উত্তর ভূমিকা : ইতিহাস চর্চায় যার নাম সবার আগে উচ্চারিত হয় তিনি হলেন গ্রিক ঐতিহাসিক, ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস। তিনি অত্যন্ত ভ্রমণপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে তথ্য সংগ্রহ করেন, তার সংগৃহীত তথ্যের আলোকে রচিত হয় ‘ইতিবৃত্ত' The Historics. তিনি ভ্রমণলব্ধ অভিজ্ঞতাকে সার্থকভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হন। তিনি সর্বপ্রথম বস্তুনিষ্ঠ নিয়মানুগ ইতিহাস গ্রন্থের সংকলক ।
● হেরোডোটাসের ইতিবৃত্ত গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য : হেরোডোটাস সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ মানবীয় গুণাবলির সমন্বয়ে ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন । তার রচনাকর্মে ইতিহাস নামক শিল্পের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠেছে। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ইতিহাসের শিল্পগুণ সমৃদ্ধ গ্রন্থ ‘ইতিবৃত্ত' সংকলন করেন । নিম্নে হেরোডোটাসের ‘ইতিবৃত্ত' গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যাবলি আলোচনা করা হলো :
১. তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইবাছাই : ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস একটি তথ্যনির্ভর ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি তথ্য সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেন। ইতিহাস যে তথ্যনির্ভর তা হেরোডোটাসের ইতিহাসকর্ম 'ইতিবৃত্ত' পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়। তিনি তার ইতিহাসকর্ম রচনার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ঘটনার সত্যতা যাচাইবাছাই করে প্রকৃত ঘটনাই তিনি ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। সর্বোপরি তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তিনি একটি নিখুঁত, তথ্যনির্ভর ও সর্বজননীন ইতিহাস গ্রন্থ 'ইতিবৃত্ত' রচনা করেন ।
২. পক্ষপাতহীন ইতিহাসকর্ম : হেরোডোটাস তার কর্মপ্রচেষ্টার ফল হচ্ছে পক্ষপাতহীন ইতিহাস গ্রন্থ “ইতিবৃত্ত'। তিনি সম্পূর্ণ দেশপ্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করেন। তিনি একদিকে যেমন গ্রিকদের প্রশাংসা করেন, অপর দিকে পারসিকদের বীরত্ব গাথারও প্রশংসা করেন। এ থেকে তার ইতিহাসকর্মে পক্ষপাতহীনতার বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে । তার এই পক্ষপাতহীন ইতিহাসকর্মের জন্য ঐতিহাসিক মহলে ব্যাপক প্রশংসা পান ।
৩. মানব কর্মকাণ্ড ভিত্তিক ইতিহাসকর্ম : ইতিহাস হচ্ছে মানুষের অতীত কর্মকাণ্ডের বিবরণ । তিনি ইতিহাস ও অনুসন্ধান শব্দ দুটিকে একত্রিত করে তার ইতিহাসকর্মে ব্যবহার করেন। হেরোডোটাস ইতিহাসকে অতিকথন না বলে মানবীয় গুণাবলির সমন্বয় ঘটিয়ে মানুষের কর্মকাণ্ডকে ইতিহাসের বিষয়বস্তুতে পরিণত করেন। তিনি গ্রিক জাতির বীরত্ব গাথা লিপিবদ্ধ করে ইতিবৃত্ত গ্রন্থটি রচনা করেন। সুতরাং তার ইতিবৃত্ত গ্রন্থের বিষয়বস্তু ছিল গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের বিবরণ এছাড়া তিনি এ গ্রন্থে আরও ২০টি জাতির আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন ।
