম্পানির সুপারভাইজার নিযুক্ত হয়ে আসেন গ্লাডউইল। তিনি ফকির-সন্ন্যাসীদের আক্রমণ প্রতিহ করার জন্য এই অঞ্চলে কোম্পানির সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। কিন্তু কোম্পানির পক্ষ হতে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত লেফটেন্যান্ট রবার্টসনের নেতৃত্বে কোম্পানি একদল সৈন্য প্রেরণ করে, যাদের সাথে ফকির-সন্ন্যাসীদের তীব্র সংঘর্ষ সংগঠিত হয়।
ময়মনসিংহের আলাপসিংহ পরগণায় ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে। এসময় পুখরিয়া নামক স্থানে মজনু শাহের সাথে কোম্পানির সৈন্যদলের সংঘর্ষ হয় এবং পরাজিত মজনু শাহ তার অনুসারীদের নিয়ে মধুপুর জঙ্গলে আশ্রয় নেন। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মজনু শাহ পুনরায় মহাস্থাগড়ের দিকে অগ্রসর ইন। এ সময় কোম্পানির সৈন্য দলের সাথে যুদ্ধে তার পরাজয় ঘটে। পরবর্তী বছর ফকিররা স্বতন্ত্র দুটি দলে বিভক্ত হয়ে আক্রমণাত্মক তৎপরতায় লিপ্ত হন। মজনু শাহ ময়মনসিংহ জেলা সংলগ্ন অঞ্চলে এবং মুসা শাহ উত্তরবঙ্গে কোম্পানি বিরোধী তৎপরতা শুরু করেন। এই দ্বিমুখী আক্রমণের কারণ ছিল সম্ভবত কোম্পানির শক্তি ও ক্ষমতাকে বিচ্ছিন্ন করে অতিমাত্রায় ব্যস্ত করে তোলা। ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে মজনু শাহের সাথে কোম্পানির সৈন্যদলের পরপর দুটি মারাত্মক সংঘর্ষ হয়। এ সময় লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের সাথে কালেশ্বর এলাকায় সংঘর্ষে মজনু শাহ তাঁর বহু সংখ্যক অনুসারীকে হারান। পরবর্তীতে মজনু শাহ নিজে কোনো অভিযান পরিচালনা করেননি। সম্ভবত ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে কানপুর জেলার মাখনপুরে মজনু শাহ মৃত্যুবরণ করেন। মজনু শাহের উত্তরাধিকারিগণ ছিলেন মুসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ, পরাগল শাহ, সোবাহান শাহ, মাদার বক্স, জরি শাহ, করিম শাহ প্রমুখ যারা অনেকেই ছিলেন মজনু শাহের আত্মীয়। ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের পুরোধা মজনু শাহ মারা যাবার পরও তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরিগণ পুরো আঠারো শতক পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। তবে ক্রমশ এই আন্দোলনের গতি স্তিমিত হয়ে পড়ে ।
এই আলোচনার পর একটা প্রশ্ন ওঠা সংগত যে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের উদ্দেশ্য কি ছিল? এটি অত্যন্ত জটিল প্রশ্ন। ফকির-সন্ন্যাসীদের অভিযোগ ছিল প্রথমত; অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়ন। কিন্তু এই উৎপীড়নের অবসানকল্পে তারা যে বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করেন সেখানে একটি সম্ভাব্য উদ্দেশ্য হতে পারে কোম্পানির শাসনের অবসান। তবে সমসাময়িক উৎসসমূহে এমনকি রানী ভবানীর নিকট লিখিত মজনু শাহের চিঠিতেও এই বিদ্রোহের উদ্দেশ্য অনুপস্থিত। কোম্পানির শাসন তারা চায় না। কিন্তু পূর্ববর্তী শাসন ব্যবস্থা বলবৎ বা নতুন কোনো শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন সম্পর্কে তাদের কোনো স্পষ্ট বক্তব্য নেই। অর্থাৎ সমকালীন রংপুর কৃষক বিদ্রোহের (১৭৮৩) মতো এই বিদ্রোহের বক্তব্য সুস্পষ্ট নয়। একে কেবল মাত্র কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে একটি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের পর এই বিদ্রোহ ক্রমান্বয়ে স্তিমিত হয়ে পড়ে। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পরিচালিত এই আন্দোলনে বাংলার অধিকাংশ অঞ্চলেই ছিল ফকির-সন্ন্যাসীদের তৎপরতা। বাংলা ব্যতীত বিহারেও তাদের আক্রমণাত্মক তৎপরতা সম্প্রসারিত হয়েছিল। বাংলাতে ফকির- সন্ন্যাসী আন্দোলন দীর্ঘ সময়ের ব্যাপ্তিতে এবং প্রায় সমগ্র অঞ্চল জুড়ে প্রসার লাভ করেছিল ।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে বাংলার একটি শ্রেণি বিরোধিতা করেছিল, যারা ছিলেন মূলত যুগান্তর যুগের উঠতি পুঁজিপতি। প্রকৃতপক্ষে তখন বাংলায় কান্তবাবু, দেবিসিংহ, গোবিন্দ সিংহ, রামকান্তা রায়, দুলাল রায় ও জয় নারায়ণ ঘোষালের মতো বেনিয়া ও মুতসুদ্দির অভাব ছিল না এবং ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল এই শ্রেণির স্বার্থের বিরুদ্ধে । কেননা কোম্পানির শাসন ও শোষণ তাদের স্বার্থের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক ছিল ।
অন্যদিকে এই বিদ্রোহে কতিপয় জমিদার ও তাদের কর্মচারীদের সাহায্য দানের প্রমাণও বিরল নয়। ফকির-সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকারী সেনাধ্যক্ষ প্রায়ই তাদের কর্ম তৎপরতায় জমিদার অসহযোগিতা সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত অভিযোগ উত্থাপন করতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগস্ট নতুন আইন প্রণীত হয়, যাতে জমিদারদের করণীয় সম্পর্কে নতুনভাবে নির্দেশ প্রদান করা হয় । কিন্তু এই রেগুলেশনটি যে সম্পূর্ণরূপে কার্যকরি হয়নি, তা কোম্পানির কর্মচারীদের সংশয় ও অন্যান্য বক্তব্য হতে স্পষ্ট ভাবেই প্রমাণিত হয়। জমিদারশ্রেণি ব্যতীত ফকির-সন্ন্যাসীগণ স্থানীয় জনগনের সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করেন। দিনাজপুরের তৎকারীন কালেক্টর লিখেছেন যে, গ্রামবাসরীরা বিপদের সময় ফকির- সন্ন্যাসীদের আশ্রয় প্রদান করে। তারা এই তৎপরতা হতে বিরত না হলে ফকির- সন্ন্যাসীদের আক্রমণ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব হবেনা। ফকির-সন্ন্যাসীদের সাথে গ্রামবাসীদের একান্ত হয়ে যাবার তথ্য যেমন কৌতূহলোদ্দীপক তেমনি এই তথ্য নিঃসন্দেহে এই বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করে । এদেশের বৃহত্তর সমাজে ফকির-সন্ন্যাসী একটি সম্প্রদায়, দেশের চরম আর্থিক দুর্দশা ও শাসনের যাতাকলে ফকির-সন্ন্যাসীদের স্বার্থ ও তাদের বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্যের সাথে সাধারণ জনগণের স্বার্থ ও উদ্দেশ্য অভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে নিয়োজিত বিক্ষুব্ধ সৈন্যদলের সাথে সাধারণ জনগণের অংশগ্রণের বিষয়টি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক ।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ফকির বা সন্ন্যাসীরা কখনও এককভাবে এবং কখনও যৌথভাবে অথবা কখনও উভয়দলই কোনো উল্লেখযোগ্য নেতা ছাড়াই বিদ্রোহ পরিচালনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এর কারণ ছিল তাদের মধ্যকার আদর্শগত ঐক্য। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। কোনো কোনো গবেষক একে দুস্য, ‘ডাকাত’ বা ‘দুষ্কৃতিকারী'দের তৎপরতা হিসেবে অভিহিত করেছেন। আবার কোনো কোনো লেখক ও গবেষক এই বিদ্রোহকে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত বলে মনে করেছেন। যারা একে ‘ডাকাত' ও ‘দুষ্কৃতিকারী’দের তৎপরতার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, তারা নির্বিচারে সরকারি নথিপত্রের উপর নির্ভর করেছেন। ফলে সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে তাদের বক্তব্য মিশে-গিয়েছে। অন্যদিকে যারা ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রণী ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা করতে চান, তারা কোম্পানির দলিলপত্রে উল্লেখিত ‘ডাকাত' ও ‘দুষ্কৃতিকারী’ ইত্যাদি শব্দের সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। দলিলপত্রে উল্লিখিত বিভিন্ন শব্দের সঠিক অর্থের জন্য স্বনির্বাচিত শব্দ গ্রহণ করেছেন এবং গবেষকদেরকে দলিল উল্টানোর পরামর্শ দিয়েছেন যা বিপজ্জনক। প্রকৃতপক্ষে ফকির-সন্ন্যাসীগণ তাদের পেশাগত স্বার্থ ও আর্থসামাজিক সুবিধা সংরক্ষণের জন্যই সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল । দেশ রক্ষা বা জাতীয়তাবাদ তাদের লক্ষ ছিল না ।
১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই সশস্ত্র বিদ্রোহ অব্যাহত ছিল । আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় যে মুহূর্তে গ্রামীণ কাঠামো ভেঙে পড়েছিল যখন কৃষক সমাজ সম্মুখীন হয়েছিল এক অজ্ঞাত শত্রুর, যাদের শক্তি ছিল অপ্রতিরোধ্য তখন বাংলার ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন ছিল কোম্পানির উপরোক্ত নির্বিচার শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ। ফকির-সন্ন্যাসীদের শক্তিশালী সংগঠনের অভাব, ধর্মীয় ভেদাভেদ, অনভিজ্ঞতা, উন্নত চেতনাবোধের অভাব এবং অন্যান্য শ্রেণির অসহযোগিতা এবং পরবর্তীকালে নেতৃত্বের অভাবে তাদের বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে । তবে ইংরেজ কোম্পানি সরকারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলার জনগণের বিভিন্ন অংশের এই বিদ্রোহের গুরুত্ব অপরিসীম। এই বিদ্রোহ ছিল পরাধীন বাংলার পরবর্তী সকল কৃষক বিদ্রোহের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ও গৌরবময় প্রেরণার উৎস। সমকালীন রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.) এবং পরবর্তীতে ১৮২৪-৩৩ সালের ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সাক্ষাৎ প্রভাব পড়েছিল।
থেকেই বাংলায় স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলন ও কৃষক
উত্তর : ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই।
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কেন প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে?
উত্তর : ঔপনিবেশিক ভূমিব্যবস্থা, ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ, জোর করে ধানের জমিতে নীল চাষে কৃষকদের বাধ্য করা ইত্যাদি কারণে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে ।
কবে থেকে এদেশের সর্বক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব পড়তে থাকে?
উত্তর : ১৭৫৭ খ্রি. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে বাংলার নবাবের পরাজয়ের পর থেকে ।
বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ কোনোটি ?
উত্তর : ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ ।
কত সময় ধরে ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ চলে ? উত্তর : ১৭৬৩-১৮০০ খ্রি. পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে। ফকিরেরা কোন শ্রেণিভূক্ত ছিল?
উত্তর : সুফি সম্প্রদায়ের মাদারিয়া শ্রেণিভুক্ত।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]