কলহণের ‘রাজতরঙ্গিণী' লেখার উৎস ও বিষয়বস্তু পর্যালোচনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশে যারা ইতিহাস রচনা করে খ্যাতির শীর্ষে আছেন, কলহণ তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি বিভিন্ন উৎস হতে তথ্যসংগ্রহ করে কালজয়ী ইতিহাস গ্রন্থ 'রাজতরঙ্গিণী' রচনা করেন। তিনি ১১৪৮ থেকে ১১৪৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ‘রাজতরঙ্গিণী' রচনা করতে সক্ষম হন। তিনি ‘রাজতরঙ্গিণীতে’ কাশ্মীরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। পর্যাপ্ত তথ্যের সমন্বয়ে তিনি কাশ্মীরের ওপর একটি প্রামাণ্য বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করেন। সেজন্য ‘রাজতরঙ্গিণী' ঐতিহাসিক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে।
• কলহণের ‘রাজতরঙ্গিণী' লেখার উৎস ও বিষয়বস্তু : নিম্নে কলহণের রাজতরঙ্গিণী লেখার উৎস ও বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করা হলো : ক. কলহণের ‘রাজতরঙ্গিণী' লেখার উৎস : কলহণ কাশ্মীরের ইতিহাস রচনার জন্য বিভিন্ন উৎস হতে তথ্যসংগ্রহ করেন । যার ফলে গ্রন্থটি সর্বজনীন ও নিরপেক্ষতার মর্যাদা পেয়েছে। তিনি যেসব উৎস হতে তথ্যসংগ্রহ করেন তা নিম্নরূপ-
১. কলহণ তার পূর্ববর্তী শাসকদের প্রচলিত মুদ্রা, লিপিমালা হতে তথ্যসংগ্রহ করেন। তবে এগুলো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের
মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য তথ্যটি তিনি ইতিহাস রচনায় ব্যবহার করেন ।
২. তিনি পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক ১১টি রাজকীয় ঘটনাপঞ্জি হতে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করেন ।
৩. কলহণ কাশ্মীরের ইতিহাস রচনা করার জন্য পুরাণের আশ্রয় গ্রহণ করেন। পুরাণ ও পূর্বাপর প্রশস্তি হতে বিভিন্ন ঘটনার তথ্যবিবরণী সংগ্রহ করেন ।
৪. তিনি বিভিন্ন রাজবংশের কুলপঞ্জি হতে তথ্যসংগ্রহ করেন ।
৫. বিভিন্ন লৌকিক উপাখ্যান ও কল্পকাহিনি হতে তথ্যসংগ্রহ করে ‘রাজতরঙ্গিণী' রচনা করেন ।
কলহণ তার ইতিহাসকর্ম সংকলনে নির্বিচারে তথ্যসংগ্রহ করেননি। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তথ্যসংগ্রহ করে তার যাচাইবাছাই করেন । তিনি লিপিমালা, মুদ্রা, পৌরাণিক কাহিনি হতে তথ্যসংগ্রহ করেন ।
উপর্যুক্ত উৎস হতে তথ্যসংগ্রহ করে কলহণ কাশ্মীরের ওপর একটি বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। তার পূর্ব হতে কলহণের সময় পর্যন্ত কাশ্মীরের ওপর ধারাবাহিকভাবে কোনো ইতিহাস রচিত হয়নি। কলহণের উত্তরসূরীরা যাতে কাশ্মীরের ধারাবাহিক ইতিহাস জানতে পারে সেজন্য তিনি ‘রাজতরঙ্গিণী' রচনা করেন।
খ. কলহণের ‘রাজতরঙ্গিণীর’ বিষয়বস্তু : ‘রাজতরঙ্গিণী' কাশ্মীরের ওপর রচিত তথ্যবহুল একটি কালজয়ী ইতিহাস গ্রন্থ । গ্রন্থটিতে শুধু কাশ্মীর নয় এখানে আরও অনেক দেশের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। ‘রাজতরঙ্গিণীর' বিষয়বস্তুকে তিন খণ্ডে ভাগ করে আলোচনা করা হয়েছে । নিম্নে এ ভাগগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
প্রথম ভাগ : ‘রাজতরঙ্গিণীর' প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের সমন্বয়ে প্রথম ভাগ রচিত হয়। ‘রাজতরঙ্গিণীর' প্রথম ভাগে সুপ্রাচীনকাল থেকে কাশ্মীরের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। তিনি প্রথম ভাগ রচনার জন্য উৎস হিসেবে জনশ্রুতি, কাহিনিমালা, কিংবদন্তি, প্রশস্তি এবং কুলপঞ্জির আশ্রয় নেন ।