৪. 'Historia' শব্দটির ব্যবহার : গ্রিক শব্দ 'Histories' শব্দটি থেকে ইংরেজি 'Historia' শব্দটি এসেছে। যার আভিধানিক অর্থ ইতিহাস। তিনি 'Historia' শব্দটির সার্থক ব্যবহার করে ইতিহাসের জনকের মর্যাদা পান। তিনিই সর্বপ্রথম তার গবেষণাকর্মের নামকরণে 'Historia' শব্দ ব্যবহার করেন। যার আভিধানিক অর্থ হলো সত্যানুসন্ধান বা গবেষণা ৷ তিনি বিশ্বাস করতেন ইতিহাস হলো সত্যিকার অর্থে যা ছিল এবং সংঘটিত হয়েছিল তা অনুসন্ধান করা ও লেখা ।
৫. যুক্তিনির্ভর ইতিহাস গ্রন্থ : হেরোডোটাস যুক্তিবোধের সমন্বয়ে ইতিবৃত্ত গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি নিজে যুক্তিবোধের ওপরে থেকে একজন ঐতিহাসিকের কর্তব্যকর্ম নির্ধারণ করেছেন। তিনি ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্কে মতামত দেন। তিনি মনে করেন কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সঠিক কারণ নির্ণয় করাই ঐতিহাসিকের কর্তব্য। সে কারণে হেরোডোটাসকে একজন যুক্তিবাদী ঐতিহাসিকও বলা হয় ।
৬. বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ : হেরোডোটাস ইতিবৃত্তের মাধ্যমে বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাস চর্চার সূচনা করেন। তিনি প্রতিটি ঘটনার কার্যকারণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। তিনি বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা যাচাই করে সর্বাপেক্ষা গ্ৰহণযোগ্য তথ্যটি তার ইতিহাসকর্মে ব্যবহার করেন । ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন । এভাবে ভ্ৰমণ ও যুক্তি তর্কের মাধ্যমে হেরোডোটাস রচিত ইতিহাস হচ্ছে বিজ্ঞান ভিত্তিক ইতিহাস ।
৭. প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক পরিবেশের অন্তর্ভুক্তকরণ : হেরোডোটাসের ইতিহাসকর্ম প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে মানুষের কর্মকাণ্ড, আচার আচরণ, স্বভাব চরিত্র ভিন্ন হয়ে থাকে। তার ভ্রমণলব্ধ অভিজ্ঞতা তিনি ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। তার ভ্রমণকৃত দেশগুলোর আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে তার ইতিহাসকর্মে উল্লেখ করেন। তিনি মিসর ভ্রমণ করে মিশরকে নীলনদের দান বলে উল্লেখ করেন। সুতরাং মানুষের কর্মকাণ্ডের সাথে প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক পরিবেশের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান ।
৮. ঘটনার বিশ্লেষণ : হেরোডোটাস ঘটনার বিশ্লেষণ করে তা ইতিবৃত্ত সন্নিবেশন করেন। তিনি অত্যন্ত সহজ সরল প্রাঞ্জলভাবে ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে হৃদয়গ্রাহী করে তোলেন । তার ইতিহাসকর্ম সহজেই বোধগম্য ।
৯. ঘটনার ধারাবাহিকতা : হেরোডোটাস ইতিবৃত্তে প্রতিটি ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেন। ঘটনার ধারাবাহিকতা ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হেরোডোটাসের ইতিবৃত্তে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ঘটনার ধারাবাহিকতা থাকার জন্য আধুনিক গ্রিক ঐতিহাসিক J.B Bury ‘ইতিবৃত্তকে’ খুব সহজেই খণ্ড বিভাজনে সক্ষম হন ।
১০. ‘ইতিবৃত্তের’ রচনাশৈলী : হেরোডোটাসের ইতিবৃত্তের’ লেখার ধরন ছিল সহজ সরল ও বোধগম্য রীতিতে। তিনি প্রচলিত পদ্যরীতির পরিবর্তে “ইতিবৃত্ত' গদ্য রীতিতে লেখেন। যাতে খুব সহজেই অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝা যায়। তার লেখায় জ্ঞান গবেষণার গভীর ছাপ লক্ষ করা যায়। অনেক সময় তিনি যা দেখেন ঠিক তেমনিভাবেই ঘটনার বর্ণনা করেন । তিনি “ইতিবৃত্তের’ সপ্তম খণ্ডে বলেন, “যত কিছু বলা হয়েছে তার সবই পরিবেশন করা আমার কাজ কিন্তু অবিকল সেগুলো আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য নই। আমার রচিত সমগ্র ‘ইতিবৃত্তের’ জন্য এ মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য।”
বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে “ইতিবৃত্তের’ মূল্যায়ন : হেরোডোটাসের ইতিহাসকর্মের মূল বিষয়বস্তু ছিল গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের বা ম্যারাথন যুদ্ধের কাহিনি। তিনি অত্যন্ত সফলভাবে এ যুদ্ধের বিবরণ ‘ইতিবৃত্তে’ তুলে ধরেন। ‘ইতিবৃত্ত' মূলত একটি মহাকাব্য। এটি প্রচলিত পদ্যরীতির পরিবর্তে গদ্যরীতে লেখা হয়েছে। এই মহাকাব্যের শিরোনামে হেরোডোটাস Histories শব্দটি ব্যবহার করে ইতিহাসের জনকের মর্যাদার আসনে আসীন হন। হেরোডোটাস অত্যন্ত সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় ‘ইতিবৃত্ত' রচনা করেন। ‘ইতিবৃত্তের’ প্রতিটি চরণ পাঠকের কাছে সহজে বোধগম্য। হেরোডোটাসের ইতিবৃত্ত রচনায় বহুমুখী প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। ইউরোপীয় মহাদেশের বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘ইতিবৃত্ত' অন্যতম। হেরোডোটাস যে সময়ে ‘ইতিবৃত্ত' রচনা করেন তার গুরুত্বের বিচারেও এটি বিখ্যাত গ্রন্থের দাবি রাখে। ‘ইতিবৃত্ত' হতে কেবল গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায় না। এটা হতে গ্রিক সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায় । এতকিছু ভালোর পরেও ‘ইতিবৃত্তের’ কিছু ত্রুটি প্রতীয়মান হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, হেরোডোটাস ‘ইতিবৃত্তের' মাধ্যমে প্রথম মহাকাব্য রচনা করেন। ইতিবৃত্ত গ্রন্থটির বৈশিষ্ট্য রচনাশৈলী ও ভাষাগত দিক থেকে অনন্য সাধারণ। বিশ্বে যতদিন ইতিহাস চর্চা হবে ততদিন ‘ইতিবৃত্তের’ গুরুত্ব থাকবে। হেরোডোটাস ‘ইতিবৃত্তের’ মাধ্যমে মানব সভ্যতায় চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন ।
হেরোডোটাসের ‘ইতিবৃত্ত' 'History of Graeco-Perseian War' গ্রন্থের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ কর ।
উত্তর ভূমিকা : ইতিহাসের আলোচনায় যার নাম সবার আগে উচ্চারিত হয়, তিনি হলেন ইতিহাসের জনক গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস। হেরোডোটাস সম্পর্কে জানার উৎস হলো তার রচিত গ্রন্থ ‘ইতিবৃত্ত’ এবং দশম শতকে প্রকাশিত Suda নামক অভিধান। প্রাথমিক জীবন থেকেই হেরোডোটাস রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। এ সুযোগে হেরোডোটাস বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। তার ভ্রমণলব্ধ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন । গ্রন্থটির নাম The Historia বা ‘ইতিবৃত্ত' ।
● হেরোডোটাসের ‘ইতিবৃত্ত' গ্রন্থের বিষয়বস্তু : হেরোডোটাস রচিত ‘ইতিবৃত্তের’ বিষয়বস্তুর পরিধি ব্যাপক। আধুনিক গ্রিক ঐতিহাসিক J.B. Bury ইতিবৃত্তকে প্রধান তিন ভাগে বিভক্ত করেন। প্রত্যেক ভাগকে আবার তিনটি করে মোট ৯টি খণ্ডে বিভক্ত করে আলোচনা করেছেন । নিম্নে ইতিবৃত্তের' তিনটি ভাগের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করা হলো : প্রথম ভাগ : ‘ইতিবৃত্তের' প্রথম ভাগ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের সমন্বয়ে গঠিত। এ অংশে সাইরাস ও কেম্বিসাসের রাজত্বকালের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ডেরিয়াস কীভাবে বংশগত বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সে বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এছাড়াও এশিয়া ও আফ্রিকা উপমহাদেশের মিসরের বিবরণ পাওয়া যায়। ‘ইতিবৃত্তের’ প্রথম ভাগের তিন খণ্ডের, বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রথম খণ্ডের সাইরাস, দ্বিতীয় খণ্ডে মিশরীয় বিবরণ, তৃতীয় খণ্ডে ডেরিয়াসের ক্ষমতা দখলের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে ।
দ্বিতীয় ভাগ : ‘ইতিবৃত্তের' দ্বিতীয় ভাগে ডেরিয়াসের রাজত্বকালের বিবরণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় ভাগে ভৌগোলিক অঞ্চল ইউরোপের বিবরণ রয়েছে। এছাড়াও দ্বিতীয় ভাগ প্রথম ভাগের মতো তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে স্কিথিয়ার বিবরণ, দ্বিতীয় খণ্ডে আইওনিয়ান বিদ্রোহ, তৃতীয় খণ্ডে গ্রিক-পারসিক যুদ্ধে গ্রিকদের বীরত্ব গাথা স্থান পেয়েছে। গ্রিক পারসিক যুদ্ধ ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংঘটিত এ যুদ্ধে একজন সৈনিক ২৬ মাইল দৌড়ে এসে এথেন্স শহরে যুদ্ধের সংবাদ পৌছান। সংবাদ দেওয়ার সাথে সাথে সৈনিকটি মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। তার এ স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্য আজও ম্যারাথন দৌড় আয়োজন করা হয়।
তৃতীয় ভাগ : ‘ইতিবৃত্তের তৃতীয় ভাগ তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। তৃতীয় ভাগ সপ্তম, অষ্টম ও নবম খণ্ডে সমন্বয়ে গঠিত। সপ্তম খণ্ডে রয়েছে পারস্য সম্রাট জারেক্স এর রাজত্বকাল। বিশেষ করে থার্মপলির যুদ্ধে জারেক্স এর বিজয় সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। অষ্টম খণ্ডে পাওয়া যায় সালামিসের যুদ্ধে জারেক্স এর পরাজয়ের কাহিনি। নবম খণ্ডে বর্ণিত আছে প্লেটিয়া ও মাইকেলির যুদ্ধে গ্রিকদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন ।
কতিপয় মহান ঐতিহাসিক
নিম্নে একটি ছকের সাহায্যে ইতিবৃত্ত গ্রন্থের বিষয়বস্তু তুলে ধরা হলো :
ইতিবৃত্ত
প্ৰথম সর্গ সাইরাস ও ক্যাম্বিসেসের
দ্বিতীয় সৰ্গ
তৃতীয় সর্গ
ডেরিয়াসের
রাজত্বকাল ও ডেরিয়াসের
সিংহাসনারোহণ (ভৌগোলিকভাবে মিসরসহ এশিয়া)
রাজত্বকাল (ভৌগোলিকভাবে ইউরোপ)
জারেক্সের রাজত্বকাল (ভৌগোলিকভাবে গ্রিক জগৎ)
১ম খণ্ড ২য় খণ্ড (সাইরাস) (মিসর)
৩য় খণ্ড
(ডেরিয়াসের সিংহাসন দখল)
৫ম খণ্ড
৬ষ্ঠ খণ্ড
৪র্থ খণ্ড (স্কিথিয়া)
(আইওনিয়ান
(ম্যারাথনের
বিদ্রোহ)
যুদ্ধ)
.৭ম খণ্ড
৮ম খণ্ড
৯ম খণ্ড
(থার্মপলির যুদ্ধে
(সালামিসের
(প্লেটিয়া ও
জারেক্সেসের বিজয়)
যুদ্ধ)
মাইকেলির যুদ্ধ
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, হেরোডোটাস তার বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ ‘ইতিবৃত্ত' রচনা করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের বিষয়বস্তুর আলোকে 'ইতিবৃত্ত' রচিত হলেও এতে আরও অনেক দেশের বিবরণ পাওয়া যায়। ‘ইতিবৃত্তে' বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। সে কারণে এটিকে বিশ্ব ইতিহাস গ্রন্থও বলা হয়। তিনি তার ইতিহাসকর্মের সূচনাতে 'Historia' শব্দটি ব্যবহার করে ইতিহাসের জনকের মর্যাদা লাভ করেছেন ।
‘ইতিবৃত্ত' কী? ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসেবে ‘ইতিবৃত্তের’ মূল্যায়ন কর।
উত্তর ভূমিকা : বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীনতম ইতিহাস গ্রন্থ হচ্ছে ‘ইতিবৃত্ত'। এটি ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস কর্তৃক রচিত হয়েছে। ‘ইতিবৃত্তকে' বিশ্বের সর্বপ্রথম ইতিহাস গ্রন্থও বলা হয়। হেরোডোটাস বিশ্ব ভ্রমণ করে বিভিন্ন উৎস হতে তথ্যসংগ্রহ করেন। তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দিয়ে রচনা করেন কালজয়ী বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গ্রন্থ “ইতিবৃত্ত' বা Histories. এই গ্রন্থে হেরোডোটাস সর্বপ্রথম মানুষের অতীত কার্যক্রম, গবেষণা ও নিয়মতান্ত্রিক লিখিত বিষয় বুঝানোর জন্য Historia শব্দটি ব্যবহার করেন ।
ইতিবৃত্ত : ‘ইতিবৃত্ত’ গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস রচিত ইতিহাস গ্রন্থ। গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে তিনি ‘ইতিবৃত্ত' রচনা করেন। ‘ইতিবৃত্তে' শুধু গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের বিবরণই পাওয়া যায় না বরং এখানে বিশ্বের প্রায় ২০টি জাতিগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিবরণ পাওয়া যায়। এছাড়াও এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ভৌগোলিক বিবরণ সন্নিবেশিত হয়েছে। সে কারণে ‘ইতিবৃত্ত' গ্রন্থটি সর্বজনীন বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। তাই ‘ইতিবৃত্তকে’ বিশ্ব ইতিহাস গ্রন্থও বলা হয় ।
ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসেবে ইতিবৃত্তের মূল্যায়ন : নিম্নে ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসেবে ইতিবৃত্তের মূল্যায়ন করা হলো : ক. ইতিবৃত্ত রচনার পটভূমি : হেরোডোটাস রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে রাজা ক্রোসাসের রোষানলে পড়ে স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি প্রথমে এথেন্সে গমন করেন। তিনি আইওনিয়ান ও এশিয়ান দার্শনিকদের কাছ থেকে ইতিহাস চর্চার শিক্ষা লাভ করেন। এ ছিল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের এক নবতর পদ্ধতি। তিনি মানুষকে জানার আকাঙ্ক্ষায় পশ্চিম এশিয়া, মিশর, গ্রিক, সিসিলি ও ইতালিতে ভ্রমণ করেন । ভ্রমণের সময়ে তিনি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করেন । তিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করেন। এ থেকে অর্জিত বিপুল পরিমাণ তথ্যসংগ্রহ করেন । তার দীর্ঘ ভ্রমণের ফলে তিনি যেসব তথ্য পান তার সমন্বয়ে রচিত হয়েছে 'ইতিবৃত্ত' বা 'Histories. ' খ. ইতিবৃত্তের ভাগসমূহ : ইতিহাসের জনক হেরোডোটাসের রচিত ‘ইতিবৃত্তের' মূল বিষয়বস্তু ছিল গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের বিশদ বিবরণ। ‘ইতিবৃত্তে' স্থান পেয়েছে গ্রিকদের বীরত্বগাথা। গ্রিক ঐতিহাসিক J.B. Bury এর মতে, 'ইতিবৃত্ত' তিন ভাগে বিভক্ত । প্রতিটি ভাগকে আবার তিনটি করে মোট নয়টি খণ্ডে বিভক্ত করা হয়েছে।
প্রথম ভাগ : ‘ইতিবৃত্তের' প্রথম ভাগে সাইরাস ও কেম্বিসাসের রাজত্বকাল এবং ডেরিয়াসের সিংহাসনের বিবরণ, মিসর ও এশিয়ার ভৌগোলিক বিবরণ রয়েছে।
দ্বিতীয় ভাগ : ‘ইতিবৃত্তের' দ্বিতীয় ভাগে ইউরোপের বিবরণ ও রাজা ডেরিয়াসের রাজত্বকালের পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় । তৃতীয় ভাগ : ‘ইতিবৃত্তের’ তৃতীয় ভাগে রাজা জারেক্সের রাজত্বকাল ও গ্রিক জাতির বিবরণ পাওয়া যায় ।
