সেন্ট অগাস্টিনের শান্তিতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর ।

উত্তর ভূমিকা : সেন্ট অগাস্টিন ছিলেন চতুর্থ শতকের একজন খ্যাতিমান খিষ্ট্রান দার্শনিক। তিনি মূলত একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক ছিলেন । তাই খ্রিস্টধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শান্তি সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করেন ৷ রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে সেন্ট অগাস্টিনের শান্তিতত্ত্ব ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। খ্রিস্টধর্মের শান্তিনীতিই অগাস্টিনের দর্শন চর্চার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় ।
সেন্ট অগাস্টিনের শান্তিতত্ত্ব : সেন্ট অরেলিয়াস অগাস্টিন শান্তি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন। সাধারণ অর্থে শান্তি বলতে বুঝায় কোনোরূপ সংঘাতবিহীন অবস্থা। পার্থিব রাষ্ট্রের নাগরিকরা সবসময় নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে । তারা লোভ, মোহ, আত্মকলহ ও বর্ণবৈষম্যে লিপ্ত। সে কারণে পার্থিব রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্বর্গরাজ্য বা বিধাতার রাষ্ট্রের প্রয়োজন। স্বর্গরাজ্যের নাগরিকেরা ভ্রাতৃত্ববোধ ও বিধাতার প্রেমে মগ্ন থাকে। তাদেরকে কোনোরূপ পাপ বা কলুষতা স্পর্শ করে না। তারা ন্যায়পরায়ণ ও পবিত্র। এটাই হচ্ছে বিধাতার বা স্বর্গরাজ্যের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য। সে কারণেই সেন্ট অগাস্টিন বলতে চেয়েছেন বিধাতার রাষ্ট্র ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। অগাস্টিনের শান্তিতত্ত্বে দুটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়। একটি হচ্ছে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ এবং অপরটি হচ্ছে সর্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থা।
তার মতে, বিধাতার রাষ্ট্র ছাড়া যেমনি ন্যায়বিচার সম্ভব নয়, তেমনি শান্তি প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব নয়। সর্বজনীন শান্তির জন্য সর্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজন । শুধু বিধাতার রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে এক ও অভিন্ন লক্ষ্য থাকে তা হচ্ছে ঈশ্বরের প্রেম ও ভালোবাসা। এখানে সবাই সমানভাবে ঈশ্বরের প্রেম, ভালোবাসার করুণা পেয়ে থাকে। অগাস্টিনের শান্তিনীতির ব্যাখ্যা করে A.B.Faster বলেন, যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় সব মানুষ অভিন্ন ঈশ্বরপ্রেমের বন্ধনসূত্রে পরস্পরে সক্রিয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ সেটিই হচ্ছে অগাস্টিনের শান্তিনীতি । সুতরাং সর্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ভ্রাতৃত্ববোধের ওপর অগাস্টিনের শান্তিনীতি প্রতিষ্ঠিত ।
" সেন্ট অগাস্টিনের শান্তিতত্ত্ব ব্যাখ্যা : সেন্ট অগাস্টিনের শান্তিতত্ত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা লাভ করতে হলে অগাস্টিনের দর্শনতত্ত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন । নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. সর্বজনীন শান্তি : সেন্ট অগাস্টিন সর্বজনীন শান্তির জন্য সর্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তার মতে, কোনো বৃহৎ বস্তুর অংশবিশেষ দেখে যেমন বস্তুটির পরিধি নির্ণয় করা যায় না তেমনি কোনো ক্ষুদ্র অংশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে সর্বজনীন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যাবে না। কারণ পার্থিব রাষ্ট্র স্বর্গরাজ্যের অংশবিশেষ। সুতরাং সর্বজনীন শান্তির জন্য সর্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজন ।
