ফরায়েজি আন্দোলন ও দুদু মিয়া

প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে আরেক মুসলিম প্রতিরোধ যোদ্ধা হলেন দুদু মিয়া। হাজি শরীয়তুল্লাহ মৃত্যুবরণ করলে (১৮৪০ খ্রি.) হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও নমশুদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত রায়ত ও চাষিরা তাঁর সুযোগ্য পুত্র ও উত্তরসূরি মুহসিনউদ্দীন আহমদ ওরফে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে দলবদ্ধ হয়। ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে দুদু মিয়ার জন্ম হয় * এবং মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁকে শিক্ষার জন্য মক্কা শরিফে পাঠানো হয়। ৫ বছর পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। দুদু মিয়া পিতার মত খ্যাতিমান আলেম ছিলেন না, কিন্তু তিনি অসাধারণ সংগঠকগুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি ফরায়েজিদেরকে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করে তাদের মধ্যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস জাগরিত করেন। দুদু মিয়ার অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে ফরায়েজিরা একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ফরায়েজিদের কাছে দুদু মিয়া ‘ওস্তাদ' বা ‘মৌলবি' হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার থেকে নিপীড়িত রায়ত ও চাষিদেরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে দুদু মিয়া বাংলার পুরাতন ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংগঠন পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন করেন এবং সাম্য ও ন্যায় বিচারের মাধ্যমে সব রকম ঝগড়া বিবাদ ও মামলা মোকদ্দমা সালিশের মাধ্যমে মীমাংসার ব্যবস্থা করেন। ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত কোর্ট কাচারির বিচারের তুলনায় দুদু মিয়ার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ফরায়েজি অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে কোর্ট কাচারিতে মামলা মোকদ্দমা দায়ের বহু হ্রাস পায় ।
ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রজারা পূজাকর দিতে অস্বীকৃতি জানালে কানাইপুরের শিকদার জমিদারগণ ও ফরিদপুরের ঘোষ জমিদারগণ প্রজাদেরকে নানা প্রকার অপমানজনক ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেন। এই অত্যাচারের প্রতিকারের জন্য দুদু মিয়া ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে এক লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে কানাইপুর অভিমুখে রওনা হন। জমিদার দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে সাহসী হলেন না; বরং আপস করতে বাধ্য হন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, মুসলমান প্রজাদের নিকট থেকে সকল প্রকার অন্যায় কর ও পূজা কর আদায় করবেন না এবং প্রজাদের প্রতি নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা নিবেন না। এরপর ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে দুদু মিয়া ফরিদপুরের ঘোষ জমিদারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান। ফরায়েজিরা জমিদারদের বাসস্থান আক্রমণ করে এবং লুণ্ঠন করে। জমিদারের ভাই মদন নারায়ণ ঘোষকে তারা বন্দি করে আনে। এই ঘটনার জন্য দুদু মিয়ার ১১৭ জন অনুসারীকে গ্রেফতার করা হয়। দুদু মিয়াকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে তিনি বেকসুর খালাস পান। অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ফলে প্রজাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে দুদু মিয়ার নাম দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দুদু মিয়ার বক্তব্য ছিল সকল মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি এবং সেজন্য সকল মানুষ সমান। কাজেই আল্লাহর সৃষ্টি পৃথিবীতে কর ধার্য করার অধিকার কারও নেই। এই প্রচার উৎপীড়িত কৃষকদের মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল । প্রজাগণ দলে দলে প্রজা আন্দোলনে যোগদান করে ।
দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য হিন্দু জমিদারেরা নীলকরদের প্ররোচিত করে। এই ক্ষেত্রে প্রভাবশালী নীলকর এনিড্রিউ এন্ডারসন ডানলপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জেমস ওয়াইজ-এর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মি. ডানলপ তাঁর প্রভাব খাটিয়ে দুদু মিয়াকে দুবার গ্রেফতার করান। তাঁর বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে অভিযোগ বাতিল হয়ে যায়। কালি প্রসাদ কাঞ্জিলাল নামক জনৈক ব্রাহ্মণ গোমস্তা ডানলপের পঞ্চচর নীলকুঠির দেখাশুনা করতো। কালি প্রসাদ কাঞ্জিলালের দৌরাত্ম্য প্রজাগণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ইংরেজদের ছত্রছায়ায় থেকে এই গোমস্তা দুদু মিয়ার সঙ্গে চরম শত্রুতা শুরু করে এবং অধিকাংশ ফরায়েজি কৃষকদের সে নীল চাষ করতে বাধ্য করে। এই গোমস্তা দুদু মিয়ার বাহাদুরপুরের বাড়িতে তার দলবল নিয়ে ডাকাতি করে অর্ধলক্ষ টাকার মালামাল লুণ্ঠন করে এবং ৪ জন চৌকিদারকে হত্যা করে। ডানলপ সাহেবের প্রভাবে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট এই ডাকাতির কেস উপেক্ষা করে। অগত্যা দুদু মিয়া নিজেই কাঞ্জিলালের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। জেমস ওয়াইজ লিখেছেন, “১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর এক বিরাট সশস্ত্র বাহিনী পঞ্চচরের কুঠি আক্রমণ ও ধূলিসাৎ করে। তারা পার্শ্ববর্তী গ্রাম লুণ্ঠন করে এবং ব্রাহ্মণ গোমস্তাকে বন্দী করে আনে; পরে বাকেরগঞ্জ জেলায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।” এ ব্যাপারে দুদু মিয়া ও অন্যান্য ৬৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। জেলা কোর্টে তাঁদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পরে সদরে নিজামত আদালতে আপিল করা হয় এবং এর বিচারে তাঁরা খালাস পান। এই ঘটনার পর থেকে জমিদার ও নীলকরগণ দুদু মিয়াকে সমীহ করে চলতেন এবং ফরায়েজি প্রজাদের নিকট থেকে অবৈধ কর আদায় ও তাদেরকে অযথা হয়রানি করা থেকে বিরত হন ।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ সরকার দুদু মিয়াকে গ্রেফতার করে কলকাতার জেলে আটক রাখে। কারণ সরকারের আশঙ্কা হয় যে, তিনি এ বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। জেমস ওয়াইজ লিখেছেন যে, দুদু মিয়া আদালতে বলেছিলেন যে, তাঁর আহ্বানে ৫০,০০০ লোক সাড়া দিবে এবং তিনি তাদেরকে যেখানে যেতে বলবেন তারা সেখানেই যাবে। দু বছর পর দুদু মিয়া জেল থেকে ছাড়া পান। বাড়িতে ফেরার পর ফরিদপুরের পুলিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে আবার গ্রেফতার করে। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ছাড়া পান এবং ঢাকার ১৩৭ নম্বর বংশাল রোডে বসতি স্থাপন করেন। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং বাসস্থানের সংলগ্ন স্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
দুদুমিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর তিন পুত্র গাজিউদ্দীন হায়দর (১৮৬২-৬৪ খ্রি.), আবদুল গফুর ওরফে নয়ামিয়া (১৮৬৪-৮৩ খ্রি.) এবং খান বাহাদুর সইফউদ্দীন আহমদ (১৮৮৩-১৯০৬ খ্রি.) যথাক্রমে ফরায়েজিদের নেতৃত্বে গ্রহণ করেন। খান বাহাদুর সইফউদ্দীন রশিদউদ্দীন ওরফে বাদশা মিয়া নেতা নির্বাচিত হন। সইফউদ্দীন ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেন। বাদশাহ মিয়া খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাঁকে কিছুদিন অন্তরিন রাখা হয়। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর তিনি পরলোক গমন করেন ।
দুদুমিয়ার মৃত্যুর পর থেকেই যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ফরায়েজি আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই সময় জমিদারেরা ফরায়েজিদের উপর অত্যাচার শুরু করে। জৌনপুরের মাওলানা কেরামত আলী ফরায়েজি আন্দোলনের বিরোধীতা করেন এবং তাঁদের মতবাদকে ