ঐতিহাসিক হিসেবে জিয়াউদ্দিন বারানির মূল্যায়ন কর ৷

উত্তর ভূমিকা : মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব ঐতিহাসিক ইতিহাস রচনা করেন জিয়াউদ্দিন বারানি তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি তৎকালীন ইতিহাস চর্চার ধারা থেকে বেরিয়ে এসে ভিন্ন আঙ্গিকে ইতিহাস চর্চার প্রচলন করেন। সুলতানি শাসন সম্পর্কে জানার উৎস হিসেবে জিয়াউদ্দিন বারানির অবদান অনস্বীকার্য। তার ইতিহাসকর্মে তৎকালীন ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক অবস্থার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ৷
ঐতিহাসিক হিসেবে জিয়াউদ্দিন বারানির মূল্যায়ন : নিম্নে ঐতিহাসিক হিসেবে জিয়াউদ্দিন বারানির মূল্যায়ন করা হলো : ক. জিয়াউদ্দিন বারানির ইতিহাস চর্চার বৈশিষ্ট্য : জিয়াউদ্দিন বারানির ইতিহাস চর্চায় নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ পরিলক্ষিত হয় ১. বাস্তবমুখী ইতিহাস চর্চা : জিয়াউদ্দিন বারানি বাস্তবমুখী ইতিহাস চর্চা করেন। তিনি সরাসরি সুলতানের কাজকর্মে জড়িত থেকে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেন।
২. ইতিহাসের উপকারিতা সম্পর্কে বারানির মতামত : জিয়াউদ্দিন বারানি ইতিহাসের উপকারিতা সম্পর্কে নিম্নলিখিত
মতামত প্রদান করেন—
ক. ইসলামি শরীয়াহ পরিপন্থি শাসকগণ রাষ্ট্র পরিচালনায় অধিষ্ঠিত হলে তারা ইসলামের রক্ষাকবচ হবেন এবং যাতে
ইসলাম প্রচার বাধাগ্রস্ত না হয় সেরূপ ব্যবস্থা নিবেন।
খ. সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখবেন । ইসলামের প্রচারের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবেন ।
গ. তারা ইসলামি বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করার পাশাপাশি অধর্মীয় (ইসলাম ব্যতীত) কার্যকলাপ বন্ধ করবেন । ঘ. রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনায় শুধু মুসলমানদের নিয়োগ করবেন ।
ঙ. বিচারকার্য পরিচালনায় কঠোরতা অবলম্বনের পাশাপাশি ইসলামি শরীয়াহ অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তি প্রদান করবেন । চ. রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ভঙ্গকারীকে প্রাণদণ্ড দিতে পারবেন।
৩. ধর্মীয় প্রভাব : জিয়াউদ্দিন বারানি ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করেন। তিনি সুন্নি সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। তার চিন্তাচেতনা, ভাবাদর্শ ইসলামি চেতনায় উদ্বুদ্ধ। তিনি সবকিছু ধর্মের মাপকাঠিতে বিচার বিশ্লেষণ করেন । ৪. সুলতানদের ক্ষমতা দখল : জিয়াউদ্দিন বারানির দর্শন মতে, নবি-রাসুল ও সুলতানদের প্রদত্ত ক্ষমতা স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে। তিনি ইসলামের চার খলিফা ব্যতীত অন্য কাউকে বৈধ শাসক হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। পরবর্তী শাসকগণ জনগণের সম্মতি না নিয়ে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করেন ।
৫. বৈধ শাসকদের জন্য উপদেশ : জিয়াউদ্দিন বারানি অবৈধ শাসকদের কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেন। তার মতে, বৈধ শাসকেরা ইসলামের রক্ষা করবেন, ইসলামের প্রচারের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবেন। হিন্দুদের কঠোর হাতে দমনের পাশাপাশি শাসনকার্যে মুসলিমদের নিয়োগ করবেন। ইসলামি স্থিতিশীলতা ভঙ্গের আশঙ্কা থাকলে প্রয়োজনে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবেন। এসব দিকনির্দেশনা দিয়ে তিনি বৈধ শাসকদের কর্তব্যকর্ম নির্ধারণ করে দেন । ৬. রাষ্ট্র সম্পর্কে মতামত : জিয়াউদ্দিন বারানি রাষ্ট্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ প্রদান করেন। ধর্মপ্রচার করার জন্য তিনি রাষ্ট্রে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে বলেন। তিনি শক্তিশালী সেনাবাহিনী, করব্যবস্থা ও গুপ্তচর ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের মুখ্য উপাদান বলে উল্লেখ করেন।
৭. মুক্তির দলিল : বৈধ শাসকগণ ন্যায়পরায়ণভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করলে শেষ বিচারের দিন তারা মুক্তি পাবে। প্রতিটি কর্মের জন্য স্রষ্টার কাছে জবাবদিহিতা রয়েছে এমন মনোভাব থেকে বারানি নির্দেশনা প্রদান করেন ৷
খ. ইতিহাসে জিয়াউদ্দিন বারানির অবদান : ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম যিনি দর্শনভিত্তিক ইতিহাস চর্চা করেন তিনি হলেন জিয়াউদ্দিন বারানি । নিম্নে ইতিহাসে জিয়াউদ্দিন বারানির অবদান আলোচনা করা হলো :
১. ইতিহাস গ্রন্থ রচনা : ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানি দুটি তথ্যসমৃদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন । একটি হলো ‘তারিখ *ই ফিরোজশাহি'। 'তারিখ ই ফিরোজশাহিতে তৎকালীন শাসনামলের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। তাছাড়া ঐতিহাসিকের কর্তব্য নির্দিষ্টকরণ, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অপর গ্রন্থটি হলো 'ফতোয়া-ই-জাহান্দারি'। এটি মূলত একটি উপদেশমূলক গ্রন্থ ।
২. ঐতিহাসিকের দায়িত্ব : জিয়াউদ্দিন বারানি ঐতিহাসিকের দায়িত্ব সম্পর্কে অভিমত দিয়েছেন । তিনি ঐতিহাসিকের দায়িত্ব সম্পর্কে বলেন, “ঐতিহাসিককে সৎ ও নিরপেক্ষ হতে হবে। সর্বাবস্থাতেই ঐতিহাসিককে নির্ভীক ও পক্ষপাতহীন ইতিহাস রচনা করতে হবে । ”
৩. ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা : জিয়াউদ্দিন বারানি তার ইতিহাসকর্মে ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। তিনি ইসলামি শরীয়তের উৎস কুরআন ও হাদিসের পর ইতিহাসের স্থান চিহ্নিত করেন। বারানির মতে, “ইতিহাস পড়লে যুক্তি ও বুদ্ধি শাণিত হয়।" কারণ অগণিত লোকের যুক্তিবুদ্ধি ও কর্মের বস্তুনিষ্ঠ ভান্ডার হলো ইতিহাস । ৪. ধর্মদর্শন : বারানি মূলত ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তার ভাবাদর্শ ব্যক্ত করেন। মহান স্রষ্টা পার্থিব বিষয়াবলি তার প্রেরিত নবি-রাসুলগণের ওপর ন্যস্ত করেন । তিনি ইসলামের চার খলিফা ছাড়া আর কাউকে ইসলামের বৈধ শাসক হিসেবে মেনে নিতে পারেননি।
৫. ইতিহাসকর্মের বিষয়বস্তু : বারানির ইতিহাসকর্মের বিষয়বস্তু হলো নবি-রাসুল, রাজা-বাদশাহ, সুলতান ও ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ এবং সরকারি কর্মচারীদের কার্যাবলির বিবরণী । তার মতে, অযোগ্য ও নীচ শ্রেণির মানুষের জীবনকর্ম ইতিহাসের বিষয়বস্তু হওয়া উচিত নয়। কারণ এতে ইতিহাসের মর্যাদা হারায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জিয়াউদ্দিন বারানি ছিলেন একজন মুসলিম ঐতিহাসিক । তিনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তার ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করেন। তার ইতিহাসকর্ম ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তিনি সীমাবদ্ধতায় থেকেও প্রকৃত ইতিহাস রচনায় অবদান রাখতে সমর্থ হন। তিনি ইতিহাস চর্চায় জ্ঞান অর্জনের চেয়ে বাস্তব জ্ঞানলাভের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন । তার ইতিহাসকর্ম তাকে অমরত্ব দান করেছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]