দ্বিতীয় ভাগ : ‘রাজতরঙ্গিণীর' দ্বিতীয় ভাগ চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ডের সমন্বয়ে রচিত হয়। দ্বিতীয় ভাগের বিষয়বস্তু হচ্ছে কার্কোটা ও উৎপল বংশের ইতিহাস। এ পর্বের ইতিহাস রচনায় তিনি পূর্ববর্তী ঐতিহাসিকদের ও তার সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের নিকট হতে তথ্য সংগ্রহ করেন ।
তৃতীয় ভাগ : 'রাজতরঙ্গিণীর' তৃতীয় ভাগ সপ্তম ও অষ্টম খণ্ডের সমন্বয়ে রচিত হয়। এ ভাগের বিষয়বস্তু হচ্ছে দুই লোহারা রাজবংশের সিংহাসন আরোহণ । কলহণ স্বয়ং তথ্যের পরীক্ষা ও যাচাইবাছাই করে ইতিহাসকর্মে ব্যবহার করেন। তিনি ইতিহাসকর্ম সম্পাদনের জন্য প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সংগ্রহ করেন। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক মত প্রদান করেন যে কলহণ সম্ভবত সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট থেকে তথ্যসংগ্রহ করতে সক্ষম হননি । তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যক্তির নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন । উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কলহণ ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিকদের মধ্যে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি 'রাজতরঙ্গিণীর' মাধ্যমে কাশ্মীরের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সংকলন করেন। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে ‘রাজতরঙ্গিণী' প্রথম লিখিত ইতিহাস গ্রন্থের মর্যাদা পায়। এ গ্রন্থে কাশ্মীরের ওপর ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার । এজন্য রাজতরঙ্গিণীকে কাশ্মীরের ইতিহাসের তথ্যভাণ্ডার বলা যায় ৷
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উৎস হিসেবে কলহণের ‘রাজতরঙ্গিণীর' মূল্যায়ন কর ।
উত্তর ভূমিকা : প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় যে কয়জন ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, কলহণ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি পিতার ন্যায় রাজমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন । রাজপদে থাকা অবস্থায় তিনি বিভিন্ন উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি একাধারে প্রশাসক, কবি ও ঐতিহাসিক ছিলেন। তিনি অলোকদত্তের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস রচনা শুরু করেন। বিভিন্ন -উৎস হতে তথ্যসংগ্রহ করে 'রাজতরঙ্গিণী' রচনা করেন বলে এটি বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষতার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
* প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উৎস হিসেবে কলহণের রাজতরঙ্গিণী : ‘রাজতরঙ্গিণীর' ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক বেশি এটি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ। নিম্নে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উৎস হিসেবে কলহণের রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হলো :
ক. রাজতরঙ্গিণী রচনার উৎস : কলহণ তার ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে বিভিন্ন উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করেন। যার ফলে তার ইতিহাসকর্মটি নিরপেক্ষতার যোগ্যতা পেয়েছে। তিনি যেসব উৎস হতে তথ্যসংগ্রহ করেন তা নিম্নরূপ :
১ . তিনি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে পূর্ববর্তী শাসকদের লিপিমালা ও মুদ্রা উৎস হিসেবে ব্যবহার করেন ৷
২ কলহণ ঘটনা বর্ণনায় পূর্ববর্তী ও তার সমসাময়িক ১১টি রাজকীয় ঘটনাপঞ্জি ও এগুলোর পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ।
