ইতিহাস কী? ইতিহাসের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক আলোচনা কর ৷

উত্তর ভূমিকা : প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে অর্থনীতি ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে আসছে। আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থায় সমাজে সব সম্পদের অধিকারী ছিল ট্রাইব। ঐ সমাজের সুসম বণ্টনমূলক অর্থনীতিকে কেন্দ্ৰ করে সাম্যবাদী সমাজের ইতিহাস গড়ে উঠেছিল। এরপর নবোপলীয় যুগে মানুষ যখন সর্বপ্রথম কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সূচনা করে তখন থেকেই ইতিহাসের গতি প্রকৃতি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। এভাবে নবোপলীয় যুগ থেকেই অর্থনীতির সাথে ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূচনা হয় ।
ইতিহাসের সংজ্ঞা : ইতিহাস কী তা এককথায় বলা কঠিন। কারণ অনেক পণ্ডিতই ইতিহাস বিষয়ে নিজেদের মতো করে মত দিয়েছেন । তাই সহজেই একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় পৌছা যায় না। তবে পণ্ডিতগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতসমূহ বিশ্লেষণ করে ইতিহাসের একটি সাধারণ সংজ্ঞা তৈরি করা সম্ভব। অতীতে যা কিছু ঘটেছে সাধারণভাবে তাকেই ইতিহাস বলা হয় । কিন্তু অতীতের সবকিছুকেই ঢালাওভাবে ইতিহাস বলা যায় না। শুধুমাত্র অতীতের যেসব ঘটনাপ্রবাহ মানুষের দ্বারা নির্মিত ও সংঘটিত বলে জানা যায় তার সত্যনিষ্ঠ লিখিত বিবরণকেই ইতিহাস বলা যায় ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
ই. এইচ. কার (E.H. Carr) বলেন, “ইতিহাস হলো বর্তমান ও অতীতের মধ্যে এক অন্তহীন সংলাপ ।”
ঐতিহাসিক জনসন (Johnson) বলেন, “ঘটে যাওয়া ঘটনাই ইতিহাস। যা ঘটে না তা ইতিহাস নয়।”
,
ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস ( Herodutus) বলেন, “ইতিহাস হলো সত্যিকার অর্থে ছিল বা সংঘটিত হয়েছিল তা অনুসন্ধান করা ও লেখা ।”
আর্নল্ড টয়েনবির (Arnold Toynbee)মতে, “সমাজের জীবনই ইতিহাস। প্রকৃতপক্ষে মানবসমাজের অনন্ত ঘটনাপ্রবাহই হলো ইতিহাস ।'
র‍্যাপসন (Rapson) বলেছেন, “ইতিহাস হলো ঘটনার বৈজ্ঞানিক ও ধারাবাহিক বর্ণনা।”
আধুনিক ইতিহাসের জনক ও জার্মানি ঐতিহাসিক লিওপোল্ড ফন র‍্যাংকে (Leopold Von Ranke) মনে করেন, “প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিল তার অনুসন্ধান ও তার সত্য বিবরণই ইতিহাস।”
সুতরাং উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, ইতিহাস হচ্ছে মানব সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন & কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিক ও সত্যনিষ্ঠ বিবরণ । সঠিক ইতিহাস সবসময় সত্যকে নির্ভর করে রচিত হয়।
" ইতিহাসের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক : ইতিহাসের সাথে অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। নিম্নে ইতিহাস ও অর্থনীতির সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিরূপণ করা হলো :
১. অতীত অর্থনীতি বিশ্লেষণ : ইতিহাস গবেষণা করতে গিয়ে অতীত অর্থনীতির সংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। একজন ইতিহাসবিদ তার ইতিহাস সংশ্লিষ্ট আলোচনায় অর্থনীতি নামক বিষয়টি আলোচনায় আনতে পারেন ঠিকই কিন্তু বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাসহ নানা আঙ্গিকের বিশ্লেষণ করার জন্য ইতিহাসবিদকে অবশ্যই একজন অর্থনীতিবিদের দ্বারস্থ হতে হবে। কোনো সাহিত্যিক সূত্র, পর্যটনের বিবরণ বা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে অর্থনৈতিক কাঠামো ও জীবনব্যবস্থা সংক্রান্ত কোনো অনুমান করা হলে তার বিচারবিবেচনা ও বিশ্লেষণের জন্য একজন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে । ২. তথ্য যাচাই সংক্রান্ত : ইতিহাসে প্রাপ্ত অর্থনীতি সংক্রান্ত তথ্য ও এর সত্যাসত্য যাচাইবাছাই ও বিচারবিবেচনার ক্ষেত্রে একজন ইতিহাসবিদকে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হয় । ঐতিহাসিকের গবেষণা থেকে অতীতের অর্থনৈতিক কাঠামো সংশ্লিষ্ট এমন কিছু তথ্য বের হয়ে আসতে পারে যে তথ্যগুলোকে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে অবাস্তব ও ভিত্তিহীন মনে হতে পারে। তবে বিষয়টি বস্তুত যৌক্তিক না ভিত্তিহীন এই দায়ভার একজন ইতিহাসবিদের নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি তথ্যসূত্র হাজির করে একজন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে এ ব্যাপারে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন ।
৩. কৌশলগত : ইতিহাসে প্রাপ্ত তথ্যসূত্রের আলোকে অতীত অর্থনীতির কৌশলগত নানা দিক বিশ্লেষণ করতে গেলে- একজন ইতিহাসবিদের অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা থাকা অতি জরুরি। একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ঢালাও বিবরণ ইতিহাসে থাকতে পারে। তবে তা থেকে ইতিহাসের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কৌশলগত দিকে ইতিহাসবিদকে সহায়তা করতে পারেন একজন অর্থনীতিবিদ বা অর্থনৈতিক ইতিহাস ।
৪. অর্থনৈতিক কাঠামোগত : ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে যখন অতীতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন করার চেষ্টা করা হয় তখন একজন ইতিহাসবিদ তথ্যপ্রমাণ প্রাপ্তির পর তা বিশ্লেষণের জন্য অর্থনীতিবিদের পরামর্শ নিতে পারেন। একজন ইতিহাসবিদ অতীত পুনর্গঠনে যতটা পারদর্শী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি ততটা পারদর্শী নাও হতে পারেন। এ কাজে অর্থনীতিবিদের সম্পৃক্ততা অর্থনৈতিক ইতিহাসকে আরও বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সাহায্য করে।
৫. অর্থব্যবস্থা সংক্রান্ত : ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে অতীতকালের কোনো বিশেষ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে জানা যায়। উক্ত সংস্কারের জন্য কিছু বৈশিষ্ট্যসূচক তথ্য আমরা ইতিহাস থেকে পেতে পারি। এসব বৈশিষ্ট্য থেকে ঐ অর্থনৈতিক কাঠামোর সুষ্ঠু বিচারবিবেচনা করা একজন অর্থনীতিবিদের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি এক্ষেত্রে একজন ইতিহাসবিদের সাহায্য নিয়ে উপকৃত হন। এক্ষেত্রে ইতিহাসবিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাইবাছাই করে অর্থনৈতিক সংস্কার সম্ভবপর হয় ।
৬. অর্থনৈতিক বিবর্তনগত : প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত মানুষের অর্থনৈতিক কাঠামোর ধরন একরকম ছিল না। যুগের চাহিদার সাথে মিল রেখে এবং যুগের বিবর্তনের সাথে সংগতি রেখে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে নানা ক্ষেত্রে নানা আঙ্গিকে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বৃহৎ পরিসরে সংঘটিত অর্থনৈতিক কাঠামোর এই পরিবর্তন সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে গেলে একজন ইতিহাসবিদকে অর্থনীতিবিদের সাহায্য নিতে হবে ।
৭. মৌল অর্থনৈতিক সমস্যাগত : ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সৃষ্ট বিভিন্ন ধরনের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা চিহ্নিত করা যায়। এই বিষয়গুলোকে অবস্থানগত দিক থেকে যৌক্তিকতার নিরিখে দক্ষ বিশ্লেষণ করা কোনো ইতিহাসবিদের পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে একজন ইতিহাসবিদের গবেষণায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেন একজন অর্থনীতিবিদ ।
৮. ইতিহাসের পটপরিবর্তনে অর্থনীতি : অনেক সময় দেখা গেছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো বিস্তৃত ও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ইতিহাসের পটপরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। যেমন ইউরোপে শিল্পবিপ্লব ও উপনিবেশ সৃষ্টির প্রভাব পুরো বিশ্বের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ রদবদল করেছে। এই পটপরিবর্তনের পিছনে কী কী নিয়ামক প্রভাবশালী হিসেবে কাজ করেছে তার বিবরণ একজন অর্থনীতিবিদ খুব সহজেই দিতে পারেন ।
৯. বাণিজ্যিক সমৃদ্ধিসংক্রান্ত : ইতিহাস থেকে আমরা আরও দেখি মধ্যযুগে বাংলার সুলতানি আমলে একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। এই সময়ে বাণিজ্যের প্রসার ও মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতি বিকাশের বহু প্রমাণ হিসেবে বাংলাজুড়ে অগণিত টাকশাল ও টাকশালকেন্দ্রিক নগরী গড়ে উঠেছিল। কোনো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি নির্দিষ্ট রাজবংশের শাসনামলে এই সমৃদ্ধির কারণ বিশ্লেষণের জন্য একজন ইতিহাসবিদকে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকের সাহায্য নিতে হয় ৷ ১০. অর্থনৈতিক সমস্যাসংক্রান্ত : অর্থনৈতিক সমস্যার কারণ উদ্ঘাটনে ইতিহাসকে সহায়তা করে অর্থনীতি। আবার ইতিহাসও সমস্যা সমাধানে অর্থনীতিবিদদের জ্ঞান সমৃদ্ধি আনতে সহায়তা করতে পারে। যেমন— মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে রুপার মুদ্রার বদলে প্রতীকী তাম্রমুদ্রার প্রচলন সেই সময়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ সংক্রান্ত অর্থনৈতিক ইতিহাস ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাসের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মানুষের সব কর্মের মধ্যে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যই প্রধান । বর্তমানে ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবনসহ সব পর্যায়ে অর্থসম্পদ ও অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে। তাই অর্থনৈতিক ইতিহাস নামে ইতিহাসের একটি শাখাও সৃষ্টি হয়েছে। তবে এটি ভুলে গেলেও চলবে না যে, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু মৌলিক পার্থক্যের দরুন উভয়েই দুটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]