প্রতিরোধ আন্দোলনের সংজ্ঞা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং নিম্নবর্গ

Definition and Characteristics of Resistance Movement and Subalterns
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়েই প্রতিরোধ আন্দোলনের সংজ্ঞা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং নিম্নবর্গ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ১৭৫৭ খ্রি. পলাশীর যুদ্ধের পরপরই ব্রিটিশ কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার জনসাধারণ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলে। লুপ্ত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় অরাজন্য (Non-princely) রাজনৈতিক, জমিদার, ধর্মীয় গোষ্ঠী, এথনিক, খাসি, চাকমা, সাঁওতাল ও কৃষক প্রতিরোধ ১৯৪৭ খ্রি. স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকে। এমনকি স্বাধীনতার পরও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামলে নাচোলের কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন (১৯৪৭) গড়ে ওঠে। এসব প্রতিরোধ আন্দোলনে নিম্নবর্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
প্রতিরোধ আন্দোলনের সংজ্ঞা
প্রতিরোধ আন্দোলনের ও নিম্নবর্গের ইতিহাস আলোচনার পূর্বে আমাদের প্রতিরোধ আন্দোলন সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। প্রতিরোধ এর ইংরেজি শব্দ Resistance. ইংরেজি Resistance- এর বাংলা অর্থ হলো প্রতিরোধ ক্ষমতা, প্রতিরোধ, বিরোধিতা ইত্যাদি। Resistance Movement এর বাংলা শব্দ হলো প্রতিরোধ আন্দোলন, ১৭৫৭ খ্রি. থেকে ১৯৪৭ খ্রি. পর্যন্ত কোম্পানি ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষক প্রজা সাধারণ যে আন্দোলন গড়ে তোলে তাকে প্রতিরোধ আন্দোলন বলে। এসব প্রতিরোধকে কেন্দ্র করেই প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাস রচিত হয়েছে ।

প্রতিরোধ আন্দোলনের সংজ্ঞা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং নিম্নবর্গ
অষ্টাদশ, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে প্রতিরোধ আন্দোলন
অষ্টাদশ, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ঔপনিবেশক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো গড়ে ওঠে। মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের পত্তন এবং মধ্য বিংশতিতম শতাব্দী পর্যন্ত এর স্থায়িত্ব বাংলায় সুদীর্ঘ বিদেশি শাসনের ইতিহাসে আরেকটি অধ্যায় যুক্ত করে, যা ছিল যথেষ্ট বৈচিত্র্যময়। এই পর্বে বাংলার জনগোষ্ঠীর কোনো জাতীয় পরিচিতি ছিল না এবং আধুনিক জাতীয়তাবাদের অনুরূপ চেতনাও তাদের মধ্যে গড়ে উঠেনি। তারা তাদের সর্বোচ্চ শাসকের জাতিত্ব ও ধর্মের উপর অতি কম গুরুত্ব আরোপ করতো। তখন একজন বিজেতাকে শান্তিপূর্ণভাবে অথবা বিদ্রোহের মাধ্যমে হটিয়ে আরেক জন দেশের শাসনক্ষমতা দখল করতেন; কিন্তু ক্ষমতার এ পরিবর্তন নিম্নবর্গের জনগণের নিকট ছিল কেবল অবগতির বিষয়, যারা তাদের ঊর্ধ্বতন এলিট শাসক সম্পর্কে কদাচিৎ কোনো আগ্রহ বা উদ্বেগ প্রকাশ করতো। নিজেদের জীবন পরিচালনার জন্য তাদের ছিল তাদেরই গড়ে তোলা জীবনবিধান। এ জীবনবিধানের অন্তর্ভুক্ত ছিল তাদের সামাজিক রীতিনীতি, প্ৰতিষ্ঠান, অভ্যাস, আচরণ, বিশ্বাস ও দর্শন এবং যতদিন তাদের সামাজিক জীবনের এই অপরিহার্য উপাদানগুলোকে অব্যাহতভাবে ক্রিয়াশীল রাখা হতো, ততদিন তারা কোনো অসন্তোষ বা বিরাগ প্রকাশ না করে কর প্রদানে প্রস্তুত থাকত। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে তারা এ বিশ্বাস অর্জন করেছিল যে নতুন শাসক যিনিই হোন এবং তাঁর জাতিত্ব ও ধর্ম যাই হোক না কেন, তাদেরকে স্থানীয় জীবনবিধান অনুসরণ করে জীবনযাপন করতে দেওয়া হবে। তারা ইতিপূর্বে যতটুকু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তার আলোকে বলা যায়, পূর্ববর্তী কোনো বিজেতা এ যাবৎ তাদের নিজস্ব ধ্যানধারণা ও প্রতিষ্ঠানের পরিমণ্ডলে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেননি। সামাজিক জীবনবিধানে কোনো পরিবর্তন হয়ে থাকলে তা বস্তুত মননশীল কোনো সমাজসংস্কারক এবং স্বাভাবিক সমাজ পরিবর্তনের ধারায় বস্তুত মননশীল কোনো সমাজসংস্কারক দ্বারা এবং স্বাভাবিক সমাজ পরিবর্তনের ধারায় সাধিত হয়েছিল এবং কদাচিৎ কোনো শাসক রাজার আদেশের মাধ্যমে এ পরিবর্তন এসেছে। শাসকরা কর সংগ্রহ করেই তুষ্ট থাকতেন এবং তাদের অব্যাহত জীবনপদ্ধতি নিয়ে দেশ শাসন করতেন। তবুও জনসাধারণের প্রয়োজন একজন রাজাকে এবং তাঁকেই তারা কর দিত, কারণ তিনি ছিলেন তাদের জীবন ও সম্পত্তির রক্ষক। ঔপনিবেশিক শাসনামলে এর ব্যতিক্রম ঘটে।
কিন্তু কেন বিজেতা ও বিজিতের মধ্যে একে অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করার (Laissez faire) সম্পর্কটি ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের সময় ভেঙে পড়ে। পূর্বের শাসকগণ অভিজাতদের মাধ্যমে শাসন করতেন, যাদের উদ্দেশ্য ছিল রাজ্য থেকে মুনাফা সংগ্রহ নয়, বরং তাদের মর্যাদা ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিক সরকারের জন্য প্রাধান্য বিস্তারই চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল না। কোম্পানি এবং কোনো না কোনোভাবে ব্রিটিশ রাজও প্রধানত মুনাফা ও বাণিজ্যিক অগ্রগতির জন্য বেশি তৎপর ছিল এবং প্রাধান্য বিস্তারকে ঈপ্সিত মুনাফা অর্জনের উপায় হিসেবে নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল, বাংলা রাষ্ট্রকে অবশ্যই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণের জন্য পর্যাপ্ত লভ্যাংশ যোগাতে হবে এবং
রাজার (Crown) সন্তুষ্টির জন্য যথেষ্ট অধীনতামূলক কর দিতে হবে, এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে অবশ্যই মুনাফাভিত্তিক হতে হবে। বাংলার ইতিহাসে এই প্রথম বার রাষ্ট্র গঠনে ও রাষ্ট্রচিন্তায় মুনাফার লক্ষ্য সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। বেনিয়ার জাত ব্রিটিশরা তাদের শাসনের শুরু থেকেই শোষণ ও নির্যাতন চালাতে থাকে ।
ছলনাময়ী বণিক সরকার শুরু থেকেই রাষ্ট্রীয় বিষয়সমূহের পরিবর্তনে সচেষ্ট ছিল, কারণ প্রচুর অর্থ পুরানো শাসনব্যবস্থা থেকে উৎসারিত হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল, বা অর্থনীতিকেন্দ্রিক না হয়ে বরঞ্চ অভিজাততান্ত্রিক সম্মানের লক্ষ্যে পরিচালিত হতো। অতএব নতুন শাসকের চাহিদা পূরণের জন্য ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রের চারিত্রিক পরিবর্তন জরুরি ছিল। এজন্য অবশ্যই প্রয়োজন ছিল প্রশাসনিক কর্মীবৃন্দকে পুনর্বিন্যাস করা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অনুপ্রবেশ ঘটানো এবং রাজস্বের প্রধানতম উৎস ভূমিকা আরও অধিকভাবে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রধান ক্ষেত্র, যেমন— ভূমিব্যবস্থা, প্রশাসন, শিক্ষা, আইন ও বিচার, পরিবহণ, এমনকি বিবাহ ও নৈতিকতার পর্যায়ে সংস্কার কাজ শুরু করা হয়। স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে এ সকল সংস্কার প্রচলিত ব্যবস্থার স্বার্থকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং বিভিন্ন স্বার্থের জন্ম দিয়েছিল, যা ক্ষতিগ্রস্ত গোষ্ঠীসমূহ নীরবে মেনে নেয়নি এবং প্রয়োজনবোধে এর বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং ব্রিটিশ শাসন অবসানের পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকে ।
পলাশী উত্তর কোম্পানি শাসনের শুরু থেকেই নতুন শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ লক্ষ করা যায় এবং ব্রিটিশরাজের পতন পর্যন্ত ঐ প্রবণতা অব্যাহত থাকে । কিন্তু ঐ সমস্ত প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারিগণ এবং সংগঠনের ক্রিয়াপদ্ধতি এবং নেতৃত্ব কখনো একই স্বার্থে এবং একইভাবে পরিচালিত ও সংগঠিক হয়নি। প্রেক্ষাপট পরিবর্তন এবং নতুন স্বার্থ ও শক্তির উত্থানের সাথে সাথে ঔপনিবেশিক শাসক প্রদত্ত চাপ সকল সময়েই এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণির উপর গিয়ে পড়েছে এবং দৃশ্যপটে পরিবর্তন এনেছে। দাবি এবং অংশগ্রহণের প্রেক্ষিতে এর প্রতিক্রিয়া কখনো সমরূপ ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণির জনগোষ্ঠী বিভিন্ন অবস্থা ও অনুষঙ্গের শিকার হয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছে। এদের প্রতিক্রিয়া ছিল কোনো কোনো সময় নিষ্ক্রিয় এবং প্রায়শই তীব্র। সার্বিক প্রেক্ষাপটে এসব প্রতিক্রিয়ার ইতিহাস রচনা করা এবং অর্থবহ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য তাই ঘটনাবলিকে সুনিপুণভাবে সাজিয়ে যুক্তিসহ ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন রয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে কাহিনিকে (যা পক্ষান্তরে বহুমুখী ও জটিল) অবশ্যই ধারণাক্রম, বিন্যস্ত ধারণা ও ভূমিকার বিপরীতে বর্ণনা করতে হবে এবং সময় ও আদর্শের নিরিখে বিশ্লেষণ করতে হবে। এ তাত্ত্বিক কাঠামোর ভিত্তিতেই আমরা এবার অষ্টাদশ, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ বা সম্মুখ প্রতিরোধের ঘটনাবলি সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করব, যা থেকে প্রতিরোধ আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসহ সার্বিক চিত্র ফুটে উঠবে
প্রতিরোধ আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
