ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২০-৩৩) বিদ্রোহের পটভূমি

Pagalpanthi Rebellion of Mymensingh (1820-33 )
একদার উপমহাদেশের বৃহত্তম গৌরবধারী ময়মনসিংহ জেলা। প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নাসিরাবাদ থেকে মোমেনশাহী এবং তা থেকে ময়মনসিংহ জেলার বয়সকাল বিচারে এটি সোয়া দুই'শ বছরেরও পুরানো। যদিও সেই জেলাটি পরবর্তীকালে ছয়খণ্ডে বিভক্ত হয়ে নতুন নতুন জেলা নামে পরিচিত পেয়েছে। নবতর জেলাগুলো হচ্ছে— ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ। এর মাঝে টাঙ্গাইল মহকুমা ষাটের দশকে বিভাজিত হয়ে নতুন জেলায় রূপান্তরিত হয়। আর বাকি পাঁচটি বিগত শতাব্দীর আশির দশকে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে নতুন জেলায় পরিণত হয়। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ময়মনসিংহ নামের এই পলিভূমি ছয়খণ্ডে বিভক্ত হলেও ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ জীবনের চিরকালীন আত্মীয়তার কোনো ছেদ পড়েনি ।
মানস-ঐক্যের এই সমন্বয়শীলতার কারণেই এখাকার জনসমাজ এটিকে এবং এর সমুদয় বিষয়াবলিকে এখনো ঐতিহ্যগত আঙ্গিকে মূল্যায়িত করে থাকে। কাল- কালান্তরের নিরন্তর ধারাবাহিকতায় এই জেলার সামগ্রিক অবয়ব বহুবার বহুভাবে বিবর্তিত হয়েছে, তার গৌরবোজ্জ্বল মর্যাদা বুকে ধারণ করেই। তাই আত্ম আবিষ্কারের অন্বেষণে, আত্মপরিচয়ের ঔজ্জ্বল্য সংরক্ষণে নিজেদের অতীত গৌরবগাথার শেকড় সচেতন লোক লোকসমাজ মাত্রই খোঁজেন। ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের অত্যাচার ও শোষণের প্রতিবাদে ময়মনসিংহ অঞ্চলে (বর্তমানে ময়মনসিংহ বিভাগ) যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে তা পাগলপন্থি বিদ্রোহ নামে পরিচিত। সমকালীন অন্যান্য আন্দোলনের মতো এটি প্রকৃতিগতভাবে ছিল বিক্ষিপ্ত, সহজাত, অপরিকল্পিত, স্থানীয়, ভূমিসংক্রান্ত এবং ধর্মীয়। প্রথম পর্যায়ে আন্দোলনটি পরিচালিত হয় জমিদারদের বিরুদ্ধে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এটি ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।
ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ পরিচিতি
প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে পাগলপন্থি বিদ্রোহ একটি বহুল আলোচিত বিষয়। তাই পাগলপন্থি বিদ্রোহ সম্পর্কে প্রথমেই ধারণা থাকা প্রয়োজন। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, করিম শাহ নামক জনৈক ভ্রাম্যমাণ ফকির অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষাংশে বৃহত্তর ময়মনসিংহ (বর্তমান জামালপুর জেলা) তাঁর খানকা স্থাপন করেন। করিম শাহ প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না এবং শিষ্যকরণে তাঁর কোনো জাতিভেদও ছিল না। তাঁর ভক্তদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, গারো, হাজং প্রভৃতি সব ধর্মের লোকই ছিল। করিম শাহ স্বীয় বিবেকের অনুশাসন মেনে চলতেন এবং অন্যান্য ফকিরদের মতো নিজেকে পারস্য কায়দায় দিওয়ানা বা মাস্তানা না বলে পাগল বলে আখ্যায়িত করতেন। এর জন্য তাঁর মতবাদ পাগলপন্থি মতবাদ বা ‘পাগলপন্থি বিদ্রোহ' নামে পরিচিত। করিম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র টিপু শাহ বা টিপু পাগলপন্থি দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। টিপু পাগলের সময়ে প্রথমে জমিদার এবং পরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পাগলপন্থিদের সশস্ত্র যুদ্ধ বাঁধে, যা প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে ‘মাইলফলক’ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানে পাগলপন্থি বিদ্রোহের প্রধান কারণ প্রজাদের উপর জমিদারের অকথ্য অত্যাচার। শেরপুর অঞ্চল ছিল পূর্বে নাটোরের জমিদারির অন্ত গর্ত। চিরস্থায়ী বন্দাবস্তের পর নাটোরের জমিদার রাজস্ব প্রদানের ব্যর্থ হলে জমিদারি নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। শেরপুর অঞ্চল কলকাতার কয়েকজন ব্যবসায়ী নিলামে খরিদ করে নেয়। নতুন জমিদারগণ ঘন ঘন খাজনা বৃদ্ধি করতে থাকে এবং নানা রকম চাঁদা, সেলামি, নজরানা, তহুরি প্রভৃতির নামে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করতে থাকে। প্রজারা ইংরেজ সরকারের নিকট এহেন অত্যাচারের প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু ইংরেজ সরকার এ ব্যাপারে প্রজাদের কোনোরূপ সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন প্রজারা আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে টিপু পাগলের শরণাপন্ন হয় । নির্যাতিত প্রজাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল টিপুর শিষ্য। টিপু পাগল তাঁর শিষ্যদেরকে বলে দেন যে, চিরাচরিত হারের ঊর্ধ্বে কেউ যেন খাজনা না দেয়। তাঁর ডাকে সকলেই সাড়া দেয়। অত্যাচার ও উৎপীড়নের প্রতিবাদে টিপু পাগলের নেতৃত্বে তারা ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে জমিদারগণ প্রাণ রক্ষার্থে পালিয়ে কালিগঞ্জের ম্যাজিস্ট্রেট ড্যাম্পিয়ার সাহেবের কাচারিতে আশ্রয় নেয়। পাগলপন্থিরা শেরপুর শহর দখল করে নেয়। টিপু পাগল স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং নিজেকে ঐ অঞ্চলের শাসক হিসেবে প্রচার করেন। পরে তিনি ইংরেজদের হাতে পরাজিত ও বন্দী হন। কিন্তু ইংরেজ সরকার পাগলপন্থিদের প্রবল চাপের মুখে টিপুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দে সরকার বিরোধী কার্যকলাপের অপরাধে পুনরায় টিপুকে বন্দী করা হয়। প্রজা ও পাগল বিদ্রোহ ধীরে ধীরে প্রবল আকার ধারণ করে। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে পাগলপন্থি ও টিপুর অনুগত বাহিনী শেরপুরের জমিদার বাড়ি ও কাচারি লুট করে সকল সরকারি ভবন ও পুলিশ স্টেশন জ্বালিয়ে দেয়। জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথর নামক দু জন গারো সর্দার এই বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। শেরপুর থেকে গারো পাহাড় পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চলকে পাগল রাজ্য বলে ঘোষণা করা হয়। বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য কোম্পানিকে ঢাকা থেকে অতিরিক্ত সৈন্য আনতে হয়। কোম্পানির সৈন্যরা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালায় এবং পাগলপন্থিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেয়। কোম্পানির সৈন্যদের ব্যাপক সন্ত্রাসের মুখে পাগলপন্থিদের বিদ্রোহ নির্মূল হয়ে যায়। তবে এ বিদ্রোহের চেতনা পরবর্তীতে এ অঞ্চলের জনসাধারণকে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে।
ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহের পটভূমি
প্রজাদের উপর ব্রিটিশ সরকার ও তাদের অনুগত জমিদারদের অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতনের ফলেই পাগলপন্থি বিদ্রোহের পটভূমি তৈরি হয়। দেখা যায় যে, আধ্যাত্মিক সুফিসাধনায় নিমগ্ন ও খোদাপ্রেমে মাতোয়ারা মুসলমান সাধক দিওয়ানা বা ‘পাগল' হিসেবে লোকসমাজে পরিচিত পান। পীর-মুরিদ বা গুরু-শিষ্যের সিলসিলা বা পরপম্পরায় সুফীবাদী লোকধর্মের এই পরিচিতি বিনির্মিত হয়। এ ধরনের অন্যতম লোকায়ত ধর্ম ঐতিহ্যগত সুনির্দিষ্ট কোনো তরিকার অনুসারী না হয়েও ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ময়মনসিংহে এ পাগলপন্থিদের আবির্ভাব ঘটে। সত্যনিষ্ঠা, সাম্য, মানবতাবাদ, ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল পাগলপন্থিদের ধর্মাদর্শের মূল বিষয়বস্তু। তাঁদের মতে, সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি; কেউ কারো গোলাম নয়। তাই কেউ উঁচু, কেউ নিচু- এইরূপ ভেদাভেদ নাই। সকল মানুষ ভাই ভাই। এই মহান সাম্যের বাণী নিয়ে বঙ্গ- ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তারের ১৮ বছর পর ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে করিম শাহ নামক এক মুসলমান ফকির ময়মনসিংহের সুসং পরগনায় আবির্ভূত হন। তিনি ছিলেন এ অঞ্চলে পাগলপন্থি ধর্মচেতনার প্রথম গুরু। সেসময় সুসং পরগনাঞ্চলে জমিদার- জোতদারদের শোষণ-নিপীড়নে জর্জরিত ছিল সেখানকার সমতলের বাসিন্দা মুসলমান, গারো পাহাড়ের প্রান্তস্থিত উপজাতীয় গারো, হাজং, হদি, ডালু, বানাই কৃষককুল । জমিদারদের চাপিয়ে দেওয়া নিবর্তনমূলক নানা নামের কর, আবওয়াব, মাথটে এই অঞ্চলের কৃষকগণ ছিলেন সর্বস্বান্ত প্রায়। এদিকে জুলুমবাজ অভিজাত জমিদার- জোতদার শ্রেণি, অন্যদিকে নিঃস্বপ্রায় কৃষক শ্রেণি। সুসং অঞ্চলে বিদ্যমান পর্বতপ্রমাণ এই শ্রেণিবৈষম্য প্রপীড়িত সমাজে সাম্য ও সুবিচারের বাণী নিয়ে আবির্ভূত হন উদারনৈতিক লোকধর্মানুসারী সাধুপুরুষ করিম শাহ। তিনিই পাগলপন্থি বিদ্রোহের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ।
পাগলপন্থি বিদ্রোহের জনক এই করিম শাহ ফকির কোনো প্রাচীন পীরালি সিলসিলাভুক্ত ছিলেন না। তাঁকে স্থানীয় পাঠান বংশোদ্ভূত আফগান জমিদার শের আলী খাঁ গাজীর পুত্র বলে ধারণা করা হয়। করিম শাহর প্রকৃত নাম চাঁদ খাঁ গাজী বলে জানা যায়। শেরপুর পরগণার স্থানীয় নাগবংশীয় জমিদারদের সাথে বিবাদে চক্রান্তমূলক সাজানো একটি খুনের অভিযোগে মুর্শিদাবাদের রাজদরবারের বিচারে শের আলী খাঁ গাজী মুক্তিপণ শোধে রাজ্যহারা হন। পরবর্তীকালে ঐসব জমিদারদের বিদ্বেষের জেরে শেরআলী খাঁ গাজী নিহত হন। অবস্থার প্রতিকূলতায় শের আলী গাজীর বিধবা স্ত্রী শিশুপুত্র চাঁদ গাজীকে নিয়ে গারো পাহাড়ের পাদদেশস্থ নির্জন স্থান পালকোণায় আত্মগোপন করেন। এই আত্মগোপনাবস্থায়ই শের আলীর স্ত্রী মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পর এতিম পুত্র চাঁদগাজী অধুনা নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর থানার জারিয়া ঝাঞ্জাইলের সাড়ে চার কিলোমিটার পশ্চিমে শংকরপুর গ্রামে স্বীয় বাসস্থান নির্ধারণ করেন। শের আলী গাজীর এই এতিম পুত্র নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই সম্ভবত এখানে অবস্থানকালীন যৌবনের প্রারম্ভে তাঁর বাল্যনাম চাঁদগাজীর পরিবর্তে করিম শাহ ব্যবহার করতে শুরু করেন। এখানে অবস্থানকালে তাঁর প্রদর্শিত ধর্মাদর্শে বিপুলসংখ্যক মানুষ আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে পীর হিসেবে গ্রহণ করে। উদার ধর্মালোচনার পাশাপাশি তাঁর হৃত পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার মানসে স্থানীয় ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের পরিপোষিত জমিদারদের জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে সোচ্চার হতে থাকেন। তাঁর এই ক্রমপরিবর্তিত বিদ্রোহী ভূমিকা পালনের ভেতর দিয়ে তাঁর বাল্যনাম চাঁদগাজী লোকমানস থেকে ক্রমবিস্মৃত হয় করিম শাহ'র আবরণে। জমিদারি বঞ্চিত ও শাসন কর্তৃত্বহীন চাঁদগাজী স্থানীয় প্রভাশালী জমিদারদের রুদ্ররোষ থেকে নিজেকে বাঁচাতে সম্ভবত করিম শাহ ছদ্মনাম ধারণ করে সূফি তরিকার আশ্রয় নিয়ে থাকবেন ।
সরকারি ভাষ্যে জানা যায়, সাতসিক্কা ও সুসংয়ের পার্বত্য অঞ্চলের লোকদের মধ্যে অনাচার দেখে করিম শাহ নামে এক মুসলমান ফকির এই এলাকায় আস্তানা গাড়েন। তিনি শরিয়তের মূল উৎস কুরআন-হাদিসের অনুসারী ছিলেন। নারীদের হিজাব, হায়েজ-নেফাস সংক্রান্ত বিধিনিষেধ, রোজা, জানাজা সংক্রান্ত নিয়মকানুন পালন করতেন। দৈনন্দিন আচারআচরণে ইসলামি আচরণের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন। ইসলামে গর্হিত কাজ বলে স্বীকৃত মিথ্যা বলা, গিবত বা পরনিন্দা, ক্রোধ প্রভৃতি কুপ্রবৃত্তি পরিহার করতে বলতেন। ইসলামে নিষিদ্ধ সুদের কারবার পরিহার, যৌতুক না নেওয়া, আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত না করা, আল্লাহর রাজ্যে কাউকে অধিকার বঞ্চিত না করা করিম শাহর নসিহতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইসলামের মূলনীতি বহির্ভূত কোনো মত করিম শাহ প্রচার করেননি। এতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাঁর ভক্ত শ্রেণিতে পরিণত হয় এবং পরবর্তীতে পাগলপন্থি বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
করিম শাহ ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে শেরপুরের মুন্সীবাজারের ১ মাইল উত্তরে পাহাড়ের পাদদেশস্থ শালকোনায় অবস্থান করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। এরপর তিনি পুকুরাকান্দায় যান। পরে শেরপুরের জমিদারদের প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধাচরণের কারণে সুসং জমিদারের এলাকা শংকরপুরে আশ্রয় নেন। এখানে অবস্থানকালে শেরপুর জমিদারদের থেকে কিছু জমি নিষ্কর লাভ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর অধিকারে ঐ বিষয়-সম্পত্তির অংশীদারিত্ব নিয়ে পারিবারিক কলহ শুরু শুরু হলে শংকরপুর ত্যাগ করে কংস নদীর দক্ষিণ পাড়ে লেটিরকান্দায় নতুন বসতি নির্মাণ করেন। এখানেও বাসকালে দশকাহনিয়া শেরপুর পরগনা, সুসং পরগনা ও পর্বত সন্নিহিত গির্দ গারো অঞ্চলের জমিদারদের কর্তৃক শোষিত নিপীড়িত মুসলমান ও উপজাতীয় গারো-হাজং কৃষিজীবীদের অনেকে করিম শাহ ফকিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। সামন্ত শ্রেণির অমানবিক জুলুমের শিকার হওয়া এই মানুষেরা করিম শাহের সাম্যবাদী, মানবতাবাদী, উদারনৈতিক লৌকিক ধর্মীয় মতাদর্শকে আশীর্বাদ হিসেবেই গ্রহণ করে। করিম শাহ তাঁর বিভিন্ন আস্তানায় অবস্থানকালে কনিষ্ঠ পুত্র টিপু শাহকে নানা স্থানে ধর্মপ্রচারে পাঠাতেন। করিম শাহ একজন সৎ, আদর্শবাদী, ধর্মপরায়ণ, ভবিষ্যৎবক্তা হিসেবে লোকসমাজে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে করিম শাহ মারা যান।
করিম শাহর দু'পুত্রের কথা জানা যায়। প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র ছেফাতি শাহ ও দ্বিতীয় পত্নী সন্ধিবিবির পুত্র ছিলেন টিপু শাহ। পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তির জন্য বৈমাত্রেয় দু’ভ্রাতার মধ্যে বিদ্বেষ তৈরি হয়। এমনকি পরবর্তীতে দেখা যায়, ছেফাতির পুত্র খাইস্যা মিয়া সম্পত্তির লোভে পিতৃব্য টিপু শাহকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। জাগতিক সুবিধা হাসিল ও নেতৃত্ব লাভে ছেফাতির বিশেষ আগ্রহ ছিল। বৈষয়িক বিষয়ে এ ধরনের অতিরিক্ত আগ্রহ সহজসরল ধর্মাচারের জীবানানুসারী ফকির করিম শাহর পছন্দসই ছিল না। যে কারণে তাঁর জীবদ্দশায়ই ধর্মীয় প্রচার ও পীরালির জন্য কনিষ্ঠ পুত্র টিপু শাহ ছিলেন তাঁর কাছে অধিকতর নির্ভরযোগ্য ।
এই ছেফাতি শাহ ও টিপু শাহ মুসলমান জাতিভুক্ত ফকির হওয়া সত্ত্বেও শেরপুরের জমিদার ও লেখক হরচন্দ্র চৌধুরী, ময়মনসিংহের ইতিহাস প্রণেতা কেদারনাথ মজুমদার থেকে নিয়ে হাল আমলের সুপ্রকাশ রায়সহ অনেক ইতিহাসবেত্তাই ‘ছপাতি গারো’ ‘টিপু গারো' বলে তাঁদেরকে ‘গারো সর্দার' হিসেবে তাঁদের লেখায় উল্লেখ করেছেন। ছেফাতি শাহ ও টিপু শাহকে ‘গারো উপজাতীয় সর্দার হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রথম পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন শেরপুরের নাগ জমিদার বংশীয় লেখক বিজয়চন্দ্র নাগ, তাঁর ‘নাগবংশের ইতিবৃত্ত' বইয়ে। আর তাঁর এ মনগড়া তথ্যকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সরেজমিনে কোনোরূপ যাচাই না করেই হরচন্দ্র চৌধুরী, কেদারনাথ মজুমদারের মতো খ্যাতিমান লেখকসহ পরবর্তীকালের কতিপয় ইতিহাসবেত্তা অন্ধ অনুকৃতি করে গেছেন মাত্র। শেরপুরের অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের লিখিত ইতিহাস গ্রন্থাদিতে এই দু'ভাইকে ‘গারো’ উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াসকে তাঁদের দ্বারা নির্যাতিত মুক্তিকামী কৃষকদের ন্যায্য আন্দোলন ও সে আন্দোলনের নেতৃত্বের পরিচয়কে প্রচ্ছন্ন করে ফেলার সচেতন প্রয়াস কি না তা বিবেচনা করার বিষয়। আর শেরপুর পরগনার আদি শাসক শের আলী গাজীর সাথে এই পাগলপন্থি ফকিরদের ঐতিহাসিক সংযোগকে বিনষ্টকরণের অশুভ চিন্তায় এবং হৃত রাজ্যের ন্যায়সংগত উত্তরাধিকারকে বিতর্কিত করার মানসে এ ধরনের তথ্য বিকৃতির আশ্রয় নেওয়া হয়ে থাকতে পারে বলে আধুনিককালের কোনো কোনো স্থানীয় ইতিহাস গবেষক মনে করেন।
জাগতিক বিষয়ে অধিকতর আগ্রহশীল, উচ্চাভিলাষী ছেফাতি শাহ পিতার জীবদ্দশায়ই গারো পাহাড়ের সন্নিহিত দশকাহনিয়া শেরপুর পরগণা, সুসং পরগণা নিয়ে তাঁর পূর্বপুরুষদের স্থাপিত একদার রাজ্যে তিনি নতুন করে রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে পর্বত-সানুস্থ এলাকার গারো, হাজং, কোচ, দাই, বানাই, হদি, হত্রি প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ঐক্যবদ্ধ করে তাঁর প্রতি আনুগত্যশীল করে তোলেন। ছেফাতি শাহর রাজ্যস্থাপন প্রচেষ্টার কথা অবগত হয়ে নিজেদের আশু অস্তিত্ব হানির আশঙ্কায় অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট করার জন্য স্থানীয় জমিদারগণ সচেষ্ট হন। তাঁরা ছেফাতির উচ্চাভিলাষকে সমূলে উৎপাটন করতে উপজাতীয়দের মধ্যে ছেফাতির স্বার্থলিপ্সার কথা প্রচার করে তাঁর ওপর সন্দেহ সৃষ্টি করেন। ফলে বাধ্য হয়ে ছেফাতিকে পাহাড়ি এলাকা পরিত্যাগ করে স্থানান্তরে যেতে হয় ।
ছেফাতির এই সূচনা-প্রয়াসের ব্যর্থতার পরও তিনি রাজ্য স্থাপনের আশা ছাড়েননি। তিনি হতোদ্যম না হয়ে পুনরায় ভিন্নপথে অগ্রসর হন। ছেফাতির এই রাজ্য স্থাপন প্রচেষ্টাকালে শেরপুর পরগণাঞ্চলের ওপর ইংরেজ সরকারের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এমনকি জমিদাররা বিপুল পরিমাণ খাজনা রায়তদের নিকট থেকে আদায় করলেও তাঁর অতি নগণ্য পরিমাণই সরকার পেত। এই অঞ্চল থেকে ইংরেজ সরকারের রাজস্ব-ক্ষতির বিষয়টি গোচরে এনে ছেফাতি শাহ তাঁর রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নতুন করে প্রয়াস চালান। তিনি এই লক্ষ্যে ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে ময়মনসিংহ জেলা সদরে আসেন। তিনি সেখানে এসে জেলা কালেক্টরকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, সুসং দুর্গাপুর, গির্দ গারো অঞ্চলসহ শেরপুর পরগণা জমিদারদের হাত থেকে উদ্ধার করে পৃথক জেলায় রূপান্তর করলে সরকারের বহু রাজস্ব অর্জিত হবে। সরকার এ সিদ্ধান্ত নিলে ছেফাতি শাহ সে রাজ্যশাসন ও রাজস্ব আদায়ের ভার নিতে পারে। ছেফাতির এই প্রস্তাব জেলা কালেক্টর সমর্থন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর রিপোর্ট পাঠালেও তা গৃহীত হয়নি। কারণ, এ প্রস্তাব পাশ করলে শেরপুর-সুসং অঞ্চলের জমিদারগণ রুষ্ট হতে পারে, এই ভয়ে রেভিনিউ প্রেরিত সুপারিশ অগ্রাহ্য করে। এতে এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। এ অসন্তোষই পাগলপন্থি বিদ্রোহের রূপ নেয় ৷
ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্ৰোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। দৃশ্যত দীউয়ানি উত্তর যুগে (১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে) বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর অঞ্চলে জনগণের, বিশেষ করে কৃষক সমাজের উপর কোম্পানির রাজস্ব বিভাগের মুতসুদ্দি, কর্মকর্তা ও জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের প্রতিবাদে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে তা পাগলপন্থি আন্দোলন নামে পরিচিত। সমকালীন অন্যান্য আন্দোলনের মতো এটি প্রকৃতিগতভাবে ছিল বিক্ষিপ্ত, সহজাত, অপরিকল্পিত, স্থানীয়, ভূমিসংক্রান্ত এবং ধর্মীয় । প্রথম পর্যায়ে আন্দোলনটি পরিচালিত হয় জমিদারদের বিরুদ্ধে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে ।
শেরপুরসহ উত্তর ময়মনসিংহ বাংলার মূলস্রোত থেকে নানাভাবে ছিল বিচ্ছিন্ন। এ অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য মূলত গারো, হাজং, ডলু, হুদি এবং রাজবংশী প্রভৃতি পাহাড়ি গোত্র দ্বারা প্রভাবিত। তাদের প্রধান ধর্ম ছিল প্রকৃতি পূজা। কালক্রমে হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির উপাদান তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে যায় এবং এ অঞ্চলে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোক অল্প অল্প করে বসতি স্থাপন শুরু করে। যুগ যুগ ধরে অঞ্চলটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিদ্রোহীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের কাজ করছিল।

করিম শাহ ছিলেন পাগলপন্থি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ। গোত্রীয়ভাবে সম্ভবত তিনি ছিলেন পাঠান এবং ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি উত্তর ময়মনসিংহ জেলার সুশং পরগনার লেতারকান্দা গ্রামে বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি ইসলামের এক জনপ্রিয় ব্যাখ্যা দেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রচারে আকৃষ্ট হয়। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম ও প্রকৃতিপূজারি ছিল
করিম শাহের শিক্ষাদান প্রক্রিয়া ছিল সহজ ও সাদাসিধা। তিনি শিক্ষা দেন যে, মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি, সুতরাং তারা সবাই সমান এবং পরস্পর ভাই ভাই। এ কারণে করিম শাহের অনুসারিগণ একে অপরকে ‘ভাই সাহেব' বলে সম্বোধন করতো। সমতল অঞ্চলের লোকদের নিকট তাদের আচার আচরণ অদ্ভুত ও বিদঘুটে ঠেকত ‘ভাই সাহেব’দের এজন্য সমতলের লোকেরা ‘পাগল' বলে ডাকত এবং করিম শাহ ও তাঁর অনুসারীদের কাজকর্ম ও প্রচার প্রচারণা পাগলপন্থি আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে। সকল ধর্মের অহিংস উপাদানের সমন্বয়ে পাগলপন্থিদের ধ্যানধারণা তৈরি হয় এবং এগুলো কৃষকদের সনাতনী ধর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
করিম শাহ একান্তভাবে ধার্মিক ছিলেন এবং জনগণ বিশ্বাস করত যে, তিনি আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন এবং অনুসারীদের মতে, তিনি রোগ নিরাময় ও তাদের ভাগ্য উন্নয়নের ক্ষমতা রাখতেন । বহুসংখ্যক লোক তাঁর সাহচর্য লাভের প্রত্যাশী ছিল। তারা তাঁর সঙ্গে অবস্থান করত এবং নানাভাবে তাঁর সেবায় নিয়োজিত থাকত। বিভিন্ন গোত্র ও দল থেকে আসা অনুসারীদের জন্য বসবাসের পৃথক পৃথক ব্যবস্থা ছিল।
১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে করিম শাহ পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র টিপু শাহ ওরফে টিপু পাগল উত্তরাধিকারসূত্রে পাগলপন্থিদের নেতৃত্ব পান। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনের চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এটি কৃষক আন্দোলনের রূপ নেয়। পাগল ও তাদের সহযোগিগণ জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য জমিদার ও কোম্পানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অবশ্য ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ আন্দোলন বহুলাংশে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে এর পূর্বে কৃষকদের করুণ অবস্থা প্রশমনের ক্ষেত্রে এ আন্দোলন খানিকটা অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করে, অনেক অন্যায় কর ও উৎপীড়নমূলক আইন তুলে নেওয়া হয়।
টিপু শাহের পর (মৃত্যু ১৮৫২) জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দুদিক থেকে অগ্রসর হয়ে পাগলপন্থিগণ শেরপুর শহরে প্রবেশ করে জমিদার বাড়ি ও রাজস্ব অফিস লুট ও থানা দখল করে এবং থানার অস্ত্রশস্ত্র পুড়িয়ে দেয়। বিদ্রোহীরা নিজদেরকে এ অঞ্চলের শাসক বলে ঘোষণা করে। জমিদার, সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ ময়মনসিংহ শহরে আশ্রয় নেয়। কিছু দিনের জন্য এ অঞ্চলে কোম্পানি শাসনের বিলুপ্তি ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয় ।
ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহের ঘটনা
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্ৰোহ ঘটনাবহুল। এ বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ সরকার ও তাদের অনুগত জমিদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীণ হয় । এমনকি ব্রিটিশ কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আবার কখনো ব্রিটিশ সরকারের দমনপীড়নে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে ।
১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে ব্রিটিশ-বার্মা যুদ্ধ শুরু হলে ময়মনসিংহের পার্বত্য সীমান্ত এলাকায় এর প্রভাব পড়ে। ঐ বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর বার্মা (বর্তমান মায়নমার) পর্যন্ত সৈন্য চলাচলের জন্য একটি রাস্তা রংপুর, জামালপুর হয়ে সুসং পর্যন্ত এবং আরেকটি রাস্তা সিলেট পর্যন্ত তৈরি করতে, সৈন্যদের রসদ সরবরাহ ও যাতায়াতের জন্য নৌকার যোগান দিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শেরপুরের জমিদারদের নির্দেশ দেন। এ আদেশের প্রেক্ষিতে জমিদারগণ রায়তদের বিনাশ্রমে বেগার খাটা এবং সৈন্য ব্যারাকে রসদ সরবরাহে বাধ্য করে। বিনা পারিশ্রমিকে নিম্নবর্গের নৃগোষ্ঠী হদিদের উপর এ ধরনের বেগার খাটার কাজে চাপ সৃষ্টি করলে, তারা তা করতে অস্বীকার করে। জমিদাররা রায়তদের মজুরীবিহীন বেগার খাটানো, ‘পল্টন রসদ খরচা'র নামে অতিরিক্ত উপ-কর চাপিয়ে দেয়। এ ধরনের জুলুমকে কৃষকেরা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি । জমিদারদের নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ধার করতে প্রজাগণ তাদের ধর্মগুরু টিপু পাগলাকে অনুরোধ করে। প্রজাদের দুর্দশা দেখে সহৃদয় টিপু শাহ কৃষকদের অধিকার রক্ষায় তাদের নেতৃত্বদানে রাজী হন। ২১ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার জনতে পারে, শেরপুর অঞ্চলে ঐ সড়ক নির্মাণের কাজ করতে রায়তরা অস্বীকার করছে এবং পাগলপন্থিরা এই বিদ্রোহে উস্কানি দিচ্ছে।
শেরপুরের জমিদারদের কর্তৃক প্রজাদের ওপর নিয়মিত খাজনার অতিরিক্ত কর চাপিয়ে দেওয়ায় কৃষকেরা অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয়। একসাথে অসহনীয় পরিমাণ করভার চাপিয়ে দেওয়ায় পরগণার প্রজাগণ বিদ্রোহী হয়ে উঠে। মুসলমান, গারো, হাজং, হদিসহ কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর চাপানো এ গুরুভার থেকে মুক্তির জন্য তাদের পাগলপন্থি ধর্মগুরু টিপু শাহর নেতৃত্বে গণআন্দোলন গড়ে তুলে। তাঁর নেতৃত্বে ১২৩১ বঙ্গাব্দে (১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ) পরগণার প্রজাগণ একতাবদ্ধ হয়ে জমিদার- তালুকদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। নিয়মিত খাজনার অতিরিক্ত খরচা, মাথট, আবওয়াবের জুলুম সহ্য করতে না পেরে প্রজারা জমিদারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তারা কুড় (শেরপুর পরগণার স্থানীয় পরিমাপ- ১ কুড় = ৩ বিঘা ১০ গণ্ডা) প্রতি চার আনার বেশি দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। ৪ ও ৫ ডিসেম্বর জমিদারগণ সরকারকে জানায় যে, ‘হত্রি ও অন্যান্যরা কাজ করতে অস্বীকার করছে। তারা বলছে যে, টিপুর কর্তৃত্ব ছাড়া তারা আর কারো কর্তৃত্ব মানে না। হত্রি ও পাগলদের কাজ করতে অস্বীকারের বিষয়টি অবগত হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট তাদের কাজ করাতে বাধ্য করার জন্য দারোগাকে নির্দেশ দেন। ২৪ ডিসেম্বর হদি ও পাগলদের নেতা টিপুকে ধরার জন্য সরকার আদেশ জারি করে ।
জমিদাররা প্রজাদের নিকট থেকে জোরপূর্বক খাজনা আদায়ের চেষ্টা করলে জমিদারদের লেঠেল-বরকন্দাজদের সাথে গড়জরিপায় বিদ্রোহীদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে জমিদারদের পরাজয় ঘটলে তাঁরা পলায়ন করে শেরপুর-কালীগঞ্জে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ডেম্পিয়ারের কাচারিবাড়িতে সপরিবারে আশ্রয় নেন। যুদ্ধে বিজয়ী সাত'শ কৃষক-বিদ্রোহী শেরপুর শহর দখল করে। বিদ্রোহী নেতারা শেরপুর শহরকে কেন্দ্র করে সেখানে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তাঁরা সেখানে বিচার ও শাসনব্যবস্থাও চালু করে। এর ইষৎ বর্ণনা তৎকালের শেরপুরের পণ্ডিত রামনাথ বিদ্যাভূষণের রচিত নিম্নোক্ত পদ্যাংশে বিধৃত হয়েছে—
“বকসু আদালত করে দীপচান ফৌজদার ।
কালেক্টরের সরবরাকার গুমানু সরকার।।
এর আংশিক ভিন্নতর আরেকটি পাঠ রয়েছে। আর তা হচ্ছে—
“বকসু জাজিয়তী করে, দ্বীপচাঁদ কালেকটার।
নথী প্রেস করে। গুমানু সরকার ।
পাগল তো টিপু শাহ গড়জরিপার পরিত্যাক্ত দুর্গাভ্যন্তরের সুরক্ষিত স্থানে অবস্থান করে এই রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। তাঁর শাসনাধীনে বকসু নামীয় ব্যক্তি বিচারক ও দীপচার ফৌজদার বা নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্ব পালন করেন। আর গুমানু সরকার রাজস্ব আদায়কারী ও অর্থব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকেন ।
বিদ্রোহী কৃষকদের প্রতিষ্ঠিত এই অভিনব রাজ্যের আয়ুষ্কাল ছিল দুই বছর। এই সময়কালে ইংরেজদের সাথে বিদ্রোহীদের কয়েক দফা খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেগুলোতে বিদ্রোহীরা জয়লাভ করে। ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে রংপুর থেকে বিরাটাকারের সেনাদল এসে জামালপুরে অবস্থান গ্রহণ করে। এখানে প্রতিষ্ঠিত সেনানিবাসের সৈনিকদের সাথে সংঘটিত যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে বিদ্রোহীরা শক্তিহীন হয়ে পড়ে।
১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দে একজন দারোগার নেতৃত্বে দশজন বরকন্দাজ গড়জরিপার অভ্যন্ত রে ঢুকে কৌশলে টিপুকে গ্রেফতার করে নাসিরাবাদ (বর্তমানে ময়মনসিংহ শহর) নিয়ে যায়। পরে ময়মনসিংহের সেশন জজের বিচারে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় । দণ্ড ভোগকালে তাঁর এক পৌত্রও কারারুদ্ধ ছিল। কারাবন্দি থাকাবস্থায়ই ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে টিপু শাহ ময়মনসিংহ জেলে মারা যান বলে কেদারনাথ পরিবেশিত তথ্যে জানা যায় ৷
পাগলপন্থি শিষ্যদের অনুরোধে টিপু শাহ স্বাধীন শেরপুর রাজ্যের দায়িত্ব নিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, “খোদাতালার নমে, প্রজাদের সম্মতিক্রমে আমি শেরপুর পরগণার শাসনভার গ্রহণ করিলাম। এ রাজ্যে কেহ চৌর্যবৃত্তি, দস্যুবৃত্তি, নরহত্যা পরদার করিতে পারিবে না। কেহ কুসীদ প্রদান করিতে পারিবে না, কিন্তু আসল প্রত্যর্পণ করিতে হইবে। ধান্য কর্জ্য দিয়া কেহ অতিরিক্ত ধান্য গ্রহণ করিতে পারিবে না। উৎকোচ গ্রহণ, পণ লওয়া, সরাপ পান করা, মিথ্যা বলা, ছল করা, জুয়াচুরি করা, কম ওজন দেওয়া, গুরুজনকে অভক্তি করা, নিন্দা করা, বিশ্বাসঘাতকতা করা, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা, মন্দ কার্য্যে সাহায্য করা, কাহাকেও অন্যায় কষ্ট দেওয়া ইত্যাদি কাৰ্য্য পরিত্যাজ্য । প্রতি কুড় জমির মাত্র চার আনা খাজনা দিতে হইবে। সকল জাতিকে প্রীতির চোখে দেখিবে।
গরিব-দুঃখীকে সাহায্য করিবে। কেহ কাহাকেও ন্যায্য অধিকার হইতে বঞ্চিত করিতে পারিবে না । খোদাতালার প্রতি অবিচল ভক্তি রাখিয়া সকলে একতাবদ্ধ থাকিবে । ”
এ আদর্শের আলোকে দেখা যায়, টিপুর শাহর স্থাপিত শেরপুর রাজ্য একটি ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ কল্যাণ রাজ্য ছিল। পাগলপন্থি এ রাজ্যের কর্ণধার টিপুকেই বিদ্রোহী রায়তরা সমস্ত ধনসম্পদ ও খাজনার মালিক বলে ঘোষণা করে। জেলা প্রশাসকের সরকারি রিপোর্টেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে— “তারা বিভিন্ন গ্রামে এখনো আদায়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এই বলে যে, তাদের ঘোষিত নেতা টিপু পাগল ছাড়া কাউকে খাজনা দেওয়া চলবে না এবং যেখানেই লোক গররাজি হচ্ছে বা বাধা দিচ্ছে, সেখানেই লুটতরাজ চলছে।”
কালীগঞ্জ, লেটিরকান্দা, গড়জরিপায় টিপুর বাদশাহী কাচারি গড়ে উঠেছিল। পাগল গুরু টিপুর পিতৃপুরুষের সাধনস্থল শংকরপুরে বিদ্রোহী প্রজারা তাদের খাজনা ও নজরানা দিত। রায়তরা টিপুকে ‘সোলতান' ও তাঁকে প্রদত্ত কর ‘সোলতানি’ বলত । বকসু জজ ও দীপচান ফৌজদার ছাড়াও নহরদ্দি সরকার এবং জরিপ পাগলও অন্যতম ফৌজদার ছিলেন।
-
ডেম্পিয়ারের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল পাগলপন্থিদের ঐক্য ফাটল ধরিয়ে তাদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করা। এ অনৈক্য সৃষ্টি-প্রয়াসে সরকার জমিদারের যৌথ প্রয়াস সক্রিয় ছিল। এজন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল পাগলপন্থি সর্দার আহমদ মণ্ডলকে। তালুক প্রদানের লোভ দেখিয়ে তাকে বশীভূত করা হয়েছিল। পাশাপাশি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য কিছু রায়তকে অস্ত্র দিয়ে অনুগত বাহিনীর সৃষ্টি করা হয়। এ ধরনের সশস্ত্র ১৫০ সদস্যের এক বাহিনী বান্দরকাটার যুদ্ধে সরকার পক্ষে অংশ নেয়। যদিও এরা সংঘর্ষ আরম্ভ হওয়ামাত্র ঘটনাস্থল থেকে পলায়ন করে ।
বিদ্রোহী রায়তদের ঐ প্রতিরোধযুদ্ধে সরকারি সিপাই ও জমিদারি বরকন্দাজরা অবাধ্য রায়তদের উপর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সশস্ত্র বিদ্রোহীরাও এ যুদ্ধে শক্তিশালী বিরুদ্ধপক্ষের মোকাবিলায় প্রাণপণে লড়ে যায়। তারা অসম সাহসে বরকন্দাজ ভগবান সিং, চুনীকে হত্যা করে এবং আরও পাঁচজন বরকন্দাজকে একমাস আটকে রেখে যমালয়ে প্রেরণ করে। দোহুলিয়া থেকে দু'জন সরকারি পেয়াদাকে ১০ দিন ধরে বন্দি রাখার পর সরকারি বাহিনী অভিযান চালিয়ে তাদের মুক্ত করে আনে । বান্দরকাটার ঐ যুদ্ধে বিদ্রোহীরা সরকারি দারোগাকে বর্শার আঘাতে আহত করে তাকে মুগুরপেটা করে। তারা সরকারি চর দুলালকে ধাওয়া করে ধরে মেরে ফেলে ।
পাগলপন্থি বিদ্রোহ প্রসঙ্গে সরকারি রিপোর্টে ছয়টি মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৪ জন লোক মারা যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে সরকার ও জমিদারপক্ষে ১০ জন, বিদ্রোহীদের পক্ষে ৪ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ব্রিটিশ সামরিক অভিযানে ৪৯৯ জনকে বন্দি করা হয়। এদের মধ্যে ২১ জন কারাগারে মারা যায়, ৩৭৭ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকিদের মাঝে ৬১ জনকে শাস্তি প্রদান এবং বাছাইকৃত ২১ জনকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে বিচারের জন্য প্রেরণ করা হয় ৷

