ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহের কারণ

ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহের কারণ


১৮২০-৩৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাগলপন্থি সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে যে কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত হয় তা পাগলপন্থি বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের (১৮২০-৩৩ খ্রি.) চৌহদ্দি ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ, উত্তরে গারো পাহাড়রাজি এবং পূর্বে হাওড় এলাকা। অতীতে এ এলাকা ছিল সকল কেন্দ্রীয় সামন্ত শক্তির নিয়ন্ত্রণ মুক্ত। চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এখানকার আঞ্চলিক ক্ষুদ্র (Minor) রাজ্যগুলোর নেতৃত্বে ছিল গারো, কোচ, মেচ, হাজং, পাগলপন্থি সম্প্রদায়, আফগান, উত্তর-ভারতীয় ব্রাহ্মণ ও বিদ্রোহী মুঘল সৈন্যরা। এলাকাটির রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল এর আঞ্চলিক স্বাধীনতা। পাগলপন্থি বিদ্রোহের পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল।
উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে জমিদারি রাজনীতির মূল বিষয় ছিল অংশীদারিত্বের সংঘর্ষ। ১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দ হতে শরিকি সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। এ অঞ্চলে জমির সীমানা ঠিক ছিল না এবং তালুকের আনুপতিক হারও নির্দিষ্ট ছিল না। এ সুযোগে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী ও দলিল রক্ষকরা একদিকে জমিদারের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বাদী বিবাদীর সঙ্গে চক্রান্তের নানা সূত্র তৈরি করে, অন্য দিকে এরূপ বিবাদের সূত্র ধরে সরকার নিজের ক্ষমতা সুসংহত করে। শরিকি সংঘর্ষ শেষ হলে জমিদাররা স্বভাবতই কৃষকদের উপর তাদের দাবিদাওয়া বিধিবদ্ধ করতে উদ্যোগী হয়। যখন জমিদাররা রাজস্ব আদায়ে চেষ্টা করলো তখনই দেখলো যে, বেপরোয়া কৃষকরা জমিদারদের ততটা বাধ্যগত নয়। ফলে এলাকার শান্তি বজায় রাখা, নিয়মিত রাজস্ব আদায় হওয়া জমিদার ও সরকারের এই স্বার্থকে কৃষকদের স্বার্থের মুখোমুখি নিয়ে এলো।
এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল কৃষকদের উপর বাড়তি কর আরোপ করা। সাধারণত পরগণার হারের ভিত্তিতে আসল জমা নির্ধারিত হতো। এই জমার সাথে স্থানীয়ভাবে যুক্ত হতো সরঞ্জামি খরচ, দেশ খরচ, জমিদারি ব্যয়, টাকা প্রতি হারে আবওয়াব খরচ ইত্যাদি। ফলে আসল জমার সাথে এগুলো যুক্ত হয়ে কৃষকদের দেয় ধার্যের পরিমাণ বেড়ে যেত। অস্থায়ী ধার্যের সংখ্যাও ছিল অসংখ্য। ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষকরা এই সব অস্থায়ী কর সংগ্রহের বিরুদ্ধে ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে আপত্তি জানায়, যা শেষে বিদ্রোহে পরিণত হয়।
কৃষকদের উপর রাজস্ব বৃদ্ধির একটি কারণ ছিল শেরপুর ও আলাপ সিং পরগণার ইজারা বন্দোবস্ত। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে শেরপুরে মাজকুরী (বড়) তালুক ছিল এগারোটি। তবে জমিদারদের সৃষ্টি হুজরী (ছোট) তালুকের সংখ্যা ছিল ৩২৩ টি। এ সকল তালুকের ইজারাদাররা জমিদারদের সাথে গোপন চুক্তির ভিত্তিতে কৃষকদের নিকট হতে ত্রুটিপূর্ণ দলিলের নামে খাজনা আদায় করতো যার সাথে কৃষকদের কোনো পরিচয় ছিল না। এরূপ শোষণ কৃষককে বিদ্রোহী করে তোলে ।
১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তত হলে অত্র অঞ্চলের অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে কৃষকের উপর করের চাপ না কমে বরং বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত করারোপ চরমে ওঠে। এর সাথে যুক্ত হয় জমিদারের অত্যাচার, বল প্রয়োগ ও খামারে বেগার খাটা। পরিণামে কৃষক-জমিদার সম্পর্কের অবনতি ঘটে ।
১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ঔপনিবেশিক সরকারের সাম্রাজ্যবাদী নীতি উত্তর ময়মনসিংহের ঘটনাপ্রবাহের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এ সময়ে ব্রিটিশ ও বর্মী সাম্রাজ্যবাদ পরস্পরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা ব্রহ্মদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আসামে যুদ্ধের জন্য জামালপুর থেকে সুশং সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তা তৈরি, মাঝে নদী পারাপারে জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক নৌকা সরবরাহ করার জন্য সরকার শেরপুরের জমিদারদের নিকট নির্দেশ পাঠায়। এ নির্দেশ পালনে জমিদারশ্রেণি বল প্রয়োগে কৃষকদের বেগার খাটানো, পল্টনের খরচ ও রসদ বাবদ আবওয়াব কৃষকদের নিকট দাবি করে। এর প্রতিবাদে কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
পাগলপন্থি বিদ্রোহহের গুরুত্ব
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্ৰোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। সত্যনিষ্ঠা, সাম্য, মানবতাবাদ, ভাতৃত্ববোধ ছিল পাগলপন্থিদের ধর্মাদেশের মূল বিষয়বস্তু। তাদের মতে, সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি; কেউ কারো গোলাম নয়। তাই কেউ উঁচু, কেউ নিচু-এইরূপ ভেদাভেদ নেই। সকল মানুষ ভাই ভাই। এই মহান সাম্যের বাণী নিয়ে বঙ্গ-ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তারের ১৮ বছর পর ১৭৭৫ খ্রি. করিম শাহ নামক একজন মুসলমান ফকির ময়মনসিংহের সুসং পরগনায় আবির্ভূত হন। তিনি ছিলেন এ অঞ্চলের পাগলপন্থি ধর্মচেতনার প্রথম গুরু। তাঁর অনুসারি পাগলপন্থিরা ১৮২০ খ্রি. থেকে ১৮৩৩ খ্রি. ব্যাপী ময়মনসিংহ অঞ্চলে এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। নানাবিধ কারণে এ আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ : ময়মনসিংহ অঞ্চলে জমিদার- জোতদারদের শোষণ-নিপীড়নে জর্জরিত ছিল সেখানকার সমতলের বাসিন্দা মুসলমান, গারো পাহাড়ের প্রান্তস্থিত উপজাতীয় গারো, হাজং, হদি, ডালু, বানাই কৃষককুল। জমিদারদের চাপিয়ে দেওয়া নিবর্তনমূলক নানা নামের কর, আবওয়াব, মাথটে এই অঞ্চলের কৃষকগণ ছিলেন সর্বস্বান্তপ্রায়। একদিকে জুলুমবাজ অভিজাত জমিদার- জোতদার শ্রেণি, অন্যদিকে নিঃস্বপ্রায় কৃষক শ্রেণি। ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিদ্যমান প্রর্বতপ্রমাণ এই শ্রেণিবৈষম্য প্রপীড়িত সমাজে সাম্য ও সুবিচারের বাণী নিয়ে পাগলপন্থি আন্দোলন শুরু হয়। জমিদার-জোতদার শ্রেণির অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ ছিল প্রতিবাদী কণ্ঠ
২. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন : দীউয়ানি উত্তর যুগে (১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে) বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর অঞ্চলে জনগণের, বিশেষকরে কৃষক সমাজের উপর কোম্পানির রাজস্ব বিভাগের মুতসুদ্দি, কর্মকর্তা ও জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে পাগলপন্থিরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। সমকালীন অন্যান্য আন্দোলনের মতো এটি প্রকৃতিগতভাবে ছিল বিক্ষিপ্ত, সহজাত, অপরিকল্পিত, স্থানীয় ভূমি সংক্রান্ত এবং ধর্মীয়। প্রথম পর্যায়ে আন্দোলনটি পরিচালিত হয় জমিদারদের বিরুদ্ধে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এটি ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এ অঞ্চলে পাগলপন্থিরা ছিলেন ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারে অস্তিত্বের প্রশ্নে হুমকিস্বরূপ। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও পাগলাপন্থিরা এ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছিল ।
৩. শেরপুরে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা : জমিদাররা প্রজাদের নিকট থেকে জোরপূর্বক খাজনা আদায়ের চেষ্টা করলে জমিদারদের লেঠেল-বরকন্দাজদের সাথে গড়জরিপায় পাগলপন্থি বিদ্রোহীদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে জমিদারদের পরাজয় ঘটলে তাঁরা পলায়ন করে শেরপুর কালীগঞ্জে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ডেম্পিয়ারের কাচারিবাড়িতে সপরিবারে আশ্রয় নেয়। যুদ্ধে বিজয়ী পাগলপন্থি সাত'শ কৃষক বিদ্ৰোহী শেরপুর শহর দখল করে। বিদ্রোহী নেতারা শেরপুর শহরকে কেন্দ্র করে সেখানে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তাঁরা সেখানে বিচার ও শাসনব্যবস্থাও চালু করে। পাগল নেতা টিপু শাহ এ রাজ্য পরিচালনা করেন। যদিও এ রম্য দু'বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি।
৪. অন্যায় কর ও উৎপীড়নমূলক আইন প্রত্যাহার : করিম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র টিপু শাহ উত্তরাধিকারসূত্রে পাগলপন্থিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনের চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এটি কৃষক আন্দোলনের রূপ নেয়। পাগল ও তাদের সহযোগিগণ জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য জমিদার ও কোম্পানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অবশ্য ১৮৩৩ খ্রি. নাগাদ আন্দোলন বহুলাংশে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে এর পূর্বে কৃষকদের করুণ অবস্থা প্রশমনের ক্ষেত্রে এ আন্দোলন খানিকটা অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করে। অনেক অন্যায় কর ও উৎপীড়নমূলক আইন তুলে নেওয়া হয়। এতে এ আন্দোলনের গুরুত্ব প্রতীয়মান হয় ।
কোম্পানি শাসনের সাময়িক বিলুপ্তি : টিপু শাহের মৃত্যুর পর জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শক্ত আন্দোলন গড়ে তোলেন। দুদিক থেকে অগ্রসর হয়ে পাগলপন্থিগণ শেরপুর শহরে প্রবেশ করে জমিদার বাড়ি ও রাজস্ব অফিস লুট ও থানা দখল করে এবং থানার অস্ত্রশস্ত্র পুড়িয়ে দেয়। পাগলপন্থি বিদ্রোহীরা নিজেদেরকে এ অঞ্চলের শাসক হিসেবে ঘোষণা করে। জমিদার, সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ ময়মনসিংহ শহরে আশ্রয় নেয় । কিছু দিনের জন্য কোম্পানি শাসনের বিলুপ্তি ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয় ৷
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ময়মনসিংহ জেলার শেরপুরে পাগলপন্থিদের যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, তা পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়, শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল, কিন্তু পাগলপন্থিদের প্রতিরোধকে চিরতরে স্তব্দ করে দেওয়া যায়নি। পাগলপন্থিদের এ আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয় ।
ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহের সার্বিক বিশ্লেষণ
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্ৰোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। দৃশ্যত উত্তর ময়মনসিংহ ছিল বাংলার ইতিহাসের মূলধারা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। যুগ যুগ ধরে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীরা উক্ত এলাকায় এসে নিরাপদ আস্তানা স্থাপন করে। পাগলপন্থি সম্প্রদায় ছিল এদের মধ্যে একটি। করম শাহ নামক একজন পাঠান ছিলেন এ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে করম শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র টিপু শাহ গদিতে বসেন। তিনিও পিতার মতো কামেল পুরুষ এবং ভবিষ্যত প্রবক্তা ছিলেন বলে ভক্তরা মনে করতো। ভক্তদের বিশ্বাস ছিল যে, টিপু শাহ যা ইচ্ছা তাই করতে পারতেন। টিপুর এ ক্ষমতা ও যোগ্যতা তাকে কৃষককুলের নেতৃত্ব গ্রহণে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ারে (বৃহত্তম ময়মনসিংহ)টিপুকে কৃষক নেতারূপে অভিহিত করা হয়েছে। টিপুর নেতৃত্বে পাগলপন্থি সম্প্রদায় দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করে। টিপুর জীবন, তার ক্ষমতার মোহ, তার চরিত্র এসব কিছুই বিপ্লবের আবহ সৃষ্টি করে। সকলের আশাভরসার স্থল হয়ে ওঠেন টিপু শাহ। অচিরেই টিপুর ক্ষমতা ও নেতৃত্ব অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে সরকার টিপুকে একটি সন্দেহজনক চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। এ বিদ্রোহে পাগলপন্থিদের নেতৃত্ব দেবার কারণ ছিল মূলত কৃষক সমাজের সংগঠনের অনুপস্থিতি, শ্রেণিচেতনার অভাব এবং পাগলদের ক্রমবর্ধমান সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি । পাগলরা ছিল বিদ্রোহী সংগঠনের মূল শক্তি ।
পাগলপন্থি বিদ্রোহের প্রথম পর্ব ছিল ১৮২৪-২৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এ সময়ে বিদ্রোহী কৃষকদের সব দাবি ও চাহিদা একমুখী হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত করারোপ, বেগার প্রথা, ব্রহ্মযুদ্ধজনিত বিভিন্ন কর, রসদ সরবরাহ, পুলিশের অত্যাচার ও চাঁদা আদায়, এসবের স্থলে টিপু শাহ কর্তৃক পরিমিত রাজস্ব প্রদানের (প্রতি কোর জমির খাজনা ৪ আনা) প্রতিশ্রুতিতে কৃষক শ্রেণি পাগলপন্থিদের কর্মসূচিতে বিশ্বাস স্থাপন করে। আন্দোলনকারীরা গ্রামে গ্রামে প্রচার করে যে, ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান আসন্ন, জমিদারি-ক্ষমতা বিলপ্তির পথে এবং নতুন রাজত্বের প্রধান হবেন টিপু শাহ পাগল। টিপুর এসব প্রচারণায় কর্তৃপক্ষ নিজেদের বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর তাকে বন্দি করে। এতে বিদ্রোহের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। সরকার পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ ডিসেম্বর টিপুকে মুক্তি দেয়। টিপুর নামে রাজস্ব আদায় শুরু হয়। কার্যত টিপু শাহ সর্বসাধারণের নেতা নির্বাচিত হন। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ জানুয়ারি বিদ্রোহীরা শেরপুর শহর ও জমিদারদের স্থাপনাসমূহ আক্রমণ করে। তারা কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাবি তোলে যে, তারা জমিদারি অত্যাচার এবং শোষণ ও উৎপীড়ন মানতে রাজি নয়। ম্যাজিস্ট্রেট সব রকম বেগার, আবওয়াব ও বাড়তি খাজনা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে জমিদার তাদের সহায়ক বাহিনীর সাথে বিদ্রোহী কৃষক শ্রেণির প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ চলে। ইতোমধ্যে সরকার বুঝতে পারে যে, কৃষক শ্রেণির আন্দোলনের প্রধান কারণ অন্যায় ভূমিকর আরোপ এবং এ প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে। এর সমাধানকল্পে সরকার একটি সংক্ষিপ্ত তদন্ত শেষে নতুনভাবে খাজনার হার পুনঃনির্ধারণ করেন। কিন্তু পরিবর্তিত এই ব্যবস্থাতেও বিদ্রোহী কৃষকরা দুটি কারণে খুশি হতে পারেনি। প্রথমত; সরকারি তদন্তে নির্যাতিত কৃষকদের নিকট হতে কোনো প্রকার তথ্য নেওয়া হয়নি এবং দ্বিতীয়ত; বিদ্রোহে মৃত্যুবরণকারী কৃষকদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে কালেক্টরের নতুন বন্দোবস্ত ‘অষ্টম আইন' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই আইন অমান্য করে কৃষকরা জানকো পাথের ও দুবরাজ পাথেরের নেতৃত্বে পুনরায় বিদ্রোহ শুরু করে।

বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্বে বিদ্রোহীরা শেরপুর শহরে প্রবেশ করে জমিদার বাড়ি, কাছারি ও রাজস্ব অফিসসমূহ লুটপাট করে। তারা পুলিশ স্টেশন জ্বালিয়ে দেয়। বিদ্রোহীরা নিজেদের স্বরাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। জমিদার, পুলিশ, সরকারি কর্মচারীরা জেলা সদর ময়মনসিংহে আশ্রয় নেয়। অন্তত কিছু কাল মনে হয় যে, এখানে কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটেছে। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ১ এপ্রিল সরকারি বাহিনী শেরপুর শহর পুনর্দখল করে। সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার সশস্ত্র কৃষক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালায় এবং তাদের স্থাবর- অস্থাবর সম্পদের ক্ষতি সাধন করা হয়। সরকারের এধরনের ব্যবস্থার ফলে প্রজারা বিদ্রোহী পক্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ মে থেকে বিদ্রোহ স্থিমিত হয়ে পড়ে। এ পর্বে বিদ্রোহীরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাবি আদায়ের পন্থা অবলম্বন করে। তাদের পক্ষে দাবি আদায়ের জন্য উজির সরকারকে উকিল নিযুক্ত করে ময়মনসিংহে পাঠানো হয়। আদালতের লড়াইয়ে তাদের হাত শক্ত করার জন্য কলকাতা থেকেও একজন এটর্নি আনা হয়। এসময়ে লক্ষ করা যায়, কৃষকরা দাবি আদায়ে হিংসার পথ পরিহার করে আইন আদালতের আশ্রয় নেয়। বিগত দিনের চেয়ে কৃষক শ্রেণি এখন জমিদার ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সংলাপে বেশি সিদ্ধ হস্ত। সম্মিলিত চাঁদার মাধ্যমে কৃষকরা ময়মনসিংহ শহরে আইন লবি প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের পরও তারা সুসংগঠিত অবস্থায় সংঘবদ্ধভাবে আদালতের মাধ্যমে প্রতিরোধ চালিয়ে যায় ।
ময়মনসিংহ বিদ্রোহ কোনো প্রকার উপজাতীয় বা ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না। এ বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন সব ধর্মের ও বর্ণের। বিদ্রোহীদের সামাজিক পরিচয় ছিল এরা উপজাতীয়, নানা বর্ণের হিন্দু ও নানা পেশার মুসলমান। তারা গোষ্ঠী পরিচয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর হলেও সকলের রণভাষা ছিল বাংলা। তাদের ধর্ম কখনো সংগ্রামে কোনো ইস্যু তৈরি করেনি। তাদের বিদ্রোহের মতাদর্শ ছিল মূলত উৎপাদন সম্পর্কে ও শোষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিদ্রোহীরা সামাজিকভাবে মোটামুটি অভিন্ন ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষক ছিল বলে মনে করা হয়। খাজনার হার হ্রাস, অবৈধ কর ও বেগার প্রথার বিলোপ প্রভৃতি ক্ষুদ্র কৃষক শ্রেণিরই দাবি। পরিশেষে এটা বলা যায় যে, এই বিদ্রোহটি ছিল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রপুষ্ট জমিদারদের শোষণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে একটি গণআন্দোলন । এই বিদ্রোহের ফলে সরকার কৃষকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। সুতরাং প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]