রংপুর কৃষক বিদ্রোহের পটভূমি (১৭৮৩ খ্রি.) প্রকৃতি নেতৃত্ব

রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.) Peasant Rebellion of Rangpur (1783)
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। এ বিদ্রোহ ছিল কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রথম ঐক্যবদ্ধ, স্বতঃস্ফূর্ত ও সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন, যার মাধ্যমে তারা কোম্পানি সরকারকে নতুন নীতিনির্ধারণ ও রাজস্ব নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করেছিল। এ বিদ্রোহ বাংলার পরবর্তী কৃষক আন্দোলনের পথ প্রদর্শন করে ।
রংপুর কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.)
অবিভক্ত বাংলার প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে রংপুরের কৃষক বিদ্ৰোহ বিশেষভাবে স্মরণীয়। বাংলার কৃষকেরা অত্যাচার অবিচার সবসময় নীরবে সহ্য করেনি। কোনো কোনো সময় তারা অত্যাচারীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। বাংলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে ‘রংপুর’ এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরের কৃষকগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এই বিদ্রোহের কারণ ছিল কোম্পানি সরকারের রাজস্ব নীতি এবং নতুন রাজস্ব নীতি বাস্তবায়নে কৃষকদের উপর অমানুষিক নির্যাতন। ব্রিটিশ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর অনুগত অনুচর দেবী সিংহকে রংপুর ও পুর্নিয়া জেলার রাজস্ব-ঠিকাদারি দিয়েছিলেন। দেবী সিংহ নানাভাবে অত্যাচার করে অত্যধিক কর আদায় করত। ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে দেবী সিংহকে দিনাজপুরের নাবালক রাজার দিওয়ান নিযুক্ত করা হয়। তিনি প্রজাদের উপর অধিক কর বসান এবং অমানুষিক অত্যাচার করে তাদের নিকট থেকে কর আদায় করতে থাকেন। হরেরাম নামক দেবী সিংহের একজন সহকারী ছিল এই অত্যাচারের প্রধান নায়ক। গরিব প্রজাগণ কর পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাদেরকে নির্মমভাবে বেত মারা হতো এবং আলো বায়ুহীন কোঠায় বন্দি করে রাখা হতো। দেবী সিংহের বর্বরোচিত অত্যাচার থেকে মহিলাগণও রেহাই পেত না। তারা পাশবিক অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার জন্য বহু প্রজা বাড়িঘর ছেড়ে বনে জঙ্গলে পালিয়ে যেত। প্রজারা দেবী সিংহের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জেলা কালেক্টরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কিন্তু তাতে কোনো ফল লাভ হয় না। দেবী সিংহ অতিরিক্ত রাজস্ব প্রদানের শর্তে ইজারা নিয়েছিলেন। কাজেই তার কার্যের জন্য ইংরেজ কোম্পানির সমর্থন ছিল। ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের সমর্থনেই দেবী কৃষকদের উপর অত্যাচার চালায় ।
রংপুরে দেবী সিংহের অত্যাচার চরমে উঠলে কৃষকেরা আত্মরক্ষার জন্য সংঘবদ্ধ হতে থাকে এবং ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর ও রংপুরের হিন্দু-মুসলমান কৃষকগণ দেবী সিংহের দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কুচবিহারের কৃষকগণও তাদের সঙ্গে যোগদান করে। বিদ্রোহ প্রথম শুরু হয় কাজির হাট, কংকনিয়া ও টেপায়। পরে তা অন্যান্য জায়গায়ও ছড়িয়ে পড়ে। নূরলদীন নামক জনৈক ব্যক্তি এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। বিদ্রোহী কৃষকগণ তাদের নেতাকে ‘নবাব' উপাধিতে ভূষিত করে এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। বিদ্রোহের ব্যয় নির্বাহের জন্য ‘ডিঙ্গাবাচা’ নামক এক প্রকার কর আদায় করা হতো। জয়দুর্গা নাম্নী একজন মহিলা জমিদার বিদ্রোহী কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনিও কৃষকদের এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন । বিদ্রোহের ফলে দেবী সিংহের গোমস্তরা মফঃস্কলে পলায়ন করে। তাদের কয়েকজন বিদ্রোহীদের হাতে ধৃত ও নিহত হয়। এভাবে রংপুরে প্রতিরোধ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে
রংপুরে কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন ভীষণ আকার ধারণ করলে তা দমনের ব্রিটিশ সরকার সেনাবাহিনী নিয়োগ করে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে সৈন্যদের কয়েকটি সংঘর্ষ হয়। মুঘল হাট নামক স্থানে এক প্রচণ্ড যুদ্ধে বিদ্রোহী কৃষকদের পরাজয় হয় এবং তাদের নবাব উপাধিধারী নেতা আহত অবস্থায় বন্দী হন। ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহী কৃষকদের সঙ্গে ব্রিটিশ সৈন্যদের পাটগ্রাম নামক স্থানে আরও একটি যুদ্ধ হয় । লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোরাল্ড এ যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যদের নায়কত্ব করেন। পাটগ্রাম যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর কামানের সামনে বিদ্রোহী কৃষকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং আরও অনেকেই হতাহত হয়। এরপর এ বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধানের জন্য যে সরকারি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়, তাতে দরিদ্র প্রজাদের উপর কিভাবে উৎপীড়ন করে ন্যায্য খাজনা ছাড়াও অতিরিক্ত কর আদায় করা হতো এবং তার ফলে প্রজাদের চরম দুর্দশার কাহিনী পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত হয়েছে। বিলেতে পার্লামেন্টে যখন ওয়ারেন হেস্টিংসের বিচার হয় তখন কৃষক নির্যাতনের ঘটনাও পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত হয়েছে। বিলেতে পার্লামেন্টে যখন ওয়ারেন হেস্টিংসের বিচার হয় তখন এডমান্ড বার্ক ( Edmund Bruke) অপূর্ব বাগ্মিতা সহকারে দেবী সিংহের অত্যাচার বর্ণনা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, “পৃথিবীর ওপারে ওয়েস্ট মিনিস্টার হলে দাঁড়াইয়া এডমান্ড বার্ক সেই দেবী সিংহকে অমর করিয়া গিয়াছেন। পর্বতোদগীর্ণ অগ্নিশিখাবৎ জ্বালাময় বাক্যস্রোতে বার্ক দেবী সিংহের দুর্বিষহ অত্যাচার অনন্তকাল সমীপে পাঠাইয়াছেন। তাঁর নিচ মুখে সে দৈববাণীতুল্য বাক্য পরস্পরা শুনিয়া শোকে অনেক স্ত্রীলোক মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছিল। আজও শত বৎসর পরে সেই বক্তৃতা পড়িতে গেলে শরীর রোমাঞ্চিত এবং হৃদয় উন্মত্ত হয়। সেই ভয়ানক অত্যাচার বরেন্দ্র ভূমি ডুবাইয়া দিয়াছিল।” যাহোক তদন্তের পর দেবী সিংহকে দিনাজপুরের জমিদারির ম্যানেজারের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। ব্রিটিশ সরকার সারা রংপুর জেলার রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কৃষক বিদ্রোহের পাঁচজন নেতাকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়। এভাবে ব্রিটিশ সরকার রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ দমন করে ।
রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ বাংলার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। শান্তিপ্রিয় বাংলার কৃষকগণ যে নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন তা এই বিদ্রোহ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। এই বিদ্রোহের আদর্শই পরবর্তীকালে বাঙালিদের প্রতি ইংরেজদের নানা অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে প্রেরণা যুগিয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকরা বৃহত্তর পরিসরে আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে ।
রংপুর কৃষক বিদ্রোহের পটভূমি
বাংলা তথা ভারতবর্ষে মুঘলদের ছিল একটি প্রধানত কৃষিভিত্তিক সাম্রাজ্য । তার অধীনে ছিল প্রধান উৎপাদকগোষ্ঠী হিসেবে রায়তশ্রেণি, যারা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিশেষ অধিকার ভোগ করতো। কিন্তু মুনাফা শিকারি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র দুঃসময়ে খাজনা মওকুফ এবং তাকাভি ঋণের মতো কোনো সুযোগ সুবিধা ব্যতিরেকেই কৃষকের সকল উদ্বৃত্ত আত্মসাতে বদ্ধপরিকর ছিল। সেই সাথে সরকারে ভূমিনীতি প্রজাদেরকে সরকারি প্রতিনিধি বা ভূস্বামীদের শোষণের শিকারে পরিণত করে। কৃষক সমাজ বিভিন্ন সময়ে এদের বিরুদ্ধে এবং এদের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। প্রচলিত হার অগ্রাহ্য করে যুক্তিহীনভাবে খাজনার বৃদ্ধিকরণ এবং কৃষিশ্রম শোষণই ছিল ১৭৮৩ সালের রংপুর কৃষক বিদ্রোহের মূল কারণ। বাংলার কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে রংপুর ছিল একটি সূতিকাগার ও কিংবদন্তি। প্রাক ব্রিটিশ আমলেও এখানে অনেক কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের শোষণ এবং তাদের এদেশীয় বা স্থানীয় প্রতিনিধিদের অত্যাচারও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের বিদ্রোহ ছিল যে কোনো বিচারে বৃহত্তর সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম। মুঘল শাসনের পূর্বে রংপুর ছিল বর্তমান ভারতের কোচবিহার রাজ্যের অধীনে। আমাদের জানা মতে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে (১৬৮৭ খ্রি.) রংপুর স্থায়ীভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। মুঘলরা রংপুর দখল করে এখানকার ভূমি পূর্ববর্তী ভূমধ্যকারীকে ‘চৌধুরী’ খেতাব প্রদান করে বন্দোবস্ত দেন। এ সময়ে চৌধুরীদের ভূমিকা ছিল তহশিলদারদের মতো, কেবলমাত্র রাজস্ব সংগ্রহে সীমিত । ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ রীতি প্রচলিত ছিল। ১৭৬৫ খ্রি. পর কোম্পানি সরকার প্রবর্তিত নতুন রাজস্ব নীতির ফলে রংপুর বিদ্রোহের পটভূমি সূচিত হয় ।
ব্রিটিশ কোম্পানি সরকার ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মহান দেওয়ানি লাভ করে রাজস্ব ধার্য ও আদায়ে যে পরীক্ষানিরীক্ষা চালায় তা বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতো রংপুরেও ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। এই ব্যর্থতার জন্য অন্যান্য কারণ ব্যতীত রংপুরে ‘শারাফ’ নামক স্থানীয় ব্যাংক ব্যবসায়ীদের অবলুপ্তি এবং 'নাকাদ' বা রেশম চাষিদের রাজস্ব প্রদান হতে অব্যাহতির নীতি দায়ী ছিল। এই ‘শারাফ' পদ্ধতির অবসান কৃষককে দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রথমত; এ সময়ে বাজারে দুই শ্রেণির মুদ্রা যেমন- নারায়ণি, ফরাসি আর্কট মুদ্রা প্রচলিত ছিল। নারায়ণি মুদ্রা ছিল স্থানীয় মুদ্রা এবং নিম্নমানের। আর আর্কট ছিল বাণিজ্য মুদ্রা। এই দুই মুদ্রার মূল্যমান বা বিনিময় হার নির্ধারণ করতেন শারাফরা । বাংলার কোনো কোনো স্থানে এদেরকে পোদ্দারও বলা হতো। ফলে শারাফ শ্রেণির এই অবলুপ্তি কৃষক সম্প্রদায়কে মুদ্রা সম্পর্কিত বিভ্রান্তিতে ফেলে এবং পরিবর্তিত মুদ্রানীতি কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয়ত; বাণিজ্যিক স্বার্থে কোম্পানি সরকার রংপুরের ‘নাকাদ’ বা রেশমচাষিদের বিভিন্ন সেস প্রদান হতে অব্যাহতির বিধান প্রবর্তন করেন। ফলে বহু সংখ্যক কৃষক চাতুরীর মাধ্যমে নাকাদ হিসেবে আত্মপরিচয়ে এই সুযোগ গ্রহণে তৎপর হয়ে ওঠে। এতে অবশিষ্ট রায়তের উপর নির্ধারিত রাজস্বের অঙ্ক সমান্তরাল চাপ বৃদ্ধি করে। এতে রংপুর কৃষক বিদ্রোহের পটভূমি তৈরি হয় ।
১৭৭২ হতে ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে বাংলার অন্যান্য স্থানের অনুরূপ রংপুরেও পাচঁসালা এবং ১৭৭৮ হতে ১৭৮০ পর্যন্ত বাৎসরিক বন্দোবস্তের নীতি অনুসৃত হয়। এ সময়কালে ভূমি বন্দোবস্ত পেতেন মূলত প্রাক্তন জমিদারেরা। কিন্তু এই রীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে কোম্পানির সরকার ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে কামালউদ্দিন হোসেন নামক এক ব্যক্তিকে দুই বছরের জন্য রংপুর জমিদারি ইজারা দেন। এর পশ্চাতে মূল উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির রাজস্ব আয় বৃদ্ধি। দেবী সিংহ ছিলেন এই ইজরা বন্দোবস্তের প্রতিভূ এবং প্রকারান্তরে কার্যত ইজারাদার। কে এই দেবী সিংহ? তিনি ছিলেন পাঞ্জাবের অধিবাসী । ভাগ্যান্বেষণে এক সময় তিনি মুর্শিদাবাদের এসে উপস্থিত হন। রেজা খানের অনুগ্রহে দেবী সিংহ প্রথম পুর্নিয়ার রাজস্ব আদায়ের ইজারা লাভ করেন। পুর্নিয়ার রাজস্ব ছিল ৬ লক্ষ টাকা। দেবী সিংহ ১৬ লক্ষ টাকায় ইজারা লাভ করেন। ইজারা প্রাপ্তির পর পরই প্রজাদের উপর শুরু হয় বাড়তি রাজস্বের জন্য অত্যধিক অত্যাচার ও নিপীড়ন। অবস্থা বেগতিক দেখে কোম্পানি সরকার তাকে পদচ্যুত করেন। পদচ্যুত দেবী সিংহ গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসকে মোটা অঙ্কের ঘুস ও উপঢৌকন দিয়ে মুর্শিদাবাদে প্রাদেশিক রেভেন্যু বোর্ডের সহকারী কর্মাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এ পদে আরোহনের সুবাদে তিনি প্রভূত সম্পদের মালিক হন। কিছু দিনের মধ্যেই সরকার তা উপলব্ধি করতে পারেন । হেস্টিংস রেভেন্যু বোর্ড বিলুপ্ত করেন। এর পর দেবী সিংহ, হেস্টিংস কর্তৃক রংপুর- দিনাজপুর অঞ্চলের ইজারাদার এবং এক হাজার টাকার পারিশ্রমিকে দিনাজপুরের নাবালক রাজার (১৭৮১) দেওয়ান নিযুক্ত হন। কামাল উদ্দিন হোসেনের ইজারার মেয়াদ শেষে দেবী সিংহ অধিক বর্ধিত সদর জমায় জমিদারিসমূহ বন্দোবস্ত নিতে ইজারাদারদেরকে বাধ্য করেন। ইজারাদারগণ চুক্তি মোতাবেক রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হন। ফলে রাজস্বের একটি বড় অংশ অনাদারি থেকে যায়। এ অবস্থাকে সরকারি নথি পত্রে জমিদারি পরিচালনায় অব্যবস্থা এবং বহিষ্কৃত ও হতাশাগ্রস্ত জমিদারদের প্ররোচনায় রংপুরের কৃষকগণ রাজস্ব প্রদান হতে বিরত থাকেন মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জমা বৃদ্ধির বিষয়টিই ছিল কৃষকদের রাজস্ব প্রদান না করার অন্যতম কারণ। রাজস্ব বৃদ্ধির ফলে জমিদার ও কৃষক উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরও উল্লেখ্য যে, দেবী সিংহের নতুন ভূমিব্যবস্থায় জমিদারদের স্বাধীন মর্যাদায় আঘাত হানে। কোম্পানির সাথে প্রত্যক্ষ বন্দোবস্ত গ্রহণের পূর্বে জমিদারদের অবস্থা ও পদ মর্যাদা যাই থাকুক না কেন, ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রদত্ত প্রত্যক্ষ বন্দোবস্তে তারা কমবেশি স্বাধীন ছিল। কিন্তু দেবী সিংহের তত্ত্বাবধানে ভূমি বন্দোবস্ত ছিল অনেকাংশে পরাধীনতা ও আর্থিক ক্ষতির কারণ যা জমিদারগণ মেনে নিতে পারেনি। শেষে তারাই প্রধূমিত কৃষক অসন্তোষকে বিদ্রোহে রূপায়ণে ইন্ধন যোগায়। অথচ সমকালীন সরকারি বিবরণীতে রংপুরের জমিদারদের অক্ষমতা ও গোমস্তা নির্ভরতাকে রাজস্ব আদায়ের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হয়েছে ।
