তারিখ ই ফিরোজশাহির বিষয়বস্তু আলোচনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে যে কয়জন প্রখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিকের পরিচয় পাওয়া যায় জিয়াউদ্দিন বারানি তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস রচনা করেন। তার বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থের নাম ‘তারিখ ই ফিরোজশাহি' । তারিখ ই ফিরোজশাহিতে তৎকালীন শাসকবর্গের শাসন সম্পর্কে জানা যায়। এছাড়া তার গ্রন্থে ভূসম্পত্তি, প্রশাসন ও অর্থনীতি বিষয়েও খবরা খবর পাওয়া যায় ।
জিয়াউদ্দিন বারানির 'তারিখ ই ফিরোজশাহি' গ্রন্থের বিভিন্ন দিক : নিম্নে জিয়াউদ্দিন বারানির তারিখ ই ফিরোজশাহি গ্রন্থের বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হলো :
ক. তারিখ ই ফিরোজশাহির বিষয়বস্তু : জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত বিখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থের নাম 'তারিখ ই ফিরোজশাহি'। তিনি ১৩৫৭ সালে এটি রচনা করেন। গ্রন্থটির বিষয়বস্তু হলো ভারতবর্ষে সুলতানি শাসনামলের আটজন শাসকের ৯৫ বছরের শাসনব্যবস্থা। গ্রন্থটিতে সুলতানি আমলের রাজনৈতিক ঘটনাবলির সাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবস্থারও বিবরণ পাওয়া যায়। 'তারিখ ই ফিরোজশাহিতে' মধ্যযুগের হাটবাজারের ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি, দ্রব্যমূল্যের সূচক, রাজধানী দিল্লির জনজীবন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এতে ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী শাসকদের কর্তব্য সম্পর্কে দিকনির্দেশনাসহ ঐতিহাসিকদের করণীয় দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। 'তারিখ ই ফিরোজশাহি' গ্রন্থটির বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনায় ঐতিহাসিক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে।
খ. অবৈধ শাসকদের উপদেশ : জিয়াউদ্দিনের মতে, নবি-রাসুল ও সুলতানগণ স্রষ্টা কর্তৃক তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন । তিনি ইসলামের চার খলিফা ব্যতীত আর কাউকে বৈধ শাসক হিসেবে মনে করেন না। কেননা তারা জনগণের অসম্মতিতে বা অবৈধভাবে শাসন ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি সুলতানদেরকে ধর্মীয় শাসনের অধীনে থেকে শাসনক্ষমতা পরিচালনা করার উপদেশ প্রদান করেছেন। তিনি অবৈধ শাসকদের উদ্দেশ্যে যেসব পরামর্শ প্রদান করেছেন তা নিম্নরূপ :
১. ইসলামের সুরক্ষা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন ।
২. অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির পর ইসলামের বাণী প্রচার করবেন। যাতে সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে সেরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
৩. রাষ্ট্রে ধর্মীয় আইন প্রচলন, অধর্ম নিরসন ও অবিশ্বাসীদের বিশেষ করে হিন্দুদের কঠোরভাবে দমন করবে ।
৪. কঠোরতার সাথে সুবিচার করতে হবে এবং শাসনকাজে মুসলমানদের নিয়োগ প্রদান করতে হবে ।
৫. ইসলামি শরীয়ার পরিপন্থি শাস্তি প্রদান করা যাবে না ।
৬. ইসলামি রাষ্ট্রের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্টকারীকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবে।
গ. রাষ্ট্র সম্পর্কে মতামত : জিয়াউদ্দিন বারানি ধর্মীয় দৃষ্টি থেকে রাষ্ট্র সম্পর্কে মতামত প্রদান করেছেন। স্থিতিশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে ধর্মপ্রচার করতে কোনো প্রকার সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয়। তিনি গুপ্তচর ব্যবস্থা, সেনাবাহিনী, রাজকোষ ইত্যাদি রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও অবৈধ উপায়ে শাসনক্ষমতা অর্জনকারীদের রাষ্ট্র পরিচালনার দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন ।
ঘ. রাজন্য দর্পণ : রাজন্য অর্থ রাজ্যের শাসক ও শাসননীতি । আর দর্পণ অর্থ আয়না। তারিখ ই ফিরোজশাহিতে তৎকালীন সুলতানি শাসনের বাস্তবচিত্র ফুটে ওঠেছে। এ কারণে একে রাজন্য দর্পণ বলা হয়েছে। তারিখ ই ফিরোজশাহিতে সুলতানি শাসনামলের আটজন শাসকের বিবরণ পাওয়া যায় । সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন থেকে শুরু করে ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনকালের ধারাবাহিক বিবরণ দেওয়া আছে। তারিখ ই ফিরোজশাহিতে তৎকালীন শাসনব্যবস্থার অবস্থা, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। সুলতানি শাসনামলের অন্যান্য শাসকদের মধ্যে ফিরোজশাহ তুঘলকই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। তারিখ ই ফিরোজশাহিতে তিনি শাসকদেরকে ভোগবিলাসিতায় মত্ত না থেকে তাদের ওপর অর্পিত কর্তব্যকর্ম পালনে উপদেশ দিয়েছেন। এ গ্রন্থটিতে রাজ্য ও রাজাদের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে বলে এটাকে রাজন্য দর্পণ বলা হয়েছে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জিয়াউদ্দিন বারানির ‘তারিখ ই ফিরোজশাহি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক গ্রন্থ। তার এ গ্রন্থের মাধ্যমে সুলতানি শাসকদের সম্পর্কে জানা যায়। এ গ্রন্থের বিষয়বস্তু হলো রাজা ও রাজ্য এবং রাজনৈতিক বিষয়াবলি । সে কারণে তারিখ ই ফিরোজশাহিকে রাজন্য দর্পণ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
জিয়াউদ্দিন বারানির পরিচয় দাও। ইতিহাসের উপকারিতা সম্পর্কে বারানির মতামত কী ছিল ?
