সেন্ট অগাস্টিনের 'দি সিটি অব গড' 'The City of God' এর বিশেষ তাৎপর্য উল্লেখপূর্বক তার কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।

উত্তর ভূমিকা : সেন্ট অগাস্টিনের পুরো নাম অরেলিয়াস অগাস্টিন (Aurelius Augustine)। ইতিহাসে স্বতন্ত্র মতবাদের জন্য যেসব ঐতিহাসিকের পরিচয় পাওয়া যায় সেন্ট অগাস্টিন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। অগাস্টিনের রচনাবলিতে চতুর্থ শতকের খ্রিস্টধর্মের প্রভাব, প্রসার এবং পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'The City of God' এ বিভিন্ন তত্ত্বের অবতারণা করেন । এ তত্ত্বগুলো তার কৃতিত্বকে বাড়িয়ে তোলে ।
● 'দি সিটি অব গড' গ্রন্থের আলোকে সেন্ট অগাস্টিনের কৃতিত্ব : সেন্ট অগাস্টিন স্বতন্ত্র মতবাদের জন্য ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। নিম্নে ‘দি সিটি অব গড' গ্রন্থের আলোকে সেন্ট অগাস্টিনের কৃতিত্ব আলোচনা করা হলো : ১. 'The City of God' : 'The City of God' অগাস্টিনের বিখ্যাত গ্রন্থ। তিনি The City of God' রচনা করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন । সেন্ট অগাস্টিন পঞ্চম শতকের প্রথম দিকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। এ সময় রোমানরা অভিযোগ করতে থাকে যে, তাদের পতনের জন্য খ্রিস্টধর্ম দায়ী। তারা পূর্ব পুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করায় পূর্ব দেবতাগণ তাদেরকে শাস্তি দিয়েছেন। রোমানরা খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে অপপ্রচার চালাতে থাকে। সেন্ট অগাস্টিন তাদের এ অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য 'The City of God' রচনা করেন। তিনি খ্রিস্টধর্মের পক্ষ নিয়ে অবিশ্বাসীদের অভিযোগের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, রোমানদের পতনের জন্য খ্রিস্টধর্ম কোনোভাবেই দায়ী নয়। তার এ সাহিত্যকর্মটি খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীদের মনে আশার আলো জাগাতে সক্ষম হয়। সেন্ট অগাস্টিন একজন ধর্মযাজক হওয়াতে তার গ্রন্থটিও কোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থ নয়। এটি মূলত সাহিত্যকর্ম। তবে কীভাবে ইতিহাস রচনা করতে হয় সে সম্পর্কে অগাস্টিন তার রচনাতে দিকনির্দেশনা রয়েছে।
২. 'The City of God' এর খণ্ড বিভাজন ও আলোচ্য বিষয় : সেন্ট অরেলিয়াস অগাস্টিন তার ৭৬ বছরের জীবদ্দশায় দুটি গ্রন্থ রচনা করেন । তার শ্রেষ্ঠ রচনাকর্ম হচ্ছে 'The City of God'. তিনি ধর্মীয় যাজক হওয়াতে সম্পূর্ণ খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসের দৃষ্টিভঙ্গিতে 'The City of God' গ্রন্থটি রচনা করেছেন। এ গ্রন্থটিতে বিধাতার রাজ্য, রাজ্যের উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। অগাস্টিন তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জোরালো যুক্তিও উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। বিষয়বস্তুর দিক থেকে অগাস্টিন The City of God' কে ২২ খণ্ডে বিভক্ত করে রচনা করেন। প্রথম ভাগে ১০ খণ্ড এবং দ্বিতীয় ভাগে ১২ খণ্ড এই দুই ভাগে ভাগ করেন । প্রথম ভাগের ১০ খণ্ডকে ৫ খণ্ড করে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। দ্বিতীয় ভাগের ১২ খণ্ডকে ৪ খণ্ড করে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগের পাঁচ খণ্ডে তিনি তাদের কথা তুলে ধরেন যারা মনে করতো পার্থিব সুখসমৃদ্ধির জন্য একাধিক বিধাতার উপাসনা করা প্রয়োজন। তা না হলে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। প্রথম ভাগের দ্বিতীয় ৫ খণ্ডে দেখানো হয়েছে সমাজে সর্বকালে দুঃখকষ্ট বিরাজমান ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে । আর সেজন্য খ্রিস্টধর্ম কোনোভাবেই দায়ী নয় । তার ভাষায় অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে এ জোরালো বক্তব্য ফুটে ওঠে। দ্বিতীয় ভাগের প্রথম ৪ খণ্ডে সৃষ্টিকর্তার দুরাজ্যের উদ্ভব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ৪ খণ্ডে রাজ্যদ্বয়ের বিকাশ এবং শেষ ৪ খন্ডে রাজ্যদ্বয়ের পরিণতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। উভয় রাজ্যের কথা প্রতিটি খণ্ডে আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটির নামকরণের জন্য তিনি নিজের পছন্দকেই অধিক গুরুত্ব দেন। তিনি বিধাতার রাজ্যের শ্রেষ্ঠতর রাজ্যটির নামানুসারে গ্রন্থটির নামকরণ করেন The City of God। এখানে নামকরণের ক্ষেত্রে সার্থকতার পরিচয় ফুটে ওঠে । কারণ বিষয়বস্তুর সাথে নামকরণের যথেষ্ট মিল রয়েছে।
