ইতিহাস বলতে কী বুঝ? ইতিহাসের সাথে সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক বর্ণনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান মানবিক বিদ্যার দুটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে পরিচিত । ইতিহাস মানবসমাজের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করে আর সমাজবিজ্ঞান একটি সামগ্রিক বিজ্ঞান হিসেবে মানবসমাজের যাবতীয় কার্যকলাপের পর্যালোচনা করে থাকে। তাই ধরে নেওয়া যায়, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মুখ্য আলোচ্য বিষয় মানুষ ও তার কর্মকাণ্ড । উভয়ের আলোচ্য বিষয় এক ও অভিন্ন হওয়ার কারণে উভয় শাস্ত্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিরাজমান । ইতিহাসের সংজ্ঞা : ইতিহাস কী তা এককথায় বলা কঠিন। কারণ অনেক পণ্ডিতই ইতিহাস বিষয়ে নিজেদের মতো করে মত দিয়েছেন । তাই সহজেই একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় পৌঁছা যায় না। তবে পণ্ডিতগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতসমূহ বিশ্লেষণ করে ইতিহাসের একটি সাধারণ সংজ্ঞা তৈরি করা সম্ভব। অতীতে যা কিছু ঘটেছে সাধারণভাবে তাকেই ইতিহাস বলা হয় । কিন্তু অতীতের সবকিছুকেই ঢালাওভাবে ইতিহাস বলা যায় না। শুধুমাত্র অতীতের যেসব ঘটনাপ্রবাহ মানুষের দ্বারা নির্মিত ও সংঘটিত বলে জানা যায় তার সত্যনিষ্ঠ লিখিত বিবরণকেই ইতিহাস বলা যায় ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
ই. এইচ. কার (E.H. Carr) বলেন, “ইতিহাস হলো বর্তমান ও অতীতের মধ্যে এক অন্তহীন সংলাপ । ঐতিহাসিক জনসন (Jonson) বলেন, “ঘটে যাওয়া ঘটনাই ইতিহাস। যা ঘটে না তা ইতিহাস নয় ।”
ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস ( Herodotuss) বলেন, “ইতিহাস হলো সত্যিকার অর্থে ছিল বা সংঘটিত হয়েছিল তা অনুসন্ধান করা ও লেখা।”
আর্নল্ড টয়েনবির (Arnold Toynbee) মতে, “সমাজের জীবনই ইতিহাস। প্রকৃতপক্ষে মানবসমাজের অনন্ত ঘটনাপ্রবাহই হলো ইতিহাস ।”
র‍্যাপসন (Rapson)বলেছেন, “ইতিহাস হলো ঘটনার বৈজ্ঞানিক ও ধারাবাহিক বর্ণনা।”
আধুনিক ইতিহাসের জনক ও জার্মানি ঐতিহাসিক লিওপোল্ড ফন র‍্যাংকে (Leopold Von Ranke) মনে করেন, “প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিল তার অনুসন্ধান ও তার সত্য বিবরণই ইতিহাস।”
সুতরাং উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, ইতিহাস হচ্ছে মানব সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিক ও সত্যনিষ্ঠ বিবরণ। সঠিক ইতিহাস সবসময় সত্যকে নির্ভর করে রচিত হয়।
সমাজবিজ্ঞানের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক : সমাজবিজ্ঞানের সাথে ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। নিম্নে সমাজবিজ্ঞানের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক আলোকপাত করা হলো :
১. বিষয়বস্তুগত : ইতিহাস যেমন মানুষের সব কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করে তেমনি সমাজবিজ্ঞানও সমাজব্যবস্থার প্রধান উপাদান হিসেবে মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপের পর্যালোচনা করে থাকে । তাই ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু এক ও অভিন্ন । বিষয়বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে উভয়ের আলোচ্যবিষয়ে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র লক্ষ করা যায়।
২. মানুষের জীবনপ্রণালি : ইতিহাসের জন্য সমাজবিজ্ঞান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সমাজবিজ্ঞানী যে গবেষণা কর্ম পরিচালনা করেন তার ফলাফল ঐতিহাসিকদের জন্য যথেষ্ট মূল্যবান। মূলত সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবনপ্রণালি হচ্ছে আধুনিক সামাজিক ইতিহাসের মূল আলোচ্য বিষয়। এদিক থেকেও ইতিহাসের সাথে সমাজবিজ্ঞানের যথেষ্ট সাদৃশ্য বিদ্যমান ।
৩. পারস্পরিক লেনদেন : পারস্পরিক লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে উঠেছে। সমাজবিজ্ঞান তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনেকাংশে ইতিহাসের ওপর নির্ভর করে। মানবসমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের ওপর সমাজবিজ্ঞান গুরুত্বারোপ করে। মানবসমাজে সংঘটিত সব ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণই হলো ইতিহাস। আর এ ইতিহাসের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তসমূহকে সমাজবিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে একটি শক্তিশালী সমাজতাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তোলেন ।