১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের রংপুর বিদ্রোহের কারণ ছিল কোম্পানির ভূমি-রাজস্ব বন্দোবস্ত প্রসূত অসন্তোষ ও অত্যাচার। এই বিদ্রোহে কৃষক সম্প্রদায়ের সাথে প্রাক্তন ও নতুন উভয় জমিদারশ্রেণি অংশ নিয়েছিল। জমিদারদের মধ্যে প্রধান প্রধান অভিযোগ ছিল, ক) মাত্রাতিরিক্ত জমা বৃদ্ধি, খ) বর্ধিত জমায় ভূমি বন্দোবস্তে বাধ্যকরণ এবং বাকি রাজস্বের জন্য জমি কেড়ে নেওয়া, গ) সদর জমার উপর অবৈধ কর-উপকর আরোপ, ঘ) মুদ্রা সম্পর্কিত জটিলতা, ঙ) রাজস্ব আদায়ে শারীরিক অত্যাচার। এই সবগুলো উপসর্গ ছিল রাজস্ব সংক্রান্ত। ফলে রাজস্ব বৃদ্ধির বিষয়টি ছিল একটি সাধারণ অসন্তে াষ। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে ডিহি জুমতালের সদর জমা ছিল ২৯,২২৫ টাকা। কিন্তু ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ পরের বছর এই অঞ্চলের সদর জমা পুনঃনির্ধারিত হয় ৩২,৭৫৫ টাকা। রাজস্ব বৃদ্ধি এবং একই সময় বিভিন্ন কর ও উপকর আরোপ চলমান অবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে। এছাড়া ‘শারাফ’ পদ্ধতির অবসানে জমিদার কৃষকদের উপর চাপ প্রয়োগ বাধ্য হয়। এর ফলে কৃষক শ্রেণি অসময়ে অবৈধ চাপে অসুবিধাজনক শর্তে ফসল বিক্রয়ে বাধ্য হয়, দ্বিতীয়ত; সিক্কা টাকার তুলনায় নারায়ণি মুদ্রার মূল্যমান মারাত্মকভাবে হ্রাস পায় এমনকি শতকরা ১৫-২০ ভাগ বাট্টা দিতে হয়। প্রচলিত মুদ্রার বাট্টা ও ওজন ঘাটতি রংপুরের কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। Report of the Rangpur Commission-এ ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে দেবী সিংহের খাজনা প্রাপ্তিতে গৃহীত বাট্টা এবং ওজন ঘাটতির পরিসংখ্যান ছিল নিম্নরূপ:
সুতরাং এটা প্রমাণিত যে, প্রচলিত নারায়ণি মুদ্রাকে আকর্ট মুদ্রায় রূপান্তরিত
করতে মাত্রাতিরিক্ত বাট্টা ও মুদ্রার ওজন ঘাটতিতে প্রচুর অর্থ দাবি জমিদার ও কৃষক উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।
উপর্যুক্ত সারণি হতে এটা প্রমাণিতে যে, কাজীর হাট তালুকের রাজস্ব প্রশাসনের ক্ষেত্রে ইজারাদার ৫৯-০-১০-০ পরিমাণ অর্থ হ্রাস করলেও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন খাতে বর্ধিত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ২৯৮-৪-১০-০ টাকা। সুতরাং বর্ধিত দাবি ছাড়া ও বিভিন্ন কর ও উপকর আরোপ এবং এসব অর্থ আদায়ের জন্য অত্যাচারের আশ্রয় নেওয়া হতো, যা ছিল ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম কারণ । এছাড়া ও জমিদারদের বদান্যতার সুযোগে কৃষকদের উপর আরোপিত খাজনার টাকা প্রতি ১/২ টাকা দেরিন ভিল্লা (Derinwilla), রসুম (কতকগুলো উপকরের সম্মিলিতরূপ) হুন্ডিয়ানা (Hundian) (হুন্ডির মাধ্যমে রাজস্ব প্রেরণ খরচ), ফেরারি, সেবনিরোজ (দৈনন্দিন আয়) এছাড়াও বিভিন্ন প্রকারের চাঁদা, ফরমাইস, পিয়ন খরচ, কারবারি, ইনাম, ডাকখরচ, হাঙ্গামা খরচ, দানখরচ, ফাত্ততি, সিজুয়াল খরচ, সাগরেদ পোষা, মেহমানি, নজরান বা সেলামি ইত্যাদি অননুমোদিত উপকর আদায় কৃষককে বিদ্রোহী করে তোলে। এমনকি মৃত জমিদারের শ্রাদ্ধের জন্য অর্থও কৃষকদের নিকট হতে আদায় করা হতো ।
এমতাবস্থায় জমিদারদের বর্ধিত হারে রাজস্ব দাবি এবং অস্তিত্ব সংকট থেকে উত্তরণের জন্য অবৈধ উপকর দাবি অন্যদিকে কৃষকদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা মারাত্মক ও এক অসহ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এ অঞ্চলে মহাজনগণ এত দিন ছিল জনসাধারণের সেবক। দেবী সিংহের অত্যাচারের ফলে মহাজনশ্রেণির ও কৃষকদের সর্বস্ব গ্রাস করতে উদ্ধত্য হলো। কৃষকরা দেবী সিংহের অত্যাচারের কবল হতে নিষ্কৃতি লাভের আশায় মহাজনদের নিকট হতে জমিজমা বন্ধক রেখে ঋণ নিল। এই ঋণ প্রতিদিন চক্রবৃদ্ধি হারে স্ফীত হয়ে কৃষককে জমিহারা গৃহহারা করল। মহাজন বিপন্ন কৃষকের নিকট হতে শতকরা ছয় থেকে আট টাকা সুদ আদায় করেছিল। একদিকে দেবী সিংহের অত্যাচার অন্যদিকে কুসীদজীবীদের অমানবিক শোষণ-উৎপীড়নে নিরীহ কৃষক প্রজা প্রতিনিয়ত মুক্তিপাগল হয়ে ওঠে। আফিম উৎপাদনের জন্য গৃহীত অগ্রিম অর্থ পরিশোধের পর কৃষক নিঃস্ব হয়ে যায়। এই অবস্থায় অধিকাংশ কৃষক কর্তৃক উৎপাদিত তামাকের বাজারদর মারাত্মকভাবে কর্মে গেলে কৃষি অর্থনীতি ও সমগ্র বাজার ব্যবস্থায় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। ফলে উৎপাদিত এই মৌলিক সমস্যাটি কৃষকদের প্রাত্যহিক জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ অবস্থায় জীবিকানির্বাহ ও বর্ধিত রাজস্ব দাবি পুরণে কৃষক হয়ে পড়ে সম্পূর্ণভাবে নিঃস্ব এবং প্রাণ বাঁচানোর জন্য জমি-জমা, চাষাবাদের প্রযুক্তিসহ স্ত্রী-পুত্র- কন্যা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। উপর্যুক্ত পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ের জন্য রায়তদের ভূমি দখল করে অর্ধেক মূল্যে বিক্রয় ইত্যাদি কার্যক্রম বাজারে বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য হ্রাসের সহায়ক হয়। এরই ফলে কৃষক তার উৎপাদিত দ্রব্যাদির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দ্বারা দেবী সিংহের বর্ধিত রাজস্ব দাবি মেটাতে ছিল অপারগ। ফলে রায়তদের দলবদ্ধভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কৃষকদের অবস্থা সম্পর্কে দেবী সিংহ নিজেই লিখেছেন যে, এটি অত্যন্ত বিড়ম্বনার বিষয় যে, বাংলার অন্যান্য স্থান অপেক্ষা রংপুর প্রদেশের কৃষকদের মধ্যেই অধিক খাদ্যাভাব লক্ষণীয় ।
১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমে কৃষ্ণ প্রসাদ এবং পরে হরেরাম ছিলেন দেবী সিংহের রংপুরের রাজস্ব এজেন্ট। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে হরেরামকে অপসারণ করে সূর্যনারায়ণকে নিয়োগ করা হয়। এদের অত্যাচারে সে সময় রংপুরে জমিদার ও কৃষকদের হৃদকম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। রাজস্ব ও অন্যান্য দাবি আদায়ের জন্য কৃষকদের উপর যে অবর্ণনীয় ও অমানবিক অত্যাচরের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল তা ছিল বিদ্রোহের আশু ও প্রত্যক্ষ কারণ । এই অত্যাচারের পদ্ধতিগুলো ছিল স্থানীয় ও অদ্ভুত প্রকৃতির।
Narahari Kaviraj - তার A Peasant uprising in Bengal গ্রন্থে দশ প্রকারের শাস্তির বিবরণ দিয়েছেন। কৃষক সম্প্রদায়ের উপর রাজস্ব আদায়ের জন্য যে সীমাহীন অত্যাচার করা হয়েছিল এ ক্ষেত্রে বিদ্রোহ ছিল তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য একমাত্র পথ। এরূপ পরিস্থিতিতে ভূমি মালিকগণ দেবী সিংহ ও কোম্পানি বাহাদুরের বিরুদ্ধে নির্যাতিত রায়তদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন। সাধারণ প্রজাদের বর্ধিত হারে রাজস্ব দিতে নিষেধ করা হয়, এর ফলে উৎসাহী প্রজারা দেবী সিংহকে কোনো প্রকার রাজস্ব প্রদান করেনি এবং সেই সাথে তাকে রংপুর ও দিনাজপুর অবাঞ্চিত (Undesirable) ব্যক্তি ঘোষণা করা হয়। এ ভাবেই রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.) এর পটভূমি রচিত হয় ।
রংপুর কৃষক বিদ্রোহের মৌলিক বিষয়
বাংলার কৃষক বিদ্রোহগুলো পর্যালোচনা করলে বিদ্রোহ সংগঠনে চারটি মৌলিক বিষয় লক্ষণীয়। এই বিষয়গুলো হলো পরামর্শ, পরিকল্পনা, সমাবেশ ও আক্রমণ । রংপুর কৃষক বিদ্রোহেও এই চারটি বিষয় পরিষ্কারভাবেই লক্ষ করা যায়। রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ অত্যাচারিত কৃষকগণ প্রথমে অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘ঢিং' বা বিদ্রোহ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন এবং পরে স্থানীয় প্রভাবশালী বসনিয়া বা গ্রাম প্রধান ও পূর্বের ইজারাদারদের সাথে পরামর্শ করে ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহের ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য বসনিয়া ও সাধারণ কৃষকদের এই বিদ্রোহ একীভূত করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। এই বিদ্রোহে বসনিয়াদের অংশগ্রহণ অনেকটা স্বেচ্ছাধীন রেখে বিদ্রোহীদের পক্ষ হতে বক্তব্য পেশ করা হয় যে, কৃষকদের উপর আস্থাবান হলে বসনিয়াগণ ‘ঢিং’ এ যোগদান করতে পারেন। অন্যদিকে এই বিদ্রোহে সাধারণ কৃষকদের যোগদানের জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ মর্মে এ বিদ্রোহকে কৃষক নেতৃত্বে সংঘটিত প্রথম বিদ্রোহ বলা যেতে পারে। ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারি মাস হতেই রংপুরের কৃষকগণ বিদ্রোহের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। রংপুরের কালেক্টর রিচার্ড গুড ল্যাড যথা সময়ে এ তথ্য কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। এ সময় কৃষকগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল মূলত দেবী সিংহের বিরুদ্ধে, যদিও পরবর্তীকালে এই ক্ষোভ কোম্পানির প্রশাসন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। প্রধূমিত কৃষক অসন্তোষের পটভূমিতেও দেবী সিংহের সুহৃদ রিচার্ড গুডল্যাডের সুপারিশ ছিল ইজারাদারদের পক্ষে এবং কৃষক শ্রেণির বিপক্ষে, যা ছিল প্রজ্বলিত বহিতে ঘি দেওয়ার শামিল। যা হোক, রংপুরে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহের প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে বামনডাঙ্গা ও টেপা পরগনার যথাক্রমে বিদলাতুর ও কোরনার সোনা গ্রামে। একটি যৌথ পরিকল্পনার মাধ্যমে এই দুই অংশের কৃষকগণ সমবেতভাবে কাইমারীর দিকে অগ্রসর হন। এ সময় তাদের নেতৃত্ব প্রদান করেন ধীরাজ নারায়ণ, যাকে বিদ্রোহী কৃষকগণ “নবাব' মনোনীত করেন। নেতার প্রতি আনুগত্যের সনাতন পদ্ধতির অনুকরণে বিভিন্ন স্থান হতে আগত বহুসংখ্যক কৃষক তাদের নেতা ধীরাজ নারায়ণ ও কেনা সরকারকে নজরানা ও উপহার প্রদান করেন এবং ইজরাদারদের কোনো প্রকার রাজস্ব প্রদান না করার শপথ নেন ৷
রংপুরের কৃষক বিদ্রোহের রূপরেখা
বিদ্রোহী কৃষকদের একটি অংশ শালমারী ও কাকিনা পরগনায় পৌঁছে সেখানে রাজস্ব প্রদান না করার জন্য আটককৃত কৃষকদের মুক্ত করেন। একই সাথে তারা ইজারাদারদের কাচারি আমলাকে অপহরণ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে কৃষকগণ কাজীর হাট পরগনার কিশোরগঞ্জে কাচারি আক্রমণ করেন। যেখানে তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজস্ব আদায়ে অত্যাচারী শেখ মুহাম্মদ মোল্লা। বিদ্রোহী কৃষকগণ শেখ মুহাম্মদ মোল্লাকে না পেয়ে তাঁর কাচারি ভস্মীভূত করে। মোল্লার সহযোগী রামকান্ত ও শ্যাম চৌধুরীকে বন্দি করে, এবং এই কাচারিতে আটককৃত জমিদার ও কৃষকদের মুক্ত করে। প্রকৃতপক্ষে কিশোরগঞ্জ কাচারি আক্রমণ ছিল কৃষকদের বৃহত্তর আক্রমণের ইঙ্গিতবহ । বিদ্রোহী কৃষকদের পরবর্তী লক্ষ ছিল কাজীর হাটের কালিকাপুরের গোবিন্দরামের কাচারি যেখানে নৃশংস ও পৈশাচিক গোমস্তা গৌরীমোহন অবস্থান করেন ৷ প্রায় দশ হতে বারো হাজার বিদ্রোহী কৃষক কোটালিয়ায় সমবেত হয়ে ডিমলা অভিমুখে অগ্রসর হয়। নবাব ধীরাজ নারায়ণ একখানা পালকীতে বিদ্রোহীদের অনুবর্তী হন। অন্যদিকে গৌরীমোহন চৌধুরী তাঁর নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য ষাট জন বরকন্দাজ নিযুক্ত করেন। বরকন্দাজদের গুলিবর্ষণে তিনজন কৃষক নিহত এবং ছয়জন আহত হয়। কৃষকগণ ডিমলা কাচারি আক্রমণ করে গোমস্তা গৌরীমোহন চৌধুরীকে ধরে নবাব ধীরাজ নারায়ণের নিকট নিয়ে আসে এবং তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই পরিস্থিতিতে কৃষকগণ ভবানীগঞ্জে কোম্পানির গোলা লুট করে।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা লক্ষ করে কালেক্টর রিচার্ড গুডল্যাড কৃষকদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। এ পর্যায়ে কৃষকগণ কালেক্টরের নিকট চারটি দাবি উত্থাপন করেন। ১) দেরিন ভিল্লার অবসান; ২) রাজস্ব প্রদানে নারায়নি মুদ্রা গ্রহণ; ৩) কর্তণী ও হুন্ডিয়ান নামক অবৈধ উপকর আরোপ বন্ধ করা; ৪) কিস্তি রশিদ হতে ফেরারি নামক আরোপিত উপকর বিলুপ্ত করা । এছাড়া বিদ্রোহী কৃষকগণ দু'বছরের জন্য রাজস্ব স্থগিত রাখার প্রস্তাব করেন। রিচার্ড গুডল্যাড কৃষকদের অন্যান্য শর্তাবলি মেনে নিলেও দু'বছরের জন্য খাজনা আদায় স্থগিত রাখার দাবিটি অনুমোদন করেননি। এতদসত্ত্বেও বিদ্রোহী কৃষকদের নেতা নবাব ধীরাজনারায়ণ কালেক্টরের গৃহীত পূর্বোক্ত শর্তানুযায়ী কৃষকদের স্ব-স্ব গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য করেন। কিন্তু কালেক্টরের কথায় ও কাজে গড়মিলের ফলে পনুরায় বিদ্রোহ লক্ষ করা যায়। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কানসাটে অনরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। রাজস্ব আদায়ে পূর্বে প্রত্যাহৃত ব্যক্তিদের পুনরায় নিয়োগ করা হয়, যারা পুনরায় অবৈধ উপকরসমূহ আদায়ের চেষ্টা করেন। শেখ মুহাম্মদ মোল্লা কাজীর হাট, রাম দুলাল ভট্টাচার্য কাকিনা ও গোকুল মেহতা টেপা পরগনায় পুনরায় রাজস্ব আদায়ের জন্য নিয়োজিত হন। ফলে কৃষকগণ রিচার্ড গুডল্যাডের প্রতি তথা কর্তৃপক্ষের নিশ্চয়তার প্রতি তাদের আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং মনে করে যে আবেদন নয়, শক্তিই তাদের সম্বল ।
