প্রগতিবাদ কাকে বলে? ইতিহাস দর্শনে প্রগতিবাদের গুরুত্ব বিশ্লেষণ কর ।

উত্তর ভূমিকা : সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের সামাজিক অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক কালের গুহাবাসী মানব সম্প্রদায় বাসস্থানের জন্য আজ বিশাল বিশাল মনোরঞ্জক অট্টালিকা নির্মাণ করেছে। সমাজ ও সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে নানা প্রকারের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ব্যাপক উৎকর্ষ সাধন করেছে। এককালে মানুষ একমাত্র নির্ভর করতো পেশি শক্তির ওপর। আজ সেখানে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রিক ও হাইড্রোলিক যন্ত্র । যা দিয়ে মানুষ অনেক অসাধ্য কাজও সাধন করতে পারছে মুহূর্তের মধ্যে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে উত্তরাধুনিক সময়কাল পর্যন্ত মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞান ও জীবনযাত্রার প্রভৃত ইতিবাচক অগ্রগতিকে এককথায় প্রগতি বলা যায় । প্রগতিবাদ : প্রগতি অর্থ Change in desirable direction. অর্থাৎ আনন্দজনক বা মনোরম পরিবর্তনকেই প্রগতি বলা হয় । প্রগতিবাদের প্রধান কথা হচ্ছে মানবিক প্রচেষ্টার দ্বারা মানুষের অবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধন করা। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানবজাতির নিরন্তর প্রগতির সাক্ষ্য দেয় ইতিহাস। এতে দেখা যায়, স্বীয় কর্ম প্রচেষ্টার দ্বারা মানুষ ধীরে ধীরে পূর্বাপেক্ষা সুখী জীবনের দিকে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু বিজ্ঞানকে মাধ্যম করে মানুষ পরিবেশ ও । প্রকৃতির ওপর পূর্বাপেক্ষা অধিকতর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে, সেহেতু ভবিষ্যতে মানব সম্প্রদায়ের নৈতিক ও জাগতিক উন্নতি অবশ্যম্ভাবী। এটিই প্রগতিবাদের মূল বক্তব্য
● ইতিহাস চর্চায় প্রগতিবাদের মূল্যায়ন : বিগত এক শতাব্দীরও কিছু বেশি সময়ের মধ্যে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মানুষের অবদানের ফলে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন গঠিত হয়েছে, জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এর ফলে আজ আমরা জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎকর্ষের জগতে বাস করতে পারছি। প্রগতিবাদ আমাদেরকে আমাদের পূর্বপুরুষগণের অবদান তাদের কর্মস্পৃহা, সফলতা, ব্যর্থতা প্রভৃতি সম্পর্কে জানায় ।
প্রগতিবাদের শুরু হয় সপ্তদশ শতকে। তবে এর সমৃদ্ধি ও বিকাশ লাভ করে আঠারো শতকে। কেননা এসময় রেনেসাঁর প্রভাবে জ্ঞানের সব শাখাই উত্তরোত্তর উন্নতির মাধ্যমে আধুনিকীরণের দিকে ধাবিত হয়। নিম্নে ইতিহাস চর্চায় প্রগতিবাদের । মূল্যায়ন কয়েকজন ঐতিহাসিকের অবদানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হলো :
১. কোঁদোর্সে : ফরাসি দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ কোঁদোর্সে ছিলেন প্রগতিবাদের অন্যতম প্রবক্তা। তিনি তার 'Outlines of Historical View of the Progress of the Human Mind' গ্রন্থে প্রগতিসংক্রান্ত ধারণা উপস্থাপন করেন । ঐতিহাসিক যুগের পর আগত সমাজসমূহে মানবীয় ক্ষমতার ক্রমোন্নতির পরিচয় দিয়ে পরিবর্তনের মধ্যে বিদ্যমান শৃঙ্খলে উন্মোচন করা কোদেসের লক্ষ্য ছিল। এ সুশৃঙ্খল প্রগতির স্বাভাবিক লক্ষ্য হচ্ছে জ্ঞানের এবং সে সূত্রে সুখের সম্পূর্ণতা প্রগতির প্রাকৃতিক বিধানে মানুষের নিজের অবদানও বিদ্যমান থাকে। তার ইচ্ছে প্রগতিকে নিজের অনুকূলে আনা এবং তাকে যথাসম্ভব বাড়িয়ে তোলা। মানুষের এ প্রগতির নির্দিষ্ট কোনো সীমা নেই। পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে এবং বিশ্ব বিধানের যদি বড় ধরনের কোনো নড়চড় না হয় তাহলে আরও নিশ্চিত আশা করতে পারি যে ভবিষ্যতে জ্ঞানে, গুণে ও স্বাধীনতায় মানব সম্প্রদায়ের প্রগতি দীর্ঘকাল পর্যন্ত চলমান থাকবে। এমনকি মানুষের আরও উন্নতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অভূতপূর্ব বিকাশ লক্ষ করা যাবে।
