ফরায়েজি আন্দোলন ও হাজি শরীয়তুল্লাহ

প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে অন্যতম মুসলিম প্রতিরোধ যোদ্ধা হলেন হাজি শরীয়তুল্লাহ। দৃশ্যত ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজা রামমোহন রায় যখন হিন্দুধর্ম সংস্কারের জন্য কলকাতায় রত, হাজি শরীয়তুল্লাহ তখন পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজ সংস্কারের আন্দোলন শুরু করেন। মূল ইসলাম ধর্মে পরবর্তীকালে যে সকল রীতিনীতি সংযুক্ত হয়েছিল সেগুলো দূর করে ইসলামের শুদ্ধিকরণ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার সাধন ছিল হাজি শরীয়তুল্লাহর আন্দোলনের উদ্দেশ্য। তিনি জমিদারগণ কর্তৃক কৃষক সম্প্রদায়ের শোষণের বিরোধী ছিলেন। এই আন্দোলনে ধর্মনৈতিক ও রাজনৈতিক আদর্শের সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয় এবং ইতিহাসে তা ‘ফরায়েজি আন্দোলন' নামে পরিচিত। সমাজ জীবন থেকে সকল প্রকার কুসংস্কার দূর করে ইসলাম ধর্মের আদি অবস্থায় ফিরে যাবার উদ্দেশ্যেই তিনি ফরায়েজি আন্দোলন : শুরু করেন। তাঁর অনুসারীদের বলা হয় ফরায়েজি। আরবি শব্দ ফরজ (অবশ্য কর্তব্য) থেকে ফরায়েজি নামের উৎপত্তি। যারা ফরজ পালন করেন তাঁরাই ফরায়েজি। কিন্তু হাজি শরীয়তুল্লাহ যে ফরজের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা করেছেন সে ফরজের অনুসারীদেরকেই শুধু ফরায়েজি বলা হয় ।
ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজি শরীয়তুল্লাহ ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার (বর্তমান জেলা) অন্তর্গত শামাইল নামক গ্রামে এক মধ্যবিত্ত তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন মাত্র ৮ বছর তখন তার পিতা আবদুল জলিল তালুকদার পরলোক গমন করেন। শরীয়তুল্লাহ তখন তাঁর চাচার আশ্রয়ে মানুষ হতে থাকেন। ১২ বছর বয়সে চাচার সঙ্গে রাগ করে তিনি কলকাতায় পালিয়ে যান এবং মাওলানা বাশারত আলীর নিকট কোরআন শরীফ শিক্ষা করেন। এরপর তিনি হুগলি জেলার ফুরফুরাতে আরবি ও ফারসি ভাষায় দু'বছর শিক্ষা লাভ করেন। কলকাতায় ফিরে এসে তিনি তাঁর শিক্ষক বাশারত আলীর সঙ্গে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে হজ করতে মক্কা শরিফে যান। মক্কায় শরীয়তুল্লাহ মুরাদ নামক এক বাঙালি শিক্ষকের কাছে ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি কয়েক বছর তাহের সম্বল নামক হানাফি শাস্ত্রবিদের শিক্ষাধীনে থাকেন এবং তাঁর নিকট কাদিরিয়া তরিকার সুফি মতবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। দু বছর তিনি কায়রোর জামিয়া-আল-আজহার শিক্ষাকেন্দ্রে ছিলেন। আরবদেশে অবস্থানকালে শরীয়তুল্লাহ সেখানকার সংস্কার আন্দোলনের নেতা মুহম্মদ ইবন আবদুল ওয়াহাবের সংস্পর্শে আসেন এবং সংস্কারের চেতনা লাভ করেন। ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন ।
হাজি শরীয়তুল্লাহ বাংলার মুসলমান সমাজে নানাবিধ কুসংস্কার ও অনৈসলামিক রীতিনীতি লক্ষ করেন। এদেশের মুসলমানদের অধিকাংশই ছিল ধর্মান্তরিত। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরও তারা নিজেদের পূর্বধর্ম ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলোকে সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন দিতে পারেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাংলার মুসলমানদের সমাজ জীবনে কোরআন ও হাদিসের পরিপন্থি পূর্বধর্মজাত নানা আচার অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি থেকে যায়। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, সামাজিক উৎসব উপলক্ষ্যে তাদের অসংখ্য পূর্বধর্মজাত অমুসলিম আচার অনুষ্ঠানের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এছাড়া জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারেও মুসলমানদের জীবন তখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। হাজি শরীয়তুল্লাহ এদের দুঃখ অনুভব করেন এবং এদের উন্নতির জন্য আত্মনিয়োগ করবেন বলে মনস্থির করেন। আরবে ইসলামি শিক্ষা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় এবং ওয়াহাবি আন্দোলনের সংস্পর্শে আসায় তিনি পূর্বেই অনুভব করেছিলেন যে প্রকৃত ইসলাম থেকে অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান বহু দূরে সরে গিয়েছে। তাই তিনি পবিত্র কোরআন ও হাদিসের শিক্ষার আদর্শে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদেরকে আত্মপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। হাজি শরীয়তুল্লাহ দ্বিতীয়বার মক্কা শরিফ যান এবং ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন। এরপর তিনি সমাজসংস্কারের কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সমাজব্যবস্থার চত্বর থেকে চুট্টি, পুটি, মহরম, ফাতেহা, ওরস, মিলাদ ইত্যাদির উদযাপন; হিন্দু জমিদারদের আদেশে দুর্গাপূজা, কালীপূজা ইত্যাদিতে চাঁদা প্রদান ও অংশ গ্রহণ: খাতনা, কানছেদানি, বিয়ে ইত্যাদিতে আড়ম্বরপূর্ণ জাঁকজমক প্রভৃতি ইসলাম বহির্ভূত, ইসলাম বিরুদ্ধ অথবা বহিপ্রভাবজনিত আচারব্যবহারের বিরোধিতা করেন এবং এগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি তৎকালীন মুসলিম সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন অনৈসলামিক রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠানকে ‘শিরক' ও ‘বেদাত’-এই দু ভাগে বিভক্ত করেন। পীরপূজা, কবরপূজা, সেজদা দেওয়া ইত্যাদি প্রচলিত রীতিকে তিনি 'শিরক' (পাপ) বলে ঘোষণা করেন। ভেলা ভাসানো, জারিগান গাওয়া, মহরমে মাতম করা ইত্যাদিকে ‘বেদাত' (ইসলামের পরিপন্থি) বলে ঘোষণা করেন। হাজি শরীয়তুল্লাহ এই সকল অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিহার করার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান। খুব অল্প সময়ের মধ্যে হাজি শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন ফরিদপুর, ঢাকা, বাখেরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা জেলায় জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর আদর্শের কথা উল্লেখ করে জেমস ওয়াইজ লিখেছেন, “তাঁর দেশবাসী তাঁর নির্মল ও আদর্শমণ্ডিত জীবনের প্রশংসা করতো ও তাঁকে পিতার মতো ভক্তি করতো। তিনি তাদেরকে দুর্দিনে উপদেশ দিতেন ও দুঃখের সান্ত্বনা দিতেন।”
হাজি শরীয়তুল্লাহ এদেশে ইংরেজদের রাজত্বকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। তাঁর মক্কা শরীফে হিজরত করার এটাই ছিল মূল কারণ। তাই দেশে ফিরে এসে তিনি তাঁর যৎকিঞ্চিৎ সাধ্য সম্বলের যা প্রয়োগ সম্ভব তা দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। তিনি মনে করেন যে, অমুসলিম শাসনাধীনে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক চেতনা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইংরেজ শাসনাধীন এদেশকে তিনি 'দারুল-হরব', (বিধর্মীর রাজ্য) বলে মনে করতেন। তাই তাঁর মতে এদেশে হানাফি মাজহাব অনুযায়ী জুমার নামাজ কায়েম করা অবৈধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এদেশে গ্রামেগঞ্জে, শহরে, বন্দরে ইসলামি প্রশাসন কায়েম নেই এবং ইসলামি প্রমাসকের উপস্থিতি জুমার নামাজের প্রথম ও প্রধান শর্ত। সুতরাং এদেশে ইসলামি প্রশাসন কায়েম করার সাপেক্ষে তিনি জুমার নামাজ এবং একই কারণে দুই ঈদের নামাজ পড়া নিষিদ্ধ বলে ফতোয়া দেন। তিনি জনগণকে জুমার বদলে জোহরের নামাজ আদায় করতে উপদেশ দেন। এটি ছিল প্রকারান্তরে ইংরেজ সরকারের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ এবং মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের বিতাড়িত করে বৈধভাবে জুমার নামাজ কায়েম করার জন্য তৎপর হবার আহ্বান। ফরায়েজি মতবাদের সঙ্গে সাবেকি মতবাদের বিরোধ দেখা দেয়। তায়াইয়ুনি মতবাদের অন্যতম প্রচারক মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরি এর বিরোধিতা করেন এবং একে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করতে থাকেন । মৌলনা জৌনপুরি ইংরেজ শাসনাধীন ভারতকে 'দারুল-হরব' (বিধর্মীর রাজ্য)-এর পরিবর্তে ‘দার-উল-আমন' (নিরাপত্তার দেশ) বলে অভিমত ব্যক্ত করেন এবং ইংরেজদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার পরামর্শ দেন। স্থানীয় জমিদারগণও ফরায়েজি আন্দোলনের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। জেমস ওয়াইজ লিখেছেন, “হিন্দু জমিদারগণ ফরায়েজি আন্দোলনের বিস্তৃতিতে ভয় পেয়ে যান, কারণ এই সংস্কার আন্দোলন মুসলমান প্রজাদেরকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল।”
জমিদারেরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বদৌলতে যে বিপুল ক্ষমতা লাভ করেছিল তার সুযোগে তারা প্রজাদের উপর বিভিন্ন অন্যায় কর ধার্য করতো। দুর্গাপূজা, কালীপূজা প্রভৃতি হিন্দু উৎসব উপলক্ষেও মুসলমানদেরকে কর দিতে বাধ্য করা হতো এবং কোনো কোনো হিন্দু জমিদার ঈদ উপলক্ষ্যে মুসলমানদেরকে গরু কোরবানি করতে নিষেধ করেছিলেন। যোগেশ চন্দ্র বাগল-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, “মুসলমানগণকে দাড়ি রাখার জন্য আড়াই টাকা হারে কর দিতে হতো।” হাজি শরীয়তুল্লাহ প্রজাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তারা জমিদারকে কোনো অবৈধ কর না দেয় এবং ঈদ প্রভৃতি উৎসবে গরু কুরবানি করতে উৎসাহিত করেন ।
হাজি শরীয়তুল্লাহর ধর্মপ্রচারের কোনো রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছিল না। তাঁর আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদেরকে ধর্মনিষ্ঠ করে তোলা, নৈতিকবলে বলীয়ান করা, তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতনা করা এবং অত্যাচারী হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের জুলুম থেকে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা। তিনি শান্তিপ্রিয় সংস্কারক ও প্রচারক ছিলেন। কিন্তু হিন্দু জমিদার ও এক শ্রেণির গোড়াপন্থি স্বার্থপর মুসলমান তাঁর সংস্কার আন্দোলন সহজভাবে গ্রহণ করেনি। হিন্দু জমিদারগণ নানা অজুহাতে ফরায়েজি প্রজাদের উপর অত্যাচার করতে থাকে। ফরায়েজিদেরকে কাবু করার জন্য জমিদারেরা ইংরেজ নীলকরদের হাত করে এবং তাদের যোগসাজশে ইংরেজ প্রশাসনিক কর্তকর্তা ও বিচারকমণ্ডলীকে ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে সচেষ্ট হয়। কলকাতার হিন্দু প্রেস এদের সহায়তায় এগিয়ে আসে । ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে ইংরেজ প্রশাসন সোচ্চার হলেও জোতদার, জমিদার ও নীলকরদের দ্বারা নিপীড়িত রায়ত চাষিরা ন্যায় বিচারের আশায় সম্প্রদায় ও জাতিধর্ম নির্বিশেষে ফরায়েজিদের পক্ষে যোগ দেয় ৷
১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে হাজি শরীয়তুল্লাহ যখন ঢাকা জেলার নয়াবাড়িতে তাঁর দলীয় প্রচার কার্য চালাচ্ছিলেন, তখন হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাঁধে। এ সময় সংস্কার বিরোধী কিছু সংখ্যক মুসলমানও তাঁর বিরোধিতা করে। অত্যাচারী জমিদারদের হাত থেকে তাঁর অনুসারীদের রক্ষা করার জন্য তিনি একটি লাঠিয়াল বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তাঁর শিষ্য জালালউদ্দীন মোল্লার উপর এ কাজের দায়িত্ব দেন। এতে স্বার্থবাদীরা তাঁর উপর আরও ক্ষিপ্ত হয় এবং নানাভাবে হয়রানি করতে চেষ্টা করে। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর উপর পুলিশি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। বাংলার যুগস্রষ্টা সংস্কারক হাজি শরীয়তুল্লাহ ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে নিজ গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। ফরায়েজি আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে পুনর্জাগরণের সূত্রপাত তাঁকে ইতিহাসে চিরদিন স্মরণীয় করে রাখবে ।
ফরায়েজি আন্দোলন ও হাজি শরীয়তুল্লাহকে নিম্নোক্ত শিরোনামে উপস্থাপন করা যায় :

হাজি শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন :

প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে হাজি শরীয়তুল্লাহ্ মনেপ্রাণে একজন খাঁটি মুসলমান। একজন খাঁটি মুসলমান হয়ে তদানীন্তন মুসলমান সমাজের কুসংস্কারগুলোকে তিনি বরদাশত করতে পারেননি । মক্কা থেকে দেশে ফিরে এসে তাই তিনি সমাজ সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। সে সময়ের মুসলমান সমাজে প্রবর্তিত পীর পূজা, কবর পূজা, মনসা পূজা, শীতলা পূজা ইত্যাদি ধরনের অনৈসলামিক কার্য গোটা বাংলার মুসলমান সমাজকে আচ্ছন্ন করেছিল । তাছাড়াও ব্রিটিশ সরকারের শাসন ও শোষণ নীতি বাঙালি মুসলমান সমাজকে আচ্ছন্ন করেছিল। তাছাড়াও ব্রিটিশ সরকারের শাসন ও শোষণ নীতি বাঙালি মুসলমানদের জীবনব্যবস্থাকে করে তুলেছিল দুর্বিষহ। হাজি শরীয়তুল্লাহ সমাজ জীবনের এসব দিকগুলো বাস্তবতার নিরিখে অবলোকন করে বাঙালি মুসলমান সমাজের জীবন থেকে এ এসব দূরীভূত করার জন্য আন্দোলনের ডাক দেন প্রতিরোধ আন্দোলনের। ইতিহাসে এ আন্দোলনই ‘ফরায়েজি আন্দোলন' নামে পরিচিত।
ক. অবিভক্ত বাংলায় ধর্মীয় সংস্কারে গৃহীত কর্মসূচি : হাজি শরীয়তুল্লাহর ধর্মীয় সংস্কারে গৃহীত কার্যক্রমসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো :
প্রথমত, সর্বপ্রথম হাজি শরীয়তুল্লাহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ প্রচার করেন। এতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সাড়া দেয় ।
দ্বিতীয়ত, ‘পীর’ ও ‘মুরিদ' শব্দগুলো প্রভু ও ভৃত্য সম্পর্ক নির্দেশ করে বিধায় তিনি উস্তাদ ও সাগরেদ শব্দ ব্যবহার করেন। এ শব্দ দুটি তার অনুগামীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে ।
তৃতীয়ত, তৎকালীন মুসলিম সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন অনৈসলামিক রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠানকে ‘শিরক' ও ‘বেদাত' বলে দু'ভাগে বিভক্ত করেন। শিবপূজা, কবর পূজা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা দেওয়া ইত্যাদি প্রচলিত রীতিকে তিনি শিরক বা পাপ বলে ঘোষণা করেন। আবার, গাজী কালুর প্রশস্তি গাওয়া, খাজা খিজিরের দোহাই দেওয়া, জন্মের সময় ছুটি পালন করা, মহরমে শোক করা ইত্যাদিকে তিনি বেদাত বা ইসলামের পরিপন্থি বলে ঘোষণা করেন। হাজি শরীয়তুল্লাহ এ সকল অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিহার করে ইসলাম ধর্মের আবশ্যকীয় বিষয়সমূহ পালন করার জন্য মুসলমানদেরকে আহ্বান জানান। মুসলমানের এসব উপদেশ গ্রহণ করে প্রকৃত ইসলামের পথে ধাবিত হন ।
চতুর্থত, ধর্মীয় কর্তব্যের পাশাপাশি পার্থিব কর্তব্যগুলো সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি হাজি শরীয়তুল্লাহ দৃষ্ট আকর্ষণ করেন। তিনি শ্রমলব্ধ উপার্জনকে হালাল রুজি হিসেবে অতি উচ্চ স্থান প্রদান করেন। হাজি শরীয়তুল্লাহর ধর্মপ্রচারে কোনো রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছিল না। মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে তিনি শান্তিপূর্ণ সংস্কার ও প্রচার কাজ করেন। ঐতিহাসিক জেমস্ ওয়াইজ বলেন যে, ইসলামের পুনর্জাগরণ ও মুসলমানদের নৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে হাজি শরীয়তুল্লাহ বিরাট সফলতা লাভ করেন। তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে কিংবদন্তিতে পরিণত হন ।
ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা : ফরায়েজি আন্দোলনে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবও লক্ষ করা যায়। শরীয়তুল্লাহর মতে ইংরেজ শাসনাধীনে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে তারা এক দার উল হারব (বিধর্মী রাজ্য) দেশে বসবাস করছে যেখানে মুসলমানরা সত্যিকার ইসলামী জীবনযাপন করতে পারছে না। হানাফি মাজহাব এর অনুসরণ করে তিনি তাই জুমার পরিবর্তে জোহরের নামাজ আদায় করতে এবং দুই ঈদের নামাজ পড়া নিষিদ্ধ বলে ফতোয়া দেন। এটি ছিল প্রকারান্তরে ইংরেজ সরকারের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ এবং মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের বিতাড়িত করে বৈধভাবে জুমার নামাজ কায়েম করার জন্য তৎপর আহ্বান জানান। এভাবে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন ও গড়ে তোলেন ।
কারণ এদেশে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে, বন্দরে ইসলামি প্রশাসন কায়েম নেই এবং ইসলামি প্রশাসকের উপস্থিতি জুমার নামাজের প্রথম ও প্রধান শর্ত। সুতরাং এদেশে ইসলামি প্রশাসন কায়েম করার সাপেক্ষে তিনি জনগণকে জুমার নামাজ এবং একই কারণে দুই ঈদের নামাজ পড়া নিষিদ্ধ বলে ফতোয়া দেন। তিনি জনগণকে জুমার বদলে জোহরের নামাজ আদায় করতে উপদেশ দেন। এটি ছিল প্রকারান্তরে ইংরেজ সরকারের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ এবং মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের বিতাড়িত করে বৈধভাবে জুমার নামাজ কায়েম করার জন্য তৎপর হবার আহ্বান। ফরায়েজি মতবাদের সাথে সাবেকি মতবাদের বিরোধ দেখা দেয়। তায়াইয়ুনি মতবাদের অন্যতম প্রচারক মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরি এর বিরোধিতা করেন এবং একে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করতে থাকেন। মুসলমানদের একটি অংশ ব্রিটিশ শাসনের পক্ষালম্বন করে। এই অংশের নেতা মাওলানা জৌনপুরি ইংরেজ শাসনাধীন ভারতকে ‘দারুল হরব' (বিধর্মীর রাজ্য)-এর পরিবর্তে ‘দারুল আমন' (নিরাপত্তা দেশ) বলে অভিমত ব্যক্ত করেন এবং ইংরেজদের সাথে সম্ভাব বজায় রাখার পরামর্শ দেন। স্থানীয় জমিদারগণও ফরায়েজি আন্দোলনের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। জেমস ওয়াইজ লিখেছেন, “হিন্দু জমিদারগণ ফরায়েজি আন্দোলনের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। জেমস ওয়াইজ লিখেছেন, “হিন্দু জমিদারগণ ফরায়েজি আন্দোলনের বিস্তৃতিতে ভয় পেয়ে যান, কারণ এ সংস্কার আন্দোলন মুসলমান প্রজাদিগকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল।” মুসলমান প্রজাদের এ একতা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় ৷
বাংলার জমিদারেরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বদৌলতে যে বিপুল ক্ষমতা লাভ করেছিল তার সুযোগে তারা প্রজাদের উপর বিভিন্ন অন্যায় কর ধার্য করতো। দুর্গাপূজা, কালীপূজা প্রভৃতি হিন্দু উৎসব উপলক্ষেও মুসলমানদেরকে কর দিতে বাধ্য করা হতো এবং কোনো কোনো জমিদার ঈদ উপলক্ষ্যে মুসলমানদেরকে গরু কুরবানি করতে নিষেধ করেছিলেন। যোগেশ চন্দ্র বাগল-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, “মুলমানগণকে দাড়ি রাখার জন্য আড়াই টাকা হারে কর দিতে হতো।” হাজি শরীয়তুল্লাহ প্রজাদিগকে উপদেশ দেন যাতে তারা জমিদারকে কোনো অবৈধ কর না দেয় এবং ঈদ প্রভৃতি উৎসবে গরু কুরবানি করতে উৎসাহিত করেন। হাজি শরীয়তুল্লাহর ধর্মপ্রচারের কোনো রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছিল না তাঁর আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুলমানদেরকে ধর্মনিষ্ঠ করে তোলা, নৈতিকবলে বলীয়ান করা, তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করা এবং অত্যাচারী হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের জুলুম থেকে মুসলমানদের
