আবুল ফজলের ইতিহাস লিখনপদ্ধতি আলোচনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রাজ ঐতিহাসিকের মর্যাদায় থেকে শেখ আবুল ফজল তার ইতিহাসকর্ম শুরু করেন। তিনি শুধু একজন ঐতিহাসিকই ছিলেন না; সেনাপতি, উপদেষ্টা ও সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম সদস্যও ছিলেন। তিনি ইতিহাস রচনায় তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে এক অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করেন। ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহ পদ্ধতিতে তিনি বিরল প্রতিভার পরিচয় দেন। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তথ্যসংগ্রহ করে ‘আকবরনামা’কে প্রামাণ্য নিরপেক্ষ ইতিহাস গ্রন্থরূপে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন।
ক. আবুল ফজল আকবরনামা রচনায় যেসব উপকরণ ব্যবহার করেন : শেখ আবুল ফজলের কালজয়ী ইতিহাস গ্রন্থ ‘আকবরনামা' রচনায় নিম্নলিখিত উপকরণ বা উৎসসমূহ ব্যবহার করেন :
১. আকবরের রাজত্বকালের ঘটনা : মুঘল সম্রাট আকবরকে ঘিরে ঘটে যাওয়া ঘটনা, ঘটনার বিবরণ তিনি 'আকবরনামা' রচনায় উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া সম্রাটের সাথে সাক্ষাৎ, আলোচনা, নির্দেশনা সবকিছু আকবরনামার উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে । তিনি নিজে সম্রাট আকবরের নিকট থেকে তথ্যসংগ্রহ করেন ।
২. গ্রন্থাগার ও মহাফোজখানা : আবুল ফজল আকবরনামার তথ্যসংগ্রহ করতে বিভিন্ন গ্রন্থাগারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। হুমায়ুন প্রতিষ্ঠিত “দিন পানাহ' নামক লাইব্রেরি থেকে তথ্যসংগ্রহ করে আকবরনামা রচনা করেন। মহাফেজখানা (তথ্যসংগ্রহশালা) হতে তিনি তথ্যসংগ্রহ করেন ।
৩. সরকারি নতিপত্র : সরকারি দলিলপত্র, সরকারি ফরমান, চুক্তিপত্র, সরদার, সেনাপতি, মনসবদার নিয়োগের আদেশ প্রভৃতি আকবরনামার উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।
৪. রাজকর্মচারীদের বিবরণ : সম্রাট আকবরের দরবারের রাজকর্মচারীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তথ্যসংগ্রহ করে আবুল ফজল ‘আকবরনামা' রচনা করেন। সম্রাট আকবরের অধীনস্থ সব প্রবীণ রাজকর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, সম্রাটের শাসনকাল সম্পর্কে যে যা জানেন তা লিখিতভাবে সম্রাটের দরবারে জমা দিবেন। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সুবা, ইক্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রশাসনসংক্রান্ত তথ্যসংগ্রহ করেন ।
৫. খুতবা : জুময়ার নামাজের খুতবা হতেও তিনি তথ্যসংগ্রহ করেন, যা ‘আকবরনামা' রচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ৬. বৈদেশিক বিবরণী : সম্রাটের শাসনামলে আগত বিদেশিদের বিবরণী হতে তথ্যসংগ্রহ করেন ।
৭. লৌকিক কাহিনি : সর্বোপরি আবুল ফজল আকবর সম্পর্কে জনশ্রুতি, কাহিনি, বিবরণী থেকেও তথ্যসংগ্রহ করেন ।
৮. পারিবারিক উৎস : আবুল ফজল পিতা মোবারক ও ভ্রাতা ফৈজীর কাছ থেকেও তথ্যসংগ্রহ করেন ।
খ. আবুল ফজলের রচনা পদ্ধতি : শেখ আবুল ফজল সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করেন। তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস রচনা শুরু করেন বলে তিনি রাজ ঐতিহাসিক হিসেবে বেশি সমাদৃত ছিলেন। তিনি বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা করেন। তার ইতিহাসকর্মের বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপ :
১. তথ্যনির্ভর ইতিহাসকর্ম : শেখ আবুল ফজল তথ্যসংগ্রহ করতে গিয়ে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেন। তিনি সরকারি দলিল, দস্তাবেজ, রাজকর্মচারীর সাক্ষ্য, প্রবীণদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও স্মৃতিচারণ, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সংগ্রহ করেন। প্রতিটি ঘটনার জন্য কমপক্ষে ২০ জনের লিখিত সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এভাবে ঘটনার যাচাইবাছাই করে তথ্য গ্রহণ করতেন । ২. ধারাবাহিকতা বজায় রাখা : শেখ আবুল ফজলের ইতিহাসকর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। তিনি সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের ঘটনা ধারাবাহিকতা রক্ষা করে বর্ণনা করা হয়েছে। আইন ই আকবরির তথ্য ছিল পর্যায়ক্রমিকভাবে বর্ণিত । বর্ণনামূলক দুই খণ্ডে আকবরের শাসনামলের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেন। আবুল ফজল ইচ্ছা পোষণ করেন যে, সম্রাট আকবর ১২০ বছর জীবিত থাকবেন এবং তিনি তার পরেও জীবিত থেকে সম্রাটের জীবনকাহিনি লিপিবদ্ধ করবেন। কিন্তু সম্রাট আকবর ১২০ বছর জীবিত থাকেননি। তার পূর্বেই শেখ আবুল ফজল হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
৩. নিরপেক্ষতা : শেখ আবুল ফজল সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ইতিহাসকর্ম উপহার দিতে সচেষ্ট ছিলেন। মুঘল রাজবংশের চিরশত্রু শেরশাহ ও হিমুর প্রশংসা তার নিরপেক্ষতার পরিচয় বহন করে। তিনি তথ্যনির্ভর, বিশ্লেষণধর্মী এবং বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করেন ।
৪. ইতিহাস সচেতনতা : শেখ আবুল ফজল ইতিহাসকর্মে অত্যন্ত সতর্কতার পরিচয় দেন। তার ইতিহাসকর্ম ছিল অন্ধকারে আলোর দিশারির মতো, যা আমাদেরকে মুঘল শাসন সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে।
৫. নির্ভুল তথ্য পরিবেশন : শেখ আবুল ফজল তার ইতিহাসকর্মে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করে নির্ভুল তথ্য পরিবেশন করেন। তিনি রাজঐতিহাসিক হয়েও অত্যন্ত সুনিপুণতার সাথে তথ্যের যাচাইবাছাই করে তথ্যের সঠিকতা নির্ণয় করেন । তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক তথ্য আইন ই আকবরিতে সন্নিবেশিত করেন। তিনি স্বয়ং সম্রাটের আদেশ ও নির্দেশনামা সম্রাটের অনুমতি ব্যতীত ইতিহাসকর্মে উল্লেখ করেননি ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শেখ আবুল ফজল মধ্যযুগের ঐতিহাসিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য । তিনিই সর্বপ্রথম সরকারি ও বেসরকারিভাবে তথ্যসংগ্রহ করেন। তথ্যের যাচাইবাছাই ও তথ্যের সত্যতার ভিত্তিতে তিনি ইতিহাস রচনা করেন। তিনি সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও নিরপেক্ষতার আলোকে ইতিহাস রচনার প্রয়াস পান। তিনি অত্যন্ত সুবিন্যস্তভাবে 'আকবরনামা' রচনা করেন। তার নিরলস পরিশ্রম ও দক্ষতার ফসল হিসেবে ‘আকবরনামা' ঐতিহাসিক গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে।
আবুল ফজল কী পরিকল্পনা নিয়ে ইতিহাস রচনা শুরু করেন? তার ইতিহাসকর্মের বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা কী?
