ইতিহাস কী বিজ্ঞান না সমাজবিজ্ঞান? ব্যাখ্যা কর ।

উত্তর ভূমিকা : নিজস্ব পদ্ধতি ও কলাকৌশলের মাধ্যমে ইতিহাস চর্চা পরিচালিত হয়। এজন্য ইতিহাসকে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান বলা যুক্তিসংগত। ঐতিহাসিকগণ মানুষের অতীত কর্মকাণ্ডকে গবেষণার একমাত্র বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচিত করে বিভিন্ন প্রক্রিয়া, পরীক্ষানিরীক্ষা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দ্বারা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করেন । আবার ইতিহাসের আলোচনার মূল বিষয় হলো সমাজ ও মানব সম্প্রদায়। এ অর্থে সমাজবিজ্ঞানের সাথে ইতিহাসের পাঠ্য সবকিছুরই গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাই অনেকেই ইতিহাসকে সমাজবিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত মনে করেন। জ্ঞান অনুশীলনে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানে লেনদেন অব্যাহত রয়েছে এবং এরা একে অপরের পরিপূরক বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন ।
ইতিহাস বিজ্ঞান না সমাজবিজ্ঞান : নিম্নে ইতিহাস বিজ্ঞান না সমাজবিজ্ঞান সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ক. ইতিহাসকে সমাজবিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা : ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে অনুষদগত ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও বিষয়
•দুটির প্রকৃতি ও বিষয়বস্তুগত ক্ষেত্রে অনেকটা অভিন্নতা লক্ষ করা যায়। প্রকৃতিগতভাবে বিষয় দুটি মানববিদ্যাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান কোনোটিতেই অলীক গল্প, রূপকথা, শোকগাথা ও সন্দেহপ্রবণতার স্থান নেই। বিশেষ করে উনিশ শতকের শুরু হতে ইতিহাস একেবারে তথ্যভিত্তিক ও প্রামাণ্যরূপে পরিগণিত হয়ে আসছে। ইতিহাসের সত্যতা নির্ণয় ও বস্তুনিষ্ঠতা একে সমাজবিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত করেছে। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান উভয়েই মানুষের জ্ঞানের পরিধিকে বর্তমানে আরও সম্প্রসারিত করেছে।
সমাজবিজ্ঞান মানুষের সামাজিকতাবোধ জাগ্রত করে এবং ইতিহাস অতীতের সামাজিক দায়িত্ববোধের চিত্র তুলে ধরে মানুষকে সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে পরোক্ষভাবে নির্দেশনা প্রদান করে। সমাজবিজ্ঞানকে যেমন ক্ষেত্র বিশেষে ইতিহাসের সামাজিক শাখার সাদৃশ্যতামূলক বিষয় রূপে মূল্যায়ন করা যায় তেমনি ইতিহাসের সামাজিক শাখা হতে আমরা অতীত সমাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অবহিত হতে পারি। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান উভয়ে সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করলেও ইতিহাস কাজ করে সমাজের অতীতকে নিয়ে এবং সমাজবিজ্ঞান সমাজের সমকালীন প্রেক্ষিতকে কেন্দ্র করে সামনের দিকে এগিয়ে চলে ।
আবার ইতিহাস রাজাবাদশা, সম্রাট-সুলতান ও রাজ্যের উত্থানপতনের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করে। কিন্তু সমাজবিজ্ঞান এসব বিষয়ের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ না করে; বরং ঘটনার আন্তঃমানবিক সম্পর্কের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। এর ফলে পণ্ডিত মহলে ইতিহাসকে সমাজবিজ্ঞান বলা হবে কী হবে না এ বিষয়ে বেশ জনপ্রিয় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে ।
খ. ইতিহাসকে বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা : ইতিহাস ও বিজ্ঞান দুটি ভিন্ন আঙ্গিকের বিষয় হলেও এদের মধ্যকার সম্পর্ক সম্পূর্ণ আলাদা নয়। ইতিহাস ও বিজ্ঞান একটি অপরটি দ্বারা কীভাবে পরিপুষ্ট হয় এবং ইতিহাসকে বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হবে কি না তা সম্পর্কিত বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হলো :
বিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত নেইবুর, লিওপোল্ড ভন র‍্যাংকে, জন বগনেল বিউরি, আলতুস হাক্সলি, অধ্যাপক টেগার্ট প্রমুখ ইতিহাসকে বিজ্ঞান বলার পক্ষপাতী ।
তাদের মতে, ঐতিহাসিক তত্ত্ব ও অনুসন্ধানের জন্য ঐতিহাসিককে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব ও অনুমান ছাড়া যেসব প্রক্রিয়া অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে তা হলো :
১. সব প্রাসঙ্গিক তথ্য বা তথ্যসমূহ আবিষ্কারের জন্য একটি অধ্যবসায়লব্ধ অনুসন্ধান পরিচালনা।
২. তথ্যসমূহ কতটুকু সত্য, মিথ্যা বা অনুমানসিদ্ধ তা যথাযথভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করা।
৩. তথ্যসমূহের বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করা ।
ইতিহাস যখন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আয়ত্ত ও অনুসরণ করে সত্যের অনুসন্ধানে নিয়োজিত থাকে, তখন তাকে প্রকৃত অর্থেই বিজ্ঞান বলা চলে। জ্ঞানের যে শাখা আমাদের কোনো সাধারণ মূলনীতি বা বিধান জোগাতে পারে না, তার বৈজ্ঞানিক প্রকৃতিকে অস্বীকার করা যায়। এ সম্বন্ধে মন্তব্য প্রসঙ্গে আলতুস হাক্সলি ১৯২৯ সালে প্রকাশিত তার 'Do As You Will' গ্রন্থে উল্লেখ করেন, "By science, I understand all knowledge that rests upon evidence and reasoning." অর্থাৎ, বিজ্ঞান বলতে তিনি যুক্তি ও প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল সব জ্ঞানকেই বুঝান। একথা সত্য পদার্থ বা রসায়ন যে অর্থে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ইতিহাস সে অর্থে বিজ্ঞান নয়। তবে পদার্থ, রসায়নবিজ্ঞানের গবেষণাও স্বীকৃত সত্য এবং ইতিহাসের গবেষণাও স্বীকৃত সত্য। তাই বৈশিষ্ট্যের জন্য পৃথক হলেও উভয়ের লক্ষ্য সার্বজনীন সত্যকে মানবসমাজের কাছে তুলে ধরা, সমালোচনা করা এবং বিশ্লেষণমূলক ।
আধুনিক ইতিহাস চর্চার শ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জন বগলেন ১৯৩০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বক্তৃতায় বলেন, "History is a sicence, no less and no more." অর্থাৎ, ইতিহাস একটি বিজ্ঞান, কমও নয়, বেশিও নয়। ঐতিহাসিকগণ সমাজস্থ মানুষের অতীত কর্মকাণ্ডকে গবেষণার বিষয়বস্তুরূপে নির্ধারিত করে বিভিন্ন প্রক্রিয়া, পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দ্বারা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে থাকেন। জ্ঞানানুশীলনের বিভিন্ন কলাকৌশলের ব্যাপক উন্নতি, অনুসন্ধানীদের নিরলস প্রচেষ্টা, ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্তকে ক্রমাগত সঠিক ও সত্যনিষ্ঠ করে তুলেছে। এদিক থেকে ইতিহাসকে বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করা যায় । . সাধারণ মতামত : ইতিহাস কী সমাজবিজ্ঞানের অংশ ইতিহাসকে সমাজবিজ্ঞানের অংশ বিবেচনা করা হবে কি না সে বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও দুই বিষয়ের বিষয়বস্তুর মধ্যে বেশ সাদৃশ্য রয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে জ্ঞানের এ বিষয় দুটি মানুষকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। ইতিহাস যেমন আমাদের অতীত কর্মকাণ্ডের তথ্যভিত্তিক ও প্রামাণ্য বিবরণ তুলে ধরে, সমাজবিজ্ঞান অনুরূপভাবে সমাজের উদ্ভব, বিকাশ ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের বস্তুনিষ্ঠ চিত্র অঙ্কন করে। ইতিহাসের মূল উপজীব্য বিষয় মানুষ, তার সমাজ ও সভ্যতা এবং সমাজবিজ্ঞানের মূল উপজীব্য বিষয় মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট সমাজ। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান উভয় বিষয়ই মানুষের ক্রিয়াকর্ম নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে প্রকৃত সত্য ও সভ্যতাকে তুলে ধরতে চেষ্টা করে। ইতিহাস যখন সাদামাটাভাবে বিবরণী পদ্ধতিতে অতীতকে তুলে ধরতে চেষ্টা করে তখন ইতিহাস শুধু কলা ও মানবিকবিদ্যার বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকে । কিন্তু ইতিহাস যখন ধারাবাহিক ও সময়ানুক্রমিকভাবে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে প্রামাণ্য অতীতকে তুলে ধরে তখন তা সমাজবিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও প্রামাণ্যভাবে অর্জিত সংশয় ও সন্দেহহীন সমাজব্যবস্থার পরিশুদ্ধ জ্ঞানই হলো সমাজবিজ্ঞান। ইতিহাসে যখন সত্যনিষ্ঠভাবে অতীত সমাজকে চিত্রণ ও বিশেষায়িত করে উপস্থাপন হবে এবং সে বিবরণ অবশ্যই প্রামাণ্য, সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল হয় তখন ইতিহাস সমাজবিজ্ঞানের সমর্থক হয়ে দাঁড়ায় । উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাসের বিষয়বস্তু, গবেষণা পদ্ধতি ও অনুসন্ধানিক কর্মের সাথে সমাজবিজ্ঞানের যথেষ্ট মিল বিদ্যমান । ইতিহাস মূলত সমাজবিজ্ঞানের একটি শাখা। সমাজবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো মানুষ ও তার সমাজ। ইতিহাস সমাজ ও মানুষ দুটি বিষয়কেই প্রাধান্য দেয়। তাই ইতিহাসকে বিজ্ঞানের চেয়ে সমাজবিজ্ঞানের অংশ রূপে বিবেচনা করাই সমীচীন হবে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]