ইতিহাসকে বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনায় সৃষ্ট বিতর্ক আলোচনা করে ।

উত্তর ভূমিকা : ইতিহাস ও বিজ্ঞান দুটি ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের বিষয় হলেও এদের মধ্যকার সম্পর্ক সম্পূর্ণ পৃথক নয় । এদের একটি বিষয়ের সাথে অন্য বিষয়ের যেমন কমবেশি সাদৃশ্য রয়েছে তেমনি রয়েছে বৈসাদৃশ্য। ইতিহাস বিজ্ঞান থেকে কীভাবে বিষয়বস্তুর মসলা পায় অথবা বিজ্ঞান থেকে ইতিহাস কতটুকু উপকৃত হয় এ ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন । তবে এ বিষেয় বিভিন্ন শ্রেণির পণ্ডিতগোষ্ঠীর মধ্যে কেউ কেউ ইতিহাসকে বিজ্ঞান হিসেবে মানে আবার কেউ কেউ ইতিহাসকে কলা বা সমাজবিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করে । তাই ইতিহাসকে শুধু বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করলে বিতর্কের অবকাশ থেকে যায় ।
ইতিহাস বিজ্ঞান না বিজ্ঞানের অংশ : নিম্নে ইতিহাস বিজ্ঞান না বিজ্ঞানের অংশ সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো : ক. ইতিহাস বিজ্ঞান হওয়ার পক্ষে অভিমত : ইতিহাস ও বিজ্ঞান দুটি ভিন্ন আঙ্গিকের বিষয় হলেও এদের মধ্যকার সম্পর্ক সম্পূর্ণ আলাদা নয়। ইতিহাস ও বিজ্ঞান একটি অপরটি দ্বারা কীভাবে পরিপুষ্ট হয় এবং ইতিহাসকে বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হবে কি না তা সম্পর্কিত বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হলো :
বিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত নেইবুর, লিওপোল্ড ভন র‍্যাংকে, জন বগনেল বিউরি, আলতুস হাক্সলি, অধ্যাপক টেগার্ট প্রমুখ ইতিহাসকে বিজ্ঞান বলার পক্ষপাতী ।
তাদের মতে, ঐতিহাসিক তত্ত্ব ও অনুসন্ধানের জন্য ঐতিহাসিককে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব ও অনুমান ছাড়া যেসব প্রক্রিয়া অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে তা হলো :
১. সব প্রাসঙ্গিক তথ্য বা তথ্যসমূহ আবিষ্কারের জন্য একটি অধ্যবসায়লব্ধ অনুসন্ধান পরিচালনা।
২. তথ্যসমূহ কতটুকু সত্য, মিথ্যা বা অনুমানসিদ্ধ তা যথাযথভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করা।
৩. তথ্যসমূহের বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করা।
ইতিহাস যখন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আয়ত্ত ও অনুসরণ করে সত্যের অনুসন্ধানে নিয়োজিত থাকে, তখন তাকে প্রকৃত অর্থেই বিজ্ঞান বলা চলে। জ্ঞানের যে শাখা আমাদের কোনো সাধারণ মূলনীতি বা বিধান জোগাতে পারে না, তার বৈজ্ঞানিক প্রকৃতিকে অস্বীকার করা যায়। এ সম্বন্ধে মন্তব্য প্রসঙ্গে আলতুস হাক্সলি ১৯২৯ সালে প্রকাশিত তার 'Do As You Will' গ্রন্থে উল্লেখ করেন, "By science, I understand all knowledge that rests upon evidence and reasoning." অর্থাৎ, বিজ্ঞান বলতে তিনি যুক্তি ও প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল সব জ্ঞানকেই বুঝান। একথা সত্য পদার্থ বা রসায়ন যে অর্থে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ইতিহাস সে অর্থে বিজ্ঞান নয়। তবে পদার্থ, রসায়নবিজ্ঞানের গবেষণাও স্বীকৃত সত্য এবং ইতিহাসের গবেষণাও স্বীকৃত সত্য। তাই বৈশিষ্ট্যের জন্য পৃথক হলেও উভয়ের লক্ষ্য সার্বজনীন সত্যকে মানবসমাজের কাছে তুলে ধরা, সমালোচনা করা এবং বিশ্লেষণমূলক ।
আধুনিক ইতিহাস চর্চার শ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জন বগলেন ১৯৩০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বক্তৃতায় বলেন, "History is a sicence, no less and no more." অর্থাৎ, ইতিহাস একটি বিজ্ঞান, কমও নয়, বেশিও নয়। ঐতিহাসিকগণ সমাজস্থ মানুষের অতীত কর্মকাণ্ডকে গবেষণার বিষয়বস্তুরূপে নির্ধারিত করে বিভিন্ন প্রক্রিয়া, পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দ্বারা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে থাকেন। জ্ঞানানুশীলনের বিভিন্ন কলাকৌশলের ব্যাপক উন্নতি, অনুসন্ধানীদের নিরলস প্রচেষ্টা, ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্তকে ক্রমাগত সঠিক ও সত্যনিষ্ঠ করে তুলেছে। এদিক থেকে ইতিহাসকে বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করা যায় ।
খ. ইতিহাস বিজ্ঞান না হওয়ার পক্ষে অভিমত :
১. ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত তথ্যসমূহ একক বা অদ্বিতীয় এবং ইতিহাস পুনঃপুন আবর্তিত হয় অর্থাৎ History repeats itself. ২. ইতিহাস সাধারণত স্বাধীন ইচ্ছা সম্পন্ন অতীত কার্যবলি ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট ধ্যানধারণা নিয়ে পর্যালোচনা করে থাকে। স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা সম্পাদিত মানবিক কার্যাবলি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সাধারণ সূত্র নিরূপণের ক্ষেত্রে কখনও কোনো মালমসলা বা উপকরণ সংগ্রহ করতে পারে না।
৩. পদার্থ ও রসায়নবিদ্যা যে অর্থে বিজ্ঞান ঠিক সে বিবেচনায় ইতিহাসকে বিজ্ঞান হিসেবে গণ্য করা হয় না। কারণ পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যার কিছু সুনির্দিষ্ট সূত্র রয়েছে। এ সূত্র ধরে কাজ করলে সবসময় একই ফল পাওয়া যায়। অন্যদিকে, ইতিহাসের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় না। ইতিহাসের কোনো সাধারণ সূত্র নেই বা ইতিহাসে কোনো ঘটনার বিশ্লেষণ সবসময় একই ধরনের ফল পাওয়া যায় না। তাই ইতিহাস সে অর্থে বিজ্ঞান নয় ।

গ. মূল্যায়ন : উপরের বর্ণনা থেকে বলা যায়, ইতিহাস মূল বিজ্ঞানের বা প্রকৃত বিজ্ঞানের সমতুল্য নয়। কিন্তু প্রকৌশলবিদ্যার মতো কিছু বাস্তব জ্ঞানের সমান। প্রতি ক্ষেত্রেই ইতিহাসের সাধারণ জ্ঞান সংশ্লিষ্ট থাকে ও প্রয়োগ করা হয়। তবে প্রত্যেক ব্যাপারেই ইতিহাস গবেষণাধীন নির্দিষ্ট উপাদান অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান নেয়। একজন ঐতিহাসিক তাদের বিষয়বস্তুর নিরিখে সাধারণ ও কৌশলগত সব ধরনের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে থাকেন। অবশ্য এমন কোনো বিষয় নেই যেখানে ইতিহাস সাধারণ প্রস্তাবের আলোকে সিদ্ধান্তে উপনীত হয় না ।
এভাবে দেখা যায়, ইতিহাস প্রকৃত অর্থেই বিজ্ঞানের সম্প্রদায়ভুক্ত এবং বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানচর্চা ছাড়া এর নিজস্ব কোনো বৈশিষ্ট্য আছে বলে অনুসৃত হয় না। ইতিহাস হুবহু বিজ্ঞান নয় বটে, কিন্তু কোনোভাবেই এটিকে বিজ্ঞান বহির্ভূত জ্ঞানের উৎস বলা যায় না ৷
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাস বিজ্ঞান কী বিজ্ঞান নয় এ পর্যালোচনায় দেখা গেল যে, এটি বিষয়বস্তুর নিরিখে হুবহু বিজ্ঞান নয়, তবে পদ্ধতিগতভাবেও সত্য উদ্ঘাটনের অনুশীলনে ইতিহাস বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত বলা যায়। পদার্থ, রসায়ন প্রভৃতি যে অর্থে বিজ্ঞান ইতিহাস হয়তো ঠিক সেই অর্থে বিজ্ঞান নয় তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিহাস অনেকটা বিজ্ঞানের অনুরূপ। আর তাই আমরা ইতিহাসকে সামাজিক বিজ্ঞান অর্থে বিজ্ঞান বলতে পারি । কেননা ইতিহাসে বর্ণিত ঘটনার অধিকাংশই সামাজিক বিজ্ঞানের অংশ ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]