উত্তর ভূমিকা : ইতিহাসের ইংরেজি প্রতিশব্দ History, যা গ্রিক শব্দ Historia ( অনুসন্ধান) থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। Historia শব্দের যথার্থ অর্থ হলো সত্যপ্রকাশ করার উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পিত অনুসন্ধান। এই পরিকল্পিত অনুসন্ধানের ভিত্তিতে যখন ইতিহাস রচিত হয় তখন ইতিহাস লেখনে লেখকের কিছু দৃষ্টিভঙ্গি জোরালোভাবে প্রভাব ফেলে। ইতিহাস লেখনে লেখককে অবশ্যই উৎসের অনুসন্ধান, উৎসের সঠিকতা নির্ণয় ও সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াতে ইতিহাস লেখন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। যার ফলে ইতিহাস একটি প্রাণবন্ত রচনা বা শিল্পকর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিহাসের সংজ্ঞা : ইতিহাস কী তা এককথায় বলা কঠিন। কারণ অনেক পণ্ডিতই ইতিহাস বিষয়ে নিজেদের মতো করে মত দিয়েছেন । তাই সহজেই একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় পৌছা যায় না। তবে পণ্ডিতগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতসমূহ বিশ্লেষণ করে ইতিহাসের একটি সাধারণ সংজ্ঞা তৈরি করা সম্ভব। অতীতে যা কিছু ঘটেছে সাধারণভাবে তাকেই ইতিহাস বলা হয় । কিন্তু অতীতের সবকিছুকেই ঢালাওভাবে ইতিহাস বলা যায় না। শুধুমাত্র অতীতের যেসব ঘটনাপ্রবাহ মানুষের দ্বারা নির্মিত ও সংঘটিত বলে জানা যায় তার সত্যনিষ্ঠ লিখিত বিবরণকেই ইতিহাস বলা যায় ।
এ পর্যন্ত বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা নিম্নে
দেওয়া হলো :
ইতিহাসের জনক গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস ( Herodotus ) বলেন, “ইতিহাস হলো অতীত ঘটনার সত্য ও সুন্দর বর্ণনা ।
ঐতিহাসিক আর. জি. কলিংউড (R. G. Collingwood) এর মতে, “অতীত শুধু অতীত বলেই ইতিহাসের বিষয়বস্তু নয়; বরং সেই অতীতই ইতিহাস যার সাক্ষ্য প্রমাণাদি আমাদের হাতে আছে।'
(V. D. Ghate) এর মতে, “ইতিহাস হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত পাঠ এবং মানবজাতির সম্পূর্ণ অতীতের একটি জীবন্ত প্রমাণ চিত্র।"
এইচ কার (E. H. Carr) বলেন, “ইতিহাস কী এ প্রশ্নের জবাবে আমার প্রথম বক্তব্য এটা ঐতিহাসিক ও তথ্যউপাত্তের মধ্যকার নিরবচ্ছিন্ন ক্রিয়া প্রক্রিয়া এবং বর্তমান ও অতীতের মধ্যে এক অন্তহীন সংলাপ ।”
ঐতিহাসিকের ইতিহাস রচনা পদ্ধতি : জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো ইতিহাস চর্চারও নিজস্ব গবেষণা ও রচনা পদ্ধতি বিদ্যমান। সাধারণভাবে বলা হয়, সাক্ষ্য বা প্রামাণিক তথ্যের বিচারবিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে ঐতিহাসিক ইতিহাস রচনায় মনোনিবেশ করেন। তথ্যের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্পর্কিত জটিলতার নিরিখে ঐতিহাসিকগণ যথোপযোগী বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস লেখন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন। বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস প্রণয়ণের লক্ষ্যে সবাইকে যথাযথভাবে এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয় । নিম্নে ইতিহাস রচনার দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ আলোকপাত করা হলো :
১. উৎসের অনুসন্ধান : ইতিহাস লেখার সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উৎসের অনুসন্ধানকে বিবেচনায় নিতে হয়। ইতিহাস উৎসভিত্তিক । উৎস ছাড়া ইতিহাস রচনা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ইতিহাসের উৎসও আবার বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে । যেমন— ক. পুরানো নিদর্শনসমূহ যেমন জীবাশ্ম, হাড়গোড়, যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র, আসবাবপত্র, সৌধমালা ইত্যাদি ।
