ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণসমূহ

১. মুসলিম ধর্মীয় আন্দোলন : ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার মুসলিম ধর্মীয় আন্দোলন ছিল প্রধানত ধর্মীয় পুনর্জাগরণধর্মী, তবে অংশত এগুলো উদার আধুনিকতাবাদী সংস্কারমূলক প্রকৃতিরও ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে কতিপয় সংস্কার আন্দোলন বাস্তব রূপলাভ করে। এদের মধ্যে ফরায়েজী, তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া, তাইয়ুনী ও আহল-ই-হাদিস এর মতো ইসলামি সংস্কার আন্দোলন উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে। প্রকৃতিগতভাবে এগুলো ছিল পুনর্জাগরণধর্মী এবং পূর্ব পশ্চিম ও উত্তর বাংলাব্যাপী মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে গভীরভাবে উদ্দীপিত করে মুসলিম জনগণকে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার কাজে এগুলো উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। যে তাবলিগ জামাত ও সিরাত সম্মেলন আন্দোলন সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে অনুরূপ গণউদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে, তা পূর্ববর্তী শতাব্দীর আন্দোলনগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় এবং এগুলো অনেকাংশ পূর্ববর্তী আন্দোলনের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারীও বটে। সুতরাং মুসলিম ধর্মীয় আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ওয়াহাবি আন্দোলন গড়ে ওঠে 1
২. বিশ্বজনীন পরিপ্রেক্ষিত : ধর্মীয় আন্দোলনগুলো সামাজিক বিষয় হওয়ায় তুলনামূলকভাবে বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে এগুলোর পর্যালোচনা প্রয়োজন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় ইসলামি পুনর্জাগরণ আন্দোলন এত বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, ঐতিহাসিকগণ এগুলোকে একটি পরাধীন ও ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবন চেতনার অবিচ্ছিন্ন প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ধর্মীয় পুনর্জাগরণবাদ শুধু বাংলার মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি সমগ্র মুসলিম সমাজকে প্রভাবিত করে সমকালীন মুসলিম বিশ্বে বিস্তার লাভ করে। এরূপ ধারণা প্রচলিত আছে যে, সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবের ফলেই বিশ্বের বিভিন্ন অংশে এ আন্দোলন রূপলাভ করে । উসমানীয় সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবে আরবের ওহাবী আন্দোলন এর উদ্ভব হয়েছিল বলে মনে করা হয়। মুগল ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ রূপ দিয়েছিল শাহ ওয়ালিল্লাহর মতবাদ ও তরিকা-ই-মুহম্মদীয় আন্দোলনের, আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে উদ্ভব ঘটে ফরায়েজি, তাইয়ুনী ও আহলে-ই-হাদিস আন্দোলনের। ফরাসি ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে উত্তর আফ্রিকায় ফুলানি ও সানুসিয়া আন্দোলন এবং ওলন্দাজ সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবের ফলে ফুলানি ও সানুসিয়া আন্দোলন এবং ওলান্দাজ সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবের ফলে ইন্দোনেশিয়ার পাদুরি ও মুহম্মদীয়া আন্দোলনের উদ্ভব ঘটে।
অপর একটি মত এই যে, এসব ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন কতকটা পাশ্চাত্যপন্থি রেনেসাঁ প্রভাবিত মুসলিম আধুনিকতাবাদ ও প্যান- ইসলামিবাদের (ইত্তেহাদুল ইসলাম) বিরুদ্ধ মত হিসেবে সাধারণ্যে ওয়াহাবিবাদ ইসলামি পুনর্জাগরণবাদ (তাজদিদুল ইসলাম) নামে পরিচিত লাভ করে। এ দুধরনের আন্দোলনের প্রস্তুতি ছিল সর্বজনীন। দুটিরই উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের পুনর্জাগরণ এবং উভয়েরই স্লোগান ছিল ‘ইসলাম বিপন্ন'। কাজেই তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও অভীষ্ট লক্ষ্যের যথেষ্ট ঐক্য এবং অনুভূতি অভিন্নতা বিদ্যমান ছিল।

এতদ্‌সত্ত্বেও আন্দোলনগুলো ভিন্নতর লক্ষ্যে কাজ করত, প্রায়শ একটি অন্যটির কর্মসূচির প্রতি বৈরী মতামত প্রকাশ করতো এবং সতর্কতার সঙ্গে সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য বাজায় রাখত। এর থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, একমাত্র বিশ্বজনীন পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া এসব আন্দোলনের মধ্যে তেমন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় না ৷ সুতরাং ওয়াহাবি আন্দোলন এসব বহুবিধ কারণে গড়ে ওঠে
৩. স্থানীয় সর্বজনীন পরিপ্রেক্ষিত : বাংলার স্থানীয় পরিবেশের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে দেশটি মুসলমান কর্তৃক অধিকৃত এবং ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত শাসিত হলেও সম্পূর্ণরূপে ইসলামিকরণ হয়নি। মুসলিম, হিন্দু ও বৌদ্ধদের সমন্বয়ে এখানে গড়ে উঠেছিল একটি সর্বজনীন সমাজ এবং তারা ইসলামের সহনশীল শান্তি, বিশ্বজনীন ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তার মধ্যে সন্নিহিত অথচ স্বতন্ত্র গ্রাম ও পল্লিতে পাশাপাশি বসবাস করতো। এ স্থানীয় সর্বজনীন ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন সামাজিক-ধর্মীয় সংস্কারের প্রেরণায় বিশেষভাবে স্পন্দিত, গতিময় ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এবং তা মুসলিম ও হিন্দু সমাজকে প্রভাবিত করে। শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এ উদ্দীপনা এমন এক বুদ্ধিদীপ্ত শ্রেণি গড়ে তোলে, যারা তাদের স্ব স্ব ধর্মের অনুপ্রেরণামূলক উৎসের সঙ্গে তাদের চলমান জীবনধারার এবং তাদের সম্প্রদায়ের আপাত ও ভবিষ্যৎ উন্নতির সংগতি সম্পর্কে সন্ধিহান হয়ে ওঠেন। বাংলার উপর ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবই ছিল এরূপ একটি পুনর্জাগরণের বর্তমান ও আশু কারণ ৷
বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন দেশের সামাজিক কাঠামোকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়। প্রথমত, তারা মুঘল শাসকশ্রেণির কর্তৃত্ব ও মর্যাদা বিনষ্ট করে, যাতে সমভাবে হিন্দু ও মুসলমানগণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয়ত, তারা গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণত অবস্থাপন্ন শ্রেণির সনাতন আয়ের উৎসগুলো বিনষ্ট করে দেয়। তৃতীয়ত, তারা কলকাতার ভিনদেশী হিন্দু বানিয়া দের ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠিত করে। এরা প্রধানত মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ও কুসীদজীবী এবং গোমস্তা (ভারতে ইংরেজদের বাণিজ্য- প্রতিনিধি) হিসেবে কাজ করত। প্রায়শ এরা ‘সাদা আদমিদের কালা গোমস্তা' নামে অভিহিত হতো। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এর ফলে ইউরোপীয় সামন্ত প্রভূদের ধাঁচে সৃষ্ট জমিদারগণ জনসাধারণের ওপর অত্যাচার চালাত। গোমস্তা ও জমিদারদের সঙ্গে যোগ দেয় তৃতীয় একদল উচ্চভিলাষী ভাগ্যান্বেষী। এরা ছিল এমন একদল ইংরেজ যারা সম্ভবত আমেরিকায় হারানো উপনিবেশগুলো থেকে অর্থ ও দক্ষতা স্থানান্তরিত করে গ্রাম বাংলার মাটিতে মূলধন বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজছিল এবং এরা নীলকর হিসেবে রাজকীয় মনোভাব নিয়ে কৃষকুলের উপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল।
একটি পরাধীন জনগোষ্ঠীর সামাজিক কাঠামোর ওপর এরূপ শক্তিশালী ও সম্মিলিত প্রভাবের ফলাফল সহজেই অনুমান করা যায়। ‘ঝুঁকিহীন নির্যাতন'- এর এই মুঘল শাসনব্যবস্থার সুনিয়ন্ত্রিত ধ্বংসের সুযোগ বাংলার ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের (১৭৫৭-১৮৫৭) ‘অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াকে' ত্বরান্বিত করেছে। ল্যাথ্রোপ স্টোভার্ড একে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনুপ্রবেশ' নীতিরূপে আখ্যায়িত করেছেন। এই নীতি বিশেষত বাংলার গ্রাম জীবনে বহুবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসংগতির সৃষ্টি করেছিল।
এতে অবাক হওয়ার এমন কিছু নেই যে, এ পরিস্থিতি খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকদের মনে করুণার গভীর অনুভূতি, ইংরেজ শাসকবর্গের কিছুসংখ্যক সহৃদয় ব্যক্তির বিবেকদংশন এবং ইংল্যান্ডের জনসাধারণের মানবতাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে বেশ সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে। তাদের আশীর্বাদ, উৎসাহ, সাহায্য ও অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৮১৪ বা ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে দিকে রাজা রামমোহন রায় কলকাতায় ‘রেনেসাঁ' ধরনের একটি আধুনিকতাবদী সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেন। এই আন্দোলন বাংলা ও ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে অসংখ্য নতুন বা বিচ্ছিন্ন সমাজসংস্কার আন্দোলনের উদ্ভব ঘটায় ।
কিন্তু তৎকালে ব্রিটিশের ইতিবাচক ভূমিকা বাংলার হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে কিছুটা ইতিবাচক সাড়া জাগালেও মুসলমানদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাংলায় গড়ে ওঠা হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন ও দিল্লির রায়বেরেলির সৈয়দ আহমদ শদীদের তরিকা-ই-মুহম্মদীয়া আন্দোলন থেকে শুরু করে কিছুসংখ্যক পুনর্জাগরণমূলক ধর্মীয় আন্দোলনেরই উদ্ভব হয় ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ।
যেখানে মুসলিম পুনর্জাগরণ আন্দোলন ছিল সংস্কারপন্থি সেখানে রাজা রামমোহন রায়ের আন্দোলন সাধারণত রেনেসাঁ হিসেবে বিবেচিত। তথাপি এটা লক্ষণীয় যে, ইউরোপীয় ‘রেনেসাঁ আদলের' তুলনায় এটি ছিল স্বতন্ত্র ধরনের এক রেনেসাঁ। বিশেষভাবে এটি আদি হিন্দু অথবা আর্য ধর্মীয় চেতনার পুনর্জাগরণমূলক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। ইউরোপীয় রেনেসাঁর লক্ষ্য ছিল যুক্তিবাদ সম্পর্কে গ্রিক-রোমানদের পুরানো ক্লাসিক্যাল সেক্যুলার ধ্যানধারণা এবং ‘বর্তমানের ক্ষমাশীল খ্রিষ্টান নীতিবাদের’ মিলন ঘটানো, যাতে ‘মানবতাবাদের’ কল্পিত ‘উজ্জ্বলতার’ মধ্যে ‘একটি ভবিষ্যৎ' সুখী ও সভ্য জগৎ গড়ে তোলার উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু তুলনামূলকভাবে রাজা রামমোহন রায়ের রেনেসাঁর লক্ষ্য ছিল আধুনিক পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার সাহয্যে ‘একেশ্বরবাদের’ আদি আর্য চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করা। তবে অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যে এই রেনেসাঁ সেক্যুলার ছিল না, ছিল গভীর ধর্মনিষ্ঠ। ফলে ‘আর্যসমাজে'র মতো কিছুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু সংস্কার আন্দোলন রামমোহনের সংস্কারমূলক তৎপরতার বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। ইসলামি পুনর্জাগরণবাদ ও হিন্দু রেনেসাঁর উত্থান একই সময়ে ঘটে। দুর্ভাগ্যবশত রেনেসাঁর প্রকৃত বা কল্পিত ‘যুক্তিসিদ্ধ' প্রণোদনার চেয়ে পারস্পরিক শত্রুভাবাপন্ন ইসলামিক বনাম হিন্দু পুনর্জগরণমূলক প্রেরণার দ্বারা একটি অপরটিকে প্রভাবিত করেছিল। এভাবে আন্দোলনগুলোর মধ্যে যুগ যুগ ধরে প্রশংসিত 'ধর্মীয় সহনশীলতার' ভিত্তিতে ইসলাম "বা মুঘলদের প্রতিষ্ঠিত শান্তিকে ভেঙে খণ্ড খণ্ড করার প্রবণতা দেখা দেয় এবং এরা নতুনভাবে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে শুরু করে। সুতরাং এসব বহুবিধ কারণে প্রভাবে মুসলিম ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে ।

৪. স্থানীয় ইসলামি পরিপ্রেক্ষিত : বাংলার মুসলিম সমাজের প্রতি তাকালে এটা লক্ষণীয় যে, বাংলায় মুসলিম বিজয় (১২০৪) থেকে শুরু করে পলাশীর যুদ্ধ ) (১৭৫৭) পর্যন্ত এখানকার মুসলিম সমাজের অবস্থান যথেষ্ট নিরাপদ ছিল এবং এ নিরাপত্তা- বেষ্টনী ছিল বিশ্ব মুসলিম সমাজের জন্য একটি দুর্জয় দুর্গস্বরূপ। রাজনৈতিকভাবেও এটি ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের একটি শক্তিশালী দুর্গ হিসেবে বিরাজিত ছিল। কিন্তু পলাশী যুদ্ধ ইংরেজদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে এবং ফলস্বরূপ মুসলিম সমাজ অবিরাম রাজনৈতিক বিপর্যয় ও টানাপোড়েনে বিক্ষত ও সংকুচিত হতে থাকে। ব্রিটিশের অধীনে পরাধীনতার যুগকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়; প্রথমটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে ১০০ বছর পূর্ণ দাসত্বের যুগ এবং দ্বিতীয়টি ব্রিটিশ রাজত্বে ৯০ বছরের পরাধীনতার যুগ। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ দুটি যুগের মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে।
প্রথম যুগে মুসলিম সমাজ আলো থেকে অন্ধকারে, আশা থেকে নিরাশায়, ‘দারুল ইসলাম' থেকে ‘দারুল হারবে' অর্থাৎ শান্তির নিবাস থেকে অশান্তির নিবাসে নিক্ষিপ্ত হয়। মুসলমানগণ মুসলিম সমাজ ও ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে বিরামহীন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এ ছিল মরণপণ যুদ্ধ, জেহাদ অথবা হিজরত এবং এরই ফলে পরবর্তীকালে রূপলাভ করে হাজী শরীয়তুল্লাহ ও দুদু মিয়ার ফরায়েজি আন্দোলন, সৈয়দ আহমদ শহীদ, তিতুমীর, মওলানা বিলায়েত আলী ও মওলানা ইনায়েত আলীর তরিকা ই-মুহম্মদীয় আন্দোলন তথা ভারতীয় ওয়াহাবি আন্দোলন, শাহ ইসমাইল শহীদ ও মওলানা নাজির হোসেনের আহলে-ই- হাদিস আন্দোলন এবং জৌনপুরের মওলানা কারামাত আলীর তাইয়ুনী আন্দোলন ।
দ্বিতীয় যুগে, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর মুসলমানগণ সম্প্রদায় হিসেবে নয়, ব্যক্তিগতভাবে বিদেশি রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা পাশ্চাত্যের আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য নিজেদের উপযোগী করে তোলা, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে সুখী ও সুসভ্য জীবনের উপকরণ লাভের উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যের অপরাপর অধীনস্থ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া এবং জেহাদের পরিবর্তে ব্রিটিশ আইনের আশ্রয় (আমান) গ্রহণের প্রয়াস চালান। এক কথায় তারা রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করে প্রশাসনিক শান্তি ও আইনের শাসনকে সুখসমৃদ্ধ আধুনিক জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করে জিহাদের ক্ষেত্র (দারুণ হারব) থেকে নিরাপত্তার পরিবেশ (দারুণ আমান) উত্তরণের চেষ্টা করে। এসব চিন্তাধারা এবং এদের সহগামী অনুভূতি ও আবেগ একটিমাত্র কথায় রূপ লাভ করে এবং তা হচ্ছে রাজভক্তিবাদ ।
