রাজ্যের উদ্ভব, বিকাশ ও অবক্ষয়ে ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রদর্শন মতবাদ আলোচনা কর ৷

উত্তর ভূমিকা : চতুর্দশ শতাব্দীতে যে কয়জন বিখ্যাত মুসলিম মনীষীর পরিচয় পাওয়া যায় ইবনে খালদুন ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'কিতাব আল ইবারের’, ‘মুখবন্ধ' বা 'আল মুকাদ্দিমায়' রাষ্ট্র তত্ত্বের বিকাশ ঘটেছে। আল মুকাদ্দিমাতে তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্ব আলোচনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতি সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেন।
• ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রতত্ত্ব : ইবনে খালদুন সমাজের বিবর্তনের আলোচনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রতত্ত্বের উদ্ভব ঘটান। নিম্নে খালদুনের রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. রাষ্ট্রের উদ্ভব : রাষ্ট্রের উদ্ভবের পিছনে আসাবিয়ার ভূমিকা রয়েছে। আসাবিয়া বিভিন্নভাবে গঠিত হতে পারে। তবে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী আসাবিয়া অর্জনকারী বংশানুক্রমিক শাসনব্যবস্থা চালু করতে সক্ষম হয়। তিনি বংশ বলতে রাষ্ট্রকে বুঝিয়েছেন। ইবনে খালদুন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে 'দওলাহ' (Dawlah) বলে অভিহিত করেন। গোত্রপ্রীতি দুর্বল হয়ে পড়লে রাষ্ট্র ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ে। শাসককুলের শৌর্যবীর্যের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র ব্যবস্থা দীর্ঘকাল টিকে থাকে ।
২. একীভূত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা : রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা একে অপরের সাথে জড়িত। রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। আলো থাকলে যেমন ছায়া থাকে ঠিক তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার মধ্যে সম্পর্ক একই রকম। এরিস্টটল রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে অভিন্ন সংগঠন হিসেবে দেখেননি। ইবনে খালদুনের চিন্তাধারায় তদ্রূপ ধারণার উদ্রেক হয় ।
৩. সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপন : ইবনে খালদুন তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'কিতাব আল ইবারের' আল মুকাদ্দিমায় সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপনের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। একই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ সমাজে ধর্মীয় ঐক্য গড়ে তোলে। যা পরবর্তী সময়ে সমাজের বিশৃঙ্খলা দূরীভূত করে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে। মানুষের আত্মকলহ থেকে সমাজে অশান্তি বিরাজ করে। এ আত্মকলহ একে অপরের সাথে সার্বক্ষণিক কলহে লিপ্ত হয়। যা সমাজের স্থিতিশীলতার পরিপন্থি । এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য শক্তিশালী গোত্রপ্রীতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে, যা সমাজের এ হীন মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারে ।
৪. রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থা : প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন রাষ্ট্র শাসনের ব্যাপারে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে অধিকতর গুরুত্ব দেন। রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে তিনি যুক্তি উত্থাপন করে বলেন, রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাস্তবায়ন করা যায়। এ শাসনব্যবস্থায় কোনো মতপার্থক্যের আশঙ্কা থাকে না । সমাজে বিরাজমান অনিয়ম ও অনৈতিক কার্যক্রম কঠোরতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পরবর্তী সময়ে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার খালদুনের মতো এক হস্তে শাসনব্যবস্থা থাকার পক্ষে মতামত প্রকাশ করেন। ভলতেয়ার বলেন, “সহস্র ইঁদুর দ্বারা শাসিত না হয়ে একটি সিংহের শাসন অধিক শ্রেয়।” অবশ্য খালদুনের এরূপ মত দেওয়ার কারণও আছে। তিনি যেসব রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন সেসব রাষ্ট্র রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হতো ।