ফলে পরবর্তী কৃষক বিদ্রোহ আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিদ্রোহী কৃষকগণ কাকিনা ও টেপাকে কেন্দ্র করে তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখে । রাম দুলাল ভট্টাচার্য কাকিনায় পুরানো হারে রাজস্ব আদায়ের জন্য গেলে ক্ষিপ্ত তিন চার হাজার কৃষক ঐক্যবদ্ধভাবে কাকিনা কাচারি আক্রমণ করে। এই সময় রাম দুলালের সাহায্যে প্রেরিত কোম্পানির একদল সৈন্যের সাথে বিদ্রোহী কৃষকদের মুখোমুখি সংঘর্ষে কৃষকগণ সমবেত হয়ে ফরমান বাড়ি কাচারি আক্রমণ করে। এ সময় ইজারাদারের প্রতিনিধি মানিক চাঁদ বিদ্রোহী কৃষকদের দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে (এ প্রতিশ্রুতি কখনো মানা হবে না তা কৃষক শ্রেণি বুঝতে অপারগ ছিল) বিদ্রোহ আর অধিক প্রসারিত হয়নি ।
অনুরূপভাবে গোকুল মেহতা বেশি কিছু অশ্বারোহী সৈন্য ও বরকন্দাজসহ টেপায় রাজস্ব আদায়ে ব্যাপৃত হলে সেখানেও কৃষকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থায় কৃষকগণ ঐক্যবদ্ধ হয় এবং কেনা সরকারকে ‘নবাব' ও রাম প্রসাদকে ‘সর্দার’ বা ‘দেওয়ান' নিযুক্ত করেন। ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ ফেব্রুয়ারি টেপার বাজারের নিকট উভয় পক্ষই সশস্ত্রভাবে সমবেত হয়। গোকুল মেহতা অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগের শর্তে ন্যায্য বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে তা ভঙ্গ করেন। গোকুল মেহতার নির্দেশে গুলি বর্ষণে দুজন কৃষক আহত হয়। ফলে পরিস্থিতি এত ভয়াবহ হয়ে পড়ে যে বিদ্রোহী কৃষকগণ গোকুল মেহতাকে ঘিরে ধরে এবং হত্যা করে। গোকুল মেহতার হত্যার মধ্য দিয়ে কৃষক বিদ্রোহ সমগ্র রংপুর-দিনাজপুরে ছড়িয়ে পড়ে। কালাপানিতে নিযুক্ত লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ডের নিকট গুডল্যাড লেখেন : “আপনার দ্বারা শক্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত দেশটি পুনরায় বিদ্রোহের সম্মুখীন।” এই পরিস্থিতিতে কালেক্টর রিচার্ড গুডল্যাড জনগণের নিরাপত্তার নামে প্রচণ্ড অত্যাচার ও নিগ্রহাত্মক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিদ্রোহ প্রশমনের চেষ্টা করেন। কোম্পানির স্থানীয় প্রশাসন মনে করেন যে, ‘বসনিয়াগণ’ এই বিদ্রোহের মূল শক্তি । তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমেই বিদ্রোহ দমন সম্ভব ।
১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্রোহী কৃষকগণ রণকৌশল পরিবর্তন করে সমগ্র দলটি ছয়টি উপদলে বিভক্ত হয়ে রংপুরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে। তাদের সাথে যুক্ত হয় কোচবিহারসহ অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকগণ। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এই অবস্থায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে রংপুরের বিদ্রোহী কৃষকগণ যাতে দিনাজপুরে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে সৈন্য প্রেরণ করেন। বিভিন্ন স্থানে সৈন্য প্রেরণ ছাড়াও স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, প্রয়োজনে বিদ্রোহী কৃষকদের একাংশকে আটক করা, তাদের গৃহাদি ভস্মীভূত করা, এমনকি গুলিবর্ষণও করা যেতে পারে। মুঘল হাটে কয়েক'শ কৃষক কোম্পানির সুবাদার ও জমাদারকে আক্রমণ করেন। এই দলের অধিনায়ক ছিলেন নূরলদীন, যিনি 'নবাব' উপাধি ধারণ করেছিলেন। তাঁর দেওয়ান ছিলেন দয়াশীল। এই সংঘর্ষে নূরলদীনকে আহত অবস্থায় বন্দি করা হয়। অন্যদিকে দেওয়ান দয়াশীল অন্যান্য বিদ্রোহী কৃষকের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। অবশ্য পরে নূরলদীন ও মৃত্যুবরণ করেন।
রংপুর কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম ঘটনা ছিল ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ২২ ফেব্রুয়ারি পাটগ্রামের যুদ্ধ। লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে একদল সৈন্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিদ্রোহী কৃষকদের আস্তানার নিকটবর্তী হয়। কৃষকগণ সহজেই বরকন্দাজদের গ্রহণ করে। কিন্তু ছদ্মবেশী বরকন্দাজগণ অপ্রস্তুত কৃষকদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় ৷ এতে অনেক কৃষকযোদ্ধা হতাহত হয়। ম্যাকডোনাল্ডের তৎপরতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যাবলি কৃষক শক্তিকে অনেকটা দুর্বল করে দেয়। তবে বিক্ষিপ্তভাবে বিদ্রোহী কৃষকদের তৎপরতা অব্যাহত থাকে। এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল মুঘল হাটের সংগ্রাম। এই সংগ্রামে ৬০ জন কৃষক নিহত হয় এবং ৫৬ জন বিদ্রোহী কৃষককে গ্রেফতার করা হয়, যাদের সকলেই ছিলেন মারাত্মকভাবে আহত। এভাবে রংপুরে শক্তি প্রয়োগ করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনেন ।
রংপুর কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব
রংপুর কৃষক সংগ্রামে বিদ্রোহী কৃষকগণ আপন গণ্ডি, সামর্থ্য ও পদ্ধতিতে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে এবং তাদের এই স্বরাজ ছিল স্থানীয় উপাদান সমৃদ্ধ ও স্থানীয় প্রকৃতির। রংপুর কৃষক বিদ্রোহের নেতাগণ সবাই ছিলেন রংপুরের অধিবাসী এবং উচ্চ মধ্যবিত্তশ্রেণিভুক্ত। বাংলার অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহ থেকে রংপুর কৃষক বিদ্রোহের মৌলিক পার্থক্য এখানেই। এই বিদ্রোহের নেতাগণ সবাই ছিলেন বসনিয়া। মুঘল হাটের যুদ্ধের নেতা নূরলদীন ছিলেন সুতানা তালুকের বসনিয়া ।
এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব সম্পর্কে আলোচনায় দুইটি বিষয় সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, নেতা মনোনয়ন ও নেতৃত্বের প্রকৃতি। রংপুর কৃষক বিদ্রোহে ধীরাজ নারায়ণ, কেনা সরকার, রামপ্রসাদ সর্দার, নূরলদীন, দয়াশীল, ভূদারো বসনিয়া, বুড়ো বসনিয়া, শেখ হাবসী, শেখ কাবিল, রহমত, আলীবর্দী, দয়া রাম দাস, হর নারায়ণ দাস, রাম দাস, ‘বানেশ্বর দাস, ও ইসরাইল খান প্রমুখ স্থানীয় বসনিয়াদের নেতৃত্ব লক্ষ করা গেলেও ধীরাজ নারায়ণ, শেখ কেনা সরকার ও নূরলদীন ছিলেন এই বিদ্রোহের প্রধান নেতা ও বিদ্রোহীদের মনোনীতি ‘নবাব' । অবশ্য নূরলদীনের ভূমিকা ছিল অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র । সরকারি বিবরণীতে বলা হয়েছে, সম্মানিত ‘নবাব' উপাধি ধারণ করে রাজমুকুটশোভিত নূরলদীন স্বাধীনতার সনদ নিয়ে আবির্ভূত হন। তবে সমস্ত নথিপত্র ও উপাত্ত যা ইঙ্গিত করে তা হলো, রংপুর বিদ্রোহে কৃষকগণই ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, বিদ্রোহী কৃষকগণের নেতা মনোনয়ন এবং তাকে ‘নবাব' উপাধি প্রদান, মুঘল সরকার কাঠামোর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। এতে প্রমাণিত হয় যে, বিদ্ৰোহী কৃষক শ্রেণি সনাতনী ব্যবস্থায় ফিরে যেতে আগ্রহী ছিল।
রংপুরের কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্বের প্রকৃতি ছিল প্রকৃত পক্ষে কৃষকদের-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। সম্ভবত কৃষকগণ (পূর্বের বসনিয়াদের ‘নবাব' মনোনীত করে তাদের নেতৃত্বে) আপন মনোজগতের সীমিত গণ্ডিতে আত্মনিয়ন্ত্রণ পেতে চান। এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের পূর্বাবস্থা প্রতিষ্ঠার চেতনা সমন্বিত । সে ক্ষেত্রে নেতৃত্বের জন্য তারা একদিকে নির্বাচিত নবাবকে নজরানা প্রদান করে আনুগত্য প্রকাশ করে অন্যদিকে প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক অনুসরণের পূনরাবৃত্তি কামনা করে ।
রংপুর কৃষক বিদ্রোহের প্রকৃতি
১৭৬০ হতে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনে ধর্ম ও ধর্মীয় চেতনা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফকির-সন্যাসী আন্দোলনে, সাঁওতালদের বিদ্রোহে পাগলপন্থি আন্দোলনে ধর্মীয় অনুভূতি কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে কাজ করে। ধর্মীয় অনুভূতি আর যাই করুক না কেন উপরোক্ত আন্দোলন নেতৃত্ব গঠন ও চেতনা আনয়নে কমবেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু রংপুর কৃষক বিদ্রোহে ধর্মের বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল বলে মনে হয় না। অর্থাৎ রংপুর বিদ্রোহের একটা পর্যায়ে কৃষকদের উৎসাহ উদ্দীপনার প্রত্যয় হিসেবে প্রকাশিত হলেও অন্যত্র ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ও ভয় কৃষকদের শত্রু নিধন হতে নিবৃত্ত করতে পারেনি। যে কারণে বিদ্রোহী কৃষকগণ ধর্মের দোহাই ও নেতার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ব্রাহ্মণ গৌরী মোহনকে (হিন্দুধর্মে ব্রাহ্মণ অবধ্য) জনসমক্ষে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। পরবর্তী সময় রংপুরে কমিশনের নিকট সাক্ষ্য প্রদানকালে বিভিন্ন ব্যক্তি স্বীকার করেন যে, বিদ্রোহী কৃষকদের আদৌ ধর্ম ভয় ছিল না। পারলৌকিক জীবনে দুঃখকষ্ট ভোগের ভয়ের চেয়ে ইহলৌকিক জীবনের অত্যাচার তাদের কাছে অধিকতর দুর্ভোগজনক বলে মনে হয়েছিল। রংপুর বিদ্রোহে 'কৃষকগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সহজাত প্রক্রিয়ায়, ধর্মের ভিত্তিতে নয়। "In fact the village people participated in the irrespective of their caste, community and Creed Neither caste distinction nor communal differences obstructed the march of events." এই বক্তব্যে নরহরি কবিরাজ রংপুর কৃষক বিদ্রোহকে একটা শ্রেণিসংগ্ৰাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যেখানে জাতি ও সম্প্রদায়ের কোনো ভূমিকা ছিলন না। তাঁর এই বক্তব্য সমর্থনযোগ্য কিন্তু এই বক্তব্য নরহরি কবিরাজের পূর্বোক্ত হিন্দু- মুসলামন ঐক্য থিসিসের বিরোধী। কেননা ঐক্য বলতে বুঝায় মতৈক্য, আর মতৈক্য থাকে চেতনা। রংপুর কৃষক বিদ্রোহে যখন কোনো সম্প্রদায়গত চেতনা ছিল না, তখন হিন্দু-মুসলমার ঐক্যের প্রশ্ন অবান্তর। সরকার গঠনে হিন্দু-মুসলমান অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় আন্দোলনের ফলশ্রুতি, যেখানে যে বসনিয়া প্রভাবশালী ছিলেন সেখানে তিনিই ‘নবাব' বা ‘দেওয়ান’ হয়েছেন। এখানে ধর্মের ভিত্তিতে বা ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করার কোনো প্রকার অভিপ্রায় ছিল না। নিম্নবর্গ গবেষক-রণজিৎ গুহ রংপুরের বিদ্রোহীদের তৎপরতাকে নেতিবাচক চৈতন্য ও অতিদেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন যা বিচার সাপেক্ষ। কেননা রংপুরের বিদ্রোহী কৃষকগণ আরও একধাপ অগ্রসর হয় ইংরেজ শাসনকে তাদের দুর্গতির জন্য দায়ী করেন এবং ইংরেজ কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। কোম্পানির কর্মচারী প্যাটারসন রংপুরের এই বিদ্রোহকে সাধারণ জনগণের বিদ্রোহ হিসেবে অভিহিত করেছেন। কোম্পানির নথিপত্রে প্রাপ্ত তথ্যাদিও এই সিদ্ধান্তকে দৃঢ়তর করে যে, রংপুর বিদ্রোহ ছিল প্রকৃতপক্ষে কৃষকদেরই সংগ্রাম। এই সংগ্রামে জমিদারদের অংশগ্রহণ, এবং বসনিয়াদের নেতৃত্ব প্রদান মূলত কৃষকদের সাথে অভিন্ন স্বার্থকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। জমিদার- বসনিয়া ও কৃষক অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণি দু'টির শক্তি ও স্বার্থ এক নয়, কিন্তু ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্রোহে এই শ্রেণি দুটির ঐক্য হয়েছিল দেবী সিংহের অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে। শোষক ও শোষিতের ভিত্তিতে যেখানে চালিকা শক্তি কৃষক সম্প্রদায়কে সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে দেবী সিংহ বিরোধী প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পথ খুঁজে পান জমিদার ও বসনিয়াগণ। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে রংপুরের এই বিদ্রোহকে শ্রেণিসংগ্ৰাম বলা চলে। তবে সম্পূর্ভভাবে বর্তমান কালের চেতনায় নয়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার সীমিত গণ্ডিতে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্বার্থবাদী ও নিপীড়িত শ্রেণির ঐক্যবদ্ধ চেতনার বিচারে এর প্রকৃতি নির্ধারণ করা হবে যুক্তিযুক্ত ।
রংপুর কৃষক বিদ্ৰোহ দমন
