“ইতিহাসের সাথে জনগণের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।”—উক্তিটি মূল্যায়ন কর ।

উত্তর ভূমিকা : ইতিহাস মানবজাতির অতীত জীবনের সফলতা, ব্যর্থতা প্রভৃতির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিয়ে থাকে। মানুষের সংশ্লিষ্টতা নেই এমন যেকোনো বিবরণ ঐতিহাসিক মূল্য লাভে ব্যর্থ হয়। তাই ইতিাহসের মুল উপজীব্য বিষয় হলো মানবজাতি তথা সমাজ বা রাষ্ট্রে বসবাসরত মানুষ বা জনগণ। প্রাগৈতিহাসিক যুগ হতে বর্তমান পর্যন্ত মানুষই ছিল ইতিহাসের নির্মাতা।
↑ ইতিহাসে জনগণের ভূমিকা : মানুষের কর্মকাণ্ডকে আবর্তিত করেই ইতিহাসের মূল কাঠামো গড়ে ওঠে। একটা সময় ছিল যখন সাধারণ জনগণের কর্মকাণ্ডের স্থলে রাজা সম্রাটের কাহিনিই ইতিহাসের মূল বিষয়বস্তুরূপে পরিচালিত হতো। ইতিহাস বিষয় আলোচনায় সাধারণ জনগণের স্থান ছিল অত্যন্ত নগণ্য। তখন ঐতিহাসিকেরা বলতেন ইতিহাস অভিজাতদের সমাধিক্ষেত্র। কিন্তু জনগণের সম্মিলিত শক্তি যখন প্রকৃতির রাজ্যে রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে ঈশ্বরের মতবাদকে (Divine theory) হটিয়ে রাষ্ট্র গঠনে অবদান রাখে তখন থেকে ইতিহাসে সাধারণ মানুষের স্থান হতে শুরু হয়।
তারপরেও কয়েক শতাব্দী কেটে গেছে। ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই জনতার শক্তি উপেক্ষা করে বলেছিলেন "I am the sate"। তার এ বক্তব্য ও সীমাহীন শোষণমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে সাধারণ জনতার ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে অভিজাত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত তথা সর্বসাধারণের কর্মকাণ্ডে সাক্ষ্য হিসেবেই ইতিহাসের পঠনপাঠন আজ অবধি এগিয়ে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে ইতিহাসে জনগণের ভূমিকাকে নিম্নোক্ত কতিপয় ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা যায় ।
১. প্রাগৈতিহাসিক যুগে জনগণের ভূমিকা : মানব সভ্যতার তথা মানুষের কর্মকাণ্ডের প্রথম স্তরকে প্রাগৈতিহাসিক যুগ বলে অভিহিত করা যায়। প্রাগৈতিহাসিক যুগ প্রধানত ৩ ভাগে বিভক্ত। এগুলো হলো— ক. প্রাচীন প্রস্তর যুগ, খ. মধ্য প্রস্তর যুগ ও গ. নব্য প্রস্তর যুগ। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ক. প্রাচীন প্রস্তর যুগ : প্রাগৈতিহাসিককালের বিভাজনসমূহের মধ্যে প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ ইতিহাসে বড় কোনো ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। এসময় মানুষ যাযাবর বৃত্তির মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করতো। মানুষের ঐক্যবদ্ধতার ফলে শক্তির সৃষ্টি হয় তা তাদের জানা ছিল না। ফলে বিচ্ছিন্ন এ মানব সম্প্রদায়ের অনেককেই হিংস্র বন্য পশুর খাদ্যে পরিণত হতে হয়েছে । খ. মধ্য প্রস্তর যুগ : ইতিহাসে মানুষের ভূমিকাকে মূল্যায়ন শুরু হয় মধ্য প্রস্তর যুগে। এসময় মানুষ নিজের সৃজনশীলতার মাধ্যমে কতিপয় পাথরের হাতিয়ার তৈরি করেন। যা মানুষকে শিকারে সাহায্য করে। নতুন শিকার করার পদ্ধতি, আবাসের মতো অস্থায়ী কুড়েঘর তৈরি প্রভৃতি মানবিক কর্মকাণ্ড ইতিহাসকে প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকে মধ্য প্রস্তর যুগে নিয়ে আসে। অর্থাৎ সহজভাবে বললে বলা যায় মধ্য প্রস্তর যুগে জনসাধারণের এরূপ সীমিত কর্মকাণ্ড ইতিহাসের কতিপয় ইতিবাচক পরিবর্তন সংঘটিত করে। ইতিহাসে তখনকার সময়ে জনগণের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় ৷
গ. নব্য প্রস্তর যুগ : নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ হাতিয়ার নির্মাণ, শিকার পদ্ধতি, উদ্যানভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন, বিবাহিত জীবনযাপনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে সামাজিক বৈশিষ্ট্য আনয়ন প্রভৃতি কর্মে স্মরণীয় হয়ে ওঠে, যাকে নবপোলীয় বিপ্লব বলে আখ্যা দেওয়া হয়। নব্য প্রস্তর যুগে মানুষের নানামুখী সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ইতিহাসের গতিপথকে সমৃদ্ধ করেছে। মানুষ সমাজ গঠনের মাধ্যমে সভ্যতার অবদান রেখেছিল বলে মানুষের ভূমিকাকেই প্রধানরূপে বিবেচনা করা হতো। জনগণের সম্মিলিত ঐক্য এ যুগে সামাজিক ইতিহাসকে দৃঢ় ভিত্তি দান করে ।
২. প্রায় ঐতিহাসিক যুগ : প্রায় ঐতিহাসিক যুগে মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন পূর্বের চেয়ে বৃদ্ধি করে। কৃষি ব্যবস্থায় সমৃদ্ধি আসার সাথে সাথে মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যেমন নিশ্চিত হয় তেমনি মানুষের মধ্যে বেশকিছু সামাজিক কৃষ্টি ঢুকে পড়ে। ফলে সাধারণ জনগণের ভূমিকাই আবারও স্পষ্টরূপে ফুটে ওঠে। মানুষ এসময় প্রায় পুরোপুরি স্বাধীনভাবে চলাচলের উপযোগী হয়ে ওঠে। ফলে ইতিহাসের আলোচনায় মানুষ প্রধান চরিত্ররূপে আবির্ভূত হয় ।
৩. ঐতিহসিক যুগে জনগণের অবদান : ঐতিহাসিক যুগকে তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। যেমন— ক. প্রাচীন যুগ, খ. মধ্যযুগ ও গ. আধুনিক যুগ। ঐতিহাসিক যুগেই মূলত সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় ৷
ক. প্রাচীন যুগ : প্রাচীন যুগের শুরুতে ইতিহাসে মানুষের অবদান শুধু অভিজাত বা রাজ উপাখ্যানে পরিণত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, এ যুগে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। এ রাষ্ট্র সৃষ্টিতে ঐশ্বরিক দায়িত্বের কথা বলে রাজা মানুষকে বোকা বানিয়ে তার আনুগত্যের অধীনে নিয়ে আসে। ফলে ইতিহাসে জনগণের ভূমিকা শুধু রাজা, রাজ্য, রাজধর্ম প্রভৃতি নির্ভর হয়ে ওঠে। তবে এ যুগের শেষে জনগণই যে রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি তা সাধারণত জনগণ বুঝতে শিখে। ফলে ক্ষেত্রবিশেষ উপেক্ষিত জনগণ ইতিহাসের পুনরায় প্রধানরূপে স্থান পায়। প্রাচীন যুগে ভারতীয় উপমহাদেশে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের বিজয়াভিযান লক্ষ করা যায়। এসময়ে ভারতের অনেক রাজাই তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের পর পরই মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বিদেশি শক্তির আক্রমণ বা রাজা রাজ্য গঠনের সময়কালে জনগণের মধ্যে বেশ বড় কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি। তাই এসময়ে রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম রূপে পরিগণিত হয়েছে। রাজারা যুদ্ধে জয়ী দেশে পরাজিতদের অবর্ণনীয় নির্যাতন করলেও জনগণ মুখ ফুটে কিছু বলেনি । তারা সবকিছু সয়ে নিয়েছিল । ফলে ইতিহাসে এ যুগে রাজা ব্যতীত সাধারণ জনগণের স্থান ছিল অত্যন্ত নগণ্য ।
খ. মধ্যযুগ : মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজার পাশাপাশি সমাজের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকা ফুটে উঠতে থাকে। ইউরোপের জনগণ এসময়ে রাজশক্তি, সামন্তপ্রথা, নাইটপ্রথা প্রভৃতিকে পদদলিত করে রাজা জনকে ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে বিল অব রাইটস প্রণয়নে বাধ্য করেছিল। এসময়ে রাজাকে জনতার ঐক্যবদ্ধ শক্তি কোণঠাসা করে রাখে। পোপতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র কিছুটা প্রভাব বিস্তার করলেও জনগণের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। ফলে বিশ্বের অনেক স্থানেই কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠিত হয়। মধ্যযুগের ইতিহাসে তাই জনগণের ভূমিকা আবারও স্পষ্ট হতে থাকে। এসময় প্রতীয়মান হতে শুরু হয় জনগণই রাষ্ট্রের প্রাণ। আর তাই এসময়ে অনেকেই ইতিহাসকে শুধু রাজা কাহিনির বাইরে এসে সমাজজীবন ও সংস্কৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট করে তোলেন ।
গ. আধুনিক যুগ : আধুনিক যুগে ইতিহাসে জনগণের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যুগের স্বীকৃত শাসনব্যবস্থা হলো গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। যাতে প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের মূল শক্তির প্রকাশ ঘটে। রাষ্ট্রের শাসকবর্গের কাছে সম্মিলিত জনতার শক্তি একটি আতংক হিসেবে দেখা দেয়। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের ফলে রাজার শিরশ্ছেদ পর্যন্ত করা হয়। রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই জনগণ মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। যার ফলে ইতিহাসের বর্ণনাতে পরিবর্তন আসে। ইতিহাসশাস্ত্রে বিভিন্ন প্রকার শাখাপ্রশাখার সৃষ্টি হয়। জ্ঞানের সব শাখায় জনগণের জয়গান প্রকাশিত হয় । অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সব শ্রেণি পেশার অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে জনগণের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে জনগণের কর্মকাণ্ড ইতিহাসের গতিপথকে পরিবর্তিত করেছে। সৃষ্টি করেছে এক নতুন ইতিহাস ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাসে জনগণের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যুগে যুগে যেসব শাসক জনগণের ভূমিকাকে অস্বীকার করেছেন তাদের চতুর্দশ লুইয়ের পরিণতি গ্রহণ করতে হয়েছে। আর যারা এ সত্যটি স্বীকার করেছেন তার ধর্মপালের ন্যায় জনপ্রিয় শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। মূলত জনগণই ইতিহাসের নির্মাতা। তাই ইতিহাসে জনগণের ভূমিকাই মূখ্য একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায় ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]