৫. রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব : ইবনে খালদুন তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'কিতাব আল ইবার' এর মুখবন্ধে রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নির্ধারণ করেন । তার মতে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা শৌর্যবীর্যের সাথে তিন জামানা টিকে থাকে । তিনি এক জামানাকে ৪০ বছর ধরেন। সে হিসেবে প্রতিটি রাষ্ট্রের ১২০ বছর পর পতন হয়। বাস্তবিকভাবে খালদুনের এ তত্ত্বটি কাল্পনিক মনে হয়। বর্তমান সময়ে এ তত্ত্বটি
দেখা যাচ্ছে না ।
৬. রাষ্ট্রের বিকাশ : ইবনে খালদুন আল মুকাদ্দিমায় রাষ্ট্রের স্থায়িত্বকে তিনটি স্তরে ভাগ করে আলোচনা করেন। প্রথম স্তর বা পর্যায়ে কোনো রাজবংশ ঐক্যবদ্ধভাবে শৌর্যবীর্যের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। এটিকেই খালদুন রাষ্ট্রের বিকাশ বলেছেন । এ পর্যায়ে তাদের মধ্যে গোত্রপ্রীতি প্রবল থাকে, ফলে তারা সাহসিকতার সাথে রাষ্ট্র শাসন পরিচালনা করতে থাকে এবং তাদের হাতে রাজ্যের বিকাশ ও বিস্তৃতি লাভ করে
৭. রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা : ইবনে খালদুন রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের দ্বিতীয় পর্যায়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার কথা তুলে ধরেছেন। এ পর্যায়ে এসে রাষ্ট্রের অধিবাসীগণ বিলাসিতার স্রোতে গা ভাসিয়ে জীবনযাপন করতে শুরু করে। তারা পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য এবং আস্তে আস্তে শাসনতান্ত্রিক উৎকর্ষতা হারিয়ে ফেলে। তাদের মধ্যে পূর্ববর্তীদের মতো কোনো কাৰ্যস্পৃহা থাকে না । ৮. রাষ্ট্রের পতন : ইবনে খালদুনের মতে, রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের শেষ পর্যায়ে বা তৃতীয় পর্যায়ে এসে শাসকবর্গ একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিলাসী জীবনযাপনের ফলে অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে অর্থসংকট দেখা দেয়। ফলে শাসকবর্গ জনগণের ওপর অতিরিক্ত কর চালিয়ে দেয়। জনগণ শাসকবর্গের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে। শাসক নৈতিকতার অধঃপতনের চরম সীমায় পৌঁছে যায়। শাসকগণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখার মতো শক্তি সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। অবশেষে বহিঃশত্রু আক্রমণ করে তাদেরকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে। সেই সাথে রাষ্ট্রের পতন ঘটে !
৯. রাষ্ট্রশক্তির অবক্ষয় : রাষ্ট্রশক্তির অবক্ষয় সম্পর্কে ইবনে খালদুন সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্র শাসনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রাষ্ট্রশক্তির অবক্ষয় নিহিত থাকে। একটি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রশক্তি অপর রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষমতা বিস্তার করার মধ্য দিয়ে নতুন রাষ্ট্র জন্ম হয় । রাষ্ট্র সর্বশক্তি দিয়ে বিজয়ী হলে সে রাষ্ট্র আর পূর্বের ন্যায় শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করতে চায় না। তাদের মধ্যে বিলাসিতার অনুপ্রবেশ ঘটে। ফলে আস্তে আস্তে তাদের নীতিনৈতিকতার চরম অধঃপতন হয়। জনগণ তাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় । বহিঃশত্রুর আক্রমণে শাসকবর্গের পতন হয়। এভাবে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রশক্তির অবক্ষয় ঘটে।
সমালোচনা : ইবনে খালদুনের আসাবিয়া তত্ত্বটি বিভিন্ন ঐতিহাসিক কর্তৃক নিম্নোক্তভাবে সমালোচনা হয়েছে :
প্রথমত, ইবনে খালদুন রাষ্ট্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে তার আসাবিয়া তত্ত্ব ব্যবহার করেছেন। কিন্তু আসাবিয়া ছাড়াও অন্যান্য উপাদানের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে ।
দ্বিতীয়ত, ইবনে খালদুন তার রাষ্ট্রতত্ত্বে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছেন। কিন্তু অন্যান্য শাসনব্যবস্থার মাধ্যমেও যে একটি রাষ্ট্রে শক্তিশালী শাসনকাঠামো ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে সে কথা তিনি অনুভব করেননি ।
তৃতীয়ত, ইবনে খালদুনের মতে, কোনো রাষ্ট্র শৌর্যবীর্যের সাথে ১২০ বছর টিকে থাকে। অনেক ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রের এ আয়ুষ্কাল সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেছেন ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে খালদুনের জ্ঞানের বহু শাখায় তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। ইবনে খালদুন আল মুকাদ্দিমাতে রাষ্ট্র শাসনের বিভিন্ন দিক, রাষ্ট্রের উদ্ভব, বিকাশ, পতন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেন। অনেক ঐতিহাসিক তার মতামতের সমালোচনা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি । বাস্তবে তার মতামতের প্রতিফলন দেখা দেয় । তার রাষ্ট্র সম্পর্কিত মতামত ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ৷
ইবনে খালদুনের ইতিহাস দর্শন ব্যাখ্যা কর ।
উত্তর ভূমিকা : চতুর্দশ শতকে জন্ম নেওয়া ইতিহাস দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বিশ্ববরেণ্য মনীষী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন চমৎকার ও তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাস দর্শনের প্রণেতা। তার ইতিহাস দর্শনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার রচিত গ্রন্থ ‘কিতাব আল ইবারের' মুখবন্ধে। তিনি দর্শন তত্ত্বের মৌলিক বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা করেন। তার ইতিহাস দর্শনের মূল আলোচ্য বিষয় হলো মানুষ ।
↑ ইবনে খালদুনের ইতিহাস দর্শন : বিশ্ববিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন তার দর্শন তত্ত্বে প্রায় সব রকমের জ্ঞানের আলোকের সংমিশ্রণ ঘটান । নিম্নে তার ইতিহাস দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো : ১. ইতিহাসের ব্যাখ্যা : ইবনে খালদুন তার দর্শনতত্ত্বে ইতিহাসের এক নতুন ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তার মতে, “রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের উত্থানপতনের কাহিনিই ইতিহাস নয়, ইতিহাস হলো বিবর্তনশীল সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তনের সুসংবদ্ধ দলিল।” সুতরাং ইতিহাসকে মাপকাঠির সাহায্যে অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব ।
২. মানবসমাজের বিবর্তন : ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন তার ইতিহাস তত্ত্বে মানবসমাজের বিবর্তন সম্পর্কে আলোকপাত করেন। এখানে ঐতিহাসিকের কর্তব্যকর্ম নির্ধারণ করে দেন। প্রতিটি ঘটনাই প্রকৃতির নিয়মানুসারে উৎপত্তি ঘটে। যদি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার উৎপত্তি ও পরিণামের পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝেন তাহলে তার ইতিহাসকর্ম ত্রুটিমুক্ত হবে । আর যদি উৎপত্তি ও বিবর্তন সম্পর্কে না বুঝে ইতিহাস রচনা করেন তাহলে তিনি অতিরঞ্জন প্রিয়তার পরিচয় দিবেন।
৩. সময়ের বিভাজন : ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন সময়ের বিভাজনে বিশ্বাসী ছিলেন না। সময় বিভাজনের তিনটি ধাপকে (বর্তমান, ভবিষ্যৎ ও অতীত) তিনি কৃত্রিম বলে মনে করেন। তার মতে, সময় নিরবচ্ছিন্নভাবে তার গতিতে বয়ে চলেছে । ৪. একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি : ইবনে খালদুনের ইতিহাস দর্শনের বিষয়বস্তু হলো মানুষ ও সমাজ। সমাজে প্রায় একই ঘটনা বার বার ঘটতে থাকে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন যে, মানুষের আচার আচরণ একই রকম। সহজে এসব পরিবর্তন হয় না। এ কারণেই মানুষ সমাজে একই কারণে একই ঘটনা বার বার ঘটিয়ে থাকে ।
