পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭ খ্রি.)

Chakama Revolt in the Chittagong Hills Tracts (1776-87)
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭ খ্রি.) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে। ব্রিটিশ শাসক, ইজারাদার ও স্থানীয় ফড়িয়াদের সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবরোধ ও অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে চাকমারা ছিল অনমনীয়। আর স্বাধীকারের প্রশ্নে তারা ছিল আপসহীন। কারণ এটি তাদের জন্মগত সম্পদ। চাকমারা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পোষণ করতেন । রাজনৈতিকভাবে চাকমারা ছিলেন সচেতন। চাকমাদের তীব্র আন্দোলনের মুখে কোম্পানি সরকার নতি স্বীকার করে ১৭৮৭ খ্রি. ফেব্রুয়ারি মাসে চাকমা রাজা জানবকসকে বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এভাবে পার্বত্য অঞ্চলে চাকমা বিদ্রোহের অবসানের মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি সূচিত হয় ।
বিদ্রোহী চাকমাদের পরিচিতি
১. সাধারণ পরিচিতি : সাধারণভাবে ‘পাহাড়ি' নামে পরিচিত যে ১১টি জাতিসত্তা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে, তাদের মধ্যে চাকমারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সবচাইতে সুপরিচিত। অবশ্য আগেই যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষিতে নয়, গোটা বাংলাদেশেই চাকমারা হলো বৃহত্তম আদিবাসী সম্প্রদায়। তবে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে নয়, সাক্ষরতার ক্ষেত্রে অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের তুলনায় এগিয়ে থাকার কারণে চাকমাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমানে কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে এবং বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অনেক চাকমা ছাত্রছাত্রী পড়াশুনা করছে, ফলে দেশে তাদের একটা সাধারণ পরিচিতি গড়ে উঠেছে।
অন্যদিকে দীর্ঘদিন যাবৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতি পরিচালিত সশস্ত্র সংগ্রামের সূত্রে আন্তর্জাতিকভাবেও চাকমারা বিশেষভাবে পরিচিতি পেয়েছে, যেহেতু পাহাড়িদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসাবে চাকমারাই এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল ।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের আদামশুমারি অনুসারে এদেশে চাকমা জনসংখ্যা ছিল আড়াই লক্ষাধিক। তবে সেসময় ভারতে আশ্রিত শরণার্থীরা যারা পরে দেশে ফিরে এসেছে তাদের হিসাব ও স্বাভাবিক জনসংখ্যাবৃদ্ধির মতো বিষয় বিবেচনায় ধরলে এ সংখ্যা বর্তমানে আরও বেশি হবে। চাকমা জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশের বসবাস রয়েছে রাঙ্গামাটি জেলায় এবং এরপর খাগড়াছড়িতে। বান্দরবান জেলায় চাকমাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম। বর্তমানে বাংলাদেশের বাইরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরাম, ত্রিপুরা ও অরুণাচল প্রদেশে অনেক চাকমা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, যাদের বড় অংশই কাপ্তাই বাঁধের ফলে স্থানচ্যুতিসহ বিভিন্ন কারণে পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ঐ সমস্ত অঞ্চলে অভিবাসিত হয়েছিল।
২. ইতিহাস ও ঐতিহ্য : চাকমাদের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে কয়েক শতাব্দী আগের প্রেক্ষিতে বিস্তারিত ও বস্তুনিষ্ঠ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না । অবশ্য শুধু চাকমাদের বেলাতেই নয়, অন্যান্য প্রায় সকল আদিবাসী জাতিসত্তা, এমনকি খোদ বাঙালি জাতির ক্ষেত্রেই কথাটা অনেকখানি প্রযোজ্য। কারণ, প্রথাগত ইতিহাস চর্চায় বিভিন্ন রাজা-বাদশা বা অন্যান্য সামন্তপ্রভুদের কর্মকাণ্ডের প্রতি যতটা মনোযোগ দেখা গেছে, সে তুলনায় সামগ্রিকভাবে একটা জাতিসত্তা কিভাবে গঠিত হয়, এর বিকাশ বা ঐতিহাসিক রূপান্তর কীভাবে ঘটে, এ ধরনের বিষয়ে তেমন গবেষণা হয়নি। তার উপর একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে অপরাপর আদিবাসী সম্প্রদায়সমূহের মতোই চাকমারাও এদেশের মূলধারার ইতিহাস চর্চায় অনেকটাই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। চাকমাদের সম্পর্কে যেসব ঐতিহাসিক তথ্য আমরা পাই, তার অনেকটা মূলত লিপিবদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের হাতে। অবশ্য সাম্প্রতিককালে শিক্ষিত চাকমাদের একটা অংশও নিজেদের ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন, যাঁরা এই জাতির অতীত সম্পর্কে অজানা বা স্বল্প-জানা অনেক তথ্য, ধারণা বা তত্ত্ব হাজির করছেন, যদিও ক্ষেত্রবিশেষে ইতিহাসের সাথে কিংবদন্তি ও কল্পনার ভেদরেখা স্পষ্ট করা সম্ভব নয়। যাহোক, নিচে বিভিন্ন সূত্র অবলম্বনে চাকমা জাতির ইতিহাসের কিছু সাধারণ দিকের উপর আলোকপাত করা হলো :
ঠিক কবে থেকে ‘চাকমা' পরিচয়ধারী একটি জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে, এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায় না, তবে মুঘল শাসনামলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে নিশ্চিতভাবেই চাকমাদের বসবাস ছিল এবং সেখানে তাদের আবির্ভাব আরও আগেই ঘটেছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে চাকমাদের আদি বাসস্থান ছিল ‘চম্পকনগর' নামক একটি স্থান, তবে এর সত্যতা বা সঠিক অবস্থান সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। চাকমাদের একাধিক পালাগানে বিজয়গিরি নামে এক রাজার যুদ্ধাভিযান, বিশেষ করে তাতে অংশগ্রহণকারী সেনাপতি রাধামন ও তার প্রেমিকা ধনপুদির কাহিনি বিবৃত রয়েছে। রাজা বিয়জগিরিকে চাকমা রাজাদের একজন আদিপুরুষ হিসাবে গণ্য করা হয়, তবে কিংবদন্তির এই চরিত্র ও ঘটনাবলির পেছনে কবেকার কোনো ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে আছে, তাও এখনো নিঃসংশয়ভাবে নিরূপিত হয়নি। অতীতে চাকমা রাজারা নিজেদের ‘শাক্য-বংশীয়' (যে বংশে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল) হিসাবে দাবি করতেন, তবে এই দাবির সামাজিক ও প্রতীকী তাৎপর্য থাকলেও তার পেছনে কোনো বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে, এমন প্ৰমাণ নেই ।
চট্টগ্রামে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়াপর আগে এই অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে যে দুইটি রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ছিল, আরাকান ও ত্রিপুরা, তাদের উত্থান পতনের সাথে চাকমা জাতির ইতিহাস অনেকটা সম্পর্কিত ছিল বলে মনে করা হয়। চাকমাদের একটা বড় অংশ একসময় আরাকান রাজ্যের প্রভাবাধীন চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে বাস করতো বলে মনে হয়, তবে তার আগে তারা সেখানে উত্তর দিক থেকে গিয়ে থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। বর্তমানেও আরাকানে ‘দৈংনাক' নামে অভিহিত একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে বলে জানা যায় যেটাকে তঞ্চঙ্গ্যা তথা চাকমাদের একটি বিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। (উল্লেখ্য, তঞ্চঙ্গ্যারা বর্তমানে একটি স্বতন্ত্র উপজাতি হিসাবে বিবেচিত হলেও তারা চাকমাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।) যাই হোক, ব্রিটিশ শাসনের প্রাক্কালে অর্থাৎ মুঘল শাসনামলে চাকমাদের মূল আবাস ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলে । চাকমা রাজারা মুঘল শাসকদের ‘কার্পাস কর’ দিত, এবং সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে তাদের অনেকে অভিজাত মুসলিম শাসকদের অনুকরণে ‘খাঁ’ পদবি সংবলিত নাম ব্যবহার করতেন যেমন— জল্লাল খাঁ, জান বক্স খাঁ প্রভৃতি। ‘রাজা' হিসেবে অভিহিত হলেও তাঁরা অবশ্য পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোনো রাজ্যের অধিপতি ছিলেন বলে মনে হয় না, তবে চাকমা জনগোষ্ঠীর উপর তাঁদের কর্তৃত্ব ছিল এবং কখনো চাকমা রাজারা মুঘল ও পরবর্তীতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টির পর সেখানে যে তিনটি ‘সার্কেল’ চিহ্নিত করা হয়, তার একটি ছিল ‘চাকমা সার্কেল' (যার সীমানায় বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলার বেশির ভাগ এলাকা এবং খাগড়াছড়ি জেলার কিয়দংশ অবস্থিত)। মূলত চাকমা-অধ্যুষিত এই সার্কেলের চিফ পদটি স্বাভাবিকভাবেই চাকমা রাজ পরিবারের জন্য নির্ধারিত হয়। ব্রিটিশ শাসনের গোড়াতে চন্দ্রঘোনা ছিল জেলা সদর, তবে ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তা রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তরিত হয়, যে পদক্ষেপ চাকমা জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল । রাজপরিবারসহ চাকমা জনগোষ্ঠীর মূল কেন্দ্র ছিল রাঙ্গামাটি, যেখানে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ঐতিহাসিকভাবে চাকমা সমাজে সাক্ষরতা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ।
ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে অন্যান্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের মতো চাকমারা ও অর্থনৈতিকভাবে মূলত জুমচাষের উপরই নির্ভর করতো। তবে ব্রিটিশরা বিভিন্ন পন্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষের পরিধি কমিয়ে তার পরিবর্তে লাঙল চাষের প্রসার ঘটানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, যে পরিবর্তনে চাকমা জনগোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শামিল হয়েছিল। বিশেষ করে রাঙ্গামাটিসহ কর্ণফুলি নদীর অববাহিকা বরাবর বেশ কিছু সমৃদ্ধ চাকমা জনপদ গড়ে উঠেছিল। তবে ১৯৬০-এর দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে এই জনপদসমূহের অধিকাংশ হ্রদের নিচে তলিয়ে যায়, এবং এতে প্রায় এক লক্ষের মতো যেসব মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছিল, তাদের অধিকাংশ ছিল চাকমা সম্প্রদায়ভুক্ত। সেসময় স্থানচ্যুত চাকমাদের অনেকে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন অংশসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য হয়, এবং বাকিরা স্থায়ীভাবে দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। উল্লেখ্য, এদের মধ্যে যারা ভারতীয় কৰ্তৃপক্ষ কর্তৃক অরুণাচল প্রদেশে পুনর্বাসিত হয়েছিল, তারা এখনো সেদেশের পূর্ণ নাগরিকত্ব পায়নি ।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘শান্তিচুক্তি' সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত জনসংহতি সমিতি নামক একটি সংগঠনের নেতৃত্বে পাহাড়িরা স্বাধিকারের দাবিতে দুই দশকের বেশি সময় ধরে যে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়েছিল, অনেক বিশ্লেষকের মতে তার একটি অন্যতম উৎস নিহিত রয়েছে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ঘটনায়। এই বাঁধের ফলে ব্যাপক স্থানচ্যুতির অভিজ্ঞতাসহ পাহাড়িদের চোখে তাদেরকে নিজভূমে পরবাসী করার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ তাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বিশেষভাবে বিচলিত করেছিল। পাহাড়িদের মধ্যে এই শ্রেণির বিকাশ সবচাইতে বেশি ঘটেছিল চাকমাদের মধ্যে, ফলে তাদের মধ্য থেকে গড়ে উঠেছে পাহাড়িদের পরবর্তীকালের আন্দোলনের মূল স্রোত ।
৩. ভাষা ও সংস্কৃতি : পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের মধ্যে ভাষাগত দিক থেকে চাকমারা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এই অর্থে যে, অন্য সকল গোষ্ঠীর ভাষাসমূহ ‘তিব্বতী-বর্মী' (Tibeto-Burman) পরিবারভুক্ত হলেও চাকমা ভাষা বাংলার মতই ‘ভারতীয়-ইউরোপীয় (Indo-European) ভাষা পরিবারের অন্তর্গত (একথা অবশ্য তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যার সাথে চাকমা ভাষার বড় কোনো পার্থক্য নেই)। চাকমা ভাষার সাথে চট্টগ্রামী বাংলার যথেষ্ট মিল রয়েছে। তবে চাকমা ভাষাকে বাংলার একটি উপভাষা হিসাবে বিবেচনা না করে একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসাবেই গণ্য করা হয়। ধারণা করা হয়, একসময় চাকমাদের পূর্বসূরিদের ভাষাও তিব্বতী-বর্মী পরিবারভুক্ত ছিল, তবে কয়েক শতাব্দী আগে যে প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রামী বাংলার বিকাশ ঘটেছিল, সেই একই প্রক্রিয়ায় সমান্তরালভাবে চাকমা ভাষারও আবির্ভাব ঘটে থাকতে পারে। ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মীয় ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে চাকমা ভাষার একটা লিখিত রূপ প্রচলিত ছিল, যে কাজে ব্যবহৃত হরফ বর্মী বর্ণমালার অনুরূপ। বর্তমানে এই চাকমা বর্ণমালার কার্যকর কোনো ব্যবহার নেই, যদিও চাকমা সমাজে অনেকে এটিকে নূতন করে চালু করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছেন। এমনিতে চাকমা ভাষায় যাঁরা সাহিত্য চর্চা করেন, তাঁরা মূলত বাংলা হরফই ব্যবহার করেন। এখন পর্যন্ত চাকমা বা অন্য কোনো পাহাড়ি ভাষা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্কুলে শেখানোর ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি, তবে অদূর ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের তত্ত্বাবধানে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে ।
চাকমা লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদানে জুমচাষ নির্ভর জীবনযাত্রার প্রতিফলন দেখা যায়। বর্তমানে অবশ্য চাকমাদের খুব কম অংশই (এক চতুর্থাংশের নিচে) জুমচাষের উপর নির্ভর করে। তথাপি শহুরে শিক্ষিত চাকমাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চায় ফেলে আসা জুমিয়া জীবনের নান্দনিক উপস্থাপনার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। এই প্রেক্ষিতে চাকমা লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদান নতুন প্রেক্ষপটে নূতন আঙ্গিকে শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে অঙ্গীভূত হচ্ছে, যেমনটা অন্যান্য সমাজের ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, এক সময় চাকমা নারীদের সাধারণ পোশাক ছিল ঘরে বোনা ‘পিনন’ (সেলাইবিহীন মোটা কাপড়ের পেটিকোট) ও ‘খাদি' (বক্ষবন্ধনী), যে ধরনের পোষাক তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা প্রভৃতি অন্যান্য পাহাড়ি সম্প্রদায়ও ব্যবহার করে। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাকমা নারীরা অনেকে প্রাত্যহিক ভিত্তিতে এই পোশাক আর ব্যবহার করে না, তথাপি দেখা যায় নিজেদের চাকমা তথা পাহাড়ি পরিচয়কে তুলে ধরার লক্ষ্যে তারা বিশেষ উপলক্ষ্যে পিনন-খাদি পরিধান করে, যদিও ‘খাদি' এর বর্তমান ব্যবহার অনেকটা ওড়নার সাথে তুলনীয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব পোশাক আর ঘরে নিজের হাতে বানানোও না, বরং বাণিজ্যিকভাবে বস্ত্রকলে উৎপাদিত পণ্য হিসাবে এগুলো বাজার থেকে কেনা। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, পিনন-খাদির উৎপাদন ও ব্যবহারের প্রেক্ষাপট পাল্টে গিয়ে এই পোশাক শহুরে প্রেক্ষপটে নতুন তাৎপর্য নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে।
চাকমা বর্ষপঞ্জীর সবচাইতে বড় উৎসবের নাম বিজু, যা চৈত্রের দুদিন ও বৈশাখের প্রথম দিন মিলে টানা তিন দিন ধরে চলে (মারমা ও ত্রিপুরারাও ভিন্ন নামে একই উৎসব পালন করে)। পুরানো বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করা বিজু উৎসবের উপলক্ষ্য, তবে এর সামাজিক তাৎপর্য বাঙালি মুসলমানদের ঈদ বা বাঙালি হিন্দুদের শারদীয় দুর্গোৎসবের সাথে তুলনীয়। অতীতে কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জীবনের ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে বিজু উৎসব পালিত হতো। তবে শহুরে প্রেক্ষপটে বিজু এখন আর শুধুমাত্র পানাহার, বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো, বা বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের সাথে সাক্ষাতের আনন্দ ইত্যাদির মধ্যে সীমিত নেই। সামাজিক মিলন বা পুনর্মিলনের একটি সময় ছাড়াও বিজু এখন চাকমা তথা পাহাড়ি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সচেতন অনুশীলন তথা পুনর্নির্মাণের একটা উপলক্ষ্যও বটে ।
ধর্মীয়ভাবে চাকমারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, তবে বহু প্রজন্ম ধরে বাহিত লোকায়ত বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তর সাংস্কৃতিক স্রোতধারাসমূহের বিভিন্ন প্রভাবও তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় । লোকায়ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি একসময় কালীপূজাসহ বিভিন্ন ‘হিন্দু’ আচার অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় বিশ্বাসের যথেষ্ট প্রভাব চাকমা সমাজে পড়েছিল, পরবর্তীতে বৌদ্ধধৰ্ম চাকমা সমাজে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে তা অনেকটা স্তিমিত হলেও পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। পক্ষান্তরে চাকমা রাজারা একসময় মুসলিম ধাঁচের নাম ব্যবহার করলেও ধর্মীয়ভাবে চাকমা সমাজে ইসলামের প্রত্যক্ষ বা ব্যাপক কোনো প্রভাব লক্ষ করা যায় না। অবশ্য চট্টগ্রামের বাঙালি মুসলমান জনসমষ্টির ঐতিহাসিক আবির্ভাবে অতীতে চাকমা তথা অন্যান্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ শামিল হয়ে থাকতে পারে, যদিও এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। বলাবাহুল্য, অন্য যে কোনো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির মতোই চাকমা সংস্কৃতিও একটি বহমান ব্যবস্থা, যেখানে সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে চলছে যেগুলোর কোনোটা ভেতর থেকে উৎসারিত, কোনটা বাইরে থেকে আসা ।
৪. সমাজ কাঠামো : চাকমা সমাজে ৪৬টি ‘গঝা’ বা গোত্র রয়েছে বলে জানা যায়, যেগুলোর প্রতিটি আবার বিভিন্ন গুথি (গুষ্ঠি) বা উপগোত্রে বিভক্ত। (এই গোত্রগুলোর মধ্যে একটির নাম হলো ‘লারমা’, যেটি বিশেষভাবে পরিচিত পেয়েছে জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও তাঁর অনুজ জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নামের অংশ হিসাবে। উল্লেখ্য, নামের অংশ হিসাবে গোত্র উপাধি ব্যবহারের দৃষ্টান্ত চাকমা সমাজে বিরল)। একসময় চাকমা সমাজে গোত্র সংগঠন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে সমকালীন প্রেক্ষিতে এর গুরুত্ব অনেকটা কমে গেছে, অন্তত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাকমাদের মধ্যে। বস্তুত চাকমাসহ সকল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে শাসনব্যবস্থার অধীনে চলে আসার পর থেকে গোত্র- সংগঠনের রাজনৈতিক গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছিল, যে প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রে সম্ভবত প্ৰাক- ব্রিটিশ আমলেই সূচিত হয়েছিল।
প্রথাগতভাবে চাকমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা সামাজিক ক্রমোচ্চ বিন্যাস ছিল যার শীর্ষ বিন্দুতে অবস্থান করতেন চাকমা রাজা (বা রাণী)। মুঘল বা ব্রিটিশ আমলে রাজ পরিবারের ঠিক পরেই যেসব চাকমা পরিবার সামাজিক-প্রশাসনিক কাঠামোয় সাধারণ প্রজাদের চাইতে উচ্চ অবস্থানে ছিল, তাদের উত্তরসূরিরা এখনো বিভিন্ন সামন্ত যুগীয় পদবি-দেওয়ান, তালুকদার, খীসা ব্যবহার করে থাকেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে যে তিনটি সার্কেলে ভাগ করা হয়েছিল, তার একটি ছিল ‘চাকমা সার্কেল', যেখানে চাকমা জনগোষ্ঠী কেন্দ্রীভূত ছিল। চাকমা সার্কেলের চিফ পদটি ছিল চাকমা রাজাদের জন্য সংরক্ষিত। তবে ব্রিটিশ-পূর্ব যুগে চাকমা রাজাদের মর্যাদা যাই হয়ে থাকুক, অন্তত ব্রিটিশ আমল থেকে ‘চাকমা রাজা’ ছিল না, বরং তা ছিল ‘চাকমা সার্কেলের চিফ বা রাজা'। এই ব্যবস্থা অনুসারে ‘চাকমা সার্কেলে' বসবাসরত সকল পাহাড়ি সম্প্রদায়ের উপর কিছু ক্ষেত্রে চাকমা রাজার কর্তৃত্ব স্বীকৃত রয়েছে, পক্ষান্তরে যেসব চাকমা পরিবার অন্যান্য সার্কেলে বসবাস করে, তাদের ক্ষেত্রে অনুরূপ কোনো কৰ্তৃত্ব প্রযোজ্য নয় ।
সার্কেল চিফ বা রাজাদের কার্যাবলির একটা ছিল নিজ নিজ সার্কেলের অধিবাসীদের কাছ থেকে রাজস্ব বিশেষত ‘জুম কর’- আদায় করা। সে সাথে প্রথাগত সামাজিক বিচারকার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রেও সার্কেল প্রধানদের কর্তৃত্ব ছিল। প্রতিটা সার্কেল বিভক্ত রয়েছে অনেগুলো মৌজায়। মৌজা প্রধান বা ‘হেডম্যান'দেরও রাজস্ব আদায় ও সামাজিক বিচারকার্য পরিচালনায় ভূমিকা ছিল। প্রতিটা পাহাড়ি গ্রাম বা ‘পাড়া’য় রাজা-হেডম্যানদের অনুমোদিত একজন করে গ্রাম প্রধান বা ‘কার্বারী' রয়েছে। প্রতিটা জুমচাষি পরিবার থেকে একটা নির্দিষ্ট হারে জুম কর আদায় করা হতো, যার ভাগ রাজা ও হেডম্যানরা পেতেন (কার্বারীর এই ভাগ পেতেন না, তবে তাদের বেলায় ‘জুম কর’ মওকুফ ছিল)। ব্রিটিশ আমলের প্রেক্ষিতে রাজা ও হেডম্যানরা সংগৃহীত রাজস্বের যে ভাগ পেতেন, তার যথেষ্ট অর্থমূল্য ছিল, যার ভিত্তিতে চাকমাসহ সকল পাহাড়ি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট শ্রেণি-বিভাজন গড়ে উঠেছিল।
ব্রিটিশ আমলে পাহাড়ি সম্প্রদায়সমূহের জন্য যে ‘প্রথাগত শাসনব্যবস্থা' প্রণীত হয়েছিল, তা কাগজে-কলমে এখনো অনেকটা বহাল থাকলেও অনেক দিক থেকেই রাজা-হেডম্যান-কার্বারীদের কর্তৃত্বের পরিধি বা গুরুত্ব হ্রাস হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষিতে চাকমা তথা পাহাড়ি সমাজে কারো সামাজিক অবস্থান নিরূপণে পূর্বতন বংশমর্যাদা একমাত্র বা প্রধানতম মাপকাঠি নয়, বরং ব্যক্তির শিক্ষা, পেশা, বিত্ত ইত্যাদি বিষয়ের উপর তা অনেকখানি নির্ভর করে। এদিক থেকে চাকমা সমাজ কাঠামোর বর্তমান গতিপ্রকৃতি অন্যত্র বিদ্যমান সাধারণ প্রবণতা থেকে ভিন্ন নয় ।
সুতরাং অতি সংক্ষেপে বলা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত চাকমারা বাংলাদেশের বৃহত্তম আদিবাসী সম্প্রদায়, যারা শিক্ষাদীক্ষায়ও বর্তমানে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা ও অরুণাচল প্রদেশেও চাকমাদের বসবাস রয়েছে, যাদের অনেকে কাপ্তাই বাঁধের ফলে স্থানচ্যুত হয়ে অভিবাসী হয়েছিল। মুঘল শাসনামল বা আরও আগে থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে চাকমাদের বসবাস ছিল, যেখানে কিংবদন্তি অনুসারে ‘চম্পকনগর' নামক একটি স্থান থেকে তাদের আগমন ঘটেছিল। ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে অন্যান্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের মতো চাকমারাও অর্থনৈতিকভাবে মূলত জুমচাষের উপরই নির্ভর করতো। তবে ব্রিটিশ শাসনামলে চাকমাদের অনেকে লাঙল চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যাদের একটা বড় অংশ কাপ্তাই বাঁধের ফলে স্থানচ্যুত হয়েছিল। চাকমাদের বেশিরভাগ এখন আর জুমচাষ না করলেও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাকমাদের সংস্কৃতি চেতনায় জুমিয়া ঐতিহ্যের গুরুত্ব রয়েছে। অন্য যে কোনো সংস্কৃতির মতো চাকমা সংস্কৃতিও পরিবর্তনশীল একটি ব্যবস্থা যেখানে বিভিন্ন ঐতিহ্যের সমন্বয় লক্ষণীয়। চাকমা সমাজে বিভিন্ন গোত্র থাকলেও বর্তমানে গোত্র পরিচয়ের চাইতে শ্রেণিগত অবস্থানই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। আর বর্তমান চাকমা সমাজে ব্যক্তির শ্রেণিগত অবস্থান নিরূপণে সামন্ত বা ঔপনিবেশিক আমলের বংশমর্যাদার চাইতে শিক্ষা, পেশা, বিত্ত ইত্যাদির গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭ খ্রি.)
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহের ঐতিহাসিক পথপরিক্রমায় দেখা যায় যে, চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি। ইংরেজদের দখলের পূর্বে তারা ছিল কার্যত স্বাধীন। মুঘল সরকারের সাথে চাকমা রাজার সম্পর্ক ছিল সৌহার্দপূর্ণ। এর কারণ ছিল রাজার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ না করার নীতি। মুঘল সম্রাটকে নাম মাত্র কিছু কর দিয়ে তারা বাস্তবে নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতো। পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতিতে তখনও মুদ্রার প্রচলন ছিল না। মুঘল সরকারকে তারা কর পরিশোধ করতো কার্পাস তুলায়। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মীর কাশিমকে নবাবি দান করে। এর প্রতিদানে কোম্পানি বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের প্রত্যক্ষ অধিকার পায়। চট্টগ্রামের রাজস্ব আদায়ের সুবাদে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব তুলে নেয়। আর তখন থেকেই সমস্যা সৃষ্টি হতে শুরু করে। কোম্পানি সরকার ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বার বার রাজস্বের পরিমাণ বাড়াতে থাকে। চাকমা রাজা জোয়ান বকশকে ১৭৭২-৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মুদ্রায় কর পরিশোধ করতে বাধ্য করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে মুদ্রা অর্থনীতি চালু করার জন্য নানা প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ফলে চাকমাদের সনাতন সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে অস্থিরতা দেখা দেয় এবং ক্রমশই কোম্পানি সরকারের প্রতি অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে। এতে বিদ্রোহের দাবাগ্নি জ্বলে উঠে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার কর্তৃক ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর রাজস্বের হার আরও বৃদ্ধি করা হয় এবং কর সংগ্রহ করার জন্য উদাদার বা চুক্তিবদ্ধ ইজারাদার নিয়োগ করা হয়। পরিস্থিতি তখন এমন দাঁড়ায় যে, চাকমাদের পক্ষে জীবন ধারণ করাই কঠিন হয়ে ওঠে। কাজেই বেঁচে থাকার তাগিদেই বিদ্রোহের পথ বেছে নেওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো গত্যন্তর রইলনা। রাজা জোয়ান বকশের প্রধান নায়েব রুনু খান সব চাকমাদের একত্র করে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী ও অনুগত লোকদের অত্যাচার উচ্ছেদের জন্য প্রস্তুতি নেন। জোয়ান বকশের সম্মতিক্রমে রুনু খান ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন । তিনি স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ও তার সংলগ্ন নিম্নাঞ্চল থেকে ইংরেজ শাসকেরা রুনু খানকে দমনের জন্য সৈন্য প্রেরণ করে। কিন্তু কোম্পানির সৈন্যরা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ফিলে আসে। রুনু খানের রণকৌশল ছিল গেরিলা পদ্ধতির। তাই লড়াই করে চাকমাদের দমন করা সম্ভব নয় বুঝে তখন ইংরেজরা অন্য কৌশল নেয়। চাকমাদের প্রধান ফসল তুলা বিক্রি করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহের জন্য তাদের চট্টগ্রামের সমতল ভূমির বাজারে আসাটা ছিল অত্যাবশ্যকীয়। এটা বুঝে ইংরেজরা ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সমতলে আসার পথে চৌকি বসিয়ে চাকমাদের সমতলে আসার পথে বাধার সৃষ্টি করে। এতে চাকমারা ভীষণভাবে অসুবিধায় পড়ে। কিন্তু রুনু খানও পাল্টা ব্যবস্থা নেন। চট্টগ্রাম থেকে সমতলে আসার পথে চৌকি বসিয়ে চাকমাদের সমতলে আসার পথে বাধার সৃষ্টি করে। এতে চাকমারা ভীষণভাবে অসুবিধায় পড়ে। কিন্তু রুনু খানও পাল্টা ব্যবস্থা নেন। চট্টগ্রাম ছিল কোম্পানির লবণ তৈরির কেন্দ্র। সেই লবণ তৈরি করতে যে জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হতো তার সবটাই আসত পার্বত্য অঞ্চল থেকে। রুনু খান জ্বালানি কাঠ সরবরাহ বন্ধ করে দেন। ফলে কোম্পানির আয়ের অন্যতম উৎস লবণ উৎপাদন ব্যাহত হতে থাকে । প্রায় দশ বছর এমনিভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে। চাকমা বিদ্রোহীদের ফাঁদে আটকা পড়ে, তৃষ্ণার্ত হয়ে, বিষাক্ত তীরের আঘাতে কত ইংরেজ ও সরকারি সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে তার সংখ্যা উল্লেখ করা সম্ভব নয়। অবশেষে ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ কোম্পানি চাকমা রাজার সাথে সন্ধি করে। ঐ সন্ধিতে ইংরেজ কোম্পানি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজার অভ্যন্ত রীণ স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ করবে না বলে স্বীকার করে নেয়। এতে বিদ্রোহ প্রশমিত হয় । এভাবে পার্বত্য অঞ্চলে চাকমা বিদ্রোহের অবসানের মাধ্যমে পাহাড়ে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরে আসে।
চাকমা বিদ্রোহের পটভূমি
বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার সমতলভূমির উপরিভাগে অবস্থিত পাহাড়- পর্বতময়, অঞ্চলটির নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ‘যাযাবর চাষিদের বাসস্থান। প্রকৃতির কঠোরতা এবং ততোধিক দুর্ধর্ষ ও বন্য প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্নভাবে কঠোর সংগ্রাম করে তাদের জীবন ধারণ করতে হয়। প্রকৃতিগতভাবেই তারা সংগ্রামী ।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলের আদিম অধিবাসীদের মতোই এই অঞ্চলের চাকমা, কুকি প্রভৃতি পার্বত্য অধিবাসীরা প্রকৃতির সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে কঠোর সংগ্রাম করে জীবন ধারণ করে। সেই কঠোর সংগ্রামই তাদেরকে দুর্ধর্ষ করে তুলেছে নিঃসন্দেহে ৷