উত্তর ভূমিকা : মধ্যযুগে সুলতানি শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে যে কয়জন প্রখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিকের পরিচয় পাওয়া যায় জিয়াউদ্দিন বারানি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি প্রচলিত ধারার পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চার প্রচলন করেন। তিনি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস চর্চা শুরু করলেও নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হন। তার লেখনীতে সুলতানি শাসনামলের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায় ।
জিয়াউদ্দিন বারানির পরিচয় : জিয়াউদ্দিন বারানি বারান নামক স্থানে ১২৮৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম জিয়াউদ্দিন। বারান হলো তার উপাধি। তার পিতা একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ছিলেন। সে সুবাদে তিনি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি আরবি ও ফার্সি ভাষায় যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেন । পিতার কর্মসূত্র ধরে রাজদরবারে তার অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল। সে কারণে তিনি সুলতানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। মুহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে তিনি রাজকর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি দীর্ঘ ১৭ বছর মুহাম্মদ বিন তুঘলকের অধীনে রাজকর্মচারী ছিলেন। মুহম্মদ বিন তুঘলক মৃত্যুবরণ করলে, ফিরোজশাহ তুঘলক রাজক্ষমতায় আসেন। ফিরোজশাহ তুঘলকের শাসনামলে তিনি ছয় বছর প্রধান রাজ ঐতিহাসিকের দায়িত্ব পালন করেন।
● ইতিহাস পাঠের উপকারিতা সম্পর্কে বারানির মতামত : নিম্নে ইতিহাস পাঠের উপকারিতা সম্পর্কে বারানির মতামত তুলে ধরা হলো :
১. ঐশী গ্রন্থের সাথে পরিচয় : ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে মানবসমাজ ঐশী গ্রন্থের সাথে পরিচিত হয়। স্রষ্টার বাণী সংবলিত ঐশী গ্রন্থে নবি-রাসুলদের জীবনকর্ম ও রাজা-বাদশাহদের অত্যাচার অবিচারের বর্ণনা পাওয়া যায়। সচেতন মানুষকে ইতিহাস দৃষ্টান্তের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে থাকে ।
২. ইতিহাস হাদিসের যমজ ভ্রাতা : বারানি ইতিহাসকে হাদিসের যমজ ভ্রাতা হিসেবে উল্লেখ করেন। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) এর বাণী ও কর্ম সম্পর্কে জানতে হলে হাদিস বর্ণনাকারীর অতীত জানতে হবে। হাদিস বর্ণনাকারীর তথ্য জানতে হলে অবশ্যই ইতিহাসের সাহায্য নিতে হয় ।
৩. শাণিত যুক্তিবুদ্ধি : ইতিহাস অগণিত মানুষের যুক্তি, বুদ্ধি ও কর্মের বস্তুনিষ্ঠ ভান্ডার। তার মতে ইতিহাস অধ্যয়ন করলে মানুষের যুক্তি ও বুদ্ধি শাণিত হয় । ইতিহাস হলো মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র ।
৪. সমস্যা মোকাবিলা : বারানি ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে সমস্যা মোকাবিলার জন্য মতামত প্রদান করেন। অতীতে শাসকবর্গ কীভাবে সমস্যা মোকাবিলা করেছেন, ভবিষ্যতে কীভাবে সমস্যা সমাধান করা হবে এসব ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে উপকৃত হওয়া যায় ৷
৫. ধৈর্যশীল হতে শিক্ষা দেয় : ইতিহাস পাঠ মানুষকে ধৈর্যশীল হতে শিক্ষা দেয়। নবি-রাসুলগণ আল্লাহর আদেশ পালন করতে গিয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছেন। এরপরও নবি-রাসুলগণ যেভাবে ধৈর্যধারণ করে সংকট মোকাবিলা করেছেন এবং সংকট হতে উত্তরণের পথ খুঁজে পেয়েছেন, মানুষ ইতিহাস পাঠ থেকে সেভাবে সংকট মোকাবিলার শিক্ষা নিতে পারে । ৬. ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া : বারানির মতে, বর্তমান শাসকগণ ইতিহাস অধ্যয়নের মাধ্যমে পূর্বের শাসকদের শাসন পদ্ধতি, তাদের ক্রিয়াকলাপ ও পরিণতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভ করতে পারে। সে অনুযায়ী শাসন পদ্ধতি হতে বিরত থেকে ন্যায়পরায়ণতা ও সততার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারেন। এভাবে ইতিহাস শাসকবর্গকে কল্যাণকর শাসনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাস পাঠ মানুষের নানাবিধ কল্যাণসাধন করে থাকে । ইতিহাস মানুষকে সহনশীল, যুক্তিবাদী, জনহিতৈষী হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া সম্ভব, যা থেকে ভবিষ্যতের শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। এ জন্যই বারানি ইতিহাস পাঠের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন ।
তারিখ ই ফিরোজশাহির আলোকে বারানির ইতিহাস দর্শন আলোচনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ঊষালগ্নে যে কয়জন ঐতিহাসিকের পরিচয় পাওয়া যায় জিয়াউদ্দিন বারানি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। সুলতানি শাসনামলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস চর্চার প্রচলন ছিল। বারানির ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তার ইতিহাসকর্মে ধর্মীয় প্রভাব বিদ্যমান ছিল। তার রচিত গ্রন্থ 'তারিখ ই ফিরোজশাহি’ ও ‘ফতোয়া-ই-জাহান্দারিতে' বাস্তবধর্মী ও ধর্মভিত্তিক ইতিহাস দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। জিয়াউদ্দিন বারানি ধর্মদর্শনের আলোকে ইতিহাস রচনা করেন। তিনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে ইসলামি ভাবধারায় ব্যাখ্যা করেছেন ।
জিয়াউদ্দিন বারানির ইতিহাস দর্শন : জিয়াউদ্দিন বারানির ইতিহাস দর্শন ছিল বাস্তবমুখী ও ধর্মভিত্তিক। নিম্নে জিয়াউদ্দিন বারানির ইতিহাস দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. ঐতিহাসিকের গুণাবলি : প্রখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানি বাস্তবতার নিরিখে ধর্মীয় দিক দিয়ে ঐতিহাসিকদের গুণাবলি সম্পর্কে দিকনিদের্শনা দেন। ঐতিহাসিকের কার্যাবলি সম্পর্কে তার মতামত হলো- “ঐতিহাসিককে নিরপেক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ হতে হবে।” সর্বাবস্থায় নিরপেক্ষ থেকে ইতিহাসের বর্ণনা দিবেন। তার মধ্যে কোনোরূপ চাটুকারিতা বা অতি উৎসাহী কোনো ঘটনার অবতারণা এবং কোনোরূপ মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারবে না। এর ব্যতিক্রম ঘটলে ইতিহাস নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
২. আত্মোপলব্ধি : জিয়াউদ্দিন বারানি রাজকর্মচারী থাকা অবস্থায় মুহাম্মদ বিন তুঘলকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেন ৷ তিনি মনে করেন এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ না করায় তিনি অন্যায় করেছেন। সে অন্যায় থেকে পরিত্রাণ পাবার আশায় ইতিহাস চর্চা করেন । এছাড়া তিনি ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত করেন ।
৩. রাজনৈতিক ও ধর্ম দর্শন : জিয়াউদ্দিন বারানির মতে, নবি-রাসুল ও সুলতানগণ সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি। তাদের হাতে পার্থিব রাষ্ট্রের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। বারানির অভিমত অনুসারে ইসলামের চার খলিফা ছাড়া বাকি সবাই ইসলামের বৈধ শাসক নয়। তাদের কার্যক্রমও বৈধ নয়। তারা স্রষ্টার কাছে ক্ষমা পাবে না। শাসনকার্যে মুসলমানদের নিয়োগ দিতে গিয়ে তারা সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেন।
৪. ইতিহাস সম্পর্কে মতামত প্রদান : জিয়াউদ্দিন বারানি ইতিহাস সম্পর্কে মতামত প্রদান করেন। তিনি রাজা ও রাজকর্মচারীদের ইতিহাস জ্ঞান থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন । অতীতের ঘটনাপ্রবাহ থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ঠিক করবেন। ইতিহাস পাঠককে তিনি সতর্ক করে বলেন তারা যেন ইতিহাসের হেয় চরিত্র এড়িয়ে যান। ইতিহাসের গুরুত্ব অনুভব করে বারানি কুরআন ও হাদিসের পর ইতিহাসের কথা বলেছেন। ইতিহাস মানুষকে সহনশীল, যুক্তিবাদী ও আদর্শবান হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে ।
৫. বারানির ইতিহাসের বিষয়বস্তু : জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত তারিখ ই ফিরোজশাহিতে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসন থেকে ছয় বছরের শাসনকালের ধারাবহিক বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি নবি-রাসুল, রাজা-বাদশাহ, সুলতান ও ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ, সরকারি কর্মচারীদের কার্যবিবরণী ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেন। তিনি নীচ শ্রেণির মানুষের ও অযোগ্য লোকের জীবনব্যবস্থা ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত করতে চাননি। তার ইতিহাসে রাজনৈতিক ঘটনা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথ্যাবলি স্থান পেয়েছে। সুফি সাধকদের জীবন কাহিনিও তার ইতিহাসের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত।
৬. ইতিহাসের উপকারিতা সম্পর্কে মতামত : জিয়াউদ্দিন বারানি ইতিহাস পাঠের উপকারিতা সম্পর্কে মতামত প্রদান করেন। তিনি মনে করেন, ইতিহাস পাঠ মানুষকে সহনশীল, যুক্তিবাদী ও পরিশীলিত হতে সাহায্য করে। ইতিহাস ধর্ম ও নৈতিক বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকে। সুন্দর জীবনযাপন করার জন্য ইতিহাস পাঠ প্রয়োজন। ইতিহাস মানুষকে দৃষ্টান্তের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে থাকে। যার ফলে মানুষের অন্তর্দৃষ্টি খুলে, যায় এবং ঐসব ঘটনা এড়িয়ে চলতে পারে। সে কারণেই জিয়াউদ্দিন বারানি ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
৭. ঐতিহাসিকদের কর্তব্যকর্ম নির্ধারণ : জিয়াউদ্দিন বারানি ঐতিহাসিকদের করণীয় দিক নির্ধারণ করেন। একজন ঐতিহাসিক সর্বদাই প্রভাবমুক্ত থেকে তার কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করবেন। তার লেখায় সত্য প্রকাশ পাবে। তিনি ঐতিহাসিকদের জবাবদিহিতার কথা উল্লেখ করেন। ঐতিহাসিক যা লিখবেন সেজন্য তাকে স্রষ্টার কাছে জবাব দিতে হবে । এই ধারণাবোধ থেকে বারানি ইতিহাস রচনা করেন। তিনি ভালো কাজের যেমন প্রশংসা করেন তেমনি মন্দ কাজের জন্য সমালোচনাও করেন । তিনি মুহম্মদ বিন তুঘলকের প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেননি । সমালোচনা : জিয়াউদ্দিন বারানির ইতিহাসকর্ম প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচিত হয়েছে। তার ইতিহাস দর্শনে যেসব অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয় তা নিম্নরূপ :
প্রথমত, তারিখ ই ফিরোজশাহিতে ঘটনার নির্দিষ্টতা ছিল না সে কারণে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি
দ্বিতীয়ত, তার ইতিহাসকর্ম শুধু ইসলাম ধর্মের আলোকে রচিত। সে কারণে এর পরিসর ছিল খুবই ছোট ।
তৃতীয়ত, নীচ শ্রেণি ও অযোগ্য লোকদের জীবন কাহিনি ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত না করায় তিনি সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয় দেন।
চতুর্থত, তিনি শাসনকাজে শুধু মুসলিমদের নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেন । পঞ্চমত : তার ইতিহাসকর্মে শুধু ফিরোজ শাহকে যোগ্য শাসক বলে অভিহিত করায় গ্রহণযোগ্যতা হারায় । ষষ্ঠত, ধর্মীয় আলোকে ঘটনার ব্যাখ্যা করার জন্য ইতিহাস পরিপন্থি মন্তব্যের অবতারণা ঘটে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জিয়াউদ্দিন বারানি সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনায় চেষ্টা করেন। তিনি ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা এবং ঐতিহাসিকদের কর্তব্যকর্ম নির্ধারণ করে দিতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ইতিহাস সম্পর্কে সচেতনতা, দর্শনতত্ত্ব তাকে ঐতিহাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে । সুতরাং সুলতানি শাসনামলের অন্যতম গ্রন্থ হিসেবে তারিখ ই ফিরোজশাহির গুরুত্ব অপরিসীম।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]