৩. তিনি ধর্মীয় গ্রন্থ পুরাণের বিভিন্ন আলৌকিক ঘটনা হতে তথ্য সংগ্রহ করেন ।
৪. তিনি কাশ্মীরের বিভিন্ন রাজবংশের কুলপঞ্জি ও প্রশস্তি হতে তথ্য সংগ্রহ করেন ।
৫. এছাড়াও তিনি জনশ্রুতি, লোককাহিনি, কিংবদন্তি হতে তথ্য সংগ্রহ করেন। কলহণ ইতিহাস পুনর্গঠনে নিজের পর্যবেক্ষণ এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের ওপর অনেকটাই নির্ভর করেছিলেন। এছাড়াও সমসাময়িক ও নিকট সমসাময়িক কাহিনিকারদের উৎকৃষ্ট ঘটনাবলি তার ইতিহাস গবেষণায় কাজে লাগান ৷
কলহণ ইতিহাসের প্রাপ্ত উৎস নির্বিচারে ব্যবহার করেননি । তিনি তথ্যগুলো যথাযথ যাচাইবাছাই এর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন ।
খ. রাজতরঙ্গিণীর রচনাকাল ও বিভাগসমূহ : কলহণের প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় তার রচিত ‘রাজতরঙ্গিণীর’ মাধ্যমে। তিনি রাজা হর্ষের মন্ত্রী পদে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করেন। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এবং অলোকদত্তের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১১৪৮ হতে ১১৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুবছরের মধ্যে 'রাজতরঙ্গিণী' রচনা করেন। 'রাজতরঙ্গিণী' গ্রন্থটি আট খণ্ডে বিভক্ত। এটি আবার তিনটি প্রধান খণ্ডে ভাগ করা হয়েছে। গদ্য ও পদ্যের সংমিশ্রণ গ্রন্থটির বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে।
প্রথম ভাগ : ‘রাজতরঙ্গিণীর' প্রথম ভাগ ১-৩ খণ্ডের সমন্বয়ে গঠিত। এ ভাগের কাশ্মীরের সুপ্রাচীনকালের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম ভাগের ইতিহাস রচনার জন্য তিনি কিংবদন্তি পুরাণের অলৌকিক কাহিনি হতে তথ্য সংগ্রহ করেন । দ্বিতীয় ভাগ : ‘রাজতরঙ্গিণীর' দ্বিতীয় ভাগ ৪-৬ খণ্ডের সমন্বয়ে গঠিত। দ্বিতীয় ভাগ উৎপল ও কার্কোটা রাজবংশের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। উৎস হিসেবে তিনি সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের প্রণিত ঘটনাপঞ্জিতে ব্যবহার করেন । তৃতীয় ভাগ : ‘রাজতরঙ্গিণীর' তৃতীয় ভাগ ৭-৮ খণ্ডের সমন্বয়ে গঠিত। এ অংশে দুই লোহারা রাজবংশের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। উৎস হিসেবে তিনি নিজ পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সংগ্রহ করেন। সম্ভবত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ তিনি সংগ্রহ করতে পারেননি। তিনি ঘটনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যক্তির নিকট হতে তথ্য সংগ্রহ করেন ।
গ. রাজতরঙ্গিণীর গুরুত্ব : কলহণ রচিত 'রাজতরঙ্গিণীতে' সুপ্রাচীনকাল হতে কলহণের সমসাময়িক সময় পর্যন্ত কাশ্মীরের ইতিহাসের ঘটনাবলি বর্ণিত হয়েছে। কলহণ ‘রাজতরঙ্গিণী' রচনার জন্য বিভিন্ন উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করেন। পরবর্তীকালের বহু ঐতিহাসিক ‘রাজতরঙ্গিণী' হতে তথ্য সংগ্রহ করেন। ‘রাজতরঙ্গিণীর’ ঐতিহাসিক গুরুত্ব কোনোভাবে কম নয়। নিম্নে ‘রাজতরঙ্গিণীর' ঐতিহাসিক গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. প্রথম ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা : কলহণের পূর্বে কাশ্মীরের কোনো তথ্যবহুল ইতিহাস রচিত হয়নি। পূর্বে যা ছিল সেগুলো পরস্পর স্বার্থবিরোধী এবং এগুলো বিছিন্ন ঘটনার ওপর লিখিত। এ গ্রন্থগুলোর কোনো ঐতিহাসিক মান ছিল না । কলহণ সর্বপ্রথম বিভিন্ন সমন্বয়ে কালজয়ী ইতিহাস গ্রন্থ ‘রাজতরঙ্গিণী' রচনা করেন। ‘রাজতরঙ্গিণীতে' সুপ্রাচীনকাল হতে কলহণের সমসাময়িক সময় পর্যন্ত ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ঘটনাবলির বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে গ্রন্থটিকে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ঐতিহাসিক গ্রন্থের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