চট্টগ্রামে পার্বত্য অঞ্চলটি প্রথমে ছিল কুকি জাতির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাসস্থান পরে চাকমীগণ কুকিদের আরও উত্তর-পূর্ব দিকে তাড়িয়ে দিয়ে আরাকান অধিকার করে কিন্তু ব্রহ্মযুদ্ধের সময় (১৮২৪-৫২) মগেরা এসে চাকমাদের বিতাড়িত করে চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ অংশ অধিকার করলে চাকমাগণ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে সেই স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে এবং নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ।
এই অঞ্চলের পার্বত্য আদিম অধিবাসীরা এমনকি মুঘল যুগেও নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখতে পেরেছিল। সেই যুগেও তারা তাদের নিজস্ব স্বাধীনতা জীবিকার ব্যবস্থা অক্ষত ও অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তখন তারা কঠোর কায়িক পরিশ্রমে প্রস্তরময় অনুর্বর জমিতে যে শস্য উৎপাদন করতো তার সামান্য একটা অংশ রাজস্ব হিসাবে মুঘল সম্রাটদের দিয়ে তারা স্বাধীনভাবেই বাস করতো । কিন্তু এই অঞ্চলটি ইংরেজ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্বাধীনভাবে জীবিকানির্বাহের পুরাতন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায় এবং অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদের মতো এই পর্বত অরণ্যচারী আদিম মানুষগুলোও ক্রমশ ইংরেজরাজের শোষণ ব্যবস্থার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ক্রমশ এই অঞ্চলের উপরেও ইংরেজরাজের শোষণযন্ত্রগুলো একে একে চেপে বসতে থাকে। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে এক সন্ধি দ্বারা ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মীর কাশেমের হাতে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাবি দান করে প্রতিদান স্বরূপ বর্ধমান, চট্টগ্রাম ও মেদিনীপুর অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে। সুতরাং সেই সঙ্গে এই ক্ষুদ্র চাকমা রাজ্যটি ও পার্শ্ববর্তী স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্য ইংরেজ বণিকদের কুক্ষিগত হয়। সেই সময় হতেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ও তার শোষণের অনুচরগণ এই আদিবাসীদের সর্বস্ব লুণ্ঠিত করতে আরম্ভ করে। এই আদিবাসীদের জীবনধারা ও তাদের বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জি সাহেব লিখেছেন :
“চট্টগ্রাম ব্রিটিশ অধিকারে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এই পার্বত্য অঞ্চলের কোনো অংশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেই সময় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পার্বত্য অঞ্চলে দুইজন মাত্র পাহাড়িয়া দলপতির সন্ধান পেয়েছিল। তাদের একজন ছিল 'ফ্রু' (Phru) নামক আদিম জাতির নায়ক, অপরজন চাকমা জাতির নায়ক। এই দলপতিগণ মুসলমান শাসকদের নিকট রাজস্ব হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্পাস পাঠাত। তারা প্রথমে ব্রিটিশ শাসকদেরকেও কার্পাসের দ্বারা রাজস্ব দিত। কিন্তু রাজস্বের কার্পাসের পরিমাণ সম্ভবত এক এক বছর এক এক রূপ হতো। এই জন্যই প্রতিবছর এই ‘কার্পাস মহল' একজন ফড়িয়ার নিকট ইজারা দেওয়া হতো। এই ইজারাদার ফড়িয়া ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কার্পাস রাজস্ব আদায়ের চুক্তি করতো এবং এইভাবে এই অঞ্চলের সমস্ত কার্পাস একচেটিয়া করে ফেলত।”
ম্যাকিঞ্জ সাহেবের মতে, মুঘল যুগেই ‘কার্পাস মহল' বা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ফড়িয়া বা ‘স্পেকুলেটর' নামের শোষকদলের আবির্ভাব ঘটে। ইংরেজ শাসকগণ এই পার্বত্য আদিম জাতিগুলোর উপর তাদের শোষণযন্ত্রের অপরিহার্য অংশ রূপে এই ফড়িয়াদের লেলিয়ে দেয়। ফড়িয়ারা ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের চুক্তি করে নানাবিধ উৎপীড়ন দ্বারা ‘কার্পাস মহলের' প্রস্তরময় অনুর্বর জমিতে পাহাড়িয়াদের অমানুষিক পরিশ্রমে উৎপন্ন একমাত্র শস্যের উপর একচেটিয়া প্রভুত্ব স্থাপন করে, যার প্রতিবাদে চাকমারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলের আদিম প্রথায় চাষবাস ও ভূসম্পত্তি প্রথার নিম্নোক্ত বিবরণটি ম্যাকেঞ্জি সাহেবের গ্রন্থে পাওয়া যায় :
“যে প্রথায় সকল পাহাড়িয়া জাতি জমি চাষ করতো, তার নাম 'ঝুম' প্রথা। প্রতিবছর এপ্রিল মাসে গ্রামের সমস্ত লোক কোনো একটা সুবিধাজনক স্থানে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। তার পর প্রত্যেক পরিবারের সকল লোক জঙ্গল কেটে চাষের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ জমি আবাদ করে নেয়। ফসল পাকার সময় বন্য পশুপক্ষীর হাত হতে শস্য রক্ষা করার জন্য তারা ‘ঝুম’ বা দল বেঁধে সারা রাত্রি জমি পাহাড়া দেয়। দুই বছর চাষের পর জমির উর্বরা শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। এইভাবে যখন গ্রামের চারিপাশের সমস্ত উর্বর জমি চাষ করা হয়ে যায়, তখন সকল লোক ঐ স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, এই প্রথায় চাষের ফলে কোনো জমির উপরই ‘ঝুমিয়াদের’ (যারা ঝুম চাষে অংশগ্রহণ করে) স্থায়ী স্বত্ত্ব জন্মাতে পারে না এবং এই সকল জমির রাজস্ব নির্ধারণ করারও কোনো উপায় থাকে না। এই জন্যই এমনকি দলপতিরাও জমি বা বনের উপর কোনো ব্যক্তিগত অধিকার দাবি করে না। পার্বত্য চট্টগ্রমের চাকমা প্রভৃতি আদিবাসীরা এইভাবে অনুর্বর জমিতে তুলার ফসল ফলিয়ে এবং সেই তুলা চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে নিয়ে এসে এর বিনিময়ে চাল, লবণ প্রভৃতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করতো। প্রকৃতির দিক দিয়ে এটি ছিল আদিবাসী কৃষকক বিদ্ৰোহ । ”
আদিবাসী সম্প্রদায়ের সরলতাকে পুঁজি করে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ও তাদের পেটোয়া মহাজনরা আদিবাসীদের শোষণ করার একটি বিশেষ ফর্মুলা নেয়। ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বিবরণ হলে বুঝতে পারা যায় যে, এই অঞ্চলের পার্বত্য আদিম অধিবাসীরা ছিল যাযাবর চরিত্রের মানুষ। ইংরেজ শাসনের পূর্বে এবং অব্যবহিত পরেও এদের মধ্যে জমির উপর ব্যক্তিগত স্বত্বের উদ্ভব হয়নি। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব না হবার ফলে ইংরেজ শাসকগণ প্রথমে এই অঞ্চলের উপর তাদের প্রত্যক্ষ শোষণের জাল বিস্তার করতে না পেরে পরোক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। পরোক্ষ ব্যবস্থাটি ছিল নিম্নরূপ :
“ইংরেজ শাসকগণ বাইরের কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কার্পাস কর আদায়ের চুক্তি করে তাকে পার্বত্য অঞ্চল ইজারা দিত। ইজারাদার বিভিন্ন কৌশলে এই সরল প্রকৃতির পার্বত্য অধিবাসীদের নিকট হতে রাজস্বের নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলা হতে কয়েকগুণ অধিক তুলা আদায় করে আনত এবং চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলা শাসকদের নিকট জমা দিয়ে বাকি তুলা আত্মসাৎ করতো। এরপর ঐ তুলা বাজারে বিক্রয় করে প্রচুর মুনাফা লাভ করতো। অবশ্য ইজারাদার ইংরেজ প্রভুদের সম্মতি নিয়েই তা করতো। শাসকগণ রাজস্ব হিসাবে যে তুলা পেতে তা বিক্রি করে মুদ্রায় পরিণত করার জন্য অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করতো। এই চুক্তিতে মুদ্রার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা থাকত। এই দ্বিতীয় বক্তিটি শাসকগণের হস্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দিয়ে বাকি তুলা হতে ফটকাবাজি দ্বারা (স্পেকুলেশন) প্রচুর মুনাফা লুণ্ঠন করতো। এতে চাকমাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়। অন্যান্য বিদ্রোহের মতো এটির ব্রিটিশ বিরোধী প্রকৃতি লক্ষ্য করা যায়।”
এই ব্যবস্থার ফলে পার্বত্য অধিবাসীদের জীবিকানির্বাহ অসম্ভব হয়ে ওঠে প্রথমত, প্রথম ইজারাদারটি তাদের নিকট হতে রাজস্বের নামে প্রায় সমস্ত তুলাই লুটে নিত। দ্বিতীয়ত, তার লুণ্ঠনের পর যে সামান্য পরিমাণ তুলা বাকি থাকত তা চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে নিয়ে গিয়ে এর বিনিময়ে বা এর বিক্রয়লব্ধ অর্থে আদিবাসীদের পক্ষে খাদ্য প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করা দ্বিতীয় ব্যক্তিটির জন্য অসম্ভব হয়ে উঠত। কারণ, সেই ব্যক্তি বিভিন্ন উপায়ে ঐ অবশিষ্ট তুলা নামমাত্র মূল্যে তার নিকট বিক্রয় করতে আদিবাসীদের বাধ্য করতো। এই অঞ্চলের আদিবাসীরা সমান ওজনের দ্রব্যের বিনিময়ে সমান ওজনের দ্রব্য নিতে অভ্যস্ত ছিল। সুতরাং তুলার ব্যাপারী দুই টাকা মূল্যের এক মণ লবণের বিনিময়ে আট টাকা মূল্যের এক মণ তুলা আত্মসাৎ করতো । এইভাবে কোনো একটি বা দুইটি দ্রব্য ক্রয় করতেই আদিবাসীদের সমস্ত তুলা নিঃশেষ হয়ে যেত। এই উভয়বিধ শোষণের ফলে এই অঞ্চলের আদিবাসীরা অনিবার্য মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়াল। অবেশেষে তারা আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসেবে বিদ্রোহের পন্থা অবলম্বর করতে বাধ্য হলো। এভাবেই রচিত হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহের পটভূমি ।
প্রথম চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৭৭ খ্রি.)