১. লুপ্ত সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় প্রতিরোধ : পলাশীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে স্বাধীনতা হারানো বাঙালিদের মধ্যে প্রতিশোধের স্পৃহা জেগে উঠে। আর ইতিহাসে একটা সাধারণ ব্যাপার এই যে পরাজিত শক্তির কিছু অংশ সর্বদাই থেকে যায় এবং তাদের সুবিধাজনক স্থান থেকে নতুন শাসকের বিরুদ্ধে নানা গোলযোগ সৃষ্টি করে। আমরা জানি যে বিজয়ী মুঘলদের বাংলার উপর সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে এবং পূর্বতন পাঠানদের ও স্থানীয় শাসকদের বিতাড়িত করতে প্রায় এক শতাব্দী লেগেছিল। কিন্তু সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি দক্ষ হওয়ার কারণে উক্ত কার্য সম্পন্ন করতে ব্রিটিশদের অনেক কম সময় লেগেছিল। পলাশীর যুদ্ধ অবশ্যই ব্রিটিশদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু তা একেবারে চূড়ান্ত যুদ্ধ ছিল না। মুঘলদের অবশিষ্টাংশকে পরাভূত করতে এবং স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে তাদেরকে বশে আনতে ব্রিটিশদের অনেক দুঃসাহসী যুদ্ধ করতে হয়েছিল। সিরাজউদ্দৌলার সবচেয়ে অদম্য জেনারেল এবং পাটনার ডেপুটি গভর্নর রাজা নারায়ণ রায় কখনো মীর জাফরকে নবাব হিসেবে স্বীকার করেননি এবং তাঁকে পরাভূত করতে আসা কোম্পানির সৈন্যসহ নবাবের বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন প্ৰথম জেলা চব্বিশ পরগনার জমিদারগণ ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতায় যেতে অস্বীকার করেন, কারণ তাদের কাছ থেকে ব্রিটিশরা নতুন হারে যে রাজস্ব দাবি করেছিল তার পরিমাণ পূর্বতন হারের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। দু'জন নৃপতি জমিদার- বর্ধমান ও বিষ্ণুপুরের মহারাজা ব্রিটিশের দুষ্কর্মের সহযোগী নবাব মীর জাফরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের সহায়তার তাঁদেরকে বশে আনা হয়। ব্রিটিশের করায়ত্ত মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামে জেলার জমিদারগণও বিদ্রোহীদের ন্যায় আচরণ করছিলেন এবং তাদের সদাচরণ নিশ্চিত করার জন্য সেখানে কোম্পানির সৈন্য মোতায়েন করা হয়। তাদের অভিযোগ ছিল এই যে কোম্পানি সরকার তাদের ভূমির উপর অধিক কর নির্ধারণ করেছে এবং তাদের এস্টেট ইজারা দিয়ে প্রজাদের উপর তাদের ঐতিহ্যিক নিয়ন্ত্রণ খর্ব করেছে। এতে জমিদার ও প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষ দাঁনা বেধে উঠে
কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই কোম্পানি সম্পর্কে মীর জাফরের মোহমুক্তি ঘটে, কারণ কোম্পানির নিকট তাঁর দেনা শেষ হচ্ছিল না যদিও তিনি প্রতিবছর কোম্পানিকে লক্ষ লক্ষ পাউন্ড স্টালিং পরিশোধ করে যাচ্ছিলেন। কোম্পানির চাপে নবাবের সৈন্যবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয় এবং এসব সৈন্যকে কোম্পানির সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ করা হয়। মীর জাফর ব্রিটিশবিরোধী আঁতাত গঠনের জন্য অন্যান্য ভারতীয় রাজা ও নৃপতিদের সাথে যোগাযোগ করেন। এক্ষেত্রে প্রধান মধ্যস্থতাকারী ছিলেন মহারাজা নন্দকুমার, যাঁকে পরবর্তীকালে ওয়ারেন হিস্টিংস বিচারের মাধ্যমে হত্যা করেন। কোম্পানির নিকট থেকে গৃহীত ঋণের অংশবিশেষ পরিশোধের ব্যবস্থা হিসেবে কোম্পনি কর্তৃক দাবিকৃত তিনটি জেলা মীর জাফর কোম্পানির নিকট হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেন। সেই অপরাধে তাঁর স্থলে তাঁর জামাতা মীর কাশিমকে সিংহাসনে বসানো হয়, যিনি বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম এ তিনটি বড় জেলা হস্তান্তরের বিনিময়ে সিংহাসন লাভ করেন। .

শীঘ্রই মীর কাশিম অনুধাবন করেন যে দেশ ইতিমধ্যেই কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। অতএব তিনি নিজেকে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে চাইলেন। একজন স্বাধীন শাসক হওয়ার উদ্দেশ্যে মীর কাশিম ধনীদের উপর কর ধার্য করে রাষ্ট্রের আর্থিক উন্নতি ঘটাতে চান এবং সিপাহিদেরকে অধিক বেতন ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সামরিক বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হন। শেষে তিনি রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে স্থানান্তরিত করেন, যা ষড়যন্ত্রকারী ও ব্রিটিশদের থেকে দূরে অবস্থিত ছিল। এভাবে শক্তি সঞ্চয় করে তিনি ব্রিটিশদের দেশ থেকে বহিষ্কারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ফ্রন্টে তাদের উপর আক্রমণ চালান। কিন্তু অধিকাংশ যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। তিনি অযোধ্যার নবাবসহ পার্শ্ববর্তী রাজ্যসমূহ থেকে সামরিক সাহায্য লাভের চেষ্টাও করেন। ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বক্সারে এক ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়, কিন্তু যৌথ বাহিনী পরাজিত হয়। মীর কাশিম দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং উত্তর ভারতের কোনো এক জঙ্গলে প্রাণত্যাগ করেন। কিন্তু লুপ্ত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় প্রতিরোধ আন্দোলন থেমে যায়নি ৷
২. অরাজন্য (Non-princely) রাজনৈতিক প্রতিরোধ : প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অরাজন্য রাজনৈতিক প্রতিরোধ। কেননা বক্সারে মীর কাশিমের পরাজয়ে সামরিক উপায়ে মুঘল সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্বারের জন্য নৃপত্য প্রতিরোধের অবসান ঘটে। তবে অন্যান্য অরাজন্য উপাদান, যারা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পূর্বতন শাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল, তারা তখনও নতুন শাসকের বিরুদ্ধে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল। নবাবি প্রতিরোধের ব্যর্থতার পর রাজনৈতিক এলিটের প্রতিরোধমুখী চেতনার উদাহরণ হিসেবে সিলেটের মির্জা আগা মোহাম্মদ রেজা বেগ এবং ঢাকার নবাব শামসুদ্দৌলার প্রতিরোধের কথা উল্লেখ করা যায়। সিলেটের মির্জা আগা মোহাম্মদ রেজা বেগ একজন স্বনির্বাসিত মুঘল ছিলেন, যিনি ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ফিরিঙ্গি হুকুমত থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সকলকে ব্রিটিশবিরোধী জেহাদে তার সাথে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি সিলেটের অদূরে প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত কাছারে এক সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। তিনি বড় বড় জমিদার ও অন্যান্য এলিটের নিকট পরওয়ানা পাঠান এবং তাদেরকে একসাথে ফিরিঙ্গি রাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তাঁর বিচারের বিবরণীতে (Final proceedings) দেখা যায়, ফতেহ মোহাম্মদ নামে যোগাযোগ করার জন্য প্রধান দূত (emissary) নিয়োগ করা হয়। রেজা বেগ ক্ষমতায় গেলে তাদেরকে ব্রিটিশদের চাইতে অধিক সুযোগ সুবিধা দানের অঙ্গীকার করা হয়। সিলেট জেলার বানিয়াচং- এর জমিদারকে বেগ লিখেছিলেন :
সময় এসেছে আপনার ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটাতে, কারণ ফিরিঙ্গিদের দিন এখন শেষ প্রান্তে এবং আল্লাহ ও রাসুলের শাসন সমাগত। অতএব আপনি অবশ্যই নাস্তিক ফিরিঙ্গিদের হত্যা করবেন এবং আমি আপনাকে এ যাবৎ আপনার অধিগত ভূমির চেয়ে আরও অধিক পরিমাণ ভূমি দান করব। যদি আপনি আমার হুকুম বাস্তাবায়ন করতে চান, ‘তবে যেখানেই ফিরিঙ্গিদের পাবেন বন্দি ও হত্যা করবেন এবং সিলেটে আমাকে সহায়তার জন্য ৫০০ জন অস্ত্রধারী পাঠাবেন..।'
[তারিখ : শুক্রবার, ৩০ আষাঢ়, ১২০৮ বাংলা ।]

প্রতিরোধ আন্দোলনের সংজ্ঞা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং নিম্নবর্গ একইবাবে সিলেটের তুরাফ পরগনার জমিদারকে বেগ লিখেছিলেন :
আপনার জানা দরকার যে ফিরিঙ্গিদের শাসনকাল ৪০ বছর ছিল, কিন্তু সে সময় অতিক্রান্ত হয়েছে এবং আল্লাহর বান্দাদের বিজয়...সমাগত। আপনি যদি ভাগ্যের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকেন.....আমার প্রতি আসক্ত থাকেন, তবে ফিরিঙ্গিদের সাথে যুদ্ধ করুন এবং অবিশ্বাসীদের হত্যা করুন ও তাদেরকে নরকে নিক্ষেপ করুন....এবং যে পরিমাণ ভূমি আপনি হারাবেন আমি আপনাকে তা মঞ্জুর করব অথবা আপনি বেশি চাইলে আমি তা দেব ।
[তারিখ ৩০ আষাঢ়, ১২০৮ বাংলা ।]
তবে বেগ যে জমিদারদের নিকট থেকে কিছু সমর্থন লাভ করেন তার প্রমাণ হলো, ফিরিঙ্গিদের বহিষ্কারের জন্য তাঁর আহ্বানের পর অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি কামান ও অন্যান্য হালকা অস্ত্রসজ্জিত এক বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হন। ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুলাই রেজা বেগ পাঁচ হাজার অস্ত্রসজ্জিত সৈন্যসহ কোম্পানির ভূখণ্ডে প্রবেশ করেন এবং কোম্পানি বাহিনীকে পরাস্ত করে বিন্দাসাইল সীমান্ত পরগনা দখল করে নেন। কিন্তু তা তিনি বেশিদিন অধিকারে রাখতে পারেননি। তাঁর শক্তি ও ঐকান্তিকতা লক্ষ করে সরকার তাঁকে পরাভূত করতে নিয়মিত সামরিক বাহিনী প্রেরণ করে। কোম্পানির সৈন্যদল কর্তৃক সহজেই পরাজিত হয়ে বেগ গেরিলাযুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে নিজেকে পুনর্গঠিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ত্বরিৎ আক্রমণের (Hit- and-run) পর দ্রুত নিষ্ক্রমণকালে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং তাঁর প্রধান সর্দার বা সেনাপতিসহ বন্দি হন। এ বন্দি যোদ্ধাকে বিচারের জন্য কলকাতায় প্রেরণ করা হয় । কলকাতা আদালতে (Court of circuit) বিচারকালে রেজা বেগের বিপক্ষে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হয় এবং তাঁকে ১৭৯৯-এর ৪ ধারা মতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তাঁর সাথে বন্দি অন্যান্য সহযোগীদের বিচার হয় ঢাকায় এক পৃথক আদালতে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাহাদুর শাহ, খাকি শাহ, নাজিম মুহাম্মদ এবং রহিম খান, যাদের সকলকে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয় ৷
আরও দুঃসাহসিক, সুশৃঙ্খল এবং ব্যাপকধর্মী ছিল নবাব শামসুদ্দৌলার প্রতিরোধ পরিকল্পনা। তিনি ঢাকার নায়েব নাজিম নবাব নুসরাত জং-এর ভ্রাতা ছিলেন। তিনি অন্যান্য বেশির ভাগ বিদ্রোহীর মতো অশিক্ষিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন বিদ্বান, যাঁর ইংরেজি সহ অন্যান্য ভাষায় ব্যুৎপত্তি ছিল। তাঁর জ্ঞান সম্পর্কে উইলিয়াম হিকি বলেন, “ভারতে আমার দেখা দেশীয়দের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে গুণবান ব্যক্তি; প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসের একজন অসাধারণ পণ্ডিত এবং ইংরেজি ভাষায় বিস্ময়কর দক্ষতার অধিকারী। যখন আমি তাঁকে প্রথম দেখি, তাঁকে আমার চল্লিশ বছর বয়স্ক মনে হয়েছিল। আমি বিশেষভাবে তাঁর সাবলীল ও সুরুচিপূর্ণ সম্মোধনে অভিভূত হই। তাঁর সাথে কয়েক দফা আলাপ-আলোচনার পর আমি তাঁর ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী হই।” হিকির (Hickey) ন্যায় বিশপ হেবারও (Bishop Heber ) শামসুদ্দৌলার জ্ঞান সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করেন, যার সাথে তাঁর ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় সাক্ষাৎ হয়। সমকালীন ইউরোপীয় সাহিত্য এবং ইতিহাস সম্পর্কে শামসুদ্দৌলার জ্ঞান দেখে হেবার বিস্মিত হয়েছিলেন। বিশপ শেক্সপিয়ারের সাহিত্যিক গুণের মূল্যায়নে তাঁর দক্ষতা দেখে বিশেষ মুগ্ধ হন। শামসুদ্দৌলা বিশপের সাথে অনর্গল ইংরেজিতে আলাপ করেন এবং কথা প্রসঙ্গে ইতিহাসের কয়েকটি ইংরেজি পুস্তকের উদ্ধৃতি দানকালে স্প্যানিশ যুদ্ধের ঘটনাবলি ও তাতে স্যার এডওয়ার্ড প্যাগেট- এর ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে।
