ইতিহাসের অলিখিত উৎসগুলো কী কী?

উত্তর ভূমিকা : মানুষের অতীত কার্যক্রমের সবই ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত নয়। তাছাড়া মানুষের অতীত কার্যক্রমসংক্রান্ত বিবরণ হলেই তা ইতিহাস হিসেবে বিবেচিত হবে এমন কথাও সম্পূর্ণ সঠিক নয়। ইতিহাস উৎসভিত্তিক হওয়ায় ইতিহাস রচনার বিভিন্ন উৎসের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভূত হয়। ইতিহাসের উৎসসমূহের মধ্যে অলিখিত উপাদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের এই অলিখিত উপাদানসমূহের মধ্যে মুদ্রা, শিলালিপি, স্তম্ভলিপি প্রভৃতি অন্যতম ।
ইতিহাসের অলিখিত উপাদান : ইতিহাসের উৎস বা উপাদানগুলোর মধ্যে যেগুলো লিখিত নয় সেগুলো অলিখিত উপাদান। অলিখিত উপাদনসমূহকে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। অতীত মানুষের জীবনযাত্রা বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যেকোনোভাবে সম্পর্কযুক্ত উপাদানসমূহকে প্রত্নতাত্ত্বিক বা অলিখিত উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অতীতকালের মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদনের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার করে যেসব উপাদান নির্মাণ, ব্যবহার বা কার্যক্ষেত্রে প্রভাবিত করে থাকে তাকে প্রত্নতাত্ত্বিক বা অলিখিত উপাদান বলে ।
যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে ইতিহাস রচিত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— ১. আমাদের পূর্ব পুরুষগণের জীবাশ্ম, ২. শিলালিপি ও তাম্রলিপি, ৩. ধাতব মুদ্রা, ৪. স্থাপত্যিক নিদর্শন এবং ৫. শিল্পকলার নিদর্শন । নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো : ১. জীবাশ্ম : প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হলো জীবাশ্ম । হাজার হাজার বছর মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা মানুষ, অন্য কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের অংশবিশেষকে জীবাশ্ম বলা হয় । এই জীবাশ্মের ওপর গবেষণা করেই আমরা খাড়া মানব, জাভা মানব, পিকিং মানব প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছি ।
২. শিলালিপি ও তাম্রশাসন : প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে শিলালিপি। সাধারণত কোনো স্থাপনার গায়ে নির্মাণের স্মারক হিসেবে পাথরের গায়ে যা খোদাই করা হতো তাই শিলালিপি। এখানে সংশ্লিষ্ট রাজার নাম, স্থানীয় নির্মাতার নাম, নির্মাণ তারিখ, স্থাপনার ধরন ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেত। অপরপক্ষে তামার পাতে খোদাই করা লিপিগুলোকে তাম্রশাসন বলা হয়। প্রাচীনকালের রাজাদের একটা বড় অংশ তামার পাতে খোদাই করে বিভিন্ন সরকারি নির্দেশনা প্রচার করতো, যা তাম্রলিপি নামে বহুল পরিচিত ।
৩. মুদ্রা : মুদ্রা বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ধরনের ধাতব খণ্ডকে বুঝায়, যা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া একটি মুদ্রার সুনির্দিষ্ট গাঠনিক বিশুদ্ধতা ও নির্ধারিত মাপ রয়েছে। মুদ্রার গায়ের অঙ্কিত রাজার ছবি, রাজতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও শিল্পকলার পরিচয় পাওয়া যায় ।
৪. স্থাপত্যিক নিদর্শন : উদ্যানভিত্তিক কৃষি সমাজে মানুষ যাযাবর জীবনযাপন ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে আবাসস্থল গড়ে তুলে। মানুষ স্থায়ী আবাসন হিসেবে যেসব দালানকোঠা নির্মাণ করেছে তা স্থাপত্যিক নিদর্শনের পর্যায়ভুক্ত। যেমন পানাম নগর, ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান, পিরামিড প্রভৃতি অন্যতম ।
৫. শিল্পকলার নিদর্শন : শিল্পকলা সৃষ্টিশীল মানুষের নিরন্তর উন্নয়ন সৃজনশীলতার প্রচেষ্টার ফসল। মানুষ মনের মাধুরী মিশিয়ে কোনো প্রাকৃতিক অবয়বকে যখন নিজের প্রয়োজনে ও ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্তন করে। আবার মূর্ত বা বিমূর্ত কোনো মানব আকাঙ্ক্ষাকে ভাষা দিতে চেষ্টা করে তখন তা শিল্পকলায় পরিণত হয়। এই শিল্পকলার নিদর্শনগুলোই একজন ইতিহাসবিদকে কোনো জাতি সম্প্রদায়ের অতীত ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সহায়তা করে থাকে । উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইতিহাসের উৎস হিসেবে অলিখিত উপাদান ইতিহাস রচনার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অলিখিত উপাদানের সাহায্যে প্রাগৈতিহাসিক, প্রায় ঐতিহাসিক ও ঐতিহাসিক কালের ইতিহাস পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়। যার ফলে সুনির্দিষ্টভাবে না হলেও অনুমান বা ধারণার ওপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হচ্ছে।

ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের গুরুত্ব আলোচনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : ইতিহাসের অলিখিত উপাদানসমূহকে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান বলা হয়ে থাকে। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহের মধ্যে জীবাশ্ম, শিলালিপি ও তাম্রশাসন, মুদ্রা, স্থাপত্য নিদর্শন, শিল্পকলা নিদর্শন অন্যতম। অতীত মানুষের জীবনযাত্ৰা বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পর্কযুক্ত উপাদান হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানকে বিবেচনা করা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ অতীত মানুষের সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভরতা এবং প্রকৃতি থেকে আহরিত উপাদানের ওপর তাদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে ।
ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের গুরুত্ব : নিম্নে ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো : ১. প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস পুনর্গঠন : প্রাগৈতিহাসিক কালের প্রথম দিকের ইতিহাসের কোনো কিছুই লিখিত আকারে পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকগণ কিংবা পুরাতাত্ত্বিকগণ প্রাগৈতিহাসিক কালের ইতিহাস জানার জন্য ঐ সময়কার মানুষের ব্যবহার্য বিভিন্ন উপাদানের ওপর নির্ভর করে থাকেন। তখনকার মানুষের হাতিয়ার থেকে তাদের যাযাবর জীবন, শিকারের প্রকৃতি, শিকারকৃত পশুর আকার, খাদ্যগ্রহণ প্রণালি প্রভৃতি সম্পর্কে জানা যায় ৷
২. অতীতের সমাজব্যবস্থার ইঙ্গিত : প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষ সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ বসবাসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। আর এজন্য মানুষ নদীতীরে, জলাশয়ের পাশে এবং কৃষিজমির আশপাশে বসতি নির্মাণ করে। বর্তমানের মতো তখনও কৃষিকাজের জন্য মানুষ নানা প্রকার উপকরণ ব্যবহার করতো। যেগুলো বর্তমানেও অনেকটা অক্ষত রয়েছে। আর এজন্যই বর্তমানে অতীতের সমাজব্যবস্থার ইতিহাস জানার জন্য প্রধানত উৎস হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানকে বিবেচনা করা হয়।
৩. সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা : এ পর্যন্ত মানুষ যা কিছু অর্জন করেছে তাই মানুষের সংস্কৃতি হিসেবে আখ্যায়িত। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষের জীবনযাত্রার সাথে সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সংস্কৃতি মানুষকে শুদ্ধ ও সুস্থ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অবদান রাখে। মানুষের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদান যেমন— বাদ্যযন্ত্র, পোশাক- পরিচ্ছদ প্রভৃতি প্রাগৈতিহাসিক কালের ইতিহাস পুনর্গঠনে আজ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ।
৪. অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস জানা : প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মুদ্রা প্রাগৈতিহাসিক, প্রাচীন ও মধ্যযুগের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সরবরাহ করে। মুদ্রার পিঠে ছাপাঙ্কিত রাজার ছবি, রাজ্যকালের সময়সীমা প্রভৃতি রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। মুদ্রার তথ্যাবলি রাজার ও রাজবংশের সার্বভৌমত্বেরও ইঙ্গিত প্রদান করে । আর এজন্যই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের মধ্যে মুদ্রাকে খুব প্রভাবশালী রূপে বিবেচনা করা হয় ।
৫. বিভিন্ন সভ্যতা সম্পর্কে জানা : প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ আমাদেরকে বিভিন্ন সভ্যতা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ থেকে আরও জানতে পারি সিন্ধু সভ্যতায় উন্নত নগর পরিকল্পনা ছিল, মানুষ শ্রেণি-পেশায় বিভক্ত ছিল, মেসোপটেমিয়া সভ্যতার হাম্বুরাবি আইন অনেক কঠোর ছিল প্রভৃতি। এভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ আমাদেরকে সভ্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে সাহায্য করে ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মানবসভ্যতার প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস পুনর্গঠন, সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন প্রভৃতির জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান অনেক প্রয়োজনীয় । প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ তাই যথাযথ উপায়ে সংরক্ষণে সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের সচেতন থাকতে হবে। তবেই ইতিহাসের প্রয়োজনার্থে আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহকে ব্যবহার করতে পারব ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]