• স্বার্থরক্ষা করা। তিনি শান্তিপ্রিয় সংস্কারক ও প্রচারক ছিলেন। কিন্তু হিন্দু জমিদার ও এক শ্রেণির গোড়াপন্থি স্বার্থপর মুসলমান তাঁর সংস্কার আন্দোলন সহজভাবে গ্রহণ - করেনি। হিন্দু জমিদাররা শরীয়তুল্লাহর সমর্থকদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন চালান ।
ব্রিটিশদের অনুগত জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধাচরণ : শক্তিশালী ফরায়েজি আন্দোলন মূলত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও তার আর্থসামাজিক আন্দোলনেও পরিণত হয়। এ আন্দোলনে ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থকেই সমর্থন করা হয়। “...কৃষিভিত্তিক সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মানুষ এর সাথে জড়িত ছিল এবং এতে অর্থনৈতিক ও কৃষিগত প্রশ্নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।” প্রকৃতপক্ষে মুসলমান কৃষকেরা জমিদার ও নীলকরদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হতো। যোগেশ চন্দ্র বাগল বলেন, “মুসলমানদের উপর জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার অত্যন্ত দুর্বিষহ ছিল।” (যোগেশচন্দ্র বাগল, বিদ্রোহ ও বৈরিতা) হাজি শরীয়তুল্লাহ তার অনুসারীদের ঈদ উৎসবে গরু কুরবানি করতে উৎসাহিত করে জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ।
শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী গঠন : ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে হাজি শরীয়তুল্লাহ যখন ঢাকা জেলার নয়াবাড়িতে তাঁর দলীয় প্রচার কার্য চালাচ্ছিলেন, তখন হিন্দু জমিদারদের সাথে তার বিরোধ হয়। এ সময় সংস্কার বিরোধী, কিছু সংখ্যক মুসলমানও তাঁর বিরোধিতা করে। অত্যাচারী জমিদারদের হাত থেকে তার অনুসারীদের রক্ষা করার জন্য তিনি একটি শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তাঁর শিষ্য জালাল উদ্দিন মোল্লার উপর এ কাজের দায়িত্ব দেন। এতে স্বার্থবাদীরা তাঁর উপর আরও ক্ষিপ্ত হয় এবং নানাভাবে হয়রানি করতে চেষ্টা করে। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তার উপর পুলিশি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এরপর তিনি জমিদারদের সাথে সংঘর্ষ পরিহার করে চলেন। ইতোমধ্যে ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়। কারণ ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দ ৫৯ বছর হাজি শরীয়তুল্লাহ তাঁর নিজ গ্রাম শ্যামায়েলে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আবাসস্থলের পেছনেই তাঁর কবর দেওয়া হয়, কিন্তু কবরটি পরবর্তীকালে আড়িয়াল খাঁ (পদ্মা) নদীর ভাঙ্গনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঢাকার এশিয়াটিক সোসাইটি ভবনে বর্তমানে শুধু তাঁর কবরের নামফলকটি রক্ষিত আছে। তাঁর অনুসারীরা তাঁর নিষ্কলঙ্ক পবিত্র জীবনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মৃত্যুকালে তিনি এমন এক ধর্মীয় অনুসারী দল এবং শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী রেখে যান যা পরবর্তী এক শতাব্দীকাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চলে প্রবল প্রতাপে তাদের প্রভাব বিস্তার করে এবং নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]