কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকা : বিশ্ববিখ্যাত ইতিহাস দার্শনিক কার্ল মার্কস তার কতিপয় তত্ত্বের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। কার্ল মার্কসের তত্ত্বসমূহের মধ্যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের যে তত্ত্ব প্রচার করেন তার মূল বক্তব্য হলো— বস্তুই একমাত্র সত্তা এবং গতি হলো বস্তুর একটি স্বাভাবিক ধর্ম। বস্তুর অস্তিত্ব মনের ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং মনের অস্তিত্বই বস্তুর ওপর নির্ভরশীল । আর এজন্য মার্কসকে অন্যতম বস্তুবাদী দার্শনিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ।
• কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ : কার্ল মার্কস বস্তুকেন্দ্রিক সামাজিক পট পরিবর্তন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমাজকাঠামোর আর্থসামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করেন। এখানে তিনি প্রকাশ করতে চেয়েছেন আমাদের সামাজিক কাঠামো উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে মিল রেখে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে তিনি নিরক্ষর সমাজ ও তার অর্থনীতি কিংবা এর
পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক কাঠামোর ধারাবাহিক পরিবর্তনের সাথে সমাজ কাঠামোর আন্তঃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমেই একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয় যে, বস্তুকেন্দ্রিক সামাজিক পরিবর্তন আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা দ্বারা সরাসরি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তাই মার্কস মনে করেন যে, ইতিহাসের পটভূমিতে এ পর্যন্ত যত ঘটনা আবর্তিত হয়েছে তার প্রতিটির তাৎপর্য শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাসকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের শিক্ষা গুরু ছিলেন দার্শনিক হেগেল। কিন্তু হেগেলীয় দ্বন্দ্ববাদের পদ্ধতি ও মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদের পদ্ধতির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। কার্ল মার্কস তার দ্বন্দ্ববাদের পার্থক্য সম্পর্কে নিজেই বলেন, আমার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির থেকে শুধু ভিন্ন নয়; বরং তা হচ্ছে একটি বিপরীত পদ্ধতি। তিনি আরও বলেন, আমার কাছে বস্তুজগৎই একমাত্র জগৎ বা আদর্শ, মানুষ তার মনের সাহায্যে বস্তুজগৎকে চিন্তার মাধ্যমে উপলব্ধির চেষ্টা করে। প্রকৃত অর্থে কার্ল মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে যে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তার মূল কথা হলো বস্তুই একমাত্র সত্তা এবং গতি হলো বস্তুর স্বাভাবিক ধর্ম । বস্তুর অস্তিত্ব মনের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং মনের অস্তিত্বই বস্তুর ওপর নির্ভরশীল। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ম্যূর বলেন, কার্ল মার্কস বিশ্বাস করেন যে, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি কেবল চিন্তার কোনো পদ্ধতি নয়, বরং এটা হচ্ছে চিন্তার মাধ্যমে উদ্ভূত যথার্থ বাস্তবতার নিরিখে উপলব্ধিমূলক একটি পদ্ধতি। কার্ল মার্কসকে এই অর্থে বস্তুবাদী বলা হয় যে, তিনি চিন্তা বা ভাবকে প্রাধান্য দানের মাধ্যমে হেগেলীয় বস্তুবাদী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে পুরোপুরি ভিন্ন একটি দ্বান্দ্বিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, চিন্তা বা ভাব সমাজের একটি বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন ঘটায় এবং বাস্তব অবস্থার দ্বারাই আবার চিন্তা বা ভাবের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়ে থাকে। মূলত এ কারণেই মার্কসকে বস্তুবাদী দার্শনিক বলা হয় ।
বস্তুবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা : ইতিহাস দার্শনিক কার্ল মার্কসের মতে, প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে অর্থব্যবস্থা মানবজীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। তিনি বলেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসকে এক দৃষ্টিকোণ থেকে কার্যত অর্থনৈতিক ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস বলাই শ্রেয়। মানুষের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, অর্থ সংগ্রহ ও বণ্টন, অর্থ ভোগ, সংরক্ষণ, সাশ্রয়, আত্মসাৎ, ছিনতাই এবং সামগ্রিক অর্থসংক্রান্ত মানব কর্মের ধারাবাহিক বিবরণই মূলত ইতিহাস। ইতিহাসকে মার্কস মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের প্রধানতম ঘাতপ্রতিঘাতের বিবরণ বলে অভিহিত করেন। দার্শনিক হেগেলের সাথে একত্মতা প্রকাশ করে কার্ল মার্কসও অভিমত ব্যক্ত করেন যে, পরস্পরবিরোধী অর্থনৈতিক স্বার্থ ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের ফলেই ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নির্ণীত হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য একটি জাতিকে বিভিন্ন প্রকার পরিকল্পনা গ্রহণ ও বহুবিধ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। রাষ্ট্রের শাসক সম্প্রদায় বা কোনো ব্যক্তি কতটুকু সম্পদ অর্জন করেছে, কীভাবে অর্জন করছে এবং আরও সম্পদ কীভাবে অর্জন করা সম্ভব, আন্তঃবাণিজ্যে কীভাবে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বিস্তার করা যায় এরূপ অর্থসংক্রান্ত কর্মের খতিয়ানই মূলত ইতিহাসের মূল উপজীব্য।
সমালোচনা : নিম্নে কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ তত্ত্বের সমালোচনাসমূহ তুলে ধরা হলো :
প্রথমত, কার্ল মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বটি অসম্পূর্ণ ও অপূর্ণাঙ্গ। কারণ অর্থনৈতিক উপাদান ছাড়া এমন আরও অনেক উপাদান রয়েছে সেগুলো মানবেতিহাসে পরিবর্তন পারে ।
দ্বিতীয়ত, কার্ল মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অস্পষ্ট ও অসঙ্গতিপূর্ণ। তিনি এ তত্ত্বে বস্তুবাদের ব্যাখ্যা তুলে ধরেননি। তিনি যা করেছেন তা এক ধরনের ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা মাত্র ।
তৃতীয়ত, প্রখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, জাতীয় জীবনের সবকিছু কেবল বস্তুগত উপাদান ও অবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না । জনগণের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, বাসনা ইত্যাদি উপাদানও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল ।
চতুর্থত, কার্ল মার্কস ঐতিহাসিক ধারণার বিশ্লেষণে মানুষের আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিকটিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছেন । উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কার্ল মার্কসের মতবাদসমূহের মধ্যে ঐতিহাসিক জড়বাদী তত্ত্বটি অন্যতম। এতে কার্ল মার্কস বস্তুর সাথে সমাজের অন্যান্য উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন। মার্কসের জড়বাদী বস্তুবাদ ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়। এর ফলে তিনি সমাজের বস্তুতান্ত্রিক ভাবনা চিন্তার রহস্যের সমাধানে সচেষ্ট হন। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে বস্তুর প্রভাবকেও অত্যন্ত সুচারুভাবে ব্যাখ্যা করেন ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]