ফরায়েজি আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

Faraizi Movement (1840)
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ফরায়েজি আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ফরায়েজি আন্দোলন (১৮৪০) ছিল মূলত পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে একত্রিত করে ধর্ম সংস্কারের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে চরম বিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ। এ আন্দোলনে ধর্মনৈতিক ও রাজনৈতিক আদর্শের সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয় এবং ইতিহাসে তা ফরায়েজি আন্দোলন নামে পরিচিত। মূল ইসলাম ধর্মের পরবর্তী সময় যে সকল রাজনীতি সংযুক্ত হয়েছিল সেগুলো দূর করে ইসলামের শুদ্ধিকরণ ও সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার সাধন ছিল ফরায়েজি আন্দোলনের উদ্দেশ্য। এ আন্দোলন প্রকারান্তে আরবের ওয়াহাবি আন্দোলনের কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী একটি শাখা ছিল। আরবের এ আন্দোলনের প্রভাবে মুসলিম বিশ্বের নানা দেশে যে অনেকগুলো সংস্কার আন্দোলনের উন্মেষ ঘটে তার মাঝে পূর্ব বাংলার ফরায়েজি আন্দোলন অন্যতম। পরে এটি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।
পলাশী নামক প্রহসনমূলক যুদ্ধে ইংরেজরা বিজয়ী পলাশীর যুদ্ধের পর সমাজ জীবনে নানা দুর্নীতি, কুসংস্কার ও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ অনুপ্রবেশ করে মুসলমানদের নৈতিক শক্তিকে দুর্বল করে ফেলেছিল। এ সময় হাজি শরীয়তুল্লাহ মুসলমানদের অনৈসলামিক রীতিনীতি পরিত্যাগ করে ইসলামি জীবনবিধান প্রতিপালনের জন্য এক আন্দোলন পরিচালনা করেন। তার এ আন্দোলনকে ‘ফরায়েজি আন্দোলন' বলা হয়। ‘ফরজ’ (অবশ্য কর্তব্য) শব্দ থেকে ফরায়েজি শব্দের উৎপত্তি। ফরায়েজি শব্দটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে ।
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্ণের ইতিহাসে মূলত ফরায়েজি আন্দোলন ছিল একটি সংস্কার আন্দোলন। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত দুটি : (১) ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কার দূরীকরণ এবং (২) রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন। ফরিদপুর ছিল এ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু ধীরে ধীরে এর ব্যাপকতা সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং মুসলিম জনগণের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া জাগে। এতে পীরপূজা, কবরপূজা ও বিভিন্ন বেদআতি কাজকর্মে আচ্ছন্ন মুসলমানদের প্রতি ইসলামে যা নিষিদ্ধ এবং যা ইসলামি শিক্ষার বিরোধী এমন সব বিশ্বাস, আচার ও অনুষ্ঠান বর্জন করে ইসলামের অবশ্য কর্তব্য বা ফরজগুলো পালনের জন্য আহ্বান জানানো হয়। হাজি শরীয়তুল্লাহ ফরজগুলো পালনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন বলেই তার এ আন্দোলনকে ফরায়েজি আন্দোলন বলা হয়। এ আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি ভারতবর্ষকে ‘দারুল হরব' বা বিধর্মীর রাজ্য বলে ঘোষণা করেন। এ আন্দোলনের ফলে মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হয়, সমাজ জীবনে আসে গতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আসে নতুনের প্রতি অসীম আগ্রহ। মুসলমানগণ দলে দলে ফরায়েজি আন্দোলনে যোগ দেয় এবং তাদের নেতার বিপ্লবী মতবাদ বাংলার সর্বত্র পৌঁছে দেয়। ফলে কালক্রমে এটি একটি সুষ্ঠু জাতীয়তাবোধে পরিণত হয়। যে জাতীয়তাবাদ ভারতে শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করে ।

ফরায়েজি আন্দোলন