৩. ন্যায়বিচারতত্ত্ব : ন্যায়বিচার সম্পর্কে অগাস্টিন গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেন। তার মতে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তাদের নিজস্ব নিয়ম থাকে। যদি প্রতিষ্ঠানের সদস্যগণ তাদের ওপর আরোপিত নিয়মকানুন পালন করেন এবং ন্যায়পরায়ণ হন তাহলে বুঝতে হবে প্রতিষ্ঠানটিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোনো বৃহৎ বস্তুর অংশ দেখে যেমন এর পরিধি নির্ণয় করা সম্ভব হয় না তেমনি বৃহৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের অংশ বিশেষে ন্যায়বিচার হলে বলা যাবে না ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ পার্থিব রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্বর্গরাজ্য বা বিধাতার রাজ্যের প্রয়োজন । কেননা পার্থিব রাষ্ট্র হচ্ছে বিধাতার রাষ্ট্রের একটি অংশ ।
৪. রাষ্ট্রতত্ত্ব : সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্র সম্পর্কিত মতামত তার দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। তার মতে, রাষ্ট্রের অধিবাসীরা বিভিন্ন রকম পাপাচারে লিপ্ত থেকে অহংকার করতে থাকে। ফলে বিধাতা তাদের এরূপ কাজের শাস্তি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটান। অর্থাৎ সহজভাবে বলা যায়, রাষ্ট্র হলো পাপের ফসল । অগাস্টিনের মতে রাষ্ট্র দুই প্রকার । যথা : ক. পার্থিব রাষ্ট্র ও খ.বিধাতার রাষ্ট্র।
ক. পার্থিব রাষ্ট্র : অগাস্টিনের মতে, পার্থিব রাষ্ট্র হলো মানুষের পাপের ফসল। এখানকার অধিবাসীরা সর্বত্রই পাপ, অহংকার ও স্বার্থপরতায় লিপ্ত থাকে। পাপ যতদিন থাকবে পার্থিব রাষ্ট্রও ততদিন থাকবে। সুতরাং পার্থিব রাষ্ট্র হলো পাপের প্রায়শ্চিত্তের জায়গা ।
খ. বিধাতার রাষ্ট্র বা স্বর্গরাজ্য : স্বর্গরাজ্যের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। এ রাজ্য স্থায়ী ও অপরিবর্তনশীল। এ রাজ্যে মানুষের দেহ বিরাজিত নয়। এ রাজ্যে প্রতিনিধিত্ব করবে মানুষের পুণ্যাত্মা। স্বর্গরাজ্যের অধিবাসীরা সর্বদাই বিধাতার প্রেমে মগ্ন থাকে । বিনয়, নম্রতা, সদাচারিতা হবে এ রাজ্যের অধিবাসীদের চরিত্র।
৫. শান্তিতত্ত্ব : সেন্ট অগাস্টিন শান্তি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেন। সর্বজনীন রাষ্ট্র ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব বোধের ওপর অগাস্টিনের শান্তি নীতি প্রতিষ্ঠিত। অগাস্টিনের মতে, স্বর্গরাষ্ট্র ব্যতীত শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। পার্থিব রাষ্ট্রের সদস্যগণ সর্বদাই লোভ, মোহ, অহংকার ও স্বার্থপরতায় লিপ্ত থাকে। তাদের এ পাপাচারের কারণে পার্থিব রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। পক্ষান্তরে, বিধাতার রাষ্ট্রের সদস্যগণ সর্বত্রই ঈশ্বরপ্রেমে মগ্ন থাকে এবং মুক্তিই তাদের কামনা। লোভ, মোহ, অহংকার, স্বার্থপরতা তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই সেখানে সর্বত্রই শান্তি বিরাজিত। সুতরাং বিশ্বভ্রাতৃত্ব বোধ ও সর্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় ।
৬. সম্পত্তিতত্ত্ব : অগাস্টিন মানুষের সম্পত্তির ভোগদখল ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্পষ্টভাবে তার বক্তব্য তুলে ধরেন। সম্পত্তি স্বয়ং স্রষ্টা কর্তৃক প্রদত্ত। মানুষের চলার জন্য যতটুকু সম্পত্তির প্রয়োজন ততটুকুই গ্রহণ করবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পত্তি সমাজের মঙ্গলের জন্য ব্যয় করবে। তা না হলে সমাজে শান্তি বিরাজ করবে না। তিনি প্রয়োজনের বেশি সম্পদ আহরণ ও সঞ্চয়ের বিরুদ্ধে কঠোর বাণী উচ্চারণ করেন ।