১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ফেব্রুয়ারি ডানবারকে শেরপুরের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও ময়মনসিংহের রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। শেরপুর ও আলেপসিংয়ের সাতসিক্কার জমিদার ও প্রজাদের মধ্যে বিদ্যমান বিরোধ নিরসনের দায়িত্ব এবং ক্ষমতাও তাঁর উপর অর্পিত হয়। এ দায়িত্বের উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জমিদারদের স্বেচ্ছাচারিতামূলক করব্যবস্থার বদলে যুক্তিগ্রাহ্য স্থায়ী রাজস্ব- হার নির্ধারণ, পাট্টা ও কবুলিয়তের যথাযোগ্য বিলি-বন্দোবস্তের ব্যবস্থা নেওয়া এবং বেআইনি কর, আবওয়াব ও মাথট আদায় বন্ধ করা। এই লক্ষ্য সামনে নিয়ে ডানবার ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রাম-মহাল সফর করে জমিদার-রায়ততের পারস্পরিক বুঝাপড়ার মাধ্যমে রাজস্ব-হার নির্ধারণ করেন।
টিপু, বকস, দীপচাঁদদের কারাবাস ও মৃত্যু পরবর্তীকালে টিপুর অন্যতম শিষ্য গুমানু সরকার বিদ্রোহী প্রজাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি গাজীর খামারের অধিবাসী ও বিত্তশালী মুসলমান কৃষক ছিলেন। অতীতে মুসলমান কৃষকদের প্রতিষ্ঠিত এই গাজীর খামারে শেরপুরের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার শের আলী গাজীর শেষ আশ্রয়স্থল ছিল। তাঁর সমাধিও সেখানে বিদ্যমান। এই গ্রামের পাগলপন্থি কৃষক নেতা গুমানু সরকারের নেতৃত্বে গাজীর খামারের কৃষকগণ ডানবারের রাজস্ব বন্দোবস্ত মেনে নিতে অস্বীকার করে। এতে ডানবার রুষ্ট হয়ে গুমানু সরকারকে গ্রেফতার করেন। বন্দি গুমানু কারামুক্তির জন্য গাজীর খামারের কৃষকরা দাবি জানাতে থাকে। গুমানুর বিরুদ্ধে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ দাঁড় করাতে না পারায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মুক্তি লাভ করেন।
সাত সিক্কা মৌজার ভরতি মৌকাণ্ডির চাঁদের নন্নী গ্রামের উজির সরকার ছিলেন পাগলপন্থি আরেক কৃষক নেতা। তিনিও মুসলমান ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ভরতি মৌকাণ্ডির কৃষকরাও ডানবারের রাজস্ব নিরিখকে প্রত্যাখ্যান করে। গুমানু সরকার ও উজির সরকার সম্মিলিতভাবে ডানবারের বন্দোবস্তকে আইনি প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা করতে থাকেন। তাঁদের সহযোগিতায় বহুসংখ্যক কৃষকপ্রজা কর্তৃপক্ষ বরাবরে, অনেক আবেদন-নিবেদন, মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করেন। এই দুই নেতার প্ররোচনায় ডানবার তাঁর নবপ্রবর্তিত ব্যবস্থা কার্যকরে বার বার বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ভীষণ চটে গিয়ে গুমানু সরকার, উজির সরকার ও গম্ভীর সরকারকে কাচারিতে ডেকে নিয়ে অমানুষিক প্রহার করেন। গুমানু পুনরায় কৃষকদের উজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হন। ডানবারও তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করতে চেষ্টা করেন। গুমানু ডানবারের অভিপ্রায় বুঝতে পেরে আইনজ্ঞের পরামর্শের জন্য চুপিসরে কলকাতা গমন করেন। পরগণায় আপাত শান্তি বিরাজমান থাকায় জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ডানবার ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে শেরপুর থেকে ময়মনসিংহে চলে আসেন। তাঁর প্রস্থানের সাথে সাথে শেরপুর ডানবারের কাচারির কার্যকারিতা বিলুপ্ত হয়। ডানবারের অনুপস্থিতির সুযোগ বুঝে গুমানু এবং উজির সরকার শেরপুর পরগণায় কৃষক বিদ্রোহের বহ্নি পুনঃপ্রজ্বলিত করেন। ঐ বছরের শেষের দিকে বিদ্রোহী কৃষকগণ বিভিন্ন স্থানে জমিদারি কাচারী আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে। জমিদারের পাইক-বরকন্দাজ এবং সরকারি পিয়ন ও পুলিশকে পেটায়। পেয়াদাদের উপরও হামলা চলে। জমিদারগণ বিদ্রোহী প্রজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। গুমানু সরকার কলকাতা থেকে সুদক্ষ আইনজীবী এনে নাসিরাবাদ শহরে থেকে কৃষকদের স্বপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ।