কোম্পানি কর্তৃপক্ষ রংপুর কৃষক বিদ্রোহে বিভিন্ন শ্রেণির অংশগ্রহণ লক্ষ করে অস্থির হয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে সরকার একটি রেগুলেশন জারি করেন। এই আইনের আওতায় রংপুর কৃষক বিদ্রোহের প্রতি সরকার এক দ্বৈত নীতি গ্রহণ করেন। প্রথমে কোম্পানি সমঝোতামূলক নীতি গ্রহণ করলেও বিদ্রোহ দমনে তাদের ব্যর্থতায় পরবর্তীতে দৃঢ় মনোভাব পোষণ করে। বিদ্রোহের ব্যাপকতা ও ক্ষিপ্রতা এত বেশি ছিল যে, কোম্পানির স্থানীয় কৃর্তপক্ষের রংপুরে অবস্থান অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই সময় রংপুরের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ রাজস্ব আদায়ে নিপীড়ন ও অত্যাচারকে বিদ্রোহের প্রধান কারণ মনে না করে কোম্পানির নমনীয় নীতিকে বিদ্রোহের প্রধান কারণ বলে বিবেচনা করেন এবং দমননীতি গ্রহণের মাধ্যমে অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। অন্যদিকে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দেয় যে, পুনরায় উত্তেজনার সহায়ক হয়, এমন কার্যক্রম হতে যেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বিরত থাকেন। দেশের অভ্যন্তরে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও রাজস্ব বিষয়ে অসন্তোষ দূরীকরণের জন্য বারংবার কালেক্টরের জেলা পরিদর্শনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় । গ্রামপ্রধান বা বসনিয়া যারা এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের প্রতি অতি সতর্ক থাকার নীতি গ্রহণ করা হয়। প্রয়োজনে বসনিয়াদের গ্রেফতার ও জনসমক্ষে ফাঁসি দানের নির্দেশ দেওয়া হয়। অপর দিকে বিদ্রোহী কৃষকদের অভিযোগ মেনে নিয়ে তাদের শান্ত থাকার নীতি গ্রহণ করা হয়। এই বিদ্রোহের অন্য একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে সরকারের মধ্যে দুটি মতের সৃষ্টি হয়। ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্যাটারসন তদন্ত রিপোর্টে বিদ্রোহের জন্য দেবী সিংহ ও কালেক্টর রিচার্ড গুডল্যাডের কর্মকাণ্ডকে দায়ী করা হয়। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ একে ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ তদন্ত অভিহিত করে তা গ্রহণ করেনি। অপর দিকে ১৭৮৪-৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনের রিপোর্টে দেবী সিংহ ও গুডল্যাড নির্দোষ প্রমাণিত হয়। সরকার নিজ স্বার্থে পরবর্তী রিপোর্ট গ্রহণ করে। ব্রিটিশ কোম্পানি সরকার কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করে ।
তবে রংপুরের এই বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়নি। ভূমি রাজস্বের ক্ষেত্রে ‘আসল তুমার জমার’ আভাবনীয় পরিবর্তন ও মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ বৃদ্ধি ছিল সাধারণ কৃষকদের নিকট অকল্পনীয়। ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর বিদ্রোহ ছিল কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রথম ঐক্যবদ্ধ, স্বতঃস্ফূর্ত ও সশস্ত্র সংগ্রাম, যার মাধ্যমে তারা কোম্পানি সরকারকে নতুন নীতিনির্ধারণে ও রাজস্ব নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করেছিল। সুতরাং রংপুর কৃষক বিদ্রোহের বাংলার পরবর্তী কৃষক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক বলা যেতে পারে।
রংপুরের কৃষক বিদ্রোহের সর্বশেষ ঘটনা
রংপুরের কৃষক বিদ্রোহের রেশ ১৯৪৭ খ্রি. স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত এবং পরেও পরিলক্ষিত হয়। রংপুরের কৃষকেরা ব্যাপক আকারে জোতদার ও মহাজনদের বাড়ি চড়াও করে এবং লুটপাট করে। কৃষকরা লুটপাট করে নিয়ে যেত মূলত জোতদার ও মহাজনদের জমি ক্রয়ের দলিল ও কবলা; তা নিয়ে গিয়ে জোতদার ও মহাজনদের বাড়ির সামনেই পুড়িয়ে ফেলত। এই অবস্থাকে হিন্দু ও মুসলমান শ্রেণির এক প্রতিক্রিয়াশীল অংশ হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হচ্ছে এইভাবে আখ্যা দেওয়া শুরু করে। হিতবাদী, সঞ্জীবনী, আজাদ প্রভৃতি পত্রিকা তা নিয়ে প্রচার অভিযানে নামে ৷ পরোক্ষভাবে, ইংরাজরাও একে মদত দিতে শুরু করে। কিন্তু মুখ্যত তা ছিল মহাজন ও জোতদারদের সঙ্গে কৃষকদের শ্রেণিসংঘর্ষ ।
ওই সময় কৃষকের সবচেয়ে বেশি জমি জোতদার মহাজনদের হাতে হস্তান্তর হয়। ফলে কৃষক নিঃস্ব ভূমিহীন দাসে পরিণত হতে শুরু করে। এরই ফলশ্রুতি প্রজাস্বত্ব আইন ও ঋণ সালিশি বোর্ড ।
১৯৩৭-এ প্রজাস্বত্ব আইন পাস হয়। এই আইনের বিরুদ্ধে কংগ্রেসিরা ভোট দেয়। প্রজাস্বত্ব আইন পাস হলে প্রজারা জমির স্বত্ব পায়। তখন থেকেই জোতদার ও মহাজনদের সৃষ্টি হয়। জমিদাররা কিছু জমি জোতদার ও মহাজনদের পত্তন দেয়। ফলে, জমির শর্ত নিয়ে জটিলতার সূত্রপাত হয়। এরপরেই শুরু হয় জমিদার, জোতদার ও মহাজনদের কৃষকের উপর শোষণ। কৃষকের সমস্ত ক্ষমতা তখন কুক্ষিগত ছিল জমিদার, জোতদার ও মহাজনদের হাতে। কৃষকের হাতে কোনো ক্ষমতাই ছিল না। ফলে, কৃষকদের উপর জমিদার, জোতদার ও মহাজনেরা বিভিন্ন রকম অত্যাচার শুরু করে।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে গণ্ডি আন্দোলন প্রথম শুরু হয় জলপাইগুড়ি জেলায়। রংপুর জেলার ‘লোহাকুচি’ হাট থেকে তোলাগণ্ডি আন্দোলন প্রথম শুরু হয়, যা রংপুর জেলার কুচবিহার বর্ডারে অবস্থিত। এই হাটটি ছিল সবচেয়ে বড় তামাকের হাট। এই হাট থেকেই কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে স্লোগান দেওয়া হয় ‘তোলাগণ্ডি বন্ধ করো।' কৃষকদের এই দাবি প্রথমে জমিদাররা মেনে নেননি। ফলে, কৃষক সমিতি স্লোগান দেয় ‘কৃষক সমিতির হাট বসাও' এবং হাট বসেও। তখন জমিদার কৃষকগণের স্থায়ী দোকন থেকে ‘তোলাগণ্ডি’ নেয়-কিন্তু সাধারণ কৃষকদের কাছ থেকে ‘তোলাগণ্ডি’ নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এই সাফল্যের পরে ব্যাপকভাবে আন্দোলন অন্যান্য অঞ্চলে প্রসারিত হয় । এরপর শুরু হয় কাঁকনা থানার অধীনে তুষভাণ্ডার হাটে। সেখানে আন্দোলনের উপর পুলিশের গুলি চলে। ফলে আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন— কুড়িগ্রাম মহকুমার (বর্তমানে জেলা) উলিপুর হাট, চিলমারির হাট এবং অন্যান্য হাট। সেখানেও আন্দোলন সফল হয় ।
কৃষক সমিতির মূল দাবি ছিল হাটে যে সমস্ত স্থায়ী দোকান আছে তা থেকে যে খাজনা আদায় হয়, তার দ্বারা হাট কমিটি করতে হবে ও সেই হাট কমিটির হাতে পয়সা জমা দিতে হবে এবং তা হাটের উন্নতিকল্পে ব্যয় হবে। ফলে এই আন্দোলন রংপুর জেলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, দিনাজপুর, রগুড়া, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার প্রভৃতি জেলাতেও ছড়িয়ে পড়ে। একমাত্র রংপুর জেলাতেই এই আন্দোলনের জন্য দশ হাজার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়েছিল এবং বহু হাটে কৃষক স্বতঃস্ফূর্তভাবে কমিটি তৈরি করে ‘তেলাগণ্ডি’ বন্ধ করে দেয়। কোনো কোনো জায়গায় কৃষক সমিতি হাট বসায়, যা A. কৃষক সমিতির হাট নামে পরিচিত। এই রকম হাট বহু জায়গায় এখনও আছে। “এই আন্দোলন সে সময় সবচেয়ে বড় আন্দোলন ৷
১৯৩৯-৪০ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় কৃষকদের বকেয়া খাজনার সুদ মওকুফ আন্দোলন । যেমন- রংপুর জেলার ‘টেপা’ জমিদারিতে সুদ মওকুফ আন্দোলন। যেমন, চন্দনপাট গ্রাম থেকে প্রায় হাজার লোকের মিছিল চল্লিশ মাইল রাস্তা হেঁটে রংপুর শহরে এসে, তারা কোর্টে ধরনা দেয় এবং সেখানে কৃষকদের এই দাবিকে কংগ্রেসিরা সমর্থন করে ও কৃষকদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে। কংগ্রেস অফিস ময়দানে বিকেলের দিকে জনসভা হয়, কংগ্রেসের জিতেন চক্রবর্তী ও জিতেন সেনের নেতৃত্বে। এর পরে জমিদারের বিরুদ্ধে খাজনা মুকুব আন্দোলন শুরু হয় মালদাহ জেলার চাঁচল রাজের জমিদারিতে। সেখানেও এই আন্দোলন সাফল্য লাভ করে। জমিদাররা কৃষকদের চাপে পড়ে প্রায় এই দাবি মানতে বাধ্য হয়। রংপুর জেলার কংগ্রেসিরা মোটামুটিভাবে কমিউনিস্ট পার্টির আয়ত্তাধীন ছিল । কিন্তু অন্যান্য জেলাতে তা ছিল না ।
১৯৪০-৪৩ খ্রিষ্টাব্দ। এই সময় বাংলার অসংখ্য কৃষক মারা যায় মন্বন্তরে। বহু গ্রাম মনুষ্যহীন হয়ে পড়ে। সরকার ‘ফ্লাউড কমিশন' বসায় এবং ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে কৃষক সমিতি তেভাগার স্লোগান দেয়। সে সময় একটি আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, মন্বন্তরের ফলে কৃষক আন্দোলন মজুত উদ্ধার এবং লঙ্গরখানা এরই মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে কৃষক নেতারা কৃষকদের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জন্য কোনো বিশেষ স্লোগান দিল না। ফলে কৃষক না খেয়ে মরল কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের বিণক্ষে হাত তুলতে পারল না। তারই ফলস্বরূপ দাঁড়াল, ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচনে কৃষকেরা কোনো কৃষক নেতাকে ভোট দিল না, ভোট দিল কংগ্রেসিদের। এর থেকেই জন্ম নিল সংস্কারবাদী আন্দোলন এবং এই আন্দোলন পাকিস্তান আমলে অব্যাহত ছিল।' ৫২ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচনে কংগ্রেসিরা স্লোগান তুলেছিল ‘আইনের জন্য ভোট দাও’, ‘স্বাধীনতার জন্য ভোট দাও'। ‘তেল নুনের জন্য ভোট দিয়ো না' কারণ, যদি গভর্নমেন্ট তৈরি না করো তাহলে ‘তেল নুন পাবে কোথা থেকে?’
১৯৪৬-এর হয় আইনসভার নির্বাচন। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে এই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির তিন জন প্রার্থী জয়লাভ করেন- যথা জ্যোতি বসু, রূপনারায়ণ রায় ও রতনলাল ব্রাহ্মণ। কংগ্রেস এই নির্বাচনে প্রচণ্ড বিরোধিতা করে এবং কমিউনিস্ট পার্টির উপর প্রচণ্ড অত্যাচার শুরু করে। প্রায় বহু জায়গাতে কমিউনিস্ট পার্টির পোলিং এজেন্টদের বুথে বসতে দেয়নি এবং তাদেরকে প্রচণ্ড মারধোর করে ভাগিয়ে দেয়। জ্যোতি বসু এই প্রথম আইনসভার সভ্য হন। এই আইন সভার মধ্যে দিয়ে কৃষকদের দাবিদাওয়া ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করে এবং তার মধ্যে আধিয়ারদের প্রশ্ন ছিল- যেমন— নিজ খোলানে ধান তোলো, বকেয়া ধানের সুদ মওকুফ করো, খোলান খরচ নেওয়া চলবে না, দুঃস্থ কৃষকদের জমিদারের দাস থেকে মুক্ত করো ইত্যাদি । তেভাগার প্রথম দিকে এই স্লোগানগুলোই প্রধান ছিল এবং এই দাবিতেই ভাগচাষি আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ৷
জেলা কৃষক সমিতির মিটিং-এ ঠিক হয় রংপুর জেলায় ডিমলা ও জলঢাকা এই দুটি থানাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন সংগঠিত করা হবে। সে সময় প্রচণ্ড হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর প্রচার হয়। অপর দিকে ছাত্র বিক্ষোভ, শ্রমিক বিক্ষোভ, সৈন্য বিদ্রোহ- সমগ্র বাংলায় এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। ডিমলা থানা মোটামুটি ছিল হিন্দু প্রধান অঞ্চল কিন্তু জোতদাররা ছিল প্রধানত মুসলমান। জলঢাকা থানা ছিল মূলত মুসলিম প্রধান অঞ্চল। জলঢাকায় আন্দোলন শুরু হয় মূলত হিন্দু কর্মী দিয়ে এবং ডিমলাতে কিছু মুসলমান কর্মীও ছিল। তখন প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সত্ত্বেও কোথাও হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হয়নি। কৃষক সমিতি মূলত আধিয়ার আন্দোলনের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ধ্বনি তুলতে সক্ষম হয়নি। ফলে, এই আন্দোলন অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটিই এই আন্দোলনের প্রধান দুর্বলতা।
এই আন্দোলনে কৃষক মহিলারা ব্যাপভাবে অংশ গ্রহণ করে ও আন্দোলনের জন্য বিভিন্নভাবে লড়াই করে। যেমন- আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মীদের রক্ষা ও দেখাশুনো থেকে শুরু করে প্রকাশ্য ময়দানে পুলিশের সঙ্গে লড়াইতেও এরা শামিল হয়েছে।
একজন মুসলিম জোতদারের হিন্দু আধিয়ার তার ধান নিজ খোলানে তুলে দিল, তারপর সেই খোলান ভাঙা হয়। তখন জোতদার পুলিশ দিয়ে এসে জোর করে ধান কেড়ে নেওয়ার চেষ্ট করে। কৃষকেরা এই খবর পেয়ে জমায়েত হতে শুরু করে এবং তারা পুরিশের হাত থেকে অস্ত্র ও ফসল কেড়ে নিয়ে পুলিশ ও জোতদারকে ভাগিয়ে দেয়। এই ঘটনায় এমন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় যে চারপাশ থেকে প্রায় দশ হাজার কৃষক মাঠে জমা হয়। কৃষকদের খাওয়ানোর জন্য মহিলা কর্মীরা পাঁচ মন চাউল তুলে ভাজা করে এবং এক মুঠো করে চালভাজা দিয়ে পাঁচ মণ ভাজা চাল কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করে। তাতেও না কুলালে ওই কৃষক জমায়েত থেকে প্রশ্ন ওঠে এখন কী করা হবে? তখন একদল প্রস্তাব দেয় যে, কৃষকেরা গিয়ে থানা আক্রমণ করবে। আরেক দল প্রস্তাব দেয় যে, থানায় যাওয়ার দরকার নেই। এই ধান রক্ষা হোক এবং অন্যান্য সব খোলান ভাঙা হোক। বেশির ভাগ ভোটে থানা আক্রমণ করা পাস হয় এবং সন্ধ্যার পরে মশাল জ্বালিয়ে কৃষকেরা থানা অভিমুখে রওনা হয়। যত দূর খবর আসে তার থেকে জানা যায় যে- থানাওয়ালারা থানা থেকে সব পালিয়ে যায়, এমনকি দারোগাও! তখন একজন কৃষক নেতা রাস্তার মাঝখানে একটি গাছের উপরে মশাল হাতে উঠে পড়ে বলেন যে, যুদ্ধের নিয়ম হচ্ছে সেনাপতির আদেশ মানতে হবে; সুতরাং তার আদেশ, থানায় যাওয়া চলবে না, ফিরতে হবে এবং ধান রক্ষা করতে হবে। তখন কৃষকেরা ক্ষুণ্ন মনে ধান রক্ষা করার জন্য ফিরে আসে। এই আদেশ উক্ত কৃষক নেতার ভুল হয়েছে। এই আন্দোলনকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এই চেতনার অভাববোধ থেকে এই ঘটনা ঘটেছিল ।
ওই সময় কৃষকদের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশ নেবার এক বিপুল উদ্দীপনা দেখা দেয়। কিন্তু কৃষকেরা যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারে এ বিশ্বাস নেতাদের মধ্যে ছিল না। ফলে কৃষকেরা প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়ে। এতে আন্দোলন পিছিয়ে পড়ে। কারণ, আন্দোলনের নিয়ম হচ্ছে আন্দোলন কখনও এক জায়গায় থাকে না, হয় এগোয় না হয় তা পিছায় ।
কৃষকেরা বোকা ছিল না। তারা নেতাদের ভুল নিশানা ধরতে পেরেছিল। কৃষকেরা বুঝতে পেরেছিল ধান রক্ষা এ রাস্তায় হয় না। ধান রক্ষা করতে গেলে আঘাত হানতে হবে নইলে, প্রতিক্রিয়াশীল চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।