২. তুর্গো : প্রগতিবাদের আরেকজন প্রবক্তা ফরাসি চিন্তাবিদ তুর্গো। তার মতে, এক যান্ত্রিক প্রগতির একক ও সরলরৈখিক নীতিই ইতিহাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে । অর্থাৎ ইতিহাস হচ্ছে একটি সরলরেখার মতো। সরলরেখার গতির মতো ইতিহাসের গতি সদা সর্বদা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও কখনও কখনও সাময়িক অবক্ষয়ের দ্বারা এ গতি ব্যাহত হতে দেখা যায়, তবে সামগ্রিকভাবে ইতিহাস মানবজাতির বস্তুগত ও মানসিক উন্নতিরই কাহিনি প্রকাশ করে থাকে । এই প্রগতি মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে অধিক থেকে অধিকতর পরিপূর্ণতার দিকে ।
৩. ইমানুয়েল কান্ট : জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ইতিহাস দর্শনে এক ধরনের প্রগতিবাদের অবতারণা করেছিলেন। তিনি তার 'Idea of a Universal History' গ্রন্থে বলেছেন যে, ইতিহাসকে যদি উন্নতর অবস্থার দিকে নিরন্তর প্রবাহমান একটি গতি হিসেবে দেখা যায় তবেই তার অর্থ প্রগতির সাথে যথাযথভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারে। ব্যক্তি জীবনে হয়ত কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাবলি প্রগতির পরিবর্তে অধোগতি এমনকি ধ্বংস বয়ে আনতে পারে। কিন্তু সমগ্র মানবজাতির ক্ষেত্রে ইতিহাস পরিণামে মঙ্গলই বয়ে আনে। কান্টীয় ইতিহাস দর্শন অনুযায়ী সৃজনশীল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থেকে প্রগতির সূচনা ঘটে এবং সমষ্টিগত স্বার্থ থেকে শৃঙ্খলার ধারণা আসে। আর এ প্রগতি ও শৃঙ্খলার সামষ্টিক রূপ হলো সভ্যতা। আর এভাবেই মানুষের ইতিহাসে প্রগতিবাদের একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে বলে কান্ট মনে করেন ।
উনিশ শতকে প্রগতিবাদ : আঠারো শতকের প্রগতিবাদের প্রভাবে ঊনিশ শতকে প্রগতিবাদের চর্চা দার্শনিকদের মাঝে পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে। যেসব মানবীয় ঘটনা ঊনিশ শতকের আধুনিক প্রগতিবাদের ধারক ও বাহক সেগুলোর মধ্যে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব ছিল অন্যতম । এসময়ের প্রগতিবাদের চর্চাকারীদের মধ্যে দার্শনিক পিয়ের জোসেফ ছিলেন উল্লেখযোগ্য । তিনি খ্রিস্টানধর্মের বিকল্প হিসেবে প্রগতিবাদকে দাঁড় করান। তিনি প্রগতিবাদকে মানুষের একমাত্র উপাস্য বলে প্রচারও করেন। তিনি জোরালোভাবে বলেন, ঈশ্বর সভ্যতা, স্বাধীনতা, প্রগতি, মানবতা ও আধুনিকতা প্রভৃতির শত্রু । প্রতিনিয়ত ঈশ্বরকে আমাদের চেতনা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে আমরা প্রগতি লাভ করতে পারি ।
'প্রকৃতিবিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের 'Origin of Species' নামক যুগান্তকারী গ্রন্থেও প্রগতিবাদের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাছাড়া সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোৎ এর রচনা ও কর্মেও প্রগতিবাদ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার লক্ষণীয় ছিল। যার মাধ্যমে তিনি মানবসমাজের উন্নতির পরিমাপ করতেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রগতিবাদ মানুষের আর্থসামাজিক কিংবা সংস্কৃতির অবস্থার উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত এবং ইতিহাস চর্চায় প্রগতিবাদ আসলেই একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ সব উন্নয়ন, সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়েই এ প্রগতিবাদের ইতিহাস। যা আগামী সময়গুলোতেও বিদ্যমান থাকবে এবং মানব সভ্যতার ক্রমাগত উন্নয়নের বিবরণ যুক্ত করে সমৃদ্ধ ইতিহাস রচনায় প্রয়াস পাবে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]