প্রথমা চাকমা বিদ্রোহ সম্পর্কে সরকারি রেকর্ডে কেবলমাত্র একখানি পত্রের উল্লেখ দেখা যায়। এই পত্র দ্বারা চট্টগ্রামের তৎকালীন কালেক্টর গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে এই বিদ্রোহের সংবাদ দিয়েছিলেন। এই পত্রে কালেক্টর সাহেব নিম্নোক্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন :
“রামু খাঁ নামক এক পাহাড়িয়া তুলার চাষের জন্য কোম্পানিকে সামান্য রাজস্ব দেয়। আমার এই স্থানে আসার পর হতে ইজারাদারগণের দুর্ব্যবহারের জন্যই হোক অথবা তার বিদ্রোহী চরিত্রের জন্যই হোক, রামু খাঁ কয়েক মাস যাবত কোম্পানির ইজারাদারগণের সঙ্গে ভীষণ দাঙ্গাহাঙ্গামা চালাচ্ছে।... রামু খাঁকে বন্দি করার জন্য বিশেষ চেষ্টা চলছে ।
কিন্তু কালেক্টরের এই চেষ্টা সফল হয়নি, কারণ রামু খাঁ তার বাসস্থান হতে পলায়ন করেছে
পরবর্তীকালে এই অঞ্চলের শাসনকর্তা রূপে এসে আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জি, ক্যাপ্টেন টি এই লুইল, আর এইচ এস হাচিন্সন প্রভৃতি উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারিগণ চাকমা জাতির এই বিদ্রোহ ও অন্যান্য বিদ্রোহ সম্পর্কে বহু তথ্য খুঁজে বের করেন । তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন লুইন-এর বিবরণটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ।
১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগে চাকমাগণ প্রথমবার বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন চাকমা দলপতি ‘রাজা' শের দৌলত ও তাঁর সেনাপতি ‘রামু খাঁ'। এরা উভয়ে ছিলেন পরস্পরের আত্মীয়। রামু খাঁ সাধারণের নিকট ‘সেনাপতি’ বলে পরিচিত ছিলেন। চাকমাদের উপর সেনাপতির রামু খাঁর অসাধারণ প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। ইংরেজ শাসকদের দ্বারা নিযুক্ত ইজারাদারগণের শোষণ-উৎপীড়ন সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে রামু ও শের দৌলত চাকমা জাতির সকল লোককে একত্র করে ইজারাদারি ও ইংরেজ শাসনের মূলোচ্ছেদ করার জন্য প্রস্তুত হন। প্রথমে কার্পাস কর দেওয়া বন্ধ হয় এবং তার সঙ্গে সঙ্গে ইজারাদাগণের তুলার গোলা লুণ্ঠিত হয়। রামু খাঁর নেতৃত্বে চাকমাগণ ইজারাদারদের বড় বড় ঘাঁটি ধ্বংস করে ফেলে। রাঙ্গুনিয়াসহ প্রভৃতি স্থানের বড় বড় গোলা লুণ্ঠন করে সমস্ত তুলা বিদ্রোহীরা নিয়ে যায় । ইজারাদার ও তার কর্মচারিগণ চাকমা অঞ্চল হতে পলায়ন করে এবং বহু কর্মচারী চাকমাদের হাতে নিহত হয় ।
ইংরেজ শাসকগণ ইজারাদারের সাহায্যে অগ্রসর হয় এবং এই অঞ্চলের সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে এই সৈন্যদল প্রেরণ করে। চাকমাগণ তাদের তীর-ধনুক ও বর্শা দ্বারা আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অসম্ভব বুঝে গভীর পার্বত্য অঞ্চলে সরে পড়ে। ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের কোনো সন্ধান না পেয়ে ফিরে আসে। চাকমাগণ সুযোগ বুঝে আবার অগ্রসর হয় এবং চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে নেমে এসে ইজারাদারের ঘাঁটি ও ব্যাপারীদের দোকান প্রভৃতির উপর আক্রমণ চালাতে থাকে। ইংরেজ বাহিনী আবার পাহাড়ি অঞ্চলে প্রবেশ করে বিদ্রোহীদের পশ্চাদ্ধাবন করে। কিন্তু এবারও বিদ্রোহীরা গভীর পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য হয়ে যায় ।
এভাবে বিদ্রাহী চাকমাদের দমন করা অসম্ভব বুঝে শাসকগণ এক নতুন কৌশল অবলম্বন করে। চাকমাগণ সমতল ভূমির বিভিন্ন বাজারে এসে তাদের উদ্বৃত্ত তুলার বিনিময়ে বাজার হতে খাদ্য, লবণ প্রভৃতি সংগ্রহ করতো। শাসকগণ জানত যে, চাকমারা তুলা বাজারে নিয়ে আসতে না পারলে খাদ্যসংগ্রহ করতে পারবে না এবং খাদ্যাভাবে শেষ পর্যন্ত বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হবে। সুতরাং তারা সমতল ভূমির বিভিন্ন বাজারের পথে বহু স্থানে সৈন্যের পাহারা বসিয়ে চাকমাদের বাজারে আসা বন্ধ করার ব্যবস্থা করে। অবশেষে তাদের এই কৌশল সাফল্য লাভ করে, চাকমাগণ, বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। রামু খাঁ ইংরেজ শাসকগণকে ৫১০ মণ তুলা বার্ষিক রাজস্ব স্বরূপ দিতে সম্মত হয়েছিলেন। এতে প্রথম চাকমা বিদ্রোহের অবসান ঘটে।
এই প্রথম চাকমা বিদ্রোহ ও এর প্রধান নায়ক রামু খাঁর নাম এখনও মুছে যায়নি, এখনও নাকি চাকমাগণ এই বিদ্রোহ ও রামু খাঁর কাহিনী গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে ।
৫.৫ দ্বিতীয় চাকমা বিদ্রোহ (১৭৮২ খ্রি.)
প্রথম বিদ্রোহের পর হতে রামু খাঁর কোনো উল্লেখ দেখা যায় না । ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা দলপতি শের দৌলত খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জানবকস খাঁ ‘রাজা' (দলপতি) নির্বাচিত হন। জানবকস খাঁ জমিদার বলে নিজের পরিচয় দিলেও তিনি বহুকাল পর্যন্ত স্বাধীনতা রক্ষা করে চলেছিলেন। জানবকস খাঁ দলপতি হয়ে চাকমা অঞ্চলে ইজারাদারগণের প্রবেশ বন্ধ করে দেন। ১৭৮৩ হতে ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোনো ইজারাদারই এই অঞ্চলে প্রবেশ করতে বা রাজস্ব আদায় করতে পারেনি। সেই হেতু ইংরেজ প্রভুরা ইজারাদারগণের উপর সদয় হয়ে ১৭৮৩, ১৭৮৪ এবং ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তাদের খাজনা মওকুফ করেছিলেন।
জানবকস খাঁর সময় ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে চাকমাগণ আবার বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। এই বিদ্রোহের কারণ স্বরূপ ক্যাপ্টেন লুইন লিখেছেন :
“ইজারাদাগণ এই উপজাতির উপর ভীষণ অত্যাচর করতো। তার ফলে বহু চাকমা নিকটবর্তী আরাকান অঞ্চলেও পলায়ন করেছিল। চাকমাগণ জানবকস-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। কিন্তু স্থানীয় শাসকগণ পূর্বের মতো অর্থনৈতিক অবরোধের দ্বারা আবার তাদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করে।'
এই বিদ্রোহের সময়েও ইংরেজ বাহিনী চাকমাদের দমন করতে পাহাড় অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু জানবকস ও সকল চাকমা গভীর পার্বত্য অঞ্চলে পলায়ন করে এই অভিযান ব্যর্থ করে দেয় ।
তৃতীয় ও চতুর্থ চাকমা বিদ্রোহ (১৭৮৪-৮৭ খ্রি.)
জানবকস খাঁর নেতৃত্বে চাকমাগণ আবার বিদ্রোহ করে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। এই বিদ্রোহ দীর্ঘকাল ধরে চলছিল। জানবকস অবশেষে ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দেই আর একজন শের দৌলত খাঁর নেতৃত্বে চাকমাদের আর একটি বিদ্রোহ ঘটিয়েছিল। তাকে হাচিন্স দ্বিতীয় শের দৌলত খাঁ নামে অভিহিত করেছেন। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় শের দৌলত খাঁ বশ্যতা স্বীকার করেন ।
ইংরেজ শাসক, ইজারাদার ও স্থানীয় ভূমাধিকারীগণের সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে চাকমাগণ কোনো কোনো সময় আপস করলেও যতদিন পর্যন্ত এই অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারা প্রথা বলবৎ ছিল, ততদিন অর্থাৎ ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চাকমা বিদ্রোহ চলছিল। বিদ্রোহকালে চাকমাগণ যে পদ্ধতিতে উন্নত অস্ত্রসজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করছিল, তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সেই যুদ্ধ ছিল একালের গেরিলা যুদ্ধেরই অনুরূপ; ইংরেজ বাহিনী চাকমা অঞ্চলে প্রবেশ করা মাত্র তারা সম্মুখযুদ্ধে বাধা দেবার চেষ্টা না করে স্ত্রীপুত্র ও অস্থাবর সম্পত্তিসহ গভীর পার্বত্য অঞ্চলে পলায়ন করতো এবং এইভাবে ইংরেজ বাহিনীকে গভীর পার্বত্য অঞ্চলে টেনে নিয়ে যেত। ইংরেজ সৈন্যগণ চাকমাদের গ্রাম, বাড়িঘর ক্ষেতের শস্য সমস্ত কিছু জ্বালিয়ে দিতে দিতে অগ্রসর হতো। এই রূপে বহু দূরে অভ্যন্তরে প্রবেশ করেও যখন ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের সন্ধান পেত না, তখন তারা ফিরতে আরম্ভ করামাত্র বিদ্রোহীদের আক্রমণ আরম্ভ হতো। চাকমাগণ বড় বড় গাছ কেটে পার্বত্য পথগুলো বন্ধ করে, পর্বত গহ্বরের মুখে ফাঁদ পেতে ও পানীয় জল নষ্ট করে দিয়ে ইংরেজ বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে ফেলত। তারপর তারা গোপন স্থান হতে বিষাক্ত তীরবিদ্ধ করে দলে দলে ইংরেজ সৈন্য সংহার করতো। ১৭৭৬ হতে ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই চৌদ্ধ বছরে কত ইংরেজ সৈন্য ও ভারতীয় সিপাহি যে বিদ্রোহী চাকমাদের তীরে প্রাণ দিয়েছে, কত সৈন্য ফাঁদ পাতা পর্বত গহ্বরে পড়ে এবং পানীয় জলের অভাবে পিপাসায় ছটফট করে মরেছে তার হিসাব নেই। ইংরেজ শাসকগণ অস্ত্রের জোরে বিদ্রোহী চাকমাদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়নি, পার্বত্য অঞ্চলে খাদ্যের অভাবে এবং অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে অর্থাৎ সমতল ভূমির হাটবাজারে এসে তুলার বদলে খাদ্য সংগ্রহ করতে না পেরেই তারা শেষ পর্যন্ত বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এই অঞ্চল হতে ইজারাদারের মারফত রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা যতদিন বর্তমান ছিল ততদিন স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। ইজারা প্রথার অবসান করেই ইংরেজগণ এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।
চাকমাগণ বারবার বিদ্রোহ করার ফলে ইংরেজ শাসকদের টনক নড়ে উঠে। তারা বুঝতে পারে যে, তাদের এবং ইজারাদারদের অবাধ শোষণ ও বর্বরসুলভ উৎপীড়নই চাকমা বিদ্রোহের কারণ এবং যতদিন এই ইজারা প্রথার অবসান না হয় ততদিন চাকমাগণ শান্ত হবে না। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় সরকারের প্রধান বাণিজ্যকর্তা হ্যারিস সাহেব সমস্ত বিষয় অনুসন্ধান করে ‘রেভিনিউ বোর্ড'-এর নিকট সুপারিশ করেন যে, ইজারাদারের হস্তে ন্যস্ত পার্বত্য অঞ্চলের কার্পাসের একচেটিয়া বাণিজ্য প্রথা রহিত করে সরাসরি ঝুমিয়াদের বা চাকমা দলপতির সঙ্গে বন্দোবস্ত করা উচিত। এই প্রস্তাব অনুসারে ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে ইংরেজ শাসকগণ স্থির করেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইজারা প্রথা রহিত হবে এবং কার্পাস কর তুলে দিয়ে ঝুমিয়াদের বা চাকমা সর্দারগণের সঙ্গে পরিমিত জমা (টাকা) ধার্য করা হবে। তা ব্যতীত আশ্বাস দেওয়া হলো যে, এই কর নিয়মিতভাবে কালেক্টরের নিকট জমা দিলে তা আর বৃদ্ধি করা হবে না। কিন্তু শাসকগণ এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। এই সময় আরও স্থির করা হয়েছিল

যে, চাকমাদের নিকট হতে কর স্বরূপ তুলা আদায় করার নিমিত্ত সরকারের পক্ষ হতে একজন কর্মচারী নিযুক্ত করা হবে। এই কর্মচারীই কর বাবদ দেয় সমস্ত তুলা আদায় করে পরে তা নিলামে বিক্রয় করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা করা হতো না, সমুদয় তুলা ঢাকাস্থিত কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে চালান দেওয়া হতো। রামু খাঁর সময় রাজস্ব হিসাবে ৫০১ মণ তুলা ধার্য হয়েছিল। রামু খাঁর মৃত্যুর পর ৫০১ মণ তুলার পরিবর্তে ১৮১৫ টাকা ধার্য হয়। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ৫০১ মণ তুলার মূল্য আরও বর্ধিত করে টা. ২২২৪/৪ পাই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। পরে আপসের শর্তানুসারে চাকমা সর্দারগণই এই রাজস্ব সংগ্রহ করে কালেক্টরের অফিসে জমা দিত। চাকমাদের এই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্রোহে শাসকগোষ্ঠীর টনক নড়ে যায়। এবং অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর ভেতরেও এ সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। তবে শাসকরা এদের ধর্মান্তরিত করে সংগ্রামের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পায় ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহের প্রকৃতি
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার সমতলভূমির উপরিভাগে অবস্থিত পাহাড়-পর্বতময় অঞ্চলটি পার্বত্য চট্টগ্রাম। ১৭৭৬-৮৯ খ্রি. ইংরেজদের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলে চাকমাদের নেতৃত্বে যে কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়, তা চাকমা আদিবাসী কৃষক বিদ্ৰোহ নামে পরিচিত । প্রাক ঔপনিবেশিক যুগে চাকমারা উৎপন্ন ফসলের একটা নির্দিষ্ট অংশ রাজস্ব হিসেবে প্রদান করে স্বাধীনভাবেই জীবন ধারণ করতো। ১৭৬০ খ্রি. মীর কাশিম বাংলার নবাবির বিনিময়ে ইংরেজ কোম্পনিকে বর্ধমান মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা প্রদান করেন। এই সুবাধে ইংরেজরা ক্ষুদ্র চাকমা রাজ্যটির অভিভাবকত্ব অর্জন করে। কিন্তু এ অঞ্চলটি ইংরেজ শাসনের অধীনে আসার ফলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা আদিবাসীদের স্বাধীন জীবিকানির্বাহের পথে ব্যত্যয় ঘটে। এতে চাকমাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। চাকমা কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল এ বিদ্রোহে। তাই বিদ্রোহের প্রকৃতির দিক থেকে একে আদিবাসী চাকমা কৃষক বিদ্রোহও বলা হয় ।
ব্রিটিশরা রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারাদারি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এ অঞ্চলের আদিবাসীদের উৎপাদিত প্রধান দ্রব্য ছিল কার্পাস। কার্পাস কর আদায়ের চুক্তি করে ইজারাদারকে পার্বত্য অঞ্চল ইজারা দেওয়া হয়। ইজারাদার নানা কৌশলে আদিবাসীদের নিকট হতে রাজস্বের নামে অতিরিক্ত কার্পাস বা তুলা আত্মসাৎ করতো। এর পর চাষির নিকট যে সামান্য তুলা অবশিষ্ট থাকতো তা বিক্রয়ের জন্য সমতল ভূমিতে দালাল ফড়িয়াদের নিকট যেতে হতো। তারা নাম মাত্র মূল্যে আদিবাসীদের বাকি তুলা ক্রয় করে নিত। এখানেও তারা ন্যায্য মূল্য পেতো না। এছাড়া এ অঞ্চলের আদিবাসীরা দ্রব্য বিনিময় প্রথায় অভ্যস্ত ছিল। এই সুযোগে তুলার ব্যাপারী দুই টাকা মূল্যের এক মণ লবণের বিনিময়ে আট টাকা মূল্যের এক মণ তুলা আত্মসাৎ করতো। এরূপ দ্বিমুখী শোষণের ফলে এ অঞ্চলের আদিবাসী সমাজের আর্থিক সংকট বৃদ্ধি পায় । এভাবে চাকমারা প্রতিনিয়ত শোষিত ও প্রতারিত হতো। অথচ এর কোনো প্রকার প্রতিকার আশা করা ছিল বৃথা। এ কারণে চাকমারা আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসেবে বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। সংগঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী কৃষক বিদ্ৰোহ ।
এটা লক্ষণীয় যে, ১৭৭৬ খ্রি. মধ্যভাগে চাকমারা প্রথমবার বিদ্রোহ ঘোষণা করে । এ বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন চাকমা দলপতি রাজা শের দৌলত ও তার সেনাপতি রামু খাঁ। চাকমাদের উপর রামু খাঁর প্রভাব ছিল অসাধারণ। এ বিদ্রোহের মাধ্যমে তারা ইজারাদারি ও ইংরেজ শাসনের মূলোচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন। আদিবাসীরা বিদ্রোহের শুরুতে কার্পাস কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তারপর ইজারাদারগণের তুলার গোলা লুণ্ঠন করে। রাঙ্গুনিয়াসহ বিভিন্ন স্থানের বড় বড় গোলা লুট করে সমস্ত তুলা বিদ্রোহীরা নিয়ে যায়। ইজারাদার ও তাঁদের কর্মচারীরা এ অঞ্চল হতে পলায়ন করে, অনেকে নিহত হয়। ইংরেজ শাসকগণ নিজ স্বার্থে ইজারাদারদের সাহায্যার্থে সামরিক বাহিনী প্রেরণ করে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ সেনাদলের মোকাবিলা করা তীর ধনুক দিয়ে সম্ভব হবে না জেনে চাকমারা জলাশয়ে বিষ মিশিয়ে পানি বিষাক্ত করে রাখে । অদৃশ্য স্থান হতে বিষ মিশানো তীর ছুড়ে মারা হয় সৈন্যদের উপর। ফলে অনিবার্য মৃত্যুর শিকার হয় ইংরেজ সৈন্যরা। বিদ্রোহীরা বিপদ টের পেলেই পার্বত্য অঞ্চলে সরে পড়ে এবং পথে পথে বাধার সৃষ্টি করে। চাকমাদেরকে দমন করা অসম্ভব বুঝে অবশেষে ইংরেজরা নতুন কৌশল অবলম্বন করে। তারা চাকমাদের অত্যাবশ্যকীয় বিক্রয় দ্রব্য তুলা বিক্রি করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করার রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এতে ইংরেজদের নিকট বিদ্রোহীরা বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়। রামু খাঁ বার্ষিক রাজস্ব স্বরূপ ৫০১ মণ তুলা সরকারকে দিতে সম্মত হয়। এভাবে চাকমাদের প্রথম বিদ্রোহ প্রমাণিত হয় । চাকমাদের প্রথম বিদ্রোহের (১৭৭৬ খ্রি.) পর হতে নথিপত্রে রামু খাঁর আর কোনো উল্লেখ দেখা যায় না। তবে ব্রিটিশ দলিল পত্রে তিনি জীবিত। ১৭৮২ খ্রি. চাকমা দলপতি শের দৌলত খার মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র জানবকস খাঁ রাজা নির্বাচিত হন। তিনি নিজেকে স্বাধীন জমিদার বলে পরিচয় দিতেন। এদিকে ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পরও চাকমাদের উপর ইজারাদারদের অত্যাচার বন্ধ হয়নি। ফলে জানবকস খাঁ তার পরও চাকমাদের উপর ইজারাদারদের প্রবেশ বন্ধ করে দেন। ১৭৮৩-১৭৮৫ খ্রি. পর্যন্ত ইংরেজদের রাজস্ব মওকুফ করে দিতে বাধ্য হয় । জানবকস খাঁর নেতৃত্বে চাকমারা পুনরায় ১৭৮৪ খ্রি. বিদ্রোহ করে। এ বিদ্রোহ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চলে। অবশেষে বিকল্প অর্থনৈতিক সুবিধার অভাব ও বাজার অধীনতার জন্য জানবকস খাঁ ১৭৮৭ খ্রি. পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হন। এদিকে চট্টগ্রামের ইংরেজ কর্তৃপক্ষ বিদ্রোহী নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির চেষ্টা চালায় এবং একজনের পক্ষ নিয়ে অন্যজনকে পরাভূত করতে সচেষ্ট হয়। গুপ্তচরের মাধ্যমে জানবকসের মনে এমন ধারণা সৃষ্টি করা হয় যে, রামু খাঁ ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং শীঘ্রই তিনি রাজাকে হত্যা করে ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। এ কৌশলে কাজ হয়। ১৭৮৭ খ্রি. ফেব্রুয়ারি মাসে রাজা জানবকস সরকারে সাথে এক চুক্তি করেন । এই চুক্তিতে কোম্পানি সরকার তাকে বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এতে চাকমারা সন্তুষ্ট হয়।
কিন্তু ১৭৮৭ খ্রি. মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ সরকার চুক্তি লঙ্ঘন করলে শের দৌলত খাঁর নেতৃত্বে চাকমারা পুনরায় বিদ্রোহ শুরু করে। ১৭৮৯ খ্রি. পর্যন্ত এই বিদ্রোহ অব্যাহত থাকে। অবশেষে সমস্ত বিষয় অনুসন্ধান করে ১৭৮৯ খ্রি. বাংলা সরকারের সুযোগ্য প্রধান বাণিজ্য কর্তা হ্যারিস (Harish, 1789 ) এর পরামর্শে ইজারা প্রথা রহিত করা হয়। সরকার চাকমা দলপতিদের সাথে সরাসরি রাজস্ব বন্দোবস্তের চুক্তি করে এবং ৫০১ মণ তুলার সমমূল্যের নগদ দুই হাজার দুইশত চব্বিশ টাকা চার আনা রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, উক্ত টাকা কালেক্টর অফিসে জমা দিলে তা আর বৃদ্ধি করা হবে না। তখন থেকে চাকমা দলপতিগণ চুক্তি মোতাবেক নির্ধারিত রাজস্ব কালেক্টর অফিসে জমা দিয়ে স্বাধীনভাবে তাদের রাজ্যটি পরিচালনা করতে থাকেন। এভাবে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়।
ব্রিটিশ শাসক, ইজারাদার ও স্থানীয় ফড়িয়াদের সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবরোধ ও অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে চাকমারা ছিল অনমনীয়। আর স্বাধীকারের প্রশ্নে তারা ছিল আপসহীন। কারণ এটি তাদের জন্মগত সম্পদ। শুধু তাই নয়, ইজারাদারদের মাত্রাতিরিক্ত শোষণের পৃষ্ঠপোষক ইংরেজ সার্বভৌমত্বের সঙ্গে চাকমা সার্বভৌমত্বের সাংঘর্ষিক রূপটি বিবেচনা করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, চাকমারা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্পৃহা পোষণ করতেন। ফলে এখানেই ই. জে. হবসবমের (E. J. Hobsbawm, 1978) তত্ত্বটি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে, যেখানে তিনি মনে করেছেন যে, ১৮শ-১৯শ শতকের কৃষক বিদ্রোহগুলোর প্রকৃতি ছিল প্রাক-রাজনৈতিক । এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, চাকমারা রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট সচেতন ছিল। লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭ খ্রি.) এর সার্বিক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে পার্বত্য চট্টগ্রাম অবস্থিত। সমুদ্র ও পাহাড় বেষ্টিত এই ভূভাগ দীর্ঘদিন যাবৎ কখনও স্বাধীন, কখনও মুঘলদের, কখনও ইংরেজদের অধীনে শাসিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ছিল কুকি। কুকিদের বিতাড়িত করে চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করতে থাকে। পরবর্তী সময়ে মগেরা চাকমাদের বিতাড়িত করলে চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীরা মুঘল যুগেও স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পেরেছিল। তখনকার চাকমা আদিবাসীরা পার্বত্য ঢালে উৎপাদিত শস্যের কিয়দংশ রাজস্ব হিসেবে মুঘল সম্রাটদের দিয়ে স্বাধীনভাবে বাস করতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মীর কাসেমের নিকট বাংলা-বিহার উড়িষ্যার নবাবি প্রদান করে। সে সুবাদে কোম্পানি বর্ধমান, চট্টগ্রাম ও মেদেনীপুর অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে। সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ইংরেজ বণিকদের কুক্ষিগত হয়। কিন্তু সে সময়ও পার্বত্য অঞ্চলের অনেক জায়গা ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তখন পার্বত্য অঞ্চলের অপর একজন চাকমা দলপতি তৎকালীন মুসলমান শাসকদের নিকট রাজস্ব স্বরূপ
নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্পাস তুলা পাঠাত। প্রতিবছরই কার্পাস মহালো একজন ফড়িয়ার নিকট পত্তন দেওয়া হতো। ফড়িয়ারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে রাজস্ব আদায় চুক্তি করতো। রাজস্ব হিসাবে প্রাপ্ত সমস্ত কার্পাসের একচেটিয়া অধিকার তারা লাভ করতো । কার্পাস মহলো ফড়িয়াদের ইজারা দেওয়ার মাধ্যমেই এতদাঞ্চলের আদিবাসীদের ওপর শোষণের পত্তন ঘটে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিকতর রাজস্ব আদায়ের জন্য ফড়িয়াদেরকে আদিবাসীর ওপর নির্যাতনের অধিকার প্রদান করেছিল। পাহাড়ে বসবাসকারী আদিবাসীরা ‘জুম' চাষের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় ফসল উৎপন্ন করতো। প্রতি বছর এপ্রিল মে মাসে গ্রামের সমস্ত লোকজন একত্র হয়ে ফসল উৎপাদনে সুবিধাজনক স্থানে বসবাস করা ছিল তাদের অভ্যাস।