ইতিহাসের সাথে নৃবিজ্ঞানের সম্পর্ক ব্যাখ্যা কর।

উত্তর ভূমিকা : নৃবিজ্ঞান মানুষের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে। নৃবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হলো মানুষ, তার অবয়বের গঠনপ্রণালি, মানুষের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা, সংস্কৃতি, সামাজিক বিবর্তন প্রক্রিয়া প্রভৃতি। আর ইতিহাসশাস্ত্রের মূল আলোচ্য বিষয়বস্তু হলো মানুষ ও তার কর্মকাণ্ড। সুতরাং বিষয়বস্তুর দিক থেকে উভয় শাস্ত্রের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে নৃবিজ্ঞানের অনেক বিষয়বস্তুই ইতিহাসের প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল। জ্ঞানের উন্নয়নে উভয় শাখার মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা প্রতিষ্ঠিত হলেও মানবিক কর্মকাণ্ড, সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক প্রভৃতি বিবেচনায় উভয় শাখার মধ্যে সম্পর্ককে আরও দৃঢ়তর করেছে ।
● ইতিহাসের সাথে নৃবিজ্ঞানের সম্পর্ক : নিম্নে ইতিহাসের সাথে নৃবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা করা হলো :
১. মানবীয় বর্ণনা : মানুষের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশকে নৃবিজ্ঞান বা Anthropology বলে। অপরদিকে, মানবজীবনে যা কিছু ঘটে তার বৈজ্ঞানিক ও বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনাকে ইতিহাস বলে। তাই বিষয়বস্তুগত দিক থেকে উভয় শাস্ত্র একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। এ কথা নিঃসন্দেহেই বলা যায় প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বর্তমানের আধুনিক যুগ পর্যন্ত সব প্রকার মানবীয় কর্মকাণ্ড ইতিহাসে বিষয়বস্তুরূপে বিবেচ্য। অন্যদিকে, মানুষ মানুষের অবয়ব, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মানুষের সংগ্রামী জীবন প্রভৃতি নৃবিজ্ঞানের বিবেচ্য বিষয়। তাই বলা যায়, উভয় শাস্ত্রই মানবীয় বর্ণনাকে প্রধানরূপে বিবেচনা করে ।
২. বিষয়বস্তু : মানুষের বর্ণনার সাথে সাথে ইতিহাস সমাজস্থ মানুষের শিল্পকলা, রুচিবোধ, মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক বিবর্তন, সামাজিক স্তরবিন্যাস, সামাজিক শ্রেণি প্রভৃতি সম্পর্কে বর্ণনা করে থাকে। অপরদিকে, নৃবিজ্ঞানও শিল্পকলা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সমাজের উৎপত্তি ও বিবর্তন প্রভৃতির বর্ণনা দিয়ে থাকে। এদিক থেকে উভয়েই অনেকটা কাছাকাছি । তাই বলতে পারি, বিষয়বস্তুগত দিক থেকে ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞান পরস্পর সম্পর্কিত ।
৩. গবেষণা : নৃবিজ্ঞানকে মানববিষয়ক বিজ্ঞান বলা হয়, যেখানে মানুষকে, মানবীয় কর্মকে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গবেষণা করা হয় । বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মানুষ ও তাদের রকমারি কর্মকাণ্ডের গবেষণা হয় নৃবিজ্ঞানে। পক্ষান্তরে, ইতিহাসও মানবকর্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে ঐতিহাসিক সত্য প্রতিষ্ঠা করে। মানুষের প্রকৃতির সাথে যেহেতু তার কর্মের এরূপ গভীরতর সম্পর্ক রয়েছে সেহেতু পদ্ধতিগত অর্থাৎ গবেষণাগত দিক বিচারেও উভয় শাস্ত্রের সুসম্পর্ক লক্ষ করা যায়।
৪. মানব বিবর্তন : হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের ফলে আজকের মনুষ্যপ্রকৃতিতে আমরা উপনীত হয়েছি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা অর্থাৎ খাড়া মানব, জাভা মানব, পিকিং মানব নিয়ানডারথাল মানব, প্রভৃতির বিবর্তন ইতিহাসে যেমন গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয় তেমনি নৃবিজ্ঞানেও আলোচিত হয়। নৃবিজ্ঞানের দৈহিক নৃবিজ্ঞান শাখায় পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ও পরবর্তীকালে তাদের শারীরিক বিবর্তন প্রক্রিয়া, মনুষ্য জীবাশ্ম গুরুত্বের সাথে স্থান পায়। যা ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞানের সম্পর্ক আরও গভীরতর করে তুলেছে।
৫. উপাদান : ইতিহাস উপাদান নির্ভর জ্ঞানশাস্ত্র । লিখিত ও প্রত্নতত্ত্বিক উপাদানের ওপর কোনো দেশ বা জাতির ইতিহাস নির্ভর করে। তন্মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ প্রাগৈতিহাসিককালের সমাজ ও রাজনীতিসহ অন্যান্য সব ধরনের রীতিনীতির সম্পর্কে আমাদেরকে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেয়। একইভাবে নৃবিজ্ঞানের বর্ণনাও প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন উপাদানের ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভর করে। উয়ারী বটেশ্বরে প্রাপ্ত নিদর্শনের মাধ্যমে আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বের সমাজ ও জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব হচ্ছে। এই প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ নৃবিজ্ঞান ও ইতিহাস উভয় শাখাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাই প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান বিচারে দুই শাস্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায় ।
৬. ঐতিহ্য : ইতিহাস ঐতিহ্যের বিবরণ। ঐতিহ্য হচ্ছে অতীতের অভ্যাস, শিক্ষা, ভাষা, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি যা ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত থাকে। মানব সভ্যতার এই ঐতিহ্যকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয় ইতিহাস। যার ওপর ভিত্তি করে আমাদের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। অন্যদিকে, সাংস্কৃতিক দিক বিচারে নৃবিজ্ঞানের অন্যতম একটি শাখা হলো সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান । এই শাখা মানুষের বিভিন্ন সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সামাজিক ব্যবস্থার বিবর্তন প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে। মানব সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক উপাদান নিয়ে ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞান সমানভাবে গবেষণা করে । সাংস্কৃতির উপাদান এই দুই শাখারই পাঠ্য।
৭. জাতি বিজ্ঞান : বর্তমান ও নিকট অতীতের জাতিগুলোর রীতিনীতি, চিন্তাভাবনা ও কাজকর্মের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য প্রভৃতি নৃবিজ্ঞানে জাতিবিজ্ঞান নামক শিরোনামে আলোচিত হয়। তেমনিভাবে সামাজিক ইতিহাসে বিভিন্ন মনুষ্য জাতি, সম্প্রদায়, সমাজ, সামাজিক স্তরবিন্যাস, সামাজিক শ্রেণি ইত্যাদি আলোচিত হয়। যার সামুষ্ঠিক রূপ হলো জাতিবিজ্ঞান। জাতিবিষয়ক আলোচনায় দুই শাখাই সমানভাবে অবদান রাখছে। যার মাধ্যমে জাতি বিজ্ঞানগত দিক থেকে ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞানের মধ্যে সুসম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়।
৮. পরিধি : অতীতের মনুষ্য সম্প্রদায় কী করেছিল? বর্তমান মনুষ্য সম্প্রদায় কী করছে? কেন করছে? কীভাবে করছে এবং এর ফলাফল কী ইত্যাদি নানান প্রশ্ন নিয়ে নৃবিজ্ঞান কাজ করে। তাই বলা হয়, Anthropology is the scientific study of people, society and culture. অনুরূপভাবে ইতিহাসও মানব প্রকৃতি, মাননকর্ম, সমাজব্যবস্থায় মানুষের কর্মের প্রভাব, সমাজ ও রাষ্ট্রে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণ প্রভৃতি কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করে। এতে করে মানুষ হিসেবে, সামাজিক প্রাণী হিসেবে কিংবা আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মানুষের কর্মের সার্বিক মূল্যায়ন সম্ভব হয়েছে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাস মানুষ ও মানবকর্মের ওপর গবেষণা পরিচালনা, সমাজে মানুষের অবস্থান ও অবদান ইত্যাদি বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নৃবিজ্ঞানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। মানবকর্মের ওপর বিস্তৃত পরিসরে নির্ভরশীলতাই জ্ঞানের দুই শাস্ত্রকে একই সূত্রে আবদ্ধ করেছে। এই দুই শাখার মধ্যে জ্ঞানের এত আদানপ্রদান ঘটবে উভয় শাস্ত্রই তত বেশি সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। ফলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মনুষ্য সমাজ সম্পর্কিত জ্ঞান ও গবেষণা আরও বেশি যুগোপযোগী ও তথ্যবহুল হবে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]