প্রায় ১৮২০ থেকে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত বাংলায় ইসলামি পুনর্জাগরণ আন্দোলনগুলো গভীর উদ্দীপনায় বিকাশ লাভ করে। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে এদের ধ্বংসসাধন বা অরাজনৈতিক ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ আন্দোলনগুলো অধিকাংশ সময় ছিল উগ্র আবেগময় পর্যায়ে। এভাবে বিবেচনা করলে আন্দোলনগুলো পরাধীনতার পর্যায় থেকে আশ্রিতের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হওয়ার ‘লম্ফন-মঞ্চ' বা উত্তরণ-সেতু' গড়ে তুলেছিল বলে উল্লেখ করা যায়। তাদের সংগ্রামের আগুন নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত ‘দারুল আমান' শ্লোগান এবং আশ্রিত রাজ্যের ধারণা মুসলিম সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। পুনর্জাগরণ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর রেনেসাঁ ধরনের মুসলিম আধুনিকতবাদ প্রকাশ্য বা গোপনভাবে ‘রাজভক্তিবাদ'-এর শ্লোগান তুলে মাঠে নামে এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে ইংরেজ শাসকদের আরও সান্নিধ্যে নিয়ে আসার ও শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতির পথে পরিচালিত করার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে ওয়াহাবি আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে।
৫. ইসলামি চেতনা ও ব্রিটিশ বিরোধিতা : সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক সামাজিক-ইসলামিক ভাবাপন্ন জিহাদ আন্দোলন হিসেবে এবং স্থানীয় সমাজব্যবস্থা ও রাজনীতির সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে স্থানীয় মুসলিম সমাজকে পুনর্গঠিত ও পুনঃসংহত করার পদক্ষেপ হিসেবে বাংলার ইসলামি পুনর্জাগরণ আন্দোলনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ধর্মের মূল শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত করা। ব্রাহ্ম সমাজ ও আর্য সমাজের ন্যায় হিন্দু সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এটাই ছিল করণীয় প্রধান কাজ। তাদের সমাজ সংস্কারমূলক প্রচেষ্টায় উভয় দলই স্বদেশে স্ব স্ব সমাজ শুদ্ধিকরণের দাবি জানায়, এবং প্রাদেশিক সীমানার বাইরে নিজেদের ও সমমনা স্বধর্মীদের মধ্যে নতুনভাবে সম্প্রদায়ব্যাপী যোগাযোগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। অন্যদিকে ওয়াহাবি আন্দোলন মুসলিম সমাজসংস্কার ও ইসলামের শুদ্ধিকরণের প্রচেষ্টা চালায় ।
পূর্ববর্তী শতাব্দীতে মুঘল আধিপত্য সংকুচিত হওয়ার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে মুসলমানদের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয় তা নিরসন করাই ছিল ইসলামি পুনর্জাগরণবাদের অন্যতম লক্ষ্য। বাংলায় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এমন ইসলামিক পুনর্জাগরণ আন্দোলনের সংখ্যা ছিল মোট চারটি। সেগুলোর মধ্যে ফরায়েজী, তরিকা-ই-মুহম্মদীয় ও আহলে-ই-হাদিসের লক্ষ্য ছিল ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পুনরুজ্জীবন এবং মুসলিম সমাজকে স্থানীয় অনৈসলামি রীতিনীতির অনুপ্রবেশ থেকে মুক্ত করা। চতুর্থটি ছিল মওলানা কারামত আলী জৌনপুরি পরিচালিত তাইয়ুনী আন্দোলন এবং এটি ছিল তরিকা-ই-মুহম্মদীয়ার একটি খণ্ডিত আন্দোলন। তাইয়ুনী আন্দোলন কর্তৃক বাতিল ঘোষিত ফাতিহা, মিলাদ ও উরসের ন্যায় কিছুসংখ্যক ঐতিহ্যবাহী প্রথাকে বহাল রাখতে চেয়েছিল। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্রোহের পরে তাইয়ুনী আন্দোলন মুসলিম আধুনিকতাবাদীদের সঙ্গে হাত মিলায় এবং ব্রিটিশ রাজত্বের অধীন ভারতবর্ষকে দারুল আমান বা নিরাপদ আবাসভূমি হিসেবে ঘোষণা করে। মওলানা কারামত আলীর মতে এই ঘোষণা মুসলমানগণকে জিহাদ অর্থাৎ মুসলিম রাজ্যকে মুক্ত করার জন্য আমরণ যুদ্ধ করা এবং হিজরত অর্থাৎ আশ্রয় গ্রহণের জন্য কোনো ইসলামিক রাজ্যে গমন করার ধর্মীয় দায়দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি প্রদান করে। তদুপরি দিল্লির শাহ ওয়ালিউল্লাহর সংস্কার কর্মসূচি আহল-ই-হাদিস আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল ।

আরবের ওয়াহাবি মতবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্ভব ঘটে এবং শাহ ওয়ালিউল্লার আন্দোলন বা দিল্লির তরিকা-ই-মুহম্মদীয়ার সঙ্গে এর কোনো : প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। অপর পক্ষে তিতুমীরের আন্দোলন ছিল তরিকা-ই-
মুহম্মদীয়ার একটি সরাসরি সম্প্রসারণ ।
ইসলামি পুনর্জাগরণবাদের বিশ্বজনীন রূপ প্রচারের ফলে এই সকল সংস্কার আন্দোলন ইসলামের সামাজিক সমতাবাদ, এক আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে সকল মানুষের সাম্য, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব, মুসলিম বিশ্বের ঐক্য এবং বিধর্মীদের কবল হতে মুসলিম দেশগুলো মুক্ত করার জন্য জিহাদ করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করত। এতদুদ্দেশ্যে এসব আন্দোলনের প্রবক্তারা ইসলামি ‘উম্মাহ’ কে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টাও করত এবং কালক্রমে এটি তাদের সংস্কার কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়। এ কারণে বিশ্বের সর্বত্র ইসলামি পুনরুজ্জীবনমূলক আন্দোলনগুলো সমাজে ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা ও দেশে একটি রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে প্রকাশ্যে বা গোপনে কাজ করতে থাকে এবং এ লক্ষ্যে তারা প্রত্যক্ষ গণসংযোগগের নীতি গ্ৰহণ করে। ইসলামি পুনর্জাগরণ আন্দোলনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ছিল। এভাবে মুসলমানদের চিন্তাধারায় উম্মাহর গঠনতান্ত্রিক ঐক্য এবং ইসলামি সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধের গভীর অনুভূতি পুনঃসঞ্চারিত করা।
তদুপরি তাদের গণসংযোগের কৌশল এবং মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও বিদেশি শাসকদের ষড়যন্ত্রের ধর্মীয় উদ্দীপনা জাগানোর জন্য মসজিদের মিম্বরে বা মুক্ত বক্তৃতা-মঞ্চে সোৎসাহে প্রদত্ত অগ্নিগর্ভ ও অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতি গণসচেতনতা জাগাতে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করে।
বাংলায় ইসলামি পুনর্জাগরণ আন্দোলনের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ছিল এভাবে গণসতর্কতা ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি এবং সামাজিক সংস্কার ও পুনর্গঠন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশেষ দশকের প্রথম দিকে যখন সৈয়দ আহমদ শহীদ কলিকাতা শহরে আগমন করেন তখন দৃশ্যত তিনি মুসলমান, হিন্দু বা সরকারি প্রশাসনের দিক থেকে কোনো বিরোধিতার সম্মুখীন হননি। কিন্তু প্রায় ১৮২৭ থেকে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীরের নেতৃত্বে গ্রামবাংলায় বিশেষত ২৪ পরগনা ও নদীয়ার অংশবিশেষে জমিদারশ্রেণি ও গোমস্তাদের গভীর ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হয় এবং এ ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে ইউরোপীয় নীলকরগণও হাত মিলায়। তিতুমীরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় ৷

ওয়াহাবি আন্দোলনের গতি প্রকৃতি


প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ওয়াহাবি আন্দোলনের ও প্রকৃতি সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে তীব্র মতভেদ দেখা যায়। সম্প্রতি জনৈক গবেষক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত অনুসরণ করে বলেছেন যে, “সৈয়দ আহমদ প্রচারিত ওয়াহাবিবাদ, তাঁর হজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মূলত ও আদর্শগতভাবে একটি নিছক ধর্মীয় আন্দোলন ছিল।” (The Wahabism advocated by Sayyid Ahmed after his return from Haj was....in its origin and purpose, a purely religious movment.) অপরদিকে উইলিয়াম হান্টার ওয়াহাবি আন্দোলনকে একটি ধর্মের বাতাবরণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলন বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন । রাজনৈতিক বা ধর্মীয় যে কোনো কায়েমি স্বার্থের বিরোধী ছিল ওয়াহাবি আন্দোলন । ওয়াহাবিরা ছিল প্রচলিত কায়েমি ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী। সাধারণতন্ত্রীদের অনুরূপ । তবে নানা মুনির নানা মত থাকলেও এটি ধর্মীয় আবরণে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত হয়েছিল।
সুতরাং ওয়াহাবি বিদ্রোহে ধর্মীয় চরিত্র থাকলেও তার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চরিত্র উপেক্ষা করা যায় না। ওয়াহাবি আন্দোলন সম্পর্কে ড. বিনয় চৌধুরী মতামত প্রণিধানযোগ্য। ওয়াহাবিদের ধর্মবিশ্বাস সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা বোধের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ওয়াহাবিরা প্রধানত কৃষক শ্রেণি থেকে এসেছিল। “ধর্মগোষ্ঠী হিসেবে ওয়াহাবিদের স্বাতন্ত্রবোধ তাদের কৃষক শ্রেণির চেতনার সাথে যুক্ত হয়।” ওয়াহাবিরা শিখ জমিদার ও জায়গিরদার শ্রেণির বিরুদ্ধে জেহাদ চালান। পরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁরা যুদ্ধে লিপ্ত হন। কুয়েমুদ্দিন আহমদের মতে, “ওয়াহাবিবাদ কোনো বিশেষ ধর্মমত ছিল না।” ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকে ওয়াহাবিবাদ কেবলমাত্র ইসলামের পবিত্রতা রক্ষার তত্ত্বে বিশ্বাস করা হতো। ড. কুয়েমুদ্দিন আহমদের মতে, ওয়াহাবিবাদ সাম্প্রদায়িক আন্দোলন ছিল না। শিখ জমিদারশ্রেণি গরিব পাঠান কৃষকদের জন্য জায়গা অধিকার করায় এ আন্দোলন তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। নিম্নবর্ণের হিন্দু বা অন্যান্য হিন্দুদের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন পরিচালিত হয়নি। মারাঠা হিন্দুদের এর সাথে ওয়াহাবিদের হৃদ্য সম্পর্কে ছিল। বহু হিন্দু ওয়াহাবিদের অর্থ সাহায্য করেন এবং গোপন সংবাদ পৌঁছে দেন। ওয়াহাবি আন্দোলন ধর্মীয় আন্দোলনরূপে দেখা দিলেও তার একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক চরিত্র ছিল। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম দ্বারা এ আন্দোলন একটি রাজনৈতিক মাত্রা পায়। ব্রিটিশ বিরোধিতা ওয়াহাবি আন্দোলনের লক্ষ্য হয়। এভাবে ওয়াহাবি আন্দোলন ধর্মীয় গণ্ডি পেরিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হয় ।
ভারতে ধর্মসংস্কার আন্দোলন রূপে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এবং প্রথম দিকে নিম্নমধ্যবিত্ত মুসলমানদের মধ্যেই তা সীমিত থাকে। সৈয়দ আহমদের মৃত্যুর পর এটা রাজনৈতিক আন্দোলন এবং কোনো কোনো অঞ্চলে এ আন্দোলন শ্রেণিসংঘাতে পরিণত হয়। দরিদ্র কৃষকদের দুর্দশার অবসান করার প্রচেষ্টা শুরু হলে ওয়াহাবি আন্দোলন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। ওয়াহাবি আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে ওয়াহাবিরা বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন হিসেবে বুঝেছিলেন, যদি তাঁদের ধর্মীয় সংস্কারগুলোর পেছনে জনসমর্থন সংগ্রহ করতে হয়, তাহলে অবশ্য গ্রামকেন্দ্রিক ভারতবর্ষের গ্রাম্য অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকের সপক্ষে বক্তব্য রাখতেই হবে। ‘দি ওয়াহাবি মুভমেন্ট' গ্রন্থের লেখক কুয়েমুউদ্দিন আহমেদ এর মতে প্রথম দিকে সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তী কালে বিশেষ করে বিলায়েত আলি ও ইনায়েত আলি নামে দুই ভ্রাতার পরিচালনায় তা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ক্রমে এটি ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হয় ।
দৃশ্যত সৈয়দ আহমদের জীবিতকাল পর্যন্ত এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় সংস্কার অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম ও সে সাথে মুসলিম সমাজের সংস্কার। অন্য কোনো ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা এতে ছিল না। শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অপেক্ষা ‘বিপদগামী ও ‘ভণ্ড' মুসলমানদের সাথে যুদ্ধেই সৈয়দ আহম্মদ অধিক সময় নিয়োজিত করেছিলেন । মুসলিম সমাজের সংস্কার সাধন করে একে রাজনৈতিক সংগ্রামের উপযোগী করে তোলাই সৈয়দ আহমদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ। কেয়ামউদ্দিন আহমেদ (Q.Ahmed) এর ভাষায় "The Wahabi Movement has two main features-Socio-religious and political. The former involved the reformation of the Muslim society while the latter related to the fight against the English." কেয়ামউদ্দিন আহমেদ ওয়াহাবি আন্দোলনকে ইংরেজ বিরোধী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে হিন্দুদের অনেকে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি ছিল ও ওয়াহাবি সমর্থক সন্দেহে বহু হিন্দুকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। ডক্টর মজুমদারের মতে ওয়াহাবিদের সাথে সাধারণ হিন্দুদের কখনও সংঘর্ষ হয়নি। ইংরেজ ঐতিহাসিক স্মিথ ওয়াহাবি আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক বলে স্বীকার করেননি । তাঁর মতে, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ আন্দোলন ছিল পূর্ণমাত্রায় শ্রেণিসংগ্ৰাম । বাংলা এ শ্রেণি সংঘাত সুস্পষ্টভাবে দেখা দেয়। জাতি ধর্মনির্বিশেষে বাংলার কৃষকরা এ আন্দোলনে যোগ দেয় এবং তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল জমিদারগণ । মুসলমান জমিদার ও মহাজনরাও তাদের আক্রমণ হতে রক্ষা পাননি। সাধারণভাবে ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ বিরোধী। এ কারণে ওয়াহাবিদের প্রতি হিন্দুদের সমর্থন ছিল। এতে ওয়াহাবি আন্দোলনের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ফুটে ওঠে 1