গ. ইতিবৃত্তের' উপভাগসমূহ : ‘ইতিবৃত্তের’ উপভাগ মোট ৯টি । যথা—
প্রথম উপভাগ- সাইরাসের বিবরণ রয়েছে, দ্বিতীয় উপভাগে- মিসরের বিবরণ, তৃতীয় উপভাগে রাজা ডেরিয়াসের সিংহাসন আরোহণ, চতুর্থ উপভাগে স্কিথিয়ার বিবরণ, পঞম উপভাগে আইওনিয়ান বিদ্রোহ, ষষ্ঠ উপভাগে ম্যারাথন কাহিনি, সপ্তম উপভাগে থার্মপলির যুদ্ধে রাজা জারেক্সের বিজয়, অষ্টম উপভাগে সালামিসের যুদ্ধ এবং নবম উপভাগে প্লেটিয়ার ও মাইকেলির যুদ্ধে গ্রিকদের চূড়ান্ত বিজয় কাহিনি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
ঘ. মূল্যায়ন : হেরোডোটাস প্রাচীনকালে ‘ইতিবৃত্ত' রচনা করলেও তার ইতিহাসকর্মে আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তিনি ইতিবৃত্তের' সূচনাতে 'Historia' শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি ইতিহাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ ও গঠনমূলক ধারণা প্রদান করেন। তার মতে, ইতিহাস কোনো অতিকথন বা দিব্যতান্ত্রিক বিষয় নয় । তিনি এটি মানসিক দিক বলে উল্লেখ করেন । একমাত্র হেরোডোটাসই ইতিহাসকে Resgestae বা মানব কর্মকাণ্ডের অতীত বিবরণ বলে উল্লেখ করেন । তার ইতিহাসকর্মে মানুষের অতীত কার্যাবলির বিবরণ পাওয়া যায়। তার ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ‘ইতিবৃত্তের’ মুখবন্ধে বলেন- মানুষের কর্মকাণ্ড লিপিবদ্ধ করাই তার মুখ্য উদ্দেশ্য। ইতিহাস জ্ঞানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে, উত্তরসূরিরা যাতে ম্যারাথন বা গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের ঘটনা ভুলে না যায় সেজন্য তিনি ইতিহাস রচনা করেন । ‘ইতিবৃত্তে' গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করার জন্য তাকে গ্রিক কবি হোমারের সাথে তুলনা করা হয় । হেরোডোটাসের ইতিহাসকর্মটি মূলত সাহিত্যকর্ম। ম্যারাথন যুদ্ধের কাহিনি বিধৃত হওয়ায় এটি মহাকাব্যের মর্যাদা পেয়েছে । ‘ইতিবৃত্তের’ রচনাশৈলী সহজ, সরল ও প্রাঞ্জলিক ভাষায় রচিত। তিনি প্রচলিত পদ্যরীতির পরিবর্তে গদ্যরীতিতে ‘ইতিবৃত্ত’ রচনা করেন। ‘ইতিবৃত্তে' শুধু ম্যারাথন যুদ্ধের কাহিনিই নয় এখানে বিশ্বের ২০টি জাতিগোষ্ঠীর জীবনধারা, রীতিনীতি, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থায় বিস্তারিত বিবরণ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ কারণে ইতিবৃত্তকে' ইতিহাস গ্রন্থ না বলে বিশ্ব ইতিহাস গ্রন্থ বলা হয়। তিনি ভ্রমণের ফলে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, মানুষ ও সভ্যতা প্রকৃতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ভৌগোলিক বিবরণ সন্নিবেশিত হয়েছে। সার্বিক দিক থেকে মূল্যায়ন করলে ‘ইতিবৃত্তকে’ একটি বস্তুনিষ্ঠ, সর্বজনীন ইতিহাস গ্রন্থ বলা যায় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, হেরোডোটাস বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করে একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করতে সক্ষম হন। তার ইতিহাসকর্মটি সর্বদিক থেকে ইতিহাসের মহামূল্যবান উপাদান। ‘ইতিবৃত্তের ' বৈশিষ্ট্য আধুনিক ইতিহাসকর্মের মতোই সমুজ্জ্বল । তিনি তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার পরিচয় দেন। পৃথিবী যতদিন থাকবে হেরোডোটাসের নাম ইতিহাসের পাতায় ততদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত