কার্ল মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর

ভূমিকা : উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব দার্শনিক কার্ল মার্কসের একটি মৌলিক তত্ত্ব। মার্কসীয় দর্শনের মৌলিক বিষয়সমূহ তার উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ তত্ত্বের সার কথা হলো শ্রমিকের শ্রমের কারণে পুঁজিপতির যে অতিরিক্ত মুনাফার সৃস্টি হয়, সেই মুনাফার একটি বৈধ দাবিদার শ্রমিক শ্রেণিও। কিন্তু যুগে যুগে মালিক পক্ষ শ্রমিক শ্রেণিকে এই মুনাফা থেকে বঞ্চিত করে এসেছে।
© কার্ল মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব : পুঁজিপতিদের দ্বারা শ্রমিক শোষণের একটি বাস্তব চিত্র দাঁড় করানোর জন্য কার্ল মার্কস উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব তুলে ধরেন। কার্ল মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব কমিউনিস্টদের নিকট অত্যন্ত মূল্যবান বলে বিবেচিত হয়। যে দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করতে যত কম শ্রম ব্যয় হবে তার বিক্রয়মূল্য তত কম নির্ধারিত হবে এবং যে দ্রব্য ও পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করতে যত বেশি শ্রম ব্যয় হবে তার মূল্য তত বেশি নির্ধারণ করা হবে। মার্কস বিখ্যাত ইংরেজ অর্থনীতিবিদ রিকার্ডো ও ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদের মূল্যের শ্রমনীতি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন । কার্ল মার্কসের মতে, শ্রমিকদের শিক্ষার অভাব, জ্ঞানের স্বল্পতা, সাংগঠনিক ক্ষমতার অনুপস্থিতি প্রভৃতি কারণে শিল্পকারখানার মালিকগণ শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে সবসময় বঞ্চিত করে থাকে ।
প্রকৃতপক্ষে, সুচতুর পুঁজিপতিগণ অত্যন্ত কৌশলে অতি অল্প মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে শ্রমিকদের শ্রম ক্রয় করে থাকে। এখানে শ্রমিকগণ নির্বোধ ও অসহায়ের মতো শিল্পকারখানার মালিক সংগঠন কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত বেতন স্কেলে তাদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হন । শ্রমিকগণ মূলত তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজন মিটানোর তাগিদে এরূপ অতি অল্প মূল্যে তাদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হন ।
কার্ল মার্কস অভিমত পেশ করেন যে, মালিক পক্ষ কর্তৃক কোটি কোটি টাকা জমে নতুন শিল্পকারখানা স্থাপিত হয়। পৃথিবীর সব শিল্পকারখানার জীবনিশক্তি হলো শ্রমিক। কারণ শ্রমিকদের হাতের সংস্পর্শ ব্যতীত শিল্পকারখানার কোনো একটি যন্ত্রের চাকা ঘুরে না বলে পণ্যসামগ্রীও উৎপাদন করাও সম্ভব হয় না। অতএব, শিল্পকারখানার প্রাণশক্তিরূপে বিবেচিত শ্রমিক শ্রেণি ছাড়া শিল্পকারখানাগুলো কার্যত অচল ও মৃত। অথচ শ্রমিকদের শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি করে, যা মুনাফা আসে তা দিয়ে মালিকগণ আরও নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করতে উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন। এক্ষত্রে নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের চেয়ে শ্রমিকদেরকে তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য দেওয়া একান্ত আবশ্যক বলে দার্শনিক কার্ল মার্কস মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে শ্রমিদেরকে তাদের শ্রমের মূল্যের এক-চতুর্থাংশ বা অনেক ক্ষেত্রে তারও কম মূল্য পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হয়। শ্রমিকরা শিল্পকারখানার মালিকদের জন্য যে বাড়তি শ্রম, অর্থাৎ কম মূল্যে শ্রমদান করে এ বাড়তি শ্রমের মূল্যও মালিকরা কেড়ে নেয়। অন্যভাবে বলা যায়, শ্রমিকদেরকে যে পরিমাণ মূল্য থেকে বঞ্চিত করা হয় সেখান থেকেই রাষ্ট্রের রাজস্ব দেওয়া হয় এবং অবশিষ্টাংশ মালিকের মুনাফারূপে থেকে যায়। কার্যত এ মুনাফার অংশীদার শ্রমিকগণও আর এই বিষয়টিকে কার্ল মার্কস উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বরূপে ব্যাখ্যা করেন ।
উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বের ফলাফল : মালিক বা পুঁজিপতি শ্রেণির অতিরিক্ত মুনাফাস্বরূপ নিম্নোক্ত ফলকে দুইভাগে ভাগ করা যায় । যথা :
১. আপাতদৃশ্য ফল ও
২. অনিবার্য ফল।
