আবুল ফজলের ‘আকবরনামা' গ্রন্থের বিষয়বস্তু ও গুরুত্ব আলোচনা কর ।

ভূমিকা : শেখ আবুল ফজল মধ্যযুগের ভারতীয় উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ছিলেন। তিনি ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি কালজয়ী বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন । তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনালগ্ন থেকে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের ৪৭তম বছর পর্যন্ত সময়ের ধারাবাহিক বিবরণসংবলিত গ্রন্থ 'আকবরনামা' রচনা করেন, যা মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস জানার অন্যতম উৎস ।
আবুল ফজলের ‘আকবরনামা' গ্রন্থের বিষয়বস্তু ও গুরুত্ব : নিম্নে আবুল ফজলের 'আকবরনামা' গ্রন্তের বিষয়বস্তু ও গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
ক. আবুল ফজলের 'আকবরনামা' গ্রন্থের বিষয়বস্তু : আকবরনামা' রচনা করেন মুঘল শাসনামলের বিখ্যাত ঐতিহাসিক আকবরের প্রিয়পাত্র, সভাসদ ও আকবরের নবরত্নের অন্যতম সদস্য শেখ আবুল ফজল। শেখ আবুল ফজল আকবরনামাকে পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত করে রচনা করার পরিকল্পনা করেন। যার প্রথম চার খণ্ড হবে বর্ণনামূলক, পঞ্চম খণ্ড হবে তথ্যমূলক। কিন্তু তিনি তিন খণ্ডের বেশি রচনা সমাপ্ত করতে পারেননি। এ তিন খণ্ডের প্রথম দুই খণ্ড বর্ণনামূলক এবং শেষ খণ্ড তথ্যমূলক । আকবরনামার তথ্যমূলক শেষ খণ্ডটি 'আইন ই আকবরি' নামে পরিচিত।
নিম্নে আকবরনামার খণ্ড ও বিষয়বস্তু আলোচনা করা হলো :
প্রথম খণ্ড : শেখ আবুল ফজলের ‘আকবরনামা' গ্রন্থে আদম (আ.) থেকে শুরু করে আকবরের শাসনামলের ১৭ বছর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ইতিহাসের বিবরণ পাওয়া যায়। শেখ আবুল ফজলের মৃত্যুর পর প্রথম খণ্ডকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় । যথা : প্রথম ভাগে আদম (আ.) এর সৃষ্টি থেকে হুমায়ুনের রাজত্বকালের শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিক বর্ণনা। দ্বিতীয় ভাগে আকবরের সিংহাসন আরোহণ থেকে ১৭ বছরের রাজত্বকালের ধারাবাহিক বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে।
দ্বিতীয় খণ্ড : শেখ আবুল ফজলের ‘আকবরনামার দ্বিতীয় খণ্ডে আকবরের রাজত্বকালের অষ্টাদশ থেকে ৪৭তম বছরের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বিবরণ পাওয়া যায়। এখানে আকবরের গুরুত্বপূর্ণ বিজয়সমূহ, রাজস্ব ব্যবস্থা, দিন ই ইলাহি এবং সামাজিক ও প্রশাসনিক সংস্কারসমূহ সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তৃতীয় খণ্ড : শেখ আবুল ফজলের ‘আকবরনামা' গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডটি ছিল তথ্যবহুল। এ তথ্যবহুল খণ্ডটিই ‘আইন আকবরি' নামে পরিচিতি লাভ করে। আইন ই আকবরিতে সম্রাটের প্রশাসনিক কাঠামো, আইন ব্যবস্থা, রাজস্ব ও অর্থসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। অবশ্য আবুল ফজল তৃতীয় খণ্ড সমাপ্ত করার পূর্বেই নিহত হন। পরবর্তী সময়ে মুহিব আলি খান নামে এক ঐতিহাসিক শাহজাহানের রাজত্বকালে ‘আইন ই আকবরি' রচনা সমাপ্ত করেন।
নিম্নে আইন ই আকবরির বিষয়বস্তুসমূহ উল্লেখ করা হলো :
প্রথম ভাগ : আইন ই আকবরির প্রথম ভাগে সম্রাট আকবরের শাসনামলের সংস্থাপন দপ্তরের বিভিন্ন বিষয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। এখানে অট্টালিকা তৈরির তথ্য, নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য, শ্রমিকের মজুরি, টাঁকশাল, অশ্বশালা, বিলাসি দ্রব্যসামগ্রী, শ্রমিকশ্রেণির তথ্য রয়েছে।
দ্বিতীয় ভাগ : আইন ই আকবরির দ্বিতীয় ভাগে সম্রাটের শাসনামলের সামরিক বিভাগের যাবতীয় বিবরণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় ভাগে সম্রাট কর্তৃক প্রবর্তিত মনসবদারি প্রথা, মনসবদারদের ক্ষমতা ও তাদের তালিকা, বেতন ভাতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও রাষ্ট্রের পণ্ডিত, কবি, গায়কসহ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের নামের তালিকা পাওয়া যায়। জনকল্যাণমূলক কাজ যেমন— মক্তব মাদ্রাসার শিক্ষাদান পদ্ধতি, বিবাহ সম্পর্কিত আইন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ভূমিদানবিষয়ক বিবরণ এ খণ্ডে পাওয়া যায়। এছাড়াও 'আইন ই আকবরি' থেকে ওয়াকফ সম্পত্তির তালিকা, রাজকীয় ভোগবিলাস ও বিনোদনের বিবরণ পাওয়া যায় ।