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা জুম চাষ করার জন্য একই অঞ্চলে দীর্ঘদিন বসবাস করতে পারত না। পাহাড়ি জঙ্গল কেটে পাহাড়ের ঢালে গর্ত খুড়ে তারা জুম চাষ করতো। একই জায়গায় দুই তিন বার চাষ করার ফলে জমির উর্বরা শক্তি কমে যেত, ফলে চাষবাসের জন্য অন্যত্র নতুন জমির সন্ধানে তারা নতুন জায়গায় বসবাস শুরু করতো। ফলে পাহাড়িদের জমির স্থায়ী স্বত্ব গড়ে ওঠেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই আদিবাসীদের যাযাবর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। স্থায়ী আবাস গড়ে না ওঠায় ও জমির মালিকানা না থাকায় ফড়িয়ারা নিজেদের ইচ্ছামতো পাহাড়ি অঞ্চলের জমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ইজারা নিয়ে আদিবাসীদের চাষ করার সুযোগ দিত। বিনিময়ে আদিবাসীদের নিকট থেকে কোম্পানির দেয় রাজস্বের চেয়ে অধিক পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতো। চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানিকে রাজস্ব দিয়ে অবশিষ্ট রাজস্ব ফড়িয়ারা আত্মসাৎ করতো। এই ফড়িয়াদের অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের ফলে আদিবাসীদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়ে। রাজস্ব দেওয়ার পর যে তুলা থাকত সে তুলা বিক্রি করে খাদ্যসহ জীবন ধারণের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা তাদের পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়ত। সে সময় সমস্ত উৎপাদিত দ্রব্যাদি পরস্পর বিনিময় করা হতো। ফলে আট টাকা মণ দরের এক মণ তুলার বিনিময়ে আদিবাসীদের দুই টাকা মণ দরের এক মণ লবণ কিনতে হতো। অতিরিক্ত রাজস্ব প্রদান ও দ্রব্যক্রয়ে এই অসম বৈষম্যের ফলে আদিবাসীরা এই অসম শোষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করে। প্রথম চাকমা বিদ্রোহ সম্পর্কে চট্টগ্রামের তৎকালীন কালেক্টরের বর্ণনা থেকে জানা যায়-রামু খাঁ নামক এক পাহাড়িয়া তুলা চাষের জন্য কোম্পানিকে সাম ন্য রাজস্ব দিতো। কোম্পানির শাসন প্রচলিত হওয়ার পর ইজারাদারদের দুর্ব্যবহারের ও শোষণের কারণে রামু খাঁ বেশ কিছুদিন যাবৎ কোম্পানির ইজারাদারদের সাথে দাঙ্গাহাঙ্গামা করে। ফলে কোম্পানি রামু খাঁকে বন্দি করার চেষ্ট করে। কিন্তু রামু খাঁ সে স্থান থেকে অন্যত্র পালিয়ে যায়। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন লইন-এর বিবরণ থেকে জানা যায়- ১৭৭৬ খ্রি. মধ্যভাগে চট্টগ্রামের চাকমারা প্রথম বিদ্রোহ করেন। চাকমাদের এই বিদ্রোহের সর্দার ছিলেন চাকমা দলপতি ‘রাজ' শের দৌলত ও তার সেনাপতি রামু খাঁ। চাকমাদের উপর রামু খাঁর প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। আদিবাসীদের উপর কোম্পানির নিযুক্ত
ইজারাদারদের শোষণের মাত্রা বেড়ে গেলে শের দৌলত ও রামু খাঁ বিচলিত হয়ে ওঠে তারা এতদঞ্চলে বসবাসকারী চাকমাদের শোষণ ও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষার জন্য একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। চাকমা জনগণ শের দৌলত ও রামু খাঁর নেতৃত্বে একতাবদ্ধ হয়। তারা ফড়িয়াদের শোষণের হাত থেকে নিষ্কৃতির প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ শুরু করে । চাকমা বিদ্রোহীরা প্রথমে কার্পাস মহলো। ইজারাদারদের রাজস্ব দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এ সময় বিদ্রোহীরা ইজারাদারদের তুলার গুদাম লুটপাট শুরু করে। রামু খাঁর নেতৃত্বে চাকমা বিদ্রোহীরা ইজারাদারদের বড় বড় ঘাঁটি ধ্বংস করতে থাকে। চাকমারা ইজারাদারদের বড় বড় গুলা লুট করে নিয়ে যায় ।
এ অবস্থায় ফড়িয়া ও ইজারাদারগণ এবং তাদের কর্মচারীরা পালিয়ে যায়, নিজ নিজ এলাকা ত্যাগ করার সময় চাকমা বিদ্রোহীদের হাতে অনেকে নিহত হয়। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে কোম্পানির শাসকগণ ফড়িয়া ও ইজারাদারদের সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে একদল সৈন্য পাঠায়। চাকমারা তীর-ধনুক ও বর্শা দিয়ে আগ্নেয় অস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করা অসম্ভব মনে করে, এ কারণে চাকমা বিদ্রোহিগণ চট্টগ্রামের গভীর অরণ্যে পালিয়ে যায় ।
ইংরেজ সৈন্যরা বিদ্রোহীদের সন্ধান না পেয়ে তাদের ক্যাম্পে ফিরে আসে। চাকমা বিদ্রোহীরা ইংরেজ সৈন্যদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টা জানতে পেরে সুযোগমতো আবার ইজারাদার ও ফড়িয়াদের উপর আক্রমণ চালিয়ে থাকে। ইংরেজ সৈন্যদের নিকট এ সংবাদ পৌছালে তারা পুনরায় বিদ্রোহীদের তাড়া করে। কিন্তু বিদ্রোহীরা আবারো গভীর অরণ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। কোম্পানির শাসকেরা চাকমাদের চতুরতা বুঝতে পেরে নতুন কৌশল অবলম্বন করে। চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমতল ভূমির বাজারে এসে তুলা বিক্রি করে খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করতো। শাসকগণ অনুধাবন করতে পারে যে, বিদ্রোহীরা বাজারে আসতে না পারলে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারবে না। খাদ্যের অভাবে শেষ পর্যন্ত চাকমাগণ বিদ্রোহ পরিত্যাগ করে বশ্যতা স্বীকার করবে। সে অনুযায়ী কোম্পানির শাসকগণ সমতলভূমির বিভিন্ন বাজারের পথে সৈন্য পাহারা বসিয়ে চাকমাদের বাজারে আসা বন্ধ করল। ইংরেজদের এই কূটকৌশল সফল হলো। চাকমারা বশ্যতা স্বীকার করল। চাকমা দলপতি শের দৌলত খাঁর মৃত্যুর পর তার পুত্র জানবকস খাঁ দলপতি মনোনীত হবার পর চাকমা অঞ্চলে ইজারাদারদের আসা বন্ধ করে দেন। বেশ কয়েক বছর ইজারাদাররা চাকমা অঞ্চলে প্রবেশ করতে ও রাজস্ব আদায় করতে পারেনি ।
ফড়িয়া-ইজারাদারদের অত্যাচারে অনেক চাকমা নিকটবর্তী আরাকান অঞ্চলে পালিয়ে যায়। চাকমাগণ জানবকস খাঁ নেতৃত্বে ১৭৮৩ খ্রি. পুনরায় বিদ্রোহ করে। কিন্তু কোম্পানির শাসকগণ তাদের পূর্বেকার কূটকৌশল প্রয়োগ করে পুনরায় চাকমাদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করে। ইংরেজ শাসক, ইজারাদার ও স্থানীয় ফড়িয়ারা চাকমাদের বশ্যতা স্বীকার করাতে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এতে মাঝে মাঝে চাকমা বিদ্রোহিগণ বশ্যতা স্বীকার করলেও চাকমা বিদ্রোহ ১৭৭৬-১৭৮৯ খ্রি. পর্যন্ত চলতে থাকে । অসম অস্ত্রের যুদ্ধে চাকমাগণ কৌশল অবলম্বন করে। আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ সেনাবাহিনী অগ্রসর হলেই চাকমা বিদ্রোহিগণ পরিবার পরিজন ও অস্থাবর সম্পদ নিয়ে গভীর জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করতো। ইংরেজরা চাকমাদের বাড়িঘর, গ্রাম, খেতের ফসল জ্বালিয়ে দিত। চাকমা বিদ্রোহিগণ বড় বড় গাছ কেটে পার্বত্য পথগুলোতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো। পার্বত্য গহ্বরের মুখে ফাঁত পেতে এবং পানীয় জল নষ্ট করে ইংরেজ সৈন্যদের অবরুদ্ধ করতো। অতঃপর বিদ্রোহিগণ গোপন আস্তানা থেকে বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করে সৈন্যদের হত্যা করতো। চাকমা বিদ্রোহিণ দীর্ঘ চৌদ্দ-পনেরো বছর ধরে বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। চাকমাদের বার বার বিদ্রোহের ফলে কোম্পানির শাসকরা বুঝতে সক্ষম হয়ে ইংরেজ ও ইজারাদাদের শোষণ-নিপীড়ন চাকমা বিদ্রোহের কারণ। ১৭৮৯ খ্রি. বঙ্গীয় সরকারের প্রধান বাণিজ্যকর্তা মি. হ্যারিস বিষয়টি অনুসন্ধান করে। রেভিনিউ বোর্ডের নিকট সুপারিশ করেন। সুপারিশে বলা হয়, ইজারাদারদের হাতে ন্যাস্ত পার্বত্য অঞ্চলে কার্পাসের একচেটিয়া বাণিজ্য প্রথা রহিত করে সরাসরি ঝুমিয়াদের বা চাকমা দলপতির সাথে বন্দোবস্ত করা উচিত। প্রস্তাব অনুযায়ী ১৭৮৯ খ্রি. জুন মাসে ইংরেজ শাসকগণ স্থির করেন যে, পার্বত্য অঞ্চলের ইজারাদার প্রথা রহিত করা হবে। কাপাস কর বাতিল করে চাকমা সর্দারদের সাথে পরিমিত জমা ধার্য করা হবে। উপরন্তু চাকমা দলপতিকে আশ্বাস দেওয়া হলো যে, নিয়মিত রাজস্বের অর্থ দিলে ভবিষ্যতে রাজস্ব বৃদ্ধি করা হবে না। এভাবে তিন পর্বের চাকমা বিদ্রোহের চূড়ান্ত পর্বের অবসান ঘটে ।
বাংলাদেশের বৃহত্তম উপজাতিক নৃগোষ্ঠী কোনটি?
উত্তর : চাকমা (২ লাখ ৫৩ হাজার)।
চাকমা সমাজের প্রধান কে?
উত্তর : চাকমা রাজা ।
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি' সংগঠনটি গঠন করেন কে?
উত্তর : কামিনী মোহন দেওয়ান (১৯১৭ খ্রি.)।
পার্বত্য চট্টগ্রামে জেলা গঠন করা হয় কবে ?
উত্তর : ১৮৬০ খ্রি.।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্কেল কতটি?
উত্তর : ৩টি (চাকমা, বোমাং এবং মাং সার্কেল)।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]