২. তথ্যভিত্তিক ইতিহাস গ্রন্থ : কলহণের রচিত 'রাজতরঙ্গিণী' ছিল তথ্যনির্ভর ইতিহাস গ্রন্থ। তার পূর্বে কিছু গ্রন্থ ছিল যা বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমন্বয়ে রচিত। তিনি বিভিন্ন উৎস হতে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করে এবং তার বিচার বিশ্লেষণ করে 'রাজতরঙ্গিণীতে' অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি পরীক্ষিত কাহিনি, জনশ্রুতি, লিপিমালা ও মুদ্রা হতে তথ্য সংগ্রহ করেন ।
৩. বিষয়বস্তুর বিন্যাস : কলহণের ‘রাজতরঙ্গিণী' ছিল বিষয়বস্তুর দিক হতে সুবিন্যস্ত • আট খণ্ডে বিন্যস্ত গ্রন্থটি প্রধান তিন ভাগে বিভক্ত । ‘রাজতরঙ্গিণীর' মোট ছন্দের সংখ্যা প্রায় ৮০০০টি।
৪. ধারাবাহিকতা বজায় : কলহণ ‘রাজতরঙ্গিণীর' বিষয়বস্তুকে ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করেন। সুপ্রাচীনকাল হতে কাশ্মীরের ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে।
৫. নিরপেক্ষ গ্রন্থ : কলহণ ‘রাজতরঙ্গিণী' রচনার জন্য বিভিন্ন উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এজন্য গ্রন্থটি নিরপেক্ষতার পরিচয় বহন করে। কলহণের গ্রন্থটির মাধ্যমে জানা যায় যে, তিনি যাকে প্রশংসা করেন তাকে আবার সমালোচনা করতেও দ্বিধাবোধ করেন নি । এ থেকে বলা যায় যে, কলহণ নিরপেক্ষতার দৃষ্টিতে ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করেন ।
ঘ. রাজতরঙ্গিণীর মূল্যায়ন : কলহণ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তথ্য সংগ্রহ করে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইতিহাসকর্মে ব্যবহার করেন। তিনি নির্বিচারে সব উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি পুরাণের বিভিন্ন কাহিনি, লোককাহিনি, জনশ্রুতি, কিংবদন্তি হতে তথ্য সংগ্রহ করেন। এছাড়াও তিনি ১১টি রাজকীয় ঘটনাপঞ্জি হতে তথ্য সংগ্রহ করেন। ‘রাজতরঙ্গিণীতে' শুধু কাশ্মীরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়নি। এখানে অনেক দেশের তথ্য রয়েছে। গ্রন্থটিতে কাশ্মীরের ঐতিহ্য, তীর্থ স্থান, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ সন্নিবেশিত আছে। সার্বিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, 'রাজতরঙ্গিণী' একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থ। সে কারণে এটি সর্বজনীন গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কলহণ কাশ্মীরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি বিভিন্ন উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করে রাজতরঙ্গিণীকে সার্বিক উৎস নির্ভর গ্রন্থের মর্যাদা দেন। গ্রন্থটিতে তিনি কাশ্মীরের ইতিহাস সুপ্রাচীনকাল হতে সমসাময়িক সময় পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করেন। এজন্য ভারতীয় উপমহাদেশে 'রাজতরঙ্গিণীর' গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি 1
প্রাচীন ভারতের ঐতিহাসিক হিসেবে কলহণের মূল্যায়ন কর ৷