আঠারো শতকের শেষভাগে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়কে একটি সুসংহত শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াসী হন ফরায়েজি নেতৃবৃন্দ। ফরায়েজি আন্দোলন ছিল মূলত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, কিন্তু এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের চরিত্র লাভ করে।
ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন হাজি শরীয়তুল্লাহ। তিনি ১৭৮১ খ্রি. বৰ্তমান বৃহত্তর ফরিপুরের মাদারীপুর জেলার শামাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা ও হুগলিতে প্রাথমিক পড়াশোনার পর তিনি আঠারো বছর বয়সে মক্কায় যান। সেখানে থাকাকালে তিনি ওয়াহাবি আদর্শ ও আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। প্রায় কুড়ি বছর সেখানে অবস্থানের পর তিনি দেশে ফিরে ধর্ম সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
আদর্শগত দিক দিয়ে ফরায়েজি ও ওয়াহাবিদের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। বরং বলা যায়, ওয়াহাবি আন্দোলনেরই আরেকটি ধারা ফরায়েজি আন্দোলন। হাজি শরীয়তুল্লাহ বিশ্বাস করতেন, বিদেশী বিধর্মীদের রাজত্বে ইসলামি জীবনব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে না। এটি সম্ভব কেবলমাত্র ইসলামি রাষ্ট্রে। ভারতবর্ষ যেহেতু বিদেশি বিধর্মী ইংরেজ জাতির শাসনাধীন, সে কারণে এই দেশটি ‘দারুল হারব'। শত্রু শাসিত দেশে যেসব মুসলমান বসবাস করে তাদের পক্ষে নির্বিঘ্নে ধর্মীয় রীতিনীতি ও অনুশাসনসমূহ যথার্থভাবে পালন করা সম্ভব নয়। এ কারণে তিনি স্বদেশের মুসলমানদের জুম'আ ও ঈদের নামাজ না পড়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি পীর পূজা, পীরের দরগায় ওরস, মানত ও মহরম পালনের ঘোর বিরোধিতা করেন। তাঁর মতে, এগুলো ইসলামের মূল বিধানের পরিপন্থি। ফরায়েজ আরবি শব্দ, এর অর্থ অবশ্য পালনীয় কর্তব্যসমূহ। পবিত্র কুরআনে যে পাঁচটি অবশ্য পালনীয় (ফরজ) মৌলনীতির কথা বলা হয়েছে তা যথার্থভাবে পালনের উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। এই পাঁচটি ফরজ হলো ঈমান বা আল্লাহর একাত্ম ও রিসালাত, নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাত ।
হাজি শরীয়তুল্লাহ ইসলামি সাম্যবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে ঘোষণা করেন, সকল মুসলমান ভাই ভাই, অতএব মুসলিম সমাজে অসাম্য ও বর্ণ বা শ্রেণিভেদের কোনো স্থান নেই। " ই মতাদর্শের ভিত্তিতে তিনি মুসলমান সমাজে বিদ্যমান উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণি অর্থাৎ আশর৷ ও আতরাফ-এর শ্রেণি বৈষম্য দূর করার চেষ্টা চালান। তাই স্বাভাবিকভাবেই শোষিত আতরাফ মুসলমান পেশাজীবীর লোকেরা শরীয়তুল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হন। দরিদ্র মুসলমান কৃষক, রায়ত, তাঁতি, জোলা সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর সাথে যোগ দেওয়ায় ফরায়েজিদের সংখ্যা বেড়ে যায়। অত্যাচারী নীলকর ও জমিদারদের উৎপীড়ন থেকে মুক্তি লাভের আশায় এই আতরাফেরা হাজি শরীয়তুল্লাহর মধ্যে তাদের নেতাকে খুঁজে পেল। তাঁর মতবাদ পূর্ব বাংলায় ব্যাপক সাড়া জাগায় । তিনি জমিদার ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচার থেকে প্রজাদের রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। অপরদিকে নির্যাতিত মুসমানেরা একজন সুশিক্ষিত ধর্মনেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে দেখে স্থানীয় জমিদারগণ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। মুসলমান রায়তদের ওপর জমিদারদের অত্যাচারের মাত্রা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। অপরদিকে শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে ফরায়েজিদের প্রতিরোধ আন্দোলনও জোরদার হতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শোষক শ্রেণির প্রবল আক্রমণের মুখে ফরায়েজি আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৮৪০ খ্রি. হাজি শরীয়তুল্লাহ মারা যান ।
