ইতিহাসের কার্যকারণ বিশ্লেষণ কর ।

উত্তর ভূমিকা : পৃথিবীর প্রতিটি ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পিছনে কোনো না কোনো কারণ নিহিত থাকে । তাছাড়া মানব সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও পতনের পিছনেও নানাবিধ কারণ বিদ্যমান থাকে। বস্তুত কারণ ছাড়া কোনো কার্য সংঘটিত হয় না এবং হওয়া সম্ভবও নয়। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, কারণ কোনো একটি বিষয় বা ঘটনার জন্য একটি চরম সত্য প্রেক্ষিত হিসেবে বিবেচিত । ইতিহাসের কার্যকারণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সত্য ঘটনা উদ্ধারের চেষ্টা করা হয় ।
ইতিহাসের কার্যকারণ বিশ্লেষণ : ঐতিহাসিক কার্য সম্পন্ন বা সংঘটিত হওয়ার যথার্থ পটভূমিই হলো কার্যকারণ। কোনো চুক্তি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, যুদ্ধবিগ্রহ, নির্মাণ, ধ্বংস ও পতনকে অনিবার্য করে তোলার পিছনে তাড়নামূলক দিককেও কার্যকারণ বলে বিবেচনা করা যায়। সুতরাং সহজভাবে বলা যায়, কোনো কার্যক্রম সংঘটিত হওয়ার পেক্ষাপট হলো ঐ কার্যক্রমের কার্যকারণ। নিম্নে ইতিহাসের কার্যকারণ বিশ্লেষণ করা হলো :
১. কার্যকারণ নির্ণয় : একজন আদর্শ ঐতিহাসিকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো কোনো ঘটনার সমসাময়িক প্রেক্ষিত যথাযথভাবে অনুধাবন করে ঐ ঘটনার প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করা। আপাতদৃষ্টিতে যা দেখা যায় ও বুঝা যায় তা হয়তো কোনো ঘটনার দৃশ্যমান কারণ বা বোধগম্য কারণ। বিদ্যমান এসব কারণ ছাড়াও ঐতিহাসিকের দায়িত্ব হলো ঐ একই ঘটনার দৃশ্যমান ও বোধগম্য কারণের অনেক পিছনের এবং অনেক গভীরের নিহিত কারণ অনুসন্ধান করা। অর্থাৎ কোনো ঘটনা বা কারণগুলোর পিছনের কারণগুলো ঐতিহাসিকগণ খুঁজে বের করবেন। এক্ষেত্রে তাকে ঘটনার যথার্থ কারণ খুঁজে বের করার জন্য প্রশ্নের পর প্রশ্ন তথা অবিরত প্রশ্ন করতে হবে। যেমন— ঐতিহাসিককে জানার চেষ্টা করতে হবে এবং প্রশ্ন করতে হবে কোন ঘটনা কীভাবে, কেন ঘটল, সম্ভাব্য কী কী কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে, সত্যিকার অর্থে কী ঘটনা ঘটেছিল, কাদের দ্বারা, কোন স্থানে ঘটনা ঘটেছিল, ঘটনার ফলাফল কী ছিল, ইত্যাদি। এমনি প্রশ্ন দ্বারা জর্জরিত করে ঐতিহাসিককে উত্তরের পাহাড় গড়ে তুলতে হবে ।
২. কার্যকারণ নির্ণয় প্রক্রিয়া : ঐতিহাসিক কোনো ঘটনার কার্যকারণ নির্ণয়ের জন্য হাজারো প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন। এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত কার্যকারণ নির্ণয় সম্ভব হয় না। এভাবে প্রাপ্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর থেকে প্রকৃত কারণ তথা প্রকৃত উত্তরটি নির্ণয়ের জন্য ঐতিহাসিককে পর্যাপ্ত বিচারবিশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এভাবে অসংখ্য তথ্য থেকে সঠিক রূপে বাছাইকৃত তথ্যগুলোকে নিয়ে ঐতিহাসিক যথার্থ বিচারবিশ্লেষণের মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনা করেন । তাহলে ইতিহাসের কার্যকারণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকের পক্ষে সঠিক তথ্য জানা সম্ভবপর হবে। পরীক্ষানিরীক্ষা, গবেষণা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ সঠিক তথ্য অনুসন্ধানের যত রকম পন্থা আছে সব পন্থা অবলম্বন করে হলেও ঐতিহাসিককে ঘটনার বাহ্যিককরণ ও অন্তর্নিহিত রহস্য উদঘাটন করতে হবে। তাহলেই ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটন করা সম্ভবপর হবে যা হবে সত্যিকার অর্থেই ইতিহাসের কার্যকারণ ।
