সমাজবিজ্ঞান কাকে বলে? ইতিহাসের সাথে সমাজবিজ্ঞানের পার্থক্য আলোচনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান মানববিদ্যার দুটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে নানারূপ বৈসাদৃশ্য পরিদৃষ্ট হয়। মানুষ কর্তৃক রচিত, সৃষ্ট, নির্মিত, বিনির্মিত, আবিষ্কৃত, ধ্বংসপ্রাপ্ত বিষয়াবলির ইতিবাচক ও নেতিবাচক কর্মের লিখিত বিবরণীকে ইতিহাস বলা হয়। অন্যদিকে, সমাজের উৎপত্তি, উদ্দেশ্য, সামাজিক কাঠামো, বিভিন্ন সামাজিক সংঘ ও প্রতিষ্ঠান, মানুষের সব প্রকার দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি সমাজবিজ্ঞানের মূল উপজীব্য বিষয়। ফলে বিষয়বস্তুগত দিক, পদ্ধতিগত দিক, উৎপত্তিগত দিক, পরিধিগত দিক, ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় ।
সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা : সমাজবিজ্ঞান বলতে আমরা সমাজের ঘটনাসমূহের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সংবলিত জ্ঞান শাস্ত্ৰকেই বুঝি। এখানে সমাজের প্রধান উপাদান হিসেবে মানুষের বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আচার আচরণ প্রভৃতি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিচারবিশ্লেষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করা হয়। সমাজবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদান করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞাগুলো নিম্নে দেওয়া হলো :
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার ও পেজ (Maclever & Page) এর মতে, "Sociology alone studies social relationships themselves and society itself."
সমাজবিজ্ঞানী সিমেল (Simmel) বলেন, “সমাজবিজ্ঞান এমন একটি বিজ্ঞান যা মানব সম্পর্ক অধ্যয়ন করে।"
সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম (Emile Durkheim) বলেন, "Sociology is the Science of Social Institutions." অর্থাৎ, সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিজ্ঞান ।
সমাজবিজ্ঞানী পার্কের (Park) মতে, “সমাজবিজ্ঞান হলো মানবগোষ্ঠী বা সমষ্টির আচরণ সম্পর্কিত বিজ্ঞান । "
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের (Max Weber) মতে, “সমাজবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হলো সামাজিক কার্যাবলির অধ্যয়ন এবং সামাজিক কার্যাবলির মধ্যে একটি কার্যকরণ সম্পর্ক নির্ণয়ে ব্যাখ্যাদান করা।”
উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলতে পারি, যে শাস্ত্র সমাজ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করে তাই সমাজবিজ্ঞান ।
ইতিহাসের সাথে সমাজবিজ্ঞানের পার্থক্য : ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বিভিন্ন দিক থেকে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং উভয়ের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও বৈসাদৃশ্যও বেশ লক্ষণীয়। নিম্নে ইতিহাসের সাথে সমাজবিজ্ঞানের পার্থক্য নিরূপণ করা হলো :
১. উৎপত্তি : পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের সময় হতেই ইতিহাসের উদ্ভব হয়। এরপর হেরোডোটাস সর্বপ্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে History শব্দটি ব্যবহার করেন । অপরদিকে, উৎপত্তিগতভাবে সমাজবিজ্ঞানের আয়ুষ্কাল ইতিহাসের চেয়ে অনেক কম । কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ও আধুনিকভাবে সমাজবিজ্ঞানের জন্ম উনিশ শতকে হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায় । ২. মতবাদগোষ্ঠী : স্বতন্ত্র জ্ঞানশাস্ত্র হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতবাদগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। যেমন— জৈবিক মতবাদগোষ্ঠী, সমাজতাত্ত্বিক মতবাদগোষ্ঠী, বিশ্লেষণাত্মক মতবাদগোষ্ঠী, মনস্তাত্ত্বিক মতবাদগোষ্ঠী প্রভৃতি। পক্ষান্তরে, ইতিহাস কোনো মতবাদ বা মতবাদগোষ্ঠীর সাহায্য ছাড়াই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজ, সভ্যতা ও রাষ্ট্রের একান্ত প্রয়োজনের তাগিদে অনিবার্যভাবে মানবকর্মের রেকর্ড হিসেবে ইতিহাসের উদ্ভব হয়েছে। ৩. বিষয়বস্তু : বিষয়বস্তুগত দিক পর্যালোচনা করলে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। প্রাচীন, মধ্য, এমনকি আধুনিক যুগেও যুদ্ধবিগ্রহ, সমরসজ্জা, রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতি, সাম্রাজ্যের উত্থানপতন ইতিহাসের মূল বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। তবে বিশ শতকের শেষের দিকে ইতিহাসে বেশকিছু শাখা যেমন— সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক প্রভৃতি ইতিহাসের উন্মেষ ঘটেছে। সমাজবিজ্ঞানে ইতিহাসের অনুরূপ বিষয়াবলি যেমন— যুদ্ধবিগ্রহ, রাজাবাদশা মুখ্য আলোচ্য বিষয় নয়, বস্তুত সমাজের অখণ্ড আলোচনাই সমাজবিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য ।
৪. দৃষ্টিভঙ্গি : অতীত ঘটনাকে তুলে আনাই ঐতিহাসিকের একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। অতীতের ঘটনার আলোকেই তিনি বর্তমানের ইতিহাস রচনা করেন। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানী মূলত বর্তমান সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করেন। অপরদিকে, গবেষণার প্রয়োজনে সমাজবিজ্ঞানী নিকট অতীতের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেও তা ইতিহাসের মতো পরিপূর্ণ অতীত বিশ্লেষণ নয় ।
৫: পদ্ধতি : সমাজবিজ্ঞানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত বেশি অনুসৃত হয়। কিন্তু ইতিহাসে পর্যালোচনা ও বিচারবিবেচনার বিজ্ঞান থাকলেও তাতে সমাজবিজ্ঞানের মতো বৈজ্ঞানিক নীতি অনুসৃত হয় না।
৬. আলোচ্য বিষয়ের ধরন : ইতিহাস অতীত কার্যাবলি নিয়ে পর্যালোচনা করে। সমাজবিজ্ঞান অতীতের কার্যাবলিকে বর্তমানের প্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটাতে চেষ্টা করে ।
৭. ধারাবাহিকতা : ইতিহাসে ধারাবাহিকতা ও সময়ানুক্রম একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কার্যত ধারাবাহিকতা ও সময়ানুক্রমকে ইতিহাসের মূলসূত্র বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানে ধারাবাহিকতা ও সময়ানুক্রমের চেয়ে সমাজের বিভিন্ন দিকই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় ।
৮. পরিধি : ইতিহাসের পরিধির চেয়ে সমাজবিজ্ঞানের পরিধি অনেক বিস্তৃত। অবশ্য এ বক্তব্যটি বর্তমানে সর্বাংশে সত্য নয়। আজ থেকে বহু পূর্বে যখন ইতিহাস বলতে অতীতের যুদ্ধবিগ্রহ ও রাজ্যের উত্থানপতনের কাহিনিকে বুঝানো হতো তখন প্রথমোক্ত বক্তব্যটি প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে মানুষের সবকিছুই ইতিহাসের পরিধিভুক্ত হওয়ায় ইতিহাসের পরিধি ও সমাজবিজ্ঞানের মতোই বৃদ্ধি পেয়েছে।
৯. প্রকৃতি : ইতিহাসে বর্ণিত সব বিষয়ই প্রামাণ্য সত্য। এখানে কল্পকাহিনি ও ধারণার কোনো স্থান নেই। তাই মানবসমাজের ইতিহাস একান্ত বস্তুনিষ্ঠ বিষয়রূপে সমাদৃত। পক্ষান্তরে, সমাজবিজ্ঞান মূলত বস্তুনিরপেক্ষ বিজ্ঞান হিসেবে পরিচিত। ১০. রচনাপদ্ধতি : একজন ঐতিহাসিক কোনো একটি ঘটনার চূড়ান্ত ফলাফল কী তা দেখে ইতিহাস রচনা করেন। পক্ষান্তরে, একজন সমাজবিজ্ঞানীকে সংগৃহীত তথ্যগুলোকে সমাজতাত্ত্বিক মানদণ্ডে পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে সমাজবিজ্ঞান রচনায় হাত দিতে হয় । সুতরাং ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের রচনাপদ্ধতি অনেকাংশে আলাদা । উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলে তাদের মধ্যে ব্যাপক অসামঞ্জস্যপূর্ণ দিক রয়েছে। ইতিহাস মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের তথ্য দিয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, সমাজবিজ্ঞান মানব সভ্যতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিট (সমাজ, পরিবার, গোত্র প্রভৃতি) নিয়ে আলোচনা করে। যার ফলে উভয় শাস্ত্রের মধ্যে কাছাকাছি সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে উভয়েই আবার সমান্তরাল রেখার মতো অগ্রসরমান। এতে দুই শাখার স্বাতন্ত্র্য বৃদ্ধি পেয়ে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা কমে গেছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]