হেরোডোটাস ও থুসিডিডিসের মধ্যে ইতিহাস চিন্তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ কর ।

উত্তর ভূমিকা : ইতিহাসের মাধ্যমে অতীত সম্পর্কে জানা যায়। ইতিহাসের তথ্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঐতিহাসিক তথ্য উত্থাপনের জন্য হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক বলা হয়। ঠিক তেমনিভাবে পিলোপনেসীয় যুদ্ধের বিবরণ তুলে ধরার জন্য থুসিডিডিসকে দ্বিতীয় মহান ঐতিহাসিক হিসেবে মনে করা হয় । দুজনেই ঐতিহাসিক তথ্যের বিশ্লেষণ করেন। তাই ইতিহাসে দুজনেরই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে ।
● হেরোডোটাস ও থুসিডিডিসের ইতিহাস চিন্তার তুলনামূলক আলোচনা : হেরোডোটাস ও থুসিডিডিস দুজনেই ইতিহাসের তথ্যের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। তাদের ব্যাখ্যার ক্ষেত্র ছিল একই ধরনের অর্থাৎ, তারা দুজনেই দুটি যুদ্ধের বিবরণ তুলে ধরেন। হেরোডোটাস বর্ণনা করেছেন ম্যারাথন অর্থাৎ, গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের ঘটনা আর থুসিডিডিস বর্ণনা করেন পিলোপনেসীয় যুদ্ধের ঘটনা। হেরোডোটাস ও থুসিডিডিস দুজনে দুটি যুদ্ধের বিবরণ দিয়ে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন। নিম্নে হেরোডোটাস ও থুসিডিডিসের ইতিহাস চিন্তার তুলনামূলক আলোচনা করা হলো :
১. তথ্যের ভিন্নতা : হেরোডোটাস ও থুসিডিডিস দুজনেই যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করেন। হেরোডোটাস ম্যারাথন বা গ্রিক- পারসিক যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করেন। অপরদিকে, থুসিডিডিস পিলোপনেসীয় যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ( এথেন্স- স্পার্টা)। এখানেই তাদের মধ্যে তথ্যের পার্থক্য রয়েছে।
২. বিষয়বস্তুর ভিন্নতা : হেরোডোটাস ও থুসিডিডিস যদিও একই ক্ষেত্রের তথ্য তুলে ধরেছেন; কিন্তু তাদের তথ্যের বিষয়বস্তুর ভিন্নতা ছিল। হেরোডোটাসের ইতিহাসকর্মের বিষয়বস্তু ছিল ম্যারাথন যুদ্ধে গ্রিক জাতির বীরত্ব গাথা, তাদের ঐক্য ও দেশপ্রেম। অপরদিকে, থুসিডিডিসের ইতিহাসকর্মের বিষয়বস্তু ছিল গ্রিকদের দ্বৈতবাদ, অভ্যন্তরীণ শক্তি প্রতিযোগিতা, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের শত্রুতা, শ্রেণিবৈষম্য, শাসক শ্রেণির অজ্ঞতা, অর্থলিপ্সা ও সাধারণ নাগরিকদের ঈর্ষামূলক আচরণ । ৩. বিষয়বস্তুর পরিধিগত পার্থক্য : হেরোডোটাস মূলত একজন ঐতিহাসিক হলেও ভূগোল বিষয়েও তার জ্ঞান ছিল। তার বিষয়ের পরিধি ছিল পারস্য পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি কেবল ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংঘটিত ম্যারাথন বা গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের বর্ণনা করেননি। তার ইতিহাসকর্মে বিশ্বের ২০টি জাতির রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় । তাছাড়া ভৌগোলিকভাবে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলসমূহের গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি ব্যাপক পরিধি নিয়ে ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করেন। অপরদিকে, থুসিডিডিসের ইতিহাসকর্মের পরিধি শুধুমাত্র গ্রিক জাতির মধ্যে সীমিত ছিল। তিনি এথেন্স ও স্পার্টা বা পিলোপনেসীয় যুদ্ধের বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি এথেন্সের নগর রাষ্ট্র ও এর রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন। হেরোডোটাসের ইতিহাসকর্মে কল্পকাহিনি, স্বপ্ন, দৈববাণী ও দেবদেবীর প্রতি বিশ্বাসের কথা পাওয়া যায়। কিন্তু থুসিডিডিসের ইতিহাসকর্মে এর কোনো স্থান ছিল না ।
৪. কাব্যগত পার্থক্য : হেরোডোটাস ও থুসিডিডিসের কাব্যের মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। হেরোডোটাসের মহাকাব্যটি ছিল মুক্তচিন্তা চেতনা ও যুক্তিবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। অপরদিকে, থুসিডিডিসের কাব্য ছিল ট্র্যাজেডির সমন্বয়ে রচিত। ৫. দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা : হেরোডোটাস যুক্তিবোধের ওপর ইতিহাস রচনা করেন। তার ইতিহাসকর্মে রোমান্টিকতার পরিচয় পাওয়া যায় । অপরপক্ষে, থুসিডিডিসের ইতিহাসকর্মে রোমান্টিকতা ছিল না ।
৬. জনক হিসেবে মূল্যায়ন : হেরোডোটাস ও থুসিডিডিসের গবেষণা, রচনাশৈলী, তথ্যসংগ্রহ পদ্ধতির আলোচনা করতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। হেরোডোটাস ছিলেন ইতিহাসের জনক আর থুসিডিডিস ছিলেন বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসের জাক। হেরোডোটাসের চেয়ে থুসিডিডিস অনেক বেশি যুক্তিবাদী ছিলেন। হেরোডোটাস ব্যাপক গবেষণা করার জন্য প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা করতে পারেননি। অপরদিকে, থুসিডিডিস ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ, প্রত্যক্ষ বিবরণ ও শিলালিপির আশ্রয় নেন। হেরোডোটাস প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করেননি। তিনি অনেক ক্ষেত্রে অলৌকিক বাণী ও অবাস্তবতার অবতারণা ঘটান। ইতিহাসের কার্যকারণের ক্ষেত্রেও তিনি বেশ অজ্ঞতার পরিচয় দেন । ৭. কার্যকারণগত ভিন্নতা : হেরোডোটাস ও থুসিডিডিসের মধ্যে কার্যকারণগত দিক থেকে তুলনা করলে দেখা যায় থুসিডিডিস ছিলেন হেরোডোটাস থেকে অনেক এগিয়ে। কারণ থুসিডিডিস ছিলেন সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী। তিনি ঘটনার প্রতিটি তথ্যকে বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করেন । তিনি ইতিহাসকে হেরোডোটাসের মতো মানুষের অতীত কর্ম বলে ব্যাখ্যা করেননি।
৮. তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ : বিষয়বস্তুর পরিধির ব্যাপকতার জন্য হেরোডোটাস ও থুসিডিডিসের মধ্যে তথ্যের বিচার বিশ্লেষণের পার্থক্য লক্ষ করা যায় । থুসিডিডিসের ইতিহাসকর্মের পরিসর ছিল শুধু গ্রিক সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সে কারণে তিনি তথ্যের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। অপরদ্রিকে, হেরোডোটাসের তথ্যের ব্যাপকতা এতটাই বিস্তৃত ছিল যে তার পক্ষে বিচার বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি । থুসিডিডিস প্রতিটি তথ্যের বিশ্লেষণ করে তারপর ইতিহাসকর্মে ব্যবহার করেন ।
৯. পাঠকের ভিন্নতা : হেরোডোটাসের মহাকাব্যটি অত্যন্ত উন্নতমানের রচনাশৈলীতে রচিত হয়। ফলে এতে কাব্যিক রস পাওয়া যায়। সে কারণে ‘ইতিবৃত্ত' শিক্ষিত শ্রেণির মনোরঞ্জন করতে সক্ষম হয়। অপরদিকে, থুসিডিডিসের ইতিহাসকর্ম আধুনিক ঐতিহাসিকদের জন্যে বিশেষভাবে উপযোগী ।
১০. ভিন্নতর রচনাভঙ্গি : হেরোডোটাসের ‘ইতিবৃত্তের’ রচনাশৈলী সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত হয়। এটি সহজে সবার নিকট বোধগম্য । অপরপক্ষে, থুসিডিডিসের ইতিহাসকর্ম নাটকীয়তার আশ্রয়ে জটিলভাবে রচিত হয় ।
১১. ভিন্নমত পোষণ : হেরোডোটাস ও থুসিডিডিস দুজনেই গ্রিসের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। হেরোডোটাস গ্রিক জাতির বীরত্ব ও ঐক্যবদ্ধতার কথা লেখেন। কিন্তু থুসিডিডিস লেখেন এথেন্সের অনৈক্য ও দ্বিধাভক্ত গ্রিসের ইতিহাস । দুজনের মধ্যে মতপার্থক্য বিদ্যমান ছিল ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, হেরোডোটাস ও থুসিডিডিস উভয়ে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন । তারা দুজনেই তাদের স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ইতিহাস চর্চা করেন । হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক বলা হয়। আর থুসিডিডিস ইতিহাসকে গতিময় ও বাস্তবতায় রূপ দেন। এজন্য থুসিডিডিসকে বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসের জনক বলা হয়। সুতরাং ইতিহাসে কারও অবদান কোনো অংশে কম নয় । দুজন ঐতিহাসিককে সম গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করতে হবে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]