কার্ল মার্কসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র আলোচনা কর ৷

উত্তর ভূমিকা : সামাজিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত করে সাম্য প্রতিষ্ঠার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে কার্ল মার্কস সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান। ধনতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী ভাবাদর্শের বিলোপসাধন করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষে সমতা গড়ে তোলাই তার সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্য ছিল। মার্কসের সমাজতান্ত্রিক দর্শনে কোনো ধরনের ব্যক্তিগত ধনসম্পদ রাখার সুযোগ রাখা হয়নি। সর্বপ্রকার অর্থসম্পদের একমাত্র মালিক হবে রাষ্ট্র। এ সম্পদ তথা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা নিয়ে কার্ল মার্কসের ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, যা মার্কসের খ্যাতিকে প্রতিষ্ঠা করে ।
মার্কসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র : নিম্নে কার্ল মার্কসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র আলোচনা করা হলো :
১. সমাজতান্ত্রিক গ্রন্থ রচনা : কার্ল মার্কস তার সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রচার ও প্রসার করার জন্য অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। এসব গ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে বিখ্যাত হলো ১৮৪৮ সালে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস এর সহায়তায় প্রকাশিত বিখ্যাত গ্রন্থ সাম্যবাদের ইশতেহার (The Communist Manifesto)। এ গ্রন্থে তিনি সর্বপ্রথম সমাজতন্ত্রবাদের (Socialism) পরিবর্তে কমিউনিজম (Communism) শব্দটি ব্যবহার করেন। এ গ্রন্থে সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে কার্ল মার্কস 'The Contribution to the Critique of Political Economy' নামক গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। প্রথমবারের মতো মার্কস এ গ্রন্থে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তার এই ব্যাখ্যাকে সমাজ নিরীক্ষণ ও বিশ্লেষণ এর মূলভিত্তি হিসেবে আজও গণ্য করা হয়। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি তিন খণ্ডে অমর গ্রন্থ The Das Kapital' প্রকাশ করেন। এতে মার্কস সমকালীন অর্থনৈতিক বিধি ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রকাশ করেন। এছাড়া এ গ্রন্থে উক্ত অবস্থার পরিবর্তনের জন্য তিনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে জোরালো অভিমত ব্যক্ত করেন। উল্লেখ্য, এ গ্রন্থের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধনতন্ত্রের পরিবর্তে কমিউনিজম ভাবধারা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং ক্রমশ সাম্যবাদী দল (Communist Party) গঠনে জনমত সংগঠিত হতে থাকে। আর তাই 'Das Kapital' সমাজতন্ত্রীদের কাছে বাইবেল রূপে পরিচিত। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সংঘটনেও 'Das Kapital' নামক গ্রন্থটি ব্যাপক ভূমিকা পালন করে ।
২. কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো : কার্ল মার্কসের বহুল আলোচিত সাম্যবাদের ইশতেহার বা কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো প্রথম প্রকাশিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৮ সালে। জার্মান ভাষায় রচিত এই গ্রন্থটির নাম ছিল মেনিফেস্ট ডেয়ার কোমুনিস্টেস। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস এর যৌথ উদ্যোগে গ্রন্থটি রচিত হয়। কমিউনিস্ট বিপ্লবের উদ্দীপনার পিছনে এ গ্রন্থের ভূমিকা অত্যন্ত সম্মানের সাথে স্বীকার করা হয় ।
৩. শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব : বাস্তবিক পক্ষে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, সব যুগের সব সমাজেই যারা ক্ষমতা, অর্থ উৎপাদনের উপাদান প্রভৃতির মালিক ছিলেন তারা সমাজের ক্ষমতাহীন, অর্থহীন ও উৎপাদনের উপাদানহীন শ্রেণিকে কমবেশি কোণঠাসা করে রেখে শোষণ করার চেষ্টা করতো। আধুনিক যুগে শিল্পবিপ্লবের পরও এ শোষণ অব্যাহত রয়েছে। আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব বঞ্চিত ও শোষিত শ্রেণিকে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ক্রমশ ট্রেড ইউনিয়ন গঠনসহ নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। পক্ষান্তরে, পুঁজিপতি শ্রেণি তথা শিল্পকারখানার মালিকগণ ট্রেড ইউনিয়নের গুটি কয়েক নেতাকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে বশীভূত করে শ্রমিক শ্রেণির ওপর কার্যত তাদের শোষণ অব্যাহত রাখতে চেষ্টা করেছে। সময় ও অবস্থার প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক নিয়মেই ক্ষমতা, অর্থ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় ক্রমশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কারণ অবহেলিত, শোষিত ও বঞ্চিত শ্রেণির অসন্তুষ্টি, লোভ ও ঘৃণা এক পর্যায়ে বৃহৎ গণআন্দোলন ও বিদ্রোহে সমাজকে প্রভাবিত করে এবং এভাবে ঐতিহাসিক নিয়মে এগিয়ে চলে সময়। অতিসূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, মার্কসের এ শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব বিশ্বের প্রতিটি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিধি ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সমানভাবেই প্রযোজ্য । সমাজের কর্তা ব্যক্তিদের কাছ থেকে সমাজের সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার পেতে এবং একইভাবে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা কর্মচারী ও সাধারণ জনগণও সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বেতন ও সুযোগ সুবিধা আদায় করতে সদা তৎপর থাকে । এভাবে শাসক ও কর্তাব্যক্তির সাথে জনগণের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়, যার সর্বশেষ রূপ সংগ্রাম তথা শ্রেণিসংগ্রাম ।
৪. উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব : পুঁজিপতিদের দ্বারা শ্রমিক শোষণের একটি বাস্তব চিত্র দাঁড় করানোর জন্য কার্ল মার্কস উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব তুলে ধরেন। কার্ল মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব কমিউনিস্টদের নিকট অত্যন্ত মূল্যবান বলে বিবেচিত হয়। যে দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করতে যত কম শ্রম ব্যয় হবে তার বিক্রয়মূল্য তত কম নির্ধারিত হবে এবং যে দ্রব্য ও পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করতে যত বেশি শ্রম ব্যয় হবে তার মূল্য তত বেশি নির্ধারণ করা হবে। কার্ল মার্কস বিখ্যাত ইংরেজ অর্থনীতিবিদ রিকার্ডো ও ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদের মূল্যের শ্রমনীতি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে এ উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। কার্ল মার্কস এর মতে, শ্রমিকদের শিক্ষার অভাব, জ্ঞানের স্বল্পতা, সাংগঠনিক দক্ষতার অনুপস্থিতি প্রভৃতি কারণে শিল্পকারখানার মালিকগণ শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে সবসময় বঞ্চিত করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, সুচতুর পুঁজিপতিগণ অত্যন্ত কৌশলে অতি অল্প মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে শ্রমিকদের শ্রম ক্রয় করে থাকে । এখানে শ্রমিকগণ নির্বোধ ও অসহায়ের মতো শিল্পকারখানার মালিক সংগঠন কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত বেতন স্কেলে তাদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হন। শ্রমিকগণ মূলত তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজন মিটানোর তাগিদে এরূপ অতি অল্প মূল্যে তাদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হন । শ্রমিকদের শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি করে যা মুনাফা আসে তা দিয়ে মালিকগণ আরও নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করতে উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন। এক্ষত্রে নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের চেয়ে শ্রমিকদেরকে তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য দেওয়া একান্ত আবশ্যক বলে দার্শনিক কার্ল মার্কস মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে শ্রমিদেরকে তাদের শ্রমের মূল্যের এক-চতুর্থাংশ বা অনেক ক্ষেত্রে তারও কম মূল্য পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হয় । শ্রমিকরা শিল্পকারখানার মালিকদের জন্য যে বাড়তি শ্রম, অর্থাৎ কম মূল্যে শ্রমদান করে এ বাড়তি শ্রমের মূল্যও মালিকরা কেড়ে নেয়। অন্যভাবে বলা যায়, শ্রমিকদেরকে যে পরিমাণ মূল্য থেকে বঞ্চিত করা হয় সেখান থেকেই রাষ্ট্রের রাজস্ব দেওয়া হয় এবং অবশিষ্টাংশ মালিকের মুনাফারূপে থেকে যায়। কার্যত এ মুনাফার অংশীদার শ্রমিকগণও আর এই বিষয়টিকে কার্ল মার্কস উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বরূপে ব্যাখ্যা করেন ।
৫. সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র : কার্ল মার্কস বলেন, মানবসমাজ মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে একটি ধারা হলো দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমজীবী শ্রেণি । পুঁজিপতিরা নানান কূটকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে যেভাবে প্রলেতারিয়েতদেরকে দিন দিন শোষিত ও বঞ্চিত করছে তাতে তারা ক্রমেই পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। চেতনা, সংহতি ও ক্ষুব্ধতা শ্রমজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করবে। যেহেতু বিশ্বময় প্রলেতারিয়েতগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেহেতু তারাই শেষ পর্যন্ত বিপ্লবের মাধ্যমে সংখ্যালঘিষ্ঠ পুঁজিপতিদেরকে হটিয়ে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। এভাবে ধনতন্ত্রীদের শোষণাত্মক নীতির বিভৎস পরিণামরূপে সারা বিশ্বেই কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে । সর্বহারাদের দ্বারা পরিচালিত এ কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে আর কোনো শ্রমিকের শোষণ থাকবে না ।
বাস্তবে আমরা দেখতে পাই, ১৯১৭ সালে রাশিয়ার সর্বহারা শ্রেণি সংগঠিত হয়ে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে একাত্ম হয়েছিল। ফলে তারা তাদের সর্বহারা একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র তথা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার বিনির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিল। কার্ল মার্কসের এরূপ অনুপ্রেরণামূলক তত্ত্ব বিশ্বের সব দেশের শ্রমিক শ্রেণিকে অনুপ্রাণিত করেছিল ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মার্কস এর বৈজ্ঞানিক সমাজতত্ত্ব বিশ্বের ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছে। সারা বিশ্বের মজদুর এক হওয়ার সংগ্রামের বদৌলতে আজ শ্রমিক অধিকার পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে গতিশীল হয়েছে। আর এজন্যই বলা যায়, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে মার্কসের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কার্ল মার্কসের ইতিহাস দর্শন সম্পর্কে আলোচনা কর ।
ভূমিকা : একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, দার্শনিক, সমাজচিন্তাবিদ ও বিপ্লবী হিসেবে কার্ল মার্কসের নাম সবচেয়ে জনপ্রিয়। তার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মূলধারা মার্কসবাদ নামেই বিশ্বের সর্বত্র পরিচিত। কার্ল মার্কসের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনায় তার ইতিহাস দর্শন গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে ব্যাপকার্থে কার্ল মার্কস মনুষ্য সমাজের ইতিহাসকে উপলব্ধি করেছেন, যা ইতিহাস দর্শনে একটি নতুন ধারণার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় ।
কার্ল মার্কসের ইতিহাস চিন্তা : আধুনিক ইতিহাস চর্চার জগতে কার্ল মার্কস ছিলেন ইতিহাসের এক নতুন ব্যাখ্যাকারক । তার মতে, সব সভ্যতার সব সময়ের ইতিহাসই মূলত শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস, যার বীজ সমাজের মধ্যেই নিহিত থাকে। ইতিহাস সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে আধুনিক ইতিহাস চর্চায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। মার্কসের ইতিহাস চিন্তা বা ইতিহাসের অগ্রগতি ও পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণার বিভিন্ন দিক নিম্নে আলোচনা করা হলো : ১. ইতিহাস পরিবর্তনশীল : কার্ল মার্কস ইতিহাসের পরিবর্তনশীলতাকে অন্তঃদৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করেন। তিনি বলেন ইতিহাসের প্রথম কথাই হলো পরিবর্তন। ইতিহাস প্রবহমান, অনুরূপ সেখানে চিরস্থায়ী কিছু নেই। রাজ্যের উত্থানপতনে, সামাজিক বিধিব্যবস্থার ক্ষেত্রে, এমনকি মানুষের জ্ঞান, ধারণা ও চিন্তার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসতে পারে। ইতিহাসের ভিতর প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যাপারই হলো এ পরিবর্তন কার্ল মার্কসের রচনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ।