ভারতের রায় বেরিলির সৈয়দ আহম্মদের যে আদর্শ তাঁর অনুগামীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল তা ছিল সেকেলে যুগ বিরোধী। সপ্তম শতকে আরবদেশে প্রচলিত জীবনধারা পুনরুজ্জীবিত করতে তাঁরা প্রয়াসী হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ইতিহাসের শিক্ষা ও মানুষের মনের উপর সমকালীন যুগের প্রভাব অস্বীকার করে ভুল করেছিলেন। তাঁরা শর্তশূন্যভাবে ধর্মের ও নৈতিকতার মৌল সত্যগুলো তথা বিগত যুগের আচার আচরণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা সর্বদাই বিবর্তনীয় তা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। ঊনবিংশ শতকের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করায় পরিশেষে আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তারাচাঁদ (Tarachand) বলেছেন যে, "This complete disregard of the geographical, economic, social and political condition of the nineteenth century bound to end indisaspointment and discomfiture." সীমান্তের উপজাতিদের উপর সৈয়দ আহম্মদ তাঁর নিজস্ব মতাদর্শ চাপাইবার চেষ্টা করে তাদের বিরাগভাজন ও` সন্দেহভাজন হন । অনিল শীল এর ভাষায় "Seeking to march backwards with fire and sword to the good old days of Aurangzeb they, (Wahabis) were unlikely to attract those three quarter of the popualtion who were Hindu... Hence they were bound to fail." সুতরাং মুসলিম ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হলেও পরবর্তীতে তা অসাম্প্রদায়িক এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চরিত্র লাভ করেছিল ।
ভারতে ওয়াহাবি-শিখ যুদ্ধ
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে বাংলা তথা ভারতের ওয়াহাবি-শিখ যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। ওয়াহাবি-শিখ যুদ্ধের পটভূমির দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, ভারতে ইতোমধ্যে সৈয়দ আহমদ নিজেকে ‘খলিফা' বলে ঘোষণা করেন এবং নিজ নামে মুদ্রা প্রচার করেন। তিনি আরবদেশের ওয়াহাবিদের মত ধর্ম কর আদায় আরম্ভ করেন। তিনি ওয়াহাবি আদর্শ অনুসারে লাহোরে মুসলিম পীরগণের নামে উৎসর্গীকৃত দরগাগুলো ভেঙে দেন। ১৮২৩ সালে তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধেমূল জেহাদ ঘোষণা করলেও আপাতত বিধর্মী শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ তীব্রতর করেন এবং পাঞ্জাবকে দারুল ইসলামে পরিণত করার সঙ্কল্প নেন। শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ পরিচালনার জন্যে তিনি বাংলা, পাটনা প্রভৃতি বিভিন্ন ওয়াহাবি কেন্দ্র থেকে মুজাহিদ ও অর্থ প্রেরণের নির্দেশ দেন। বহু মুসলিম যোদ্ধা এ উদ্দেশ্যে উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে যাত্রা করেন এবং অর্থ ভারতের নানা স্থান থেকে আসতে থাকে। এভাবে ওয়াহাবি শিখ যুদ্ধ আরম্ভ হয়, যা ভারতে মুসলিম শাসন পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
ভারতের অধুনা কোনো কোনো গবেষক ওয়াহাবি শিখ যুদ্ধকে নিছক ধর্মীয় যুদ্ধ বলে মনে করেন না। তাঁদের মতে, শিখ জমিদার, ভূস্বামী, জায়গিরদারদের বিরুদ্ধে উপজাতি মুসলিম কৃষকদের বিদ্রোহে সৈয়দ আহমদ নেতৃত্ব দেন। মূলত এটি ছিল কৃষক বিদ্রোহ। তবে ধর্মীয় প্রচার ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা প্রচার দ্বারা সৈয়দ আহমদ এ শ্রেণিসংগ্রামকে তীব্রতর করেন। সৈয়দ আহমদ পেশোয়ারের অত্যাচারী মুসলিম' শাসনকর্তার বিরুদ্ধে কৃষকদের সমর্থন জানান বলে প্রমাণ পাওয়া যায় ।
সৈয়দ আহমদ একাধারে ইংরেজ ও শিখদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ভাররবর্ষে মুসলিম শাসন পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। তাঁর মতে, ভারতবর্ষ যেহেতু ‘দারুল হারব’ কাজইে ব্রিটিশ শাসন অবসানের জন্য লড়াই করা বা কোনো মুসলিম দেশে হিজরত করা এদেশের মুসলমানদের জন্য ফরজ বা অবশ্য করণীয়। মূল পরাধীনতার কবল থেকে সমগ্র ভারতকে মুক্ত করাই ছিল সৈয়দ আহমদ শহীদের আসল লক্ষ্য। এভাবেই তাঁর সংগ্রাম প্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হয় ।
ভারতে উপর্যুক্ত উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সৈয়দ আহমদ শহীদ একটা স্থায়ী ও নিয়মিত সংগঠন গড়ে তোলেন। চারদিক থেকে অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র আসতে থাকে। হাজার
হাজার মুজাহিদ তাঁর নেতৃত্বে আস্থা স্থাপন করে। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে মুজাহিদদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২,০০০ হাজারে। প্রথম দিকে শিখ রাজা রণজিৎ সিং মুজাহিদদের অভিযানকে তেমন কোনো আমল দেননি। কয়েকটি যুদ্ধে শিখদের পরাজিত করে মুজাহিদরা পেশোয়ার দখল করে এবং সেখানে সৈয়দ আহমদ শহীদ একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলেন। বেশ কয়েকবার আক্রমণ চালিয়েও রণজিৎ সিং সুবিধে করতে পারেননি। ইতোমধ্যে মুজাহিদদের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে মুজাহিদরা দলে দলে পেশোয়ারে আসতে শুরু করে। এতে করে পেশোয়ারে এক শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত রচিত হলো। সৈয়দ আহমদ শহীদ উক্ত রাষ্ট্রের ইমাম হিসেবে আখ্যায়িত হন। কিন্তু অচিরেই পাঠানদের মধ্যে দলগত বিরোধ দেখা দেওয়ায় মুজাহিদরা ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ দুর্বলতার সুযোগে রণজিৎ সিং পেশোয়ার পুনরুদ্ধার করেন ।
অতঃপর সৈয়দ আহমদ শহীদ পেশোয়ার ত্যাগ করেন এবং কাশ্মীরে তাঁর কর্মকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর সামরিক কেন্দ্র বালাকোটে স্থানান্তর করেন। রণজিৎ সিং-এর পরাক্রমশালী খালসা বাহিনী সৈয়দ আহমদের কর্মকাণ্ড বানচালের উদ্দেশ্যে বালাকোট আক্রমণ করে। ফলে তুমুল যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধের ভয়াবহতা ছিল অত্যধিক। শিখ মুজাহিদদের সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় মুজাহিদরা পরাজিত হয় ৷
শিখ সেনাপতি শের সিং শিখ যুদ্ধের সময় বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহমদকে নিহত করেন। এ যুদ্ধে শাহ ইসমাইল সহ আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ওয়াহাবি নেতাসহ বহু সাধারণ ওয়াহাবি মুজাহিদ নিহত হন। এরপর ওয়াহাবিগণ পেশোয়ার ছেড়ে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সিতানা দুর্গকে কেন্দ্র করে তাঁদের জেহাদ চালাতে থাকে। উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের মতে, সিতানা থেকে ওয়াহাবিরা জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল ভারতীয়দের ইংরেজ ও তার সমর্থিত জামিদার জায়গিরদারদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের ডাক দেন। ১৮৪৯ খ্রি. পাঞ্জাব ব্রিটিশ শাসনে আসার পর ইংরেজের বিরুদ্ধে ওয়াহাবিরা জেহাদ পরিচালনা করে, যা প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এরপর ১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহের সময় ওয়াহাবিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোনো সক্রিয় ভূমিকা নেয় কিনা তা জানা যায়নি। তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ১৮৫৭ খ্রিঃ বিদ্রোহ যে তীব্র ইংরেজ বিরোধী বিক্ষোভ দেখা যায়, তার পশ্চাতে ওয়াহাবি প্রচার কাজ করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। ১৮৫৭ খ্রিঃ পর ব্রিটিশ সরকার আফগান সীমান্তে রুশ অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় পাঞ্জাব থেকে আফগানিস্তানের দিকে দৃষ্টি দেন। এর ফলে উত্তর পশ্চিম প্রদেশের সিতানায় ইংরেজ বিরোধী ওয়াহাবি ঘাঁটি ব্রিটিশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করা হয়। ১৮৬০ খ্রিঃ থেকে ইংরেজ সেনার সাথে ওয়াহাবিদের খণ্ড যুদ্ধ চলে। এর ফলে ওয়াহাবিদের আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৮৮০-৯০ এর দশক পর্যন্ত ওয়াহাবিগণ উপজাতিদের সহায়তায় প্রতিরোধ আন্দোলন চালান। ১৮৯০ খ্রিঃ ওয়াহাবি আন্দোরনের সমাধি ঘটে। তবে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনা জনগণের মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করে।
ওয়াহাবি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ
প্রতিরোধ আন্দোলন নিম্নবর্গের ইতিহাসে ওয়াহাবি আন্দোলন বহু ঘটন-অঘটনের জন্ম দিলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর ব্যর্থতার পেছনে বহু কারণ রয়েছে। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
ওয়াহাবি বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে দলত্যাগ করতে থাকে এবং সীমান্ত উপজাতিরা একেরপর এক আক্রমণ করতে থাকে। এসব অনবরত দলত্যাগ ও সীমান্তের উপজাতিদের আক্রমণাত্মক মনোভাব এসব কারণে ওয়াহাবি আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। আন্দোলনের ঘাঁটি হিসেবে সৈয়দ আহম্মদ উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল বেছে নিয়েছিলেন এবং উপজাতিদের সমর্থন ও সাহায্য পাবার আশাও তাঁর ছিল। কিন্তু উপজাতিদের অসহযোগিতা ও আক্রমণাত্মক মনোভাবের ফলে তাঁর আস্থা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এতে ওয়াহাবি আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ।
ওয়াহাবিদের কৌশলগত কিছু ভুল ছিল। কারণ সকল রকমের অস্ত্রশস্ত্র, অর্থ ও রসদের যোগানের জন্য ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত ঘাঁটিগুলোর উপর নির্ভর করে ওয়াহাবিরা মারাত্মক ভুল করেছিল। কারণ এ কেন্দ্রগুলো ছিল ইংরেজদের কৃপার উপর নির্ভরশীল এবং যে কোনো সময় অল্পায়াসেই এ কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করার ক্ষমতা ইংরেজদের ছিল। এসব ভুলের জন্য ওয়াহাবি আন্দোলনের পতন ত্বরান্বিত হয় ৷
আরও গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, ইংরেজদের ন্যায় এক বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাবার উপযোগী যুদ্ধসম্ভার ও আর্থিক সংগতি ওয়াহাবিদের মোটেই ছিল না। ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র আদর্শ ও অনুপ্রেরণাই যথেষ্ট ছিল না। কেয়ামউদ্দিন আহমেদের ভাষায় "In the final analysis it was the material superiority of the west which proved to be the deciding factor in the struggle against the wahabis." সুতরাং, উপর্যুক্ত কারণে ওয়াহাবি আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ৷
৮.৭ ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলাফল
ওয়াহাবি আন্দোলন ব্যর্থ হলেও প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে এর সুদূর প্রসারী ফলাফল রয়েছে। সৈয়দ আহমদের আন্দোলন ব্যর্থ হয় বটে, কিন্তু তাহা সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজে বিচ্ছিন্নতাবাদের সূচনা করে। যুগ যুগ ধরে হিন্দুদের সংস্পর্শে আসার ফলে মুসলিম সমাজে যে আচার আচরণ ও মতাদর্শের উদ্ভব ঘটেছিল তা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে হজরত মুহম্মদের যুগের ঐতিহ্য সর্বাংশে গ্রহণ করার কথা প্রচার করে সৈয়দ আদ ভারতীয় উপমহাদেশের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদের সূচনা করেন। “পবিত্র কোরআনে ফিরিয়ে দাও” সৈয়দ আহমদের এ প্রচার ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব পরিবেশের সূচনা করে। এর পর মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুদ্ধিজীবী ও পুরোহিত যা মোল্লাদের হাতে চলে যায়। অবশ্য একথাও স্বীকার করতে হয় যে, এ আন্দোলন মুসলিম সমাজের নবজাগরণের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পরবর্তীকালে শিক্ষিত মুসলিম সমাজ ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব পরিত্যাগ করে এবং আলিগড় আন্দোলন শুরু হলে এরা ‘ওয়াহাবি আন্দোলন' বর্জন করে আপাতত ইংরেজ সরকারের সমর্থকে পরিণত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ওয়াহাবি আন্দোলনের অনুসারীরা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও সচেতন হয়ে ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলে, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ।
আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, সৈয়দ আহমদ শহীদের শিক্ষা ও আদর্শ ভারতের বিভিন্ন স্থানে সংগ্রামী অনুসারীদের জন্ম দেয়। এ অনুসারীবৃন্দ সৈয়দ আহমদের মৃত্যুর পরও অকুতোভয়ে তাঁর আদর্শ ও জিহাদ পরিচালনা করেন। আদর্শ প্রচার করতে গিয়ে তাঁরা কখনো মৃত্যুভয়কে গ্রাহ্য করেননি। এদের এক অগ্নিপুরুষ ছিলেন বারাসাত জেলার তিতুমীর। তিনি ছিলেন বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনে এক খ্যাতনামা ২.রপুরুষ। তিনি ছিলেন বাংলার একজন ধর্মীয় ও সমাজসংস্কারক এবং স্বাধীনতার বীর সৈনিক। ব্রিটিশ বেনিয়া শক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে তিনিই সর্বপ্রথম বাঙালি শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। তাঁর এ আদর্শ ও আত্মত্যাগের মহান শিক্ষা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং ভারতকে স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত পথে এগিয়ে নিয়েছে। সুতরাং প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলাফল সুদূরপ্রসারী।
তিতুমীর ও ওয়াহাবি আন্দোলন
পলাশীর যুদ্ধের পর একশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলার মুসলমানেরা চরম অধঃপতনের সম্মুখীন হন। পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে মুসলমানেরা রাজ্যহারা হয়। সামরিক ও অন্যান্য লোভনীয় প্রশাসনিক চাকুরি থেকেও তারা বঞ্চিত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলায় যে স্বল্পসংখ্যক মুসলমান ছিলেন, তারাও তাদের জমিদারি হারান। ইংরেজরা তাদের শাসনের শুরু থেকেই মুসলমানদের সন্দেহের চোখে দেখত, কেননা তাদের কাছ থেকেই তারা বাংলার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল। আবার একই কারণে মুসলমানেরাও ইংরেজদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। ধর্ম, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে মুসলমানদের এই অধপতনের বিষয়টি কিছু সমাজ সংস্কারককে আলাড়িত করে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে কয়েকজন মুসলমান ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারকের আবির্ভাব হয়। এরা মুসলিম সমাজের প্রচলিত কুসংস্কারসমূহ দূর করে মুসলমানদের মধ্যে একটি ঐক্য সৃষ্টি করা এবং একই সাথে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য সামনে রেখে অগ্রসর হতে থাকেন। এই একই উদ্দেশ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রভাব বাংলাতেও লক্ষ করা যায়। তবে বাংলায় বিশেষ করে ইংরেজ নীলকর ও উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদার শ্রেণির অত্যাচার ও শোষণ নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচার জন্য দরিদ্র চাষি, তাঁতি ও জোলা শ্রেণি সশস্ত্র প্রতিরোধের দিকে অগ্রসর হয়। বাংলায় এই প্রতিরোধ সংগ্রামের অন্যতম নেতা ছিলেন ওয়াহাবি আদর্শের অনুসারী তিতুমীর। তিতুমীরের আসল নাম মীর নিসার আলী, কিন্তু তিতুমীর নামেই তিনি বেশি পরিচিত। ১৭৮২ খ্রি. চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসত মহকুমার চাঁদপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তিনি লেখাপড়া করেন গ্রামের এক মাদ্রাসায়। এ সময় থেকেই দুটি গুণের সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর মধ্যে; একদিকে তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ ও ধর্মপ্রাণ, অন্যদিকে তিনি ছিলেন শক্তিশালী ও অসম সাহসী। গ্রামেরই একটি ব্যায়ামাগারের অনুশীলন করে একজন কুস্তিগীর হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। এক সময় নদীয়ার জমিদারের অধীনে লাঠিয়ালের চাকরিও গ্রহণ করেন। ঊনচল্লিশ বছর বয়সে তিনি মক্কায় হজ করতে যান। সেখানে ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা সৈয়দ আহমদ বেরেলভির সংস্পর্শে এসে তিতুমীর তাঁর আদর্শ ও মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। চার বছর পর দেশে ফিরে এসে তিনি কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে অবশেষে নারিকেলবাড়িয়ার কাছে হায়দারপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এ সময়েই তিনি ধর্মসংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। স্থানীয় অনেক চাষি ও তাঁতি তাঁর অনুসারী হয় ।
ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন আর জমিদার শ্রেণির অত্যাচারে নিম্নবর্ণের মুসলমানেরা তখন বিপর্যস্ত ও সর্বস্বান্ত। এদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তিতুমীর প্রথমে মুসলমান সমাজে অনুপ্রবেশ করা বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার দূর করতে সচেষ্ট হলেন। পীর মানা, কবরের ওপর মাজার তৈরি করা, পীরের মাজারে গান-বাজনা, মৃতদের উদ্দেশ্যে শিরনি দেওয়া তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তাঁর শিক্ষা ছিল ইসলাম ধর্মের মৌল বিষয়গুলো নিষ্ঠার সাথে পালন করা আর অন্য ধর্মের যেসব কুসংস্কার ইসলাম ধর্ম প্রবেশ করেছে তা বর্জন করা। মুসলমান সমাজে প্রবেশ করা ইসলাম বিরোধী রীতিনীতির বিরুদ্ধেই তিতুমীরের আন্দোলনের সূচনা হয়। তিতুমীরের এই আন্দোলনের ফলে একদিকে যেমন তাঁর অনুসারী একটি দল সৃষ্টি হয়, আবার অপরদিকে মুসলমানদের মধ্যেও এমন অনেকে ছিলেন, যারা এসব রীতিনীতি বা কুসংস্কার ছাড়তে রাজি ছিলেন না। ফলে তিতুমীর ও তাঁর সংস্কারপন্থিদের সাথে ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরোধ দেখা দেয়। আবার তিতুমীরের অধীনে কৃষক-প্রজাদের সংগঠিত হতে দেখে হিন্দু জমিদারেরা তিতুমীরের সংস্কার আন্দোলনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফলে তিতুমীরের সাথে হিন্দু জমিদারদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে 1
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট জমিদারদেরকে সরকারের কাছে নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব পরিশোধ করতে হতো। এর ফলে জমিদারিতে তাদের একচেটিয়া অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে তারা চাষি রায়তদের কাছ থেকে ভূমি কর ও অন্যান্য কর আরোপ করে জোর জবরদস্তির মাধ্যমে আদায় করতো। অনেক সময় হিন্দু জমিদারেরা তাদের পূজা পার্বণের জন্যও প্রজাদের কাছ থেকে জবরদস্তি কর আদায় করতো; অনেক সময় তাদেরকে আটকও করতো। নারিকেলবাড়িয়ার অধিকাংশ প্রজা ছিল মুসলমান তাঁতি ও কৃষক, তাই তারা সংগঠিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে জমিদারদের অসন্তোষ বৃদ্ধি পায় এবং শিগগিরই উভয়পক্ষে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।
জমিদারেরা দাড়ির ওপর কার আরোপ করলে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই দাড়িকর তিতুমীর ও জমিদারদের মধ্যে সংঘর্ষের তাৎক্ষণিক কারণ। বিশেষ করে গুণিয়ার জমিদার রামানারায়ণ ও পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় দাড়িকর নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করেন। তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীরা এই কর দিতে অস্বীকার করলে জমিদার লাঠিয়াল পাঠিয়ে তাদের উপর হামলা করে। প্রজারা জমিদারদের বিরুদ্ধে থানায় নালিশ করে বারাসতে মামলা দায়ের করে। এমনকি কলকাতার কমিশনারের কাছে প্রতিকার চেয়েও তারা ব্যর্থ হয়। তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীরা বুঝতে পারে ইংরেজ সরকার জমিদারদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতেই বেশি আগ্রহী, চাষিদের ভালমন্দের ব্যাপারে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী একেবারেই উদাসীন। তাই তারা নিজেরাই প্রতিশোধ গ্রহণ করতে বদ্ধপরিকর হয় ।
তিতুমীরের দলের সাথে সংঘর্ষ বাঁধে জমিদারদের। নওঘাটার জমিদার দেবনাথ রায় তাদের হাতে নিহত হন। এরপর জমিদারদের সাথে আরও দুটি সংঘর্ষে তিতুমীরের বাহিনী জয়লাভ করে। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস এতো বেড়ে যায় যে, তারা ইংরেজদের ক্ষমতার কথা ভুলে ইংরেজ রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা করে। জমিদারেরা নীলকরদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, তিতুমীরের সংগ্রাম মূলত ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। জমিদারদের প্ররোচনায় মোল্লাহাটির নীলকর ডেভিস তিতুমীরকে আক্রমণ করে পরাজিত হয়। তিতুমীরের দল প্রতিশোধ নিতে নীলকুঠি আক্রমণ করে লুটপাট করে। এর ফলে আশপাশের এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি হয়। জামিদার ও নীলকর সাহেবেরা সরকারের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানায়। ইংরেজ সরকার অত্যন্ত দ্রুত সাড়া দেয়। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ নভেম্বর বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার ১২৫ জনের একটি পুলিশ বাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়ার পৌঁছলে তিতুমীরের দল হঠাৎ তাদের আক্রমণ করে। অপ্রস্তুত ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার তার দল নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও কয়েকজন সিপাহি ও বরকন্দাজ ঘটনাস্থলে নিহত হয়। এই বিজয়ে বিদ্রোহীদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। তারা আশপাশের নীলকুঠিগুলো লুট করে। এরপর নদীয়ার জেলা- ম্যাজিস্ট্রেট ২৫০ জন পুলিশ ও বেশ কিছু হাতি নিয়ে নারিকেলবাড়িয়া যান, জেলার নীলকর সাহেবরাও তাদের লোকজন নিয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু তিতুমীরের বিরাট বাহিনী ঢাল, তলোয়ার, লাঠি, বর্শা, সড়কি নিয়ে এই দলের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণ পরিচালনা করলে ম্যাজিস্ট্রেট তার দলবল নিয়ে পালিয়ে যান। এখানে সরকার পক্ষের অনেকে আহত হয় ৷
বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার কলিকাতা পৌঁছে সরকারকে পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করে তিতুমীরের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। ইংরেজ সরকার এবার আরও চিন্তিত হয়ে পড়ে; তার পুরো ব্যাপারটিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা বলে মনে করে। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকার নারিকেলবাড়িয়ায় একটি নিয়মিত ও শক্তিশালী বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অন্যদিকে, তিতুমীর ইংরেজ বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য নারিকেলবাড়িয়ায় একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে দেশি পদাতিক বাহিনীর ১১টি রেজিমেন্ট, কয়েকটি কামানসহ গোলন্দাজ বাহিনীর সেনাদল নিয়ে একটি শক্তিশালী বাহিনী নারিকেলবাড়িয়ায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে। কেল্লার বাইরে এসে তিতুমীর বীরবিক্রমে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। সুশিক্ষিত ইংরেজ বাহিনীর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে তিতুমীরের বাহিনী বিপর্যস্ত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কামানের গোলার আঘাতে স্বাভাবিকভাবেই তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। যুদ্ধ করতে করতেই তিতুমীর তাঁর প্রায় ৫০ জন অনুসারীসহ নিহত হন। বিদ্রোহীরা উপায়ন্তর না দেখে আত্মসমর্পণ করে। উন্মত্ত ইংরেজ সৈন্যরা তিতুমীর ও তাঁর সহযোগীদের মৃতদেহ জ্বালিয়ে দেয়। পরে কলকাতায় তিতুমীরের অনুসারীদের বিচার করা হয়। প্রহসনমূলক একতরফা এই বিচারে তিতুমীরের অনুসারীদের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিতুমীরের সেনাপতি গোলাম মাসুমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় । এভাবে এই বিদ্রোহের অবসান ঘটে।
তিতুমীরের এই আন্দোলনের স্বরূপ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। একে সংস্কার আন্দোলন, প্রজা বিদ্রোহ আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবেও চিত্রিত করা হয়েছে। তবে সম্পূর্ণ আন্দোলনটিতে এই তিনটি উপাদান সম্মিলিতভাবেই কাজ করেছে বলে মনে করা হয় । তিতুমীর ওয়াহাবি ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করার প্রচেষ্টাই প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। মক্কায় অবস্থানকালে তিনি ইসলামের মহান সংস্কারক সৈয়দ আহমদ বেরেলভির সান্নিধ্য লাভ করেন। দেশে ফিরে এসে তিতুমীর সমাজ সংস্কারে মনোযোগ দেন। এভাবেই তাঁর একদল অনুসারী গড়ে ওঠে এবং তিতুমীর এদের নেতৃত্ব দেন। তিতুমীরের আন্দোলনে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বহিপ্রকাশও ঘটেছিল। বিশেষ করে আন্দোলনের একটি পর্যায়ে কয়েকটি ধারাবাহিক সফলতার পর আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে তিতুমীর ও তাঁর দল এদেশ থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করে আবার মুসলিম শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতুমীরকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল বলে এই বিদ্রোহকে প্রজা বিদ্রোহও বলা হয়ে থাকে। তবে একে কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলা ঠিক হবে না। কেবলমাত্র ঘটনাচক্রেই জমিদারেরা তিতুমীরের অনুসারীদের কাজেকর্মে বাধা না দিলে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়তো হতো না। তিতুমীরের এই আন্দোলন শুধুমাত্র নারিকেলবাড়িয়া অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাদের এই সংহতি, চেতনা আঞ্চলিক সীমারেখা অতিক্রম করতে পারেনি। এ কারণে ইংরেজ শাসক ও দেশীয় জমিদারদের সম্মিলিত শক্তির পক্ষে অঞ্চলকেন্দ্রিক এই আন্দোলন দমন করা কঠিন হয়নি। অন্যদিকে ইংরেজদের উন্নততর রণকৌশল ও অস্ত্রের কাছে তিতুমীরের পরাজয় ঘটেছে। ইংরেজদের হাতে ছিল শক্তিশালী কামান, আর তিতুমীরের হাতে ছিল বাঁশের লাঠি। কাজেই বিদ্রোহের এই পরিণতি ছিল অনিবার্য।
তিতুমীরের সংগ্রাম সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এর গুরুত্ব অনেক। তার মৃত্যুর পরও স্বাধীনতা আন্দোলন ধারা থেমে থাকেনি বরং জোরদার হয়েছে।
বাংলায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনগুলোর মধ্যে ওয়াহাবি আন্দোলন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুসলিম সমাজ সংস্কার আন্দোলর হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে এটি বাংলার মানুষদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ৷
তিতুমীর ও ওয়াহাবি আন্দোলনকে নিম্নোক্ত শিরোনামে উপস্থাপন করা যায় :
i. তিতুমীরের পরিচিতি : প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে তিতুমীর একজন সংগ্রামী । তিতুমীরের আসল নাম ছিল মীর নিসার আলী খান। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে চব্বিশ পরাগণার বাদুড়িয়া থানার হায়দারপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল সৈয়দ হাসান আলী ও মাতার নাম রোকেয়া বেগম। ছোটবেলায় তিনি খুব সুদর্শন ও বলিষ্ঠ ছিলেন। বাল্যকালে তিনি গ্রামের এক মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেন এবং শীঘ্রই গ্রামের এক ব্যায়ামগারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনুশীলনের মাধ্যমে একজন কুস্তিগীর হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ১৮১৫ সালে তিনি কলিকাতায় একজন পেশাদার কুস্তিগীর হিসেবে বাস করেন। পরে তিনি নদীয়ার জমিদারের অধীনে একজন লাঠিয়াল হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন। লাঠিয়ালের চাকরি থাকাকালে একবার এক দাঙ্গা হাঙ্গামায় তিনি ধৃত হন এবং বিচারে তিনি কিছুকাল জেলে আবদ্ধ থাকেন। জেল থেকে মুক্তির পর তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন ।
সুদৃঢ় মনোবল, অসীম সাহসী ও শক্তিধর তিতুমীরের হৃদয় ছিল ধর্মীয় অনুভূতিতে সমুজ্জ্বল। অল্পবয়সে তিনি ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হন এবং মুসলমানদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পুনর্জাগরণে নিজেকে বিলিয়ে দেন। ১৮২২ খ্রিষ্টব্দে ৪০ বছর বয়সে তিনি হজব্রত পালনের জন্য মক্কায় গমন করেন। সেখানে তিনি আধ্যাত্মিক বিষয়ে জ্ঞানানুশীলনের সাথে সাথে রাজনৈতিক দীক্ষা লাভে সচেষ্ট হন। তিনি তদানীন্তন উত্তর ভারতের বিপ্লবী নেতা সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর সান্নিধ্যে আসেন এবং রাজনৈতিক চেতনায় পুষ্ট হয়ে ওঠেন। মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিনি একজন সমাজসেবক হিসেবে পরিচিতি হন। সমাজের বাস্তব চিত্র দর্শনে তাঁর ধর্মপ্রাণ মন কেঁদে উঠে। সমাজ থেকে সর্বপ্রকার দুর্নীতি, অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণ দূর করার জন্য তিনি বজ্রকঠিন শপথে উদ্দীপ্ত হন। সংগ্রামী চেতনা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে অতি ব্যাপকভাবে। রণোন্মদনা তাঁকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। আধ্যাত্মিক ও দৈহিক শক্তিতে বলীয়ান তিতুমীর ঝাঁপিয়ে পড়েন শোষক জমিদার ও ইতিহাসের জঘন্যতম অত্যাচারী ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে। অবশেষে সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ১৮৩১ সালে তিনি বাঙালিদের কাছে রেখে গেলেন এক শহিদি রক্তের তেজোদ্দীপ্ত অনুপ্রেরণা। প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে এভাবেই লিপিবদ্ধ হলো এক স্মরণীয় নাম ।