১. আপাতদৃশ্য ফল : উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বের আপাত দৃশ্যমান ফল হলো মালিক বা পুঁজিপতিরা শ্রমিকের শ্রম শোষণের মাধ্যমে আরও বেশি পুঁজির আত্মসাৎ করতে পারবে। শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রম যে উদ্বৃত্ত মূল্যের জন্ম দেয় তা মালিক শ্রেণিকে অন্যত্র পুঁজি স্থানান্তরে অনুপ্রাণিত করবে। এভাবে পুঁজির বহুমুখী ব্যবহার মালিক শ্রেণিকে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ভিত্তি পাকাপোক্তকরণে উৎসাহিত করে। এক্ষেত্রে একদিকে ধীরে ধীরে শ্রমিকের শোষণ প্রক্রিয়া অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে তেমনি অন্যদিকে মালিকের পুঁজিরও স্ফীতি ঘটবে। অর্থাৎ পুঁজিপতিরা আরও পুঁজি হাতিয়ে নেবে আর শ্রমজীবীরা শত পরিশ্রমের দ্বারাও দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে না। এর একটি যৌক্তিক কারণ হলো বছর বছর শ্রমিকের শ্রমের মূল্যের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দামও বৃদ্ধি। ফলে শ্রমিকের পক্ষে সুখেস্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়বে।
২. অনিবার্য ফল : কার্ল মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বের অনিবার্য ফল হলো সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। তিনি বলেন, মানবসমাজ মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে একটি ধারা হলো দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমজীবী শ্রেণি। পুঁজিপতিরা নানান কূটকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে যেভাবে প্রলেতারিয়েতদেরকে দিন দিন শোষিত ও বঞ্চিত করছে তাতে তারা ক্রমেই পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। চেতনা, সংহতি ও ক্ষুব্ধতা শ্রমজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করবে। যেহেতু বিশ্বময় প্রলেতারিয়েতগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেহেতু তারাই শেষ পর্যন্ত বিপ্লবের মাধ্যমে সংখ্যা লঘিষ্ঠ পুঁজিপতিদেরকে হটিয়ে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। এভাবে ধনতন্ত্রীদের শোষণাত্মক নীতির বীভৎস পরিণামরূপে সারা বিশ্বেই কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। সর্বহারাদের দ্বারা পরিচালিত এ কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে আর কোনো শ্রমিকের শোষণ থাকবে না ।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১৯১৭ সালে রাশিয়ার সর্বহারা শ্রেণি সংগঠিত হয়ে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে একাত্ম হয়। ফলে তারা তাদের সর্বহারা একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র তথা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার বিনির্মাণ করতে সক্ষম হয়। কার্ল মার্কসের এরূপ অনুপ্রেরণামূলক তত্ত্বে বিশ্বের সব দেশের শ্রমিক শ্রেণিকে অনুপ্রাণিত করে ।
সমালোচনা : কার্ল মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বটি বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। তার এ তত্ত্ব অনুসারে সমাজের সর্বহারা শ্রেণি তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য থেকে সব সময়ে বঞ্চিত হয়। সমাজের পুঁজিবাদী ও বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের শ্রমের দ্বারা অর্জিত সম্পদ আত্মসাৎ করে। কিন্তু কার্ল মার্কসের এ তত্ত্বটি সর্বাংশে সত্য নয়। আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে শ্রমিক শ্রেণি বিভিন্ন সুযোগ- সুবিধা ভোগ করছে। বর্তমানে দেখা যায়, শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠেছে। এসব সংগঠন শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। তারা একটি নির্দিষ্ট বেতন কাঠামোর অধীনে কাজ করছে। এছাড়া কার্ল মার্কস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য যে একনায়কতন্ত্র ও বিপ্লবের কথা বলেছেন তাও লক্ষ্য করা যায় না। তাই বলা যায়, কার্ল মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বটি একটি অসম্পূর্ণ তথ্য ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব মার্কসের শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বেরই সমর্থক । শ্রেণিসংগ্রামে যেমন সর্বশেষে প্রলেতারিয়েতদের একত্রিত করে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা হয় তেমনি উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে। আর এজন্য দুনিয়ার মজদুরদের এক হওয়ার চেয়ে অন্য কোনো বিকল্প নেই ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]