৭. রোমের পতনের কারণ নির্ণয় : সেন্ট অগাস্টিন ৪১০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের পতন প্রত্যক্ষ করেন। জড়বাদীরা প্রচার করতে থাকে যে, রোমান সাম্রাজ্য পতনের জন্য খ্রিস্টধর্ম দায়ী। তারা পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করার কারণে পুরনো দেবতাগণ তাদেরকে দুঃখকষ্টের মধ্যে নিপতিত করেছেন । সেন্ট অগাস্টিন তাদের এ অভিযোগের বিরুদ্ধে The City of God' এ উল্লেখ করেন যে, “রোমানদের পতন হয়েছে স্বাভাবিক নিয়মে। তাদের উন্নতির জন্য যেমন পৌত্তলিক দেবদেবীদের আশীর্বাদ ছিল না তেমনি তাদের পতনের জন্য খ্রিস্টধর্ম দায়ী নয়।” পৃথিবীর কোনো কিছুই উন্নতির শীর্ষে থাকে না, নির্দিষ্ট সময়ের পর অবক্ষয় শুরু হয় এবং একটি সময়ে এসে পতন ঘটে। রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সুতরাং রোমের পতন স্বাভাবিকভাবেই ঘটে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সেন্ট অগাস্টিন একজন শ্রেষ্ঠ ধর্মযাজক ছিলেন । তার লেখনীর দ্বারা খ্রিস্টধর্ম ব্যাপক প্রসার লাভ করে । তিনি খ্রিস্টধর্মের আলোকে মধ্যযুগের রাষ্ট্র দর্শন ও ধর্ম দর্শনের ক্ষেত্রে যে অবদান রাখেন তা বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে । এজন্য সেন্ট অগাস্টিনকে মধ্যযুগের স্থপতি ও দুই যুগের সংযোগ স্থাপনকারী বলা হয় ।
‘দি সিটি অব গড' গ্রন্থের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে যে কয়জন দার্শনিক তাদের একান্ত নিজস্ব চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হন সেন্ট অগাস্টিন তাদের মধ্যে অন্যতম। সেন্ট অগাস্টিন তার ধর্ম দর্শন ও রাষ্ট্র দর্শনের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন । 'The City of God' হচ্ছে অগাস্টিনের চিন্তা দর্শনের বহিঃপ্রকাশ। অগাস্টিন সম্পর্কে অধ্যাপক সেবাইন বলেন, “সেন্ট অগাস্টিনের রচনাবলির ভাবধারায় এমন একটি খনি বিশেষ যা পরবর্তীকালে কি ক্যাথলিক কি প্রটেস্ট্যান্ট সব লোকই গ্রহণ করেছেন।” তার চিন্তাচেতনার তাৎপর্য সব যুগে সমভাবে সমাদৃত হয়েছে ।
'The City of God' : 'The City of God' অগাস্টিনের বিখ্যাত গ্রন্থ। তিনি 'The City of God' রচনা করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন । সেন্ট অগাস্টিন পঞ্চম শতকের প্রথম দিকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। এ সময় রোমানরা অভিযোগ করতে থাকে যে, তাদের পতনের জন্য খ্রিস্টধর্ম দায়ী। তারা পূর্ব পুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করায় পূর্ব দেবতাগণ তাদেরকে শাস্তি দিয়েছেন। রোমানরা খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে অপপ্রচার চালাতে থাকে। সেন্ট অগাস্টিন তাদের এ অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য The City of God' রচনা করেন। তিনি খ্রিস্টধর্মের পক্ষ নিয়ে অবিশ্বাসীদের অভিযোগের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, রোমানদের পতনের জন্য খ্রিস্টধর্ম কোনোভাবেই দায়ী নয়। তার এ সাহিত্যকর্মটি খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীদের মনে আশার আলো জাগাতে সক্ষম হয়। সেন্ট অগাস্টিন একজন ধর্মযাজক হওয়াতে তার গ্রন্থটিও কোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থ নয়। এটি মূলত সাহিত্যকর্ম। তবে কীভাবে ইতিহাস রচনা করতে হয় সে সম্পর্কে অগাস্টিন তার রচনাতে দিকনির্দেশনা রয়েছে ।
o 'The City of God' গ্রন্থের বিভিন্ন দিক : সেন্ট অগাস্টিনের চিন্তাধারা বা দর্শনতত্ত্ব খ্রিস্টানদের মধ্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সে কারণে The City of God' এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক বেশি। নিম্নে The City of God' গ্রন্থের বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হলো :
১. ধর্ম ও রাজনীতি : সেন্ট অগাস্টিন ছিলেন একজন খ্রিস্টধর্মযাজক। তাই তিনি ধর্মতত্ত্বের আলোকে ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন । তিনি কৌশলে ধর্ম ও রাজনীতিকে একত্রিত করে পার্থিব রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালান । তিনি ধর্ম ও রাজনীতিকে অভিন্ন মনে করেননি ।
২. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : সেন্ট অগাস্টিন তার The City of God' গ্রন্থে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মনে করেন, স্বর্গরাজ্যে যেমন শান্তি বিরাজ করে তেমনি পার্থিব রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে ন্যায়বিচার থাকতে হবে, তা না হলে শান্তি আসবে না ।