উত্তর ভূমিকা : প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় যে কয়জন ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, কলহণ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি পিতার ন্যায় রাজা হর্ষের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি একাধারে প্রশাসক, ঐতিহাসিক ও কবি ছিলেন। রাজপদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় তিনি খুব সহজেই বিভিন্ন উৎস হতে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করেন। অলোকদত্তের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ইতিহাস চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তিনি ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘রাজতরঙ্গিণী’ রচনা করে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ।
" ইতিহাসে কলহণের অবদান : কলহণ তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বিভিন্ন উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করে রচনা করেন কালজয়ী ইতিহাস গ্রন্থ 'রাজতরঙ্গিণী'। তিনি ‘রাজতরঙ্গিণীতে' কাশ্মীরের ইতিহাস পুনর্গঠন করে ইতিহাসে অবদান রাখতে সমর্থ হন । নিম্নে ইতিহাসে কলহণের অবদান আলোচনা করা হলো :
১. ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা : কলহণই সর্বপ্রথম কাশ্মীরের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থ ‘রাজতরঙ্গিণী' রচনা করেন। তার পূর্বে যেসব গ্রন্থকারক গ্রন্থ রচনা করেন তা পূর্ণাঙ্গ ছিল না। এগুলোর বিষয়বস্তু ছিল বিচ্ছিন্ন। কলহণ পরিকল্পিতভাবে তথ্য সংগ্রহ করে সুবিন্যস্তভাবে কাশ্মীরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। কলহণ তথ্যনির্ভর ইতিহাস রচনা করেন। তিনি বিভিন্ন উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো যাচাইবাছাই করে ইতিহাসকর্মে ব্যবহার করেন। তার ইতিহাসকর্ম তথ্যে পরিপূর্ণ ছিল। ‘রাজতরঙ্গিণী' প্রথম ভাগে কাশ্মীরের ইতিহাস সুবিন্যস্তভাবে লিপিবদ্ধ আছে। তিনি লিপিমালা, মুদ্রা, পৌরাণিক কাহিনি, জনশ্রুতি, কিংবদন্তি হতে তথ্য সংগ্রহ করেন ।
৩. বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা রক্ষা : কলহণ অত্যন্ত সুবিন্যস্ত ও ধারাবাহিকভাবে ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করেন। তার আট খণ্ডের রাজতরঙ্গিণীকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এতে ধারাবাহিকতা ও সুবিন্যস্ততা বজায় রাখা হয়েছে। ৪. নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসকর্ম সম্পাদন : কলহণের ইতিহাসকর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে ইতিহাস রচনা করা। ‘রাজতরঙ্গিণী' হতে জানা যায়, তিনি যাকে প্রশংসা করেছেন তাকে আবার সমালোচনাও করেছেন । এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নিরপেক্ষ ব্যক্তি না হলে তারপক্ষে এরূপ সমালোচনা করা সম্ভব হতো না। তিনি বিভিন্ন উপাদান থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন বলে ‘রাজতরঙ্গিণী' নিরপেক্ষতার মর্যাদা পেয়েছে।
৫. সমালোচিত ইতিহাসকর্ম : কলহণ সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তার ইতিহাসকর্ম বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। তিনি সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করতে পারেননি । এক্ষেত্রে তার সময়ের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তাকে মূল্যায়ন করতে হবে। তিনি যতটুকু সম্ভব নিরপেক্ষ থেকে ইতিহাস রচনা করেন এবং এর থেকে বেশি তার পক্ষে সম্ভব ছিল না । এসব সমালোচনা সত্ত্বেও আধুনিক ঐতিহাসিকগণ তার প্রশংসাও করেছেন ।
৬. সফল ঐতিহাসিক : কলহণ ছিলেন প্রাচীন যুগের শেষের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের একজন সফল ঐতিহাসিক । তার পূর্বে কাশ্মীরের ওপর কোনো পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হয়নি। তিনিই প্রথম কাশ্মীরের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করেন ৷ তাই তাকে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস রচনায় একজন সফল ঐতিহাসিক বলা হয় ।