৫. ইতিহাসের কাজ : ইবনে খালদুনের মতে, ইতিহাসের কাজ হচ্ছে সত্যানুসন্ধান, প্রকৃত ঘটনার কারণ ও উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা, ঘটনার প্রকৃত বিবরণ তুলে ধরা এবং অতি কথন বর্জন করা । মানবসমাজের সাথে পরিচয় করে দেওয়াই ইতিহাসের মূল উদ্দেশ্য। ৬. সভ্যতার উত্থানপতন ও বিকাশ : খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন তার ইতিহাস তত্ত্বে সভ্যতার উত্থানপতন ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এখানে তিনি সভ্যতার তিনটি ধাপ উল্লেখ করেন। প্রথম ধাপে সভ্যতা বিকশিত হয় । দ্বিতীয় ধাপে সভ্যতা চরম উন্নতি লাভ করে এবং তৃতীয় ধাপে এসে সভ্যতার অবক্ষয় হতে শুরু করে ৷
৭. একীভূত মানবসমাজ : ইবনে খালদুন মানবসমাজকে গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন। তিনি জাতিধর্মবর্ণ গোষ্ঠী, সাদাকালোতে বিভেদ সৃষ্টি না করে মানুষ হিসেবে সবাইকে সমষ্টিগত জীবনের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াস চালান । ৮. পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা লাভ : ইবনে খালদুনের মতে, শুধু বুদ্ধির সাহায্যে পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায় না। জাগতিক বিষয়ে প্রকৃত ধারণা পেতে হলে ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রয়োজন । তবেই প্রকৃত ধারণা লাভ করা সম্ভব । ৯. জ্ঞানশূন্য জন্মগ্রহণ : ইবনে খালদুনের মতে, মানুষ যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন তার মধ্যে পৃথিবী সম্পর্কে কোনোপ্রকার জ্ঞান থাকে না। ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা সঞ্চারের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জিত হতে থাকে। তিনি ঐশীবাদের বদলে বাস্তবতাকে দর্শনের অন্তর্ভুক্ত করেন ।
১০. সামাজিক পরিবর্তন : ইবনে খালদুনের মতে, মানবসমাজের পরিবর্তন যাযাবর অবস্থা থেকে সূচিত হয়। পরবর্তীতে এ পরিবর্তন বিভিন্ন পর্যায়ে সাধিত হচ্ছে। আদিম যুগে যখন মানুষ যাযাবর ছিল তখন তারা কোনো স্থানে স্থায়ী ছিল না । কোনো সভ্যতার উত্থান ঘটাতে পারেনি। পরবর্তীতে গোত্র সংহতি দ্বারা, রক্তের সম্পর্ক দ্বারা, ধর্মীয় অনুভূতির দ্বারা সভ্যতার পত্তন ঘটাতে সক্ষম হয়। এ সভ্যতাই ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক রূপলাভ করে ।
১১. ইতিহাস দর্শন : ইবনে খালদুন ইতিহাস দর্শনের আবিষ্কারক। তিনি রাষ্ট্র শাসনের ব্যাপারে সমাজতন্ত্রের বা একক শাসনের প্রাধান্য দেন। তিনি সমাজতান্ত্রিক বা রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সুবিধাসমূহ আলোচনা করেন। কারণ তিনি যেসব রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে পরিচিত ছিলেন সেসব রাষ্ট্রে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল ।
১২. ধারাবাহিক সৃষ্টি প্রক্রিয়া : ইবনে খালদুনের মতে, এ ধরা বা পৃথিবী একটি নির্দিষ্ট নিয়মে ক্রমাগত ছুটে চলছে। তার এ চলার কোনো ছেদ বা বিরতি নেই। এখানে বস্তুর সাথে বস্তুর বিবর্তন এবং প্রাণীর সাথে প্রাণীর বিবর্তন সাধিত হয়। উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইবনে খালদুন দর্শনতত্ত্বের অবতারণা করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন । জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় রয়েছে তার গভীর পদচারণা। ঐতিহাসিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন যে, ইতিহাসও সমাজের অবিচ্ছেদ্য। তার ইতিহাস দর্শন সর্বকালে সমানভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে আসছে। তার চিন্তাধারায় ইতিহাস দর্শন, সমাজদর্শন, সামাজিক বিবর্তন, রাষ্ট্রদর্শন প্রভৃতি ফুটে ওঠে ।