৩. ঐক্যের প্রতিষ্ঠা : খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে গির্জা এবং বহু দেবতাবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব অব্যাহত ছিল। তখন বহু দেবতাবাদীদের যুক্তির বিরুদ্ধে চার্চের পক্ষ নিয়ে অগাস্টিন The City of God' এর মাধ্যমে অনেক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে সক্ষম হন । ফলে চার্চ এবং বহু দেবতাবাদীদের মধ্যকার চলে আসা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। তাই The City of God' কে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
৪. শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপন : সেন্ট অগাস্টিন The City of God' এর মাধ্যমে রাষ্ট্রে শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য প্রচেষ্টা করেন। Harmen সেন্ট অগাস্টিনের 'The City of God' পাঠ করে বলেন, “অগাস্টিনের মতে রাজ্যের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা।”
৫. সত্যের প্রতিষ্ঠা : সেন্ট অগাস্টিন 'The City of God' এর মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন। তিনি মনে করতেন যে, সত্যের প্রতিষ্ঠা হলে রাষ্ট্রে কোনো অন্যায় অসত্য থাকবে না। রাষ্ট্রের অধিবাসীরা সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হলে রাষ্ট্রের সর্বত্র শান্তি বিরাজ করবে।
৬. চার্চ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা : সেন্ট অগাস্টিন তার ধর্ম দর্শনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন। অবশ্য তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে স্বর্গরাজ্যের কথা বলেন। এ রাজ্যের নাগরিকেরা হবেন বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, সদালাপি, স্রষ্টার প্রেমে আবদ্ধ । তারা ন্যায়পরায়ণতা থেকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রের বিকাশ সাধনে সর্বদা তৎপর থাকবেন। তিনি কখনও চাননি রাষ্ট্র চার্চের দ্বারা পরিচালিত হোক। তবে চার্চ রাষ্ট্রের নীতি নৈতিকতা নিয়ন্ত্রণ করবে। এভাবে তিনি চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন ।
৭. দুই যুগের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী : অনেক ঐতিহাসিক অগাস্টিনকে দুই যুগের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেন । প্রাচীন যুগের দার্শনিকরা ছিলেন ভাববাদ নিয়ে ব্যস্ত। তারা রাষ্ট্রের যেসব উপাদান নিয়ে আলোচনা করেন অগাস্টিন সেই উপাদানগুলোকেই খ্রিস্ট রাষ্ট্রের উপাদান হিসেবে গণ্য করেন। অগাস্টিন বলেন, “ঈশ্বরের বাণী বহন করবে খ্রিস্টধর্ম, সেই বাণীকে বাস্তবে রূপ দান এবং প্রচার করবে চার্চ।” অগাস্টিনের রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কিত এ বাণী ধারণ করে তার The City of God'। সে কারণেই 'The City of God' কে দুই যুগের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবে গণ্য করা হয় । ৮. রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ নির্ণয় : সেন্ট অগাস্টিন 'The City of God' এ রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ সম্পর্কে যুক্তি উপস্থাপন করেন। রোমান সাম্রাজ্যের পতন সম্পর্কে তিনি বলেন, রোমানরা পৌত্তলিকতা পরিত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের জীবনধারা পৌত্তলিকতা অনুযায়ী পরিচালিত হতো যা ছিল খ্রিস্টধর্মের আদর্শের পরিপন্থি। এ কারণে রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এ জন্য খ্রিস্টধর্ম কোনোভাবেই দায়ী নয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিখ্যাত খ্রিস্টীয় দার্শনিক ও ঐতিহাসিক সেন্ট অগাস্টিনের বিখ্যাত রচনা দি সিটি অব গড। সেন্ট অগাস্টিনের ‘দি সিটি অব গড' গ্রন্থে তার চিন্তাচেতনায় ধর্মীয় গাম্ভীর্য ফুটে ওঠেছে। তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি নীতি নৈতিকতার আশ্রয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন । তিনি সীমাবদ্ধতার বৃত্তে আবদ্ধ থেকে তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'দি সিটি অব গড' প্রণয়ন করেন ।