তৃতীয় ভাগ : আইন ই আকবরির তৃতীয় অংশে বিভিন্ন প্রকার বিষয় সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। এখানে ২০ প্রকার সালের বর্ণনা, বাংলা সনের প্রবর্তন, রাজকীয় পদের নিয়োগ ও কার্যাবলি, ভূমির প্রকারভেদ ও ভূমি বন্দোবস্ত, বিভিন্ন প্রকার সুবার রাজস্বের পরিমাণ এবং সুবাগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় ।
চতুর্থ ভাগ : আইন ই আকবরির চতুর্থ ভাগে রাজপুতদের ঐতিহ্য ও গোত্রীয় বিবরণ পাওয়া যায় । এছাড়া তাদের শিক্ষা সংস্কৃতির বিবরণ পাওয়া যায় । এখানে চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন চর্চা জ্যোতিষশাস্ত্রের পাশাপাশি হিন্দুদের ধ্যানধারণা তুলে ধরা হয়েছে। পঞ্চম ভাগ : আইন ই আকবরির পঞ্চম ভাগে সম্রাট আকবরের বিভিন্ন বাণী ও নির্দেশনা উক্তিসমূহ তুলে ধরেছেন। তাছাড়া আবুল ফজল তার জীবনের অনেক তথ্যবহুল ঘটনা উল্লেখ করেছেন ।
খ. আবুল ফজলের ‘আকবরনামা' গ্রন্থের গুরুত্ব : নিম্নে আবুল ফজলের ‘আকবরনামা' গ্রন্থের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো : ১. আকবরনামার গুরুত্ব : শেখ আবুল ফজলের ‘আকবরনামা' একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ। মধ্যযুগ এবং মুঘল শাসনামল সম্পর্কে জানতে এ গ্রন্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আকবরনামা মুঘল শাসক সম্রাট আকবরের শাসনামল সম্পর্কে জানার একমাত্র উৎস। 'আকবরনামা' কেবল ঐতিহাসিক গ্রন্থই নয় এটি মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা থেকে সম্রাট আকবরের ৪৭তম বর্ষের তথ্যবহুল ঘটনার অধিষ্ঠিত বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তথ্যের বিজ্ঞানভিত্তিক যাচাইবাছাই ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ গ্রন্থ ‘আকবরনামা' রচনা করেন। আবুল ফজলের ‘আকবরনামার’ তৃতীয় খণ্ড ‘আইন ই আকবরি' একটি তথ্যবহুল গ্রন্থ। এতে সম্রাট আকবরের শাসনামলের যাবতীয় তথ্যচিত্র ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত আছে। যদিও এখানে প্রত্যক্ষ কোনো রাজনৈতিক বর্ণনা নেই। তারপরও তৎকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে এ গ্রন্থের মাধ্যমে জানা যায়। এখানে মুঘল শাসনামলের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন— সম্রাট আকবরের টাকশাল, অট্টালিকা নির্মাণ, অস্ত্র, খাদ্য, শিল্প, বিলাসসামগ্রী। চিত্রশিল্প, বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য তালিকা, শ্রমিকশ্রেণি ও শ্রমিকের মজুরি সম্পর্কে জানা যায় । আইন ই আকবরির মাধ্যমে সম্রাটের সামরিক তথ্য জানা যায়। আকবরের শাসনামলে ৬৬ প্রকার মনসবদার ছিল। সর্বনিম্ন ১০ জন এবং সর্বোচ্চ ১০,০০০ সৈন্য একজন মনসবদারের অধীনে থাকত। সামরিক বিভাগ ছাড়াও ভূমিদান, শিক্ষাদান পদ্ধতি, বিবাহ সম্পর্কিত আইন, ইত্যাদি প্রশাসনিক সম্পর্কিত তথ্য জানার জন্য আইন ই আকবরির গুরুত্ব রয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশের শেখ আবুল ফজল সার্থকভাবে ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা করেন । তিনি সর্বপ্রথম পরিকল্পনার ভিত্তিতে ইতিহাস রচনা করে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেন। তার ইতিহাসকর্ম মুঘল শাসনামল সম্পর্কে জানার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । তার বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষ সর্বজন গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ ‘আকবরনামা' তাকে ঐতিহাসিকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে । তাই ইতিহাসে আকবরনামার গুরুত্ব অপরিসীম

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]