কিন্তু বিদ্যা বা মার্জিত আচরণ শামসুদ্দৌলাকে সম্মানের সাথে বাঁচার জন্য কোনো সুবিধা দেয়নি। তিনি ছিলেন বেকার। যেহেতু তিনি স্থানীয় অধিবাসী (Native) ছিলেন, তাই তাঁর জন্য সকল সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কর্নওয়ালিস বিধি (Cornwallis Code) মোতাবেক কোনো স্থানীয়কে রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা যেত না। ঢাকায় কোনো কর্মসংস্থান করতে না পেরে হতাশ হয়ে শামসুদ্দৌলা মুর্শিদাবাদে তাঁর ভাগ্য পরীক্ষার জন্য যান, কিন্তু ঢাকার মতো সেখানেও তাঁর জীবন ছিল একঘেয়ে ও সম্মানহানিকর। বিদ্বান ব্যক্তি হিসেবে শামসুদ্দৌলা দেশে ব্রিটিশ শাসনের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করেছিলেন। পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ না করে তিনি সাধারণ বিপ্লবের মাধ্যমে ব্রিটিশদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে বদ্ধপরিকর হন । এ লক্ষ্যে তিনি বাংলা ও বিহারের সকল অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতে গোপন আন্দোলন শুরু করেন। মুর্শিদাবাদ ও কলকাতায় তাঁর কর্মব্যস্ততা এবং আন্দোলন কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁকে সন্দেহভাজন ব্যক্তিতে পরিণত করে। ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে ঢাকায় যেতে বলা হয় এবং তিনি ঢাকায় চলে যান। কিন্তু তাঁর আসল পরিকল্পনা তিনি কখনো পরিত্যগ করেননি। তিনি দেশের অভ্যন্তরে কোডলিপির (Code correspondence) মাধ্যমে সকল অসন্তুষ্ট জনগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। ভারতের অন্যান্য মুসলিম নৃপতির সমর্থন আদায়ের জন্য তাঁদের নিকট দূত প্রেরণ করা হয়। ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এক সাধারণ গণঅভ্যুত্থানের জন্য তাঁর প্রস্তুতি পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছে যায় ৷
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখন শামসুদ্দৌলা তাঁর ধারণাবহির্ভূত এক বহিঃস্থ ঘটনার শিকার হন। অযোধ্যার নির্বাসিত নবাব ওয়াজির আলী তখন বেনারসে বাস করছিলেন। ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি তিনি ব্রিটিশ রেসিডেন্ট চেরি ও তাঁর ইউরোপীয় গার্ডদের হত্যা করে বেনারস থেকে পালিয়ে যান। পালাবার পর তাঁর বাড়ি থেকে এক বান্ডিল কাগজপত্র পাওয়া যায়। ঐ বান্ডিলে ৬২টি চিঠি ছিল, যেগুলো শামসুদ্দৌলাসহ বাংলা ও বিহারের বিদ্রোহী নেতাদের লিখিত ছিল। তাঁর চিঠিগুলো পরীক্ষা করে জানা যায় যে সুবিধাজনক সময়ে জাতীয় বিদ্রোহ সংঘটিত করার পরিকল্পনা তাঁর ছিল। বেনারসে কি ঘটেছে তা তিনি জানতে পারার আগেই এক ঝটিকা বাহিনী (Storm troop) ঢাকায় আসে এবং তাঁকে গ্রেফতার করে। নিরাপত্তার কারণে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় তাঁকে বিচারের জন্য ঢাকা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। বিচারকালে ওয়াজিরকে লেখা তাঁর সকল চিঠি খোলা হয়। চিঠিতে প্রকাশ পায় যে নবাব শামসুদ্দৌলা আফগানিস্তানের জামান শাহ ও মাস্কাটের শেখের সাথে যোগাযোগ করছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সময় বাইরে থেকে কোম্পানির এলাকা আক্রমণের জন্য তিনি তাদের নিকট আবেদন জানান । তিনি হিন্দু ও মুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন করেন এবং তাদেরকে ঢাকার হেমায়েত
শাহের নেতৃত্বে সংগঠিক করেন। মির্জা তাপিস নামে পারস্যের এক অভিযাত্রী কলকাতা, মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার বৈরী ব্যবসায়ীদেরকে অনুপ্রাণিত করে যুদ্ধের জন্য অর্থসংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বউরভূমের রাজা, যিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চাপে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তিনি বাংলা এবং বিহারের অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত জমিদারদের সমর্থন আদায়ে নিয়োজিত থাকেন। শেখ আলী খান নামে একজনকে আফগানিস্তানের জামান শাহের নিকট পাঠানো হয় সম্ভাব্য স্বাধীনতাযুদ্ধের নীল নক্শা সম্পর্কে তাঁকে সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলার জন্য। হাকিম খান, গর খান, দাউদ খান এবং মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী লালা ইন্দরমুন্ডের প্রতিনিধির (Agency) মাধ্যমে অযোধ্যার সিংহাসনচ্যুত নবাব ওয়াজির আলী এবং মারাঠা প্রধান সিন্ধিয়ার সাথে দু'টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির সিদ্ধান্ত ছিল, বাংলা এবং বিহারে বিদ্রোহের সময় তারাও বিদ্রোহী তৎপরতা আরম্ভ করবেন এবং জামান শাহের আক্রমণরত বাহিনীকে সহায়তা দেবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেনারসের ঘটনা এসব দুঃসাধ্য গোপনীয় প্রস্তুতিকে নস্যাৎ করে দেয়। বাংলায় ব্রিটিশ সরকারকে ধ্বংস করার চেষ্টা এবং অভ্যন্তরীণভাবে একতাবদ্ধ হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে বাংলা ও বিহারের জমিদারদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং পত্রাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক যোগাযোগের অভিযোগে শামসুদ্দৌলা এবং তাঁর সহযোগীদের বিচার হয়। এতে জনসাধারণ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আরও প্রতিরোধমুখী ।
কেননা শামসুদ্দৌলার পরিকল্পনা শুধুমাত্র অলস স্বাপ্নিকের অলীক কল্পনা ছিল না। তাঁর পরিকল্পনা থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে বাংলার বিভিন্ন শ্রেণির জনগণ যেভাবে নীরবে এবং নতমস্তকে ব্রিটিশ শাসন মেনে নেবে বলে সাধারণভাবে ধারণা করা হয়েছিল সেভাবে ব্রিটিশ শাসনকে তারা মেনে নেয়নি। তখন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল গণঅভ্যুত্থানের, কিন্তু অভাব ছিল নেতৃত্ব এবং এক ধরনের অনিয়মিত সংগঠন নিয়ে সম্ভাবনাপূর্ণ ও সফল নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু বেনারসের দুর্ঘটনা তাঁর স্বপ্ন নস্যাৎ করে দেয়। যদি তিনি চূড়ান্ত অভ্যুত্থান ঘটাতে সক্ষম হতেন, তবে তা কোম্পানি শাসনে কী ফল বয়ে আনত তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কিন্তু তাঁর গোপন তৎপরতা ইঙ্গিত দেয় যে বাংলা ও বিহারের জনগণের মানসিক অবস্থা ছিল বিপ্লবমুখী । শামসুদ্দৌলা এ সুযোগ গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। এভাবেই অরাজন্য রাজনৈতিক প্রতিরোধ ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের চরিত্র পরিগ্রহ করে ।
৩. জমিদার প্রতিরোধ : প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জমিদার প্রতিরোধ। দেখা যায় যে, প্রাকব্রিটিশ সময়কালে পরগনার নিয়ন্ত্রক তথা স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ জ৷মদারদের হাতে ন্যস্ত ছিল, যারা মধ্যগ (Middle man) হিসেবে সরকারের নিকট গ্রামীণ সমাজের প্রতিনিধিত্ব এবং গ্রামীণ সমাজের নিকট সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতেন। জমিদার ছিলেন বংশগতভাবে রাষ্ট্রীয় পদাধিকারী কর্তাব্যক্তি, য়ার উপর বিভিন্ন সরকারি দয়িত্ব, যেমন প্রশাসন, পুলিশ, বিচার, যোগাযোগ ইত্যাদির দায়িত্ব অর্পিত ছিল। এমনকি তাঁর সামরিক দায়িত্ব ছিল। জরুরি অবস্থায় এবং যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁকে সরকারকে সৈন্য, ঘোড়া এবং পশু সরবরাহ করতে হতো। সৈন্যবাহিনী চলাচলকালে সৈন্যদেরকে প্রয়োজনীয় স্থানীয় সরবরাহ সহ অন্যান্য সহায়ক জোগানও তাঁকে দিতে হতো। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনামলে এই ঐতিহ্যের ব্যতিক্রম ঘটে।

এর কারণ হলো মুঘল সরকারের নিকট জমিদারি প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিক সরকারের স্বার্থের সঙ্গে এ প্রতিষ্ঠান সংগতিপূর্ণ ছিল না। যেহেতু জমিদারি প্রতিষ্ঠান ঔপনিবেশিক মুনাফার অভিপ্রায়কে সমর্থন করতো না, তাই কোম্পানি সরকারের সচেতন নীতি ছিল এই প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্নভাবে দুর্বল করা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে তাত্ত্বিকভাবে না হলেও কার্যত তা থেকে অব্যাহতি লাভ করা। এভাবে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর উপঢৌকন হিসেবে প্রাপ্ত ২৪ পরগনার বড় বড় জমিদারি এবং ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে অধিকৃত তিনটি জেলাভুক্ত জমিদারি বিলোপ করা হয়। দীউয়ানি গ্রহণের পর জমিদারগণ ক্রমবর্ধমান রাজস্বচাহিদার চাপের মধ্যে পড়েন। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে তাদেরকে পেনশনভোগীতে পরিণত করা হয় এবং তাদের এস্টেট পাঁচ বছরের জন্য সর্বোচ্চ নিলাম ডাককারীর নিকট ইজারা দেওয়া হয়। জমিদারগণ পরিস্থিতির কারণে দরিদ্র ও হতোদ্যম হয়ে পড়েন এবং তারা সমাজের স্বাভাবিক নেতৃত্বে আর বহাল থাকলেন না। গভর্নর জেনারেল ও কাউন্সিলের একজন সম্মানিত সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস সত্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যান যখন তিনি মন্তব্য করেন যে “ব্রিটিশ শাসনে জমিদারগণ ক্রমান্বয়ে আলস্য, নির্বুদ্ধিতা, চরম দারিদ্র্য ও অবমাননায় নিমজ্জিত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন যে “সার্বিকভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে তাঁরা জনগণের কাছে সকল সম্মান ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেন।” ১৭৭৭ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত জমিদারদেরকে বাৎসরিক ভিত্তিতে তাদের দখল ফিরিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু তাঁরা ক্রমবর্ধমান রাজস্ব দাবির শিকার হয়েছিলেন। এ সময়ে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদি থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং তারা শুধুমাত্র রাজস্ব সংগ্রহকারী এজেন্ট হিসেবে গণ্য হন । ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পন্ন করা হয় এবং সরকারের নিকট যথাসময়ে রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হলে তাঁদের ভূসম্পত্তি নিলামে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে জমিদারদের উপর কুঠারঘাত করা হয় ।
কাজেই এটা সম্ভব ছিল না যে বাংলার এসব স্থানীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যাঁরা বংশপরম্পরায় ক্ষমতা, মর্যাদা ও সম্পদের অধিকারী ছিলেন, তাঁরা এ জাতীয় উদ্বেগজনক এবং অস্থিতিশীল পদক্ষেপ সময়মতো মেনে চলবেন। প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত জমিদার সচরাচর ব্যক্তিগতভাবে এবং কখনো যৌথভাবে কোম্পানির পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সিলেটের আগা মোহাম্মদ রেজা এবং ঢাকার নবাব শামসুদ্দৌলার প্রতিরোধের উদাহরণ ইঙ্গিত দেয় ব্রিটিশ শাসনের প্রথম পর্যায়ে জমিদারগণ সাধারণভাবে কতখানি অসন্তুষ্ট ছিলেন। এখানে আমরা যুক্তিসহ আরও কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরব, যেখানে যুক্তি দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে যে ক্ষতিগ্রস্ত জমিদারগণ বাধ্য হয়েই ব্রিটিশ শাসন মেনে নেন এবং যখন নতুন সরকার কর্তৃক তাঁদের স্বার্থ ও প্রভাবের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে তখনই তাঁরা বিদ্রোহ করেছেন এবং প্রজাদেরকে নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন ।
গবেষক বারুই (Barui) উপকূলীয় অঞ্চলের জমিদার বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছেন। উক্ত এলাকায় স্থানীয় জমিদারদের প্রধান স্বার্থ ছিল লবণ উৎপাদন। কোম্পানি সরকার রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য লবণ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ সরকারের একচেটিয়া অধিকারে নিয়ে আসে এবং ব্যক্তিগতভাবে লবণ উৎপাদনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। সরকার স্বয়ং লবণ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে এগিয়ে আসবে এটি ঐতিহ্যবাহী লবণ উৎপাদনকারীদের চিন্তাবহির্ভূত ছিল। তাদের স্মৃতিতে এবং লোকাচারে রাষ্ট্রের পক্ষে এ ধরনের পদক্ষেপের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। জমিদারগণ ঘৃণাভরে লবণবিধির (Regulation) বিরোধিতা করেন এবং কোম্পানির লবণচাষিদেরকে খেলারী বা লবণক্ষেত থেকে হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। দীর্ঘ দ্বন্দ্বের পর অবশেষে সরকার উপকূলীয় লবণ উৎপাদনকারী জমিদারদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাঁদের সাথে মীমাংসায় আসতে বাধ্য হয়। এতে সাময়িকভাবে উত্তেজনা প্রশমিত হয় ।
বারুই মন্তব্য করেন, “বাংলার উপকূল অঞ্চলের জমিদারগণ ইস্ট উন্ডিয়া কোম্পানির লবণ একচেটিয়াকরণের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী, সংগঠিত ও প্রণালিবদ্ধ বিদ্রোহ গড়ে তোলেন। কোম্পানির এই একচেটিয়াকরণের ফলে জমিদারগণ মুঘল আমল থেকে লবণের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারান এবং লবণ উৎপাদন ও ব্যবসায় থেকে বাদ পড়েন। ফলে জমিদারদের লবণ উৎপাদন সৃষ্ট বহু যুগের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সুবিধা হুমকির সম্মুখীন হয়। জমিদারগণ ও তাঁদের স্থানীয় মিত্ররা প্রণালিবদ্ধভাবে উক্ত একচেটিয়াত্ব খর্ব করতে প্রায়াসী হয় এবং তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি বিভিন্নভাবে পুষিয়ে নিতে ব্রতী হয়। এভাবে এক পক্ষে কোম্পানি ও তার মিত্র এবং অপর পক্ষে জমিদারগণ ও তাদের মিত্রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।”
দেখা যায় যে, গোড়ার দিকে প্রথম ও প্রধান প্রতিরোধ আসে বীরভূমের নৃপতিতুল্য জমিদার রাজা আসাদুজ্জামানের কাছ থেকে। নবাবের শাসনে রাজাকে পার্বত্য সীমান্ত রক্ষার কাজে ও রাজকীয় যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য সামরিক বাহিনী রাখার কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছিল। কোম্পানি মীর কাশিমকে রাজার সৈন্যবাহিনী বাতিল করার এবং তাঁর রাজস্ব বৃদ্ধি করার পরমার্শ দেয়। তবে মীর কাশিম তা করতে অস্বীকৃতি জানান। কোম্পানি নিজেই তখন রাজনৈতিক কারণে সৈন্যবাহিনী বাতিলের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফোর্ট উইলিয়মের গভর্নর হেনরি ভ্যানসিটার্ট (Henry Vansittart) রাজাকে তাঁর সৈন্যবাহিনী ভেঙে দিতে বলেন, অন্যথায় কোম্পানির সামরিক আক্রমণের সম্মুখীন হওয়ার হুমকি দেন। আসাদুজ্জামান এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং কোম্পানির প্রভুত্বকে প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করেন। ভ্যানসিটার্ট তাঁকে পরাভূত করতে কয়েকটি অভিযান প্রেরণ করেন এবং অবশেষে রাজা পরাজিত ও বন্দি হন। বীরভূমের রাজা কখনোই যথাযভাবে ব্রিটিশ শাসন মেনে নেননি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চাপে তাঁর সমগ্র জমিদারি সাত বছরের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাজা আসাদুজ্জামানের পুত্র জামান খান কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে এক কৃষক বিদ্রোহ পরিচালনা করেন এবং এ অপরাধে নিজস্ব প্রাসাদে তাঁকে অন্তরিন করে রাখা হয়, যেখানে তিনি ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। এতে প্রতিরোধ আন্দোলন থেমে যায়নি। বরং আন্দোলন নতুন গতি লাভ করে।
এরপর পূর্ব বাংলার ফৌজদার ও নুরুল্লাপুরের জমিদার মোহাম্মদ আলী ইংরেজদের নিকট আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন যখন তারা দাবি করে যে তাদের অধিকৃত চট্টগ্রাম জেলা পশ্চিমে মেঘনা নদীর পূর্বতীর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে অধিকৃত চট্টগ্রাম জেলার বাইরে তারা নবাবের প্রজা এবং নবাবের এলাকায় তাদের প্রজা হিসেবেই আচরণ করতে হবে, অন্যথায় তাদেরকে ফৌজদারের বাহিনী কর্তৃক নিগৃহীত হতে হবে। মোহাম্মদ আলী ও কোম্পানির মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দিউয়ানি অধিকারের পর মোহাম্মদ আলী ফৌজদারের রাষ্ট্রীয় পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। নূরল্লাপুর পরগনার জমিদার হিসেবে তাঁকে অতিরিক্ত রাজস্ব চাহিদার আওতাভুক্ত করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে ধ্বংস করা। ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানির এক ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী যখন তাঁর জমিদারিস্থ বাজারের দ্রব্যাদি একচেটিয়া দখলভুক্ত করতে আসে, তখন তাকে হত্যা করেন। কোম্পানি চট্টগ্রাম থেকে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর তাঁকে গ্রেফতার করে এবং তাঁর নিজস্ব জমিদারি, সম্মান ও সুবিধা থেকে তাঁকে বঞ্চিত করে। এতে ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন আরও তীব্র হয়।
দেখা যায় যে, জমিদারদের প্রথম দিককার প্রতিরোধ আন্দোলনের মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক ও সংগঠিত ছিল সন্দ্বীপের ভূমালিকদের (Land holder) অভ্যুত্থান । ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানির অধিকারে নিয়ে আসার সময় সন্দ্বীপ চট্টগ্রাম জেলার অংশ ছিল। ১৭৬০ সাল থেকে এই দ্বীপটি অনেকবার জরিপ (Measure) করা হয় এবং প্রতিবার ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি করা হয়। জমিদার ও তালুকদারগণ এ ধরনের অভূতপূর্ব কঠোরতার বিরুদ্ধে আপত্তি তোলেন। ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি জরিপের জন্য আমিনদের পুনরায় প্রেরণ করা হয়। হাতিয়া, বামনি এবং সন্দ্বীপ- এ তিনটি উত্তেজিত জমিদার ও তালুকদারগণ সন্দ্বীপের জমিদার আবু তোরাবের নেতৃত্বে সংগঠিত হন এবং ঘন ঘন জরিপের অবস্থান গ্রহণ করতে এবং কোম্পানিকে খাজনা না দিতে তাঁদের সংকল্প ব্যক্ত করেন। উক্ত তিনটি দ্বীপে জরিপের সমস্যা সম্পর্কে আলোচনাকালে ঢাকা প্রাদেশিক কাউন্সিল উল্লেখ করে যে “এ তিন দ্বীপের সকল জমিদার ও তালুকদার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, কাচারি থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন করে, বহু সংখ্যক সরকারি কর্মচারীকে হত্যা করে এবং রাজস্ব প্রদান পুরোপুরি বন্ধ রাখে ।” প্রাদেশিক কাউন্সিল আরও মন্তব্য করে যে “বিভিন্ন সময়ে সন্দ্বীপে দুটি অভিযান পরিচালিত হয়েছে, একটি মেজর গ্রান্টের তত্ত্বাবধানে এবং অন্যটি ক্যাপ্টেন নলিকিন্সের পরিচালনায়। এ দুটি অভিযানই তৎকালীন জমিদার আবু তোরাবের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় এবং তিনি নিজ বাড়িতে প্রকাশ্যে নিহত হন।” এতেও প্রতিরোধ আন্দোলন দমন করা সম্ভব হয়নি ।
এরপর ১৭৭২-১৭৭৭ সময়ের চাষব্যবস্থায় অধীন অনেক জমিদার নিলাম সাড়া দিতে অস্বীকার করেন এবং নির্ধারিত শতকরা দশভাগ মালিকানা-ভাতার ব্যাপারে উম্মা প্রকাশ করেন। এসব ক্ষুব্ধ জমিদার ও তালুকদার গণঅভ্যুত্থানে প্রেরণা দান সহ স্থানীয় সংকট সৃষ্টি করে উক্ত চাষব্যস্থাকে অকার্যকর করার চেষ্টা করেন। উদাররণ স্বরূপ বলা যায়, কুমিল্লা জেলার হোমনাবাদের জমিদার আলী গাজী এবং মোজাফফর গাজীর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফিরিঙ্গি সরকারকে রাজস্ব প্রদান বন্ধ করে দেন। কুমিল্লার রেসিডেন্ট আর. লিক (R. Leeke) তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে চার বছর যাবৎ তাঁরা রাজস্ব প্রদান বন্ধ রাখেন এবং সরকারি কর সংগ্রহকারীদের কর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এলাকায় প্রবেশ সফলতার সাথে রুখে দেন। এতে জমিদারদের ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের তীব্রতা অনুধাবন করা যায় ।
