কার্ল মার্কসের শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর ।

ভূমিকা : কার্ল মার্কস সমাজ সম্পর্কে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তার মতে, সমাজ মানুষের পারস্পরিক কর্মের বিনিময় কেন্দ্র ছাড়া আর কিছুই নয় । কর্ম ও শ্রমের ভিন্নতার ওপর ভিত্তি করেই মানবসমাজের মধ্যে শ্রেণিভেদ গড়ে ওঠে । মার্কসের মতে, এ শ্রেণিভেদে দুর্বল দরিদ্ররা সর্বদাই শোষিত ও নির্যাতিত। দরিদ্রের এই শোষণ ও নির্যাতনকে মার্কস শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব বলে অভিহিত করেন ।
• কার্ল মার্কসের শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব : বাস্তবিকপক্ষে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, সব যুগের সব সমাজেই যারা ক্ষমতা, অর্থ উৎপাদনের উপাদান প্রভৃতির মালিক ছিলেন তারা সমাজের ক্ষমতাহীন, অর্থহীন ও উৎপাদনের উপাদানহীন শ্রেণিকে কমবেশি কোণঠাসা করে রেখে শোষণ করার চেষ্টা করতো। আধুনিক যুগে শিল্পবিপ্লবের পরও এ শোষণ অব্যাহত রয়েছে। আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব বঞ্চিত ও শোষিত শ্রেণিকে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ক্রমশ ট্রেড ইউনিয়ন গঠনসহ নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। পক্ষান্তরে, পুঁজিপতি শ্রেণি তথা শিল্পকারখানার মালিকগণ ট্রেড ইউনিয়নের গুটি কয়েক নেতাকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে বশীভূত করে শ্রমিক শ্রেণির ওপর কার্যত তাদের শোষণ অব্যাহত রাখতে চেষ্টা করেছে। সময় ও অবস্থার প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক নিয়মেই ক্ষমতা, অর্থ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় ক্রমশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কারণ অবহেলিত, শোষিত ও বঞ্চিত শ্রেণির অসন্তুষ্টি, লোভ ও ঘৃণা এক পর্যায়ে বৃহৎ গণআন্দোলন ও বিদ্রোহে সমাজকে প্রভাবিত করে এবং এভাবে ঐতিহাসিক নিয়মে এগিয়ে চলে সময় । অতিসূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, মার্কসের এ শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব বিশ্বের প্রতিটি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিধিব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সমানভাবেই প্রযোজ্য। সমাজের কর্তা ব্যক্তিদের কাছ থেকে সমাজের সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার পেতে এবং একইভাবে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা কর্মচারী ও সাধারণ জনগণও সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বেতন ও সুযোগ সুবিধা আদায় করতে সদা তৎপর থাকে। এভাবে শাসক ও কর্তাব্যক্তির সাথে জনগণের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়, যার সর্বশেষ রূপ সংগ্রাম তথা শ্রেণিসংগ্রাম ।
নিম্নের বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বকে আরও বিস্তারিতভাবে বুঝা যায় :
১. অবস্থানগত শ্রেণি বিভাজন : কার্ল মার্কস শ্রেণিতত্ত্ব আলোচনা অবতারণা করে যে সামাজিক শ্রেণি বিভাজনের বিবরণ দিয়েছেন তাতে সমাজকে মৌল শ্রেণি ও গৌণ শ্রেণি এ দুভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। মৌল শ্রেণি উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। তারা একদিকে উৎপাদনের মালিক অথবা মালিক শ্রেণি পর্যায়ের। অন্যদিকে যারা উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সরাসরি যুক্ত নয়, তারা গৌণ শ্রেণি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যেমন— দাসযুগে দাস মালিকগণ মৌল আর দাসরা গৌণ, ধনতন্ত্রে পুঁজিপতি মৌল শ্রেণি আর সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণি গৌণ হিসেবে বিবেচ্য।
২. উদ্বৃত্ত মূল্যের ফলে শ্রেণি দ্বন্দ্ব : কার্ল মার্কস উৎপাদনের উদ্বৃত্ত মূল্য নিয়ে যে তত্ত্ব পরিবেশন করেছেন তাকে উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব বলে অভিহিত করা যায়। মার্কসের এই উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বের মাধ্যমেও শ্রেণি দ্বন্দ্বকে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন— মালিক শ্রেণির অত্যধিক লাভের আশায় শ্রমিকের ওপর শোষণ-নির্যাতন অব্যাহত রাখে, যা শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে গণঅসন্তোষের জন্ম দেয়। এই গণঅসন্তোষ মালিক বা পুঁজিপতি শ্রেণিকে দমন করতে চাইলেই একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। যাকে এক কথায় মার্কস শ্রেণিসংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। এভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্বও শ্রেণিসংগ্রামের জন্ম দেয় ।
৩. শ্রেণি সচেতনতা : সমাজের প্রত্যেক শ্রেণির নিজস্ব স্বার্থ সংরক্ষণের সচেতনতা থেকেই পরবর্তীতে শ্রেণিসংগ্রামের সূচনা ঘটে। কেননা, সামাজিক অর্থনীতিতে প্রতিযোগী শ্রেণিসমূহ নিজস্ব স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে, শোষিত শ্রেণি এরূপ শোষণের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ফলে শ্রেণি সচেতনতা ও পারস্পরিক শ্রেণি সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি ঘটে।
৪. সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য : কার্ল মার্কসের মতে, সমাজে শ্রেণি ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটার সাথে সাথেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে । এই বৈষম্যের ফলে শাসক ও মালিক শ্রেণি কর্তৃক শ্রমিক বা সাধারণ শ্রমিক শ্রেণি প্রতিনিয়ত শোষিত হতে থাকে ।
সমালোচনা : কার্ল মার্কসের শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব বহুল সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে এ তত্ত্বের সমালোচনা প্রদত্ত হলো :
প্রথমত, সমালোচকরা অদ্যাবধি মানবসমাজের ইতিহাসকে শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস বলে মেনে নিতে নারাজ। তাদের মতে, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি ছাড়াও মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম-ভালোবাসাও আছে, যা মার্কসীয় শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি ।
দ্বিতীয়ত, মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রকে শ্রেণি শোষণের হাতিযার হিসেবে উল্লেখ করে সত্যের অপলাপ করেছেন মাত্র। আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সর্বহারা শ্রেণি রাষ্ট্রের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিজেদের উন্নতি সাধনের সুযোগ পাচ্ছে।
তৃতীয়ত, যদিও কার্ল মার্কসের শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব শিল্পায়িত সমাজে আজও বিদ্যমান, তবে তিনি যে সাম্যবাদী সমাধানের কথা বলেছেন তা সেভাবে বাস্তবায়িত হয়নি ।
চতুর্থত, অদ্যাবধি শ্রেণিস্বার্থ ও শ্রেণিদ্বন্দ্বকে প্রতিহত করার নজির রয়েছে। ব্রিটেনে এখনো ধনী-দরিদ্র এবং মালিক-শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে।
পঞ্চমত, কার্ল মার্কস বলেছেন যে, বুর্জোয়া ও সর্বহারা শ্রেণি নামক দুটি শ্রেণি থাকবে; কিন্তু বাস্তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে যারা ধনিক শ্রেণির পক্ষে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব এবং মর্যাদা ভোগ করে আসছে।
ষষ্ঠত, ভোটের অধিকারী ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার শ্রমিক শ্রেণিকে অনেক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দিয়েছে, যা কার্ল মার্কস ধারণা করেননি ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কার্ল মার্কসের শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব ঊনবিংশ শতকের ইতিহাসকে নতুন ঠিকানায় পৌছে দেয়। যার অনুপ্রেরণায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বাস্তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে বিশ্বের ইতিহাসের গতিপথে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং কার্ল মার্কসের শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]