আরনল্ড টয়েনবির 'A Study of History' গ্রন্থের বিভিন্ন দিক আলোচনা কর ।

ভূমিকা : আরনল্ড টয়েনবির ইতিহাস গবেষণার কেন্দ্রীয় বিষয় হলো মানব সভ্যতা। তিনি কোনো দেশকে ভিত্তি করে ইতিহাস রচনা না করে শুধু বিশ্বের কতিপয় সভ্যতাকে ভিত্তি ধরে ইতিহাস রচনার সূচনা করেন। তিনি সভ্যতার উদ্ভবের অনেকগুলো কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন এবং কী কারণে সভ্যতার পতন ঘটে তার একটি সর্বজনীন নিয়ম আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহে ইতিহাস সম্পর্কে বহুমুখী দিকের পরিচয় পাওয়া যায়। তার রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো A Study of History |
* আরনল্ড টয়েনবির 'A study of History' গ্রন্থের বিভিন্ন দিক : নিম্নে এ গ্রন্থের বিভিন্ন দিক আলোকপাত করা হলো : ক. আরনল্ড টয়েনবির 'A Study of History' গ্রন্থের বিষয়বস্তু : আরনল্ড টয়েনবির কালজয়ী গ্রন্থসমূহের মধ্যে 'A Study of History' অন্যতম। ১২ খণ্ডে প্রকাশিত এ গ্রন্থের সব খণ্ডই ইতিহাস চর্চার নবতর পদ্ধতি উদ্ভাবনের সমন্বয়ে রচিত একটি মৌলিক গ্রন্থ। A Study of History গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ইতিহাসের পরিধি ও বিষয়বস্তু নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেন। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে ইতিহাসের পরিধির বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব তুলে ধরেন। বইটির প্রথম তিন অধ্যায়ে তার গবেষণা ও কর্মপরিধি, উদ্দেশ্য এবং গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। টয়েনবি 'A Study of History' নামক গ্রন্থে তার বিখ্যাত The Challenge and Response Theoryটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। চিন্তাশীলতা ও যথার্থ প্রায়োগিক দক্ষতায় রচিত এ গ্রন্থ থেকে সভ্যতার সূচনা, ক্রমবিকাশ, চরমোৎকর্ষ, অবনতি, পতন ও বিলুপ্ত সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ গ্রন্থে হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, সভ্যতার উদ্ভবের জন্য কোনো বংশ, জাতি এবং ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশ খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণভাবে বিবেচ্য নয় । তিনি সভ্যতার উদ্ভবের জন্য নির্দিষ্ট দুটি পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা দৃঢ়তার সাথে তুলে করেন । যথা :
১. সমাজে সৃজনশীল মানসিকতা ও অত্যুৎকৃষ্ট কর্ম তৎপরতায় উদ্দীপ্ত কিছু ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ও এমন একটি সমাজ যে সমাজ সৃজনশীলতা বিকাশে সার্বিক পরিবেশ জীবনযাত্রা নির্বাহ ও সভ্যতা বিকাশের অতিরিক্ত সহায়ক বা মোটেই বৈরী নয় ।
'A Study of History' গ্রন্থে টয়েনবি জোরালো বক্তব্য পেশ করেন যে, যখন কোনো সমাজ ও মানবগোষ্ঠীর মধ্যে উপযুক্ত দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় তখন তাদের মধ্যে সভ্যতার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ ঘটে ।
এভাবে সভ্যতার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ তত্ত্বের জন্য আরনল্ড যোসেফ টয়েনবি এবং তার বই 'A Study of History' বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সভ্যতার হুমকি ও মোকাবিলা ছাড়াও টয়েনবি এ গ্রন্থে ইতিহাস রচনায় নিয়োজিতদের জন্য কতিপয় পরমার্শ ও গ্রন্থটিতে সংযোজন করেন।
খ. 'A Study of History' গ্রন্থে টয়েনবির পরামর্শসমূহ : টয়েনবির ইতিহাস গ্রন্থমূহের মধ্যে 'A Study of History' গ্রন্থটি অত্যন্ত বিখ্যাত । তিনি এ গ্রন্থে সভ্যতার উৎপত্তি ও বিকাশ তত্ত্বের সাথে সাথে ইতিহাস রচনার কতকগুলো পরামর্শও সংযোজন করেন । এগুলো হলো : ১. সংকীর্ণ জাতীয় ও গোষ্ঠী স্বার্থ পরিহার করে ঐতিহাসিকরা নিজেদের বৃহত্তর মানবজাতির একটি অংশ হিসেবে দেখবেন । ২. ইতিহাসকে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না বিবেচনা করে সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনা করা উত্তম। কেননা
রাষ্ট্রের উত্থানপতন হয়। কিন্তু সে স্থলে মনবসমাজ অনড়। গ্রেট ব্রিটেন কিংবা এথেন্সের ইতিহাস রাষ্ট্র হিসেবে লেখা যেতে পারে । তবে এদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো এরা বৃহত্তর মানবসমাজের একটি অংশ ।
৩. কোনো সমাজই সমস্ত মানবজাতি নয় এবং মানুষ নিজেকে সেরকম ভেবে বিচ্ছিন্ন থাকতে গেলে তার বিনাশ অনিবার্য । ৪. একটি দেশের ইতিহাসের কোনো এক অধ্যায়ের সাথে অন্য অধ্যায়ের যত মিল লক্ষ করা যায় ভিন্ন দেশের ঐ অধ্যায়ের মধ্যে তার তত মিল লক্ষ করা যায় না ।
যদিও ঐতিহাসিকগণ হেলেনিক ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে মানগত ব্যবধান সত্ত্বেও কিছু মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন । বস্তুনিষ্ঠ ও দিক নির্দেশ করতে সক্ষম এরূপ ইতিহাস রচনার পথে অসংখ্য অন্তরায় বিদ্যমান। আরনল্ড টয়েনবি এগুলোকে একটি সাধারণ সূত্রের মধ্যে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এ যুগের মানবসমাজগুলোর সমষ্টিগত উপলব্ধি মোটামুটি এমন যে, তার বৃহত্তর বিশ্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে পরিগণিত অথচ যে যুগের আজ বিনাশ হয়ে গেছে সে যুগে প্রত্যেক সমাজের সমষ্টিগত স্পৃহা অবশ্যই ছিল, অদূর ভবিষ্যতে নিজেরাই একটি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড হয়ে উঠবে ।
গ. টয়েনবির ইতিহাস চর্চায় দুর্বলতাসমূহ : বর্তমানের ইতিহাস রচনাসমূহের মধ্যে টয়েনবির রচনাসমূহকে সবচেয়ে উপযুক্ত ও সাক্ষ্য প্রমাণনির্ভর মনে করা হলেও তাতে বেশ কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে। এগুলো হলো— ১. সাধারণ দুর্বলতা ও ২. মৌলিক দুর্বলতা। নিম্নে এদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. সাধারণ দুর্বলতা : টয়েনবির ইতিহাস চর্চার সাধারণ দুর্বলতা হলো তার রচিত A Study of History গ্রন্থটি বিশালাকার । তাছাড়া পুরাণ, কবিতা প্রভৃতি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তার A Study of History এর কলেবর বৃদ্ধি করা হয়েছে যা অনাবশ্যক ছিল বলে বর্তমানে অনেক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেন । তিনি সর্বমোট ২৬টি সভ্যতার কথা উল্লেখ করলেও সবগুলো সভ্যতা সম্পর্কে তার জ্ঞানের গভীরতা যথাযথ ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়। শুধু হেলেনিক সভ্যতা সম্পর্কে তার পর্যাপ্ত জ্ঞান ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ নিশ্চিত করেন। টয়েনবি সভ্যতাকে ইতিহাস চর্চার প্রকৃত বিষয় বলেই উল্লেখ করেন । প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস একটি অতি ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী বিষয়। তার মধ্যে সভ্যতা ছাড়াও সকল বর্বর ও সভ্যতার পূর্ববর্তী যুগের বিষয়সমূহও অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং আছে। সমাজের বিভিন্ন কলাকৌশলকে তিনি সভ্যতা বিকাশের সহায়ক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি ছিলেন না। অথচ কলাকৌশল সভ্যতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেগুলোকে অনেক ঐতিহাসিক টয়েনবির ইতিহাস চর্চার সাধারণ দুর্বলতা বলে মনে করেন ।
২. মৌলিক দুর্বলতা : সভ্যতার উৎপত্তি ও বিকাশের সাথে সংশ্লিষ্ট তত্ত্বে টয়েনবির দুর্বলতাগুলোকে মৌলিক দুর্বলতা বলে অভিহিত করা হয়। আরনল্ড টয়েনবি সভ্যতা ধ্বংস, বিচ্ছিন্নতা ও বিলুপ্তি সম্পর্কে যে বাখ্যা দেন তা সবক্ষেত্রে সঠিক নয় বলে বর্তমানের ঐতিহাসিকগণ অভিমত দেন। তাছাড়া ধ্বংসের পূর্বে প্রতিটি সভ্যতারই একটি স্থবিরতা ও গতিহীনতা পর্যায় থাকতে পারে, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। স্থবিরতা ও ক্রমাবনতির স্তর পার না হয়ে একটি সভ্যতা হঠাৎ করে ধ্বংস বা বিলুপ্ত হতে পারে না। এমনকি একটি সভ্যতার সব দিক বা সব কিছুই একেবারে ধ্বংস, বিলুপ্তি বা নিঃশেষ হয়ে যায় না। সাধারণত একটি সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের ওপর যখন অপর কোনো জাতি নতুন সভ্যতা গড়ে তোলে তখন ঐ নতুন জাতির সভ্যতার মধ্যে পুরানো সভ্যতার অনেক বিষয়ের সংমিশ্রণ দেখা যায়। অনেক সময় নবীন জাতির অজান্তেই পূর্বের সভ্যতার বহু বৈশিষ্ট্য নতুন সভ্যতার মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে। সত্যিকার অর্থে এভাবেই একটি বৃহত্তর সভ্যতা নির্মিত হয়ে থাকে। যা টয়েনবির ইতিহাস দর্শনের মৌলিক দুর্বলতা হিসেবেই আজ প্রমাণিত হয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আরনল্ড টয়েনবি ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনতে সক্ষম হন। তিনি ভিন্ন আঙ্গিকে 'A study of History' গ্রন্থে তার হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বটি ব্যবহার করেন। এ কর্মের মাধ্যমে তার সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে আরনল্ড টয়েনবির ইতিহাস চর্চায় কতিপয় দুর্বলতা থাকলেও তার 'A Study of History' নামক বিখ্যাত রচনাকর্ম এবং হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্ব তার দুর্বলতাকে ছাপিয়ে যোগ্যতার স্বাক্ষর বহন করে। → প্রশ্ন ৯.৪২ | ইতিহাস তত্ত্বে টয়েনবির প্রতিকূলতা তত্ত্বটি আলোচনা কর ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]