২. শ্রেণিসংগ্রামের ‘ইতিহাস : দূরদর্শী সমাজতাত্ত্বিক কার্ল মার্কস মানব সভ্যতার ইতিহাসকে মূলত শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস বলে অভিহিত করেন। শ্রেণিসংগ্রাম প্রসঙ্গে মার্কস যুক্তির সাথে ব্যাখ্যা করেন যে, সভ্যতার সূচনাপূর্ব থেকে সবল ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা প্রশাসন অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যক্তি ও রাজ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সদা সচেষ্ট থাকে। এক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থেই পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সব যুগের সব সমাজই যাদের কাছে ক্ষমতা, অর্থ ও উৎপাদনের উপকরণ প্রভৃতি ছিল তারা তাদের সমাজের ক্ষমতাহীন, অর্থহীন ও উৎপাদনের উপাদানহীন শ্রেণিকে কমবেশি কোণঠাসা করে রেখে তাদেরকে শোষণ এর প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখত । আধুনিক যুগে তথা শিল্পবিপ্লবের পরও এ শোষণ প্রক্রিয়া বিদ্যমান রয়েছে। আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঞ্চিত ও শোষিত শ্রেণি তাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্রমশ ট্রেড ইউনিয়ন গঠনসহ নানাবিধ কর্মসূচি প্রণয়ন করতে থাকে। পক্ষান্তরে, পুঁজিপতি শ্রেণি তথা শিল্পকারখানার মালিকগণ সুকৌশলে ট্রেড ইউনিয়নের গুটি কয়েক নেতাকে মোটা অঙ্কের অর্থ উৎকোচ দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির ওপর কার্যত তাদের শোষণ প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করেন, যা বিশ্বের সব সমাজ ও সভ্যতায় কমবেশি লক্ষ করা যায় ।
৩. ইতিহাস শোষিত মানুষের রিদ্রোহের দলিল : সময় ও অবস্থার পরিবর্তনের ফলে ঐতিহাসিক নিয়মেই ক্ষমতা, অর্থ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ অবহেলিত, শোষিত ও বঞ্চিত শ্রমজীবী শ্রেণির পুঁজিপতিদের অসন্তুষ্টি, ক্ষোভ ও ঘৃণা এক পর্যায়ে আন্দোলন ও বিদ্রোহের আকারে প্রকাশ পায় এবং এভাবে ঐতিহাসিক নিয়মে এগিয়ে চলে সময়কাল। এক্ষেত্রে অতিসূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে উপলব্ধি করা যাবে সমাজের কর্তা ব্যক্তিদের কাছ থেকে সমাজের সাধারণ মানুষ তাদের প্রাপ্য অধিকার পেতে এক প্রকার দাবি আদায়মূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। একইভাবে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সাধারণ নাগরিকরা সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বেতন ও সুযোগ সুবিধা আদায় করতে সদা সচেষ্ট থাকে। পক্ষান্তরে, সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে অপেক্ষাকৃত কম বেতন ও কম সুযোগ সুবিধা দিয়ে জনগণের কাছ থেকে পর্যাপ্ত কর আদায় করার কৌশল তৈরি করে। এভাবে শাসক ও জনগণের মধ্যে চলতে থাকে অঘোষিত শ্রেণিসংগ্রাম। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে ব্যবহার করতে সদা তৎপর থাকে। এভাবে মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের বৃহৎ পরিসরে শোষিত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহে অংশ নেয়, যা সমাজে বৃহৎ পরিবর্তন নিয়ে আসে ।
৪. ইতিহাস হলো সমাজ ও সভ্যতার বিকাশধারা : কার্ল মার্কসের মতে, ইতিহাস হলো সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের ধারাবাহিক বিবরণ । উৎপাদন পদ্ধতি ও আনুষঙ্গিক আর্থিক বিধিব্যবস্থায় পরিবর্তনের কারণে নানা ধরনের সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং সেই সাথে সামাজিক জীবন ও সভ্যতার চেহারাও বদলাতে শুরু করে। এভাবেই এক যুগ হতে অন্য যুগের পরিবর্তন ঘটে এবং সমাজের একস্তর শেষে অন্য স্তরে রূপান্তর সম্ভব হয়। মধ্যযুগের কিউডাল জগৎ এভাবে আধুনিক ধর্মতন্ত্রে পরিবর্তিত হয়েছে। তবে ভিন্ন ভিন্ন জীবন ব্যবস্থা নির্ভর সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা ও আর্থিক গড়নের ওপর নির্ভর করেই সমাজের পরিবর্তনের ধারায় সভ্যতারও পরিবর্তন সম্ভব হয়। আর এভাবেই সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা অব্যাহত থাকে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আপাত দৃষ্টিতে কার্ল মার্কস একজন ঐতিহাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হলেও তার প্রবর্তিত পরিচিতি ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কার্ল মার্কসের দৃষ্টিতে ইতিহাস, সমাজ ও সভ্যতার কিছু বিশ্লেষণী দিক ফুটে ওঠে। এর মাধ্যমে সমাজের শোষিত শ্রেণির প্রকৃত অবস্থা নির্ণয় করা সহজ হয় । পক্ষান্তরে, শোষিত গণমানুষের ইতিহাস বিনির্মাণে তাদের একতাবদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণা জাগায় ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]