ভূমিকা : মধ্যযুগে রাজ ঐতিহাসিকের মর্যাদা থেকে যে কয়জন মুসলিম ঐতিহাসিক ইতিহাস রচনা করেন তাদের মধ্যে আবুল ফজল ছিলেন অন্যতম। তিনি কেবল মুঘল শাসনামলের ঐতিহাসিক নয়; বরং সমগ্র মধ্যযুগের সব ঐতিহাসিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। তিনিই প্রথম ভিন্ন ধারায় পরিকল্পনা মোতাবেক ইতিহাস রচনা করেন । ইতিহাসকর্মের তথ্যসংগ্রহের ব্যাপারে তিনিই যে পদ্ধতি অবলম্বন করেন তা সত্যিকার অর্থে নতুনত্বের দাবি রাখে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে ইতিহাস রচনা করেন বলেই তার ইতিহাসকর্ম নিরপেক্ষতা পেয়েছে।
ক. ইতিহাস রচনায় আবুল ফজলের পরিকল্পনা : শেখ আবুল ফজল একজন দূরদর্শী ঐতিহাসিক ছিলেন। তিনি ইতিহাস রচনায় অত্যন্ত কুশলী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি ‘আকবরনামা'কে পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত করে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেন। পাঁচ খণ্ডের চার খণ্ড হবে বর্ণনামূলক এবং শেষ খণ্ড হবে তথ্যমূলক। আবুল ফজল করেন যে, সম্রাট আকবর ১২০ বছর বাঁচবেন এবং তিনি আকবর থেকে বেশিদিন বেঁচে থেকে লেখা শেষ করবেন। কিন্তু তিনি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। আকবরনামার তিন খণ্ড লেখা শেষ হওয়ার পর তিনি নিহত হন। তিন খণ্ডের দুই খণ্ড ছিল বর্ণনামূলক বাকি এক খণ্ড তথ্যমূলক। বর্ণনামূলক ও তথ্যমূলক সমষ্টিগতভাবে ‘আকবরনামা' নামে পরিচিত। আকবরনামা তথ্যমূলক তৃতীয় খণ্ড ‘আইন ই আকবরি' নামে পরিচিত।
৫. সামরিক ব্যবস্থা : মুঘল শাসনামলে সম্রাটগণ খুব কমসংখ্যক সৈন্য পোষণ করতেন। অধিকাংশ সৈন্য উচ্চপদস্থ সামরিক প্রধানদের অধীনে চাকরি করতো। সৈন্য সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে কর্মকর্তার পদমর্যাদা নির্ধারণ করা হতো। মুঘল সম্রাট আকবরের পরিকল্পনা মোতাবেক ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে সামরিকবাহিনীর সংস্কার করার লক্ষ্যে শাহবাজ খানকে মির বকশির পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটাই সম্রাট আকবরের মনসবদারি প্রথা নামে পরিচিত। শেখ আবুল ফজলের আইন ই আকবরি' থেকে জানা যায়, আকবরের শাসনামলে ৬৬ প্রকার মনসবদার ছিল। সর্বোচ্চ পদমর্যাদার মনসবদারের অধীনে ১০,০০০ সৈন্য থাকত এবং সর্বনিম্ন পদমর্যাদার মনসবদারের অধীনে ১০ জন সৈন্য থাকত। তাছাড়া আহাদি ও দাখিলি নামে আরও দুই শ্রেণির সৈন্যবাহিনী ছিল। দাখিলি নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য দিয়ে গঠিত হতো। দাখিলি সৈন্যদের ব্যয় রাষ্ট্র বহন করতো। আহাদি সৈন্যবাহিনী সম্ভ্রান্ত বংশের যুবকদের দ্বারা গঠিত ছিল। তারা সরাসরি সম্রাটের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকত। আহাদি সৈন্যবাহিনী মনসবদারদের পদমর্যাদা পেতেন না, কিন্তু তাদের অনন্য মর্যাদা, বেতন সাধারণ সৈন্য অপেক্ষা অনেক বেশি ছিল।
৬. বিচারব্যবস্থা : মুঘল সম্রাটগণ ছিলেন উদার, প্রজাহিতৈষী ও প্রজাবাৎসল্য। তারা বিচারকার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতেন। বিচারকার্য সম্পাদনের দায়িত্ব প্রধান কাজির ওপর ন্যস্ত ছিল। তিনি রাজধানীতে থেকে বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। প্রধান কাজি সরাসরি সম্রাট কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন। সম্রাট দেখেশুনে অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান, আইন বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ দিতেন। প্রধান বিচারক পদাধিকার বলে নিম্ন আদালতের কাজি নিয়োগ করতেন । সম্রাটগণ বিচারিক ব্যবস্থায় কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করতেন না। তাছাড়া জনগণের সুবিচার নিশ্চিত করার পক্ষে প্রদেশে, জেলা ও পরগনায় বিচারক নিয়োগ করা হতো। মুঘল শাসনব্যবস্থা স্বেচ্ছাচারী হলেও তাদের বিচারব্যবস্থা ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। মুঘল সম্রাটগণ বিচারের ক্ষেত্রে কারো সাথে আপস করতেন না ।
৭. প্রাদেশিক ও স্থানীয় শাসনব্যবস্থার স্বরূপ : মুঘল সাম্রাজ্য ছিল খুবই বিশাল । যা একজন শাসকের পক্ষে একত্রিতভাবে শাসন করা সম্ভব ছিল না। প্রশাসনিক সুবিধার্থে সম্রাট আকবর গোটা সাম্রাজ্যকে ১২টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রত্যেকটি প্রদেশ সুবা নামে পরিচিত ছিল। প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য নাজিম বা সুবাদর নিয়োগ দেওয়া হতো। সুবাগুলো হলো অযোধ্যা, এলাহাবাদ, আজমির, আহমেদাবাদ, বাংলা, বিহার, দিল্লি, কাবুল, লাহোর, মুলতান, আগ্রা, মালোয়া । পরবর্তী সময়ে সম্রাট আকবর বেরার, খান্দেশ, আহমেদনগর জয় করে নিজ রাজ্যভুক্ত করেন। এ তিনটি প্রদেশ মিলে প্রদেশের সংখ্যা হয় ১৫টি। প্রদেশের শাসনকর্তা নিয়োগ দেওয়ার পর তাকে পদমর্যাদা ভূষিত করতেন। দায়িত্ব গ্রহণের সময়ে সুবেদারকে দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আদেশ নির্দেশমালা প্রদান করা হতো। ‘আইন ই আকবরি’ থেকে জানা যায়, শহরের পুলিশ বাহিনীর প্রধান কোতোয়াল ছিলেন পৌরকর্মকর্তা, জনসাধারণের মধ্যে শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপন করাই ছিল তার প্রধান কাজ। সুবেদারকে প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করার জন্য ফৌজদার নিয়োগ করা হতো। ফৌজদারগণ প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতো ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাস জানার একমাত্র উৎস হলো শেখ আবুল ফজলের ‘আইন ই আকবরি'। তিনি মুঘল শাসনের বিভিন্ন দিক আইন ই আকবরিতে তুলে ধরেন। তিনি স্বয়ং রাজদরবারে উপস্থিত থেকে এ গ্রন্থে রচনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহ করেন । যে করণে আইন ই আকবরির তথ্য অনেকটাই নির্ভুল বলা যায় । শেখ আবুল ফজল তার গ্রন্থে মুঘল শাসনামলের আর্থসামাজিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করেছেন। এজন্যই আইন ই আকবরিকে মুঘল শাসনামলের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বিশ্বকোষ বলা হয় ।


উত্তর ভূমিকা : মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবুর ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি 'বাদশা' উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এরপর থেকেই মুঘল শাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন সম্রাট। শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে সম্রাটগণের যৌথ অংশগ্রহণ ছিল। মুঘল সম্রাটগণ সামরিক রাষ্ট্র গঠন করলেও তারা অনেক ক্ষেত্রে উদারতার পরিচয় দেন। তারা ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা এবং উদার ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা কায়েম করেন।
● মুঘল রাজতন্ত্র সম্পর্কে আবুল ফজলের ধারণা : নিম্নে মুঘল রাজতন্ত্র সম্পর্কে শেখ আবুল ফজলের ধারণা আলোচনা করা হলো :
১. রাজক্ষমতা : মুঘল শাসকদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হচ্ছে রাজক্ষমতা। তারা নিজেদেরকে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী মনে করতেন। এ কারণে তারা সুলতানি শাসকদের কোনো তোয়াক্কা করতেন না। শেখ আবুল ফজল তার আইন ই আকবরিতে উল্লেখ করেন, “মুঘল শাসকগণ সীমাহীন রাজক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।” তাদের ক্ষমতার মতো একচ্ছত্র অধিকারী আর কেউ ছিল না ।