একজন ঐতিহাসিক হিসেবে ইবনে খালদুনের অবদান মূল্যায়ন কর ।
উত্তর ভূমিকা : মধ্যযুগে যে কয়েকজন মুসলিম মনীষীর পরিচয় পাওয়া যায় ইবনে খালদুন ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি স্বীয় চিন্তাচেতনার দ্বারা জ্ঞানভাণ্ডারকে সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হন। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'কিতাব আল ইবার' এর মুখবন্ধ ‘আল মুকাদ্দিমায়’ তার ইতিহাস দর্শন সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন । একজন ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি মানুষ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ নিয়ে আলোকপাত করেছেন । ইবনে খালদুনের পরিচয় : ইবনে খালদুনের পুরো নাম আবু জাইদ আবদুর রহমান ইবনে খালদুন আল হাযরামি। খালদুন তার পারিবারিক নাম। তার পিতা ও পিতামহের নাম মুহাম্মদ । তিনি ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মে আফ্রিকার জ্ঞানচর্চা কেন্দ্ৰ তিউনিস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষরা আরব থেকে তিউনিস এসেছিল । মাত্র ২০ বছর বয়সে মরক্কোর সুলতান দ্বিতীয় ইসহাকের অধীনে সচিব পদে চাকরি করেন। জ্ঞান অর্জনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন । তিনি মিসরে অবস্থানকালীন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মিসরের প্রধান বিচারপতির দায়িত্বও পালন করেন। তার অগাধ পাণ্ডিত্যের খ্যাতিস্বরূপ তাকে ‘ওলিউদ্দিন' উপাধি দেওয়া হয়। ১৪০৬ সালে ৫ মে এ মহান ঐতিহাসিকের জীবনাবসান ঘটে।
● ঐতিহাসিক হিসেবে ইবনে খালদুনের মূল্যায়ন : আবু জাইদ আবদুর রহমান ইবনে খালদুন সমাজবিজ্ঞানী হয়েও সমাজের বিবর্তন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন । তিনি বিশ্লেষণধর্মী ইতিহাস রচনা করেন । তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'কিতাব আল ইবার' এর আল মুকাদ্দিমায় বা মুখবন্ধে এক জ্ঞানগর্ভ ও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেন । এটিই তাকে ঐতিহাসিকের মর্যাদা দান করেছে। নিম্নে ঐতিহাসিক হিসেবে ইবনে খালদুনের মূল্যায়ন করা হলো :
১. ইতিহাস গ্রন্থ প্রণয়ন : ইবনে খালদুনের বিখ্যাত গ্রন্থের নাম 'কিতাব আল ইবার’। তিনি দুনিয়ার চিন্তা হতে মুক্ত হয়ে আলজেরিয়ার কালাত ইবনে সালামা দুর্গে অবস্থানকালে 'কিতাব আল ইবার' রচনা করেন। 'কিতাব আল ইবার' সম্পূর্ণ মানবীয় প্রেক্ষাপটে রচিত একটি গ্রন্থ। এ গ্রন্থটিতে আরব বার্বারদের ও আফ্রিকার মুসলমানদের ইতিহাস স্থান পেয়েছে । ইবনে খালদুন আরবদের চৌদ্দশ বছরের ক্রমবিবর্তনের ধারাবাহিক বর্ণনা দেন। 'কিতাব আল ইবার' (১৩৭৫-১৩৭৯) চার বছর সময়ের মধ্যে রচনা সমাপ্ত করেন। গ্রন্থটি মোট পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত। এর প্রথম খণ্ডের নাম 'আল মুকাদ্দিমা' বা মুখবন্ধ। ‘আল মুকাদ্দিমাতে' ইতিহাস দর্শন, সমাজবিবর্তনের ধারা, সভ্যতার উত্থানপতন সম্পর্কে দর্শন তত্ত্বের প্রকাশ ঘটান । আরব জাতির ক্রমবিবর্তনের ধারা লিপিবদ্ধ হওয়ায় গ্রন্থটি ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করে ।
২. মানব সভ্যতা বিবর্তনের ধারণা প্রদান : ইবনে খালদুন তার ইতিহাসকর্মে মানব সভ্যতার বিবর্তন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেন। তিনি সামাজিক বিবর্তনের পথ ধরে চলতে গিয়ে নতুন তত্ত্বের সন্ধান পান। যার থেকে উৎসারিত হয় উমরান বা সাংস্কৃতিক বিজ্ঞান। সাংস্কৃতিক বিজ্ঞানের মূল প্রতিপাদ্য ছিল মানবসমাজ ও সমাজের বিবর্তন। তাই মানবসমাজের বিবর্তনের ইতিহাস 'আল মুকাদ্দিমায় আলোচনা করা হয় ।
৩. খালদুনের ইতিহাসকর্মের বৈশিষ্ট্য : ইবনে খালদুনের ইতিহাসকর্মের কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো : ক. ইবনে খালদুন তার ইতিহাস দর্শনে সামাজিক সংগঠন ও সভ্যতার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেন । তার মতে,
“মানুষ যখনই কোনো সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, তাকে কেন্দ্র করেই সভ্যতার উন্মেষ ঘটে।”
খ. খালদুন ইতিহাসকে আন্তরিকতার সাথে মূল্যায়ন করেন। তিনি ঐতিহাসিকদের সমলোচনা করেন এবং তাদের
ভুলগুলো দেখিয়ে দেন। তাদের ভুলের কারণ উল্লেখপূর্বক ইতিহাসকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন ।
গ. তিনি মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে আলোচনা করেন। মানব সভ্যতার জীবন থেকে কীভাবে সুসভ্য সমাজব্যবস্থা
গড়ে উঠেছে তার বিস্তারিত আলোচনা তার ইতিহাসকর্মে তুলে ধরেন।
৪. খালদুনের মৌলিক ইতিহাস দর্শন : ইবনে খালদুন বিখ্যাত গ্রন্থ 'কিতাব আল ইবারে' তার ইতিহাস দর্শনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি মানব সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায় অর্থাৎ যাযাবর জীবন থেকে আদিকাল বিবর্তনের মাধ্যমে সভ্যতার উন্নতির শীর্ষ পর্যন্ত অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রের উত্থানপতন ও বিকাশের কারণ আলোচনা করেন। 'কিতাব আল ইবারের' বিষয়বস্তুই তার ইতিহাসকর্মের মৌলিকত্বের পরিচয় বহন করে ।
৫. সভ্যতা বিকাশের বিশ্লেষণ : ইবনে খালদুন সভ্যতার বিকাশ সম্পর্কে বলেন, মানুষের প্রয়োজন থেকেই সংগঠন সৃষ্টি হয় আর সংগঠনকে কেন্দ্র করে সভ্যতার জন্ম হয় এবং ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করে। মানুষ সেখানে উন্নত জীবন ব্যবস্থার ভিত রচনা করে। পরবর্তীতে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম দেয়। এভাবে যখন মানুষের জীবনধারণের ব্যবস্থা উন্নতির চরম শিখরে পৌছায় তখনই সভ্যতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ।
৬. সভ্যতার পতন সম্পর্কে মতামত প্রদান : ইবনে খালদুন ইতিহাস দর্শনের আলোকে সভ্যতার পতন সম্পর্কে আলোচনা করেন। উত্থান ও পতন দুনিয়ার চিরাচরিত নিয়ম। খালদুনের মতে, সভ্যতা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিকশিত হতে থাকে। চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেলে আর বিকশিত হতে পারে না, তখন পতনের দিকে ধাবিত হয়। সভ্যতার তিনটি ধাপ রয়েছে। যথা : ১. উদ্ভব, ২. বিকাশ ও ৩. পতন। সভ্যতা তৃতীয় পর্যায়ে পৌছালে পতন অনিবার্য হবে। এ পর্যায়ে এসে শাসকবর্গ তাদের উদ্যমতা হারিয়ে বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে জীবনযাপন শুরু করে। ধীরে ধীরে তারা কর্মবিমুখ ও অলস হয়ে যায়। তারা তাদের শৌর্যবীর্যকে কাজে লাগাতে চায় না। এ বিলাসিতাই সভ্যতার পতন ঘটায়। ফলে উক্ত সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে বিকশিত হয় অন্য একটি সভ্যতা ।
৭. ঐতিহাসিকের কর্তব্যকর্ম নির্ধারণ : ইতিহাস হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল তার অনুসন্ধান ও সত্যের বিবরণী। সঠিক ইতিহাস সবসময় সত্যকে নির্ভর করে রচিত হয়। ইবনে খালদুননের মতে, ঐতিহাসিককে সত্য ও সার্বিক ইতিহাস রচনা করা তার মূল কাজ। ঐতিহাসিকগণ সমালোচনায় ঊর্ধ্বে থেকে সত্য, নির্ভুল, বস্তুনিষ্ঠ ও প্রকৃত ঘটনার বিবরণ তুলে ধরবেন । তিনি যাবতীয় পক্ষপাতিত্ব, তোষামোদি, অতিরঞ্জন প্রিয়তা, আবেগপূর্ণ ঘটনা পরিহার করে প্রকৃত ঘটনার বিবরণ তুলে ধরবেন । এটিই ঐতিহাসিকের প্রধান কাজ ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইবনে খালদুন ছিলেন একজন দূরদর্শী ঐতিহাসিক । তিনি আল মুকাদ্দিমাতে সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও পতন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে স্মরণীয় হয়ে আছেন । তিনি ঐতিহাসিকের দায়িত্ব কর্তব্য নির্ধারণ করেন। তিনি মানবজাতির জন্য বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা করেন । তিনি অতীতের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে জাতিকে সামনে চলার অনুপ্রেরণা দেন । তার ইতিহাসকর্ম ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]