নিম্নে ঐতিহাসিক হিসেবে কলহণের মূল্যায়ন করা হলো :
প্রথমত : কলহণ তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সচেতনতার পরিচয় দেন। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিভিন্ন উৎস হতে তথ্যসংগ্রহ করেন । তিনি প্রাচীন ঘটনাপঞ্জি, পুরাণের অলৌকিক ঘটনাপ্রবাহ, জনশ্রুতি, লোককাহিনি, কিংবদন্তি হতে তথ্য সংগ্রহ করেন। কোনো কোনো সময়ে তিনি লিপিমালা ও শাসকবর্গের মুদ্রার আশ্রয় নেন। তাছাড়া তিনি ১১টি রাজকীয় ঘটনাপঞ্জি হতে নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করেন।
দ্বিতীয়ত : কলহণ ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ছিলেন। তিনি ঐতিহাসিকের কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে ধারণা দেন। তার মতে, একজন ঐতিহাসিক যাবতীয় স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে থেকে একজন বিচারকের ন্যায় ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ করে গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন । তার কাছে কেবল গুণিজনেরাই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য ।
তৃতীয়ত : কলহণ প্রাচীনকালের শেষের দিকের ইতিহাসের বিবরণ পুনর্গঠন করেন । তিনি তথ্যের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রেণি বিন্যস্ত করেন। কলহণ নিজে একজন আদর্শবান ঐতিহাসিক ছিলেন। তার ব্যক্তিত্ব বজায় রাখতে গিয়ে যার প্রশংসা করেছেন তার কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে আবার সমালোচনাও করেছেন। তিনি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সক্ষম হন
চতুর্থত : কলহণ অত্যন্ত সফলভাবে ইতিহাস চর্চা করেন। কিন্তু তার সফলতাকে সমালোচনার মুখে নিপতিত করে তার সন্দেহপ্রবণতা। কলহণের মধ্যে সন্দেহপ্রবণতা প্রকট আকারে বিদ্যমান ছিল। যে কারণে তিনি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। তিনি জাদুমন্ত্র বিশারদ ছিলেন। যৌক্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্পর্কে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি। তিনি নিয়তি, দেবতার ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর ঘটনার বিবরণ দেন। তিনি কর্মফল পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। এ জন্য তিনি বিভিন্ন মহল হতে সমালোচিত হন ।
পঞ্চমত : কলহণ ইতিহাস চর্চায় সাহসিকতার পরিচয় দিতে সক্ষম হন। তিনি সাহসিকতার সাথে অতীত ঘটনাপ্রবাহের ভুল সংশোধন করে ইতিহাসকর্মে ব্যবহার উপযোগী করেন । কিন্তু তার সে চেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি । অবশেষে তাকে বাস্তবতার নিরিখে ইতিহাস চর্চা করতে হন । তিনি সীমাবদ্ধতার মাঝে ইতিহাস চর্চায় যে অবদান রাখতে সক্ষম হন তা খুবই মূল্যবান । উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রাচীন যুগের শেষের দিকের ঐতিহাসিক হয়ে কলহণ তার ইতিহাসকর্মের জন্য প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি দায়িত্ববান ঐতিহাসিকদের মর্যাদায় থেকে একজন ঐতিহাসিকের কর্তব্যকর্ম নির্ধারণ করেন। নিজ দায়িত্ব ও পরিশ্রমের ফলে ইতিহাসে যতটুকু অবদান রাখেন তা খুবই মূল্যবান। তার মতো অনেক ঐতিহাসিক কাশ্মীরের ওপর ইতিহাস রচনা করেন। কিন্তু সেগুলো ছিল পরস্পর বিরোধী। সে কারণে তাদের রচনা সফলতার মুখ দেখেনি। একটি পূর্ণাঙ্গ ও সর্বজনীন ইতিহাসকর্ম রচনা করে কলহণ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]