দৃশ্যত ঊনবিংশ শতাদ্বীর শেষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদের জন্য ব্যাপক সুবিধা বয়ে আনে, কারণ ততদিনে জমির মূল্য কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে সরকারের প্রাপ্য খাজনার পরিমাণ ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের খাজনার সমানই থেকে যায়। কিন্তু উক্ত ব্যবস্থার প্রাথমিক বছরগুলোতে এটি জমিদারদের উপর কঠিন বোঝায় পরিণত হয়েছিল। তাঁরা কদাচিৎ সরকারি রাজস্ব পরিশোধ করতে পারতেন এবং ফলশ্রুতিতে তাঁদের জমিদারি হুমকির সম্মুখীন হয় এবং সূর্যাস্ত আইন নামে পরিচিত কঠোর রাজস্ব বিক্রয় আইনের আওতাভুক্ত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দশ বছরের মধ্যে বর্ধমানের রাজার জমিদারি ব্যতীত বাংলার বড় বড় সকল জমিদারি সূর্যাস্ত আইনের কার্যকারিতায় বিক্রয় হয় এবং হাজার হাজার জমিদারি এস্টেট নিলামে উঠে। হিসাব করা হয়েছে যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের দশ বছরের মধ্যে সরকারি রাজস্বের মাপকাঠিতে বাংলার ভূসম্পত্তির অর্ধেকেরও বেশি রাজস্ব বকেয়ার কারণে নিলামে বিক্রয় হয়ে যায়। যেসমস্ত পরিবার ভূমি হারায়, তারা বংশপরম্পরায় সমাজের গতানুগতিক নেতৃত্বে ছিল এবং এত অল্প সময়ের মধ্যে ভূস্বামী হিসেবে তাদের পতন নিঃসন্দেহে এক বিরাট বিপর্যয় ছিল, যার জন্য তারা শুধুমাত্র ফিরিঙ্গিদের দায়ী করতো। ব্যক্তিগতভাবে এবং যৌথভাবে তারা সরকারের কাছে তাদের দাবিদাওয়া পেশ করে এবং এমনকি তাদের অনেকেই মরিয়া হয়ে স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত করে ।
অনেক পুরানো জমিদার যদিও আঞ্চলিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন, তথাপি তাঁরা তাঁদের লাখেরাজ বা খাজনা মওকুফ অধিকারের বদৌলতে কোনোভাবে তাঁদের সামাজিক সম্মান বজায় রাখতে পেরেছিলেন। অতীতে যথাযথ সরকারি অনুমোদন নিয়ে জমিদারগণ ধর্ম, সাহিত্য, বিনোদন ইত্যাদি বিষয়ে নিবেদিত ব্যক্তিদেরকে লাখেরাজ-স্বত্ব মঞ্জুর করতে পারতেন। একে মাদাদ-ই-মাআশ বা জীবিকানির্বাহমূলক ভূমি অনুদান বলা হতো। এসব অনুদানের মধ্যে ছিল ইমামদের জন্য আইমা, সুফিদের জন্য পিরুত্তর, ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের জন্য ব্রহ্মোত্তর, প্রতীমাপূজার জন্য দেবোত্তর, চারণ কবিদের জন্য ভাতুত্তর ইত্যাদি। এছাড়া বৃত্তি, মহাত্রাণ, মিল্লাকী, ওয়াকী ইত্যাদি অন্যান্য অনুদানও ছিল। এসব অনুদান সকল ধরনের শিক্ষক ও সাহিত্যিক ব্যক্তির ভরণপোষণের জন্য নির্ধারিত ছিল। তত্ত্বগতভাবে এসব তামাদিযোগ্য হলেও কার্যক্ষেত্রে এতে বংশগত দখলস্বত্ব ছিল। মুঘল সরকারের উদার নীতির সুযোগ গ্রহণ করে অনেক জমিদার শুধু সত্যিকারের যোগ্য ব্যক্তিদেরই লাখেরাজ অনুদান মঞ্জুর করেন নি, তবে মানবিক কারণ দেখিয়ে বিপুল সরকারি রাজস্ব জব্দ করে মিথ্যা বা জাল নামে নিজেদের জন্য তা বরাদ্দ করেছিলেন। প্রধানত দুটি সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে তাঁরা খালসা বা রাজস্বভূমি সরাতে চেয়েছিলেন। প্রথমটি অতিরিক্ত আয় এবং দ্বিতীয়টি নিরাপত্তা। কোনো কারণে কিছু সময়ের জন্য জমিদারি হাতছাড়া হয়ে গেলে লাখেরাজ অনুদান তাঁদের অধিকারে থেকে যেত। তাঁদের দূরদৃষ্টি
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্তী সময়ে যথাযথ প্রমাণিত হয়, যখন অনেক পুরনো জমিদার পরিবার তাদের ভূমি হারান, কিন্তু তখনও লাখেরাজ ভূমি বেনামিতে রাখার কারণে পুরোপুরি ধ্বংসের হাত থেকে তাঁরা বেঁচে যান ।
কোম্পানি সরকার সুবিদিত ছিল যে সরকারি রাজস্বের বেশির ভাগ অংশ মাদাদ- ই-মাআশ নামে ফন্দিবাজ জমিদাররা বাগিয়ে নিচ্ছিল । কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি, কারণ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র তখন পর্যন্ত শিথিলভাবে গঠিত হচ্ছিল এবং জমিদারদের মতো ক্ষমতাবান কায়েমি স্বার্থকে উচ্ছেদ করার অবস্থানে ছিল না। তবে ১৮২০ ও '৩০-এর দশকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার 'পর এ ব্যাপারে কোনো উদ্বেগ ছিল না। অধিকন্তু ভীষণ আর্থিক সংকটে নিপতিত সরকার রাজস্বের নতুন উৎস থেকে অধিক আয়ের পথ খুঁজতে থাকে। অকেজো লাখেরাজ ভূমিকে পুনরায় ভাড়ার আওতায় আনা সরকারের নিকট খুব আকর্ষণীয় এবং মজবুত মনে হয়েছিল। রাজস্ব বোর্ডের প্রেসিডেন্ট জন শোর (John Shore) কর্তৃক তৈরি ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব মতে অকেজো লাখেরাজ-এর কারণে সরকার বাৎসরিক ৩৫ লক্ষ সিক্কা রুপি থেকে বঞ্চিত হয়েছে, যা সরকারের বাৎসরিক মোট রাজস্বের এক- চতুর্থাংশ। ভূমি অনিরীক্ষিত থাকায় রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণও কম ছিল না এবং সেসকল ভূমি মুক্ত করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় থেকে চাষাবাদের আওতায় আনা হয়। সরকার দাবি করে যে মুক্ত ভূমির মালিক রাষ্ট্র এবং সকল পুনঃদাবিকৃত সকল ভূমি তাঁদের জমিদারি এস্টেটের অংশ হিসেবে দাবি করেন, যা নতুনভাবে করযোগ্য হবে না ।
সরকার ১৮২০ এর দশক থেকে বাজেয়াপ্ত আইন (Resumption proceedings) ব্যাপকভাবে প্রবর্তন করে এবং ১৮২৮ সাল থেকে আরও আক্রমণাত্মকভাবে তা প্রয়োগ করে। জমিদার ও তালুকদারদেরকে তাদের লাখেরাজ বা তাইদাদ (taidad) কাগজপত্র পরীক্ষণের উদ্দেশ্যে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ পদক্ষেপ জমিদারদের বেসামাল করে দিয়েছিল, কারণ তারা কদাচিৎ তাদের কাগজপত্র সঠিক ও আসল বলে প্রমাণ করতে সক্ষম হতেন, যেখানে সরকার নিজেই উক্ত কাগজপত্র সঠিক হিসেবে মেনে নিতে আগ্রহী ছিল না। বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা এ সকল পুরানো পরিবারের জন্য হুমকি হিসেবে আসে, যারা সূর্যাস্ত আইনে ইতিমধ্যেই তাদের এস্টেট হারায় এবং লাখেরাজ ব্যবস্থায় তখন পর্যন্ত টিকে ছিল ।
বাজেয়াপ্ত আইন নতুন করে জমিদারদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ালে তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। দুটি ক্ষেত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। সরকারি কর্মকর্তারা অকুস্থলে জরিপের জন্য আসা মাত্র স্থানীয় প্রতিরোধ সংগঠিত করা হয়। আমিন ও রাজস্ব সংগ্রহকারী এজেন্টদের তাড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে লাঠিয়ালবাহিনী ব্যবহার করা হয়। ফলশ্রুতিতে গ্রামাঞ্চলে পুলিশ ও জমিদারের লাঠিয়ালদের সংঘর্ষ স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো ১৭৬০ এর দশকে জরিপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় এবং চট্টগ্রাম জমিদার বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে। ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার জে. জে. হারভের নিকট পাঠানো পত্রে জেলা প্রশাসক জমিদারদের আনুগত্যহীনতা ও অসন্তুষ্টির উল্লেখ করেন, যারা তাদের এলাকায় সরকারি এজেন্সির প্রবেশের বা সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিচ্ছিলেন না। পালিত (Palit) মন্তব্য করেন, “অবস্থার এমন অবনতি ঘটে যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অতিরিক্ত সামরিক বাহিনী তলবের প্রয়োজন হয়। ঢোল বাজিয়ে জনগণকে সতর্ক করা হয় যাতে তারা জরিপকারিদর (Measuring people) সাথে সহযোগিতা না করে এবং এলাকা থেকে তাদের বহিষ্কার করে। উভয় পক্ষে বহুজনের মৃত্যু হয় । কলকাতার এক পত্রিকা ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়াতে চট্টগ্রাম বিদ্রোহের ঘটনার বিবরণ নিম্নোক্তভাবে পরিবেশিত হয় :
“বাজেয়াপ্ত আইন বাস্তাবায়নে প্রথম রক্তপাত হয়েছে এবং আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি যে এটাই শেষ ঘটনা।” কিন্তু তা শেষ ছিল না, বরং ছিল প্রথম। সিলেট এবং ত্রিপুরাতে লাখেরাজদারগণ জমি জরিপ ও অনুদানের কাগজপত্র পরীক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রেরিত (১৮৪১) আমিন ও ডেপুটি কালেক্টরদের সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেন। সশস্ত্র সিপাহিসহ জরিপ কর্মকর্তাদের বিদ্রূপ, ইট-পাটকেল ইত্যাদির সম্মুখীন হতে হতো এবং প্রায়শ এগুলো সশস্ত্র সংঘর্ষের রূপ নিত, যাতে উভয় পক্ষের লোক প্রাণ হারাত। অন্যান্য জেলাতেও একই ধানের ঘটনা ঘটে। প্রতিরোধ ফ্রন্টপগুলো বিশেষভাবে শক্তিশালী ছিল সীমান্ত জেলাসমূহে যেমন- চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর মেদিনীপুর ইত্যাদি স্থানে, যেখানে লাখেরাজ ব্যবস্থা পর্যাপ্তভাবে বিদ্যমান ছিল, সেসব স্থানে জমিদাররা তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে ।
তবে বাজেয়াপ্তকরণ বিরোধী আন্দোলনের (Anti-resumption movement) একটি রাজনৈতিক দিক ছিল। মফস্বল এলাকায় ব্যক্তিগত প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো ছিল বিশেষভাবে স্থানীয় ও নির্দেশনাবিহীন, অকারণ সন্ত্রাসমুখী এবং এর ফলে অভিযুক্তদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো। ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিমালিকদের দাবিদাওয়া সাংগঠনিকভাবে পূরণের বিষয়টি ছিল সময়ের দাবি এবং এ প্রয়োজনেই ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা জমিদারি সঙ্ঘ (Zamindari Association of Calcutta ) প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল এ ধরনের প্রথম সংঘ, ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে যার পরিবর্তিত নাম হয় ভূম্যধিকারী সমিতি। (Landholder's Society)। এ সমিতি বাজেয়াপ্তকরণ ইস্যুকে মফস্বল এলাকায় সরকারি কর্মকর্তদের কঠোরতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে রূপান্তরিত করে এবং বাজেয়াপ্তকরণ নীতির বিরুদ্ধে স্থানীয় ও বিরুদ্ধবাদী অ্যাংলো- ইন্ডিয়ান পত্রিকাতে প্রবন্ধ লিখে এবং পার্লামেন্টে আবেদন জানিয়ে জনমত গঠনের চেষ্টা করে। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ২০,০০০ ক্ষতিগ্রস্তের স্বাক্ষরযুক্ত এক আবেদনপত্র ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রেরণ করা হয়। আবেদনকারিগণ যুক্তি উপস্থাপন করে যে বাজেয়াপ্তকরণ কর্মপন্থা আইনসিদ্ধ নয় এবং গ্রামাঞ্চলগুলো অকেজো লাখেরাজ অনুদান উদ্ঘাটনের জন্য নিয়োজিত অল্পবয়স্ক ও অশিক্ষিত ডেপুটি কালেক্টরদের দ্বারা নিপীড়িত হচ্ছে। আরও অভিযোগ করা হয় যে ডেপুটি কালেক্টরগণ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের অপপ্রয়োগ করছিল এবং দেশের অসহায় গোষ্ঠীকে ঠকিয়ে যাচ্ছিল। স্থানীয় প্রতিরোধ ও সমিতির আবেদন কর্তৃপক্ষেকে ১৮৪০-এর দশকে বাজেয়াপ্তকরণের সমগ্র প্রশ্নটি পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহিত করে। এর ফলে জমিদারদের ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন কিছুটা প্রশমিত হয় ।

৪. ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিরোধ : প্রতিরোধ আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিরোধ। প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার রাষ্ট্রশাসনকার্যে ধর্ম এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে ব্রিটিশপূর্ব সব সরকার জনগণের সকল ধর্মকে সম্মান প্রদর্শন করে। তখন সরকার শুধুমাত্র বহু ধর্মের উপস্থিতিকেই সহ্য করেনি, উপরন্তু উদারতার সাথে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহকে সহায়তা প্রদান করে। বিদেশি শাসকদের জন্য এটি ছিল ধর্মীয় গোষ্ঠীসমূহকে তুষ্ট রাখার রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু পশ্চিমা, খ্রিষ্টান ও মুনাফাকেন্দ্রিক কোম্পানি সরকার স্থানীয় ধর্মকে সম্মান প্রদর্শনের কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। এই সরকার স্থানীয় ধর্মকে শুধুই কুসংস্কার হিসেবে দেখতো এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবর্গকে পৃষ্ঠপোষকতা দানের কোনো রকম বাধ্যবাধকতা তাদের নেই বলে ভাবতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে ফকির, সন্ন্যাসী এবং অন্যান্য ভিক্ষুদেরকে মুষ্টি (Musthi) নামে গ্রামীণ গৃহস্থদের প্রদত্ত সাহায্য গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হতো না। ধর্ম ও শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে মাদাদ-ই-মাআশ অনুদান প্রদানের রীতি রহিত করে দেওয়া হয়। একইভাবে ধর্মীয় স্থান (shrine), মন্দির ও মসজিদের জন্য রাষ্ট্রীয় অনুদানও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি ফকির ও সন্ন্যাসীগণকে সদলবলে ত্রিশূল, শিকল ইত্যাদি সহকারে গ্রামাঞ্চলে অবাধে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি দেয় হতো না। ভ্রমণরত ভিক্ষুদেরকে প্রায়শই চুরি ও ছিনতাইয়ের দায়ে অভিযুক্ত করা হতো। এ পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানসমূহ স্পষ্টত ক্ষুব্ধ হয় এবং নতুন সরকারের অনুসৃত নীতির কারণে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তারা কোম্পানি সরকারকে তাদের বৈধ শাসক হিসেবে মানতে অস্বীকার করে এবং শুরু থেকেই প্রতিরোধ সংগঠিত করতে থাকে। ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিরোধ আন্দোলন সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করে ।
ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম এবং সর্বাধিক সংগঠিত বিদ্রোহ গড়ে তোলেন ফকির মজনু শাহ। তিনি ফকিরদের মাদারীয়া অংশের বুরহানা সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। ফকিরদের সদর খানকাহ্ ছিল বিহারের কানপুর জেলার মাখনপুরে। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ছিল মজনু শাহের নিজস্ব মুরিদদের এক বিশাল নেটওয়ার্ক । এঁরা দেশের সকল স্থানে ফিরিঙ্গিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য মজনু শাহের নিকট থেকে নির্দেশ লাভ করতেন। যদিও ফকির প্রতিরোধ ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়, তবে ১৭৭০-এর দশকের শুরুতে তা সাংগঠনিক দৃঢ়তা লাভ করে এবং ১৭৮০-এর দশকের শেষাবধি সক্রিয় থাকে। এই আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে যখন এর নেতা কোম্পানি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষকালে সম্ভবত ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে নিহত হন। কিন্তু প্রতিরোধ আন্দোলন অব্যাহত থাকে ।
এরপর ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ফকিরগণ মজনু শাহের ভ্রাতা মুসা শাহের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ, জাফরশাহী ও শেরপুর পরগনা দখল করে নেন। তাদেরকে এই পরগনাগুলো থেকে বহিষ্কারের জন্য কালেক্টরগণ ঢাকা থেকে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু ফকিরগণ শীঘ্রই গেরিলা কৌশল অবম্বন করে নিরাপদ স্থানে পশ্চাদপসরণ করেন এবং উক্ত পরগনা থেকে সৈন্যবাহিনী চলে যাওয়া মাত্র তারা ফিরে আসেন এবং তাদের বৈধ শাসক হিসেবে ব্রিটিশদের স্বীকার না করার জন্য জনগণকে প্ররোচিত করেন। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে মজনু শাহ স্বয়ং বাংলার প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাঁর সম্পর্কে কলকাতা সরকার ঢাকার চীফের নিকট লেখে, “আমরা গোয়েন্দা সূত্রে খবর পেয়েছি যে মজনু শাহ সৈন্যবাহিনীসহ সিলবারিস জেলায় প্রবেশ করেছে এবং আশা করছি যে আপনার জেলাকে তার ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য দেশে ছড়িয়ে থাকা সিপাহিদের একত্র করে এবং যুদ্ধের জন্য মোতায়েন করে আপনি যতদুর সম্ভব তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করবেন.....।” ফকিরদের উৎখাতের জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তাদেরকে কদাচিৎ চিহ্নিত করা গেছে। স্থানীয় জনগণের সহায়তায় ফকিরগণ সর্বদাই সরকারি বাহিনীর সাথে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে যেতে সক্ষম হন। ফকিরবাহিনীর হয়রানি কৌশল এমন গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছায় যে কোম্পানির বাহিনী মোতায়েন থাকাকালে বাইরে থেকে গ্রামাঞ্চলকে কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত মনে হতো, কিন্তু এ বাহিনী প্রত্যাহৃত হলে কার্যত তা ফকিরদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেত। এ অবস্থার সাথে কার্যকরীভাবে মোকাবিলা করার জন্য কলকাতা সরকার এর গুপ্ত গোয়েন্দা বিভাগকে আরও সক্রিয় করার এবং সরাসরি গভর্নর জেনারেলকে দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড ও পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঐ সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয় :
কাউন্সিলসহ গভর্নর জেনারেলের অভিমত এই যে মজনু শ [মজনু শাহ] এবং তার অনুগতদের আক্রমণ ও ক্ষতি থেকে দেশকে রক্ষার জন্য এ যাবৎ গৃহীত পদক্ষেপের চেয়ে আরও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। অতএব তার এবং তার প্রধান সহযোগীদের সম্ভাব্য গ্রেফতার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তাকে অনুসরণ, তার আস্তানা ও গতিবিধি চিহ্নিকরণ এবং কীভাবে তিনি জীবনযাপন করেন তা জানার জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করতে আপনাকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে...এ বিষয়ে গভর্নর জেনারেল ও পরিষদের অবগতির জন্য আপনি শুধুমাত্র আমার সাথে যোগাযোগ করুন ।
১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে শুরু থেকে ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কিত যথেষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই। ধারণা করা হয় যে মজনু শাহ ১৭৮৭ অথবা ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে কোনো এক সময় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বুরহানা ফকির প্রতিরোধ আন্দোলন ক্রমান্বয়ে স্তিমিত হয়ে আসে। শেষ প্রতিরোধটি ঘটে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন শাহ বাহারপুর নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং নিজেকে হিন্দুস্থানের ‘রাজা' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এতে প্রতিরোধ আন্দোলন নতুন রূপ পরিগ্রহ করে ।
দৃশত ফকিরদের স্বাধীনতা ঘোষণা ১৭৮০ এবং ‘৯০-এর দশকে সম্ভবত এক রীতি (Fashion) হয়ে দাঁড়ায়। কুমিল্লা জেলার কালু ফকির, যাঁকে বিভিন্ন পরিচয়ে, যেমন- হুল্লি ফকির, হাল্লা ফকির এবং আল্লাহ ফকির নামে ডাকা হতো, সেই ব্যক্তি কৃষক, জোতদার, তালুকদার ও জমিদারদেরকে তাঁর অধীনে সংগঠিত করেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর অনুগত প্রজা হিসেবে থাকার বিনিময়ে ব্রিটিশদের কাছ থেকে খাজনা দাবি করেন। ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালের বলাকী শাহ ‘নির্যাতিত রায়তদের' স্বার্থ তুলে ধরেন এবং জীয়ন নামে এক পরামর্শদাতাকে 'সুলতান' হিসেবে নিয়োগ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঢাকা জেলা কালেক্টরের (বরিশাল তখন ঢাকা জেলার অংশ ছিল) প্রতিবেদন অনুযায়ী “বলাকী শাহ নামে এক ব্যক্তি এক সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন এবং কতিপয় পরগনায় জমিদারদের আটক করে..... এবং রাজস্ব আদায় করে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। এক সরকারি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে ঐ ফকির তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য কয়েক হাজার সশস্ত্র লোক সংগ্রহ করেন এবং সালিমাবাদ, নাজিপুর ও চন্দ্রদ্বীপ পরগনার সকল জমিদারকে ব্রিটিশদের পরিত্যাগ করতে এবং তাঁকে প্রধান বা চিফ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করেন। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে “ঐ ফকির ঢোল বাজিয়ে ঘোষণা করেন যে ফিরিঙ্গিদের শাসন শেষ হয়েছে ও তারা পালিয়ে গেছে এবং যদি কেউ ভবিষ্যতে ফিরিঙ্গিদের খাজনা দেয়, তবে তাকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে।” বলাকী শাহের নিয়ন্ত্রণাধীন সকল পরগনায় ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে বৃদ্ধিকৃত সকল কর বিলুপ্ত বরা হয়। রাজস্বের হার হ্রাস করে বলাকী শাহ ঘোষণা করেন যে প্রতি কানি (প্রায় এক একর) জমির জন্য দুই রূপী খাজনা নেওয়া হবে; কেউ তার অধিক নিয়ে ঢাকলে ফেরত দিতে হবে, অন্যথায় তাকে জরিমানা করা হবে।” এভাবেই ফকিরদের প্রতিরোধ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে ।