২. পদমর্যাদা : মুঘল শাসকগণ পদমর্যাদার দিক থেকে অদ্বিতীয় ছিলেন। তারা সৃষ্টিকর্তাকে ব্যতীত অন্য কারো সাথে আপস করতে চাইতেন না। শাসকগণ মনে করতেন তারা সম্রাট হিসেবে জন্মগ্রহণ করেননি; স্বয়ং বিধাতার ইচ্ছায় তারা এ পদমর্যাদার অধিকারী হয়েছেন । মুঘল শাসকদের সমালোচনা করে ঐতিহাসিক ইবনে হাসান বলেন, “মুঘল সম্রাটগণ ছিলেন স্বয়ং বিধানকর্তা।” ৩. সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী : মুঘল শাসকগণ সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তারা মনে করতেন, এটি তাদের জন্মগত অধিকার। আবুল ফজল মুঘল শাসকদের প্রশংসা করে বলেন, “মুঘল বাদশাহগণ পৃথিবীতে আল্লাহর ছায়া । তাদের সর্বময় কর্তৃত্ব আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত।” সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী সম্পর্কে হুমায়ুন নিজেই বলেছেন, তিনি নিজে স্বর্গীয় ক্ষমতার অধিকারী।
৪. বীরের সাথে সম্পর্কযুক্ত : মুঘল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবুর পিতামাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খান ও তৈমুর লং এর বংশধর ছিলেন। তাদের শরীরে দুই বীরের রক্তের ধারা প্রবাহিত। তাই তারা কাউকে পরোয়া করতেন না । এমনকি তারা ওসমানীয়দের থেকেও বেশি মর্যাদাবান বলে মনে করতেন। সেজন্যই আবুল ফজল মুঘল বাদশাহদের আলোকের সন্তান বলেছেন ।
৫. রাজসভা : মুঘল বাদশাহগণ কর্তব্যপরায়ণ ও প্রজাবাৎসল্য ছিল। বাদশাহগণ নিয়মিত প্রজাসাধারণের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং সমস্যা সমাধানের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন ।
৬. শাসকদের দায়িত্ব : মুঘল সম্রাটগণ আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তারা জাতিধর্মনির্বিশেষে সবার স্বার্থ সমানভাবে দেখতেন। তাদের নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা সর্বত্রই প্রশংসিত হয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। তারা আধ্যাত্মিক ও পার্থিব উভয় দিক দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যাপৃত ছিল ।
৭. ধর্মীয় কর্তৃত্ব গ্রহণ : শেখ আবুল ফজলের মতে, ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে গণ্যমান্য আলেম ওলামাগণের স্বাক্ষরিত এক আবেদনের মাধ্যমে জানা যায় যে, আবুল ফাতাহ জালালুদ্দিন মোহাম্মদ আকবর বাদশাহ গাজিকে সর্বজ্ঞানের অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত দলিল থেকে আরও জানা যায়, সর্বজ্ঞানের অধিকারী বাদশাহ মুজাহিদ অপেক্ষা অধিকতর মর্যাদার অধিকারী। প্রজাদের মঙ্গলের জন্য তিনি ধর্মীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন। তার গৃহীত সিদ্ধান্ত অবশ্য পালনীয়, যদি কেউ পালনে অক্ষম হয় তাহলে তাকে ইহলোক ও পারলৌকিক শাস্তি পেতে হবে। তিনি কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্য রেখে যেকোনো ধর্মীয় আইন প্রণয়ন করতে পারবেন। এ থেকে বুঝা যায়, সম্রাট ধর্মীয় ব্যাপারেও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
৮. হিন্দু-মুসলিমের শাসনব্যবস্থা : মুঘল সম্রাটগণ ধর্মীয় ব্যাপারে উদারনীতি গ্রহণ করেন। সে কারণে মুঘল শাসনব্যবস্থায় হিন্দু-মুসলমানের সমন্বিত অংশগ্রহণ ছিল। সম্রাটগণ মুসলমান হয়েও প্রশাসনিক ব্যাপারে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেন । মুঘল সম্রাটগণ পূর্ববর্তী উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকদের মতো বিভক্ত শাসনব্যবস্থা কায়েম করেননি । তারা ধর্মের প্রজাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। মুঘল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীর হিন্দুদের বিয়ে করেন। যার মাধ্যমে তারা ধর্মীয় বিভেদ দূর করার জন্য চেষ্টা করেন। হিন্দুদের জিজিয়া কর রহিতকরণ ও হিন্দুদের উচ্চ রাজপদে নিয়োগ মুঘল শাসনের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় বহন করে। যেমন— রাজা মানসিংহ, রাজা বীরবল, রাজা টোডরমল প্রমুখ। সে কারণে মুঘল শাসনব্যবস্থাকে শুধু মুসলিম শাসনব্যবস্থা না বলে হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ শাসনব্যবস্থা বলা হয়। এ শাসনব্যবস্থা হিন্দু-মুসলিম যৌথভাবে পরিচালিত হয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবুরের শারীরে তৈমুর ও চেঙ্গিস খানের রক্ত প্রবাহিত। তাদের বংশধরেরা উদার, নিরপেক্ষ সর্বজনীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হন। মুঘল সম্রাটগণ কখনোই শাসনব্যবস্থাকে কেন্দ্রীভূত করেননি। মুঘল শাসকগণ প্রজাবাৎসল্য শাসক ছিলেন । মুঘলদের প্রতিটি শাসকই প্রজাপালনে সচেষ্ট ছিলেন। মুঘল সম্রাটগণ হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ ভুলে যোগ্য ব্যক্তিদের উচ্চপদে নিয়োগ দান করেন । এ থেকে বুঝা যায়, মুঘল শাসব্যবস্থায় হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ছিল ।
* প্রশ্ন ৯.৩২ আবুল ফজলের পরিচয় দাও। মুঘল ইতিহাস তত্ত্বের তার অবদান মূল্যায়ন কর ।
অথবা, মুঘল সম্রাট আকবরের রাজদরবারে ঐতিহাসিক আবুল ফজলের অবদান মূল্যায়ন কর । অথবা, মধ্যযুগের ঐতিহাসিক হিসেবে আবুল ফজলের অবদান মূল্যায়ন কর। উত্তর ভূমিকা : মধ্যযুগে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যে কয়জন ঐতিহাসিক ইতিহাস রচনা করেন শেখ আবুল ফজল, তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি কেবল রাজ ঐতিহাসিকই ছিলেন না বরং মুঘল সম্রাট আকবরের উপদেষ্টা, সেনাপতি ও নবরত্ন সভার অন্যতম সদস্যও ছিলেন । তার দক্ষতা ও প্রতিভাগুণে সম্রাট আকবরের রাজসভার এ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো অর্জন করতে সক্ষম হন । আবুল ফজলের পরিচয় : আবুল ফজলের পুরো নাম শাইখ আবু আল ফজল ইবনে মোবারক আল্লামি । তিনি ১৫৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ব বংশধরেরা আরবের শেখ সম্প্রদায়ের অধিভুক্ত ছিলেন। তার পিতার নাম শেখ মোবারক। তার মাতা ছিলেন একজন বিদূষী পারসিক মহিলা। সম্রাট আকবরের সভাকবি ও সমালোচক শেখ ফৈজি ছিলেন আবুল ফজলের বড় ভাই। বাল্যকাল থেকেই আবুল ফজল মেধাবী ছিলেন। পিতার কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৫ বছর বয়সে বিদ্যাশিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং পিতার পরিচালিত বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। পেশা শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করলেও আবুল ফজল অতি অল্প সময়ের মধ্যে নিজ প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হন । তিনি ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের রাজদরবারে প্রবেশ করেন । তখন তার বয়স ২২ বছর। তিনি স্বীয় যোগ্যতার দ্বারা সম্রাট আকবরের প্রিয়পাত্রে পরিণত হন। তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা দেখে আকবর রাজ লেখকের দায়িত্ব দেন । পরবর্তী সময়ে তিনি মন্ত্রী, কূটনৈতিক ও মনসবদারের পদ অলংকৃত করেন। তবে তিনি ঐতিহাসিক হিসেবেই বেশি পরিচিতি পান । তার ব্যর্ণাঢ কর্মময় জীবনের ইতি টেনে এ মহান ঐতিহাসিক ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন ।
• মুঘল ইতিহাস তত্ত্বে আবুল ফজলের অবদান : মুঘল সম্রাট আকবরের একান্ত সান্নিধ্যে থেকে শেখ আবুল ফজল ইতিহাস চর্চা করেন। তিনি সম্রাট কর্তৃক ইতিহাস লেখক হিসেবে নিয়োগ পেয়েও তার ইতিহাস চর্চা শুধু সম্রাটের রাজদরবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। শেখ আবুল ফজল তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস রচনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন । তার জীবদ্দশায় সর্বমোট দশটি গ্রন্থ রচনা করেন । এর মধ্যে ‘আকবরনামা' তাকে ঐতিহাসিকের মর্যাদা দান করেছে।
নিম্নে ঐতিহাসিক হিসেবে শেখ আবুল ফজলের মূল্যায়ন করা হলো :
ইতিহাস সম্পর্কে আবুল ফজলের ধারণা : আবুল ফজলের ইতিহাসকর্ম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পাদিত হয় । তারপরও তিনি নিরপেক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি ঘটনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। তার মতে, ইতিহাস হচ্ছে অতীত সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য মানবীয় ঘটনাবলির সংযোজন । অতীতের ক্রমবিবর্তন ও ঐতিহ্যের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ হলো ইতিহাস। ২. আবুল ফজলের ইতিহাসকর্ম : আবুল ফজল অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মতো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস চর্চা শুরু করেন । তৎকালীন প্রথা থেকেই তিনি ইতিহাস চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তার জীবদ্দশায় দশটি গ্রন্থ রচনা করেন । তার বিখ্যাত ও কালজয়ী গ্রন্থ হচ্ছে ‘আকবরনামা' । আকবরনামাকে পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত করে রচনার পরিকল্পনা করে । যার প্রথম চার খণ্ড বর্ণনামূলক এবং পঞ্চম খণ্ড তথ্যমূলক। কিন্তু তিনি পরিকল্পনা মোতাবেক তিন খণ্ড সমাপ্ত করতে সমর্থ হন ৷ প্ৰথম দুই খণ্ড বর্ণনামূলক এবং তৃতীয় খণ্ড তথ্যমূলক। ‘আকবরনামা' তৃতীয় খণ্ড আইন ই আকবরি' নামে পরিচিত। নিম্নে আকবরনামার বিষয়বস্তু আলোচনা করা হলো :
ক. প্রথম খণ্ডের বিষয়বস্তু : শেখ আবুল ফজলের ‘আকবরনামা' গ্রন্থে হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে আকবরের শাসনামলের ১৭ বছর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ইতিহাসের বিবরণ পাওয়া যায় । শেখ আবুল ফজলের মৃত্যুর পর প্রথম খণ্ডকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা : প্রথম ভাগে হযরত আদম (আ.) এর সৃষ্টি থেকে হুমায়ুনের রাজত্বকালের শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিক বর্ণনা। দ্বিতীয় ভাগে আকবরের সিংহাসনে আরোহণ থেকে ১৭ বছরের রাজত্বকালের ধারাবাহিক বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে।
খ. দ্বিতীয় খণ্ডের বিষয়বস্তু : শেখ আবুল ফজলের আকবরনামার দ্বিতীয় খণ্ডে আকবরের রাজত্বকালের অষ্টাদশ থেকে ৪৭তম বছরের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বিবরণ পাওয়া যায়। এখানে আকবরের গুরুত্বপূর্ণ বিজয়সমূহ, রাজস্ব ব্যবস্থা, দিন ই ইলাহি এবং সামাজিক ও প্রশাসনিক সংস্কারসমূহ সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ।
গ. তৃতীয় খণ্ডের বিষয়বস্তু : শেখ আবুল ফজলের ‘আকবরনামা' গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডটি ছিল তথ্যবহুল। এ তথ্যবহুল খণ্ডটিই ‘আইন ই আকবরি' নামে পরিচিতি লাভ করে। আইন ই আকবরিতে সম্রাটের প্রশাসনিক কাঠামো, আইন ব্যবস্থা, রাজস্ব ও অর্থসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। অবশ্য আবুল ফজল তৃতীয় খণ্ড সমাপ্ত করার পূর্বেই নিহত হন। পরবর্তী সময়ে মুহিব আলি খান নামে এক ঐতিহাসিক শাহজাহানের রাজত্বকালে ‘আইন ই আকবরি' রচনা সমাপ্ত করেন।