সেন্ট অগাস্টিনের দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব আলোচনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : সেন্ট অগাস্টিন একজন ধর্মযাজকই ছিলেন না, তিনি একজন সফল রাষ্ট্রচিন্তাবিদও ছিলেন। তিনি যেসব তত্ত্ব আলোচনা করেছেন তার মধ্যে দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব অন্যতম। তিনি খ্রিস্টীয় ধর্ম দর্শন তত্ত্বের আলোকে দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব আলোচনা করেছেন। তার এ দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব আলোচনাটি ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাই এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসীদের মনে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
● সেন্ট অগাস্টিনের দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব ব্যাখ্যা : রাষ্ট্র সম্পর্কে সেন্ট অগাস্টিনের ধারণা তার দূরদর্শী চিন্তাধারার প্রতিফলন । তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে, রাষ্ট্র হলো মানুষের পাপের শাস্তিস্বরূপ। অর্থাৎ মানুষ নানা ধরনের নেতিবাচক কার্যকলাপ করে থাকে, এ নেতিবাচক কার্যকলাপের ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মানুষের যেমন দুই প্রকার সত্তা আছে রাষ্ট্রও তেমনি দুই প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন— ১. পার্থিব রাষ্ট্র বা জাগতিক রাষ্ট্র ও ২. বিধাতার রাষ্ট্র বা স্বর্গরাজ্য। নিম্নে পার্থিব রাষ্ট্র ও স্বর্গরাজ্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হলো :
১. পার্থিব বা জাগতিক রাষ্ট্র : সেন্ট অগাস্টিন পার্থিব রাষ্ট্র বলতে পৃথিবীকে বুঝিয়েছেন। হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করে সৃষ্টিকর্তা স্বর্গে বসবাস করার অনুমতি দেন। কিন্তু সেখানে আদম (আ.) পাপকাজ করে ফেলে। ফলে তাকে শাস্তিস্বরূপ সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। সে কারণে তিনি বলেন, “পার্থিব রাষ্ট্র পাপের ফসল।” এখানে পার্থিব রাষ্ট্রের অধিবাসীরা স্বার্থপরতা, হানাহানি, পাপাচার ও পারস্পরিক অবিশ্বাস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এখানে সর্বত্রই নেতিবাচক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। তার মতে, “যতদিন পাপ থাকবে ততদিন পার্থিব রাষ্ট্র থাকবে।” এখানে মানুষে মানুষে লোভ, মোহ, হিংসাবিদ্বেষ, বর্ণবৈষম্য বিরাজ করবে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন। পার্থিব রাষ্ট্র ক্ষণস্থায়ী ও নশ্বর। এখানকার অধিবাসীরা আত্মকেন্দ্রিক ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত থেকে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখছে। স্রষ্টার নাম নিচ্ছে না। এখানের অধিবাসীরা তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ডের দ্বারাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছে ।
২. বিধাতার রাষ্ট্র বা স্বর্গরাজ্য : সেন্ট অগাস্টিনের মতে, “যখন কোনো সম্প্রদায়ের লেখা একই মূল্যবোধের দ্বারা অথবা কোনো কারণে একই অনুভূতির দ্বারা পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয় তখন একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়।” ঠিক তেমনি ঈশ্বরের প্রেমে একীভূত হয়ে গড়ে ওঠেছে স্বর্গরাজ্য। এখানে পুণ্যবান মানুষের আত্মা প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতিটি আদম সন্তান স্বর্গরাজ্যের সদস্য। স্বর্গরাজ্যের অধিবাসীদেরকে কোনো প্রকার পাপ, জরা, দুঃখ, কূটিলতা স্পর্শ করে না । তাদের লক্ষ্য একটাই আর তা হলো স্রষ্টার প্রেম ভালোবাসা। এ রাজ্যের অধিবাসীরা বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের হয়ে থাকে। স্বর্গরাজ্য অনন্ত চিরস্থায়ী। এটি পবিত্র ও মঙ্গলময়। এ স্বর্গরাজ্যের শেষ নেই, এটা অবিনশ্বর। স্বর্গরাজ্যের সদস্য হতে হলে তাকে যাবতীয় পাপাচার ও কলুষতা মুক্ত থাকতে হবে। কোনো প্রকার শ্রেণিবৈষম্য, বর্ণবৈষম্য সৃষ্টি করা যাবে না। তাহলে বিধাতার কৃপা পাবে না । আর বিধাতার কৃপা বা করুণা না পেলে স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করা যাবে না। কিন্তু সমস্যা হলো, বিধাতা সব মানুষের প্রতি সবসময় কৃপা প্রদর্শন করেন না । কেবল যাদের খ্রিস্টধর্মে অটুট বিশ্বাস থাকে শুধু তারাই ঈশ্বরের কৃপা পেয়ে থাকে । সুতরাং বলা যায়, স্বর্গরাজ্যের সদস্য শুধু খ্রিস্টধর্ম অনুসারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে এটাও বলা হয়েছে যে, এটা সর্বজনীন, সর্বত্র পরিব্যাপ্ত
পার্থিব ও স্বর্গরাজ্যের মধ্যে পার্থক্য : সেন্ট অগাস্টিন দুই রাষ্ট্রতত্ত্বের ধারণা প্রদান করেন। তার দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব হলো পার্থিব রাষ্ট্র ও স্বর্গরাষ্ট্র। এ দুই রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্যও বিদ্যমান । নিম্নে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করা হলো : ১. নাগরিকত্ব : সেন্ট অগাস্টিনের বর্ণনা অনুযায়ী স্বর্গরাজ্য ও পার্থিব রাজ্যের সদস্যদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করা যায়। পার্থিব রাষ্ট্রের সদস্যগণ সর্বদাই নেতিবাচক কার্যক্রম করে থাকে । তারা আত্মকলহ, বর্ণবৈষম্য ও বিভেদ সৃষ্টি করে । তারা জাগতিক চিন্তাচেতনায় এতটাই মগ্ন থাকে যে, ঈশ্বরের নাম পর্যন্ত নেয় না। পক্ষান্তরে, স্বর্গরাজ্যের সদস্যরা ন্যায়পরায়ণ, ধর্মপ্রাণ, পাপাচার মুক্ত। তারা নিজেদের আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে ঈশ্বরপ্রেমে মগ্ন থাকে। জাগতিক কোনো চিন্তাচেতনা তাদেরকে স্পর্শ করে না । স্বর্গরাজ্যে অনন্ত সুখ বিরাজ করে ।
২. দুই রাষ্ট্রের অবস্থান : সেন্ট অগাস্টিন যে দুই রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করেন তার মধ্যে অবস্থানগত পার্থক্য রয়েছে। সেন্ট অগাস্টিন পার্থির রাষ্ট্র বলতে পৃথিবীকে বুঝিয়েছেন। এখানে মানুষের সত্তা বিরাজ করে। অন্যদিকে বিধাতার রাজ্যের অবস্থান দৃশ্যমান নয় । এটির অবস্থান স্বর্গে। এখানে মানুষের অবস্থান সম্ভব নয় । এখানে মানুষের পুণ্যাত্মা বিরাজ করে । ৩. উৎপত্তি : সেন্ট অগাস্টিনের দুই রাষ্ট্রের মধ্যে উৎপত্তিগত পার্থক্য লক্ষ করা যায়। পার্থিব রাষ্ট্র মানুষের দৈহিক সদাচারি হতে উৎপত্তি হয়েছে। এটা দৃশ্যমান বাস্তব প্রতিষ্ঠান। পার্থিব রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রয়েছে। অন্যদিকে স্বর্গরাজ্য ধারণাটি অগাস্টিনের মনস্তাত্ত্বিক ধারণার প্রতিফলন । বাস্তবে এ রাষ্ট্রের কোনো অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায় না ।
৪. পরিধি : সেন্ট অগাস্টিনের দুই রাষ্ট্রের মধ্যে পরিধিগত পার্থক্য বিদ্যমান। পার্থিব রাষ্ট্র নশ্বর। এর পরিধি নির্ণয় করা যায়। পার্থিব রাষ্ট্রের পরিধি স্বর্গরাজ্য অপেক্ষা সামান্য। অপরদিকে স্বর্গরাজ্যের পরিধি ব্যাপক। এর শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। স্বর্গরাজ্য অবিনশ্বর। এর ধ্বংস বা বিনাশ নেই। সব খ্রিস্টানগণই স্বর্গরাজ্যের সদস্য নয়। কেবল স্বর্গের দেবদূতগণ, পুণ্যবান খ্রিস্টানদের আত্মা এ রাষ্ট্রের সদস্য'।
৫. অধিবাসীদের কার্যক্রম : অগাস্টিনের দুই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে কার্যকলাপের পার্থক্য রয়েছে। পার্থিব রাষ্ট্রের নাগরিকরা সর্বদা পাপাচারে লিপ্ত থাকে। তারা আত্মকলহ, বর্ণবিভেদ সৃষ্টি করে থাকে। অন্যদিকে স্বর্গরাজ্যের অধিবাসীরা সর্বত্রই বিধাতার 'সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিমগ্ন থাকে। তাদেরকে পরম সুখে শান্তিতে বিরাজ করতে দেখা যায়। তারা বিধাতার আশীর্বাদপুষ্ট । পার্থিব দুঃখ তাদের স্পর্শ করে না ।
সমালোচনা : অগাস্টিনের রাষ্ট্রতত্ত্বটি সমালোচনার যোগ্য। এটি বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নলিখিতভাবে অগাস্টিনের রাষ্ট্রতত্ত্বের সমালোচনা করা যায় :
১. ধারণাগত দিক : সেন্ট অগাস্টিন পার্থিব রাষ্ট্রকে শয়তানের রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করেন। বাস্তবে শয়তানের রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা তার মনস্তাত্ত্বিক ধারণার প্রতিফলন ।
২. পার্থক্য করা কঠিন : সেন্ট অগাস্টিন দুই রাষ্ট্র সম্পর্কে যে ধারণা প্রদান করেন তা প্রায় সমার্থক। সংজ্ঞাগত দিক থেকে এ রাষ্ট্রদ্বয়ের পার্থক্য করা খুবই কঠিন।
৩. সাংঘর্ষিক : সেন্ট অগাস্টিন দুই রাষ্ট্রের মধ্যে ধর্ম ও অধর্মের বীজ বপন করে মানবজাতিকে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেন ৷
৪. ধর্মীয় প্রাধান্য : সেন্ট অগাস্টিন ধর্মীয় ভাবধারায় চার্চ ও স্বর্গরাজ্যের গুণকীর্তন করেন। যা ধর্মীয় গোঁড়ামিকে আরও মজবুত করেছে । তিনি সবকিছুতেই ধর্মের প্রাধান্য দেন। মূলত তার দর্শনতত্ত্ব খ্রিস্টধর্মকেন্দ্রিক I
৫. মানুষ অবমূল্যায়িত : সেন্ট অগাস্টিন পার্থিব রাষ্ট্র পাপের ফসল, শয়তানের রাজ্য বলে যে ধারণা প্রদান করেন তা প্রকৃতপক্ষে মানুষের অবমূল্যায়নের শামিল। তিনিও পার্থিব রাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন। সুতরাং পার্থিব রাষ্ট্রের অধিবাসী হয়ে মানুষকে তিনি অবমূল্যায়ন করতে পারেন না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সেন্ট অগাস্টিন রাষ্ট্র সম্পর্কে যে অভিমত ব্যক্ত করেন তা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কর্মপ্রয়াস। যদিও বাস্তবতার সাথে তার রাষ্ট্রতত্ত্বের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না । তিনি সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চেয়েছেন। তিনি কল্পনা-প্রসূতভাবে হলেও বিশ্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে শান্তি আনয়নে প্রচেষ্টা চালান ।
সেন্ট অগাস্টিনের বিধাতার রাজ্য বা স্বর্গরাজ্যের রূপরেখা তুলে ধর।
উত্তর ভূমিকা : সেন্ট অগাস্টিন চতুর্থ শতকের একজন অন্যতম খ্যাতমান দার্শনিক ছিলেন। তিনি একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক ছিলেন । ৪১০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এ সময় অভিযোগ ওঠে যে, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের জন্য খ্রিস্টধর্ম দায়ী। অগাস্টিন অবিশ্বাসীদের এ অভিযোগ খণ্ডন করার জন্য 'The City of God' রচনা করেন। 'The City of God' এ দুটি রাজ্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ রাজ্যদ্বয়ের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে পার্থিব রাজ্য এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিধাতার রাজ্য বা স্বর্গরাজ্য।
সেন্ট অগাস্টিনের বিধাতার রাষ্ট্র বা স্বর্গবাজ্য : সেন্ট অগাস্টিনের মতে, “যখন কোনো সম্প্রদায়ের লেখা একই মূল্যবোধের দ্বারা অথবা কোনো কারণে একই অনুভূতির দ্বারা পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয় তখন একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়।” ঠিক তেমনি ঈশ্বরের প্রেমে একীভূত হয়ে গড়ে ওঠেছে স্বর্গরাজ্য। এখানে পুণ্যবান মানুষের আত্মা প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতিটি আদম সন্তান স্বর্গরাজ্যের সদস্য। স্বর্গরাজ্যের অধিবাসীদেরকে কোনো প্রকার পাপ, জরা, দুঃখ, কূটিলতা স্পর্শ করে না। তাদের লক্ষ্য একটাই আর তা হলো স্রষ্টার প্রেম ভালোবাসা। এ রাজ্যের অধিবাসীরা বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের হয়ে থাকে। স্বর্গরাজ্য অনন্ত চিরস্থায়ী। এটি পবিত্র ও মঙ্গলময়। এ স্বর্গরাজ্যের শেষ নেই, এটা অবিনশ্বর। স্বর্গরাজ্যের সদস্য হতে হলে তাকে যাবতীয় পাপাচার ও কলুষতা মুক্ত থাকতে হবে। কোনো প্রকার শ্রেণিবৈষম্য, বর্ণবৈষম্য সৃষ্টি করা যাবে না। তাহলে বিধাতার কৃপা পাবে না। আর বিধাতার কৃপা বা করুণা না পেলে স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করা যাবে না। কিন্তু সমস্যা হলো, বিধাতা সব মানুষের প্রতি সবসময় কৃপা প্রদর্শন করেন না। কেবল যাদের খ্রিস্টধর্মে অটুট বিশ্বাস থাকে শুধু তারাই ঈশ্বরের কৃপা পেয়ে থাকে। সুতরাং বলা যায়, স্বর্গরাজ্যের সদস্য শুধু খ্রিস্টধর্ম অনুসারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে এটাও বলা হয়েছে যে, এটা সর্বজনীন, সর্বত্র পরিব্যাপ্ত ।
সেন্ট অগাস্টিনের বিধাতার রাজ্যের রূপরেখা : নিম্নে সেন্ট অগাস্টিনের বিধাতার রাজ্যের রূপরেখা সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো : ১. কর্মফলের ক্ষেত্র : সেন্ট অগাস্টিনের মতে, প্রতিটি ক্ষেত্রের দুটি দিক থাকে, একটি মঙ্গল এবং অপরটি অমঙ্গল । সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই মহাপ্রয়াণ মানবাত্মা হরণ করছে। পার্থিব জগতে যারা পুণ্য কাজ করে, ঈশ্বরের দেওয়া বিধান অনুযায়ী জীবনব্যবস্থা পরিচালিত করে তাদের আত্মা ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করবে। তারা চিরসুখে থাকবে, যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। পক্ষান্তরে, যারা ঈশ্বরের দেওয়া বিধান অনুযায়ী জীবনব্যবস্থা পরিচালিত করবে না তারা ঈশ্বরের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে তারা অমঙ্গলের দিকে ধাবিত হবে। তারা স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না ৷ ঈশ্বরের অভিশাপ নিয়ে তারা চিরকাল শাস্তি পেতে থাকবে । সুতরাং পার্থিব জীবন হচ্ছে কর্মফলের ক্ষেত্রস্বরূপ ।