কৃষকেরা জানে, পুলিশই তাদের শত্রু। শত্রু খতম না করতে পারলে তাদের উপর আক্রমণ নেমে আসবে, তখন প্রতি আক্রমণের আর সময় থাকবে না। এ কথা সত্য যে, সরকারের শক্তিকে সর্বদাই নেতারা বাড়িয়ে দেখেছে, কিন্তু জনসাধারণের সংগ্রামের মনোভাবকে নেতারা সর্বদাই ছোট করে দেখেছে। এই ধারণা, থেকেই কৃষক নেতারা কী সিদ্ধান্ত নেবে তা পরিমাপ করতে ভ্রান্তপথে চালিতে হয়েছে। এটিই সমস্ত, আন্দোলনের মূল পর্যালোচনা ।
এই ঘটনার পর ডিমলা থানায় জোতদারের পক্ষ থেকে যাদু মিঞার নেতৃত্বে কৃষকদের উপর গুলি চালনা হয়। গুলির আঘাতে তন্নারায়ণ নিহত হয়, বাচ্চা মিঞাসহ অন্যান্যরা আহত হন। ফলে, মহকুমা কৃষক সমিতি থেকে নীলফামারি শহরে (বর্তমানে জেলা) কৃষক সমিতি মহকুমা জমায়েত-এর ডাক দেওয়া হয় এবং সেখানে কৃষকদের আওয়াজ ওঠে যাদু মিঞার রক্ত চাই, খুনের বদলে খুন চাই ।
পুলিশ জানতে পারে, এ ঘটনায় শহরে কৃষক জমায়েত হবে এবং তা জানা মাত্রই শহরের সমস্ত পুলিশ ওই দিন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যায়। বহু পুলিশ অফিসার তাদের পরিবারকে শহরের অন্যত্র নিয়ে যায়। পুলিশের ধারণা ছিল যে, কৃষক জমায়েত এসে মহকুমা সদর দখল করবে এবং এস.ডি.ও সাহেবও এ ঘটনায় সদর মহকুমার সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কৃষকেরা শুধু জমায়েত করেই চলে এল, কোনো প্ৰত্যক্ষ সংগ্রামে অংশ নিল না। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনার অভাব থেকেই এই বোধ উদ্বুদ্ধ। ফলে, আন্দোলনের গতি একই জায়গায় থেমে থাকল এবং তাতে শাসকগোষ্ঠী প্রতি আক্রমণের সুযোগ পেল । যদি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে কৃষকেরা সেই সময় মহকুমা শহর দখল করে জেলা দপ্তর দখলের দিকে এগিয়ে যেত তা হলে সমস্ত আন্দোলনের চেহারা পালটে যেত । কিন্তু তা না হয়ে আন্দোলনের লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যেতে লাগল ।
রংপুর জেলার কৃষক সমিতি কিশোরগঞ্জ (বর্তমানে নীলফামারী জেলার একটি উপজেলা) থানার অধীনে ‘বড়ভিটায়’ একটি জনসভার ডাক দেয়। ওই জনসভায় রংপুর শহরের বেশ কিছু কংগ্রেসকর্মী যোগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ওই কর্মী ও কংগ্রেস নেতাদের যারা নিতে এসেছিল তাদের একটি সমস্যা দাঁড়াল, গাড়ি আছে কিন্তু পেট্রোল নেই। শেষে পেট্রোল পাম্পে যাওয়া হলো, পাম্পের মালিক বলেন পেট্রোল নেই, সমস্ত পেট্রোল ডি.এম. অধিগ্রহণ করেছে। এ কথা শোনার পর কৃষক
কর্মীরা থানা ও এস.পি. অফিসে পেট্রোলের খোঁজে যান। এস.পি অফিসে শোনা যায় যে, ডি.এম. সমস্ত পেট্রোল অধিগ্রহণ করেছে, উদ্দেশ্য সমস্ত কর্মীদের গ্রেফতার করা হবে। এই সংবাদ পেয়ে একজন কর্মী কৃষক সমিতির অফিসে খবর দেন যে ডি. এম. নিৰ্দেশ দিয়েছে গ্রেফতার করার, শীঘ্রই ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হচ্ছে। এই সংবাদ কৃষক সমিতির অফিসে পৌঁছানো মাত্র পুলিশও গ্রেফতারের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। জেলার কৃষক সমিতির প্রধান নেতাদের ওই রাত্রিতেই গ্রেফতার করা হয়। প্রায় তিনশো কৃষক নেতা ও পাঁচশো স্থানীয় কৃষক নেতা ওই রাত্রিতেই গ্রেফতার হয়। কৃষকদের ওপর শুরু হয় প্রতি আক্রমণ। জোতদার ও পুলিশের মিলিত চেষ্টায় প্রচণ্ড প্রতিআক্রমণে সংগ্রামী কৃষক অসহায় হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত তারা আর ধান রক্ষা করতে পারে না। সমস্ত : নেতা গ্রেফতার হওয়ার ফলে কৃষকেরা নেতাহীন হয়ে পড়ে। ধান রক্ষার লড়াই আরও হতে পারত কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না। আন্দোলন প্রায় পঙ্গু হয়ে গেল ।

রংপুর কৃষক বিদ্রোহের সার্বিক বিশ্লেষণ
১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন, বৃহস্পতিবার পলাশীর আম্রকাননে প্রধান সেনানায়ক মীরজাফর আলী খান, অন্যান্য সেনা প্রধান ও অমাত্যদের (ইয়ার লতিফ খান, রহিম খান, রাজা রায়দুর্লভ, মানিক চাঁদ, নন্দ কুমার প্রমুখের) বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। ক্লাইভ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ও নবাবের বিশ্বাসঘাতক অমাত্যরা ধৃত নবাবকে শুধু নির্মমভাবে হত্যাই করেনি বরং তাঁর লাশ হাতির পিঠে উঠিয়ে মুর্শিদাবাদে আনন্দ মিছিল করে। নবাবের এ করুণ পরিণতি এদেশের মানুষের মন থেকে কোনোদিনই মুছে যায়নি ।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও মুর্শিদাবাদের কুচক্রী অমাত্যগণ ২৯ জুন বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর আলী খানকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু পর্দার অন্তরালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই প্রশাসনের কলকাঠি নাড়তে থাকেন। পলাশীর যুদ্ধের ফলে ইংরেজ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি সরাসরি বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেনি বটে কিন্তু তখন থেকেই বাংলার নবাবগণ তাদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হন। মুর্শিদাবাদের সিংহাসনের পেছনে মূল পরিচালিকা শক্তিরূপে আবির্ভূত হলেন ইংরেজরা। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা হয়ে উঠলেন ‘নৃপতি স্রষ্টা' অর্থাৎ King maker' ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থলোলুপতা মেটাতে গিয়ে মুর্শিদাবাদের নবাবের কোষাগার শূন্য হতে থাকে।' পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ের পুরস্কার স্বরূপ বা এনাম হিসেবে অর্থ আদায় করতে থাকে। এর পাশাপাশি অবাধে চলতে থাকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত উৎকোচ গ্রহণ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবাধ লুণ্ঠন ও ক্রমবর্ধমান হারে রাজস্ব আদায় ।
নবাব মীরজাফর আলী খান ও উচ্চহারে রাজস্ব আদায় করে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সন্তুষ্ট করতে বাধ্য হন। তিনি তার অন্যতম নির্মম ও অত্যাচারী রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারী হরেরাম সেনকে রংপুর অঞ্চলের শাসনকর্তা নিয়োগ করে। প্রজাপীড়ন শুরু করেন। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনামলে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির নায়েবে দেওয়ান রেজা খানের কৃপায় পশ্চিম ভারতের নিকটবর্তী এক গ্রামের বৈদ্য সম্প্রদায়ের জনৈক দেবী সিংহ প্রথমে পুর্নিয়ার ইজরাদার ও শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। পুর্নিয়া অঞ্চলে দেবীসিংহ নির্মমভাবে প্রজাপীড়ন ও অধিকহারে রাজস্ব আদায় করে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বশীভূত করেন। ‘প্রাদেশিক রেভিনিউ বোর্ড' গঠিত হলে দেবী সিংহ সেই বোর্ডের সহকারী কর্মাধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হন। সুযোগ বুঝে বিপুল অর্থ উৎকোচ প্রদান করে এবং বোর্ডের সভ্যদের জন্য একটি নর্তকী দল গঠন করে দেবী সিংহ রেভিনিউ বোর্ডকে বশীভূত করেন। এভাবে দেবী সিংহ প্রকৃতপক্ষে বাংলার রাজস্বের কর্তা ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। কিন্তু দেবী সিংহ প্রজাপীড়ন করে আদায়কৃত রাজস্ব ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতারণা করতে গিয়ে ধরা পড়ে। রেভিনিউ বোর্ডের সদস্যদের বিরাগভাজন হয়ে পড়ায় এবং প্রজাবিদ্রোহের আশঙ্কায় হেস্টিংস পরবর্তীতে দেবী সিংহকে রেভিনিউ বোর্ড থেকে সরিয়ে দিয়ে দিনাজপুরের নাবালক রাজার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। এরপর দেবী সিংহকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির দিনাজপুর, রংপুর অঞ্চল ও এদ্রাকপুর পরগনার রাজস্ব আদায়ের ইজারাদার নিযুক্ত করে। সুচতুর দেবী সিংহ অধিক অর্থ বা রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যেই হরেরাম সেনকে তার সহকারী হিসেবে বেছে নেন। রংপুরের কালেক্টর রিচার্ড গুডল্যাড দেবী সিংহকে রংপুর অঞ্চলের দেওয়ান পদে ও হরেরাম সেনকে (ডিমলা জমিদারর প্রতিষ্ঠাতা) তার সহকারী হিসেবে নিযুক্তি প্রদান করে প্রজাপীড়ন ও অধিকহারে রাজস্ব আদায়ের ভিতকে সুদৃঢ় করেন। হরেরাম সেন মীরজাফরের আমলে ডিমলার জায়গিরদার তথা রাজস্ব আদায়ের পরবর্তীতে শুধু দেবী সিংহের সহকারী দেওয়ানই নিযুক্ত হননি বরং তারপর তিনি কার্যিরহাট পরগনার রাজস্ব আদায়ের ইজারাদারি লাভ করেন। পরবর্তীতে হরেরাম সেন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট থেকে কোচবিহারের রাজস্ব সংগ্রহেরও দায়িত্ব প্রাপ্ত হন ৷
এবারে শুরু হয় অধিকহারে রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রজাপীড়নের পালা। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের দুর্নীতি, উৎকোচ গ্রহণ এবং এর পাশাপাশি তাদের রাজস্ব আদায়কারীগণের (দেবী সিংহ, হরেরাম সেন প্রমুখর অত্যাচার, নিপীড়নের ফলে কৃষক প্রজাগণ সর্বস্বান্ত হতে থাকেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীনচেতা ও প্রজাদরদি জমিদারগণও ওদের অত্যাচারের শিকার হন। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার পাঙ্গার জমিদারের উপর অধিক বা বর্ধিত হারে রাজস্ব দাবি করা হয়। পাঙ্গার রাজা উক্ত বর্ধিত হারে রাজস্ব প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি সরাসরি রাজস্ব আদায়ে হস্তক্ষেপ করেন এবং চন্দ্র নারায়ণ নামক জনৈক ব্যক্তিকে গোমস্তা নিয়োগ করেন। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব আদায়কারী দেবী সিংহের অত্যাচারে এবং বর্ধিত হারে খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে মন্থনার জমিদার জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। তাঁর অনুপস্থিতিতে দেবী সিংহ রাজস্ব আরও বৃদ্ধি করেন এবং তা আদায়ের জন্য সাজোয়াল (তহসিলদার) নিযুক্ত করেন ।
দেবী সিংহ ও হরেরাম সেনের পরামর্শে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার রংপুর জেলার অনেক জমিদারের জমিদারি বাতিল করেন শুধুমাত্র বর্ধিত হারে রাজস্ব পরিশোধ না করার জন্য। রংপুর জেলার বাতিলকৃত জমিদারির যে তালিকা ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ অক্টোবর প্রকাশিত হয় সেখানে জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানীর নাম পাওয়া যায়। দেবী সিংহের দাবি অনুসারে বর্ধিত হারে রাজস্ব দিতে না পারায় অনেক জমিদার আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। এসময় বহু জমিদারপত্নী স্বামীর অনুপস্থিতিতে নাবালক সন্তানের পক্ষে জমিদারি পরিচালনা করতে থাকেন। তবে তাঁরাও বর্ধিত হারে রাজস্ব প্ৰদান করতে ব্যর্থ হলে দেবী সিংহ-হরেরাম সেন প্রমুখ ‘মহিলা লাঠিয়াল বাহিনী' গঠনের মাধ্যমে জমিদার বাড়ির অন্তঃপুরের মালামাল লুট করে বকেয়া রাজস্ব আদায়ের মত হীন কাজে লিপ্ত হন ।
সময়মতো বর্ধিতহারে রাজস্ব পরিশোধ করতে না পারায় দেবী সিংহ ও তার সহকারী হরেরাম সেনের লাঠিয়াল বাহিনী তিন আনা ফতেহপুর পরগনার অর্থাৎ ইটাকুমারীর জমিদার শিবচন্দ্রসহ অনেক জমিদারকে গ্রেফতার করে রংপুর শহরের নিকটবর্তী মীরগঞ্জে অবস্থিত দেবী সিংহের কুঠিবাড়িতে অন্ধকার ঘরে আবদ্ধ করে রাখে ।
শিবচন্দ্রের স্ত্রী ও অন্যান্য বন্দি জমিদারের স্ত্রীগণ তাঁদের স্বামীর মুক্তি জন্য এসময় সাবিত্রীব্রত পালন করেন। বহু টাকার বিনিময়ে রাজা শিবচন্দ্র মুক্তি অর্জন করেন। মুক্ত হবার পর রাজা শিবচন্দ্র মন্থনার জমিদার জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানীর পরামর্শে সমগ্র রংপুর অঞ্চলের জমিদার প্রজাদেরকে নিয়ে তাঁর রাজবাড়িতে এক সম্মেলন অনুষ্ঠান করেন। এ সম্মেলনে দেবী চৌধুরানী দেবী সিংহের বিরুদ্ধে তেজোদীপ্ত ভূমিকা পালন ও বক্তব্য প্রদান করেন ।
মন্থনার জমিদার জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানীর সাথে রংপুর অঞ্চলের স্বাধীনতা, প্রজাদরদি ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইজারাদার দেওয়ানদের অত্যাচারে নিপীড়িত অনেক জমিদারের মধ্যেই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। নিপীড়িত লাঞ্ছিত প্রজাদের মধ্যে ধূমায়িত বিক্ষোভকে প্রজাবিদ্রোহে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব জমিদারদের অবদান ছিল অপরিসীম। মূলত দেবী চৌধুরানীর পরামর্শ ও উদ্যোগেই ইটাকুমারীর জমিদার শিবচন্দ্র রায়ের নাটমন্দিরে রংপুর অঞ্চলের অনেক জমিদার ও রায়ত-প্রজারা মিলিত হন এবং অত্যাচারী ইংরেজ শাসক ও দেবী সিংহ হরেরাম সেন প্রমুখের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ইটাকুমারীর পণ্ডিত যাদবেশ্বর তর্করত্ন পীরগাছা এলাকার লোক কবি রতিরাম দাসের লেখা যে ‘জাগ গান’ বা ‘জাগের গান' সংগ্রহ করেছেন সেখানে এ নিয়ে উল্লেখ রয়েছে। এ জাগের গানে বলা হয়েছে যে- কত পাইক পেয়াদা আছে কত দারোয়ান
কত যে আমলা আছে কত দেওয়ান ৷ মন্থনার কত্রী জয়দুর্গা চৌধুরানী। বড় বুদ্ধি বড় তেজ সকলে ৰাখানি ॥ শিবচন্দ্রের কাজকর্ম তার বুদ্ধি নিয়া ৷ তার বুদ্ধির পতিষ্ট করে সক্কল দুনিয়া ॥ শিবচন্দ্রের হৃদে এসব দুস্ক বাজে ।
জয়দুর্গার আজ্ঞায় শিবচন্দ্ৰ সাজে ॥
রংপুর অঞ্চলে কৃষক প্রজা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মন্থনার জমিদার জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী, ইটকুমারীর জমিদার শিবচন্দ্র রায়, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নায়ক ভবানী পাঠক, দিরজী নারায়ণ, দয়াশীল, মুন্সী কাদের উল্লাহ্ খাঁ ওরফে মুসা শাহ, নূরলদীন বা নূরুল উদ্দিন প্রমুখ। ভবানী পাঠক কুড়িগ্রাম-উলিপুর-সুন্দরগঞ্জ এলাকায়, দেবী চৌধুরানী কাউনিয়া ও পীরগাছা এলাকায়, শিবচন্দ্র রায় ইটাকুমারী এলাকায় গোপন ও প্রকাশ্যে বিদ্রোহী কৃষক-প্রজা সেনাদের অবস্থানের জন্য অনেক দুর্গ বা আস্তানা গড়ে তোলেন। হারাগাছের ভবানী পাঠকসহ অনেক বিদ্রোহী নেতার আগমন ঘটেছিল। দেবী চৌধুরানী ও শিবচন্দ্র রায় পীরগাছা নাগইচণ্ডী, অন্নদা নগরের সন্ন্যাসীর মঠ এবং ইটাকুমারীর পার্শ্ববর্তী ঘন বনাঞ্চলে নাউয়ার দিঘির আশপাশের বনাঞ্চলে এরূপ অনেক গোপন আস্তানা বা দুর্গ গড়ে তুলে সেখান থেকে কৃষক-প্রজা বিদ্রোহ পরিচালনা করেন ।
ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনী ও তাদের নিযুক্তর রাজস্ব আদায়কারী ইজারাদার-দেওয়ানদের উপর ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে এবং তাদের সর্বস্ব লুট করে তার একাংশ গরিব প্রজাদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হতো এবং অবশিষ্টাংশ দিয়ে বিদ্রোহ পরিচালনার ব্যয় মেটানো হতো। ভবানী পাঠক বা দেবী চৌধুরানী দুর্গ এবং গোপন আস্তানায় যেমন অবস্থান করতেন তেমনি অনেক সময় তারা নৌকা বা বজরায় অবস্থান করেও প্রজাবিদ্রোহ পরিচালনা করতেন। ইস্ট-ইন্ডয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারী ও দেবী সিংহ হরেরামসহ এদেশীয় রাজস্ব আদায়কারীদের অত্যাচার-নিপীড়নের ফলে অনেক স্বাধীনচেতা জমিদার এবং তাদের প্রজা অনেকেই যখন সর্বস্বান্ত ও গৃহহারা, উচ্চ হারে রাজস্ব বা খাজনা দিতে গিয়ে রিক্ত ও নিঃস্ব ঠিক সেসময়ই অর্থাৎ ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে (১১৭৬ বঙ্গাব্দে) বাংলা ও বিহারে দেখা দেয় মহাদুভিক্ষ যা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' নামে অধিক পরিচিত। এ মহাদুর্ভিক্ষে মারা যায় বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। এ মহাদুর্ভিক্ষের করুণ বিবরণ প্রদান করেছেন প্রসিদ্ধ ইংরেজ লেখক ও ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টার ও এস ম্যালে এবং আরও অনেকে। তাঁদের মতে, অনশনক্লিষ্ট কৃষক-প্রজাগণ খাদ্যদ্রব্যের জন্য সকল প্রকার গবাদিপশু, গৃহস্বামী জিনিসপত্র ও এমনকি ছেলেমেয়েদেরকেও বিক্রি করে দেয়। কিন্তু এসব ছেলেমেয়েকে কেনার লোকও তখন পাওয়া যেত না। ক্ষুধার তাড়নায় এসব ভাগ্যাহত মানুষ গাছের পাতা, ঘাস্, এমনকি মৃতদেহও খেতে শুরু করে। মারা যাবার পূর্বেই মুমূর্ষদের দেহের মাংস শিয়াল কুকুরে খেয়ে ফেলতো ।
এ মহাদুর্ভিক্ষের সময়েও নির্মম-নির্দয় রাজস্ব আদায়কারীগণ দুঃস্থ ও মুমূর্ষ প্রজাদের দুর্দশা নিবারণের জন্য কিছু না করে বরং রিক্ত-নিঃস্ব মুমূর্ষ প্রজাদের নিকট থেকে পূর্বের বৎসর অপেক্ষা উচ্চহারে রাজস্ব ও খাজনা আদায়ে করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। এ জঘন্যতম মজুতদারি ব্যবসায়ে মুনাফা এত বেশি হয়েছিল যে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন ইংরেজ কর্মচারী এভাবে শুধুমাত্র মহাদুর্ভিক্ষের বৎসরই প্রায় দেড় লক্ষাধিক টাকা (তখনকার টাকার মূল্যমানে) ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিল ।
একদিকে দুর্ভিক্ষ, অন্যদিকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির অত্যাচার-লুণ্ঠন ও তাদের রাজস্ব আদায়কারীদের উচ্চহারে খাজনা আদায় ও প্রজাপীড়ন-রংপুর অঞ্চলে কৃষক প্রজাদেরকে বিদ্রোহী করে তোলে। এ বিদ্রোহ ‘রংপুর অঞ্চলের কৃষক বিদ্ৰোহ' নামে পরিচিত ।
রংপুর অঞ্চলে এ কৃষক বিদ্রোহের অপর নায়ক কৃপানাথ রংপুরের বিশাল বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে নিজের শক্ত ঘাঁটি থেকে ইংরেজ বিরোধিতা করেছিলেন। রংপুরের তৎকালীন কালেক্টর ম্যাকডোনাল্ড সাহেবকে কৃপনাথের বাহিনী বেশ কয়েকবার আক্রমণ করেছিল ।
১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে কোচবিহার রাজ্যের দিনহাটা নামক স্থানে সন্ন্যাসী বিদ্রোহী রামানন্দ গোঁসাই-এর নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে লে. মরিসনের বাহিনীর যুদ্ধে রংপুর অঞ্চলের বিদ্রোহী ফকির-সন্ন্যাসীগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ যুদ্ধে মরিসনের বাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ যুদ্ধে ফকীর সন্ন্যাসীগণ গেরিলা পদ্ধতি অবম্বন করেছিলেন। ইংরেজ সরকার এ বিদ্রোহ দমনে তৎপর হয়ে উঠায় ফকীর সন্ন্যাসী বিদ্রোহীগণ হিমালয়ের পাদদেশে জঙ্গলাকীর্ণ মোরাঙ অঞ্চলে সমবেত হয়। ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা মোরাঙ অঞ্চল অবরুদ্ধ করলে ফকীর সন্ন্যাসীগণ পাল্টা আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয় এবং তাদের সেনাপতি কিথ নিহত হন ।
১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে পুর্নিয়া জেলা থেকে কয়েকটি বিদ্রোহী দল রংপুরের বিদ্রোহীদের সাথে মিলিত হয়। এ সম্মিলিত বিদ্রোহী শক্তি রংপুরের গ্রামাঞ্চল থেকে ইংরেজ কর্মচারী ও অত্যাচারী জমিদারদেরকে তাড়িয়ে দেয় এবং ইংরেজদের বাণিজ্য কুঠিগুলো লুণ্ঠন করে। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এ বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাপতি টমাসের নেতৃত্বে এক বিরাট সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর ভোরবেলা রংপুর শহরের নিকটবর্তী শ্যামগঞ্জের ময়দানের সেনাপতি টমাস বিদ্রোহীদের উপর আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু বিদ্রোহী বাহিনীর চতুর নায়কগণ প্রথমে সসৈন্যে পলায়নের ভান করে ক্রমশ পিছু হটতে থাকে এবং টমাসের বাহিনীকে কৌশলে পাশের গভীর জঙ্গলের দিকে টেনে নিয়ে যায়। টমাসের ইংরেজ বাহিনী জয়ের উল্লাসে মত্ত হয়ে তাদের গোলাগুলি নিঃশেষে করে ফেলে। এবারে সুযোগ বুঝে বিদ্রোহীরা অবিলম্বে ইংরেজ বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই টমাসের বাহিনী পরাজিত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বিদ্রোহীদের তরবারির আঘাতে সেনাপতি টমাস নিহত হন। এ যুদ্ধে রংপুর শহরের নিকবর্তী এলাকার সাধারণ কৃষকগণ বিদ্রোহীদেরকে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন এবং অনেকেই বিদ্রোহীদের সাথে সশস্ত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের ইজারাদার দেবী সিংহের 'এ অত্যাচার উৎপীড়নের বিরুদ্ধে রংপুর অঞ্চলের কৃষকগণ ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমে সভা সমিতি এবং পরে তাদের দাবিদাওয়া রংপুরের কালেক্টরের নিকট পেশ করে। কিন্তু এ দাবিদাওয়া পূরণ না হওয়ায় কৃষকগণ নূরলদীনকে তাদের ‘নবাব' বলে ঘোষণা করে এবং তার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। নূরলদীন দেবী সিংহকে কর বা রাজস্ব না দেওয়ার জন্য আদেশ জারি করেন এবং বিদ্রোহের ব্যয় মেটানোর জন্য সামান্য ডিং নামে ধার্য করেন। তিনি দয়াশীল নামক একজন প্রবীণ কৃষককে তাঁর দেওয়ান নিযুক্ত করেন। সমস্ত রংপুর অঞ্চলে হিন্দু- মুসলমান কৃষক দেবী সিংহের উৎপীড়ন ও ইংরেজ শাসনের মূলোচ্ছেদ করার জন্য নূরলদীনের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে কাকিনা, ফতেপুর, ডিমলা, কার্যিরহাট ও টেপা পরগণার কৃষক বিদ্রোহীরা নুরুল উদ্দীনের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেবী সিংহের সংগ্রহকারী নায়েব পাইক বনকন্দাজদেরকে বিতাড়িত করে দেয়। অনেকেই বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। টেপা জমিদারির নায়েব কৃষকদেরকে বাধা দিতে অগ্রসর হলে বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন । ক্রমেই এ কৃষক বিদ্রোহ কোচবিহার দিনাজপুরেও সম্প্রসারিত হয় এবং এসব অঞ্চলের কৃষকগণও নূরলদীনকে নেতা বলে স্বীকার করে নেয় এবং এসব অঞ্চলের উৎপীড়ক নায়েব গোমাস্তাদেরকে বিতাড়িত করে। ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের বিদ্রোহে নবাব নূরলদীন সংগ্রাম সহায়তা করেন দর্জি নারায়ণ, কেনা সরকার, ইসরায়েল খাঁ প্রমুখ। এ বীরযোদ্ধাদের হাতে দেবী সিংহ পর্যুদস্ত হন। (গাইবান্ধার ইতিহাস ও ঐতিহ্য)- সম্পাদকঃ আঃ রাজ্জাক-পৃ. ১৫২)।
নূরলদীনের নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ মারাত্মক আকার ধারণ করলে দেবী সিংহ রংপুরের তৎকালীন কালেক্টর গুডল্যাডের শরণাপন্ন হয়। দেবী সিংহের কুকর্মের দোসর গুডল্যাড ও ম্যাকডোনাল্ডে সাথে খণ্ডযুদ্ধে নূরুল উদ্দীনের কৃষক বাহিনী অসম সাহসিকতার পরিচয় প্রদান করেন। এরপর বিদ্রোহী কৃষকগণ দেবী সিংহ ও ইংরেজ প্রধান ঘাঁটি মুঘল হাট আক্রমণ করে বসেন। মুঘলহাটের এ ভীষণযুদ্ধে নূরুল উদ্দীন গুরুতর আহত ও ইংরেজ সেনাদের হাতে বন্দি হন। নূরুল উদ্দীনের বিচক্ষণ দেওয়ান দয়াশীল এ .যুদ্ধে বীরের মত যুদ্ধ করে নিহত হন। বন্দি ও আহত নূরুল উদ্দীন অল্প কয়েকদিন পর মৃত্যুবরণ করেন।
কৃষক বিদ্রোহের অগ্রনায়ক নুরলদীন ও তাঁর যোগ্য সহচর দয়াশীলের মৃত্যুর পর কৃষক বিদ্রোহিগণ পাটগ্রাম নামক স্থানে তাঁদের ঘাঁটি নির্মাণ করে অবস্থান নেয়। ইংরেজ সেনাপতি ম্যাকডোনাল্ড এ সংঘবদ্ধ বিদ্রোহী কৃষকবাহিনীকে সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত করা অসম্ভ ভেবে যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রতারণাপূর্ণ কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেন । সাধারণ কৃষকের ছদ্মবেশে ম্যাকডোনাল্ডের সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে পাটগ্রামে বিদ্রোহী কৃষকদের ঘাঁটি অকস্মাৎ আক্রমণ করলে বিদ্রোহী কৃষকগণ হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। বিদ্রোহী কৃষকগণ পরাজয় নিশ্চিত জেনেও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেন। ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি অতি প্রত্যুষে শুরু হয় উভয় পক্ষের ভীষণ যুদ্ধ। ইংরেজ বাহিনী ছিল কামান ও আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত। বিদ্রোহীগণ দেশীয় বন্দুক এবং লাঠিসোঠা দিয়েই যুদ্ধ শুরু করে। এ আকস্মিক আক্রমণে বিদ্রোহী কৃষক সেনাগণ যুদ্ধসাজে সজ্জিত হবার কোনো প্রকার সুযোগ পাননি। ফলে হতভম্ব কৃষক বিদ্রোহিগণ এ যুদ্ধে দলে দলে নিহত ও আহত হন। এ যুদ্ধে ৬০ জন বিদ্রোহী কৃষক সেনা নিহত হন।
আহতের সংখ্যা ছিল কয়েক শত। যুদ্ধ জয়ের পর দেবী সিংহ ও ম্যাকডোনাল্ডের ইংরেজ বাহিনী পেশাচিক তাণ্ডব শুরু করে। তাঁরা পার্শ্ববর্তী নিরীহ কৃষকদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ব্যাপক লুটতরাজ ও নারীনির্যাতন শুরু করে। এর ফলে রংপুর অঞ্চলের কৃষকগণ সর্বস্বান্ত ও গৃহহারা হয়ে পড়ে। এসব নির্যাতনের ফলেও এর পর দেবী সিংহের পক্ষে রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়নি। কেননা কৃষকগণ কপর্দক শূন্য হয়ে পড়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব না পেয়ে এর কারণ অনুসন্ধান করার জন্য পিটার্সনকে প্রধান নিয়োগ করে একটি কমিশন গঠন করে রংপুর পাঠায়। পিটার্সন ইংরেজ হলেও দেবী সিংহের প্রজাপীড়ন দেখে দুঃখিত ও মর্মাহত হন। তিনি কলকাতায় কোম্পানির পরিচালকগণকে দেবী সিংহ ও কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে যা লেখেন তার অংশ বিশেষ ছিল নিম্নরূপ : আমার প্রথম দুই পত্রে প্রজাদের উপর কঠোর অত্যাচার এবং তারই জন্য যে তারা বিদ্রোহী হয়েছে সেকথা সাধারণভাবে বিবৃত করেছি।....... আমার প্রতিদিনের অনুসন্ধানে আরও দৃঢ় হচ্ছে। তারা যদি বিদ্রোহী না হতো, তাহলে আমি আশ্চর্য জ্ঞান করতাম। প্রজাদের নিকট হতে রাজস্ব আদায় করা হয় নি, তাদের উপর রীতিমত দস্যুতা এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে কঠোর শারীরিক যন্ত্রণা থাকলেও যেখানে অত্যাচার সীমা অতিক্রম করে, সেখানে প্রতিষ্ঠা বা টিকে থাকার জন্য তাদের বিদ্রোহ করা ব্যতীত আর কোনো উপায় থাকে না। পিটার্সনের মতে, দেবী সিংহ প্রজাপীড়নের মাধ্যমে ৭০ লক্ষাধিক টাকা আয় করেছিলেন।

পিটার্সনের প্রদত্ত রিপোর্টের আলোকে দেবী সিংহের নিকট থেকে রেভিনিউ বোর্ড রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব কেড়ে নেয়। কিন্তু গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস ও কোম্পানির পরিচালকগণ দেবী সিংহের নিকট থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে এত বেশি বশীভূত হয়েছিলেন যে, একটি প্রহসনমূলক বিচার কমিটি (হেস্টিংস কর্তৃক এ বিচার কমিটি গঠিত হয়।) বিচারের রায়ে বলে যে, দেবী সিংহ সম্পূর্ণ নির্দোষ, পিটার্সনই তার নামে মিথ্যা রিপোর্ট প্রদান করেছে। দেবী সিংহের সপক্ষে হেস্টিংস ইংল্যাণ্ডে এ রিপোর্ট প্রদান করেন। দেবী সিংহ গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং প্রজাদের রক্ত শোষণের দ্বারা যে অর্থ জমিয়েছিলেন তা দিয়ে মুর্শিদাবাদের নসীপুর রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠা করেন। তবে চতুর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেবী সিংহকে প্রজা অসন্তোষের ভয়ে আর কোনোদিন রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেনি।
নূরলদীনের নেতৃত্বে রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ এদেশের মানুষের মনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এবং তাদের তাবেদার এদেশীয় জমিদার নায়েব বরকন্দাজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের স্পৃহা জাগিয়ে দেয়। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ‘রংপুরের বিদ্রোহ' তার পরবর্তী কৃষক বিদ্রোহও ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সমর্থ হয় ।
