উত্তর ভূমিকা : প্রতিটি বিষয়, বস্তু, দেশ ও জাতিকে তার একান্ত নিজস্ব কিছু বেশিষ্ট্য ও উপাদানের মাধ্যমে আলাদা করা যায়। ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যেমন কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে। ঠিক তেমনি ঐতিহাসিক, সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরও কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, যোগ্যতা বা গুণাবলি রয়েছে। একজন ঐতিহাসিকও এর বাইরে নন । ঐতিহাসিক হিসেবে যেকোনো ব্যক্তিকে অবশ্যই ইতিহাসবোধসম্পন্ন তথ্যানুরাগী ও উৎস অনুসন্ধানভিত্তিক ইত্যাদি গুণের অধিকারী হতে হবে ।
ঐতিহাসিক : যে শিল্পী মানব সভ্যতার যাবতীয় অতীত কর্ম বর্ণনার মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠভাবে লেখনীর দ্বারা বর্তমানে ফুটিয়ে তোলেন অর্থাৎ তিনি ঐতিহাসিক নামে পরিচিত এবং যে শিল্পী অতীতের যাবতীয় ঘটনাকে ইতিহাস নামক সুতোয় একত্রে গ্রোথিত করে বর্তমানের মধ্যে অতীতকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস পান তিনিই ঐতিহাসিক। যে গবেষক মানুষের অতীতকে নিয়ে সুসংবদ্ধভাবে জ্ঞানান্বেষণ করেন। অন্যভাবে বলা যায়, ইতিহাস বোধসম্পন্ন প্রতিটি ব্যক্তিই একজন ঐতিহাসিক এবং ইতিহাস রচয়িতাও একজন ঐতিহাসিক । মানুষের অতীত কর্ম সংশ্লিষ্ট উপাদান, উৎস ও তথ্যকে যথাযথভাবে যাচাইবাছাই করে সত্যকে নিরপেক্ষ ও সর্বজনীনভাবে লিখিত আকারে তুলে ধরার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি মাত্রই ঐতিহাসিক। আবার আত্মোপলব্ধিমূলক মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত সমাজ ও সভ্যতার অতীত সন্ধানী ব্যক্তি হলেন একজন ঐতিহাসিক একজন ঐতিহাসিক কার্যত একজন অতীতাশ্রয়ী গবেষক এবং মানুষের' অতীত কর্ম সংশ্লিষ্ট জ্ঞানতাপস। যিনি একান্ত মমত্ববোধ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের অতীত কর্মের অসীম সাগরে অবগাহন করে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রামাণ্য তথ্যের আলোকে নিরপেক্ষভাবে অতীতকে বর্তমানের মাঝে তুলে ধরেন তিনিই ঐতিহাসিক ।
একজন ঐতিহাসিকের যেসব যোগ্যতা থাকা দরকার : নিম্নে একজন ঐতিহাসিকের যেসব যোগ্যতা থাকা দরকার তা
আলোচনা করা হলো :
১. ইতিহাসবোধ : ইতিহাসবোধ একজন প্রকৃত ঐতিহাসিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ। জাতীয়তাবোধ যেভাবে একজন নাগরিককে খাঁটি দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলে, ঠিক তেমনিভাবে ইতিহাসবোধ একজন মানুষকে ইতিহাস প্রেমী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। কার্যত কোনো ব্যক্তির ইতিহাসবোধ না থাকলে তিনি ঐতিহাসিক হিসেবে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে পারেন না। ইতিহাসবোধহীন কোনো তথাকথিত ঐতিহাসিকের রচিত ইতিহাস পক্ষপাত দোষে দুষ্ট ও বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ।
২. ইতিহাসের উৎস ও তথ্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান : একজন ঐতিহাসিককে ইতিহাসের উপাদান, উৎস ও তথ্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনা করার স্বার্থে প্রাথমিক উৎস ও দ্বৈতয়িক উৎসের স্পষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে । তাছাড়া তথ্যানুরাগিতাকে ঐতিহাসিকের বিশেষ প্রয়োজনীয় গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় । ৩. তথ্য নির্মাণ : ইতিহাস উৎস নির্ভর। উৎস আবার তথ্যভিত্তিক এবং তথ্য তথ্যের নির্মাতাভিত্তিক । আর ইতিহাসের তথ্যের নির্মাতা একমাত্র ইতিহাসবিদ। তাই যথাযথ ইতিহাস রচনা করার জন্য শুধু সঠিক উৎস ও তথ্যের জ্ঞান থাকলেই হবে না । ঐতিহাসিককে ইতিহাসের উৎসের একজন দক্ষ নির্মাতা হিসেবে সমকালীন প্রেক্ষিত সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে ।
৪. অধ্যবসায় ও ত্যাগ : ঐতিহাসিককে অধ্যবসায়ী, ত্যাগী মানসিকতাসম্পন্ন এবং ধীরতা ও দৃঢ়তাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হবে। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং এজন্য অনেক ধৈর্য ও ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা পোষণ করতে হবে। ঐতিহাসিককে নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচনা করার জন্য ঠান্ডা মস্তিষ্কে, ধীরস্থিরভাবে এবং বলিষ্ঠ মনোবল নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
৫. আত্মসমালোচনার মানসিকতা : আত্মসমালোচনামূলক মানসিকতা একজন ঐতিহাসিকের একটি মহৎ গুণ বলে বিবেচিত হয়। তিনি যেমন অন্য ঐতিহাসিকের রচিত ইতিহাস অধ্যয়ন করে ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষতা মূল্যায়ন করে থাকেন, তদ্রুপ অন্য ঐতিহাসিকগণও তার রচিত ইতিহাস পড়ে নিরপেক্ষতার বিষয়টি যথার্থভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন ।
৬. অনুসন্ধিৎসু : অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিভঙ্গি একজন ঐতিহাসিকের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গুণাবলি। যথাযথ অনুসন্ধানমূলক মানসিকতা ও কার্যক্রম ছাড়া প্রামাণ্য ইতিহাস রচনা করা প্রায় অসম্ভব। অনুসন্ধিৎসুমূলক মানসিকতা ঐতিহাসিককে গবেষণাধর্মী করে তোলে । কারণ তিনি জানেন ও বুঝেন যে, অনুসন্ধিৎসার মাপকাঠিতে ঐতিহাসিক উৎসসমূহ গবেষণার দ্বারা পরিশুদ্ধ করে নিতে হয় ।
৭. আন্তর্জাতিক রীতিনীতি সম্পর্কে সচেতনতা : ইতিহাসবিদকে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি সম্পর্কে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে । অন্যথায় তার দ্বারা আন্তঃরাষ্ট্রীয় ইতিহাস রচনা বস্তুনিষ্ঠ হয়ে উঠবে না। এক্ষেত্রে আরও একটি গুণ ঐতিহাসিকের অর্জন করতে হয়, তা হলো আন্তর্জাতিক ভাষাজ্ঞান সংশ্লিষ্ট দক্ষতা। ঐতিহাসিক যথেষ্ট দক্ষ ও অভিজ্ঞ না হলে সহজ কৌশলেও সাবলীল ভাষায় ইতিহাস রচনা করতে ব্যর্থ হন ।
৮. সমকালীন জ্ঞানের অধিকারী : সমকালীন সার্বিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া ঐতিহাসিকের একান্ত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। ইতিহাসবিদ যে সময়ের ইতিহাস রচনা করবেন তাকে ঐ সময়কার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে। সমকালীন জ্ঞানের অধিকারী ঐতিহাসিক দ্বারাই শুধুমাত্র ধারাবাহিকতা ও সময়ানুক্রম অনুযায়ী ইতিহাস রচনা সম্ভব।
৯. সাহসিকতা : সাহসিকতা ঐতিহাসিকের অন্যতম গুণ। কারণ তাকে সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমে নির্ভুল ইতিহাস তুলে ধরতে হবে । রাজনৈতিক প্রশাসক এবং দলীয় প্রভাব ও চাপের ঊর্ধ্বে ওঠে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে ঐতিহাসিককে নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা করতে হবে। উল্লেখ্য, মধ্যযুগে রাজাশ্রিত ও রাজদরবারকেন্দ্রিক ঐতিহাসিকগণ রাজদণ্ডের ভয়ে নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনায় অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছেন ।
১০. ন্যায়নিষ্ঠতা : ন্যায়নিষ্ঠতা ঐতিহাসিকের একটি বড় মানদণ্ড। তিনি অবশ্যই সব বিষয় ও ঘটনাকে নৈতিক মানদণ্ড মোতাবেক বিচারবিশ্লেষণ করেন। তিনি যখন ইতিহাসের কোনো উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন তখন তিনি ঐসব পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্রের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অতএব একজন ন্যায়নিষ্ঠ বিচারকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি ইতিহাসের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবেন এমনটাই প্রত্যাশা থাকে। তার ব্যক্তিগত লাভের প্রতি কোনো মোহ থাকবে না। কারণ ন্যায়নিষ্ঠাহীন ভাবাবেগ ও মোহাচ্ছন্নতায় আবদ্ধ থেকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনা সম্পূর্ণই অসম্ভব ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ঐতিহাসিকের উন্নতমানের দক্ষতা ও যোগ্যতা ইতিহাস জ্ঞানকেও উন্নত ও সমৃদ্ধ করে। ঐতিহাসিক একটি মহৎ দায়িত্ব নিয়ে দেশের সর্বস্তরের জনগণের জন্য ইতিহাস রচনায় প্রয়াসী হন। ইতিহাস শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের ইতিহাস অনুরাগীর মনের খোরাক মিটানোর জন্য বস্তুনিষ্ঠ, সর্বজনীন ইতিহাস রচনা করতে হবে। এজন্য ঐতিহাসিককে যথেষ্ট দক্ষতা, যোগ্যতা ও নানাবিধ গুণসম্পন্ন হতে হবে। একজন ঐতিহাসিকের চেষ্টা থাকবে সর্বোচ্চ সংখ্যক গুণাগুণ নিজের মধ্যে রপ্ত করা ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত