ইতিহাস চর্চায় নৈর্ব্যক্তিকতা সম্ভব কী? এর সমস্যা ও সমাধানের উপায় আলোচনা কর

উত্তর ভূমিকা : ঐতিহাসিক কর্তৃক রচিত বস্তুনিষ্ঠ ও সুসংহত লিখিত বিবরণ হলো ইতিহাস । ঐতিহাসিক যে উপাদান ও উপকরণের সাহায্যে ইতিহাস রচনা করেন তা হলো ইতিহাসের তথ্য। ঐতিহাসিকের এ তথ্য নির্বাচন প্রক্রিয়া অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। আলোচনা সমালোচনা, উপযুক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঐতিহাসিককে নিরেট ও নির্ভেজাল ঐতিহাসিক সত্য বের করে আনতে হয়। আর এ ধরনের চর্চায় লেখকের নৈর্ব্যক্তিকতাই সবচেয়ে বড় গুণ বলে প্রতীয়মান হয় যা ঐতিহাসকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে।
ইতিহাস চর্চায় নৈর্ব্যক্তিকতার পরিমাণ : ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিকতা বলতে এমন একটি প্রত্যয়কে বুঝায় যেখানে গবেষণার ফলে প্রাপ্ত ফলাফলের হুবহু ইতিহাসের পাঠ্য হিসেবে সংযোজিত হয়। এখানে ইতিহাসবিদের ব্যক্তিগত মতবাদ প্রকাশের কোনো সুযোগ থাকে না। আবার ইতিহাসবিদের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ ইতিহাসে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। ইতিহাসকে বস্তুনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদের নৈর্ব্যক্তিকতা ইতিহাসকে নিরপেক্ষ ইতিহাস রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। আর এজন্য এ গুণটি ইতিহাসবিদের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন। কিন্তু এর বিপরীতে দেখা যায় যে, ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে নৈর্ব্যক্তিকতাকে পুরোপুরি মেনে চলতে সক্ষম হন না; বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারাই তাড়িত হন। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, ঐতিহাসিকগণ যে পরিবেশে বেড়ে উঠেন তাতে তার ব্যক্তিগত জীবনে পরিবেশ কিছুটা হলেও প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এসব সত্ত্বেও ঐতিহাসিককে নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার ব্যাপারে যথাসম্ভব আন্তরিক থাকা উচিত। কেননা এরূপে প্রত্যেকে যদি তার স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাস রচনা করেন তাহলে ইতিহাস তার বস্তুনিষ্ঠতা হারাবে এবং পাঠকের নিকট আবেদনহীন হয়ে পড়বে। আর এজন্যই ঐতিহাসিকের মধ্যে নৈর্ব্যক্তিকতা থাকতে হবে। নিজস্ব ধ্যানধারণার মিশ্রিত ইতিহাস রচনা থেকে অতিসত্বর সরে আসতে হবে। ইতিহাসবিদের নৈর্ব্যক্তিকতা প্রশ্নে E. H. Carr বলেন, “ইতিহাসে নৈর্ব্যক্তিকতা থাকা সম্ভব এবং সত্যিকারের ইতিহাস হতে হলে তাকে নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে।'
" ইতিহাসে নৈর্ব্যক্তিকতার সমস্যা ও সমাধানের উপায় : ইতিহাসে নৈর্ব্যক্তিকতার পরিমাণ নির্ধারণে কিছু সমস্যা ও সমাধানের উপায় রয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ক. ইতিহাসে নৈর্ব্যক্তিকতার সমস্যা : ইতিহাসের রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদের নৈর্ব্যক্তিকতা অবলম্বনের ক্ষেত্রে কতিপয় সমস্যা রয়েছে । নিম্নে ইতিহাসে নৈর্ব্যক্তিকতার সমস্যাসমূহ বর্ণনা করা হলো :
১. অতীতের অসম্পূর্ণ জ্ঞান : ঐতিহাসিকগণকে অতীত সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। অতীতের অসম্পূর্ণ জ্ঞানের ফলে ঐতিহাসিক ক্ষেত্রবিশেষে নৈর্ব্যক্তিকতা অবলম্বন করেন। ঐতিহাসিকের কাজ মূলত ধারণাসংক্রান্ত, যা অতীত সম্পর্কে তাদের জ্ঞান সর্বদা খণ্ড খণ্ড ও অসম্পূর্ণ হিসেবেই দৃশ্যমান। আবার ঐতিহাসিক কোনো উৎসের ওপর গবেষণা চালিয়েও অতীত সম্পর্কে অসম্পূর্ণ তথ্য পেতে পারেন । এর ফলে ঐতিহাসিক অনেক সময়ই বাধ্য হয়ে নৈর্ব্যক্তিকতার পথে ধাবিত হন । ২. সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতপার্থক্য : কোনো ঘটনার বিশ্লেষণের ফলে যে কার্যকারণ ফুটে ওঠে তা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য শুধু সাধারণই নয়, নিদারুণ অনমনীয়ও বটে। বিভিন্ন ধরনের উপাত্তের ওপর নির্ভর করে প্রশ্নাদির মীমাংসার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ যখন নিশ্চিত প্রায় তখন ঐতিহাসিকেরা একই সময় বা বিষয়ের ওপর নানা ধরনের বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত দাঁড় করান। এর অন্যতম কারণ ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গিগত মতপার্থক্য । কেননা প্রতিটি ব্যক্তির কিছু নিজস্ব মতামত থাকবে এবং ব্যক্তিমাত্রই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মতামত দানের যোগ্যতা থাকতে হবে। এ মতামতসমূহের মধ্যে কিছু কিছু একেবারে নিরেট ও সত্য আবার কিছু কিছু ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ফলে এরূপ সিদ্ধান্তহীন ইতিহাস রচিত হলে তা সাধারণ জনগণকে অনেক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্ত ও জ্ঞানার্জনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আর এজন্যই ইতিহাস চর্চায় সব ঐতিহাসিকগণকেই নৈর্ব্যক্তিকতা অনুসরণ করতে হয় ।
খ. সমস্যার সমাধান : ইতিহাস চর্চায় নৈর্ব্যক্তিকতা অর্জনে অনেক সমস্যা থাকলেও সমস্যাসমূহের যথার্থ সমাধানও রয়েছে। নিম্নে ইতিহাসবিদের নৈব্যক্তিকতা অর্জনের লক্ষ্যে বিদ্যমান সমস্যাসমূহের সমাধানের লক্ষ্যে কতিপয় মতামত দেওয়া হলো :
১. পক্ষপাতহীনতা অবলম্বন : ঐতিহাসিকের পক্ষপাতহীনতা অবলম্বন একটি অত্যাবশ্যকীয় গুণ। তবে প্রায় প্রত্যেক ঐতিহাসিকের পক্ষেই সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা অনেকটাই দুরূহ কাজ । প্রত্যেক ঐতিহাসিকই নিজস্ব গোষ্ঠী চেতনা, সামাজিক দৃষ্টিকোণ ও জাতীয়তাবাদের ধারায় ইতিহাস রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। ঐতিহাসিকের মতপার্থক্য সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি বিভিন্ন যুক্তিতর্কের ওপর নির্ভর করে না; বরং এটি দলীয় ও গোত্রীয় স্বার্থ বা মঙ্গল চিন্তা বা আশা-আকাঙ্ক্ষার ওপর অধিক নির্ভর করে। তাছাড়া তাদের মতপার্থক্য কোনোটি সত্য কোনোটি মিথ্যা। ফলে ঐতিহাসিকের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ স্বাভাবিকভাবে জ্ঞানসংক্রান্ত না হয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। তাই ইতিহাস কিংবা প্রচারণ বা বিজ্ঞাপনের মধ্যে পার্থক্য দূর করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ইতিহাসকে সর্বজনীন চরিত্র দেওয়া অনেক কঠিন বলে প্রতীয়মান হয় ।
২. যুগোপযোগী চিন্তাচেতনা : একথা ঠিক যে, ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিকের নৈর্ব্যক্তিকতার ধারণা কিংবা নৈব্যক্তিকতার চর্চা এক নয়। এর কারণ অনুসন্ধানে দৃশ্যমান যে, প্রায় সব ঐতিহাসিক পক্ষপাত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইতিহাস রচনা করে থাকেন। ইতিহাসের কঠোর সমালোচনা করলেও তারা কখনও সুস্পষ্টভাবে কোনো ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক ধারণাকে ইতিহাস গবেষণা ও চর্চার জন্য সর্বোত্তম উপযোগী বলে গ্রহণ করেন না। ঐতিহাসিকের কাজ শিল্পীর কাজের মতো অনেকটা ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। শিল্পী শুধু তার ভাবাবেগই প্রকাশ করেন না; বরং অনুভূতি ও অন্তর্দৃষ্টির নিরিখে কোনো জিনিসের প্রকৃতি প্রকাশে প্রচেষ্টা চালান। এ কারণে কোনো শিল্পী তার কাজের সত্যতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা দাবি করতে পারেন। অনুরূপভাবে অতীতের বিভিন্ন ধরনের কিছু সামঞ্জস্যপূর্ণ দৃশ্যপট দক্ষতার সাথে তুলে ধরেন ঐতিহাসিক । আর এর প্রতিটি দৃশ্যপটই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাস চর্চায় ইতিহাসবিদের নৈর্ব্যক্তিকতাই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। ইতিহাসবিদের বড় অর্জনের মধ্যে এটিও এ নৈর্ব্যক্তিকতা গুণ। এ মহৎ কর্মের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তিই দেশ ও সমাজের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারেন। এ অর্জন ব্যতীত ইতিহাস রচনা কখনোই বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ হতে পারে না। আর বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা ব্যতীত প্রকৃত ইতিহাসও কল্পনা করা যায় না ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]