সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে আরনল্ড টয়েনবির মতবাদ বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকা : প্রখ্যাত ইতিহাস দার্শনিক আরনল্ড যোসেফ টয়েনবি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ২৬টি সভ্যতার ওপর ব্যাপক পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ পরিচালনা করেন। তিনি পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন সভ্যতার উদ্ভব অঙ্কুরেই কেন বিনষ্ট হয়, কীভাবে একটি সভ্যতার বিনাশ হয়, কীভাবে একটি সভ্যতা উন্নতির চরম স্তরে পৌছাতে সমর্থ হয়, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন। সভ্যতার বন্ধাত্য ও হুমকিসমূহের মোকাবিলা নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করেন, যা বহুলভাবে 'The Theory of Challenge and Response' তত্ত্ব নামে পরিচিত ।
● ইতিহাস তত্ত্বে টয়েনবির প্রতিকূলতা তত্ত্ব : নিম্নে ইতিহাস তত্ত্বে টয়েনবির প্রতিকূলতা তত্ত্ব আলোচনা করা হলো : ক. হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্ব পরিচিত : হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্ব অনুসারে কোনো সমাজ ও সভ্যতাকে নানাবিধ সমস্যা মোকাবিলা করে সমাজে টিকে থাকতে হয় এবং উন্নতির লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হয়। সমাজ ও সভ্যতাকে সর্বদা ছোট বড় হুমকির মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে যেতেই স্বীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে হয়। টয়েনবির মতে, হুমকি ও মোকাবিলার মধ্যে অবিরত শক্তির দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। পরিবেশ থেকে আমাদের সমাজ ও সভ্যতার ওপর যেমন বিরামহীনভাবে হুমকি আসতে থাকে, তেমনিভাবে সমাজের সৃজনশীল মানুষের অবদানে সমাজ সে হুমকির মোকাবিলা করে সভ্যতাকে সামনের দিকে এগিয়ে যায় । যেমন একটি হুমকি মোকাবিলা করার পরপরই আবার নতুন একটি হুমকি আসতেই পারে। কখনও বা একই সময়ে একাধিক হুমকিও সমন্বিতভাবে সমাজকে আক্রান্ত করতে পারে। তবে হুমকি বা হুমকিসমূহকে যথাযথভাবে প্রতিহত করার মতো সদুত্তর ও কার্যকরী পদক্ষেপের ব্যবস্থাও তাৎক্ষণিকভাবে সমাজ থেকেই উঠে আসে। এরূপে চলতে থাকে হুমকি ও মোকাবিলার মধ্যে বিরামহীন ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া। আর এ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে সমাজের ক্রমপরিবর্তন ঘটতে থাকে । ফলে সমাজ এক সময় সভ্যতার পর্যায়ে এসে উপনীত হয় ।
খ. হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বের ব্যাখ্যা : নিম্নে এ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হলো :
১. সভ্যতার বিকাশ : টয়েনবির যুক্তি অনুযায়ী সভ্যতা হলো মানবসমাজের একটি প্রজাতির মতো। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছুটা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে টয়েনবি সভ্যতাকে ইতিহাস চর্চার যথাযথ ও বিচার্য বিষয় বলে গণ্য করেন। হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি প্রায় ২৬টি সভ্যতাকে বিচারবিশ্লেষণের আওতায় নিয়ে আসেন। এ ২৬টি সভ্যতার মধ্যে ২১টি সভ্যতা হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বের মোতাবেক অবিরত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়। এই ২১টি সভ্যতার মধ্যে অন্যতম ছিল সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, হিট্টাইট সভ্যতা, সিরীয় সভ্যতা, সিনিক সভ্যতা, ইনডিক সভ্যতা, মায়া সভ্যতা, মিসরীয় সভ্যতা প্রভৃতি । তিনি বলেন, এগুলো হলো প্রকৃত সভ্যতা। এসব সভ্যতার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ ও চরমোৎকর্ষ সাধিত হয়েছে ।
২. স্থবির ও বন্ধ্যা সভ্যতা : টয়েনবি এমন কয়েকটি সভ্যতার কথা বলেন যেগুলো হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বানুসারে বন্ধ্যা হয়ে গেছে। এগুলো হলো :
যাযাবর সভ্যতা, এস্কিমো সভ্যতা, পলিনেশিয়ান সভ্যতা, স্পার্টান সভ্যতা ও ওসমানিয়া সভ্যতা ।
এসব স্থবির ও বন্ধ্যা সভ্যতায় সমাজে সৃজনশীল মানুষ শ্রেণির উপস্থিতি ছিল না। যে কারণে এ ৫টি তথাকথিত সভ্যতা সত্যিকার অর্থে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ও মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে । এগুলো পরিণত সভ্যতার স্তরে উন্নীত হতে পারেনি। ৩. সভ্যতার পতনের কারণ : টয়েনবি তার হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বে সভ্যতার পতনের জন্য নিম্নোক্ত কারণকে দায়ী
করেন । যথা :
i. যখন কোনো সভ্যতার সৃজনশীল মানুষ শ্রেণির উদ্ভাবনী শক্তি পরিবেশগত হুমকির মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় ।
ii. যে সভ্যতার শাসক জনগণ আনুগত্য ও সাহায্যে সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নেয় ও
iii. যে সভ্যতার বাসিন্দাদের মধ্যে সামাজিক সহনশীলতা, সৌহার্দ্রতা এবং ঐক্যবদ্ধতার ব্যাপক ঘাটতি দেখা যায় সে সভ্যতা ক্রমশ অবনতি, পতন ও বিলুপ্তির পথে ধাবিত হয়।
৪. সভ্যতার পতনের পর্যায়সমূহ : একটি সভ্যতা একদিনে পতনের দ্বারপ্রান্তে আসে না। এর জন্য যে পর্যায়গুলো অতিক্রম করতে হয় সেগুলো হলো :
i. অবনতি ও ধ্বংসপ্রাপ্তি : পরিবেশের সাথে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়ায় সভ্যতা ধীরে ধীরে অবনতির দিকে ধাবিত হয়। কোনো সভ্যতার অবনতির বিষয়টি একটি সুদীর্ঘকালীন ঘটনা। কারণ কোনো একটি সভ্যতার ক্রমাবনতির শেষ ধাপ হলো ধ্বংস । তাহলে বলা যায়, প্রথমে কোনো একটি সভ্যতা অবনতির দিকে ধাবিত হয় এবং পরে তা ধ্বংস সাধিত হয় । ii. বিচ্ছিন্নতা : ক্রমাবনতির পর সভ্যতা অন্যান্য সভ্যতা ও সৃজনশীল মানব গোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। তখন কোন সভ্যতা পরিবেশের হুমকি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হতে থাকে । পরিবেশগত হুমকির ধরন এবং উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির অনুপস্থিতির ওপর বিচ্ছিন্নতার সময়কাল নির্ভর করে। পরিবেশগত হুমকি যত দৃঢ় ও অপ্রতিরুদ্ধ হবে এবং উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির উপস্থিতি যত কাম্য হবে সভ্যতার বিচ্ছিন্নতাও তত বেশি কম সময়ে ঘটবে ।
iii. বিলুপ্তি : ধ্বংস ও বিচ্ছিন্নতার পর সভ্যতার বিলুপ্তিকালের সূচনা হয়। স্মরণ রাখা দরকার, যেকোনো একটি সভ্যতা ধ্বংস ও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেই তা বিলুপ্ত হয় না, ধ্বংস ও বিচ্ছিন্নতার পরও বিলুপ্তির আগ মুহূর্ত একটি সভ্যতার অনেক নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে। মুমূর্ষু অবস্থা ও মৃত্যু এবং সাধারণ একজন মানুষের মৃত্যুপূর্ব— এ তিনটি পর্যায়ের মধ্যে যেমন বিস্তর পার্থক্য রয়েছে তেমনিভাবে ধ্বংস, বিচ্ছিন্নতা ও বিলুপ্তির মধ্যেও বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। এ তিনটি পর্যায়ের মধ্যে অনেক সময় শত শত বছর, এমনকি হাজার হাজার বছরের ব্যবধানও হতে পারে। বিলুপ্ত সভ্যতাকে প্রস্তরীভূত মৃত জীবন বলে আখ্যায়িত করা যায় ।
সমালোচনা : টয়েনবি হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বে সভ্যতাসমূহকে যে হুমকির মোকাবিলা করে টিকে থাকার কথা উল্লেখ করেন তা সর্বক্ষেত্রে সঠিক নয় । উল্লেখ্য, টয়েনবির এ তত্ত্বটি প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী সরোকিন ও ইবনে খালদুনের সমাজ ও পরিবর্তনের ‘চক্রাকার তত্ত্বের' সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে। সভ্যতার জন্য উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন সৃজনশীল ব্যক্তির অত্যাবশ্যক কথা রয়েছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন । যথার্থ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তার এ মতাদর্শটি মোটামুটি বাস্তব । টয়েনবির হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বটি যে সর্বাংশে সত্য বা সব পণ্ডিত মহলে গ্রহণযোগ্য তা এককথায় বলা যাবে না। অধিকাংশ পণ্ডিত বলেন, টয়েনবি এ তত্ত্বে বাস্তবতার চেয়ে দার্শনিক ভিত্তিকেই অধিক গুরুত্ব দেন। তিনি যে ২৬টি সভ্যতার কথা তুলে ধরেন তার ঐসব সভ্যতা সম্পর্কেই গভীর জ্ঞান ছিল না। তাছাড়া টয়েনবি সভ্যতাকে ইতিহাস চর্চার মূল একক বলে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস একটি অতিব্যাপক ও সুদূরপ্রসারিত বিষয় হিসেবে বিবেচিত। এর মধ্যে সভ্যতা ছাড়া বর্বর ও সভ্যতার পূর্ববর্তী যুগের বিষয়সমূহও ঘনিষ্ঠভাবে অন্তর্ভুক্ত। টয়েনবি সভ্যতার ধ্বংস, বিচ্ছিন্নতা ও বিলুপ্তি সম্পর্কে যে অভিমত ব্যক্ত করেন তাও সর্বাংশে সত্য নয় বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন। কারণ ক্রমাবনতি ধ্বংস, বিচ্ছিন্নতা ও বিলুপ্তিকে প্রকৃতপক্ষে আলাদা আলাদা করে আলোচনা করা কাম্য নয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আরনল্ড টয়েনবি সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ, হুমকি ও মোকাবিলার যে তত্ত্বসমূহ প্রদান করেন তা আসলেই যুগান্তকারী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে টয়েনবির সীমাবদ্ধতা থাকলেও সমকালীন সময়ে তার মতো যুক্তিগ্রাহ্য সভ্যতার ব্যাখ্যা অপর কোনো ইতিহাস দার্শনিক দিতে পারেননি। এজন্য টয়েনবির হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয় ।
আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বে আরনল্ড টয়েনবির অবদান মূল্যায়ন কর
উত্তর ভূমিকা : যে কয়েকজন ঐতিহাসিক সমসাময়িক কালে ইতিহাস দর্শনের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন তাদের মধ্যে বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক ও সমাজতান্ত্রিক আরনল্ড টয়েনবি ছিলেন অন্যতম। তার ইতিহাস দর্শনের মূলতত্ত্ব হলো ইতিহাসের কোনো ধারাবাহিক গতি নেই। ইতিহাস হলো কতক সভ্যতার বৃত্তের সমষ্টি। সভ্যতার উত্থান ও বিকাশে তিনি প্রতিকূলতা ও মোকাবিলা তত্ত্ব প্রদান ও বহুবিধ গ্রন্থ রচনা করে ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ।
* আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বে টয়েনবির অবদান : নিম্নে আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বে আরনল্ড টয়েনবির অবদান মূল্যায় করা হলো : ১. ইতিহাস চর্চার নিবেদিতপ্রাণ : ব্যালিওল কলেজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের পর আরনল্ড টয়েনবি ১৯১২ সালে অক্সফোর্ডে টিউটর হিসেবে নিযুক্ত হন। টয়েনবি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে A Fellow of Ancient History হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। দার্শনিক টয়েনবি ১৯১৫ সালে বিখ্যাত লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন । লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি গ্রিক ভাষা ও সাহিত্য বিষয়েও শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন । এরপর টয়েনবি ১৯২০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক ইতিহাসের একজন গবেষক ও অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। একই সময়ে তিনি Royal Institute of International Affairs এর পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। ২. বিখ্যাত লেখক হিসেবে অবদান : আধুনিক যুগের ইতিহাস দার্শনিকদের মধ্যে টয়েনবির রচনাসমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তার রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে বিখ্যাত হলো 'A study of History'. এছাড়াও তিনি Civilization and Charter, Greek Historical Thought, Civilization on Trial, East to West, The History of Civilization, A Journey Round the World প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তার গ্রন্থগুলো পর্যালোচনায় যে বিষয়গুলো নজরে আসে তা হলো ইতিহাস ও ঐতিহাসিক বিষয় এবং সভ্যতা ও তত্ত্বমূলক বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং তাত্ত্বিক ও ইতিহাস দার্শনিকবোধের স্পষ্ট প্রতিফলন লক্ষ করা যায় ।
৩. সভ্যতা সম্পর্কে টয়েনবির ইতিহাস দর্শন : নিম্নে সভ্যতা সম্পর্কে টয়েনবির ইতিহাস দর্শনের বিশিষ্ট দিকসমূহ উল্লেখ করা হলো : ক. সভ্যতা : টয়েনবি সভ্যতা সম্পর্কে বলেন, ইতিহাস গবেষণার বোধগম্য একক হলো সভ্যতা। গতানুগতিক জাতীয়, নগররাষ্ট্র বা অন্য কোনো রাজনৈতিক সম্প্রদায় নয়। ধর্মীয়, আঞ্চলিক ও কিছুটা রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে তিনি সভ্যতাকে ইতিহাস চর্চার প্রকৃত বিষয় বলে গ্রহণ করেন এবং এ সূত্রে সভ্যতাকে সমাজের এক প্রজাতি হিসেবে ধরা হয়। টয়েনবি বলেন, সভ্যতা গড়ে ওঠার সময় যেমন তাকে পরিবেশের সাথে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও মোকাবিলা করতে হয়; তেমনিভাবে পতনের সময়ও কোনো একটি সভ্যতা পরিবেশের কাছে একেবারে অসহায় ও নিরুপায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে না। সভ্যতার অনিবার্য পর্যায়েও এটি পরিবেশের সাথে প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখতে চেষ্টা করে থাকে । প্রকৃতপক্ষে যে কারণে কোনো সভ্যতার একটি বা কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিধ্বস্ত হলেও ঐ সভ্যতার অনেক বৈশিষ্ট্যই কোনো না কোনোভাবে সমাজে বহু বিদ্যমান থাকে ।
খ. হুমকি ও মোকাবিলা : সভ্যতার জন্ম ও কৌশল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে টয়েনবি হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বের অবতারণা করেন ৷ এ তত্ত্ব মতে, সভ্যতার হুমকি ও মোকাবিলার মধ্যে অবিরাম ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। এমতাবস্থায় সমাজ সর্বদা পরিবেশ, থেকে হুমকি বা বিপদের মুখোমুখি হয়। সমাজ তার উদ্ভাবনক্ষম মনুষ্য শ্রেণির সহায়তায় সফলভাবে হুমকির মোকাবিলা করে এবং বিপদ কেটে যায়। সময়ের পরিবর্তনে আবার নতুন হুমকিও আসে এবং তার বিপরীতে সফল উত্তর আসতেও ততটা বিলম্ব হয় না। এভাবে সমাজের হুমকি মোকাবিলার অবিরাম প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এরূপ আবর্তন ও বিবর্তনে ঘুরপাক খেয়ে শেষ পর্যন্ত সমাজ সভ্যতার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়। এরূপ তিনি ২১টি সভ্যতাকে হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করেন । তিনি দেখান যে, তার দেখানো হুমকি ও মোকাবিলা প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েই এই ২১টি সভ্যতা বিকশিত হয়েছে ।
গ. বিকাশ তত্ত্ব : ইতিহাস দার্শনিক টয়েনবি তার হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বে সভ্যতাকে ইতিহাস গবেষণা ও উপলব্ধি অতি গুরুত্বপূর্ণ একক বলে আখ্যায়িত করেন। তার যুক্তি অনুযায়ী সভ্যতা হলো মানবসমাজের এক প্রজাতি বিশেষ। তিনি তার হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্বে ২৬টি সভ্যতা নিয়ে বিচারবিশ্লেষণ করেন যার মধ্যে ২১টিকে তিনি অবিরত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিকশিত হওয়ার কথা বলেন। তার গবেষণাকৃত সভ্যতাসমূহের মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতা, হিট্টাইট সভ্যতা, আরব সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, হেলেনিক সভ্যতা, মিসরীয় সভ্যতা প্রভৃতি হলো প্রকৃত সভ্যতা। এসব সভ্যতার উদ্ভব, ক্রমবিকাশ ও চরমোৎকর্ষতা সাধিত হয়েছে।
ঘ. অবনতি ও ধ্বংস : ধ্বংসের ফলে নতুনের গড়ে ওঠার পথ প্রশস্ত হয়। টয়েনবির মতে, পরিবেশের সাথে মোকাবিলা করে টিকে থাকতে ব্যর্থ হওয়ায় সভ্যতা ক্রমশ অবনতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সভ্যতার অবনতির বিষয়টিও দীর্ঘকালীন ব্যাপার। কারণ কোনো একটি সভ্যতার ক্রমাবনতির শেষ ধাপ হলো উক্ত সভ্যতার ধ্বংসপ্রাপ্তি। সুতরাং বলা যায়, প্রথমে কোনো একটি সভ্যতা অবনতির দিকে এগিয়ে যায় এবং তারপর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ।
পক্ষান্তরে, নিম্নোক্ত সভ্যতাগুলো তিনি স্থবির ও বন্ধ্যা সভ্যতা বলে গণ্য করেন। যেমন-
i. যাযাবর,
ii. এক্সিমো ও
iii. পলিনেশিয়ান স্পার্টান ও ওসমানিয়া ।
প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও দুর্গম পথ অতিক্রম করে সামাজিক রীতিনীতি এবং ক্রিয়াকর্ম অগ্রসর হতে থাকে। দীর্ঘ ধারাবাহিক পথ ও সময় অতিক্রমের মাধ্যমেই তা ধীরে ধীরে সভ্যতার স্তরে উপনীত হয় । টয়েনবির মতে, যে সভ্যতা বিকাশ লাভ করে তা অবশ্যই সুসংহত ও অভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ঘটে থাকে। তদুপরি যে সমাজের সভ্যতা বিকাশ লাভ করে সে সমাজের সৃজনশীল সংখ্যালঘু শ্রেণিকে সংখ্যাগুরু শ্রেণিকে সর্বদাই অনুসরণ করে থাকে । অন্যদিকে, হুমকি ও মোকাবিলা তত্ত্ব অনুসারে টয়েনবি সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও চরমোৎকর্ষের পাশাপাশি এর অবনতি, পতন ও বিলুপ্তি সম্পর্কেও যথাযথ কিছু অভিমত প্রদান করেন। সাধারণত কোনো সভ্যতার পতনের জন্য প্রাকৃতিক কারণ, শাসকদের দুর্বলতা, সামরিক বাহিনীর শক্তি হ্রাস, অর্থনৈতিক সংকট, বহিরাক্রমণ প্রভৃতি বিষয়কে দায়ী করা হয়। কিন্তু টয়েনবি সভ্যতার পতনের জন্য নিম্নোক্ত কারণকে দায়ী করেন—
১. পরিবেশগত হুমকি মোকাবিলা করার ব্যর্থতা
২. দেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যকার সাহায্য সহযোগিতার অভাব । ৩. সামাজিক সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও ঐক্যবদ্ধতার মধ্যে ঘাটতি ।
এসব করণেই কোনো সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটে বলে টয়েনবি মত প্রকাশ করেন ।
৪. ইতিহাস রচনায় পরামর্শ প্রদান : টয়েনবির ইতিহাস গ্রন্থমূহের মধ্যে 'A Study of History' গ্রন্থটি অত্যন্ত বিখ্যাত। তিনি এ গ্রন্থে সভ্যতার উৎপত্তি ও বিকাশ তত্ত্বের সাথে সাথে ইতিহাস রচনার কতকগুলো পরামর্শও সংযোজন করেন । এগুলো হলো : i. সংকীর্ণ জাতীয় ও গোষ্ঠী স্বার্থ পরিহার করে ঐতিহাসিকরা নিজেদের বৃহত্তর মানবজাতির একটি অংশ হিসেবে দেখবেন ii. ইতিহাসকে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না বিবেচনা করে সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনা করা উত্তম। কেননা রাষ্ট্রের উত্থানপতন হয়। কিন্তু সে স্থলে মানবসমাজ অনড়। গ্রেট ব্রিটেন কিংবা এথেন্সের ইতিহাস রাষ্ট্র হিসেবে লেখা যেতে পারে । তবে এদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো এরা বৃহত্তর মানবসমাজের একটি অংশ ।
iii. কোনো সমাজই সমস্ত মানবজাতি নয় এবং মানুষ নিজেকে সেরকম ভেবে বিচ্ছিন্ন থাকতে গেলে তার বিনাশ অনিবার্য । iv. একটি দেশের ইতিহাসের কোনো এক অধ্যায়ের সাথে অন্য অধ্যায়ের যত মিল লক্ষ করা যায়, ভিন্ন দেশের ঐ
অধ্যায়ের মধ্যে তার তত মিল লক্ষ করা যায় না।
যদিও ঐতিহাসিকগণ হেলেনিক ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে মানগত ব্যবধান সত্ত্বেও কিছু মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন । বস্তুনিষ্ঠ ও দিক নির্দেশ করতে সক্ষম এরূপ ইতিহাস রচনার পথে অসংখ্য অন্তরায় বিদ্যমান। আরনল্ড টয়েনবি এগুলোকে একটি সাধারণ সূত্রের মধ্যে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এ যুগের মানবসমাজগুলোর সমষ্টিগত উপলব্ধি মোটামুটি এমন যে তার বৃহত্তর বিশ্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে পরিগণিত অথচ যে যুগের আজ বিনাশ হয়ে গেছে সে যুগে প্রত্যেক সমাজের সমষ্টিগত স্পৃহা অবশ্যই ছিল, অদূর ভবিষ্যতে নিজেরাই একটি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড হয়ে উঠবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক ইতিহাস চর্চায় টয়েনবির অবদান ছিল বহুমুখী। তার সৃজনশীল কর্মের প্রয়াসে ইতিহাসের চর্চায় নানাবিধ পরিবর্তন এসেছে। তার রচিত গ্রন্থ 'A Study of History' ইতিহাস তত্ত্বে আরও সমৃদ্ধি এনেছে। আর তাই আধুনিক ইতিহাস চর্চায় টয়েনবির অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। প্রকৃত অর্থে টয়েনবি ইতিহাস তত্ত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]