নূরলদীন নেতৃত্বাধীন কৃষক বিদ্রোহীদের অনেকেই পরবর্তীতে ফকির সন্ন্যাসীদের সাথে যোগ দেয়। ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ফকীর মজনু শাহ মারা যান। তাঁর যোগ্যতম শিষ্য ও ভ্রাতা শাহ্ ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীর নেতৃত্বে যে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন পরিচালিত হয় সে সংগ্রামে রংপুরের বিদ্রোহী কৃষকগণ ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে পরেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু লে. ব্রেনানের নেতৃত্বে একটি সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে যুদ্ধে স্বয়ং ভবানী পাঠক ও তাঁর পাঠান সেনাপতিসহ অপর দু'জন সহকারী নিহত হন। এরপরও দেবী চৌধুরানী দীর্ঘদিন যাবৎ ইংরেজ বিরোধী কৃষক বিদ্রোহ পরিচালনা করে ইংরেজ শাসকদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছিলেন। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এ ফকীর-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ও কৃষক বিদ্রোহের অবসান ঘটে।
ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহে রংপুর অঞ্চলের কৃষকগণ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন এবং প্রয়োজনবোধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। কিন্তু ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে নূরল উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন ‘রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ' ছিল সম্পূর্ণভাবে একটি গণবিদ্রোহ ও কৃষকবিদ্রোহ। তাছাড়া ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ‘রংপুর কৃষক বিদ্রোহ' ছিল সম্পূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা দ্বারা সমৃদ্ধ। এ অসাম্প্রদায়িক চেতনাই রংপুরের জনগণকে বিদ্রোহী ইংরেজ বেনিয়া শাসকগণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল। রংপুরের অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন মানুষের জন্য এ কৃষকবিদ্ৰোহ তাই গর্বের ও ঐতিহ্যের বিষয় ।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহ বা সিপাহিবিদ্রোহ সমগ্র রংপুর অঞ্চলকে প্রকম্পিত করেছিল। এ সময় বিদ্রোহী সিপাহিদের রংপুরের দিকে আসার কথা শুনে ভীত হয়ে রংপুরের তৎকালীন কালেক্টর ম্যাকডোনাল্ড তার অনুগত লোকজন ও ট্রেজারির সম্পদ হাতির পিঠে নিয়ে গাইবান্ধার দিকে চলে আসেন এবং তুলশীঘাটের গভীর জঙ্গলে বেশ কয়েকদিন আত্মগোপন করে থাকেন।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ রংপুর অঞ্চলকেও প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। রংপুর অঞ্চলে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ, হরতাল, রাখিবন্ধন, বিলাতি দ্রব্য বর্জন এবং জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশের মধ্যে রংপুরে প্রথম জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। এসময় রংপুরে অনুশীলনী সমিতির অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন সতীশ পাকড়াশী। তিনি ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের বিপ্লবীদের প্রেরণাদাতা এবং রংপুর ছিল উত্তরবঙ্গ যুববিপ্লবী আন্দোলনের কেন্দ্র ।
খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলনের সময় রংপুর জেলার সমস্ত গ্রাম অঞ্চলে এক বিপুল ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থান ঘটেছিল এবং গ্রামগুলো মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। এসময়ে স্বাধীন পলাশবাড়ি, স্বাধীন ডিমলা, স্বাধীন কিশোরগঞ্জ গড়ে তোলার জন্য উক্ত এলাকার মানুষ সংগ্রামী ও অসাম্প্রদায়িক ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। পলাশবাড়ি, কিশোরগঞ্জ ও ডিমলায় ‘স্বাধীন সরকার' প্রতিষ্ঠিত হয় ।
পলাশবাড়ির বাঁশকাটা, কাতুলী ও ছোট ভগবানপুর গ্রামে ব্রিটিশ স্থানীয় জমিদারদের সহায়তায় নীলকুঠি স্থাপন করে কৃষকদের নির্যাতনের মাধ্যমে নীলচাষে বাধ্য করতে শুরু করলে-জনগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ আগস্ট এক বিরাট জনসভা থেকে স্বাধীন ‘পলাশবাড়ি স্টেট' এর ঘোষণা দেওয়া হয়। এ জনসভায় কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক ও স্বাধীনতা সংগ্রামের জেলা নেতা অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জী বক্তৃতা করেন। জনসভায় ‘স্বাধীন পলাশবাড়ি' পতাকাও উত্তোলন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক এম, কে রহিমউদ্দিন, ‘স্বাধীন পলাশবাড়ির’ এর ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এ ঘোষণার পর থেকে পলাশবাড়িতে ব্রিটিশ সরকারের অফিস-আদালত, কোর্ট- কাচারি-বয়কট করে এবং সংগ্রাম পরিষদ তথা স্বাধীন সরকার গঠন করে বিচার সালিশ সবকিছুই করতে থাকে। সাধারণ কৃষক-জনতার মধ্য থেকেই বিপ্লবী শান্তি সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়েছিল-এর সর্বাধিনায়ক ছিলেন খান মোহাম্মদ দারাজ হোসেন খান লোদী। জামালপুর মৌজায় স্বাধীন পলাশবাড়ি স্টেট-এর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়েছে। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ আগস্ট পলাশবাড়ি স্বাধীন স্টেট এর যে ‘রাষ্ট্রীয় সমিতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করা হয় তার সভাপতির ছিলেন ফজল উদ্দিন তালুকদার ও সম্পাদক ছিলেন এম.কে রহিম উদ্দিন। স্বাধীন পলাশবাড়ি স্টেট গঠনের সংবাদ বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্যার হেনরি হুইলারকে ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং তিনি রংপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এ আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য কঠোর নির্দেশ জারি করেন। রংপুরের তদানীন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডি, এম ফ্রেজার গাইবান্ধা মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেটকে ‘পলাশবাড়ি স্বাধীন স্টেট' আন্দোলনের নেতাদেরকে গ্রেফতারের নির্দেশ প্রদান করলে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধা মহকুমার পুলিশ ইন্সপেক্টর কিছু নেপালি পুলিশ নিয়ে পলাশবাড়ির পুরানো ডাকবাংলোয় উপস্থিত হন। কিন্তু স্থানীয় তীর ধনুক ও লাঠিসোটা সজ্জিত বিপ্লবী জনগণের প্রতিরোধের মুখে তিনি কাউকে গ্রেফতার না করে মহকুমার সদরে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এরপর মিলিটারি গোয়েন্দা অফিসার মিঃ গ্রেগরি ..অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কয়েকশ ব্রিটিশ, বেলুচ ও গুর্খা সৈন্য নিয়ে পলাশবাড়ি আসেন।

পলাশবাড়ি থানার দারোগা মেহের রকস্ মিয়ার সাথে বিপ্লবীদের ছিল গভীর বন্ধুত্ব। তারই প্রচেষ্টায় বিপ্লবীদের ৩ ৩জন স্বেচ্ছায় গ্রেফতারবরণ করেন। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে জনগণ তাদের মুক্ত করার জন্য থানা ঘেরাও করে বিপ্লবী স্লোগান দিতে থাকে। কিন্তু বিপ্লবী পরিষদের নেতাদের অনুরোধ তারা শান্ত হন। পরবর্তীতে বিচারে বাদিদের তিনমাসের কারাদণ্ড হয় ৷
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ‘ডোমার স্বাধীন স্টেট' ঘোষণা করেন সেখানকার বিপ্লবী জনগণ । এর নেতৃত্বে ছিলেন ‘ডোমার থানা কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটি।' জনাব বছির মিয়া ছিলেন এ কমিটির সম্পাদক। দলে দলে সাধারণ মানুষ বিপ্লবী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে নাম লেখাতে থাকে। বিপ্লবী সংগ্রাম কমিটি নিজেরাই পাল্টা কোর্ট, কাচারি, বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল । ডোমার থানার বামুনিয়া গ্রামে বিপ্লবী সরকার নিজেদের অফিস স্থাপন করে। মহেন্দ্র পণ্ডিত ছিলেন এ আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা। বিপ্লবীরা নিজেরাই দারোগা, পুলিশ ও আমিনের দায়িত্ব ও সততা নিষ্ঠার সাথে পালন করে । বিপ্লবী জনগণ এলাকার সতীশ বর্মণকে হাকীম, বিপন চন্দ্রকে আমীন এবং ফারাজ আলীকে দারোগা পদে অধিষ্ঠিত করে ।
রংপুর জেলার সবচেয়ে সংগঠিত আন্দোলন গড়ে ওঠে বাতাসন পরগনায়। বাতাসন রায়ত সমিতির নেতৃত্বে স্থানীয় জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে ‘খাজনা বন্ধ’ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। এ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন ঠাকুর প্রসাদ রায়। আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য জমিদার তার লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে ঠাকুর প্রসাদ রায়কে মেরে ফেলার উদ্যোগ নেয়। লাঠিয়াল বাহিনী ঠাকুর প্রসাদ রায়কে আক্রমণ করে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায়। জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। পরদিন ক্ষিপ্ত জনগণের ঢল নামে বদরগঞ্জ বাজারে। জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীকে হত্যা করে তারা এর প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হয়। রংপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সংবাদ পেয়ে কয়েকজন জেলা পর্যায়ের হিন্দু-মুসলমান নেতাকে সঙ্গে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বদরগঞ্জে যান এবং জনগনকে শান্ত থাকতে অনুরোধ জানান এবং লাঠিয়ালদের গ্রেফতার করলেও অন্যান্য অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। ঠাকুর প্রসাদ মৃতপ্রায় হলেও তার ভ্রাতুষ্পুত্র ব্রহ্মেশ্বর রায়, লক্ষ্মীকান্ত কুণ্ড এবং দারাজ উদ্দিন মণ্ডলের নেতৃত্বে আন্দোলন আরও জোরদার হলে নিরুপায় হয়ে জমিদার নিজেই বিপ্লবীদের সাথে আপোষ করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রায়ত সমিতির সাথে জমিদারের কতকগুলো প্রধান দাবি স্বীকারের ভিত্তিতে আপোষ হয়ে গেলে ধীরে ধীরে এ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে ।
ত্রিশের দশকের শেষদিকে রংপুর জেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকগণ জমিদারদের বিরুদ্ধে ‘হাটতোলা বন্ধ' আন্দোলন গড়ে তোলেন। জমিদাররা ‘হাট-তোলা’ নিয়ে কৃষক-জনগণের উপর জুলুম-নির্যাতন করতে শুরু করায় জনগণ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং জমিদারের হাট বয়কট করে নিজেরাই নতুন হাটবাজার প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। এসব নতুন হাটের নামকরণ করা হয় ‘দশের হাট' বা সব জনগণের হাট। কাশিমবাজার স্টেটের বাহারবন্দ পরাগনার উলিপুর হাট, কাঁঠালবাড়ি হাট, বড়বাড়ি হাট, মুস্তফী হাট এবং বদরগঞ্জ থানার ‘বায়ারহাট'-এর হাট-তোলা আদায় নিয়ে স্থানীয় জনগণের সাথে জমিদারদের প্রচণ্ড বিরোধ সৃষ্টি হয়। জনগণ একদিকে যেমন হাটতোলা বন্ধের আন্দোলন করছিলেন, অন্যদিকে তারা নিজেরাই বিকল্প হাট বাজার গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন ৷
জমিদারদের উচ্ছেদ, ক্রোক, নিলাম, সার্টিফিকেটের বিরুদ্ধেও রংপুর অঞ্চলের জনগণ বিশের দশক থেকে প্রতিবাদী হতে থাকে। টেপা, ডিমলা, কাশিমবাজার, ঘড়িয়ালডাঙ্গা, মুর্শিদাবাদ, নবাব স্টেট প্রভৃতির জরিমদারগণ রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রজাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। অনেক সময় তারা রাজস্ব বাকি ফেলে তাদের জমিদারি সরকারের হাতে তুলে দেয়। এরপর সরকার সার্টিফিকেট করে চাষির গরু- ছাগল ঘটি-বাটি ক্রোক করে খাজনা আদায় করে। জমিদার নির্ঝঞ্ঝাট তার প্রাপ্য অর্থ পেয়ে যায়। সরকার জমিদারের কাচারিতে বসেই পুলিশ-বরকন্দাজ, পেয়াদা, তহসিলদার পাঠিয়ে জুলুম অত্যাচার করতে শুরু করলে অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে । ত্রিশের দশকে জমিদারদের এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘কৃষক- প্রজা সমিতি' ও ‘কৃষক প্রজা' দলের রংপুর অঞ্চলের নেতাগণ সোচ্চার হয়ে ওঠেন তাদের মধ্যে গাইবান্ধার জনাব আবু হোসেন সরকার, কুড়িগ্রামের কাজী এমদাদুল হক ও সুধীর মুখার্জী, রংপুরের অবনী বাগচী, দীনেশ লাহিড়ী, মহী বাগচি, মন্টু মজুমদার, নৃপেন ঘোষ, বিমল ভৌমিক, মণিকৃষ্ণ সেন, নীলফামারীর জনাব এফেন্দী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য ।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে কংগ্রেসের ডাকে ‘আইন অমান্য আন্দোলন' শুরু হয়। এ আন্দোলনের সময় গাইবান্ধার প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা ও তুলশীঘাটের জমিদার বিজয় রায় চৌধুরীকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করলে গাইবান্ধা জেলা স্কুলে-এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। গোবিন্দগঞ্জ থানার কামদিয়া থেকে শতশত সাঁওতাল তীর ধনুক নিয়ে মিছিল সহকারে এসে গাইবান্ধা কারাগার ঘেরাও করেছিল। এ ‘আইন অমান্য আন্দোলনে' ১৯৩০-১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কারাভোগ করেন গাইবান্ধা অঞ্চলের মহিউদ্দিন খাঁ, আহমদ জান খান, স্বামী খানানন্দ, আবু হোসেন সরকার, অন্নদা সেন, হরিশচন্দ্র চৌধুরী, রতিশ পাল, হেমন্ত সরকার, বেনী মাধব উকিল ও তার কন্যা শান্তিবালা, দৌলুতন নেছা, খাতুন, তমিজ উদ্দিন উকিলের দুই কন্যা মতি ও মৈলী, নলডাঙ্গার বৈদ্যনাথ লাহিড়ী ও অমৃতলাল উকিল প্রমুখ। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে কারারুদ্ধ হন বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা মজিবর রহমান। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখার জন্য কারমাইকেল কলেজে অধ্যয়নরত আবুল মোকসেদ ও নির্মলেন্দু বর্মণকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে ‘ভারত ছাড়' আন্দোলন শুরু হলে রংপুর অঞ্চলের মধ্যেও বিশেষ করে গাইবান্ধা অঞ্চলে এর প্রচণ্ড প্রভাব লক্ষ করা যায়। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে ২০ আগস্ট রংপুর শহরে বিরাট গণসমাবেশ হয়। সভাপতিত্ব করেন আবু হোসেন সরকার। সুধীন মুখার্জী, শচীন ঘোষ, এ সভায় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। এ সময়ে আন্তর্জাতিক ভিত্তিতে ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার জন্য সরকার গাইবান্ধা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী ও কংগ্রেস নেত্রী দৌলতুন নেছা খাতুন, শ্রীমতি প্রতিভা সরকার, মহামায়া ভট্টাচার্য প্রমুখ অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে।