৪. ইতিহাস দর্শন : পৃথিবীর মানব সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ, ক্রমবিবর্তন, পরিবর্তন, পতন ইত্যাদি প্রসঙ্গে ইতিহাস দর্শন সমাজবিজ্ঞানে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে থাকে। ইতিহাস দর্শন হচ্ছে আধুনিক সমাজচর্চার ক্ষেত্রে এক নতুন সংযোজন। আধুনিক সমাজ চিন্তা ও ইতিহাসচর্চা উভয়েই ইতিহাস দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত। ইতিহাস দর্শনের অবদানের ফলে ইতিহাস বিদ্যায় অজ্ঞাত ধ্যানধারণার প্রয়োগ ও তাত্ত্বিক অনুসন্ধান সম্ভব হয়েছে।
৫. ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞান : সমাজবিজ্ঞান সমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারণা ও এর শ্রেণিবিভাগের প্রথম উপকরণ জানার জন্য ইতিহাসের কাছে ঋণী। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞান নামে যে নতুন ধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার ধারণা অনুসারে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিক তথ্যাদির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়। মূলত সমাজ চিন্তার ক্ষেত্রে এটি হলো এক বিশেষ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে যুগে যুগে ঐতিহাসিক ধ্যানধারণার ভিত্তিতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্ভব, বিকাশ ও শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে বিশদভাবে জ্ঞানার্জন করা যায় ।
৬. সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ : ইতিহাস সমাজবিজ্ঞানের সাহায্য সহযোগিতার ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল । সমাজবিজ্ঞান ইতিহাসের আলোচনাতে সামাজিক পটভূমি প্রদান করে। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের চর্চা করা হয়ে থাকে। বস্তুত সমাজতান্ত্রিক তাৎপর্য অনুধাবন ছাড়া ইতিহাসের অনুশীলন পরিপূর্ণ হয় না। সমাজবিজ্ঞানের মতোই সামাজিক ইতিহাসে সমাজ ও তার গঠন, বিন্যাস, বিচিত্র সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক আচার আচরণ, প্রথা, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে পর্যালোচনা পরিলক্ষিত হয়। কার্যত ঐতিহাসিক কর্তৃক সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজবিজ্ঞানীদের সামাজিক বিষয়াদির বিশ্লেষণের যথেষ্ট মিল পরিলক্ষিত হয়। তথাপি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতি, কৌশল, প্রশ্নমালা পদ্ধতি ইত্যাদি থেকেও ইতিহাস উপকৃত হচ্ছে ।
৭. সামাজিক পরিবর্তন : আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশের তারতম্যের কারণে সামাজিক জীবনে বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে সামাজিক পরিবর্তন ও আনুষঙ্গিক বিবিধ বৈচিত্র্য নিয়ে যখন ইতিহাসশাস্ত্র আলোচনা করে তখন একজন ইতিহাসবিদের সামাজিক জ্ঞান প্রয়োগ করতে হয়। এক্ষেত্রে সামাজিক কাঠামোর স্বরূপ, অর্থনৈতিক কাঠামো, উৎপাদন সম্পর্ক, রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতির সম্পর্কে ইতিহাসবিদের জ্ঞান থাকতে হবে ।
৮. বিভিন্ন পেশার মানুষের বর্ণনা : ইতিহাস যখন সমাজে বসবাসরত মানুষের পেশা, সামাজিক শ্রেণি, ধর্ম, আচার অনুষ্ঠান, শিক্ষা, জীবনবোধ, অর্থনৈতিক অবস্থা ও নানাবিধ সমস্যা, ভাষা, আইন ও প্রথা, জীবনাচরণ, শিল্প ও চিত্রকলার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করে তখন সমাজবিজ্ঞানের সহায়তা দরকার হয়। কারণ এই বিষয়গুলো যথার্থভাবে বিশ্লেষণ করেই একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসরত প্রায় সব শ্রেণি পেশার মানুষের জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে অনেক গাঢ় সম্পর্ক বিদ্যমান। আধুনিক মানুষের ইতিহাস বা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইতিহাসের পাতায় বেশ গুরুত্বের সাথে স্থান পাচ্ছে। উভয় শাস্ত্র জ্ঞান লেনদেনের মাধ্যমে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। ফলে মানুষের বর্তমান ও অতীতের মধ্যে একটি যোগসূত্র রচনা সম্ভব হচ্ছে, যা মানববিদ্যার বা মানববিদ্যা সম্পর্কিত অন্যান্য শাস্ত্রের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]