ii. তিতুমীরের ওয়াহাবি আদর্শ গঠন ও প্রচার : তিতুমীর ওয়াহাবি আদর্শ গঠন ও প্রচার করেন। মক্কায় সৈয়দ আহমদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর তিতুমীর ওয়াহাবি মতাদর্শ বাংলায় প্রচার আবম্ভ করেন। তিনি হায়দরপুর থেকে ওয়াহাবি সংস্কার আন্দোলন আরম্ভ করেন। ওয়াহাবি আদর্শের মূল কথা ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণ। এজন্যে তিতুমীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রচার করেন-
১. পীর পয়গম্বর মানার দরকার নেই ।
২. মন্দির মসজিদ তৈরির দরকার নেই । ৩. ফয়তা বা শ্রাদ্ধ শান্তির দরকার নেই । ৪. সুদে টাকা খাটান উচিত নয় ।
৫. তিতুমীর ধর্মপ্রচারক বা মৌলবিগণ, পীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নিষেধ
করেন এবং দরগা নির্মাণের প্রতিবাদ করেন ।
৬. তিতুমীর তাঁর আন্দোলনের নাম দেন শরিয়ত-ই-মহম্মদী। ওয়াহাবি
ধর্মশাস্ত্রে শিরাত-ই মুস্তাকিন তিনি মান্য করতেন ।
৭. তিতুমীর তাঁর আনুগামীদের এক বিশেষ ধরনের দাড়ি রাখার নির্দেশ দেন ৷
অবিভক্ত বাংলার জোলা, নাকারি, পটুয়া ও বাদ্যকর প্রভৃতি নিম্নশ্রেণির মুসলমানরা তিতুমীরের ধর্মমতের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিতুমীর ওয়াহাবি শিষ্যদের মধ্যে জোলা ও রায়ত চাষিরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। সকল শ্রেণি মুসলমান তাঁর মত গ্রহণ করেননি। বিলেতি কাপড়ের আমদানির ফলে বাংলার জোলা বা তাঁতিরা কর্মহীন ও বেকার হয়ে যান। তাঁদের তাঁতশিল্প ধ্বংস হয়। এজন্য এ শ্রেণি তিতুমীর আদর্শের মধ্যে এবং ধর্মমতের মধ্যে শোষণ মুক্তির সম্ভাবনা অনুভব করেন। কারণ তিতু প্রচার করেন যে, মুসলিমদের হাত থেকে ইংরেজ ভারতের রাজশক্তি কেড়ে নিয়ে ভারতবর্ষকে দারুল হারবে পরিণত করেছে। ওয়াহাবিরা ভারতবর্ষকে দারুল ইসলামে পরিণত করতে চান। ইছামতী নদীর উপত্যকা অঞ্চলে ২০-১৪ মাইল পরিধির মধ্যে গ্রামবাসীদের উপর তিতুর প্রভাব স্থাপিত হয়। তিনি জমিদারদের বিরুদ্ধে সাফল্যজনক সংগ্রাম রায়তদের অনুপ্রাণিত করে। তিতুমীরের প্রভাবে ওয়াহাবিগণ সাহসী ও বেপরোয়াভাবে তাঁদের মত প্রচার করেন এবং অন্য মতাবলম্বীদের সমালোচনা করেন বলে জানা যায় ৷
তিতুমীরের ওয়াহাবি মতাদর্শ সার্বজনীন ছিল না। তিতুর ওয়াহাবি মত সকল শ্রেণির মুসলিম গ্রহণ করেননি। বহু সুন্নি মুসলিম ছিলেন হানাফি মতের অনুরাগী এবং অনেকে ছিলেন পীর পয়গম্বরের ভক্ত। তাঁরা তিতুমীরের ওয়াহাবি ও মৌলভি মতের বিরোধিতা করেন । বহু মুসলিম মোল্লা ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা তিতুর ওয়াহাবি মতবাদে ভীত হন। কারণ তাঁদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও সম্পত্তির ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় ৷ স্থানীয় হিন্দু, মুসলিম জমিদাররাও ওয়াহাবিদের এ নবোদিত শক্তি ও নির্ভীক আচরণে শঙ্কা বোধ করেন। তাঁরা আশঙ্কা করেন যে, এর ফলে গ্রামাঞ্চলে তাঁদের প্রভাব কমে যাবে এবং জমিদারতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ড. বিনয় চৌধুরীর মতে, “ওয়াহাবিদের ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তি জমিদারশ্রেণির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।” সুতরাং তিতুর ওয়াহাবি আন্দোলনে সাধারণ মুসলিম রায়ত, জোলা, ঢালী, পটুয়া প্রভৃতি বঞ্চিত শ্রেণি যতই আকৃষ্ট হয়, ততই হিন্দু মুসলিম জমিদার, মহাজন শ্রেণি এমনকি নীলকরগণ ওয়াহাবিদের দমনের জন্যে বদ্ধপরিকর হয়। ওয়াহাবি বিরোধী মুসলিমগণ স্থানীয় জমিদারদের কাছে ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে থাকেন
দৃশ্যত ২৪ পরাগনার ও নদীয়ার অধিকাংশ প্রধান জমিদার ছিলেন হিন্দু। হিন্দু জমিদারগণ ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে যে দমননীতি নেন, তার পশ্চাতে কোনো সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল বলে মনে করা যায় না। কৃষকদের একাংশের মধ্যে ওয়াহাবি প্রভাবে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও পুরাতন ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থাকে তাঁরা জমিদার শ্রেণির লোক হিসেবে অসহনীয় মনে করেন। মুসলিম কৃষকদের মধ্যে যাঁরা ওয়াহাবি মতের অনুরাগী ছিলেন তাঁদের প্রতিই জমিদারদের ক্রোধ বর্ষিত হয়। সকল শ্রেণির মুসলিমদের প্রতি হিন্দু জমিদারদের দমন নীতি প্রযুক্ত হয়নি। কলভিন রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, একশ্রেণির মুসলিম কৃষক ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে জমিদারদের কাছে নালিশ করেন । ওয়াহাবিদের উপর জরিমরা ধার্য করে অর্থ আদায়ের সুযোগ জমিদারগণ গ্রহণ করেন বলে কথিত আছে।
iii. পুড়ার জমিদারদের ওয়াহাবি দমননীতি ও তিতুমীরের প্রতিরোধ : পুড়ার জমিদাররা ওয়াহাবিদের উপর দমনপীড়ন চালালে তিতুমীরে তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিতুমীর ইসলামের পবিত্রতার উপর গুরুত্ব দিলেও হিন্দু ধর্মের বিরোধী ছিলেন না। তবে তিনি হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ঐতিহাসিক থ্রনটন (Thronton) বলেছেন যে, “ওয়াহাবিদের ধর্ম সংস্কারের প্রতি হিন্দু জমিদারদের কোনো সহানুভূতি ছিল না।” অন্যদিকে তিতুমীরের ধর্মপ্রচারে সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী মুসলমান এবং মোল্লারা স্বভাবতই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেন। এ প্রচারের ফলে তাঁদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও সম্পত্তি উভয় ক্ষেত্রেই ঘোরতর বিপদ নিয়ে আসতে থাকে। সুতরাং তাঁরাও তিতুমীরের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। তিতুমীরের ওয়াহাবি আন্দোলন যতই বিস্তার লাভ করতে থাকে, ততই হিন্দু-মুসলমান জমিদার-মহাজন ও নীলকর সাহেবরা সমবেতভাবে ওয়াহাবিদের আন্দোলন দমন করতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং দমনপীড়ন চালাতে থাকে ।
দৃশ্যত সে সময় পুড়া গ্রামের জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী । তাঁরা প্রজাদের মধ্যে ওয়াহাবি আন্দোলন দ্রুত বিস্তৃত হতে দেখে তিনি অকথ্য অত্যাচার ও নিপীড়ন শুরু করেন এবং ওয়াহাবি প্রজাদের উপর জরিমানা ধার্য করেন । তিনি ওয়াহাবিদের বিশেষ ধরনের দাড়ির উপর দাড়ি পিছু ২.৫০ টাকা হারে জরিমানা ধার্য করেন। ওয়াহাবি দাড়ির উপর কর ধার্য করায় তিতু ক্রোধে জ্বলে উঠেন।” তিতুমীর বলেন যে, “আমাদের ধর্মের কথায় কথা কহিবার কাফেরের কোনো অধিকার নেই।” তিনি ওয়াহাবিদের জরিমানা দিতে নিষেধ করেন। কৃষ্ণদেব রায় দাড়ির উপর করের সাথে অন্যান্য আদেশও দেন। এগুলো নিম্নরূপ-
১. নতুন পাকা বাড়িতে ওয়াহাবি মসজিদ স্থাপনের জন্যে ১০০০ টাকা এবং
কাঁচা বাড়ির জন্যে ৫০০ টাকা কর দিতে হবে ।
২. তিতুমীরের শিষ্যদের আরবি নাম গ্রহণের জন্যে ৫০ টাকা কর দিতে হবে। ৩. কোনো হিন্দু তিতুমীরের সম্প্রদায়কে আশ্রয় দিলে তার জমি বাজেয়াপ্ত হবে ।
তবে আরও মজার ও হাস্যকর ব্যাপার হলো যে, কৃষ্ণদেব রায়ের সাথে যোগ দিয়ে অন্যান্য জমিদাররাও দাড়ির উপর কর ধার্য করেন। পুঁড়া গ্রামে দাড়ির খাজনা আদায়ের পর জমিদারের পাইক কোশান সিং ও আরও কয়েকজন সর্পরাজপুর গ্রামে এ কর আদায়ের জন্যে গেলে তিতুমীরের অনুগামীদের সাথে সংঘর্ষ হয়। একজন বন্দি হয়। এ ঘটনার পর কৃষ্ণদেব রায় ২/৩ শত লাঠিয়াল সহ সর্পরাজপুর গ্রাম আক্রমণ করেন এবং একটি কাঁচা ঘরের মসজিদ ভস্মীভূত করেন ও বেশ কয়েকটি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেন। ওয়াহাবি প্রজাদের হপ্তাম আইন অনুযায়ী কর প্রদান গাফিলতির অজুহাতে কাচারিতে এনে নির্যাতন করা হয়। সর্পরাজপুরের ঘটনার পর কলিঙ্গ থানায় দুই পক্ষ অভিযোগ দয়ের করেন। ইতোমধ্যে কৃষ্ণদেব রায় বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এজাহার দেন যে, তিনি সর্পরাজপুরের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তিনি তখন কলকাতায় ছিলেন। দারোগা রামরাম চক্রবর্তী হিন্দু জমিদারদের পক্ষ নিয়ে রিপোর্ট দেন যে, জমিদারকে বিপদের ফেলার জন্যে ওয়াহাবিরা নামাজ ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট এ রিপোর্ট গ্রহণ করে কৃষ্ণদেব রায়কে খালাস দেন। তিতুমীরের সমর্থকদের অভিযোগকে ম্যাজিস্ট্রেট কোনো গুরুত্ব দেননি। তিনি হিন্দু জমিদারদের পক্ষাপলম্বন করেন ৷
বাংলার সর্বত্র এরপর বিভিন্ন জমিদার ও নীলকররা জোটবদ্ধ হয়ে মৌলভী অর্থাৎ ওয়াহাবিদের উপর ব্যাপক নির্যাতন চালান। কলভিন রিপোর্ট অনুযায়ী ‘হপ্তাম’ আইনের ব্যাপক অপপ্রয়োগ দ্বারা ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও গ্রেফতার চালাতে থাকেন । তবে এসবের বিরুদ্ধে তিতুমীর প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ।
iv. তিতুমীরের পুড়া আক্রমণ ও তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা : তিতুমীর পুড়া আক্রমণ করে সেখানে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। উল্লেখ্য, মিস্কিন শাহ নামে এক ফকিরের সহায়তায় তিতুমীর লাঠিয়াল ও লোকজন যোগাড় করেন এবং ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে ৬ নভেম্বর পুড়া গ্রামে কৃষ্ণদেব রায়ের গৃহ আক্রমণ করেন। জমিদার বাড়ির প্রতিরোধে পিছু হটে তিতুমীর পুড়া গ্রামের বারোয়ারী তলায় একটি মন্দির আক্রমণ করেন এবং একটি গোহত্যা করে সে রক্ত মন্দিরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং এক পুরোহিত বাধা দিলে তাঁকে হত্যা করা হয়। এরপর দাঙ্গাকারীরা স্থানীয় বাজার লুট করে। পুড়ার দাঙ্গার পর তিতুমীর ঘোষণা করেন যে, কোম্পানির রাজত্বের অবসান হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায় কোম্পানির হাত থেকে তাঁদের হৃত রাজ্য ফিরে পেলেন। ও কিনলে (O'kinley) মতে, তিতুমীর গোড়া থেকেই পরিকল্পনা আনুযায়ী কাজ করেছিলেন। বাঙালিরা কোনো আন্দোলন করার আগে এ ধরনের গোলাযোগ ও প্রচার চালায়,
তিতুমীর তা থেকে বিরত থাকেন। তিনি যান্ত্রিক শৃঙ্খলায় ও নিঃশব্দে কোম্পানির সাথে চূড়ান্ত সংঘাতের জন্যে প্রস্তুতি নেন। ইংরেজ শাসন লোপ পেয়েছে, একথা ঘোষণার পর তিনি নিকটবর্তী হিন্দু জমিদারদের কাছে রাজস্ব দাবি করেন। মুসলিম কৃষক ও ওয়াহাবিদের উপর হিন্দু জমিদারদের নিষ্ঠুর কর আদায়ের বিরুদ্ধে এটি ছিল প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা। জমিদাররা এর ফলে জোটবদ্ধ হন এবং নীলকররাও তাঁদের সাথে যুক্ত হন। তবে তিতুমীর ও তাদের বিরুদ্ধে আরও সোচ্চারভাবে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন ৷
v. তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা : তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ ও নিজেকে স্বাধীন শাসক বলে ঘোষণা প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিখ্যাত ইতিহাসে একটি বিখ্যাত ঘটনা। তিতুমীরের সাংঠনিক ও সামরিক শক্তি দেখে ভীত সন্ত্রন্ত হিন্দু জমিদারগণ তাকে সমূলে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ হয় । গোবরডাঙ্গার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায়, তারাগণিয়ার জমিদার রামনারায়ণ, নাসরপুরের জমিদার গৌরপ্রসাদ চৌধুরী প্রমুখ জমিদার এবং ডেভিস সাহেবসহ অন্যান্য নীলকর সাহেবগণ সংঘবদ্ধ হয়ে তিতুমীরের বাহিনীকে আক্রমণ করতে উদ্যত হন। মোল্লাহাটির নীলকুঠির ম্যানজার ডেভিস সাহেরেব মিলিত বাহিনী তিতুমীরের বাহিনীর নিকট সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয় এবং পলায়ন করে। এ পরাজিত অত্যাচারী শাসক শোষকদেরকে আশ্রয় দান করায় তিতুমীর গোবনা গোফিদপুর গ্রামের জমিদার দেবনাথ রায়কে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে দেবনাথ রায় পরাজিত ও নিহত হন। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ অক্টোবর তিতুমীরের বাহিনী খাসপুর গ্রামের এক ধনী মুসলমানের গৃহ আক্রমণ করে তার সমস্ত সম্পদ কেড়ে নেয় । ক্রমশ নদীয়া ও চব্বিশ পরগনা জেলার গ্রামঞ্চলের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তিতুমীরের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিতুমীর নিজেকে ‘স্বাধীন শাসক' বলে ঘোষণা করেন এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে এটিই ‘বারাসাত বিদ্রোহ' (Barasat Mutiny) নামে খ্যাত। এভাবে তিতুমীর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন ৷
vi. নারিকেলবাড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা স্থাপন ও প্রতিরোধ : তিতুমীর কর্তৃক নারিকেল বাড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা স্থাপন ব্রিটিশ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। তিতুমীর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন যে, ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে প্রয়োজন সমর প্রস্তুতি ও উপযুক্ত সেনা প্রশিক্ষণ। সেনাবাহিনীর আত্মরক্ষার প্রয়োজনে তিনি একটি দূর্গ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেন। সময় ও অর্থাভাবে তিনি আপাতত কলিকাতার নিকটবর্তী নারিকেলবাড়িয়া নামক স্থানে একটি 'বাঁশের কেল্লা' বা দুর্গ নির্মাণ করেন। প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে এটিই ‘নারিকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লা' নামে বিখ্যাত। তাঁর প্রিয় সহচর গোলাম মাসুম ও মিসকিন শাহের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে প্রায় ৮৩ হাজার অকুতোভয় কৃষকসেনা সংগঠন। বিহারীলাল সরকার তাঁর ‘তিতুমীর' গ্রন্থে নারিকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এ রকম- “ভরতপুরের মাটির কেল্লার মতন সুন্দর, সুগঠিত, সুরক্ষিত, সুসজ্জিত না হোক-কেল্লার (বাঁশের) রচনা কৌশলময়, দৃশ্য সৌন্দর্যময়। কেল্লার ভেতর যথারীতি অনেক প্রকোষ্ঠ নির্মিত হয়েছিল। কোনো প্রকোষ্ঠে আহার্যদ্রব্য স্তরে স্তরে বিন্যস্ত ছিল-কোন প্রকোষ্ঠে তরবারি, বর্শা, সড়কি, বাঁশের ছোটবড় লাঠি সংগৃহীত ও সজ্জিত ছিল, কোনো প্রকোষ্ঠে স্তূপাকার বেল (কাঁচা) ও ইষ্টক খণ্ড সংগৃহীত হয়েছিল। এ কেল্লার কৌশল-কায়দা তিতুমীরের বুদ্ধি ও শিল্পচাতুর্যের পরিচায়ক। তিতুমীর ও তাঁর অনুচরবর্গের দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, এ কেল্লা বাঁশের হলেও প্রস্তর নির্মিত দুর্গ অপেক্ষাও দুর্জয় ও দুর্ভেদ্য। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি ।
vii. নারিকেলবাড়িয়ায় তিতুমীর ইংরেজ বাহিনীর ঐতিহাসিক সংঘর্ষ : নারিকেলবাড়িয়ায় তিতুমীর ও ইংরেজ বাহিনীর সংঘর্ষ প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ট্রাজিক ঘটনা। তিতুমীরের সংস্কার আন্দোলন কালক্রমে কৃষক বা প্রজা আন্দোলনে পরিণত হয়। কৃষকগণ সংঘবদ্ধ হয়ে তাঁর নেতৃত্বে দেশীয় শোষক এবং নীলকুঠির জুলুমবাজ কুঠিয়ালদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। তিতুমীরের নির্দেশে বিস্তীর্ণ এলাকার হিন্দু মুসলমান প্রজা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ঘটনার ব্যাপকতা এবং জমিদার কুঠিয়ালদেতর আবেদনে ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়ে ওঠে। তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের দমন করার জন্য বারাসতের মুগ্ম ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার ১২৫ জন সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে তিতুমীরের সামরিক কেন্দ্র নারিকেলবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হন। এক সংঘর্ষে সরকারি বাহিনী পরাজিত হয়; তাদের ১৫ জন নিহত ও অনেক আহত হয়। এরপর তিতুমীরের মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন এলাকার নীলকুঠিসমূহের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ভীতসন্ত্রন্ত কুঠিয়ালরা সপরিবারে কলিকাতায় পালিয়ে যায়। ১৭ নভেম্বর কৃষ্ণনগরের সৈন্যদলকেও পরাজিত ও বিতাড়িত করে দেয়। এরপর ইংরেজ সরকার আলেকজান্ডার ও মেজর স্কটের অধীনে পদাতিক, অশ্বারোহী ও বন্দুকধারী সৈন্যদের এক বিরাট বাহিনী পাঠান। এ বাহিনীতে কয়েকটি কামানও ছিল। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর নারিকেলবাড়িয়ায় এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ইংরেজদের কামান ও গোলাগুলির বর্ষণে বাঁশের কেল্লা বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তিতুমীর ও তাঁর চল্লিশ জন অনুচর নিহত হন। ইংরেজ সৈন্যগণ অনুচরদের মৃতদেহ পুড়িয়ে দেয়। যুদ্ধবন্দিদের বিচারে ১১ জনের যাবজ্জীবন এবং ১২৮ জনের বিভিন্ন সেনাদের কারদণ্ড হয়। নেসাপতি গোলাম মাসুমকে নারিকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লার সামনে ফাঁসি দেয় হয়। এরূপ ব্রিটিশ নিষ্ঠুরতায় নারিকেলবাড়িয়ায় তিতুমীরের প্রতিরোধের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে ।
প্রকৃতপক্ষে তিতুমীরের প্রজা আন্দোলন ছিল একটি গণবিপ্লব। কৃষক ও তাঁতিগণ এ আন্দোলনে যোগ দিয়ে জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল। অত্যাচার, অবিচার ও অপমানের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম সেদিন ব্যর্থ হলেও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামের (১৮৫৭ খ্রি.) প্রেরণা যুগিয়েছিল। এভাবে তিতুমীরের ওয়াহাবি বিদ্রোহের অবসান হলেও এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী ।
viii. তিতুমীরের ওয়াহাবি আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি : প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে তিতুমীরের বিদ্রোহ নিছক ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্ৰোহ অথবা কৃষক বিদ্রোহ ও ইংরেজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল কিনা এ বিষেয়ে দারুণ বিতর্ক দেখা যায়। সমকালীন লেখক বিহারীলার সরকার, কুমুনাথ মল্লিক প্রভৃতি তিতুমীরের আন্দোলনকে “ধর্মোন্মাদ মুসলমানদের কাণ্ড” এবং হিন্দু বিরোধী আন্দোলন রূপে দেখেছেন। ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতে, এ আন্দোলন ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর মুসলিম সম্প্রদায়ের আক্রমণ। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, তিতুমীরের আন্দোলন ছিল নিছক সাম্প্রদায়িক মুসলিমদের আন্দোললন। মুসলিমদের জন্যে, মুসলিমদের দ্বারা, মুসলিম কর্তৃক আন্দোলন। তিনি বলেছেন, “It was a movment of the muslims, by the muslims and for the muslims.” এ গ্রন্থে আরও বলেছেন যে, “বারাসত বিদ্রোহ ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় ভাবধারার সমান্তরাল আন্দোলন।” (It has both socio-economic and religious undertones running parallel throughout its course)। তিনি তিতুর আন্দোলনকে হিন্দু বিরোধী ও সাম্প্রদায়িক আন্দোলনরূপে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। তবে তাঁর বক্তব্য বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয় ৷
অপরদিকে থর্নটন, হান্টার প্রভৃতি লেখকের মতে, এ আন্দোলন সাম্প্রদায়িক ছিল না। কারণ ওয়াহাবিরা কেবলমাত্র হিন্দু জমিদারদের আক্রমণ করেননি, মুসলিম জমিদারদের তাঁরা অব্যাহতি দেননি। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তিতুমীরের আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন না। তিতুমীর সকল মুসলিমদের আস্থাভাজন ছিলেন না। বহু মুসলিম জমিদার ও কৃষক তিতুমীরের বিপক্ষে ছিলেন। সুতরাং আন্দোলনের সাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। আসলে তিতুমীর জমিদারদের হিন্দু হিসেবে আক্রমণ করেননি, অত্যাচারী বলেই আক্রমণ করেন। অপর দিকে, হিন্দু জমিদাররা দাড়ির উপর কর ধার্য করেন কোনো সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে নয়। গ্রাম সমাজে ওয়াহাবিদের উদীয়দমান ক্ষমতা ও প্রভাব দমনই ছিল এর উদ্দেশ্য। তাঁরা ভয় পান যে, ওযাহাবিদের দমন না করলে গ্রামগুলো ও প্রজাদের বশে রাখা যাবে না। ড. বিনয় চৌধুরী বলেন যে, “জমিদারি প্রভুত্বের বিরুদ্ধে ওয়াহবি প্রতিরোধ জমিদারদের ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করে প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের উপর আঘাতটি বড় কথা নয়, জমিদার শ্রেণির উপর আঘাতই ছিল মূলকথা। মোটামুটি ওয়াহাবি আন্দোলনকে শুধুমাত্র হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গোঁড়ামিযুক্ত সাম্প্রদায়িক আন্দোলন কখনই বলা যায় না। এ আন্দোলনের অর্থনৈতিক চরিত্রও পরিলক্ষিত হয়।
আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিক যথা নরহরি কবিরাজ প্রভৃতির মতে, ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের শ্রেণিসংগ্রাম। ক্যান্টওয়েল স্মিথ, কেয়ামউদ্দীন আহমদ জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহ রূপে ওয়াহাবি আন্দোলনকে দেখতে চেয়েছেন। একথা সত্য যে, তিতুমীরের বিদ্রোহ জমিদার ও নীলকর বিরোধী ছিল। কিন্তু গোড়ার দিকে তিতুমীর নীলকরদের বিরোধী ছিলেন না। নীলকররা জমিদারদের সমর্থন করায় তাঁরা তিতুমীরের রোষে পড়েন। সকল শ্রেণির কৃষক তিতুমীরের পক্ষে ছিলেন না। তথাপি ধর্মীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্দোলনটি ছিল প্রধানত এক কৃষক আন্দোলন। বয়ন শিল্প ধ্বংস হলে তাঁতি, জোলারা কর্মহীন হন। তাঁরা চাষাবাসের কাজে লিপ্ত ছিলেন। জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে তিতুমীরের আন্দোলনে তাঁরা মুক্তি ইঙ্গিত দেখতে পান। তিতুমীরের মধ্যে তাঁরা ‘অবতারত্ব’ বা মেসিয়ানিক নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ করেন। এজন্য তাদের বিশ্বাস ছিল যে, এ অলৌকিক শক্তির দ্বারা তিতুমীর তাঁদের জমিদার ও কোম্পানির হাত থেকে রক্ষা করবেন। সুতরাং তিতুমীরের আন্দোলনে সামন্ত শ্রেণির বিরুদ্ধে কৃষক শ্রেণির সংগ্রামী চরিত্রও ফুটে উঠে। তিতুমীরের আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রকৃতিও পরিলক্ষিত হয়। কেননা তিতুমীর গোড়ায় ইংরেজ বিরোধী না হলেও শেষ পর্যন্ত ইংরেজের বিরোধী হন। তিতুমীর নিজেকে বাদশাহ বলে ঘোষণা করেন। সুতরাং এ আন্দোলন কৃষক বিদ্ৰোহ ছাড়াও স্বাধীনতা সংগ্রাম। তিতুর বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় কারণ তিনি সকল শ্রেণির কৃষককে তাঁর পক্ষে আনতে পারেননি। তাঁর অনুচররা মাঝে মাঝে ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রকাশ করায় হিন্দুদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তিতুমীর কেবলমাত্র কয়েকটি গ্রাম নিয়ে তাঁর সংগঠন গঠন করায় আন্দোলনের ব্যাপকতা ছিল সীমাবদ্ধ। ব্রিটিশের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে তিতুমীরের জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল না। তিতুমীরের আধুনিক শিক্ষা না থাকায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা তাঁর মনে স্থান পায়নি ৷ তার পরিবর্তে তিনি মধ্যযুগের আদর্শ অনুসারে একটি মুসলিম রাজ্য স্থাপনের কথা ভাবেন। সকল শ্রেণির মুসলমান তাঁর পক্ষে ছিলেন না। এজন্য আন্দোলন ব্যর্থ হয়। আন্দোলন ব্যর্থ হলেও পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা যুগিয়েছিল ।
ওয়াহাবি আন্দোলনের সার্বিক বিশ্লেষণ
বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন বলতে মূলত “তরিকায়ে মুহাম্মদীয়া” আন্দোলনকেই বুঝায়। রায়বেরেলির স্বনামধন্য সৈয়দ আহমদ শহীদ ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে এই আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন। এই আন্দোলনের ইসলামি চেতনাবোধের কারণে অনেকে একে ‘মুজাহিদীন আন্দোলন'ও বলে থাকেন। আর ভারতীয় ইংরেজ প্রশাসন ইউরোপীয় লেখক এবং রক্ষণশীল ওলামাদের একাংশ একে ‘ওয়াহাবি' বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু সৈয়দ আহমদ শহীদ নিজে এর নামকরণ করেন ‘তরিকায়ে মুহাম্মদীয়া' । এই আন্দোলনের প্রতিপাদ্য ছিল আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ মোতাবেক জীবনযাপন করা। এটা অবিকল ফরায়েজিদের (১৮৩৮-৪৪) আদর্শও বটে। ১৮২১- ২২ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ আহমদ শহীদের দলবেঁধে হজ্জযাত্রা এবং ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ অধিকৃত ভারতবর্ষের বাইরে কোনো স্বাধীন মুসলিম দেশে থেকে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কঠিন ও কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া' আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান চত্বরে সন্নিবেশিত করে। এ দিক থেকে তিনি যখন পবিত্র মক্কায় হজ সমাপন করতে গমন করেন, তথায় বাংলার তিতুমীর ইসলামের মহান বাণী ও খাঁটি ইসলাম ধর্মপ্রচারের ব্রত নিয়ে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮২৭-১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিতুমীর পশ্চিম বাংলার নদীয়া ও চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকায় তরীকায়ে মুহাম্মদীয়ার একটি চমকপ্রদ আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিতুমীরের প্রকৃত নাম ছিল মীর নিসার আলী খান। ১৭৭২ খ্রি. পরগনার বাদুড়িয়া থানার চাঁদপুর গ্রামে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন। এ সময় বাদুড়িয়া নদীয়া জেলার অন্তর্গত ছিল ।
তিতুমীরের আন্দোলনকে প্রকারান্তরে ওয়াহাবি আন্দোলনেরই একটি প্রশাখা মনে করা হয়। ‘ওয়াহাবি' কথাটি সুদূরপ্রসারী অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘ওয়াহাবি' শব্দটির উৎপত্তি ও প্রয়োগ অপবাদমূলক। মক্কার মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের নামানুসারে ‘ওয়াহহাবী' কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। যদিও আবদুল ওয়াহাব তার আন্দোলনের নাম রাখেন তওহীদ বা একত্ববাদ এবং মুওয়াহহিদীন বা একত্ববাদীদের আন্দোলন। এ ওয়াহাবকে অপদস্ত করার লক্ষে বিরুদ্ধবাদী ব্রিটিশ ও তুর্কিরা এই আন্দোলনকে ওয়াহাবি নামে অভিহিত করেছেন। ওয়াহাবি বিরুদ্ধবাদীরাই মূলত ‘ওয়াহাবি' শব্দটির সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এর দ্বারা অবশ্য মুসলিম সমাজের রক্ষণশীল গোষ্ঠীর ধর্মীয় দর্শনকেও নির্দেশ করে। তদুপরি উল্লেখযোগ্য যে, ‘ওয়াহাবি' কথাটি ইংরেজিতে উচ্চারণ কটু হওয়ার কারণে ডব্লিউ. ডব্লিউ. হন্টার (W. W. Hunter) অতি সরলীকরণ করে একে ‘ওয়াহাবিতে' রূপান্তরিত করেন। এর ফলে ইংরেজি সূত্র অনুসরণ করে বাংলায়ও সংক্ষেপিত রূপে ‘ওয়াহাবি’ কথাটির বহুল প্রচলন ঘটে। আমরা এই বহুল প্রচলিত শব্দটি (ওয়াহাবি) কে আলোচনায় প্রাধান্য দিয়েছি ।
সামাজিক বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে আবদুল ওয়াহাবের সংস্কার নীতির চারটি স্তর ছিল, যথা : ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন। প্রকাশ্যত এটা ছিল ইসলামি পুনরুজ্জীবনবাদী সংস্কার আন্দোলন। বাংলার ফরায়েজি আন্দোলনের মূলনীতিগুলো আরবের মুয়াহিদুন আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তবে ‘ভারতীয়’ বলে কথিত ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া' আন্দোলনের অনুপ্রেরণার উৎস ছিল ভিন্নতর। আর তা হলো দিল্লির শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী। স্মর্তব্য যে, মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ প্রায় একই সময়ের দু'জন সংস্কারক। প্রথম জন আরবে এবং দ্বিতীয় জন দিল্লিতে কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত ছিলেন। এই দু'জনের মতবাদ ছিল যথেষ্ট নিকটবর্তী। কিন্তু দু'জনের কখনো সাক্ষাৎ ঘটেনি। আবদুল ওয়াহাব ছিলেন হাম্বলী মাযহাবপন্থি আর শাহ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন হানাফিপন্থি। ‘সুফীবাদ' সম্পর্কেও দু'জন দুউ মেরুতে অবস্থান করতেন। ভারতীয় ওয়াহাবিবাদের প্রবর্তক সৈয়দ আহম্মদ শহীদ ছিলেন শাহ ওয়ালী উল্লাহপন্থি। তাঁর সাথে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের মতবাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না অথবা আরবের মুয়াহিদুনদের সংস্পর্শেও তিনি আসেননি। তার সংস্কার আন্দোলনের নামও ছিল ভিন্ন। ফলে মার্কসবাদী লেখক সুপ্রকাশ রায়ের দাবি সঠিক নয় যে, সৈয়দ আহমদ শহীদ সম্পূর্ণভাবে আরবের ‘মুয়াহিদুন' আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন। এছাড়া ভারতীয় আহলে হাদীস আন্দোলনও এর একটি প্রশাখা মাত্র। অতএব, তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া ও আহলে হাদীস আন্দোলনকে নাম ও উৎপত্তির দিক দিয়ে আরবের ওয়াহাবি আন্দোলনের সাথে যুক্ত করা কিছুতেই সংগত নয়। যদিও এই আন্দোলনগুলোর উদ্দেশ্য ও লক্ষ ছিল প্রায় অভিন্ন। সুতরাং আমাদের শিরোনামায় ‘ওয়াহাবি ' আন্দোলন বলতে ভারতীয় ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ আন্দোলনকেই বিশেষভাবে বুঝানো হয়েছে। এই তরীকায়ে মুহাম্মদীয়ার প্রভাব বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাকেও প্রভাবিত করে। ১৮২৭ খ্রি. সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর সৈয়দ আহমদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বাংলায় ধর্মীয় ও সমাজসংস্কার আন্দোলন আরম্ভ করেন। এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে এবং কৃষক শ্রেণির আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে পরিণত হয় ৷
তিতুমীর কর্তৃক পরিচালিত ওয়াহাবি বিদ্রোহ (১৮৩১ খ্রি.) বাংলার কৃষক- সংগ্রামের ও প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট ঘটনা। এ বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে লিখিত ইতিহাসে ভিন্ন ভিন্ন মত লক্ষণীয়। প্রাচীনপন্থি লেখকদের অনেকে এই বিদ্রোহকে হিন্দু-বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা এবং ধর্মোন্মাদ মুসলমানের কাণ্ড বলে অভিহিত করেছেন। অথচ জমিদার-নীলকর গোষ্ঠীর শোষণ, উৎপীড়ন ও সামন্ততান্ত্রিক প্রভুত্বই যে মুসলমান ধর্মের অন্তরালে ব্যাপক কৃষক-বিদ্রোহ প্রতিরোধকে জাগিয়ে তুলেছিল-এ সত্য উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে তাঁদের পক্ষে একে সাম্প্রদায়িক বিদ্ৰোহ বলা অসংগত নয় ৷
ইংরেজ ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টার তিতুমীরের বিদ্রোহকে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের চত্বরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে জমিদারগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কৃষকের অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করেছেন। গবেষক G. Okenelly তাঁর The Wahabis in India গ্রন্থে বলেছেন যে, আন্দোলন জমিদারগোষ্ঠীর অত্যাচারে বিদ্রোহের আকার ধারণ করেছিল। Modern Islamic India গ্রন্থে এ বিদ্রোহকে জমিদার নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষক শ্রেণির সংগ্রাম রূপে ব্যাখ্যা করেছেন। মার্কসবাদী লেখক নরহরি কবিরাজ ও সুপ্রকাশ রায় প্রমুখের মতে, ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের শ্রেণিসংগ্রাম। কিন্তু তাদের বক্তব্য অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়। কেননা নেতৃত্ব ছিল বিত্তশালী জোতদারদের হাতে। সুতরাং মার্কসীয় মতে শ্রেণিসংগ্রাম বলতে যা বুঝায় তা তিতুমীরের বিদ্রোহে ছিল অনুপস্থিত। এ ধরনের শ্রেণিসংগ্রাম ১৯৪৬-৪৭ এ তেভাগা আন্দোলনে আমরা প্রথম লক্ষ করি। তা ছাড়া এ আন্দোলনে ওয়াহাবি কৃষকদের শ্রেণিচেতনা ছিল একান্তই গৌণ। সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক বা গোষ্ঠী চেতনা অন্যসব কিছুকে আচ্ছন্ন করেছে। কৃষক শ্রেণির সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষার ওয়াহাবিদের কোনো উদ্যোগ ছিল না। সুতরাং যারা এই বিদ্রোহে সাম্প্রদায়িক চরিত্র আবিষ্কারে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তারা বুঝতে অক্ষম যে, বাংলার মতো দেশে যেখানে সামন্ত প্রথার প্রাধান্য বর্তমান সেখানে জনসাধারণ অর্থাৎ কৃষকের ধর্মও জমিদার এবং শাসকগোষ্ঠীর শোষণের শিকারে পরিণত হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় জনসাধারণের সংগ্রাম ধর্মীয় বা অন্য যে কোনো স্লোগান নিয়ে আরম্ভ হোক না কেন, তা শেষাবধি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামে পরিণত হতে বাধ্য। এখন ইহা সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত যে, বাংলার তিতুমীরের নেতৃত্বে পরিচালিত কৃষক-অভ্যুত্থান, (১৮৩১ খ্রি.) প্রথমে ধর্মের আহ্বানে শুরু হলেও ক্রমশ তা দেশব্যাপী কৃষক-বিদ্রোহে পরিণত হয়েছিল। এটি ছিল শিল্প বিকাশের পূর্বযুগ ও প্রাক-ধনতান্ত্রিক যুগের গণসংগ্রামের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। শিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গণসংগ্রামে ধর্মের প্রভাব ক্রমশ বিলুপ্ত হতে থাকে ।
তিতুমীর হায়দরপুর থেকে ওয়াহাবি সংস্কার আন্দোলন আরম্ভ করেন। প্রথমে ধর্মের সংস্কার নির্ভর হলেও পরবর্তীতে ওয়াহাবি আন্দোলন দ্রুত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপ গ্রহণ করে। এই আন্দোলন যতোই বিস্তার লাভ করে, যতই জনসাধারণ এতে অংশগ্রহণ করে ততই এর ধর্মীয় চরিত্র বিলুপ্ত হয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা এর ধর্মীয় প্রভাবকে অস্বীকার করছি বা এ ক্ষেত্রে কম গুরুত্ব দিচ্ছি। এ দেশের মুসলমানদের অধিকাংশ‍ই ছিল নিম্নশ্রেণির হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত। তারা ইসলাম গ্রহণের ফলে হিন্দুর রীতিনীতি সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারেনি। সংস্কারের অভাবে অনেক বিধর্মীয় রীতিনীতি বংশ পরম্পরায় বিদ্যমান ছিল। এছাড়া অন্যান্য কারণেও হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক ঘনিষ্ঠতা ও সান্নিধ্যে ইসলামে নানা পাপাচার ঢুকে পড়ে। এ সকল কুসংস্কার দূর করার ব্রত নিয়েই ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হয়। ওয়াহাবি আন্দোলনের মূল কথা ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণ। তিতুমীর তার শিষ্যদেরকে বিশেষ ধরনের দাড়ি রাখার আদেশ দেন। জোলা, নাকারি, পটুয়া ও বাদ্যকর প্রভৃতি নিম্নশ্রেণির মুসলমানরা তিতুমীরের ধর্মমতের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। তাঁর প্রচারে অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে ইসলামের পার্থক্য বোধগম্য হয়। মুসলমানরা তাদের পূর্ব ঐতিহ্য সম্পর্কে সজাগ হয়, তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। তাদের চেতনা বৃদ্ধি পায়। এভাবে ধর্মকে ভিত্তি করে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হয় ।
ইংরেজ শাসনের শুরু থেকে ১৮৭০ খ্রি. পর্যন্ত মুসলমানরা ছিল ইংরেজ শাসনের আপসহীন শত্রু। এ সময়ে হিন্দু মধ্যবিত্তশ্রেণি ইংরেজের সহযোগী হয়ে সর্বক্ষেত্রে সুবিধাজনক স্থান অধিকার করে। আর মুসলমানরা নানা প্রকার বিদ্রোহের মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের মূলোচ্ছেদ করার প্রয়াস পায়। এজন্যই লর্ড ক্যানিং প্রশ্ন তুলেছিলেন এই যে, মহারানির শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাই কি মুসলমান ধর্মের অনুশাসন? সুতরাং ওয়াহাবি বিদ্রোহ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের চরম পর্যায়। বিদ্রোহের অবসানে বিদ্রোহী নায়কগণের স্বীকারোক্তি বিদ্রোহের রাজনৈতিক চরিত্র প্রমাণ করে। কলকাতার কলুটোলার বিখ্যাত ব্যবসায়ী আমীর খান মামলায় নিয়োজিত এডভোকেট অ্যানেস্টি তথ্য প্রমাণের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, এটা কোনো সাম্প্রদায়িক বিদ্রোহ নহে, এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীকার প্রাপ্তি। ড. বিপিন চন্দ্ৰ এই স্বাধীনতার বাণী স্বদেশি আন্দোলনের শতশত কর্মীকে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছেন। তিতুমীরের শিষ্যদের মধ্যে জোলা ও নিম্নশ্রেণির রায়ত চাষিরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সকল শ্রেণির মুসলমান তাঁর মত গ্রহণ করেননি। বিলাতি কাপড়ের আমদানির ফলে বাংলার জোলা বা তাঁতিরা কর্মহীন ও বেকার হয়ে পড়ে। তাদের তাঁত শিল্প ধ্বংস হয়। এজন্য এই শ্রেণি তিতুমীরের আদর্শের মধ্যে তাদের সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত খোঁজেন। কৃষক বা রায়তরাও ছিল শোষিত। এজন্য তাঁরা তিতুমীরের ধর্মমতের মধ্যে তাদের শোষণ মুক্তির সম্ভাবনা অনুভব করেন। কারণ তিতুমীর প্রচার করেন যে, মুসলিমদের হাত থেকে ইংরেজ রাষ্ট্রশক্তি কেড়ে নিয়ে ভারতবর্ষকে দারুল হরবে পরিণত করেছে। ওয়াহাবিরা ভারতবর্ষকে ‘দারুল ইসলামে' পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। এখানেই ওয়াহাবিদের রাজনৈতিক তত্ত্বের বিকাশ ঘটে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এই সকল রাজনৈতিক ক্রিয়া কলাপের কোনোটিই হিন্দু বিরোধী ছিল না। ইছামতি নদীর উপত্যকা অঞ্চলের ২০-২৪ মাইলের মধ্যে গ্রামবাসীদের ওপর তিতুমীরের প্রভাব স্থাপিত হয়। উত্তর ভারতে ওয়াহাবি নেতা সৈয়দ আহমদের শিখ-জমিদার বিরোধী সাফল্য বাংলায় রায়ত চাষিকে বিপ্লবে অনুপ্রাণিত করে। তিতুমীরের প্রভাবে ওয়াহাবিগণ সাহসী ও বেপরোয়াভাবে তাঁদের মত প্রচার করেন এবং অন্য মতাবলম্বীদের সমালোচনা করেন। নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ মুসলমানগণ এতে দলবেঁধে যোগদান করে যাদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু-মুসলমান কৃষক। ফলে বিদ্রোহের ধর্মীয় চরিত্র বদলে আর্থরাজনৈতিক চরিত্রই প্রধান হয়ে ওঠে। ওয়াহাবিদের অর্থনৈতিক দর্শনে ধর্মের প্রশ্নটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। কৃষকের মুক্তিসংগ্রাম একই সঙ্গে ইংরেজ, জমিদার-ইজারাদার-মহাজন ও নীলকরদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে পরিণত হয়। ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার এর মতে, ওয়াহাবিরা ছিল ধর্মীয় বিষয়ে ফরাসি বিপ্লবের অ্যানাবাপটিস্ট এবং রাজনৈতিক বিষয়ে কমিউনিস্ট বিষয়ে কমিউনিস্ট ও বিপ্লবী সাধারণতন্ত্রীদেরই অনুরূপ ।
তিতুমীরের ওয়াহাবি মতবাদ সকল শ্রেণির মুসলমান গ্রহণ করেননি। বহু সুন্নি মুসলিম ছিলেন হানাফি মতের অনুসারী এবং অনেকে ছিলেন পীর-পয়গম্বরের ভক্ত। তাঁরা তিতুমীরের ওয়াহাবি ও মৌলবি মতের বিরোধিতা করেন। বহু মুসলিম মোল্লা ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা তিতুমীরের ওয়াহাবি মতবাদে ভীত হয়। প্রকৃতপক্ষে মুসলমান ধনীদের অবস্থা হয়েছিল অপেক্ষকৃত অধিক শোচনীয়। কারণ এতে তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও অর্থ-সম্পত্তির ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ফলে তারা বিদ্রোহীদের বিপরীতে দণ্ডায়মান হয়। স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম জমিদাররাও ওয়াহাবিদের এই নবোদিত শক্তি ও নির্ভীক আচরণে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা আশঙ্কা করেন যে, এর ফলে গ্রামাঞ্চলে তাদের প্রভাব কমে যাবে এবং জমিদারতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো কোনো লেখক মনে করেন যে, “ওয়াহাবিদের ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তি জমিদার শ্রেণির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।” সমসাময়িক সরকারি বিবরণেও ওয়াহাবিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা সংখ্যায় ৮০,০০০ এদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই, সকলেই নিম্নশ্রেণির মানুষ । এদের ভয়ে কোনো দেশের ভূস্বামী গোষ্ঠীই শঙ্কিত না হয়ে পারে না। এই দিক হতে (অর্থনৈতিক) ওয়াহাবি বিদ্রোহ ছিল পূর্ণমাত্রায় শ্রেণিসংগ্রাম। এটি হতে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নটি ধীরে ধীরে অর্ন্তনিহিত হয়েছিল। সুতরাং তিতুমীরের ওয়াহাবি আন্দোলনে সাধারণ মুসলিম রায়ত, জোলা, ঢালী, পটুয়া প্রভৃতি বঞ্চিত শ্রেণি যতই আকৃষ্ট হয় ততই হিন্দু-মুসলিম জমিদার, মহাজনশ্রেণির এমনকি নীলকরগণও ওয়াহাবিদের দমনের জন্য বদ্ধপরিকর হয়। ওয়াহাবি বিরোধী মুসলিমগণ স্থানীয় জমিদারদের কাছে ওয়াহাবিদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে থাকে। এ সুযোগে অর্থ উপার্জনের মনোবৃত্তি নিয়ে জমিদারশ্রেণি ওয়াহাবিদের উপর জরিমানা ধার্য করে। এই প্রকার জরিমানা আদায় হতেই ব্যাপক সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
ওয়াহাবিরা ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে জমিদারের হস্তক্ষেপ অস্বীকার করে। প্রজাদের নিঃশর্ত আনুগত্য পেতে অভ্যস্ত জমিদার ওয়াহাবিদের এ আচরণে অপমানিত বোধ করে। ফলে কোনো কোনো জমিদার নানা অজুহাতে বিভিন্ন প্রকারের করের দাবি নিয়ে ওয়াহাবিদের সামনে এসে হাজির হয় এবং বিদ্রোহের অন্যতম কারণ বলে মনে হয় । অন্যভাবে ওয়াহাবিদেরকে হেনস্তার চেষ্টা করে ৷
পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদের রায় এ বিষয়ে হিন্দু জমিদারদের মুখপাত্র ছিলেন । তিনি ওয়াহাবিদের বিশেষ ধরনের দাড়ি প্রতি ২.৫০ টাকা কর ধার্য করেন। দাড়ির ওপর করারোপের ফলে তিতুমীর ক্রোধে জ্বলে ওঠেন। তিনি ধর্মে কারো-হস্তক্ষেপ অন্যায় রায় দেন এবং এই কর দিতে নিষেধ করেন। অবশ্য এটা সন্দেহাতীত যে, দাড়ির জরিমানা থেকে চূড়ান্ত সংঘর্ষ ক্রমে অনিবার্য হয়ে পড়ে। বারাসত বিদ্রোহের সমসাময়িক অনেক বিবরণে এর উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। তিতুমীরে সহযোদ্ধা সাজন গাজী রচিত বা সংকলিত তিতুমীরের গান, নামক পুথি থেকে গিরীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করেছেন-
“নামাজ পড়ে দিবারাতি
কি তোমার করিল খেতি
কেন কল্লে দাড়ির জরিপানা ।'
কৃষ্ণদেব এছাড়াও নতুন পাকা বাড়ীতে ওয়াহাবি মসজিদ স্থাপনের ওপর এক হাজার টাকা এবং কাঁচা বাড়িতে পাঁচশত টাকা কর নির্ধারণ করেন। সেই সাথে ওয়াহাবিদের আরবি নামকরণের ফি বাবদ পঞ্চাশ টাকা নির্ধারণ করেন এবং কোনো হিন্দু কোনো ওয়াহাবিকে আশ্রয় দিলে তার জমি বাজেয়াপ্তের ঘোষণা দেন। কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে যোগ দিয়ে অন্য জমিদাররাও দাড়ির ওপর কর ধার্য করেন। কোলডিন রিপোর্টে স্বীকার করা হয়েছে যে, কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক ধার্যকৃত দাড়ি কর ছিল গোলযোগ সৃষ্টির তাৎক্ষণিক কারণ। পুড়া গ্রামে দাড়ির কর আদায়ের পর জমিদার- পাইক কোশান সিং সর্পরাজপুর গ্রামে এই কর আদায়ের জন্যে গেলে ওয়াহাবিদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। এর প্রতিবাদে জমিদার কৃষ্ণদেব সর্পরাজপুরে কয়েকটি মসজিদ ও বেশ কয়েকটি বাড়ি পুড়িয়ে দেন। এ সময় ওয়াহাবি প্রজাদের সাথে সংঘর্ষ হয়। কিন্তু জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়নি। মসজিদ পোড়ানোর প্রতিবাদে ওয়াহাবিরা স্থানীয় আদালতে আর্জি জানায়। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। কারণ তদন্তকারী দারোগা রিপোর্ট দেয়, জমিদারকে বিপদে ফেলার জন্য ওয়াহাবিরাই মসজিদ পুড়িয়েছে। জমিদাররা ‘হপ্তাম আইন' অনুযায়ী বাকী খাজনার অজুহাতে ওহাবি প্রজাদের উপর জুলুম নির্যাতন করে। ওয়াহাবিদের অভিযোগ সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেট কোনো গুরুত্ব দেননি। ড. এ. আর মল্লিক মূল দলিলপত্র পরীক্ষা করে প্রমাণ করেন যে, বারাসতের ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট ১৭৯৩

খ্রিষ্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধার মোতাবেক জমিদারদের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করা যুক্তিযুক্ত মনে করেননি। তাই ম্যাজিস্ট্রেট লোক দেখানো রায় প্রদান করে মামলা খারিজ করে দেন। বরং শান্তিপূর্ণ বসবাসের শর্তে মুসলমানদের নিকট হতে মুচলেকা নেওয়া হয়। তখন তিতুমীর অনুসারীরা দারোগার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ দু'দফা আবেদন জানান এবং কলকাতায় কমিশনারের কাছে প্রতিকার চাইতে যান । যখন এতে ও কোনো সুফল হয়নি তখন তারা প্রতিকারের ভাব নিজেদের হাতে নেন। এ ঘটনার পর হতে জমিদার গোষ্ঠী ও ইংরেজ সরকারের সাথে তিতুমীরের এক আপসহীন সংগ্রাম আরম্ভ হয়। আলিপুরের জজ-ওকেনলি এর সত্যতা স্বীকার করেছেন। এ সময় তিতুমীর ওয়াহাবি দলভুক্ত মুসলমানদের সংহতির উপর জোর দেন। তিনি অনুসারীদের অর্থ সাহায্যে নিয়ে রসদপত্র ও অস্ত্রশস্ত্র-সংগ্রহ করে নারকেলবেড়িয়াতে মজুদ করেন।
এরপর বিভিন্ন জমিদার ও নীলকরেরা জোটবদ্ধ হয়ে ওয়াহাবিদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়। কোলডিন রিপোর্ট অনুসারে ‘হপ্তাম’ আইনের ব্যাপক অপপ্রয়োগে ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও গ্রেফতার চলতে থাকে। মিস্কিন শাহ নামে এক ফকিরের সহায়তায় তিতুমীর লাঠিয়াল বাহিনী যোগাড় করে পুড়া গ্রামে জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়ী আক্রমণ করেন। কিন্তু জমিদারের প্রতিরোধে তিনি পিছু হটেন । ফিরতি পথে পুড়া গ্রামের বারোয়ারী তলায় একটি মন্দির আক্রমণ করে এতে গরুর রক্ত ঢেলে দেওয়া হয়। এক পুরোহিত বাধা দিতে এলে তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনাকে কোনো কোনো ঐতিহাসিক সাম্প্রদায়িকতার বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আক্রমণকারী দল স্থানীয় বাজার এবং ওয়াহাবি বিরোধী ধনী মুসলমানের গৃহও এ সময়ে লুট করে। পুড়ার ঘটনার পর তিতুমীর ঘোষণা করেন যে, অবৈধ দখলদার কোম্পানির রাজত্বের অবসান। মুসলিম সম্প্রদায় কোম্পানির হাত থেকে তাদের হৃত রাজ্য ফিরে পাবে। তিতুমীর হবেন মুসলিম শাসনের নতুন প্রতিনিধি। ওয়াহাবিরা অবলীলায় এ ঘোষণা চারদিকে ছড়িয়ে দেন। এর সামাজিক দর্শন মৌলিকত্ব হয়তো বিশেষ কিছু ছিল না; কিন্তু জমিদারি অপশাসন ক্লিষ্ট কৃষককুলের কাছে এ প্রচারের মূল্য ছিল অপরিসীম। বিশেষ করে এ প্রচার ছিল একেবারে সাম্প্রতিক। বিশেষ এক পরিবেশে, বিশেষ এক ব্যক্তিত্বের ছোঁয়ায় অতি পরিচিত কথাও কখনো কখনো প্রাণময় ও গভীর অর্থবহ হয়ে ওঠতে পারে। তিতুমীরের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল।
তিতুমীর গোড়া থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেছিলেন। বাঙালিরা কোনো আন্দোলন শুরু করার আগে যে ধরনের গোলযোগ ও প্রচার চালায়, তিতুমীর তা থেকে বিরত থাকেন। তিনি যান্ত্রিক শৃংখলার ও নিঃশব্দে কোম্পানির সঙ্গে চূড়ান্ত সংঘাতের জন্যে প্রস্তুতি নেন । ইংরেজ শাসন লোপ পেয়েছে এ কথা ঘোষণার পর তিনি নিকটবর্তী হিন্দু জমিদারদের কাছে রাজস্ব দাবি করেন। মুসলিম কৃষক ও ওহাবিদের ওপর হিন্দু জমিদারদের নিষ্ঠুর কর আদায়ের বিরুদ্ধে এটি ছিল প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা। জমিদাররা এর ফলে জোটবদ্ধ হন এবং নীলকররাও তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। গোবরডাঙ্গার জমিদার কালি প্রসন্ন মুখোপাধ্যার ও মোল্লাহাটির নীলকর ডেভিস তিতুমীরের বাহিনীকে আক্রমণ করে পরাস্ত হন। ডেভিস প্রাণে রক্ষা পান। লাউঘাটির জমিদারের সঙ্গে তিতুমীরের সংঘর্ষে জমিদার দেবনাথ রায় (১৮৩১ খ্রি.) নিহত হন। এই সময় তিতুমীরের অলৌকিক শক্তির গল্প পল্লবিত হয়ে অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের মধ্যে ছড়াতে থাকে । গ্রাম্য কবি সাজনগাজী এই উপলক্ষে গান বাঁধেন এবং তা মুখে মুখে প্রচার করেন। তিতুমীরের শক্তি ও প্রভাব দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। বিদ্রোহীরা জমিদার, মহাজন, নীলকর ও ওয়াহাবি বিরোধীদের কাছে রাজস্ব দাবি করেন। রাজস্বের দাবি আসে ধনাঢ্য মুসলমানদের উপর। তিতুমীরের বিরুদ্ধে জমিদার দেবনাথ রায়কে প্ররোচিত করেছিলেন। নীলকরের প্রজাগণ খাজনা প্রদান বন্ধ রাখে। নদীয়া ও চব্বিশ পরগণার এক বিশাল অংশের পুলিশ বাহিনী পালিয়ে যায় এবং সেখানে তিতুমীরের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিতুমীর আশংকা করেন যে, শেষাবধি তার সঙ্গে কোম্পানির সংঘাত অনিবার্য। এ জন্য তিনি চব্বিশ পরগণার নারকেলবাড়িয়া গ্রামে ভারতপুরের জাঠদেব অনুকরনে বাঁশের তৈরি এক সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করেন ও প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্র যোগাড় করেন। আর বিদ্রোহী-বাহিনী (গেরিলা বাহিনী) পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ভাগ্নে গোলাম মাসুমের উপর। এই সময় তিতুমীর নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। এই ‘বাদশা’ ‘মুঘল-নবাবি' শাসনের প্রতীক বলে মনে হয়। মুইজুদ্দিন বিশ্বাস নামে এক ধনী মুসলমানকে উজির এবং সাজন গাজীকে খলিফার দেহরক্ষী নিয়োগ করেন। নিস্কিন শাহ পাগলকে গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় ।
এ দিকে ভীত-সন্ত্রস্ত জমিদার ও নীলকররা তিতুমীরের হাত থেকে তাদের রক্ষার জন্যে একত্রে সরকারের কাছে বিশেষত নদীয়া ও বারাসতের ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট এবং পরে বাংলার ছোট লাটের নিকট প্রার্থনা জানান। কোম্পানির বাহাদুরের বিরুদ্ধে তিতুমীরের বিদ্রোহ ঘোষণার কথা সরকারের গোচরে আনা হয়। প্রথম দিকে কর্তৃপক্ষ তিতুমীরের বিদ্রোহের কথা অবিশ্বাস করলেও বারাসত ও নদীয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকার তিতুমীরের বিদ্রোহ সম্পর্কে অবহিত হন। বিদ্রোহ দমনের জন্য বারাসতের ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার (১৫ নভেম্বর ১৮৩০) ও নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট এডওয়ার্ড স্মিথের তেতৃত্বে দুটি অভিযান প্রেরণ করে ব্যর্থ হয়। এ সময়ে কুখ্যাত দারোগা রাম দাশকে হত্যা করা হয়। এতে ওয়াহাবিদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। নীলকুঠি ধ্বংস করা হয়। নীলকরগণ কলকাতায় পালয়ন করে। বিদ্রোহীরা হুগলিতে অবস্থিত মি. স্টর্মের একটি ফ্যাক্টরি দখল করেন। এই ফ্যাক্টরির ম্যানেজার মি. হেনরি ব্লন্ড ও তার পরিবারকে বন্দি করে বাঁশের কেল্লায় আনা হয়। তিতুমীরের জন্যে নীল উৎপাদন করার শর্তে মি. ব্লন্ডকে মুক্তি দেওয়া হয়। এই সময় ভূষণার অপ্রাপ্ত বয়স্ক জমিদার মনোহর রায় ও তিতুমীরের দলভুক্ত হয়ে শক্তি সামর্থ্যে এবং অর্থবিত্তে তিতুমীরকে সাহায্য করেন। ইতিপূর্বে ওয়াহাবি আন্দোলন, তিতুমীরের বাদশাহ উপাধি গ্রহণ, ইংরেজ-জমিদার শক্তির পরাজয়ের সংবাদ কলকাতায় তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে জানানো হলো। তাঁর আদেশে কলকাতার কর্তৃপক্ষ দশম পদাতিক বাহিনীকে কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে প্রেরণ করেন। ইতোমধ্যে তিতুমীরের অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে কল্প কাহিনীর প্রসার ঘটে। মিস্কিন শাহ প্রচার করেন যে, তিনি ইংরেজের কামানের গোলা গিলে হজম করতে পারেন। কর্নেল স্টুয়ার্ট নারকেলবেড়িয়া কেল্লার সামনে এসে তিতুমীরকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। এই আদেশ অগ্রাহ্য করা হয়। তিনি গোলার আঘাতে দুর্গটি উড়িয়ে দেন। তিতুমীর গোলার আঘাতে এই দুর্গেই মৃত্যুবরণ করেন (১৯ নভেম্বর ১৮৩১ খ্রি.)। বিদ্রোহী পক্ষে প্রায় ৬০ জন নিহত হয় এবং ৮০০ জন বন্দি হয়। বন্দিদের সংখ্যা নিয়ে যথেষ্ঠ মতপার্থক্য রয়েছে। আই. আর. কোলডিনের রিপোর্টে, বন্দিদের সংখ্যা ছিল ২২৮ জন, মি. বারওয়েলের পরামর্শে মি. আলেকজান্ডার ভবিষ্যৎ বিপদ এড়ানোর জন্য মৃতদেহগুলোকে পুড়িয়ে ফেলেন। বন্দিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়। আলীপুর আদালতে তাদের বিচার কার্য চলে। দীর্ঘ বিচারের পর সেনাপতি গোলাম মাসুমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৪০ জন বন্দিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বাঁশের কেল্লা থেকে একটি পতাকা পাওয়া যায়। মি. আই. আর. কোলডিনের হাতে দেওয়া হয় বিষয়বস্তু উদ্ধারের জন্য। এটাতে এমন কিছু লেখা ছিল যা সার্বভৌমত্বের প্রতীক বলে মনে হয়। কিন্তু কোলডিন এ ব্যাপারে পরবর্তীতে কোনো কিছুই উল্লেখ না করায় বিষয়টি তমশাচ্ছন্ন থেকে যায়। সরকার বারাসত বিদ্রোহের বিষয়টি পূর্ণ তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় মি. আই. আর. কোলডিনের উপর। মি. কোলডিন সংঘর্ষের উৎস, কারণ ও বিস্তার সম্পর্কে পূর্ণ তদন্ত শেষ করে ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে রিপোর্ট পেশ করেন। এই রিপোর্টই হচ্ছে এ বিদ্রোহ সম্পর্কে একপ্রকার প্রামাণ্য দলিল। তবে রিপোর্টে কোলডিন একটি আর্থসামাজিক-সংগ্রামকে শুধুমাত্র ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলনরূপে চিহ্নিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন যা রিপোর্টের অন্যতম দুর্বল দিক ।
তিতুমীরের বিদ্রোহ নিছক ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক কৃষক বিদ্রোহ বা ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল কি না এ বিষয়ে বিতর্ক বিদ্যমান। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার এই বিদ্রোহকে একটি ‘সাম্প্রদায়িক' চরিত্র দেবার চেষ্টা করেছেন। তবে তিনি একা নন। এই মত খণ্ডন করে আধুনিক গবেষক ড. অভিজি দত্ত তাঁর ‘Muslim Society in Transition' গ্রন্থে বলেছেন যে, বারাসত বিদ্রোহ ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় ভাবধারার সমান্তরাল আন্দোলন। এর কোনো একটি দিক বাদ দিলে এই বিদ্রোহ মূল্যায়নে অপূর্ণতা থেকে যাবে। তার এই বক্তব্যের সমর্থন পাই থর্নটন ও হান্টার প্রমুখের লেখায়। সুতরাং এর সাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে বক্তব্য দীর্ঘায়িত করার সুযোগ নেই। আসলে জমিদারি প্রভুত্বের বিরুদ্ধে ওয়াহাবি প্রতিরোধ ছিল সশস্ত্র প্রতিবাদ। এক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের উপর আঘাতটি বড় কথা নয়, বরং জমিদারশ্রেণির আর্থিক স্বার্থের ওপর আঘাতই ছিল মূলকথা। এই আন্দোলনটির বিশেষ দিক ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। সুতরাং ধর্মীয় প্রশ্নে এ প্রতিবাদের উদ্ভব হলেও সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে একে বিচ্ছিন্ন করে দেখা অসমীচীন। পক্ষন্তরে এ আন্দোলনকে ধর্মীয় আবরণে কোনো বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ মনে করাও ভুল হবে। আসলে ওয়াহাবি চৌহদ্দি পেরিয়ে এ প্রতিরোধ বৃহত্তর কোনো আন্দোলনে পরিণত হতে পারত না যদি না ধর্ম ছাড়াও অন্যান্য কারণে অর্থাৎ প্রজা সাধারণের আর্থিক ও সামাজিক সুবিধা স্থান না পেত ।
এই বিদ্রোহ যে সুসংগঠিত ছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিদ্রোহীরা ঝোঁকের মাথায় কিছু করেনি। তারা কি করতে যাচ্ছে, তা তারা পরিষ্কার জানত । শুরুতে লুটতরাজের ঘটনা বিশেষ ঘটেনি। জমিদার বিরোধিতাই বিদ্রোহের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। রাজ বিরোধী লক্ষণ ক্রমেই প্রকট হয়ে ওঠে। নারকেলবেড়িয়ায় বাঁশের কেল্লায় ওয়াহাবিদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে একটি পতাকাও ওড়ানো হয়েছিল। তিতুমীর নিজেকে ‘বাদশা' বলে ঘোষণা করেন। প্রচলিত মতে, মুইজুদ্দিনের (এক জন ধনী কৃষক) বাড়ীতে-ই-মহাসমারোহে তিতুমীরের অভিষেক হয়। ওয়াহাবি রাজ পরিচালনার নানা দায়িত্ব তিতুমীর বিশ্বস্ত এবং নিকট শিষ্যদের উপর অর্পণ করে। সম্ভবত বাদশাহি কর্তৃত্বের অঙ্গ হিসেবে তিতুমীর স্থানীয় জমিদারদের কাছে রাজস্ব দাবি করেন। ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে বারাসত ও নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেটদের ব্যর্থতায় তাদের এ বিশ্বাস আরও সুদৃঢ় হয় যে, ওয়াহাবি-রাজ-প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। শুধুমাত্র সাংগঠনিক নৈপুণ্যই ওয়াহাবিদের আত্মবিশ্বাসের প্রধান উৎস ছিল না। তাদের উপর অন্যান্য প্রভাবও সক্রিয় ছিল। বিশেষ করে নৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব। শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আসলে তাদের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ এবং পবিত্র কর্তব্য ছিল। সাজন গাজীর গানেও এ বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটেছে। ওয়াহাবিদের আত্মবিশ্বাসে আরও ছিল সংকট মুহূর্তে এক পরিত্রাতার আবির্ভাব হবে। এ বিশ্বাস সংগঠনকে প্রভাবিত করে। এ বিশ্বাস আসে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে বালাকোটের যুদ্ধে ওয়াহাবি নেতা সৈয়দ আহমদের মৃত্যুর রহস্য থেকে। এই অতিপ্রাকৃত শক্তির ধারণা সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস ছিল ব্যাপক । একথা তারা প্রকাশ্যে প্রচার করতো। তবে তিতুমীর নিজে এ শক্তির অধিকারী বলে দাবি করেননি ।
ইংরেজ শক্তির সাফল্যের বিপরীতে বিদ্যমান ছিল তিতুমীরের ব্যর্থতার কারণগুলো। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই বিদ্রোহের পরাজয় ঘটে। এই বিদ্রোহে সকল শ্রেণির কৃষকদেরকে সম্পৃক্ত করা যায়নি। এছাড়া তিতুমীরের অনুসারীদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রকাশের ফলে হিন্দুদের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই আন্দোলনের ব্যাপকতা ছিল সীমাবদ্ধ । আধুনিক শিক্ষা না থাকায় তিতুমীর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দ্বারা জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারেননি। এর স্থলে তিনি মধ্যযুগের আদর্শ অনুসারে একটি মুসলিম স্বরাজ স্থাপনের কথা প্রচার করেন। আর নতুন মতের দার্শনিক জটিলতার কারণেও সকল শ্রেণির মুসলমান তাঁর পক্ষে ছিলেন না। এজন্য তার আন্দোলন ব্যর্থ হয়। তবে পরাধীন ভারতে তথায় বাংলায় তিতুমীর প্রমুখ সংস্কারবাদিগণই সর্বপ্রথম সচেতনভাবে ইংরেজ শক্তির উচ্ছেদ করে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ধ্বনি তুলেছিল, যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী পূর্ণ স্বাধীনতা আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। তিতুমীরের বিদ্রোহের শ্রেষ্টত্ব ও অবিস্মরণীয় অবদান এখানেই নিহিত ।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই বিশেষ করে বাংলায় দীর্ঘদিন ধরে চলে স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। প্রথম দিকে ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন এবং ধর্মসম্মতভাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে গড়ে তোলাই এর প্রধান লক্ষ্য ছিল। কিন্তু তিতুমীরের নেতৃত্বে মুসলিম সমাজসংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে এটি বাংলার মানুষদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং, প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ওয়াহাবি আন্দোলন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]