৩. পরিকল্পিত ইতিহাস গ্রন্থ : শেখ আবুল ফজল পরিকল্পনা করে ইতিহাস রচনা করেন। তিনি আকবরনামাকে পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত করে রচনা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি তিন খণ্ডের বেশি রচনা করতে সক্ষম হননি। পাঁচ খণ্ডের চারখণ্ড ছিল বর্ণনামূলক এবং পঞ্চম খণ্ড ছিল তথ্যমূলক । বর্ণনামূলক চার খণ্ডে সম্রাট আকবরের শাসনামলের ত্রিশ বছরের শাসনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার পরিকল্পনা করেন। তিনি আশা করেন যে, সম্রাট ১২০ বছর জীবিত থাকবেন এবং তিনি সম্রাটের শাসনামল সম্পর্কে ইতিহাস লিখে যাবেন। কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয়নি। তিনি নিহত হওয়ার পূর্বে চার খণ্ডের মধ্যে বর্ণনামূলক দুই খণ্ড এবং তথ্যমূলক খণ্ডটি লিখে যেতে সক্ষম হন। বর্ণনামূলক দুই খণ্ড এবং তথ্যমূলক অংশই সমষ্টিগতভাবে 'আকবরনামা' নামে পরিচিত।
৪. বস্তুনিষ্ঠ তথ্যসংগ্রহ : শেখ আবুল ফজল ইতিহাস রচনায় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তথ্যসংগ্রহ করেন। তিনি সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে তথ্যসংগ্রহ করেন। তিনি সরকারি দলিলপত্র, দস্তাবেজ, মহাফেজখানা, স্মৃতিচারণ, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য গ্রহণ, এমনকি গুণীজনদের কাছে থাকা চিঠিপত্র দলিলাদি সংগ্রহ করেন। প্রতিটি তথ্যের নির্ভুলভাবে যাচাইবাছাই করে তার ইতিহাসকর্মে অন্তর্ভুক্ত করেন। তাছাড়াও তিনি অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ রাজকর্মচারীদের নিকট হতে লিখিত সাক্ষ্য গ্রহণ করেন । তিনি প্রতিটি ঘটনার বিপরীতে কমপক্ষে ২০ জন লোকের লিখিত সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। তার এ তথ্যনির্ভর ইতিহাস গ্রন্থ আমাদেরকে মুঘল শাসন সম্পর্কে জানাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার এ তথ্যসংগ্রহের অভিনব পদ্ধতি তার অসামান্য দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে ।
৫. নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা : শেখ আবুল ফজল রাজঐতিহাসিক হয়েও সততা ও নিরপেক্ষতার সাথে তার ইতিহাসকর্ম সম্পাদন করেন। তিনি ঘটনার কার্যকারণের সঠিকতা যাচাই না করে তার ইতিহাসে সংযোজন করেননি। তিনি সর্বোত্তম রচনাশৈলীতে ‘আকবরনামা' রচনা করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের চিরশত্রু হিমু ও শের খানের বীরত্বের প্রশংসাই তার ইতিহাসকর্মের বস্তুনিষ্ঠতায় বা নিরপেক্ষতার পরিচয় বহন করে। তার এ নিরপেক্ষতার জন্য ইংরেজদের অনুবাদকের নিকট থেকে একজন সত্যানুসন্ধানী বলে আখ্যায়িত হন। এভাবেই তিনি গণ্ডির বাইরে গিয়ে ইতিহাস রচনা করে ইতিহাসকর্মের নিরপেক্ষাত বজায় রাখেন ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মুঘল সম্রাট আকবরের দরবারি ঐতিহাসিক আবুল ফজল ছিলেন অনন্য প্রতিভার অধিকারী। মধ্যযুগে তিনিই সর্বপ্রথম পরিকল্পনা করে ইতিহাস রচনা করেন। ইতিহাসকর্ম সম্পাদনের জন্য তার তথ্যসংগ্রহ পদ্ধতি নতুনত্বের দাবিদার। তিনি যাচাইবাছাই করে নিরপেক্ষ তথ্যটি নিয়ে ইতিহাসকর্ম সম্পাদনা করেন । তার বিখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘আকবরনামা' যা তাকে ঐতিহাসিকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]