ব্রিটিশ কোম্পানি সরকার কর্তৃক দুঃসাহসী বলাকী শাহকে দমন করার জন্য ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত এক শক্তিশালী সিপাহিবাহিনী প্রেরিত হয়। বলাকী শাহের মাটির দুর্গে (Mud fort) আক্রমণ চালিয়ে তাঁকে বন্দি করা হয় । ঢাকার নিজামত আদালত তাঁকে বিদ্রোহ ও রক্তপাতের দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত করে এবং সাত বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। আমরা ব্রিটিশ শাসন বিরোধী ধর্মীয় গোষ্ঠীর আরও অনেক প্রতিরোধের উদাহরণ দিতে পারি। এসব স্থানীয় প্রতিরোধ ইঙ্গিত দেয় যে জনগণ, বিশেষ করে ধর্মীয় গোষ্ঠীসমূহ, যারা সাধারণ রায়ত হিসেবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তারা নতুন সরকারকে সামগ্রিকভাবে মেনে নেয়নি। তাই রায়তদের সমর্থনে তারা তথাকথিত স্বাধীনতা ঘোষণা করে তাদের প্রতিবাদ ব্যক্ত করে। স্থানীয় পর্যায়ে তাদের স্বাধীনতা জনগণের সত্যিকার জাতীয়তাবাদী চেতনার ইঙ্গিত দেয় না, বরং ঔপনিবেশিক শাসকের বিধিবিধান তাঁর কর্মচারিগণ আসার পূর্বেই পল্লি অঞ্চলে পৌছে যেত । প্রতিরোধকারী জনগণ নতুন শাসকদের সম্পর্কে শুনে থাকলেও তাদেরকে কাদাচিৎ চোখে দেখেছিল। এজন্য সহজেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয় ৷ এক কথায়, গ্রামাঞ্চলের মানুষ নতুন শাসকদের অধীনে সুখী ছিল না, তাই নতুন অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে যিনি এগিয়ে আসতেন তাঁকেই তারা সহযোগিতা প্রদান করতে প্রস্তুত থাকত। এভাবেই প্রতিরোধ আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ বিরোধী ধর্মীয় স্বতঃস্ফূর্ত ও বিচ্ছিন্ন স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলন ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে শেষ হয়ে যায়, যখন ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগঠন পূর্ণতায় পৌঁছে এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে ৷ সমাজের শিক্ষিত ও সচেতন শ্রেণি হিসেবে ধর্মীয় গোষ্ঠীসমূহ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে বাস্তবতার নিরিখে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে এবং নতুন শাসকগোষ্ঠীর সাথে সমঝোতায় আসে, যদিও ময়মনসিংহের শেরপুরের ন্যায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখনো ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের অনুপ্রবেশ ঘটে নি, যেখানে পুরানো কায়দায় ধর্মীয় প্রতিরোধ লক্ষ করা গেছে। শেরপুর ও সুসাং পরগনায় টিপু শাহ ও তাঁর উপজাতীয় অনুসারিগণ নতুন শাসকের ভূমিনীতি মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং প্রথমে ১৮২৪ ও পরে ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। টিপু ও তাঁর অনেক অনুসারীকে বন্দি করে শাস্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিতুমীর, শরীয়তুল্লাহ ও দুদু মিয়ার সাথেও নতুন শাসক ও তার স্থানীয় প্রতিনিধি জমিদারদের সংঘর্ষ হয়। কিন্তু তাঁদের বিদ্রোহের এক নতুন মাত্রা ছিল। ঔপনিবেশিক শাসকের সাথে তাঁদের দ্বন্দ্ব ইসলামি সংস্কার আন্দোলনের কারণে ঘটে, প্রত্যক্ষভাবে স্বার্থের সংঘাতের কারণে নয়। এভাবে সংস্কারবাদী ও রক্ষণশীলদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। জমিদারগণ ও সরকার আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় হস্তক্ষেপ করে এবং ফলশ্রুতিতে কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ দেখা দেয়। তথাকথিত ওয়াহাবি আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার সাথে সাথে গোষ্ঠী দ্বারা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে ধর্মীয় গোষ্ঠীর তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলন ব্রিটিশদের ভালোই ভুগিয়েছে ৷
৫. এথনিক প্রতিরোধ : প্রতিরোধ আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এথনিক প্রতিরোধ। সমাজের প্রভাবশালী সংখ্যাগরিষ্ঠের নিকট উপজাতি হিসেব পরিচিত বাংলার এথনিক সংখ্যালঘু জনগণ প্রধানত পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণের সীমান্তে উপ- পার্বত্য (Sub-montane) অঞ্চলে বাস করতো। সীমান্তের প্রান্তিক সমাজ হিসেবে এথনিক গোষ্ঠীগুলো বাঙালিদের থেকে অপেক্ষাকৃত বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতো। এমনকি তারা নিজেরাই একে অপর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতো। প্রতিটি উপজাতির নিজস্ব এলাকা এবং জীবনপ্রণালি ছিল। স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রের প্রতিটি উপজাতি স্ববিবর্তিত ব্যবস্থা অনুসারে জীবনযাপন করতো এবং তারা কদাচিৎ বহিঃস্থ প্রভাব ও হস্তক্ষেপ করতো। কিন্তু কোম্পানি সরকার এ সকল সীমান্ত-অঞ্চলকে রাজস্বের উৎস হিসেবে বিবেচনা করে। উপ-পার্বত্য এলাকাসমূহকে কোম্পানি রাষ্ট্রের আওতাধীনে আনা হয় এবং উপজাতির জনগণকে নগদ অর্থ বা দ্রব্যে রাজস্ব পরিশোধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ধরনের বিনিময়ের মাধ্যম উপজাতিদের নিকট অজ্ঞাত বিষয় ছিল । তাই উপজাতিরা এ নির্দেশ অমান্য করে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ।
দৃশ্যত উপজাতীয় সমাজগুলোর নিকট রাষ্ট্রের আইনের বশ্যতা স্বীকার এক অজানা অভিজ্ঞতা ছিল এবং স্পষ্টত তারা এ জাতীয় বশ্যতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই যে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া ও উপজাতির বিদ্রোহের মধ্যে একটা ধনাত্মক সম্পর্ক ছিল। এ বক্তব্যের সপক্ষে অনেক উদাহরণের মধ্যে মাত্র তিনটি প্রতিনিধিত্বশীল উপজাতি বিদ্রোহের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো, যেগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রকম ।
৬. খাসি প্রতিরোধ : প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো খাসি প্রতিরোধ। স্থানীয় জনগণকে, বিশেষকরে খাসি জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে রবার্ট লিন্ডসেকে সিলেটে রেসিডেন্ট (Resident) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি এ অঞ্চল সম্পর্কে মানসিক জরিপ চালিয়ে পাহাড়ি সমাজে ব্যবসা ও বাণিজ্যের বিপুল সম্ভাবনা লক্ষ করেন। খাসি পাহাড়গুলোতে প্রচুর পরিমাণে জাহাজ নির্মাণ সামগ্রী, কাঠ, লোহা, সিল্ক, মোটা বা অসূক্ষ্ম মসলিন, হাতির দাঁত, মধু, আঠা, কমলালেবু ইত্যাদি পাওয়া যেত। কিন্তু খাসি জনগণের অর্থনীতি কোম্পানির সাথে ব্যবসায় করার অনুকূল ছিল না। অধিকন্তু লিন্ডসে মন্তব্য করেন, “গ্রামের প্রত্যেক চিফ (Chief) নিজেকে রাজা হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং নিজস্ব এলাকায় তাঁর স্বাধীন সরকার রয়েছে।” গ্রামে চিফের স্বাধীন অস্তিত্ব সম্পর্কে লিন্ডসে আরও উল্লেখ করেন, “তারা নিজস্ব ধারণায় পুরোপুরি স্বাধীন। আমি রাজা ও প্রধান ব্যক্তিদের সাথে প্রায়শ পূর্বে যোগাযোগ করে সাক্ষাৎ করেছি, কিন্তু একেবারে সমভাবে তা সম্ভব হয়নি, কিছু ক্ষেত্রে তারা সাক্ষাৎ দানে অস্বীকার করে। তারা আমাকে কোনো উচ্চ পর্যায়ের মর্যাদা দেয়নি এবং নিজেদের পরিণাম সম্পর্কে তারা ছিল নাছোড়বান্দা (Tenacious)।” লিন্ডসের মতে, ব্যবসার উদ্দেশ্যে পাহাড়ি সমাজে অনুপ্রবেশ করা তাদের স্বাধীন মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করে সম্ভব ছিলনা। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র খাসি জনগোষ্ঠীকে কোম্পানি সরকারের আওতাধীনে আনার জন্য সীমিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং তা পাহাড়ি জনগণের তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের কারণ হয়। এ প্রতিরোধ আন্দোলন ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করে ।
দৃশ্যত খাসিরা পশ্চিমে পান্দুয়া থেকে পূর্বে লাউর পরগনা পর্যন্ত সমতলের জমিদারদের সাথে আঁতাত করে এবং কোম্পানির রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়াকে নাজেহাল করে । খাসি জনগোষ্ঠীর সংহতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে সরকার সফলতার সাথে চিফদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করে এবং তাদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি করে। ১৭৮৩ থেকে ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত খাসি জনগোষ্ঠীকে তাদের অধিকৃত সমতল ভূমি থেকে বের করে পাহাড়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে অনেকগুলো সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়। তাদের নিজস্ব ভূমি থেকে তাড়িয়ে পাহাড়ে উদ্বাস্তু করার পর আপস মীমাংসার দ্বার উন্মুক্ত করা হয় এবং বলা হয় যে “তারা শান্তিপূর্ণ আচরণ সাপেক্ষে কোম্পানির এলাকায় ব্যবসার উদ্দেশ্যে খোলাখুলি আদান প্রদান করতে পারবে; তাদেরকে সশস্ত্রভাবে চলার অনুমতি প্রদান করা হবে না; এবং যদি তারা কোম্পানির চৌহদ্দিতে শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করে অথবা তাদের এলাকায় আক্রমণ চালায়, তবে ব্যক্তিগত শত্রু ও অনধিকারপ্রবেশকারী হিসেবে তাদের শাস্তি প্রদানের নির্দেশসহ তাদের অঞ্চলে তৎক্ষণাৎ সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করা যাবে।” খাসি প্রতিরোধ আন্দোলনের নায়ক ছিলেন গঙ্গা শাহ, যাঁকে ব্রিটিশ বাহিনী বন্দি করে। কোম্পানিকে অবজ্ঞা করার দায়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এতে তাদের প্রতিরোধ দমন করা সম্ভব হয়নি।
৭. চাকমা প্রতিরোধ : প্রতিরোধ আন্দোলনের বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চাকমা প্রতিরোধ। খাসি ভূমির ন্যায় পার্বত্য অঞ্চলেও ব্যবসায় ও রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনা কোম্পানি রাষ্ট্রকে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে এবং পার্বত্য জনগোষ্ঠী চাকমাদের অনুরূপ প্রতিরোধের সম্মুখীন করে। চাকমারা মুঘলদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, কারণ মুঘল শাসনে সুতার বিনিময়ে রাজস্ব প্রদান ব্যতিরেকে তাদের কাছ থেকে আর কোনো কিছু দাবি না করে তাদেরকে পুরোপুরি স্বাধীনভাবে নিজস্ব জীবনযাপনের অনুমতি দেওয়া হতো। ১৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা চিফ শেরমস্ত খান পার্বত্য