২. স্বৰ্গীয় শান্তি : স্বর্গীয় শান্তির ওপর ভিত্তি করে ঈশ্বরের রাজ্য গড়ে ওঠে। যার লক্ষ্য হলো শান্তি ও মুক্তি। স্বর্গীয় শান্তির প্রত্যাশায় হিব্রু জাতি যিশুর রাজ্যের পত্তন করে। আত্মার ও সত্তার মিলনে ঈশ্বরের রাজ্য শেষ হবে। আর তখনই আত্মা মুক্তি পাবে এবং ঈশ্বরের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অনন্ত সুখে বিরাজ করবে।
সংযমীদের সমাজ : ঈশ্বরের রাজ্যে সংযমীদের সমাজব্যবস্থা বিরাজমান। যারা নিরহংকার, ন্যায়পরায়ণ, সদাচারী, পুণ্যবান, উন্নত চরিত্রের অধিকারী, উদার ব্যক্তিবর্গ তারা এ সমাজের সদস্য। এ সমাজের সদস্যগণ একেশ্বর প্রেমের শুভাকাঙ্ক্ষী ।
৪. মহত্ত্বের প্রতীক : স্বর্গরাজ্যের অধিবাসীরা সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও মহত্ত্বের প্রতীক। পক্ষান্তরে, পার্থিব রাজ্যের অধিবাসীরা স্বার্থপরতা ও হিংসার প্রতীক । স্বর্গরাজ্যে মানুষের আত্মা বিরাজ করে । কিন্তু এখানে দেহ বিরাজ করতে পারে না । ৫. ঈশ্বরের প্রেম : অগাস্টিনের ধারণা মতে, অভিন্ন ঈশ্বরের ভালোবাসা কামনা স্বর্গরাজ্যের বৈশিষ্ট্য। স্বর্গরাজ্যের অধিবাসীরা ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে থাকে। তাদের ওপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ সমভাবে বর্ষিত হয়। সেখানে পার্থিব জগতের কোনো স্থান নেই। ঈশ্বরের অপার মহিমায় অনন্ত সুখে তারা ঈশ্বর রাজ্যে বিরাজ করে। দুঃখ, জরা তাদেরকে স্পর্শ করে না। হিংসার বাণী উচ্চারিত হয় না। সর্বত্রই প্রভুর অপার ভালোবাসায় সিক্ত হতে থাকে ।
৬. ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট রাজ্য : অগাস্টিনের মতে, পার্থিব রাজ্য হলো পাপের ফসল। পাপের ফলে পার্থিব রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে, সে কারণে পার্থিব রাজ্য বিধাতার অভিশপ্ত। অপরদিকে স্বর্গরাজ্য কল্যাণের, চির শান্তির। এ রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেতে হবে। আর ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেতে হলে খ্রিস্টধর্মের অনুসারী হতে হবে। যিশুর প্রতি আস্থা রাখতে হবে । অন্যথায় স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করা যাবে না।
৭. সর্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থা : সেন্ট অগাস্টিনের মতে স্বর্গরাজ্যে কেবল খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীরা প্রবেশ করতে পারবে। এখানে জাতিধর্মবর্ণ কোনো বৈষম্য থাকবে না। পুণ্যাত্মার অধিকারীগণ স্বর্গরাজ্য বিরাজ করবে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সে কারণে স্বর্গরাজ্যকে সর্বজনীন বলা হয়েছে ।
সমালোচনা : সেন্ট অগাস্টিনের বিধাতার রাজ্য বা স্বর্গরাজ্য তত্ত্ব বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
প্রথমত, স্বর্গরাজ্য অসীম ও অনন্ত। এর কোনো সীমা বা পরিধি নির্ণয় করা যায় না। বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে রয়েছে। সব আদম সন্তান এ রাজ্যের নাগরিক হওয়ার যোগ্য। তবে যারা ঈশ্বরের করুণাপ্রাপ্ত কেবল তারাই সদস্য হতে পারে। সেন্ট অগাস্টিন এর কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখাননি ।
দ্বিতীয়ত : সেন্ট অগাস্টিনের মতে, স্বর্গরাজ্যে শুধু খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীরা অনন্ত শান্তিতে বিরাজ করবে । অন্য ধর্মের অনুসারীরা অভিশাপ প্রাপ্ত হবেন । তাদের ওপর ঈশ্বরের করুণা বর্ষিত হবে না। অগাস্টিনের এ ধারণা গ্রহণযোগ্য নয় । কেননা বিধাতা শুধু খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাসীদের নয়। তিনি সমুন্নত ও পরিব্যাপ্ত, সর্বত্র বিরাজমান। সব সৃষ্টির প্রতি তার করুণা আছে। সুতরাং বলা যায়, এটা অগাস্টিনের একান্তই নিজস্ব অভিমত ।
.
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সেন্ট অগাস্টিনের দর্শনের মধ্যে রাষ্ট্রতত্ত্ব অন্যতম। আর রাষ্ট্রতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে নিয়ে সেন্ট অগাস্টিন ঈশ্বরের রাজ্য বা স্বর্গ রাজ্যের অবতারণা করেন। তিনি তার ধর্ম দর্শনের আলোকে স্বর্গরাজ্য ধারণা ব্যাখ্যা করেন । অগাস্টিনের স্বর্গরাজ্যের আলোচনা সমালোচনা যাই হোক না কেন তার মূল লক্ষ্য ছিল সমকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা । শান্তির অন্বেষায় তিনি এ ধারণার অবতারণা করেন ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]