২. সর্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থা : সেন্ট অগাস্টিনের মতে, জাগতিক বা পার্থিব রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় । পার্থিব রাষ্ট্রের নাগরিকগণ সর্বদা পাপাচারে লিপ্ত থাকে। তারা মিথ্যা ও স্বার্থপরতায় নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখে। তারা এতটাই অকৃতজ্ঞ যে ঈশ্বরকে স্মরণ পর্যন্ত করে না। তাই সর্বজনীন শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আগে প্রয়োজন সর্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থা। সর্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থা হওয়ার পরই সর্বজনীন শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব ।
৩. খ্রিস্টধর্মের প্রয়োজনীতা : সেন্ট অগাস্টিন সর্বজনীন শান্তি প্রতিষ্ঠায় খ্রিস্টধর্মের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তার শান্তিতত্ত্ব খ্রিস্টধর্ম দর্শনের আলোকে ব্যাখ্যা করেন। সেজন্য বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে খ্রিস্টধর্মের মাধ্যমে করা সম্ভব। খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাবের পূর্বে কোনো পৌত্তলিক রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই অগাস্টিন মনে করেন যে, খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই কেবল সর্বজনীন শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
৪. ঐক্যবদ্ধ : সেন্ট অগাস্টিন শান্তি প্রতিষ্ঠায় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। পার্থিব রাষ্ট্রের সদস্যদের মধ্যে আত্মকলহ, বিভেদ, স্বার্থপরতা বিরাজ করে। এরা একতাবদ্ধ নয়। তার মতে, এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় ! শান্তি প্রতিষ্ঠায় একতাবদ্ধ থেকে ঈশ্বরের অনুগ্রহ কামনায় লিপ্ত থাকতে পারলেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
৫. গির্জার প্রতি আনুগত্যশীলতা : সর্বজনীন শান্তি প্রতিষ্ঠায় সেন্ট অগাস্টিন সব নাগরিককে গির্জার প্রতি অনুগত থাকার জন্য পরামর্শ দেন। কেননা গির্জা হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তার দৃষ্টিতে গির্জার ক্ষমতা রাষ্ট্রের ক্ষমতার চেয়েও অধিক । গির্জা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। রাষ্ট্রব্যবস্থা গির্জার আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। অর্থাৎ সবকিছুই গির্জার নিয়ন্ত্রণাধীন হবে। সে কারণে অগাস্টিন গির্জার প্রতি অনুগত থাকার নির্দেশ দেন ।
সমালোচনা : সেন্ট অগাস্টিনের শান্তিতত্ত্বটি ঐতিহাসিক মহলে বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে এ তত্ত্বের সমালোচনাসমূহ দেওয়া হলো :
১. সংকীর্ণ চিন্তাচেতনা : সেন্ট অগাস্টিন খ্রিস্টধর্মের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার কর্মপ্রয়াস চালান যা তার সংকীর্ণ চিন্তাচেতনার পরিচয় বহন করে ।
২. প্রকৃতির প্রতি গুরুত্বারোপ : সেন্ট অগাস্টিন শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রকৃতির প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি শুধু প্রকৃতির মাঝে শান্তির সন্ধান করেন । প্রকৃতি ছাড়া অন্য কোথাও শান্তি প্রতিষ্ঠার ভাবনা তার মাঝে অনুপস্থিত ছিল । ৩. পার্থিব রাষ্ট্রের অবহেলা : সেনট অগাস্টিন তার শান্তিতত্ত্বে পার্থিব রাষ্ট্রকে অবহেলা করেছেন। তার মতে, প্রকৃতপক্ষে পার্থিব রাষ্ট্রে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয় । পার্থিব রাষ্ট্রে বিরাজিত শান্তি বিশ্বশান্তি নয় ।
৪. নেতিবাচক দোষে দুষ্ট : সেন্ট অগাস্টিনের শান্তিতত্ত্বটি নেতিবাচক দোষে দুষ্ট। তিনি সাধারণত যুদ্ধের অনুপস্থিতিকে শান্তি বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু যুদ্ধের অনুপস্থিতি ছাড়াও যে রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সেকথা তিনি ভাবেননি । ৫. বাস্তবতা বিবর্জিত : অগাস্টিন যে শান্তিতত্ত্ব প্রচার করেছেন তা সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিবর্জিত। বাস্তবের সাথে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সেন্ট অগাস্টিন ধর্মযাজক হিসেবে শান্তির যে বাণী উচ্চারণ করেন তা কেবল খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীদের মনে গভীর রেখাপাত করতে সক্ষম হয় । তার রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে শান্তিনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। বাস্তবে তার শান্তিনীতির অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তার নীতি অনুযায়ী পার্থিব রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় । তার শান্তিনীতি ঐতিহাসিক মহলে বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে।
সেন্ট অগাস্টিনের ন্যায়বিচার তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর ।
উত্তর ভূমিকা : খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে যিনি রাষ্ট্র দর্শন প্রচার করে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি হলেন সেন্ট অরেলিয়াস অগাস্টিন। রাষ্ট্রদর্শনের পাশাপাশি তিনি ন্যায়বিচারের প্রতি বেশ গুরুত্ব আরোপ করেন । তিনি রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ন্যায়বিচার তত্ত্বের অবতারণা করেন। তার মতে, চরম ও পরম ন্যায় বিচারের প্রতিষ্ঠার জন্য একমাত্র বিদাতার দৈবরাষ্ট্রের প্রয়োজন। পার্থিব রাষ্ট্রে কোনোভাবেই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তৎকালীন সময়ে সেন্ট অগাস্টিনের এ তত্ত্ব ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে ।
" ন্যায়বিচার তত্ত্ব : নিম্নে সেন্ট অগাস্টিনের ন্যায়বিচার তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হলো :
ক. সেন্ট অগাস্টিনের ন্যায়বিচার তত্ত্ব পরিচিত : ন্যায়বিচার সম্পর্কে অগাস্টিনের মতামত হলো এই যে, প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব নিয়ম বা রীতিনীতির দ্বারা পরিচালিত হয়। উক্ত প্রতিষ্ঠানের সদস্যগণ তাদের ওপর আরোপিত নিয়মকানুন যথাযথভাবে পালন করলে, তখন ধরা হবে উক্ত প্রতিষ্ঠানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সদস্যবৃন্দকে ন্যায়পরায়ণ বলে গণ্য করা হবে। তবে আগে বুঝতে হবে প্রতিষ্ঠানটির স্বরূপ কেমন। যদি প্রতিষ্ঠান উচ্চতর কোনো প্রতিষ্ঠানের অংশবিশেষ হয়, তাহলে বুঝতে হবে চূড়ান্ত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে গণ্য হবে না। এ সম্পর্কে অগাস্টিন বলেন, “সর্বোচ্চ ও সর্বজনীন দৈবরাষ্ট্র ব্যতীত অন্য কোনো সমাজের প্রেক্ষিতে ন্যায়বিচার চূড়ান্ত হতে পারে না।” এটাকে আপেক্ষিক ন্যায়বিচার অর্থে বলা যেতে পারে। এ সম্পর্কে তিনি একটি চমৎকার উদাহরণের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন । যেমন— “একটি পরিবার একটি সমাজের অংশবিশেষ, যদি শুধু এই পরিবারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে তাকে প্রকৃত ন্যায়বিচার বলা যৌক্তিক হবে না। কারণ এ পরিবার বিশাল সমাজের ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।” ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য একমাত্র বিধাতার রাষ্ট্রের প্রয়োজন। পার্থিব রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কেননা পার্থিব রাষ্ট্র বিধাতার রাষ্ট্রের অংশবিশেষ। কোনো বস্তুর অংশবিশেষ দেখে যেমন প্রকৃত অবস্থা বিচার করা যায় না তেমনি কোনো ক্ষুদ্র অংশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে বলা যায় না যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সুতরাং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিধাতার রাষ্ট্রের প্রয়োজন । অগাস্টিনের মতে, স্বর্গরাজ্য ব্যতীত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় । ন্যায়বিচারের ধারণা দিতে গিয়ে তিনি আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধি করেন। আইনবিহীন রাষ্ট্রকে তিনি দস্যুর সাথে তুলনা করেন । তার মতে কোনো রাষ্ট্র যদি ধর্মবিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা থেকে বিরত থাকে এবং চার্চের নিয়ম মোতাবেক পরিচালিত হয় তাহলে সে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে ।
খ. ন্যায়বিচার তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য : মধ্যযুগের দার্শনিকদের মধ্যে অগাস্টিন সর্বপ্রথম ন্যায়বিচার সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেন । ন্যায়বিচারের তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে হলে তার ন্যায়বিচারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করতে হবে। তাহলে ন্যায়বিচার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। নিম্নে ন্যায়বিচার তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করা হলো :
১. সর্বজনীন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা : সেন্ট অগাস্টিন ন্যায়বিচার তত্ত্বের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সর্বজনীন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। সর্বজনীন রাষ্ট্র ব্যতীত অন্য কোনো রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আর যদিও কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয় তা চূড়ান্ত ন্যায়বিচার বলে গণ্য হবে না। কেননা তা বৃহৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের অংশবিশেষ। সুতরাং কোনো অংশবিশেষ ন্যায়বিচার হলে রাষ্ট্রে চূড়ান্ত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যাবে না। একমাত্র সর্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ।
২. দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণতা : সেন্ট অগাস্টিন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণতার কথা উল্লেখ করেন। তার মতে, রাষ্ট্রের সব নাগরিক যদি নিষ্ঠার সাথে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে তাহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। রাষ্ট্রের নাগরিকগণ ন্যায়পরায়ণ না হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় ।
৩. খ্রিস্টান রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা : সেন্ট অগাস্টিন একমাত্র খ্রিস্টান রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার কথা উল্লেখ করেন । তিনি বলেন, “কেবল খ্রিস্টবাদের মাধ্যমেই মুক্তি অর্জন সম্ভব।” তিনি খ্রিস্টধর্মের আলোকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। খ্রিস্টান মতাদর্শ রাষ্ট্র ব্যতীত অন্য কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার ন্যায়বিচার তত্ত্ব প্রযোজ্য নয় এবং সেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন ।
৪. প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব : অগাস্টিনের ন্যায়তত্ত্ব বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি সর্বনিম্ন হতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেন। এ সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, পরিবার, রাষ্ট্রব্যবস্থা, বৃহত্তর সমাজব্যবস্থা সব ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ন্যায়বিচার বাস্তবায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান ছাড়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নাগরিকদের যথাযথ সচেতনতার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় ।
৫. গির্জার প্রতি অনুগত : সেন্ট অগাস্টিনের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অন্যতম মাধ্যম হলো গির্জা। তিনি গির্জাকে বিধাতার রাজ্যের বাহ্যিক রূপ বলে আখ্যায়িত করেন। ন্যায়বিচার গির্জার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। কেননা গির্জা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পরিচালিত করে। অগাস্টিনের মতে, প্রত্যেক শাসকবর্গ গির্জার অধীন। গির্জার কর্মকর্তার গুরুত্ব জাগতিক সংগঠনের কর্মকর্তার চেয়ে অধিক । সে কারণে গির্জার প্রাধান্য অনেক বেশি ।
৬. দ্বৈব বা স্বর্গরাজ্যের প্রাধান্য : সেন্ট অগাস্টিনের মতে, জাগতিক রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কারণ জাগতিক রাষ্ট্র সর্বজনীন রাষ্ট্রের অংশবিশেষ মাত্র। চূড়ান্ত ন্যায়বিচার একমাত্র সর্বজনীন রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ৭. রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ : রাষ্ট্রের নাগরিকরা তাদের কর্তব্য পালনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য না থাকলে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে না, সেজন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয় । সুতরাং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য নাগরিকদের আনুগত্য একান্ত প্রয়োজন । সমালোচনা : সেন্ট অগাস্টিনের ন্যায়বিচার তত্ত্ব বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো : ১. কল্পনাপ্রসূত ধারণা : সেন্ট অগাস্টিনের ন্যায়বিচার সংক্রান্ত মতবাদটি একান্তই তার ব্যক্তিগত কল্পনাপ্রসূত। তিনি কাল্পনিক রাজ্যের অবতারণা ঘটিয়ে সেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালান । বাস্তবে তিনি কোনো রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাননি । ২. বাস্তবায়ন সম্ভব নয় : সেন্ট অগাস্টিনের ন্যায়বিচার তত্ত্ব কল্পনাপ্রসূত। সুতরাং কল্পনাকে বাস্তবে রূপদান করা সম্ভব নয়। তিনি স্বর্গরাজ্যের যে বিবরণ দেন বাস্তবে তার কোনো অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই ন্যায়বিচার তত্ত্ব বাস্তবায়নের অযোগ্য ।
৩. পার্থিব রাষ্ট্রকে অবহেলা : সেন্ট অগাস্টিন স্বর্গরাজ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পার্থিব রাষ্ট্রকে অবহেলা করেন। তার মতামত খ্রিস্টধর্ম দর্শনের আলোকে ব্যাখ্যা করেন। এ ব্যাপারে তিনি জোরালো যুক্তিও প্রদর্শন করেন । তিনি পার্থিব রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কোনো চেষ্টাই করেননি ।
৪. ধর্মীয় প্রাধান্য : অগাস্টিন ন্যায়বিচার তত্ত্বের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে অত্যন্ত হীনতার পরিচয় দেন। খ্রিস্টধর্মের আলোকে তার ন্যায়তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় খ্রিস্টধর্মের অনুসারী হতে হবে এবং খ্রিস্টান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজন হবে যা তার সংকীর্ণ চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ ।
৫. প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিকতা : সেন্ট অগাস্টিনের ন্যায়তত্ত্ব প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আলোচিত হয়েছে, কোনো ব্যক্তির ওপর নয় । তিনি স্বর্গরাজ্যে বা সর্বজনীন প্রতিষ্ঠানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন। সে কারণে বলা যায়, তার ন্যায়বিচার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক । উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অগাস্টিনের ন্যায়তত্ত্ব তার দর্শন তত্ত্বের মধ্যে অন্যতম । যার আলোকে তিনি মধ্যযুগের রাষ্ট্রব্যবস্থায় শান্তি অন্বেষণ করেছেন। অগাস্টিন সম্পর্কে গেটেল বলেন, “অগাস্টিনের সমগ্র রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে তার ন্যায়বিচার তত্ত্ব ও শান্তিতত্ত্ব তাকে পরিপূর্ণতা দান করেছে।” তাই সেন্ট অগাস্টিন ন্যায়বিচার তত্ত্ব প্রদান করে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন ।
সেন্ট অগাস্টিনের ইতিহাস দর্শন আলোচনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : সেন্ট অগাস্টিন ছিলেন চতুর্থ শতকের একজন প্রাণপুরুষ। ইতিহাস দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন। তিনি ধর্মদর্শনের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাসকর্ম তুলে ধরেছেন। ৪১০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অবিশ্বাসী রোমানরা খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাবকে দায়ী করে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে তিনি ইতিহাস দর্শনের সূচনা করেন ।

সেন্ট অগাস্টিনের ইতিহাস দর্শন : সেন্ট অগাস্টিনের বিখ্যাত গ্রন্থ 'The City of God' এর মাধ্যমে তার রাষ্ট্রদর্শন তত্ত্বের প্রকাশ ঘটে। তিনি রোমান সাম্রাজ্যের পতন, শান্তিনীতি, দাসপ্রথা, সম্পত্তি প্রভৃতি সবকিছুই সম্পর্কে ধারণা খ্রিস্টধর্মের আলোকে ব্যাখ্যা দেন। তিনি ধর্মদর্শনের আলোকে দুটি রাষ্ট্রের উল্লেখ করেন। একটি বিধাতার রাষ্ট্র এবং অপরটি পার্থিব রাষ্ট্র ।
বিধাতার রাষ্ট্র সর্বজনীন। সব আদম সন্তান এ রাজ্যের নাগরিক। এ রাজ্যের সদস্যগণ সব ধরনের দুঃখ, জরা থেকে মুক্ত । লোভ, মোহ, অহংকার তাদের স্পর্শ করতে পারে না। তারা বিধাতার অপার করুণার জন্য লিপ্ত থাকেন। অপরদিকে পার্থিব রাজ্যের মানুষেরা সর্বদা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে। তাদের ওপর বিধাতার করুণা সমভাবে বর্ষিত হয় না। The City of God' এর প্রতিটি ঘটনাই ধর্মীয় দর্শনে আবর্তিত। সুখদুঃখ বিধাতার দান । এখানে মানুষের কোনো হাত নেই । তিনি প্রতিটি ঘটনার জন্য ঈশ্বরের আধিপত্যের গুণগান করেন। পার্থিব রাজ্যের ইতিহাস ব্যর্থতার বিবরণে পরিপূর্ণ। অন্যদিকে স্বর্গরাজ্যের ইতিহাস আদম (আ.) থেকে যিশু খ্রিস্টের সময়কাল পর্যন্ত ধারাবাহিক বর্ণনা করা রয়েছে। রোম সাম্রাজ্যের পতন সম্পর্কে তিনি বলেন, পার্থিব রাজ্যের অংশ হিসেবে রোম সাম্রাজ্যের পতন খুবই স্বাভাবিক। পার্থিব রাষ্ট্র নশ্বর আর স্বর্গরাজ্য অবিনশ্বর। সুতরাং স্বাভাবিক নিয়মেই রোম সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে। সেজন্য খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব কোনোভাবেই দায়ী নয় । অগাস্টিন সীমাবদ্ধতার বৃত্তের বাইরে আসতে পারেননি। ধারাবাহিকতা ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তিনি ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করেননি । তিনি ইতিহাসকে একান্ত নিজের মতো করে ব্যবহার করেন। আর এটাই ছিল তার ইতিহাসকর্মের দুর্বল দিক। তার ইতিহাসকর্ম মূল্যায়ন করলে প্রতীয়মান হয় যে, খ্রিস্টধর্মের প্রভাব প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহে উল্লিখিত হয়েছে। তিনি সর্বদাই ঈশ্বরের আধিপত্যের কথা উল্লেখ করেন ।
·
সেন্ট অগাস্টিনের চিন্তাধারা তার দুটি গ্রন্থের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তার প্রথম গ্রন্থটি হচ্ছে ‘দি কনফেসনস' অপরটি ‘দি সিটি অব গড” । “দি কনফেসনস' হলো আত্মচরিত্রমূলক গ্রন্থ। খ্রিস্টানদের যতগুলো গ্রন্থ ছিল তার মধ্যে 'দি কনফেসনস' ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী। এতে অগাস্টিনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ, আধ্যাত্মিকতার জন্য কঠোর পরীক্ষা নিরীক্ষা ও বিভিন্ন প্রচেষ্টার বিবরণ রয়েছে। সেন্ট অগাস্টিন ‘দি কনফেসনস' গ্রন্থে ধর্মীয় পথ প্রদর্শনের দিকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন । সেন্ট অগাস্টিনের অপর বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম The City of God'। এটি মূলত একটি সাহিত্যকর্ম। তিনি কোনো ঐতিহাসিক নন। তাই তার রচিত গ্রন্থটিও ইতিহাসকর্ম নয়। তবে গ্রন্থটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। গ্রন্থটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ না হলেও ইতিহাস কীভাবে লিখতে হয় সে সম্পর্কে বিবরণ দেওয়া হয়েছে। ৪১০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে অবিশ্বাসীরা অপপ্রচার করতে থাকে যে, খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাবই রোমান সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী। সেন্ট অগাস্টিন তাদের এ অভিযোগের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন । তিনি The City of God' এর মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, “রোমান সাম্রাজ্যের পতনের জন্য খ্রিস্টধর্ম দায়ী নয়। স্বাভাবিক নিয়মে রোমান সম্রাজ্যের পতন হয়েছে। রোমানদের উত্থানের ক্ষেত্রে যেমন পৌত্তলিকতার কৃতিত্ব নেই, তেমনি পতনের জন্য খ্রিস্টধর্ম দায়ী নয়।” তার এ অভিমত একমাত্র খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীদের মনে গভীর রেখাপাত করে। রোমানরা এক পর্যায়ে খ্রিস্টানদের ঘৃণার চোখে দেখতে থাকে। তাদের অভিযোগ থেকে মুক্ত করার জন্য খ্রিস্টধর্মের পক্ষে সেন্ট অগাস্টিন 'The City of God' রচনা করেন ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সেন্ট অগাস্টিনের ইতিহাস দর্শন ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। ধর্মকে তিনি ইতিহাসের প্রধান বিষয়বস্তুতে পরিণত করেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ে তার এ ধর্মকেন্দ্রিক ইতিহাস চর্চা ইউরোপে ব্যাপক আলোচিত হয়। পরবর্তী সময়ে তা আবার স্থিমিত হয়ে যায়। সত্যিকার অর্থে সেন্ট অগাস্টিন কোনো ঐতিহাসিক ছিলেন না। এ কারণে তিনি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেননি । তিনি স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণের জন্য ইতিহাসকে ব্যবহার করেন ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]