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধনীতির কারণে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে (বাংলা ১৩৫০) সমগ্র বাংলাদেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়। এ দুর্ভিক্ষ ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ বা মহাদুর্ভিক্ষ' নামে পরিচিত। সরকারি যুদ্ধনীতির ফলে বাজার থেকে চাউল উধাও হয়েছিল এবং খাদ্যশস্য মজুদ হয়েছিল সরকার, চোরাবাজারি ও মজুদদারদের গুদামে । খোলা বাজারে খাদ্যশস্যের পাশাপাশি লবণ, কেরোসিন, ডাল প্রভৃতির সরবরাহ কমে যাবার ফলে হু হু করে দাম বেড়ে যায়। বিশেষ করে ডোমারে খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। শুধু নীলফামারী মহকুমায় ৩ লক্ষ লোকের মধ্যে এ দুর্ভিক্ষে মারা যায় পঞ্চাশ হাজার। সমগ্র জেলায় সর্বদলীয়ভাবে রিলিফ কমিটি গঠন এবং লঙ্গরখানা খুলে এ দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়। জেলা রিলিফ কমিটির সভাপতি হন জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং সম্পাদক হন মণিকৃষ্ণ সেন। নীলফামারী এলাকার বলরাম সাহা, কেষ্ট বাবু, কুড়িগ্রাম জেলায় শ্রী অজয় চক্রবর্তী, সুধীর মুখার্জী, গাইবান্ধা জেলায় কংগ্রেস নেত্রী দৌলতুন্নেসা খাতুন, গোপেন রায়, রেবা রায় চৌধুরী, পানু পাল (সাংস্কৃতি কর্মী) প্রমুখের ভূমিকা ছিল স্মরণযোগ্য। একদিকে তারা যেমন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেছিলেন তেমনি দুর্ভিক্ষের সময় বুভুক্ষ জনগণের পাশে এসে সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে দিয়েছিলন।
১৯৪৬-৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘তেভাগার' দাবিতে যে ব্যাপক আন্দোলন রংপুর তথা উত্তরবঙ্গের শোষক জমিদার জোতদার শ্রেণিগুলোকে ভীত সন্ত্রস্ত করে সে কাহিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক তথা কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ও গৌরবজনক অধ্যায়। ১৯৪৬-৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ‘তেভাগা আন্দোলন' একটি অসাধারণ কৃষক-সংগ্রাম পরিণত হয়েছিল। ১৯৪২-৪৩ খ্রিষ্টাব্দের মহাদুর্ভিক্ষের রেশ কাটতে না কাটতে সমগ্র বাংলায় সাম্প্রদায়িক চেতনা অতি দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছিল। তেভাগা আন্দোলন শুরুর পূর্বে ১৬ আগস্টের বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এদেশের সামাজিক জীবনে কুৎসিত ক্ষতের সৃষ্টি করে। এমনি এক দুঃসময়ে সংঘটিত হয় তেভাগা আন্দোলন যা হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির এক অভূতপূর্ব অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছিল। উল্লেখ করা প্রয়োজন ‘তেভাগা আন্দোলন' কী এবং কীভাবে সংঘটিতে হয়েছিল। ‘তেভাগা’ কথাটির উৎস অধিকার আন্দোলন থেকে। জোতদারি ব্যবস্থায় কৃষক প্ৰধানত ভূমিহীন, জোতদারদের জমি ভাগে চাষ করে সে অর্ধেক ফসলের অধিকারী। তবে বাস্তবে বহুক্ষেত্রে ঋণ, প্রবঞ্চনা ইত্যাদি কারণে ইত্যাদি এ অধিকার বা ভাগচাষি কৃষকরা পেতে তারো কম । মন্বন্তর এদেশের ভাগচাষি অসহায় কৃষকদের চোেেখ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বা উপলব্ধি করতে সাহায্য করে যে, ফসলের উপর তার অধিকার অর্ধের নয় বরং তার অধিক। তার-----আধা নয়, তিনভাগের দু'ভাগে। জোতদার নেবে একভাগ, উপরন্তু ফসল কাটা হয়ে ধান উঠবে আধিয়ারের খোলানে। সেখান থেকে জোতদার তার নির্দিষ্ট ভাগ পাবে ।

‘তেভাগা' সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে ভূমি রাজস্ব কমিশনের সুপারিশ বলা হয়েছিল যে, বর্গাদারদের প্রজা হিসেবে গণ্য করা হোক এবং জোতদার-এর ভাগ অর্ধেকের পরিবর্তে এক তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা হোক যাতে বর্গাদার তার ভাগ হিসেবে দুই-তৃতীয়াংশ পেতে পারে। এ ভূমি রাজস্ব কমিশনের সুপারিশে আরও বলা হয়েছিল যে, “যেসব বর্গাদার লাঙল, গরু বলদ ও কৃষি উপকরণ যোগায় তাদের প্রজা হিসেবে গণ্য করা হোক------আমরা এও সুপারিশ করছি যে তাদের কাছে আইন সংগতভাবে আদায়যোগ্য ফসলের ভাগ অর্ধেকের পরিবর্তে এক-তৃতীয়াংশ করা হোক।” ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে পাঁজিয়া প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন এবং ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের লালিতাবাড়ি প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনে তেভাগা সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। কৃষক নেতাদের মধ্যে ভাগচাষি কৃষকদের অধিকার সম্পর্কে চেতনার সৃষ্টি হয়। শুরু হয় তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তুতি। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে এ আন্দোলন জলপাইগুড়ি দিনাজপুর, রংপুর, ২৪ পরগণা, মেদিনীপুর, ও ময়মনসিংহ জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। রংপুর জেলার তেভাগা আন্দোলন শুধুমাত্র নীলফামারী মহকুমায় (সৈয়দপুর থানা বাদে) এবং সদর থানার একটি গ্রামে সীমাবদ্ধ ছিল।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে রংপুরে অনুষ্ঠিত হয় উত্তরবঙ্গের কৃষক নেতাদের বৈঠক। নভেম্বরে কৃষক সভা তেভাগা সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু করে। তেভাগা আন্দোলন শুরু হয় তৎকালীন দিনাজপুর জেলার আটোয়ারী থানার রামপুর গ্রাম থেকে। অতি দ্রুত আন্দোলন রংপুর ও জপাইগুড়ি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে আন্দোলন শুরু হয় ডোমার থানায়। জেলার প্রখ্যাত নেতা মহী বাগচী, অবনী বাগচী, দীনেশ লাহিড়ী, মণিকৃষ্ণ সেন, মন্টু মজুমদার সকলেই তখন ডোমার-ডিমলা এলাকায় তেভাগা আন্দোলন সংগঠন কাজে সদাব্যস্ত। ডোমারের স্থানীয় কৃষক সমিতির নেতা বলরাম সাহা, নারায়ণ ব্যানার্জী, হিরকান্ত সরকার নেতৃত্ব দিচ্ছেন নিজ নিজ এলাকায় । তাদের সাথে রয়েছেন তেজোদ্দীপ্ত মহিলা নেত্রী রানী মুখার্জী। এদের নেতৃত্বে আধিয়ার- কৃষকদের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠে তেভাগার স্থানীয় সৈনিকেরা-কালিপদ দে, নজর পণ্ডিত, রমেন ব্যানার্জী, রূপকান্ত, মোহন, পাঁচতুরী, তরণী, গোলাম আজিজ, মোহনী, ক্ষীরোদা, বিমল ভৌমিক আরও কত ত্যাগী সাহসী মানুষ। ডিমলা এলাকায় দীনদয়াল বর্মণ, চাঁটি মোহাম্মদ, কালা চাঁদ, বাবু মিঞা, শফরুদ্দীন, টোগরু মোহাম্মদ, গজেন রায়, তন্নারায়ণ, নীল বর্মণ, আলিমুদ্দিন, মহির উদ্দিন, ভোটরা বর্মণ, চিত্র বর্মণ, বাবুরী বর্মণ, বিপিন বর্মণ, হরেন্দ্র বর্মণ, জামশেদ আলী প্রমুখ নির্ভীক ও অকুতোভয় লড়াকু কৃষক সেনারা। কিশোরগঞ্জ এলাকায়-নেতৃত্ব দেন পরেশ মজুমদার, আব্দুস সামাদ প্রমুখ এবং নির্ভীক লড়াকু যোগেন সরকার, মোহিনী বর্মণী, ছোট ধরণী বর্মণ, সৌরিন সেন প্রমুখের তখন একটাই আওয়াজ ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ', ‘তেভাগা চাই'। কিশোরগঞ্জ বড়ভিটা, মেলাবর, বড় ডুমুরিয়া, রণচণ্ডি, কুটাপাড়া ও কৈমারী এবং জলঢাকা থানার গাররোল, খুটামারী অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন বিস্তৃত হয়েছিল। কাইমারির ভেরা বানিয়া, জলঢাকার মহান্ত বানিয়া, মহিম বানিয়া, যতীশ বানিয়া, আপ্তার মিঞা এ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বদরগঞ্জ এলাকায় স্বয়ং কৃষক নেতা সুধীর মুখার্জী, রানী মুখার্জী, জিতেন দত্ত, নৃপেন ঘোষ, শংকর বাবু নেতৃত্ব দেন। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে দেবেন বসু, অনন্ত শীল. ছয়ের উদ্দিন প্রমুখ তেভাগার লড়াইয়ে তখন তেজোদ্দীপ্ত। বদরগঞ্জ এলাকায় মধুপুর গ্রামে এ আন্দোলন ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত।
তেভাগা আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে মণিকৃষ্ণ সেন আহত হয়েছিলেন জোতদারদের ভাড়াটিয়া গুণ্ডাদের লাঠির আঘাতে। এর সচিত্র বিবরণ রয়েছে শিল্পী সোমনাথ হোর-এর লেখা ‘তেভাগার ডায়েরি' গ্রন্থে। লেখায় এবং স্কেচে মণিকৃষ্ণ সেনের আহত হবার দৃশ্য রয়েছে সেখানে। সোমনাথ হোর লিখেছেন এভাবে— “২০ ডিসেম্বর প্রায় দুপুরে মণিকৃষ্ণ সেন যখন খাওয়ার আয়োজন করছিলেন, সে সময় জোতদার কোরামল (মাড়ওয়ারী) প্রায় দশ এগারো জন লোক নিয়ে বাবুরি বর্মণের বাড়ির দিকে হৈ হল্লা করতে করতে এগোতে থাকে। মণিকৃষ্ণ সেন হৈচৈ শুনে তাদের দিকে এগিয়ে যান। কোরামল ‘তুমিই আধিয়ারদের ক্ষেপাচ্ছ” এ কথা বলেই মণিকৃষ্ণ সেনের মাথায় জোরে লাঠির আঘাত করে। মণিকৃষ্ণ সেনকে আঘাত করতে দেখে বিপিন বর্মণ ছোট একটি লাঠি হাতে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু কোরামলের লোকজনের আক্রমণে সে সরে পড়তে বাধ্য হয়। তখন বাবুরির বৃদ্ধা মা ছাড়া আর কেউ ছিলো না। বাবুরির মা মণিকৃষ্ণ সেন এবং বিপিনকে আক্রমণ করতে দেখে ‘গাইন’ হাতে এগিয়ে আসেন, এবং ঐ গাইন দিয়ে কোরামলকে মারতে শুরু করেন। কোরামলের লোকজনেরা তখন লাঠির আঘাতে বৃদ্ধা রমণীকে ধরাশায়ী করে পালিয়ে যায় এবং নিকটবর্তী নিজেদের এক খামারে আশ্রয় নেয়। এ সময় স্থানীয় কিছু লোক খবর পেয়ে ঘটনাস্থালের দিকে এগিয়ে আসে। তাদের দেখে কোরামল ভীত হয়ে কৃষকদের ভয় দেখানোর জন্য বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করে এবং সন্ধ্যার আন্ধকারে গাঢাকা দিয়ে রংপুর থেকে পালিয়ে যায়। (কোরামল দুটো বন্দুকও সঙ্গে এনেছিলেন) মণিকৃষ্ণ সন এবং বিপিন বর্মণ উভয়েই মাথায় ও শরীরের অন্যান্য স্থানে খুব চোট পেয়েছিলেন।”
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাস থেকে' ৪৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ডোমার-ডিমলা, কিশোরগঞ্জ, জলঢাকা, বদরগঞ্চে আধিয়ার কৃষকরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলেন। তাদের মুখে ছিল স্লোগান—
‘আধি নাই, তেভাগা চাই'
'বিনা রসিদে ধান নাই'
‘কর্জা ধানের সুদ নাই'
‘ধান কেটে ঘরে তোল' ‘নিজ খুলিতে ধান তোল’
‘কৃষক সমিতি জিন্দাবাদ'
‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ।'
রংপুরের তেভাগার লড়াইয়ে করুণ ও দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছিল। বুকের তাজা রক্তে সিক্ত হয়েছিল বঙ্গভূমি। সুনীল সেন তার সুলিখিত গ্রন্থে বলেছেন যে, “শয়ে শয়ে স্বেচ্ছাসেবক মাঠে নেমে ফসল তোলেন বর্গাদারদের খামারে। জানুয়ারি (৪৭) মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের একটা সংঘর্ষ হয়। ডিমলার জনৈক মুসলমান জোতদার অতর্কিতে এক কৃষকের বাড়িতে হামলা চালায় । সেখানে কৃষকেরা এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিল । বাচ্চা মোহাম্মদ ও তন্নারায়ণ রায়ের নেতৃত্বে কৃষকরা সে আক্রমণ প্রতিরোধ করে। জোতদার কৃষকদের উপর গুলি চালায়। তন্নারায়ণ মারা যান এবং বাচ্চা গুরুতর আহত হন। তন্নারায়ণের মৃত্যুর খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। লাঠি আর বর্শা হাতে তিন হাজার কৃষক গ্রামে জড়ো হন। সেদিন ডিমলা এক অভ্যুত্থানের মুখে। জোতদার মুসলমান ছিলেন বলে নেতারা মারমুখী মেজাজের কৃষকদের বুঝিয়ে তার বাড়ি আক্রমণ করতে নিষেধ করে।, তাদের ভয় ছিল মুসলমান জোতদারদের বাড়িতে আক্রমণ করা হলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধে যেতে পারে। ইতোমধ্যে সৈয়দপুরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল । কৃষকরা একটি বিক্ষোভ শোভাযাত্রা বের করেন। সে শোভাযাত্ৰা বিভিন্ন গ্রামের মধ্য দিয়ে নীলফামারী শহর পর্যন্ত যায়। মিছিল সৈয়দপুর পরিক্রমা করার পর দাঙ্গা বন্ধ হয়। স্বাধীনতা পর্যন্ত রংপুরের কোথাও আর দাঙ্গা হয়নি। জোতাদাররা গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়ে সুদিনের অপেক্ষা করতে থাকে।”
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে রংপুর অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে রংপুর অঞ্চলের ছাত্র-শ্রমিক- রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ডাকে প্রতিটি আন্দোলনে সাধারণ কৃষক কোনোদিনই পিছিয়ে ছিল না ।
রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ কত খ্রিষ্টাব্দে সংগঠিত হয়?
উত্তর : ১৭৮৩ খ্রি. ।
কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম ঐক্যবদ্ধ, স্বতঃস্ফূর্ত ও সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন কোনটি?
উত্তর : রংপুর কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.)।
কোন আন্দোলনের ফলে কোম্পানি সরকার রাজস্ব নীতি পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছিল?
উত্তর : রংপুর কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.) ।
কোন আন্দোলন বাংলার পরবর্তী কৃষক আন্দোলনের পথ প্রদর্শক ছিল?
উত্তর : রংপুর কৃষক আন্দোলন (১৭৮৩ খ্রি.)।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]