আঠারো শতকের শেষ দিনে সব আন্দোলন বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে বিপুলভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল, ফরায়েজি আন্দোলন তন্মধ্যে অন্যতম। এটি ছিল মূলত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনাচক্রে ফরায়েজি আন্দোলন একটি রাজনৈতিক প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপ নেয়। নীলকর ও জমিদারদের অত্যাচারে মুসলমান শোষিত সম্প্রদায় যখন জর্জরিত, তখন এই সম্প্রদায়কে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হাজি শরীয়তুল্লাহ এগিয়ে আসেন ৷
হাজি শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুহাম্মদ মহসিন উদ্দিন আহমদ ওরফে 'দুদু মিয়া ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৮১৯ খ্রি. দুদু মিয়ার জন্ম। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি পিতার কাছে কুরআন ও হাদিস শাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করেন। অপেক্ষাকৃত কম বয়সেই তিনি হজ করতে মক্কা যান এবং সেখানে ওয়াহাবি ভাবধারার সংস্পর্শে আসনে। দেশে ফিরে তিনি এ মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। তবে তাঁর সাংগঠনিক শক্তি ছিল অসাধারণ । এই কারণে তিনি অল্পদিনের মধ্যেই মুসলিম সমাজে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন।
ফরায়েজির শব্দগত অর্থ
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ফরায়েজি শব্দটি অত্যন্ত পরিচিত ও তাৎপর্যপূর্ণ। আরবি শব্দ 'ফরজ' থেকে ফরায়েজি শব্দের উৎপত্তি। ফরায়েজি শব্দের অর্থ হলো 'ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য।' ফরায়েজি আন্দোলনের প্রকৃত অর্থ ছিল মুসলমানগণকে ফরায়েজ অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ সমূহের ভিত্তিতে জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলার নির্দেশ প্রদান করা। ফরায়েজি আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন হাজি শরীয়তুল্লাহ। তিনি তার অনুসারীদের ধর্মীয় কুসংস্কারমুক্ত হয়ে মুসলমানদের অবশ্য করণীয় কর্তব্য পালনের আহ্বান জানান। কেননা হাজি শরীয়তুল্লাহ লক্ষ করেন যে, মুসলমান জনগণ পীরপূজা, পীরের দরগায় ওরস, মানত পালন এবং কবর পূজায় লিপ্ত। মুসলমানদের এসব ধর্মীয় কুসংস্কার ও অনাচার এবং নৈতিক অধঃপতন শরীয়তুল্লাহকে বিচলিত করে তোলে। তাই হাজি শরীয়তুল্লাহ ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনে ইসলাম ধর্মে অবশ্য করণীয় বা পাঁচটি ফরজ পালনের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছিলেন বলে এ আন্দোলনের নাম ‘ফরায়েজি আন্দোলন' করা হয়েছে। এ আধ্যাত্মিক শব্দটি ধর্মপ্রাণ মুসলমাদের মনে স্থান করে নেয় এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ফরায়েজি আন্দোলনের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট
প্রতিরোধ আন্দোলন আন্দোলন নিম্নবর্গের ইতিহাসে ফরায়েজি আন্দোলনের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত গুরুত্ববহ। যে কোনো আন্দোলন তার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের বহিঃপ্রকাশ। সে হিসেবে ফরায়েজি আন্দোলনের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলমান সম্প্রদায় তার ঐতিহ্য হারাতে থাকে। ঐ সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট জমিদার শ্রেণি বাংলার কৃষকদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায়। পূজার সময় মুসলমান কৃষকদের নিকট থেকে খাজনা নেওয়া হতো। জমিদারদের ছেলেদের বিদেশে পড়াশোনা করার জন্য, দাঁড়ি রাখার জন্য কৃষকদেরকে কর প্রদানে বাধ্য করা হতো। এতে কৃষকরা নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয় এবং সকল প্রকার মানবিক দিক উপেক্ষা করে স্তরবিন্যাসের সৃষ্টি করা হয়। এতে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয় ।
ব্রিটিশ শাসনের ঐ সময়ে মুসলমান সমাজে নানাবিধ কুসংস্কার ও অনৈসলামিক রীতিনীতি লক্ষ করা যায়। বঙ্গের অধিকাংশ (মুসলমানরা) নিম্নবর্ণের হিন্দুর থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। ধর্মীয় অনুভূতি নয়, মূলত বিভিন্ন সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় সমাজ জীবনে কোরআন ও হাদিসের পরিপন্থি পূর্বধর্মজাত নানা আচার অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি থেকে যায়। হাজি শরীয়তুল্লাহ আরবে ইসলামি শিক্ষা সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ায় এবং ওয়াহাবি আন্দোলনের সংস্পর্শে আসায় অনুভব করতে সমর্থ হন যে প্রকৃত ইসলাম থেকে অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান বহু দূরে সরে গিয়েছে। তাই তিনি পবিত্র কোরআন ও হাদিসের শিক্ষার আদর্শে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে এবং তাদেরকে আত্মপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সংস্কার আন্দোলন বা ধর্ম ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। পরে এ আন্দোলনের অনুসারীরা ব্রিটিশ সরকার ও জমিদারদের অন্যায় ও অনাচারে বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় ।
ফরায়েজি আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
ফরায়েজি আন্দোলনের ৬টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। যথা :
সকল মুসলমানকে ইসলামি মূলনীতি তথা ফরজ এর উপর প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদের প্রকৃত মুসলমানে পরিণত করা ।
মুসলমান জাতির পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করা ।
ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ ও কুসংস্কার রোধে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করা। মুসলমানদের অধিকার ও কর্তব্য পালনে সচেতন ও আত্মপ্রত্যয়ী করে গড়ে তোলা ৷
মুসলমানদের ধর্মভীরু ও নৈতিক বলে বলীয়ান করা এবং ইমানদার বান্দায় পরিণত করা ।
ব্রিটিশ সরকার ও জমিদারদের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা ।
ফরায়েজি আন্দোলনের ঘটনা
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ফরায়েজি আন্দোলন অত্যন্ত ঘটনাবহুল। এটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় গড়ে ওঠা একটি সংস্কার আন্দোলন । প্রাথমিক পর্যায়ে এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় সংস্কার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনে আর্থসামাজিক প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ফরায়েজি শব্দটি ‘ফরজ' থেকে উৎপন্ন, এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। কাজেই ফরায়েজি বলতে তাদেরকেই বোঝায় যাদের লক্ষ্য হচ্ছে অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্তব্যসমূহ কার্যকর করা। এ আন্দোলনের প্রবক্তা হাজি শরীয়তুল্লাহ অবশ্য শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, অবশ্য পালনীয়ই হোক বা ঐচ্ছিকই হোক, কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত সকল ধর্মীয় কর্তব্যই এর অন্তর্ভুক্ত। শরীয়তুল্লাহ হজ্ব পালনের জন্য মক্কায় যান এবং সেখানে বিশ বছর অবস্থান করে হানাফি শাস্ত্রজ্ঞ শেখ তাহির সোম্বলের নিকট ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। দেশে ফিরে তিনি দেখতে পান যে, বাংলার মুসসমানদের একটি অংশ বহুবিধ স্থানীয় লোকাচার ও পর্ব-উৎসব পালনে উৎসাহী হয়ে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার প্রতি চরম উদাসীন হয়ে উঠেছেন। তাই তিনি ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন এবং কালক্রমে এ আন্দোলন গতি লাভ করে সমগ্র পূর্ববঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ।
শরীয়তুল্লাহ ইসলামের পাঁচটি মৌল আদর্শের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেন, তৌহিদে পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও পূর্ণ অনুশীলনের উপর জোর দেন এবং মূল বিশ্বাস বা মতবাদ থেকে যে কোনো বিচ্যুতিকে তিনি শিরক' ও 'বিদাত' বলে ঘোষণা করেন। জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহুসংখ্যক আচার অনুষ্ঠান যেমন ছটি, পট্টি, চিল্লা, শাবগাস্ত মিছিল, ফাতিহা, মিলাদ ও ওরস নিষিদ্ধ করা হয়। পীরপূজা, পীরের প্রতি অতিশ্রদ্ধা প্রদর্শন, মহরমে তাজিয়া নির্মাণকেও শিরক বলে ঘোষণা করা হয়। তিনি ন্যায়বিচার, সামাজিক সাম্য এবং মুসলমানদের সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং সর্বপ্রকার সামাজিক বৈষম্য ও বর্ণগত কুসংস্কারের বিলোপ সাধনের চেষ্টা করেন।
হাজি শরীয়তুল্লাহ বাংলায় ব্রিটিশ শাসনকে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করতেন। হানাফি আইনের অনুসরণে তিনি মত প্রকাশ করেন যে, বাংলায় বৈধভাবে নিযুক্ত একজন মুসলিম শাসকের অনুপস্থিতি মুসলমানদের জুমআর নামাজের অনুষ্ঠানের সুযোগ হতে বঞ্চিত করেছে। এ মত ছিল ফরায়েজি আন্দোলনের একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য যা একে ঐ সময়ের অপরাপর পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলন থেকে আলাদা করেছে।
জেমস ওয়াইজ হাজি শরীয়তুল্লাহকে নিজেদের দুঃখদুর্দশা সম্পর্কে উদাসীন ও অসচেতন বাংলার মুসলমান কৃষকদের আত্মসচেতন ও উজ্জীবিত করার কাজে নিয়োজিত একজন একনিষ্ঠ ও সহানুভূতিশীল প্রচারকরূপে গণ্য করেন। ফরায়েজি আন্দোলন অসামান্য দ্রুততার সঙ্গে ঢাকা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল), ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা), চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলাসমূহে এবং আসাম প্রদেশে বিস্তার লাভ করে। যেসব এলাকায় নব্য হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরগণ শক্তিশালী ছিল এবং কৃষকদের উপর অত্যাচার চালাত সেখানেই এ আন্দোলন সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে ।
কিন্তু বাংলার সমাজব্যবস্থার রক্ষণশীল পরিবেশ এবং বিচ্ছিন্ন আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে ফরায়েজি আন্দোলন অব্যাহতভাবে চলতে পারেনি। হিন্দু জমিদারগণ ফরায়েজি ও রক্ষণশীল গোঁড়া মুসলমানদের মধ্যে কিছু কিছু ধর্মীয় বিষয়ে সৃষ্ট বিরোধে হস্তক্ষেপ করার মোক্ষম সুযোগ লাভ করে। ঢাকার জমিদাররা পুলিশের সহায়তায় রামনগর বা নয়াবাড়িতে অবস্থিত প্রচারকেন্দ্র থেকে শরীয়তুল্লাহকে বহিষ্কার করেন। হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের সঙ্গে অবিরাম সংঘর্ষের ফলে আন্দোলনটি ক্রমান্বয়ে আর্থসামাজিক রূপ পরিগ্রহ করে। এ আর্থসামাজিক দিকটি দুদু মিয়া ও তার উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায় ৷
উনিশ শতকে মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নব্য শ্রেণির হিন্দু জমিদারগণ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয় এমন বহু অতিরিক্ত আবওয়াব (অবৈধ কর) কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেয়। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের এক তদন্তে প্রকাশ পায় যে, কৃষকদের উপর জমিদারদের আরোপিত অবৈধ করের সংখ্যা তেইশের কম নয় । এমনকি, তারা মুসলমান প্রজাদের কাছ থেকে কালীপূজা, দুর্গাপূজা ইত্যাদি অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য কর আদায় করতো। শরীয়তুল্লাহ এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং জমিদারদের এসব অবৈধ কর প্রদান না করার জন্য তার শিষ্যদের নির্দেশ দেন। জমিদাররা বিশেষ করে ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে গরু জবাইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। গরু কোরবানি করা মুসলমানদের প্রচলিত ধর্মীয় প্রথা এবং মুসলমানদের খাদ্য হিসেবে অন্যান্য মাংসের তুলনায় গরুর মাংসের মূল্য কম বিধায় শরীয়তুল্লাহ এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার জন্য মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করেন।
জমিদারগণ কলকাতার সংবাদপত্র এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনাকালে ফরায়েজিদের বিদ্রোহী ভাবাপন্ন দল হিসেবে বিজড়িত করে প্রচারাভিযান শুরু করে। ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তারা শরীয়তউল্লাকে তিতুমীর এর ন্যায় একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তারা ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করে এবং এতে তারা ইউরোপীয় নীলকরদের সক্রিয় সহযোগিতা লাভ করে। কিন্তু তাদের অভিযোগসমূহ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হওয়ায় কোনোটিই তারা আদালতে প্রমাণ করতে পারেনি। অবশ্য ফরিদপুরে শান্তিভঙ্গ ও গোলযোগ সৃষ্টির অভিযোগে ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে শরীয়তুল্লাহ একধিকবার পুলিশি হেফাজতে ছিলেন।
১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে হাজি শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর তার একমাত্র পুত্র মুহসীনউদ্দীন ওরফে দুদু মিয়াকে ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা ঘোষণা করা হয়। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক স্বার্থ প্রণোদিত একটি জমিদারশ্রেণি গড়ে তোলে ৷ প্রজাদের কাছ থেকে জোর করে যতটা সম্ভব অর্থ আদায় করা ছাড়া অপর কোনো চিন্তাভাবনাই তাদের ছিল না। তারা বহুসংখ্যক লাঠিয়াল পুষত এবং তাদের সাহায্যে প্রজাদের উপর নির্যাতন চালাত ৷
এ ব্যবস্থা জমিদারদের বস্তুত সামন্তাধিকার প্রদান করে এবং কৃষক শ্রেণিকে পরিণত করে প্রায় ভূমিদাসে। কলকাতার আদালত ছিল দরিদ্র কৃষকদের আওতার বাইরে। জমিদারদের যৌক্তিক পথে আনার জন্য শক্তি প্রয়োগ ছাড়া দুদু মিয়ার আর কোনো উপায় ছিল না। তিনি কানাইপুরের শিকদার পরিবার ও ফরিদপুরের ঘোষদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এক সংঘর্ষে মদন ঘোষ নিহত হন। এর ফলে ১১৭ জন ফরায়েজি গ্রেফতার হন এবং তাদের মধ্যে ২২ জন দায়রা জজ কর্তৃক ৭ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। দুদু মিয়াসহ অন্যান্যরা তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান ৷
দুদু মিয়ার এই প্রাথমিক বিজয় জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তাদের কাছে তাঁর সম্মান দারুণভাবে বেড়ে যায়। এ ঘটনাপ্রবাহ ফরায়েজি আন্দোলনের প্রসারে আরও প্রেরণা যোগায়। এতদিন যেসব মুসলমান আন্দোলন থেকে দূরে ছিল শুধু তারাই যে এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় তা নয়, জমিদারদের বিরুদ্ধে দুদু মিয়ার সাহায্য লাভের জন্য হিন্দু ও দেশীয় খ্রিষ্টানগণও এ আন্দোলনে যোগ দেয় ৷
জমিদারদের প্ররোচনায় এন্ড্রু ডানলপ নামীয় এক বড় নীলকর দুদু মিয়ার চরম শত্রুতে পরিণত হয়। এক মাড়োয়ারি হিন্দু কালীপ্রসাদ কাঞ্জিলাল পাঁচচরে ডানলপের নীলকুঠির গোমস্তা ছিলেন। ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে পাঁচচরের হিন্দু বাবুদের সঙ্গে মিলে ৭০০ বা ৮০০ লোক নিয়ে কাঞ্জিলাল বাহাদুরপুরে দুদু মিয়ার বাড়ি আক্রমণ করেন। দুদু মিয়ার অভিযোগ মতে তারা সামনের দরজা ভেঙে ফেলে, চার জন পাহারাদারকে হত্যা করে এবং অন্যান্যদের মারাত্মকভাবে জখম করে নগদ অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের সম্পদ লুট করে নেয়। ঘটনাটি পুলিশকে জানালে হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে আহত ব্যক্তিদেরই বিচারার্থে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে প্রেরণ করেন :
ডানলপের গোমস্তা কালীপ্রসাদ কাঞ্জিলালের সঙ্গে এ সংঘর্ষের কারণে দুদু মিয়াকে গ্রেফতার করে দায়রায় সোপর্দ করা হয়। দায়রা আদালত দুদু মিয়া ও তার ৪০ জন অনুসারীকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করে। কিন্তু প্রদত্ত গুরুদণ্ড এ আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়ায় রায়টি অনুমোদনের জন্য কলকাতায় সদর নিজামত আদালতে প্রেরণ করা হয়। সদর নিজামত আদালত ফরিয়াদির অভিযোগের বর্ণনা অংশত চরম অবাস্তব এবং অংশত একদম অবিশ্বাস্য বলে মনে করে। ফলে তারা সবাই খালাস পেয়ে যান। দুদু মিয়ার অনুসারিগণ একে নিপীড়িত কৃষককুলের জন্য এক মহাবিজয় বলে স্বাগত জানায় ৷
১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে দুদু মিয়া মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার নাবালক পুত্ৰ গিয়াসউদ্দীন হায়দার ও আবদুল গফুর ওরফে নয়া মিয়ার তত্ত্বাবধানের জন্য একটি অভিভাবক পরিষদ গঠন করেন। এ দুই পুত্র পরপর ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্বে ! অধিষ্ঠিত হন। পরিষদ অতি কষ্টে ক্ষীয়মান আন্দোলনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা 7 করেন। নয়া মিয়ার বয়ঃপ্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে এবং তার নেতৃত্বে 1 আন্দোলন হারানো শক্তি কিছুটা ফিরে পায়। মাদারীপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক নবীনচন্দ্র সেন বিচক্ষণতার সঙ্গে পারস্পরিক সহায়তার ভিত্তিতে ফরায়েজি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তোলেন। ফরায়েজি নেতৃবৃন্দও তাদের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব প্রদর্শন করে।
১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে নয়া মিয়ার মৃত্যুর পর দুদু মিয়ার তৃতীয় ও কনিষ্ঠতম পুত্র সৈয়দউদ্দীন আহমদ ফরায়েজিদের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। তার সময়ে তাইয়ুনিয়দের সঙ্গে ফরায়েজিদের সংঘর্ষ চরমে পৌঁছে এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় বিতর্ক পূর্ববঙ্গে নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। সরকার সৈয়দউদ্দীনকে ‘খান বাহাদুর' উপাধি প্রদান করে। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ এর প্রশ্নে তিনি বিভাজনের পক্ষে নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। কিন্তু কিছুকাল পরেই তিনি ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
খান বাহাদুর সৈয়দউদ্দীনের পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র রশিদউদ্দীন আহমদ ওরফে বাদশা মিয়া ফরায়েজি নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর নেতৃত্বের প্রথমদিকে বাদশা মিয়া সরকারের প্রতি সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ তাকে ব্রিটিশ বিরোধী করে তোলে এবং তিনি খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন এ যোগ দেন । পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি নারায়ণগঞ্জে ফরায়েজিদের এক সম্মেলন আহবান করে পাকিস্তানকে ‘দারুল ইসলাম' বলে ঘোষণা করেন এবং তার অনুসারীদের জুমআ ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রদান করেন।
ফরায়েজিগণ তাদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মানুশীলনে কতিপয় স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্যসহ হানাফি মাজহাবের অনুসারী ছিল। ঐ বৈশিষ্ট্যগুলোকে মোটামুটি পাঁচটি ফরায়েজি মতবাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়:
তওবা অর্থাৎ আত্মার পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে অতীত পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া, ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্যসমূহ কঠোরভাবে পালন করা, কুরআন নির্দেশিত তৌহিদ বা একেশ্বরবাদ, ভারতবর্ষ ‘দারুল হরব' বিধায় এখানে জুমআ ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠান অত্যাবশ্যকীয় নয়, কুরআন ও সুন্নাহ বহির্ভূত সকল লোকাচার ও অনুষ্ঠানকে ‘বিদাত' বলে পরিহার করা। ‘পীর’ ও ‘মুরিদ' অভিধার পরিবর্তে ফরায়েজিদের নেতাকে ‘ওস্তাদ’ বা শিক্ষক এবং তার অনুসারীদের ‘শাগরিদ’ বা শিষ্য বলা হতো । এভাবে ফরায়েজি জামায়াতে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিকে ‘তওবার মুসলিম’ বা মুমিন' বলা হতো ।
ফরায়েজিদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে দুদু মিয়ার দুটি লক্ষ্য ছিল : • হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচার থেকে ফরায়েজি কৃষক সম্প্রদায়কে রক্ষা করা এবং জনগণের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ।
প্রথম লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য তিনি এক স্বেচ্ছাসেবক লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন এবং তাদের মারদাঙ্গার নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি অর্জনের জন্য তিনি ফরায়েজিদের নেতৃত্বে সনাতন স্থানীয় সরকারব্যবস্থা (পঞ্চায়েত পুনঃপ্রবর্তন করেন। প্রথমোক্তটি ‘সিয়াসতি' বা রাজনৈতিক শাখা এবং পরেরটি ‘দিনি’ বা ধর্মীয় শাখা হিসেবে পরিচিত লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ দুটি শাখা একীভূত করে 'খিলাফত' ব্যবস্থার রূপ দেওয়া হয় ।
ফরায়েজি খিলাফত পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল সকল ফরায়েজিকে দুদু মিয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের (খলিফা) প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা। খলিফাদের এই পরম্পরায় সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন ‘ওস্তাদ’ দুদু মিয়া। তিনি তিন পদমর্যাদার খলিফা নিয়োগ করেন: উপরস্থ খলিফা, তত্ত্ববধায়ক খলিফা ও গাঁও খলিফা ।
দুদু মিয়া ফরায়েজি বসতি এলাকাকে ৩০০ থেকে ৫০০ পরিবারের এক একটি ছোট এককে বিভক্ত করেন এবং প্রতি এককে একজন গাঁও বা ওয়ার্ড খলিফা নিযুক্ত করেন। অনুরূপ দশ বা তদোধিক একক নিয়ে একটি সার্কেল বা গির্দ গঠিত হতো । প্রতিটি সার্কেল বা গির্দে একজন করে তত্ত্বাবধায়ক খলিফা নিয়োজিত হতেন । তত্ত্বাবধায়ক খলিফাকে একজন পিয়ন ও একজন পেয়াদা বা পাহারাদার দেওয়া হতো। এই পিয়ন ও পেয়াদারা একদিকে তত্ত্বাবধায়ক খলিফার সঙ্গে গাঁও খলিফাদের এবং অন্যদিকে তত্ত্ববধায়ক খলিফা ও ওস্তাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতো। ‘উপরস্থ খলিফা'গণ ছিলেন ওস্তাদের উপদেষ্টা এবং তারা ফরায়েজি আন্দোলনের প্রধান কার্যালয় বাহাদুরপুরে ওস্তাদের সঙ্গে অবস্থান করতেন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]