সেসময় মামলা পরিচালনার সুবাদে গুমানু সরকার এবং উজির সরকার নাসিরাবাদ শহরে বসবাস করতে থাকেন। এই দুই নেতার শেরপুরে অনুপস্থিতিতে জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথর নামীয় দুই দুর্ধর্ষ গারো সর্দারকে বিদ্রোহীরা তাদের নেতৃত্বে বরণ করে। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে বিদ্রোহ পরিচালনার সুবিধার জন্য জানকু ও দোবরাজ উভয়ে পরামর্শক্রমে শেরপুর অঞ্চলকে দু'ভাগে বিভক্ত করেন। জানকু শেরপুরের উত্তর-পশ্চিম কোণের কড়ইবাড়ির পাহাড়ের পাদদেশস্থ বাটাজোড়ে আর দোবরাজ পূর্বদিকের নালিতাবাড়ির সন্নিকটে অবস্থান গ্রহণ করেন। পরে উভয়ে তাদের বাহিনী নিয়ে একযোগে শেরপুর আক্রমণ করেন। তাঁরা জমিদারবাড়ি ও কাচারী লুণ্ঠন করেন। জমিদারগণ সপরিবারে অন্যত্র গিয়ে প্রাণরক্ষা করেন ।
সেসময় মামলা পরিচালনার সুবাদে গুমানু সরকার এবং উজির সরকার নাসিরাবাদ শহরে বসবাস করতে থাকেন। এই দুই নেতার শেরপুরে অনুপস্থিতিতে জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথর নামীয় দুই দুর্ধর্ষ গারো সর্দারকে বিদ্রোহীরা তাদের নেতৃত্বে বরণ করে। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে বিদ্রোহ পরিচালনার সুবিধার জন্য জানকু ও দোবরাজ উভয়ে পরামর্শক্রমে শেরপুর অঞ্চলকে দু'ভাগে বিভক্ত করেন। জানকু শেরপুরের উত্তর-পশ্চিম কোণের কড়ইবাড়ির পাহাড়ের পাদদেশস্থ বাটাজোড়ে আর দোবরাজ পূর্বদিকের নালিতাবাড়ির সন্নিকটে অবস্থান গ্রহণ করেন। পরে উভয়ে তাদের বাহিনী নিয়ে একযোগে শেরপুর আক্রমণ করেন। তাঁরা জমিদারবাড়ি ও কাচারী লুণ্ঠন করেন। জমিদারগণ সপরিবারে অন্যত্র গিয়ে প্রাণরক্ষা করেন।
গারো সর্দারদের নেতৃত্বাধীন এই প্রজাবিদ্রোহের সংবাদ অবগত হয়ে ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনরত ডানবার জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট গ্যারেটকে বিদ্রোহ দমনার্থে শেরপুর প্রেরণ করেন। গ্যারেট ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল শেরপুর পৌঁছে জমিদারদের সান্ত্বনার বাণী শোনালেও তা তখনকার মত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শুরুতেই গ্যারেটের অবস্থানস্থল ডাকবাংলো বিদ্রোহীদের কর্তৃক আক্রান্ত হয়। গ্যারেট নিজের ও জমিদারদের প্রাণ রক্ষার্থে সচেষ্ট হলেন। তিনি এ লক্ষ্যে সরকারি পুলিশ ও জমিদারী বরকন্দাজদের একত্রীভূত করে শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হন। তিনি দোবরাজ পাথরকে দমনার্থে নালিতাবাড়ির দিকে একজন পুলিশ সৈন্য ও বরকন্দাজ পাঠান। দোবরাজ খবর পেয়ে পাহাড়ে গা ঢাকা দেন। জমিদাররা নালিতাবাড়িতে কাচারী প্রতিষ্ঠা করে বরকন্দাজ সজ্জিত করেন । দোবরাজ সুযোগ বুঝে জমিদারী কাচারী আক্রমণ করে ১ জন পুলিশ, ১ জন বরকন্দাজ, ১ জন মোহরার ও ১ জন পিয়নকে ধরে নিয়ে যান। দিশেহারা জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট গ্যারেট বিষয়টি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানান । ময়মনসিংহ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডানবার ২৯ এপ্রিল ঢাকার কমিশনার মিডলটনকে সমস্ত বিষয়টি পত্রযোগে অবহিত করেন এবং ডানবার স্বয়ং শেরপুরে গমন করেন। তিনি সেখানে পৌঁছে শেরপুরের নিকটবর্তী আহমদগঞ্জে অবস্থান নিয়ে বিদ্রোহ দমন অভিযানের ছক কষেন এবং জামালুপর ক্যান্টমেন্টের সেনাধ্যক্ষ মনটিথের নিকট ১৫০ জন সৈন্যের জন্য আশু প্রার্থনা জানান। পরদিন ক্যাপ্টেন সিলের নেতৃত্বে সৈন্যদল শেরপুর উপস্থিত হলো। ডানবারের সাথে পরামর্শক্রমে সৈনিকদের তিনি দু'অংশে বিভক্ত করেন। এক অংশ ক্যাপ্টেন সিল নিজ দায়িত্বে রেখে অপর অংশ ইয়ং হাজব্যান্ডের নেতৃত্বে পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ক্যাপ্টেন সিল তাঁর অংশীয় সৈন্য সমভ্যিহারে পশ্চিমের পাহাড়ে অবস্থানরত জানকুকে দমনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সিল চর মারফত জানতে পারেন, জানকু চার হাজার সশস্ত্র অনুচর নিয়ে বৃটিশ সৈন্যদের গতিরোধে প্রস্তুিতি নিয়ে অপেক্ষমান রয়েছে। এ সংবাদে ক্যাপ্টেন সিল আতঙ্কগ্রস্থ হন। তিনি পূর্ব পরিকল্পনা সংশোধন করে লেফটেন্যান্ট ইয়ং হাজব্যান্ডকে সসৈন্যে তাঁর সাথে যোগ দেওয়ার আদেশ দেন। ৩ মে সম্মিলিত বাহিনী পাহাড়ের সন্নিকটস্থ মধুপুরে অবস্থান গ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন সিল সেখান থেকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে পাহাড়ি অরণ্য মধ্যস্থিত জানকুর জলঙ্গীর আশ্রয়স্থলে অভিযান পরিচালনা করেন। জানকুকে না পেয়ে তাঁর আবাসস্থলে অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করেন ।
ক্যাপ্টেন সিল দোবরাজের আস্তানা ধ্বংস করে তাঁর অনুসারী বিদ্রোহীকে আত্মসমর্পণের আদেশ জারি করেন। না হলে তাদের আবাসস্থলও দোবরাজের আস্ত ানার মতো আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘোষণায় অনেক বিদ্রোহী আত্মসমর্পণ করে। জানকুর বিদ্রোহী বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে ক্যাপ্টেন সিল ১৯ এপ্রিল শেরপুরে প্রত্যাবর্তন করেন। অপরদিকে লেফট্যানেন্ট ইয়ং হাজব্যান্ড দোবরাজকে দমনের জন্য সসৈন্যে ৭ মে নালিতাবাড়িতে শিবির স্থাপন করেন। তিনি পরদিন নালিতাবাড়ির সন্নিকটে গারো পাহাড় অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়ে দোবরাজের আশ্রয়স্থল আবিষ্কারে সক্ষম হন। টের পেয়ে আটককৃত বরকন্দাজ, মোহরার, পিয়নদের নিয়ে দোবরাজ অজ্ঞাতে পালিয়ে যান। ইয়ং হাজবেন্ড কেবলমাত্র জমাদারকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। দোবরাজ ও তার বাহিনীকে ধরতে না পেরে তার আস্তানায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেন। দোবরাজকে দমনের অভিযান থেকে ফিরে ইয়ং হাজবেন্ড নালিতাবাড়ি ও হালুয়াঘাটের বারো বর্গ মাইলব্যাপী অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহীদের দমন তৎপরতা চালান। ১৩ মে বিদ্রোহীদের অনেকে আত্মসমর্পণ করে। ২০ মে ২৫ জন সৈন্য নালিতাবাড়িতে রেখে ক্যাপ্টেন সিল বাকি সৈন্য নিয়ে জামালপুর সেনাবাসে ফিরে যান । ৩১ মে ইয়ং হাজবেন্ডও তাঁর অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে জামালপুর ক্যান্টমেন্টে প্রত্যাবর্তন করেন। ক্যাপ্টেন সিল ও লেফটেন্যান্ট ইয়ং হাজবেন্ডের দমন অভিযানের মাধ্যমে শেরপুর অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন প্রশমিত হয় ।
ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহের কারণ
১৮২০-৩৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাগলপন্থি সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে যে কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত হয় তা পাগলপন্থি বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের (১৮২০-৩৩ খ্রি.) চৌহদ্দি ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ, উত্তরে গারো পাহাড়রাজি এবং পূর্বে হাওড় এলাকা। অতীতে এ এলাকা ছিল সকল কেন্দ্রীয় সামন্ত শক্তির নিয়ন্ত্রণ মুক্ত। চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এখানকার আঞ্চলিক ক্ষুদ্র (Minor) রাজ্যগুলোর নেতৃত্বে ছিল গারো, কোচ, মেচ, হাজং, পাগলপন্থি সম্প্রদায়, আফগান, উত্তর-ভারতীয় ব্রাহ্মণ ও বিদ্রোহী মুঘল সৈন্যরা। এলাকাটির রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল এর আঞ্চলিক স্বাধীনতা। পাগলপন্থি বিদ্রোহের পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল।

ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২০-৩৩)
২৪৭
উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে জমিদারি রাজনীতির মূল বিষয় ছিল অংশীদারিত্বের সংঘর্ষ। ১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দ হতে শরিকি সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। এ অঞ্চলে জমির সীমানা ঠিক ছিল না এবং তালুকের আনুপতিক হারও নির্দিষ্ট ছিল না। এ সুযোগে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী ও দলিল রক্ষকরা একদিকে জমিদারের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বাদী বিবাদীর সঙ্গে চক্রান্তের নানা সূত্র তৈরি করে, অন্য দিকে এরূপ বিবাদের সূত্র ধরে সরকার নিজের ক্ষমতা সুসংহত করে। শরিকি সংঘর্ষ শেষ হলে জমিদাররা স্বভাবতই কৃষকদের উপর তাদের দাবিদাওয়া বিধিবদ্ধ করতে উদ্যোগী হয়। যখন জমিদাররা রাজস্ব আদায়ে চেষ্টা করলো তখনই দেখলো যে, বেপরোয়া কৃষকরা জমিদারদের ততটা বাধ্যগত নয়। ফলে এলাকার শান্তি বজায় রাখা, নিয়মিত রাজস্ব আদায় হওয়া জমিদার ও সরকারের এই স্বার্থকে কৃষকদের স্বার্থের মুখোমুখি নিয়ে এলো।
এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল কৃষকদের উপর বাড়তি কর আরোপ করা। সাধারণত পরগণার হারের ভিত্তিতে আসল জমা নির্ধারিত হতো। এই জমার সাথে স্থানীয়ভাবে যুক্ত হতো সরঞ্জামি খরচ, দেশ খরচ, জমিদারি ব্যয়, টাকা প্রতি হারে আবওয়াব খরচ ইত্যাদি। ফলে আসল জমার সাথে এগুলো যুক্ত হয়ে কৃষকদের দেয় ধার্যের পরিমাণ বেড়ে যেত। অস্থায়ী ধার্যের সংখ্যাও ছিল অসংখ্য। ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষকরা এই সব অস্থায়ী কর সংগ্রহের বিরুদ্ধে ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে আপত্তি জানায়, যা শেষে বিদ্রোহে পরিণত হয়।
কৃষকদের উপর রাজস্ব বৃদ্ধির একটি কারণ ছিল শেরপুর ও আলাপ সিং পরগণার ইজারা বন্দোবস্ত। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে শেরপুরে মাজকুরী (বড়) তালুক ছিল এগারোটি। তবে জমিদারদের সৃষ্টি হুজরী (ছোট) তালুকের সংখ্যা ছিল ৩২৩ টি। এ সকল তালুকের ইজারাদাররা জমিদারদের সাথে গোপন চুক্তির ভিত্তিতে কৃষকদের নিকট হতে ত্রুটিপূর্ণ দলিলের নামে খাজনা আদায় করতো যার সাথে কৃষকদের কোনো পরিচয় ছিল না। এরূপ শোষণ কৃষককে বিদ্রোহী করে তোলে ।
১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তত হলে অত্র অঞ্চলের অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে কৃষকের উপর করের চাপ না কমে বরং বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত করারোপ চরমে ওঠে। এর সাথে যুক্ত হয় জমিদারের অত্যাচার, বল প্রয়োগ ও খামারে বেগার খাটা। পরিণামে কৃষক-জমিদার সম্পর্কের অবনতি ঘটে ।
১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ঔপনিবেশিক সরকারের সাম্রাজ্যবাদী নীতি উত্তর ময়মনসিংহের ঘটনাপ্রবাহের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এ সময়ে ব্রিটিশ ও বর্মী সাম্রাজ্যবাদ পরস্পরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে

২৪৮
ব্রিটিশরা ব্রহ্মদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আসামে যুদ্ধের জন্য জামালপুর থেকে সুশং সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তা তৈরি, মাঝে নদী পারাপারে জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক নৌকা সরবরাহ করার জন্য সরকার শেরপুরের জমিদারদের নিকট নির্দেশ পাঠায়। এ নির্দেশ পালনে জমিদারশ্রেণি বল প্রয়োগে কৃষকদের বেগার খাটানো, পল্টনের খরচ ও রসদ বাবদ আবওয়াব কৃষকদের নিকট দাবি করে। এর প্রতিবাদে কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
৭.৬ পাগলপন্থি বিদ্রোহহের গুরুত্ব
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্ৰোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। সত্যনিষ্ঠা, সাম্য, মানবতাবাদ, ভাতৃত্ববোধ ছিল পাগলপন্থিদের ধর্মাদেশের মূল বিষয়বস্তু। তাদের মতে, সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি; কেউ কারো গোলাম নয়। তাই কেউ উঁচু, কেউ নিচু-এইরূপ ভেদাভেদ নেই। সকল মানুষ ভাই ভাই। এই মহান সাম্যের বাণী নিয়ে বঙ্গ-ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তারের ১৮ বছর পর ১৭৭৫ খ্রি. করিম শাহ নামক একজন মুসলমান ফকির ময়মনসিংহের সুসং পরগনায় আবির্ভূত হন। তিনি ছিলেন এ অঞ্চলের পাগলপন্থি ধর্মচেতনার প্রথম গুরু। তাঁর অনুসারি পাগলপন্থিরা ১৮২০ খ্রি. থেকে ১৮৩৩ খ্রি. ব্যাপী ময়মনসিংহ অঞ্চলে এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। নানাবিধ কারণে এ আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ : ময়মনসিংহ অঞ্চলে জমিদার- জোতদারদের শোষণ-নিপীড়নে জর্জরিত ছিল সেখানকার সমতলের বাসিন্দা মুসলমান, গারো পাহাড়ের প্রান্তস্থিত উপজাতীয় গারো, হাজং, হদি, ডালু, বানাই কৃষককুল। জমিদারদের চাপিয়ে দেওয়া নিবর্তনমূলক নানা নামের কর, আবওয়াব, মাথটে এই অঞ্চলের কৃষকগণ ছিলেন সর্বস্বান্তপ্রায়। একদিকে জুলুমবাজ অভিজাত জমিদার- জোতদার শ্রেণি, অন্যদিকে নিঃস্বপ্রায় কৃষক শ্রেণি। ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিদ্যমান প্রর্বতপ্রমাণ এই শ্রেণিবৈষম্য প্রপীড়িত সমাজে সাম্য ও সুবিচারের বাণী নিয়ে পাগলপন্থি আন্দোলন শুরু হয়। জমিদার-জোতদার শ্রেণির অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ ছিল প্রতিবাদী কণ্ঠ
২. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন : দীউয়ানি উত্তর যুগে (১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে) বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর অঞ্চলে জনগণের, বিশেষকরে কৃষক সমাজের উপর কোম্পানির রাজস্ব বিভাগের মুতসুদ্দি, কর্মকর্তা ও জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে পাগলপন্থিরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। সমকালীন অন্যান্য আন্দোলনের মতো এটি প্রকৃতিগতভাবে ছিল বিক্ষিপ্ত, সহজাত, অপরিকল্পিত, স্থানীয় ভূমি সংক্রান্ত এবং ধর্মীয়। প্রথম পর্যায়ে আন্দোলনটি পরিচালিত হয় জমিদারদের বিরুদ্ধে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এটি ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এ অঞ্চলে পাগলপন্থিরা ছিলেন ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারে অস্তিত্বের প্রশ্নে হুমকিস্বরূপ। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও পাগলাপন্থিরা এ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছিল ।

ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২০-৩৩)
২৪৯
৩. শেরপুরে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা : জমিদাররা প্রজাদের নিকট থেকে জোরপূর্বক খাজনা আদায়ের চেষ্টা করলে জমিদারদের লেঠেল-বরকন্দাজদের সাথে গড়জরিপায় পাগলপন্থি বিদ্রোহীদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে জমিদারদের পরাজয় ঘটলে তাঁরা পলায়ন করে শেরপুর কালীগঞ্জে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ডেম্পিয়ারের কাচারিবাড়িতে সপরিবারে আশ্রয় নেয়। যুদ্ধে বিজয়ী পাগলপন্থি সাত'শ কৃষক বিদ্ৰোহী শেরপুর শহর দখল করে। বিদ্রোহী নেতারা শেরপুর শহরকে কেন্দ্র করে সেখানে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তাঁরা সেখানে বিচার ও শাসনব্যবস্থাও চালু করে। পাগল নেতা টিপু শাহ এ রাজ্য পরিচালনা করেন। যদিও এ রম্য দু'বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি।
৪. অন্যায় কর ও উৎপীড়নমূলক আইন প্রত্যাহার : করিম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র টিপু শাহ উত্তরাধিকারসূত্রে পাগলপন্থিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনের চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এটি কৃষক আন্দোলনের রূপ নেয়। পাগল ও তাদের সহযোগিগণ জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য জমিদার ও কোম্পানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অবশ্য ১৮৩৩ খ্রি. নাগাদ আন্দোলন বহুলাংশে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে এর পূর্বে কৃষকদের করুণ অবস্থা প্রশমনের ক্ষেত্রে এ আন্দোলন খানিকটা অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করে। অনেক অন্যায় কর ও উৎপীড়নমূলক আইন তুলে নেওয়া হয়। এতে এ আন্দোলনের গুরুত্ব প্রতীয়মান হয় ।
৫. কোম্পানি শাসনের সাময়িক বিলুপ্তি : টিপু শাহের মৃত্যুর পর জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শক্ত আন্দোলন গড়ে তোলেন। দুদিক থেকে অগ্রসর হয়ে পাগলপন্থিগণ শেরপুর শহরে প্রবেশ করে জমিদার বাড়ি ও রাজস্ব অফিস লুট ও থানা দখল করে এবং থানার অস্ত্রশস্ত্র পুড়িয়ে দেয়। পাগলপন্থি বিদ্রোহীরা নিজেদেরকে এ অঞ্চলের শাসক হিসেবে ঘোষণা করে। জমিদার, সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ ময়মনসিংহ শহরে আশ্রয় নেয় । কিছু দিনের জন্য কোম্পানি শাসনের বিলুপ্তি ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয় ৷
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ময়মনসিংহ জেলার শেরপুরে পাগলপন্থিদের যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, তা পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়, শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল, কিন্তু পাগলপন্থিদের প্রতিরোধকে চিরতরে স্তব্দ করে দেওয়া যায়নি। পাগলপন্থিদের এ আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয় ।
৭.৭ ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহের সার্বিক বিশ্লেষণ
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্ৰোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। দৃশ্যত উত্তর ময়মনসিংহ ছিল বাংলার ইতিহাসের মূলধারা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। যুগ যুগ ধরে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীরা উক্ত এলাকায় এসে নিরাপদ আস্তানা স্থাপন করে। পাগলপন্থি সম্প্রদায় ছিল এদের মধ্যে একটি। করম শাহ নামক একজন পাঠান ছিলেন এ সম্প্রদায়ের

২৫০ প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাস (নির্বাচিত বিষয়
প্রতিষ্ঠাতা। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে করম শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র টিপু শাহ গদিতে বসেন। তিনিও পিতার মতো কামেল পুরুষ এবং ভবিষ্যত প্রবক্তা ছিলেন বলে ভক্তরা মনে করতো। ভক্তদের বিশ্বাস ছিল যে, টিপু শাহ যা ইচ্ছা তাই করতে পারতেন। টিপুর এ ক্ষমতা ও যোগ্যতা তাকে কৃষককুলের নেতৃত্ব গ্রহণে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ারে (বৃহত্তম ময়মনসিংহ)টিপুকে কৃষক নেতারূপে অভিহিত করা হয়েছে। টিপুর নেতৃত্বে পাগলপন্থি সম্প্রদায় দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করে। টিপুর জীবন, তার ক্ষমতার মোহ, তার চরিত্র এসব কিছুই বিপ্লবের আবহ সৃষ্টি করে। সকলের আশাভরসার স্থল হয়ে ওঠেন টিপু শাহ। অচিরেই টিপুর ক্ষমতা ও নেতৃত্ব অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে সরকার টিপুকে একটি সন্দেহজনক চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। এ বিদ্রোহে পাগলপন্থিদের নেতৃত্ব দেবার কারণ ছিল মূলত কৃষক সমাজের সংগঠনের অনুপস্থিতি, শ্রেণিচেতনার অভাব এবং পাগলদের ক্রমবর্ধমান সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি । পাগলরা ছিল বিদ্রোহী সংগঠনের মূল শক্তি ।
পাগলপন্থি বিদ্রোহের প্রথম পর্ব ছিল ১৮২৪-২৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এ সময়ে বিদ্রোহী কৃষকদের সব দাবি ও চাহিদা একমুখী হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত করারোপ, বেগার প্রথা, ব্রহ্মযুদ্ধজনিত বিভিন্ন কর, রসদ সরবরাহ, পুলিশের অত্যাচার ও চাঁদা আদায়, এসবের স্থলে টিপু শাহ কর্তৃক পরিমিত রাজস্ব প্রদানের (প্রতি কোর জমির খাজনা ৪ আনা) প্রতিশ্রুতিতে কৃষক শ্রেণি পাগলপন্থিদের কর্মসূচিতে বিশ্বাস স্থাপন করে। আন্দোলনকারীরা গ্রামে গ্রামে প্রচার করে যে, ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান আসন্ন, জমিদারি-ক্ষমতা বিলপ্তির পথে এবং নতুন রাজত্বের প্রধান হবেন টিপু শাহ পাগল। টিপুর এসব প্রচারণায় কর্তৃপক্ষ নিজেদের বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর তাকে বন্দি করে। এতে বিদ্রোহের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। সরকার পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ ডিসেম্বর টিপুকে মুক্তি দেয়। টিপুর নামে রাজস্ব আদায় শুরু হয়। কার্যত টিপু শাহ সর্বসাধারণের নেতা নির্বাচিত হন। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ জানুয়ারি বিদ্রোহীরা শেরপুর শহর ও জমিদারদের স্থাপনাসমূহ আক্রমণ করে। তারা কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাবি তোলে যে, তারা জমিদারি অত্যাচার এবং শোষণ ও উৎপীড়ন মানতে রাজি নয়। ম্যাজিস্ট্রেট সব রকম বেগার, আবওয়াব ও বাড়তি খাজনা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে জমিদার তাদের সহায়ক বাহিনীর সাথে বিদ্রোহী কৃষক শ্রেণির প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ চলে। ইতোমধ্যে সরকার বুঝতে পারে যে, কৃষক শ্রেণির আন্দোলনের প্রধান কারণ অন্যায় ভূমিকর আরোপ এবং এ প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে। এর সমাধানকল্পে সরকার একটি সংক্ষিপ্ত তদন্ত শেষে নতুনভাবে খাজনার হার পুনঃনির্ধারণ করেন। কিন্তু পরিবর্তিত এই ব্যবস্থাতেও বিদ্রোহী কৃষকরা দুটি কারণে খুশি হতে পারেনি। প্রথমত; সরকারি তদন্তে নির্যাতিত কৃষকদের নিকট হতে কোনো প্রকার তথ্য নেওয়া হয়নি এবং দ্বিতীয়ত; বিদ্রোহে মৃত্যুবরণকারী কৃষকদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে কালেক্টরের নতুন বন্দোবস্ত ‘অষ্টম আইন' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই আইন অমান্য করে কৃষকরা জানকো পাথের ও দুবরাজ পাথেরের নেতৃত্বে পুনরায় বিদ্রোহ শুরু করে।

ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২০-৩৩)
২৫১
বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্বে বিদ্রোহীরা শেরপুর শহরে প্রবেশ করে জমিদার বাড়ি, কাছারি ও রাজস্ব অফিসসমূহ লুটপাট করে। তারা পুলিশ স্টেশন জ্বালিয়ে দেয়। বিদ্রোহীরা নিজেদের স্বরাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। জমিদার, পুলিশ, সরকারি কর্মচারীরা জেলা সদর ময়মনসিংহে আশ্রয় নেয়। অন্তত কিছু কাল মনে হয় যে, এখানে কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটেছে। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ১ এপ্রিল সরকারি বাহিনী শেরপুর শহর পুনর্দখল করে। সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার সশস্ত্র কৃষক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালায় এবং তাদের স্থাবর- অস্থাবর সম্পদের ক্ষতি সাধন করা হয়। সরকারের এধরনের ব্যবস্থার ফলে প্রজারা বিদ্রোহী পক্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ মে থেকে বিদ্রোহ স্থিমিত হয়ে পড়ে। এ পর্বে বিদ্রোহীরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাবি আদায়ের পন্থা অবলম্বন করে। তাদের পক্ষে দাবি আদায়ের জন্য উজির সরকারকে উকিল নিযুক্ত করে ময়মনসিংহে পাঠানো হয়। আদালতের লড়াইয়ে তাদের হাত শক্ত করার জন্য কলকাতা থেকেও একজন এটর্নি আনা হয়। এসময়ে লক্ষ করা যায়, কৃষকরা দাবি আদায়ে হিংসার পথ পরিহার করে আইন আদালতের আশ্রয় নেয়। বিগত দিনের চেয়ে কৃষক শ্রেণি এখন জমিদার ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সংলাপে বেশি সিদ্ধ হস্ত। সম্মিলিত চাঁদার মাধ্যমে কৃষকরা ময়মনসিংহ শহরে আইন লবি প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের পরও তারা সুসংগঠিত অবস্থায় সংঘবদ্ধভাবে আদালতের মাধ্যমে প্রতিরোধ চালিয়ে যায় ।
ময়মনসিংহ বিদ্রোহ কোনো প্রকার উপজাতীয় বা ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না। এ বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন সব ধর্মের ও বর্ণের। বিদ্রোহীদের সামাজিক পরিচয় ছিল এরা উপজাতীয়, নানা বর্ণের হিন্দু ও নানা পেশার মুসলমান। তারা গোষ্ঠী পরিচয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর হলেও সকলের রণভাষা ছিল বাংলা। তাদের ধর্ম কখনো সংগ্রামে কোনো ইস্যু তৈরি করেনি। তাদের বিদ্রোহের মতাদর্শ ছিল মূলত উৎপাদন সম্পর্কে ও শোষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিদ্রোহীরা সামাজিকভাবে মোটামুটি অভিন্ন ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষক ছিল বলে মনে করা হয়। খাজনার হার হ্রাস, অবৈধ কর ও বেগার প্রথার বিলোপ প্রভৃতি ক্ষুদ্র কৃষক শ্রেণিরই দাবি। পরিশেষে এটা বলা যায় যে, এই বিদ্রোহটি ছিল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রপুষ্ট জমিদারদের শোষণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে একটি গণআন্দোলন । এই বিদ্রোহের ফলে সরকার কৃষকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। সুতরাং প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২০-৩৩)
: ২৪৩
গরিব-দুঃখীকে সাহায্য করিবে। কেহ কাহাকেও ন্যায্য অধিকার হইতে বঞ্চিত করিতে পারিবে না । খোদাতালার প্রতি অবিচল ভক্তি রাখিয়া সকলে একতাবদ্ধ থাকিবে । ”
এ আদর্শের আলোকে দেখা যায়, টিপুর শাহর স্থাপিত শেরপুর রাজ্য একটি ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ কল্যাণ রাজ্য ছিল। পাগলপন্থি এ রাজ্যের কর্ণধার টিপুকেই বিদ্রোহী রায়তরা সমস্ত ধনসম্পদ ও খাজনার মালিক বলে ঘোষণা করে। জেলা প্রশাসকের সরকারি রিপোর্টেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে— “তারা বিভিন্ন গ্রামে এখনো আদায়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এই বলে যে, তাদের ঘোষিত নেতা টিপু পাগল ছাড়া কাউকে খাজনা দেওয়া চলবে না এবং যেখানেই লোক গররাজি হচ্ছে বা বাধা দিচ্ছে, সেখানেই লুটতরাজ চলছে।”
কালীগঞ্জ, লেটিরকান্দা, গড়জরিপায় টিপুর বাদশাহী কাচারি গড়ে উঠেছিল। পাগল গুরু টিপুর পিতৃপুরুষের সাধনস্থল শংকরপুরে বিদ্রোহী প্রজারা তাদের খাজনা ও নজরানা দিত। রায়তরা টিপুকে ‘সোলতান' ও তাঁকে প্রদত্ত কর ‘সোলতানি’ বলত । বকসু জজ ও দীপচান ফৌজদার ছাড়াও নহরদ্দি সরকার এবং জরিপ পাগলও অন্যতম ফৌজদার ছিলেন।
-
ডেম্পিয়ারের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল পাগলপন্থিদের ঐক্য ফাটল ধরিয়ে তাদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করা। এ অনৈক্য সৃষ্টি-প্রয়াসে সরকার জমিদারের যৌথ প্রয়াস সক্রিয় ছিল। এজন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল পাগলপন্থি সর্দার আহমদ মণ্ডলকে। তালুক প্রদানের লোভ দেখিয়ে তাকে বশীভূত করা হয়েছিল। পাশাপাশি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য কিছু রায়তকে অস্ত্র দিয়ে অনুগত বাহিনীর সৃষ্টি করা হয়। এ ধরনের সশস্ত্র ১৫০ সদস্যের এক বাহিনী বান্দরকাটার যুদ্ধে সরকার পক্ষে অংশ নেয়। যদিও এরা সংঘর্ষ আরম্ভ হওয়ামাত্র ঘটনাস্থল থেকে পলায়ন করে ।
বিদ্রোহী রায়তদের ঐ প্রতিরোধযুদ্ধে সরকারি সিপাই ও জমিদারি বরকন্দাজরা অবাধ্য রায়তদের উপর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সশস্ত্র বিদ্রোহীরাও এ যুদ্ধে শক্তিশালী বিরুদ্ধপক্ষের মোকাবিলায় প্রাণপণে লড়ে যায়। তারা অসম সাহসে বরকন্দাজ ভগবান সিং, চুনীকে হত্যা করে এবং আরও পাঁচজন বরকন্দাজকে একমাস আটকে রেখে যমালয়ে প্রেরণ করে। দোহুলিয়া থেকে দু'জন সরকারি পেয়াদাকে ১০ দিন ধরে বন্দি রাখার পর সরকারি বাহিনী অভিযান চালিয়ে তাদের মুক্ত করে আনে । বান্দরকাটার ঐ যুদ্ধে বিদ্রোহীরা সরকারি দারোগাকে বর্শার আঘাতে আহত করে তাকে মুগুরপেটা করে। তারা সরকারি চর দুলালকে ধাওয়া করে ধরে মেরে ফেলে ।
পাগলপন্থি বিদ্রোহ প্রসঙ্গে সরকারি রিপোর্টে ছয়টি মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৪ জন লোক মারা যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে সরকার ও জমিদারপক্ষে ১০ জন, বিদ্রোহীদের পক্ষে ৪ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ব্রিটিশ সামরিক অভিযানে ৪৯৯ জনকে বন্দি করা হয়। এদের মধ্যে ২১ জন কারাগারে মারা যায়, ৩৭৭ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকিদের মাঝে ৬১ জনকে শাস্তি প্রদান এবং বাছাইকৃত ২১ জনকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে বিচারের জন্য প্রেরণ করা হয় ৷

২৪৪
১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ফেব্রুয়ারি ডানবারকে শেরপুরের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও ময়মনসিংহের রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। শেরপুর ও আলেপসিংয়ের সাতসিক্কার জমিদার ও প্রজাদের মধ্যে বিদ্যমান বিরোধ নিরসনের দায়িত্ব এবং ক্ষমতাও তাঁর উপর অর্পিত হয়। এ দায়িত্বের উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জমিদারদের স্বেচ্ছাচারিতামূলক করব্যবস্থার বদলে যুক্তিগ্রাহ্য স্থায়ী রাজস্ব- হার নির্ধারণ, পাট্টা ও কবুলিয়তের যথাযোগ্য বিলি-বন্দোবস্তের ব্যবস্থা নেওয়া এবং বেআইনি কর, আবওয়াব ও মাথট আদায় বন্ধ করা। এই লক্ষ্য সামনে নিয়ে ডানবার ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রাম-মহাল সফর করে জমিদার-রায়ততের পারস্পরিক বুঝাপড়ার মাধ্যমে রাজস্ব-হার নির্ধারণ করেন।
টিপু, বকস, দীপচাঁদদের কারাবাস ও মৃত্যু পরবর্তীকালে টিপুর অন্যতম শিষ্য গুমানু সরকার বিদ্রোহী প্রজাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি গাজীর খামারের অধিবাসী ও বিত্তশালী মুসলমান কৃষক ছিলেন। অতীতে মুসলমান কৃষকদের প্রতিষ্ঠিত এই গাজীর খামারে শেরপুরের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার শের আলী গাজীর শেষ আশ্রয়স্থল ছিল। তাঁর সমাধিও সেখানে বিদ্যমান। এই গ্রামের পাগলপন্থি কৃষক নেতা গুমানু সরকারের নেতৃত্বে গাজীর খামারের কৃষকগণ ডানবারের রাজস্ব বন্দোবস্ত মেনে নিতে অস্বীকার করে। এতে ডানবার রুষ্ট হয়ে গুমানু সরকারকে গ্রেফতার করেন। বন্দি গুমানু কারামুক্তির জন্য গাজীর খামারের কৃষকরা দাবি জানাতে থাকে। গুমানুর বিরুদ্ধে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ দাঁড় করাতে না পারায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মুক্তি
লাভ করেন।
সাত সিক্কা মৌজার ভরতি মৌকাণ্ডির চাঁদের নন্নী গ্রামের উজির সরকার ছিলেন পাগলপন্থি আরেক কৃষক নেতা। তিনিও মুসলমান ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ভরতি মৌকাণ্ডির কৃষকরাও ডানবারের রাজস্ব নিরিখকে প্রত্যাখ্যান করে। গুমানু সরকার ও উজির সরকার সম্মিলিতভাবে ডানবারের বন্দোবস্তকে আইনি প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা করতে থাকেন। তাঁদের সহযোগিতায় বহুসংখ্যক কৃষকপ্রজা কর্তৃপক্ষ বরাবরে, অনেক আবেদন-নিবেদন, মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করেন। এই দুই নেতার প্ররোচনায় ডানবার তাঁর নবপ্রবর্তিত ব্যবস্থা কার্যকরে বার বার বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ভীষণ চটে গিয়ে গুমানু সরকার, উজির সরকার ও গম্ভীর সরকারকে কাচারিতে ডেকে নিয়ে অমানুষিক প্রহার করেন। গুমানু পুনরায় কৃষকদের উজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হন। ডানবারও তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করতে চেষ্টা করেন। গুমানু ডানবারের অভিপ্রায় বুঝতে পেরে আইনজ্ঞের পরামর্শের জন্য চুপিসরে কলকাতা গমন করেন। পরগণায় আপাত শান্তি বিরাজমান থাকায় জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ডানবার ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে শেরপুর থেকে ময়মনসিংহে চলে আসেন। তাঁর প্রস্থানের সাথে সাথে শেরপুর ডানবারের কাচারির কার্যকারিতা বিলুপ্ত হয়। ডানবারের অনুপস্থিতির সুযোগ বুঝে গুমানু এবং উজির সরকার শেরপুর পরগণায় কৃষক বিদ্রোহের বহ্নি পুনঃপ্রজ্বলিত করেন। ঐ বছরের শেষের দিকে বিদ্রোহী কৃষকগণ বিভিন্ন স্থানে জমিদারি কাচারী আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে। জমিদারের পাইক-বরকন্দাজ এবং সরকারি পিয়ন ও পুলিশকে পেটায়। পেয়াদাদের উপরও হামলা চলে। জমিদারগণ বিদ্রোহী প্রজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। গুমানু সরকার কলকাতা থেকে সুদক্ষ আইনজীবী এনে নাসিরাবাদ শহরে থেকে কৃষকদের স্বপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ।

ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২০-৩৩)
245
সেসময় মামলা পরিচালনার সুবাদে গুমানু সরকার এবং উজির সরকার নাসিরাবাদ শহরে বসবাস করতে থাকেন। এই দুই নেতার শেরপুরে অনুপস্থিতিতে জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথর নামীয় দুই দুর্ধর্ষ গারো সর্দারকে বিদ্রোহীরা তাদের নেতৃত্বে বরণ করে। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে বিদ্রোহ পরিচালনার সুবিধার জন্য জানকু ও দোবরাজ উভয়ে পরামর্শক্রমে শেরপুর অঞ্চলকে দু'ভাগে বিভক্ত করেন। জানকু শেরপুরের উত্তর-পশ্চিম কোণের কড়ইবাড়ির পাহাড়ের পাদদেশস্থ বাটাজোড়ে আর দোবরাজ পূর্বদিকের নালিতাবাড়ির সন্নিকটে অবস্থান গ্রহণ করেন। পরে উভয়ে তাদের বাহিনী নিয়ে একযোগে শেরপুর আক্রমণ করেন। তাঁরা জমিদারবাড়ি ও কাচারী লুণ্ঠন করেন। জমিদারগণ সপরিবারে অন্যত্র গিয়ে প্রাণরক্ষা করেন ।
সেসময় মামলা পরিচালনার সুবাদে গুমানু সরকার এবং উজির সরকার নাসিরাবাদ শহরে বসবাস করতে থাকেন। এই দুই নেতার শেরপুরে অনুপস্থিতিতে জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথর নামীয় দুই দুর্ধর্ষ গারো সর্দারকে বিদ্রোহীরা তাদের নেতৃত্বে বরণ করে। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে বিদ্রোহ পরিচালনার সুবিধার জন্য জানকু ও দোবরাজ উভয়ে পরামর্শক্রমে শেরপুর অঞ্চলকে দু'ভাগে বিভক্ত করেন। জানকু শেরপুরের উত্তর-পশ্চিম কোণের কড়ইবাড়ির পাহাড়ের পাদদেশস্থ বাটাজোড়ে আর দোবরাজ পূর্বদিকের নালিতাবাড়ির সন্নিকটে অবস্থান গ্রহণ করেন। পরে উভয়ে তাদের বাহিনী নিয়ে একযোগে শেরপুর আক্রমণ করেন। তাঁরা জমিদারবাড়ি ও কাচারী লুণ্ঠন করেন। জমিদারগণ সপরিবারে অন্যত্র গিয়ে প্রাণরক্ষা করেন।
গারো সর্দারদের নেতৃত্বাধীন এই প্রজাবিদ্রোহের সংবাদ অবগত হয়ে ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনরত ডানবার জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট গ্যারেটকে বিদ্রোহ দমনার্থে শেরপুর প্রেরণ করেন। গ্যারেট ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল শেরপুর পৌঁছে জমিদারদের সান্ত্বনার বাণী শোনালেও তা তখনকার মত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শুরুতেই গ্যারেটের অবস্থানস্থল ডাকবাংলো বিদ্রোহীদের কর্তৃক আক্রান্ত হয়। গ্যারেট নিজের ও জমিদারদের প্রাণ রক্ষার্থে সচেষ্ট হলেন। তিনি এ লক্ষ্যে সরকারি পুলিশ ও জমিদারী বরকন্দাজদের একত্রীভূত করে শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হন। তিনি দোবরাজ পাথরকে দমনার্থে নালিতাবাড়ির দিকে একজন পুলিশ সৈন্য ও বরকন্দাজ পাঠান। দোবরাজ খবর পেয়ে পাহাড়ে গা ঢাকা দেন। জমিদাররা নালিতাবাড়িতে কাচারী প্রতিষ্ঠা করে বরকন্দাজ সজ্জিত করেন । দোবরাজ সুযোগ বুঝে জমিদারী কাচারী আক্রমণ করে ১ জন পুলিশ, ১ জন বরকন্দাজ, ১ জন মোহরার ও ১ জন পিয়নকে ধরে নিয়ে যান। দিশেহারা জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট গ্যারেট বিষয়টি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানান । ময়মনসিংহ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডানবার ২৯ এপ্রিল ঢাকার কমিশনার মিডলটনকে সমস্ত বিষয়টি পত্রযোগে অবহিত করেন এবং ডানবার স্বয়ং শেরপুরে গমন করেন। তিনি সেখানে পৌঁছে শেরপুরের নিকটবর্তী আহমদগঞ্জে অবস্থান নিয়ে বিদ্রোহ দমন অভিযানের ছক কষেন এবং জামালুপর ক্যান্টমেন্টের সেনাধ্যক্ষ মনটিথের নিকট ১৫০ জন সৈন্যের জন্য আশু প্রার্থনা জানান। পরদিন ক্যাপ্টেন সিলের নেতৃত্বে সৈন্যদল শেরপুর উপস্থিত হলো। ডানবারের সাথে পরামর্শক্রমে সৈনিকদের তিনি দু'অংশে বিভক্ত করেন। এক অংশ ক্যাপ্টেন সিল নিজ দায়িত্বে রেখে অপর অংশ ইয়ং হাজব্যান্ডের নেতৃত্বে পরিচালনার

২৪৬
দায়িত্ব দেন। ক্যাপ্টেন সিল তাঁর অংশীয় সৈন্য সমভ্যিহারে পশ্চিমের পাহাড়ে অবস্থানরত জানকুকে দমনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সিল চর মারফত জানতে পারেন, জানকু চার হাজার সশস্ত্র অনুচর নিয়ে বৃটিশ সৈন্যদের গতিরোধে প্রস্তুিতি নিয়ে অপেক্ষমান রয়েছে। এ সংবাদে ক্যাপ্টেন সিল আতঙ্কগ্রস্থ হন। তিনি পূর্ব পরিকল্পনা সংশোধন করে লেফটেন্যান্ট ইয়ং হাজব্যান্ডকে সসৈন্যে তাঁর সাথে যোগ দেওয়ার আদেশ দেন। ৩ মে সম্মিলিত বাহিনী পাহাড়ের সন্নিকটস্থ মধুপুরে অবস্থান গ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন সিল সেখান থেকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে পাহাড়ি অরণ্য মধ্যস্থিত জানকুর জলঙ্গীর আশ্রয়স্থলে অভিযান পরিচালনা করেন। জানকুকে না পেয়ে তাঁর আবাসস্থলে অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করেন ।
ক্যাপ্টেন সিল দোবরাজের আস্তানা ধ্বংস করে তাঁর অনুসারী বিদ্রোহীকে আত্মসমর্পণের আদেশ জারি করেন। না হলে তাদের আবাসস্থলও দোবরাজের আস্ত ানার মতো আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘোষণায় অনেক বিদ্রোহী আত্মসমর্পণ করে। জানকুর বিদ্রোহী বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে ক্যাপ্টেন সিল ১৯ এপ্রিল শেরপুরে প্রত্যাবর্তন করেন। অপরদিকে লেফট্যানেন্ট ইয়ং হাজব্যান্ড দোবরাজকে দমনের জন্য সসৈন্যে ৭ মে নালিতাবাড়িতে শিবির স্থাপন করেন। তিনি পরদিন নালিতাবাড়ির সন্নিকটে গারো পাহাড় অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়ে দোবরাজের আশ্রয়স্থল আবিষ্কারে সক্ষম হন। টের পেয়ে আটককৃত বরকন্দাজ, মোহরার, পিয়নদের নিয়ে দোবরাজ অজ্ঞাতে পালিয়ে যান। ইয়ং হাজবেন্ড কেবলমাত্র জমাদারকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। দোবরাজ ও তার বাহিনীকে ধরতে না পেরে তার আস্তানায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেন। দোবরাজকে দমনের অভিযান থেকে ফিরে ইয়ং হাজবেন্ড নালিতাবাড়ি ও হালুয়াঘাটের বারো বর্গ মাইলব্যাপী অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহীদের দমন তৎপরতা চালান। ১৩ মে বিদ্রোহীদের অনেকে আত্মসমর্পণ করে। ২০ মে ২৫ জন সৈন্য নালিতাবাড়িতে রেখে ক্যাপ্টেন সিল বাকি সৈন্য নিয়ে জামালপুর সেনাবাসে ফিরে যান । ৩১ মে ইয়ং হাজবেন্ডও তাঁর অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে জামালপুর ক্যান্টমেন্টে প্রত্যাবর্তন করেন। ক্যাপ্টেন সিল ও লেফটেন্যান্ট ইয়ং হাজবেন্ডের দমন অভিযানের মাধ্যমে শেরপুর অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন প্রশমিত হয় ।

ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহের কারণ


১৮২০-৩৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাগলপন্থি সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে যে কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত হয় তা পাগলপন্থি বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের (১৮২০-৩৩ খ্রি.) চৌহদ্দি ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ, উত্তরে গারো পাহাড়রাজি এবং পূর্বে হাওড় এলাকা। অতীতে এ এলাকা ছিল সকল কেন্দ্রীয় সামন্ত শক্তির নিয়ন্ত্রণ মুক্ত। চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এখানকার আঞ্চলিক ক্ষুদ্র (Minor) রাজ্যগুলোর নেতৃত্বে ছিল গারো, কোচ, মেচ, হাজং, পাগলপন্থি সম্প্রদায়, আফগান, উত্তর-ভারতীয় ব্রাহ্মণ ও বিদ্রোহী মুঘল সৈন্যরা। এলাকাটির রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল এর আঞ্চলিক স্বাধীনতা। পাগলপন্থি বিদ্রোহের পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল।
উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে জমিদারি রাজনীতির মূল বিষয় ছিল অংশীদারিত্বের সংঘর্ষ। ১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দ হতে শরিকি সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। এ অঞ্চলে জমির সীমানা ঠিক ছিল না এবং তালুকের আনুপতিক হারও নির্দিষ্ট ছিল না। এ সুযোগে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী ও দলিল রক্ষকরা একদিকে জমিদারের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বাদী বিবাদীর সঙ্গে চক্রান্তের নানা সূত্র তৈরি করে, অন্য দিকে এরূপ বিবাদের সূত্র ধরে সরকার নিজের ক্ষমতা সুসংহত করে। শরিকি সংঘর্ষ শেষ হলে জমিদাররা স্বভাবতই কৃষকদের উপর তাদের দাবিদাওয়া বিধিবদ্ধ করতে উদ্যোগী হয়। যখন জমিদাররা রাজস্ব আদায়ে চেষ্টা করলো তখনই দেখলো যে, বেপরোয়া কৃষকরা জমিদারদের ততটা বাধ্যগত নয়। ফলে এলাকার শান্তি বজায় রাখা, নিয়মিত রাজস্ব আদায় হওয়া জমিদার ও সরকারের এই স্বার্থকে কৃষকদের স্বার্থের মুখোমুখি নিয়ে এলো।
এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল কৃষকদের উপর বাড়তি কর আরোপ করা। সাধারণত পরগণার হারের ভিত্তিতে আসল জমা নির্ধারিত হতো। এই জমার সাথে স্থানীয়ভাবে যুক্ত হতো সরঞ্জামি খরচ, দেশ খরচ, জমিদারি ব্যয়, টাকা প্রতি হারে আবওয়াব খরচ ইত্যাদি। ফলে আসল জমার সাথে এগুলো যুক্ত হয়ে কৃষকদের দেয় ধার্যের পরিমাণ বেড়ে যেত। অস্থায়ী ধার্যের সংখ্যাও ছিল অসংখ্য। ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষকরা এই সব অস্থায়ী কর সংগ্রহের বিরুদ্ধে ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে আপত্তি জানায়, যা শেষে বিদ্রোহে পরিণত হয়।
কৃষকদের উপর রাজস্ব বৃদ্ধির একটি কারণ ছিল শেরপুর ও আলাপ সিং পরগণার ইজারা বন্দোবস্ত। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে শেরপুরে মাজকুরী (বড়) তালুক ছিল এগারোটি। তবে জমিদারদের সৃষ্টি হুজরী (ছোট) তালুকের সংখ্যা ছিল ৩২৩ টি। এ সকল তালুকের ইজারাদাররা জমিদারদের সাথে গোপন চুক্তির ভিত্তিতে কৃষকদের নিকট হতে ত্রুটিপূর্ণ দলিলের নামে খাজনা আদায় করতো যার সাথে কৃষকদের কোনো পরিচয় ছিল না। এরূপ শোষণ কৃষককে বিদ্রোহী করে তোলে ।
১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তত হলে অত্র অঞ্চলের অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে কৃষকের উপর করের চাপ না কমে বরং বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত করারোপ চরমে ওঠে। এর সাথে যুক্ত হয় জমিদারের অত্যাচার, বল প্রয়োগ ও খামারে বেগার খাটা। পরিণামে কৃষক-জমিদার সম্পর্কের অবনতি ঘটে ।
১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ঔপনিবেশিক সরকারের সাম্রাজ্যবাদী নীতি উত্তর ময়মনসিংহের ঘটনাপ্রবাহের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এ সময়ে ব্রিটিশ ও বর্মী সাম্রাজ্যবাদ পরস্পরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা ব্রহ্মদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আসামে যুদ্ধের জন্য জামালপুর থেকে সুশং সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তা তৈরি, মাঝে নদী পারাপারে জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক নৌকা সরবরাহ করার জন্য সরকার শেরপুরের জমিদারদের নিকট নির্দেশ পাঠায়। এ নির্দেশ পালনে জমিদারশ্রেণি বল প্রয়োগে কৃষকদের বেগার খাটানো, পল্টনের খরচ ও রসদ বাবদ আবওয়াব কৃষকদের নিকট দাবি করে। এর প্রতিবাদে কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
পাগলপন্থি বিদ্রোহহের গুরুত্ব
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্ৰোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। সত্যনিষ্ঠা, সাম্য, মানবতাবাদ, ভাতৃত্ববোধ ছিল পাগলপন্থিদের ধর্মাদেশের মূল বিষয়বস্তু। তাদের মতে, সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি; কেউ কারো গোলাম নয়। তাই কেউ উঁচু, কেউ নিচু-এইরূপ ভেদাভেদ নেই। সকল মানুষ ভাই ভাই। এই মহান সাম্যের বাণী নিয়ে বঙ্গ-ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তারের ১৮ বছর পর ১৭৭৫ খ্রি. করিম শাহ নামক একজন মুসলমান ফকির ময়মনসিংহের সুসং পরগনায় আবির্ভূত হন। তিনি ছিলেন এ অঞ্চলের পাগলপন্থি ধর্মচেতনার প্রথম গুরু। তাঁর অনুসারি পাগলপন্থিরা ১৮২০ খ্রি. থেকে ১৮৩৩ খ্রি. ব্যাপী ময়মনসিংহ অঞ্চলে এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। নানাবিধ কারণে এ আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ : ময়মনসিংহ অঞ্চলে জমিদার- জোতদারদের শোষণ-নিপীড়নে জর্জরিত ছিল সেখানকার সমতলের বাসিন্দা মুসলমান, গারো পাহাড়ের প্রান্তস্থিত উপজাতীয় গারো, হাজং, হদি, ডালু, বানাই কৃষককুল। জমিদারদের চাপিয়ে দেওয়া নিবর্তনমূলক নানা নামের কর, আবওয়াব, মাথটে এই অঞ্চলের কৃষকগণ ছিলেন সর্বস্বান্তপ্রায়। একদিকে জুলুমবাজ অভিজাত জমিদার- জোতদার শ্রেণি, অন্যদিকে নিঃস্বপ্রায় কৃষক শ্রেণি। ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিদ্যমান প্রর্বতপ্রমাণ এই শ্রেণিবৈষম্য প্রপীড়িত সমাজে সাম্য ও সুবিচারের বাণী নিয়ে পাগলপন্থি আন্দোলন শুরু হয়। জমিদার-জোতদার শ্রেণির অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ ছিল প্রতিবাদী কণ্ঠ
২. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন : দীউয়ানি উত্তর যুগে (১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে) বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর অঞ্চলে জনগণের, বিশেষকরে কৃষক সমাজের উপর কোম্পানির রাজস্ব বিভাগের মুতসুদ্দি, কর্মকর্তা ও জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে পাগলপন্থিরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। সমকালীন অন্যান্য আন্দোলনের মতো এটি প্রকৃতিগতভাবে ছিল বিক্ষিপ্ত, সহজাত, অপরিকল্পিত, স্থানীয় ভূমি সংক্রান্ত এবং ধর্মীয়। প্রথম পর্যায়ে আন্দোলনটি পরিচালিত হয় জমিদারদের বিরুদ্ধে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এটি ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এ অঞ্চলে পাগলপন্থিরা ছিলেন ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারে অস্তিত্বের প্রশ্নে হুমকিস্বরূপ। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও পাগলাপন্থিরা এ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছিল ।
৩. শেরপুরে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা : জমিদাররা প্রজাদের নিকট থেকে জোরপূর্বক খাজনা আদায়ের চেষ্টা করলে জমিদারদের লেঠেল-বরকন্দাজদের সাথে গড়জরিপায় পাগলপন্থি বিদ্রোহীদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে জমিদারদের পরাজয় ঘটলে তাঁরা পলায়ন করে শেরপুর কালীগঞ্জে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ডেম্পিয়ারের কাচারিবাড়িতে সপরিবারে আশ্রয় নেয়। যুদ্ধে বিজয়ী পাগলপন্থি সাত'শ কৃষক বিদ্ৰোহী শেরপুর শহর দখল করে। বিদ্রোহী নেতারা শেরপুর শহরকে কেন্দ্র করে সেখানে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তাঁরা সেখানে বিচার ও শাসনব্যবস্থাও চালু করে। পাগল নেতা টিপু শাহ এ রাজ্য পরিচালনা করেন। যদিও এ রম্য দু'বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি।
৪. অন্যায় কর ও উৎপীড়নমূলক আইন প্রত্যাহার : করিম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র টিপু শাহ উত্তরাধিকারসূত্রে পাগলপন্থিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনের চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এটি কৃষক আন্দোলনের রূপ নেয়। পাগল ও তাদের সহযোগিগণ জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য জমিদার ও কোম্পানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অবশ্য ১৮৩৩ খ্রি. নাগাদ আন্দোলন বহুলাংশে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে এর পূর্বে কৃষকদের করুণ অবস্থা প্রশমনের ক্ষেত্রে এ আন্দোলন খানিকটা অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করে। অনেক অন্যায় কর ও উৎপীড়নমূলক আইন তুলে নেওয়া হয়। এতে এ আন্দোলনের গুরুত্ব প্রতীয়মান হয় ।
কোম্পানি শাসনের সাময়িক বিলুপ্তি : টিপু শাহের মৃত্যুর পর জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শক্ত আন্দোলন গড়ে তোলেন। দুদিক থেকে অগ্রসর হয়ে পাগলপন্থিগণ শেরপুর শহরে প্রবেশ করে জমিদার বাড়ি ও রাজস্ব অফিস লুট ও থানা দখল করে এবং থানার অস্ত্রশস্ত্র পুড়িয়ে দেয়। পাগলপন্থি বিদ্রোহীরা নিজেদেরকে এ অঞ্চলের শাসক হিসেবে ঘোষণা করে। জমিদার, সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ ময়মনসিংহ শহরে আশ্রয় নেয় । কিছু দিনের জন্য কোম্পানি শাসনের বিলুপ্তি ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয় ৷
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ময়মনসিংহ জেলার শেরপুরে পাগলপন্থিদের যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, তা পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়, শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল, কিন্তু পাগলপন্থিদের প্রতিরোধকে চিরতরে স্তব্দ করে দেওয়া যায়নি। পাগলপন্থিদের এ আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয় ।
ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহের সার্বিক বিশ্লেষণ
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্ৰোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। দৃশ্যত উত্তর ময়মনসিংহ ছিল বাংলার ইতিহাসের মূলধারা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। যুগ যুগ ধরে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীরা উক্ত এলাকায় এসে নিরাপদ আস্তানা স্থাপন করে। পাগলপন্থি সম্প্রদায় ছিল এদের মধ্যে একটি। করম শাহ নামক একজন পাঠান ছিলেন এ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে করম শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র টিপু শাহ গদিতে বসেন। তিনিও পিতার মতো কামেল পুরুষ এবং ভবিষ্যত প্রবক্তা ছিলেন বলে ভক্তরা মনে করতো। ভক্তদের বিশ্বাস ছিল যে, টিপু শাহ যা ইচ্ছা তাই করতে পারতেন। টিপুর এ ক্ষমতা ও যোগ্যতা তাকে কৃষককুলের নেতৃত্ব গ্রহণে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ারে (বৃহত্তম ময়মনসিংহ)টিপুকে কৃষক নেতারূপে অভিহিত করা হয়েছে। টিপুর নেতৃত্বে পাগলপন্থি সম্প্রদায় দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করে। টিপুর জীবন, তার ক্ষমতার মোহ, তার চরিত্র এসব কিছুই বিপ্লবের আবহ সৃষ্টি করে। সকলের আশাভরসার স্থল হয়ে ওঠেন টিপু শাহ। অচিরেই টিপুর ক্ষমতা ও নেতৃত্ব অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে সরকার টিপুকে একটি সন্দেহজনক চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। এ বিদ্রোহে পাগলপন্থিদের নেতৃত্ব দেবার কারণ ছিল মূলত কৃষক সমাজের সংগঠনের অনুপস্থিতি, শ্রেণিচেতনার অভাব এবং পাগলদের ক্রমবর্ধমান সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি । পাগলরা ছিল বিদ্রোহী সংগঠনের মূল শক্তি ।
পাগলপন্থি বিদ্রোহের প্রথম পর্ব ছিল ১৮২৪-২৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এ সময়ে বিদ্রোহী কৃষকদের সব দাবি ও চাহিদা একমুখী হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত করারোপ, বেগার প্রথা, ব্রহ্মযুদ্ধজনিত বিভিন্ন কর, রসদ সরবরাহ, পুলিশের অত্যাচার ও চাঁদা আদায়, এসবের স্থলে টিপু শাহ কর্তৃক পরিমিত রাজস্ব প্রদানের (প্রতি কোর জমির খাজনা ৪ আনা) প্রতিশ্রুতিতে কৃষক শ্রেণি পাগলপন্থিদের কর্মসূচিতে বিশ্বাস স্থাপন করে। আন্দোলনকারীরা গ্রামে গ্রামে প্রচার করে যে, ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান আসন্ন, জমিদারি-ক্ষমতা বিলপ্তির পথে এবং নতুন রাজত্বের প্রধান হবেন টিপু শাহ পাগল। টিপুর এসব প্রচারণায় কর্তৃপক্ষ নিজেদের বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর তাকে বন্দি করে। এতে বিদ্রোহের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। সরকার পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ ডিসেম্বর টিপুকে মুক্তি দেয়। টিপুর নামে রাজস্ব আদায় শুরু হয়। কার্যত টিপু শাহ সর্বসাধারণের নেতা নির্বাচিত হন। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ জানুয়ারি বিদ্রোহীরা শেরপুর শহর ও জমিদারদের স্থাপনাসমূহ আক্রমণ করে। তারা কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাবি তোলে যে, তারা জমিদারি অত্যাচার এবং শোষণ ও উৎপীড়ন মানতে রাজি নয়। ম্যাজিস্ট্রেট সব রকম বেগার, আবওয়াব ও বাড়তি খাজনা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে জমিদার তাদের সহায়ক বাহিনীর সাথে বিদ্রোহী কৃষক শ্রেণির প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ চলে। ইতোমধ্যে সরকার বুঝতে পারে যে, কৃষক শ্রেণির আন্দোলনের প্রধান কারণ অন্যায় ভূমিকর আরোপ এবং এ প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে। এর সমাধানকল্পে সরকার একটি সংক্ষিপ্ত তদন্ত শেষে নতুনভাবে খাজনার হার পুনঃনির্ধারণ করেন। কিন্তু পরিবর্তিত এই ব্যবস্থাতেও বিদ্রোহী কৃষকরা দুটি কারণে খুশি হতে পারেনি। প্রথমত; সরকারি তদন্তে নির্যাতিত কৃষকদের নিকট হতে কোনো প্রকার তথ্য নেওয়া হয়নি এবং দ্বিতীয়ত; বিদ্রোহে মৃত্যুবরণকারী কৃষকদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে কালেক্টরের নতুন বন্দোবস্ত ‘অষ্টম আইন' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই আইন অমান্য করে কৃষকরা জানকো পাথের ও দুবরাজ পাথেরের নেতৃত্বে পুনরায় বিদ্রোহ শুরু করে।

বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্বে বিদ্রোহীরা শেরপুর শহরে প্রবেশ করে জমিদার বাড়ি, কাছারি ও রাজস্ব অফিসসমূহ লুটপাট করে। তারা পুলিশ স্টেশন জ্বালিয়ে দেয়। বিদ্রোহীরা নিজেদের স্বরাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। জমিদার, পুলিশ, সরকারি কর্মচারীরা জেলা সদর ময়মনসিংহে আশ্রয় নেয়। অন্তত কিছু কাল মনে হয় যে, এখানে কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটেছে। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ১ এপ্রিল সরকারি বাহিনী শেরপুর শহর পুনর্দখল করে। সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার সশস্ত্র কৃষক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালায় এবং তাদের স্থাবর- অস্থাবর সম্পদের ক্ষতি সাধন করা হয়। সরকারের এধরনের ব্যবস্থার ফলে প্রজারা বিদ্রোহী পক্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ মে থেকে বিদ্রোহ স্থিমিত হয়ে পড়ে। এ পর্বে বিদ্রোহীরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাবি আদায়ের পন্থা অবলম্বন করে। তাদের পক্ষে দাবি আদায়ের জন্য উজির সরকারকে উকিল নিযুক্ত করে ময়মনসিংহে পাঠানো হয়। আদালতের লড়াইয়ে তাদের হাত শক্ত করার জন্য কলকাতা থেকেও একজন এটর্নি আনা হয়। এসময়ে লক্ষ করা যায়, কৃষকরা দাবি আদায়ে হিংসার পথ পরিহার করে আইন আদালতের আশ্রয় নেয়। বিগত দিনের চেয়ে কৃষক শ্রেণি এখন জমিদার ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সংলাপে বেশি সিদ্ধ হস্ত। সম্মিলিত চাঁদার মাধ্যমে কৃষকরা ময়মনসিংহ শহরে আইন লবি প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের পরও তারা সুসংগঠিত অবস্থায় সংঘবদ্ধভাবে আদালতের মাধ্যমে প্রতিরোধ চালিয়ে যায় ।
ময়মনসিংহ বিদ্রোহ কোনো প্রকার উপজাতীয় বা ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না। এ বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন সব ধর্মের ও বর্ণের। বিদ্রোহীদের সামাজিক পরিচয় ছিল এরা উপজাতীয়, নানা বর্ণের হিন্দু ও নানা পেশার মুসলমান। তারা গোষ্ঠী পরিচয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর হলেও সকলের রণভাষা ছিল বাংলা। তাদের ধর্ম কখনো সংগ্রামে কোনো ইস্যু তৈরি করেনি। তাদের বিদ্রোহের মতাদর্শ ছিল মূলত উৎপাদন সম্পর্কে ও শোষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিদ্রোহীরা সামাজিকভাবে মোটামুটি অভিন্ন ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষক ছিল বলে মনে করা হয়। খাজনার হার হ্রাস, অবৈধ কর ও বেগার প্রথার বিলোপ প্রভৃতি ক্ষুদ্র কৃষক শ্রেণিরই দাবি। পরিশেষে এটা বলা যায় যে, এই বিদ্রোহটি ছিল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রপুষ্ট জমিদারদের শোষণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে একটি গণআন্দোলন । এই বিদ্রোহের ফলে সরকার কৃষকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। সুতরাং প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]