এবং চাষাবাদযোগ্য চাকলা রাঙ্গুনিয়া অঞ্চলের জমিদারি সনদ লাভ করেন এবং জমিদার হিসেবে চাকমা চিফ সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে আসেন। ঔপনিবেশিক সরকার স্বায়ত্তশাসনের পুরানো নীতি বাতিল করে চাকমাদেরকে সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায় । তাদেরকে নগদ রাজস্ব প্রদান করতে বলা হয়। রাঙ্গুনিয়া জমিদারিতে খাজনার হার বৃদ্ধি করা হয়। যখন চাকমা রাজা জুয়ান বক্স বর্ধিত খাজনা প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানালেন, তখন রাঙ্গুনিয়া এস্টেটকে কলকাতার এক বোনিয়ার নিকট ইজারা দেওয়া হয়। রাজার খাজনামুক্ত ভূমিসমূহ পদখল (Resumed) করা হয়। এসব পদক্ষেপ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে এত বেশি ক্ষুব্ধ করে যে ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং রাজার দীউয়ান রানু খানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এতে ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।
দৃশ্যত সাংগঠনিকভাবে রানু খান গেরিলা কৌশল অবলম্বন করেন। তাদের যুদ্ধকৌশল ছিল আঘাত করে সরে পড়া (Hit-and-run)। রানু খান ছিলেন সামরিক সর্বাধিনায়ক। তাঁর অধীন বেশ ক'জন সেনাপতি (Commander) ছিলেন। আবার তাঁদের নিয়ন্ত্রণে ছিল পালোয়ান নামে সৈনিকরা, যাদের অধিকাংশ কুকী গোষ্ঠী থেকে সংগ্রহ করা হয়। দাপ্তরিক বিবরণী ইঙ্গিত দেয় যে জুয়ান বক্স এবং রানু সমগ্র রাঙ্গুনিয়া ও সমতলসংলগ্ন অন্যান্য এলাকাতেও সম্প্রসারিত করেন। পূর্বতন জমিদারি রাঙ্গুনিয়া অঞ্চলের উপর তাদের আক্রমণের মূল চাপ কেন্দ্রীভূত ছিল। ১৭৭৭ থেকে ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে তিনটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক কঅভিযান প্রেরিত হয়, কিন্তু বিদ্রোহীদের পরাভূত করার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। প্রতিরোধী চাকমাদের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভিযানের বর্ণনা দিয়ে চট্টগ্রাম কর্তৃপক্ষ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে লিখে ৷
“....যেহেতু এই লোককে (রানু খান) সর্বদা মর্যাদাহীন এবং বিবেচনার অযোগ্য ব্যক্তি বলে গণ্য করা হয়েছে, আমি আশা করেছিলাম যে তাকে আটক করে অবিলম্বে তার অশুভ উদ্দেশ্য এবং কর্মকাণ্ডের সমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হব, কিন্তু আমার কর্মসূচি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। লোকটি নিজস্ব বাসভূমি থেকে পালিয়ে যায় এবং তার বিরুদ্ধে প্রেরিত ৫০ জন সিপাহি প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়, তারা শত্রুকে অনুসরণ করে এবং দুই বা তিনটি পাহাড় ও গ্রাম দখল করে এবং জ্বালিয়ে দেয়, যেখানে তারা অগ্রবর্তী ছিল; এটি তাকে বশে আনতে পর্যাপ্ত ছিল না; সে আরও অধিক সংখ্যক লোক জড়ো করে, তারা তেমন সশস্ত্র না থাকলেও অভিযানকালে কিছু সিপাহিকে হয়রানি করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সেনাপতি (Commanding Officer) ক্যাপ্টেন এলারকার গতকাল অতিরিক্ত বাহিনী প্রেরণ যথাযথ বিবেচনা করেন, যার ফলে নিয়োজিত সিপাহি সংখ্যা .দাঁড়ায় সর্বমোট ১১৫ জন যাদেরকে বাধাদান করে বিপুল সংখ্যক কুকী উপজাতির লোক । এদেরকে ডেকে এনেছে রুনু কন (Runoo Cawn) এরা বাস করে পাহাড়ের অনেক অভ্যন্তরে। এরা অস্ত্র ব্যবহার করতে জানে না এবং এদের দেহ থাকে অনাবৃত ৷ ”
পূর্ববঙ্গের সিলেটে যখন চাকমাদের প্রতিরোধ চলছিল, তখন এ প্রতিরোধ মোকাবিলার উদ্দেশ্যে প্রথমে সমতলের পরগনা থেকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে তাড়িয়ে এ এলাকাকে তাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার এবং তারপর দীর্ঘস্থায়ী মীমাংসার জন্য আলাপ আলোচনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু যখন চাকমা নেতা কোম্পানির সাথে সমঝোতায় আসতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তখন আরও কঠোর ও অমানবিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সব ধরনের দ্রব্য, যেমন- শুকনো মাছ, লবণ, মৃন্ময় দ্রব্য, লৌহ দ্রব্য, মুদি দ্রব্য, মশলা ইত্যাদির সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, যেগুলোর উপর পাহাড়ি জনগণ পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল। এ অবরোধ খুব বেশি সফল হয় নি, কারণ বিদ্রোহী বাহিনী অন্যান্য স্থান থেকে বিকল্প সরবরাহের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়। আবার যখন সিলেটে বিদ্রোহ বিস্তার লাভ করে, তখন চট্টগ্রাম কর্তৃপক্ষ বিদ্রোহীদের নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালায় এবং এদের এক জনের পক্ষ নিয়ে অন্য জনকে পরাভূত করতে সচেষ্ট হয়। গুপ্তচরের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং শীঘ্রই তিনি রাজাকে বহিষ্কারের উচ্চ অভিলাষ নিয়ে আঘাত হানবেন। এ কৌশলে কাজ হয়। রানু খানের অগোচরে জুয়ান বক্স সরকারের সাথে গোপন আলোচনা শুরু করেন, যার ফলে গভর্নর জেনারেল জুয়ান বক্সকে কলকাতায় গিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য আমন্ত্রণ জানান । এতে জুয়ান বক্স সাড়া দেন ৷
১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে জুয়ান বক্স কলকাতায় যান এবং সরকারের সাথে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এতে বলা হয়, কোম্পানি সরকার তাঁকে বৈধ চিফ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে এবং তিনি স্বাধীনভাবে তাঁর এলাকা শাসন করবেন। আরও ঐকমত্য হয় যে জুয়ান বক্স রাঙ্গুনিয়া পরগনায় তাঁর জমিদারিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন এবং অন্যান্য জমিদারের মতো কোম্পানি রাষ্ট্রের একজন জমিদার হিসেবে দেশের সাধারণ আইনের আওতাভুক্ত হবেন। রানু খান, যিনি প্রত্যাখ্যাত হন, তিনি নির্জন স্থানে গমন করেন এবং তাঁর সম্পর্কে আর কিছু শোনা যায়নি। তবে তাদের প্রতিরোধ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায় ।
৮. সাঁওতাল প্রতিরোধ : প্রতিরোধ আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাঁওতাল প্রতিরোধ। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার উপজাতীয় জনগণের যারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিদ্যমান সমস্যার প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তারা হচ্ছে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তারা প্রচণ্ড প্রতিরোধ সংগঠিত করে, যে শাসন তাদের সংস্কৃতি ও নিজস্ব জীবন প্রণালির প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এ প্রতিরোধের বেশ কিছু কারণ নরহরি কবিরাজ যথার্থভাবে চিহ্নিত করেছেন। কারণগুলো হলো-“মহাজনের নিপীড়ন, জমিদারের অত্যাচারের বর্ধিত খাজনা আরোপ, ইউরোপীয় রেলওয়ের ঠিকাদার কর্তৃক বলপ্রয়োগে শ্রমিক খাটানো, মাঁঝি (Manjhi) ও পরগনাইত (Parganait)-এর অধিকার হ্রাসকরণ ইত্যাদি।” সাঁওতাল সমাজ কাঠামোতে শাসক এলিটশ্রেণি ছিল মাঁঝি (Manjhi) নামে বংশগত শ্রেণি, যার পরে ছিল পরগনাইত বা পরগনাইত বা পরগনাপ্রধানগণ । তাদের আধিপত্য আধুনিক রেলব্যবস্থা, শ্রমব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হয়। উক্ত শাসক শ্রেণি অন্যান্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং বীরভূম জেলা ও ভাগলপুর সংলগ্ন পরগনাগুলোর উপর দরিদ্র মানুষের শাসন (Poor manÖs raj) প্রতিষ্ঠা করে। বিদ্রোহীরা ব্রিটিশদের শান্তি প্রস্তাব তখনই মেনে নেয়, যখন ঐতিহ্যবাহী স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা সহ তাদের সকল দাবি সরকার পূরণ করে। এতে সাঁওতাল বিদ্রোহের আবসান ঘটে।
প্রতিরোধ আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো কৃষক প্রতিরোধ। মুঘলদের ছিল একটি প্রধানত কৃষিভিত্তিক সাম্রাজ্য এবং তার অধীনে ছিল প্রধান উৎপাদকগোষ্ঠী হিসেবে রায়তগণ, যারা রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশেষ মর্যাদা ভোগ করতো। যদিও জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত কৃষি-উদ্বৃত্তের প্রায় সবটুকুই করের আকারে আদায় করা হতো, তথাপি রায়াতদেরকে নিপীড়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ এবং অভাব-অনটন থেকে নিস্তার লাভের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধা ভোগের অনুমতি দেওয়া হয়। মুনাফা শিকারি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র দুঃসময়ে খাজনা মওকুফ এবং তাকভি ঋণের মতো কোনো সুবিধা প্রদান ছাড়াই সকল কৃষকের উদ্বৃত্ত আদায়ে বদ্ধপরিকর ছিল। সরকারের ভূমিনীতি প্রজাদেরকে সরকারি প্রতিনিধি তথা ভূস্বমীদের শোষণের শিকারে পরিণত করে। যে ঐতিহ্যবাহী গ্রামপঞ্চয়েত প্রথাগতভাবে গ্রামে আইনশৃঙ্খলা তদারক করতো, তার জন্য সরকারি সহায়তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ৷ বিচ্ছিন্ন (Alienated) গ্রামসমাজ তখন অসহায়ভাবে রাষ্ট্র ও তার প্রতিনিধি, যেমন— জমিদার, তালুকদার, ইজারাদার, বানিয়া, ব্যবসায়ী, একচেটিয়া কারবারি, আমলা প্রভৃতি শোষণের শিকার হয়। কৃষক সমাজ বিভিন্ন সময়ে এদের বিরুদ্ধে এবং মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদের অবিভক্ত বাংলার সর্বত্র প্রতিরোধ আন্দোলন তুঙ্গে উঠে।
কৃষক বিদ্রোহকে এর অন্তর্নিহিত কারণগুলোর প্রকৃতি অনুসারে তিনটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। কারণগুলো হচ্ছে- (১) কৃষকদের খাজনা ও অধিকার সংক্রান্ত নীতি বা প্রথা লঙ্ঘন; (২) প্রচলিত খাজনার হার অগ্রাহ্য করে যুক্তিহীনভাবে খাজনার হার বৃদ্ধিকরণ; এবং (৩) কৃষিশ্রম শোষণ। উপরোক্ত তিন পর্যায়ের বিদ্রোহ থেকে আমরা উদাহরণ হিসেবে প্রধান প্রধান কৃষক প্রতিরোধের উল্লেখ করব যেগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রায় একই প্রকৃতির ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]