আবার ঐতিহাসিক কোনো বিষয় বা ঘটনার শুধু একটি মাত্র কারণ খুঁজে বের করেই ক্ষান্ত থাকবেন না। প্রকৃতপক্ষে, ঘটনার যথাযথ কারণ খুঁজে বের করার জন্য ঐতিহাসিককে নানাভাবে বহুমাত্রিক প্রশ্ন করার মাধ্যমে একই ঘটনার সার্বিক প্রেক্ষিত নিয়ে উত্তরগুলোকে গুরুত্বানুসারে সাজাতে হবে। যেমন— বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুধু রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক কারণ অনুসন্ধান করলেই হবে না। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বা অন্য কোনো কারণ থাকলে সেগুলোকে গুরুত্বানুসারে ক্রমানুযায়ী সাজাতে হবে ।
৩. কার্যকারণের উপযোগিতা : ঘটনার সঠিক কার্যকারণ ইতিহাসের প্রধান অঙ্গ। ইতিহাসের গতিময়তাকে স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রবাহমান এবং নির্ভেজাল রাখতে সঠিক কার্যকারণ প্রক্রিয়ার অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কার্যকারণ প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের গলদ থাকলে তা ইতিহাসকে কলুষিত ও বিতর্কিত করে। কার্যকারণের ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদকে যথাসম্ভব নৈর্ব্যক্তিকতা অনুসরণ করতে হবে। এর মাধ্যমে তিনি ঘটনার সঠিক কার্যকারণ নির্ণয় করে একজন ঐতিহাসিক প্রকৃত ইতিহাস চর্চায় আত্মনিয়োগ করতে পারবেন ।
৪. ইতিহাসের কার্যকারণ নিয়ে ঐতিহাসিকগণের অভিমত : ইতিহাসে কার্যকারণ যে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঐতিহাসিকগণের রচনা থেকেই। ঐতিহাসিকগণের মধ্যে হেরোডোটাস তার 'History of the Greaco-Persian War' গ্রন্থে গ্রিক ও পারসিকদের মধ্যকার যুদ্ধের কারণ তুলে ধরে কার্যকারণের ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেন । বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু হেরোডোটাসের মতো ঘটনার কার্যকারণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ The Spirit of Laws' এ কার্যকারণ সম্পর্কিত প্রত্যয়টি তিনি আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। দার্শনিক মন্টেস্কুর মতে, নিয়তি বা প্রকৃতি মানুষের কর্মকাণ্ডের দৃশ্যমান ফলাফল তৈরি করেছে এমন মনে করা একবারেই ঠিক নয়। তার মতে, যা কিছুই ঘটুক তার পিছনে অবশ্যই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ এবং নৈতিক বা বাস্তব কারণ বিদ্যমান থাকে। দার্শনিক ভলতেয়ারের মতে, ইতিহাসের কারণ প্রকৃতপক্ষে বিশ্লেষিত না হলে তা পরিপূর্ণ ইতিহাস রূপে বিবেচিত হয় না। তিনি আরও বলেন ইতিহাসের পটভূমি তথা কারণ যথাযথভাবে খুঁজে বের করতে না পারলে সে ইতিহাস মানব সমাজের হিত সাধনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় । অতএব, কার্যকারণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে ইতিহাসকে ফলস ও পরিপূর্ণ করে তোলা সম্ভব ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কার্যকারণ ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রকৃতপক্ষে, এটি একটি বিশ্লেষণী প্রক্রিয়া। ঘটনার সঠিক কার্যকারণের মাধ্যমে ইতিহাস বোধগম্য ও বিশ্লেষণী বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকে । সত্য ঘটনার পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সম্পর্কের প্রতিফলন হিসেবে ইতিহাসের কার্যাকারণ নির্ণয় করা সব থেকে যুক্তিযুক্ত । আর কার্যকারণে ইতিহাসবিদের দক্ষতার ওপরই ইতিহাসের সফলতা ব্যর্থতা নির্ভর করবে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]