খ. মৌখিকভাবে হস্তান্তরিত বিশ্বাস বা প্রথাসমূহ যেমন— অতিকথন, রূপকথা, কাহিনিমালা, পালাগান ইত্যাদি ।
গ. ছবিভিত্তিক উপাত্ত যেমন— নকশা, মানচিত্র ইত্যাদি ।
ঘ. লিখিত বিবরণসমূহ যার মধ্যে অতিপ্রাচীন পাণ্ডুলিপি থেকে আরাম্ভ করে সকল সন্ধি, যুক্তি, দিনলিপি, পুস্তক ও
সংবাদপত্রও অন্তর্ভুক্ত আছে ।
২. ঐতিহাসিক তথ্যবিষয়ক সিদ্ধান্তগ্রহণ : উৎসের জোগাড়কার্য সম্পন্ন করার পর ইতিহাস লেখকের পালনীয় দ্বিতীয় পদক্ষেপ হলো জোগাড়কৃত উৎসরাজি থেকে প্রকৃত তথ্য খুঁজে বের করা বা তথ্যবিষয়ক কোনো সিদ্ধান্তগ্রহণ করা। এ প্রক্রিয়ার অংশ দুটি— ক. বাহ্যিক সমালোচনা ও খ. অভ্যন্তরীণ সমালোচনা ।
ক. বাহ্যিক সমালোচনা : বাহ্যিক সমালোচনা উৎসের সঠিকতা ও মৌলিকত্ব পরিমাপণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। এ সমালোচনার মাধ্যমে উৎসের ভিতর কোনো জালিয়াতি, ভাঁওতাবাজি বা দূষণীয় কোনো উপাদান ইত্যাদি থাকলে তা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয় ৷
খ. অভ্যন্তরীণ সমালোচনা : উৎস বিশ্লেষণে সমালোচনার দ্বিতীয় ধাপ হলো অভ্যন্তরীণ সমালোচনা। লিখিত উপাত্তের মূল্যায়নে ইতিহাস লেখককে সবসময় উৎস প্রণেতার দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবাদর্শ ও প্রেষণা সম্বন্ধে নিশ্চিত থাকতে হবে এবং বর্ণিত বক্তব্য সঠিক কি না তা যথাসম্ভব যাচাইবাছাই করতে হবে। এজন্য গবেষণাধীন জনগোষ্ঠীর ধ্যানধারণা, যুগ, ধর্ম, উৎসের ভাষা ইত্যাদি ইতিহাস লেখকের আয়ত্তে আনার জন্য উৎসের অভ্যন্তরীণ সমালোচনা কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে হবে। সরকারি নথিপত্রের বেলায়ও ঠিক একই কথা প্রযোজ্য। সরকার সম্পর্কিত বিষয় গোপনে ও কিছু বিষয় প্রকাশ্যে করার প্রবণতা বেশ প্রকটভাবে লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে সরকার যখন কোনো বিষয়ে স্বীয় অবস্থান ব্যাখ্যা বা বৈদেশিক নীতি পরিবর্তনের যথার্থতা বা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তা প্রমাণের জন্য দলিলাদি জনসম্মুখে প্রকাশ করে তখন ব্যাপারটি প্রকটভাবে দেখা যায়। যে কারণে উৎসের অভ্যন্তরীণ সমালোচনার মাধ্যমে সঠিক তথ্য বের করে আনা ঐতিহাসিকের গুরুদায়িত্ব হয়ে পড়ে ।
৩. সংশ্লেষণ : ইতিহাস লিখন পদ্ধতির শেষ পদক্ষেপ হলো সংশ্লেষণ। গবেষণাধীন বিষয়ের ওপর উৎস জোগাড় এবং উৎসের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও সমালোচনার পর বিপুল তথ্যের পাহাড় সৃষ্টি হয়। ঐতিহাসিকের পক্ষে এসব তথ্য ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয় না। এ শেষ ধাপে ইতিহাস লেখককে তার বিষয়ের সাথে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলি বাছাই করতে হয়। তথ্যের নির্বাচন তথা গ্রহণ বর্জনের এ পর্যায়টি খুবই স্পর্শকাতর এবং এতে ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে আত্মবাদী ধারণার ব্যাপক প্রাধান্যই প্রকাশ পায়। গবেষণাধীন বিষয় যত জটিল, ব্যাপক ও বিস্তৃত হবে ইতিহাস লেখকের পক্ষে গ্রহণ বর্জনের পালাও তত কঠিন হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানব সভ্যতার অতীত কর্মের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণই ইতিহাস । আর এই ইতিহাস লেখনে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি বা ইতিহাস লেখন পদ্ধতি বেশ দরকারি। যথাযথ পদ্ধতিতে না লেখলে ইতিহাসের তথ্য প্রাণহীন উপন্যাসের মতো হয়ে পড়ে। তখন ইতিহাস হয়ে পড়ে মূল্যহীন, যে ইতিহাস পাঠ করে কোনো তথ্য উৎঘাটন করা সম্ভব হয় না। আর তাই সব ভুলভ্রান্তি এড়িয়ে যথার্থ প্রক্রিয়াতে ইতিহাস রচনা ঐতিহাসিকের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত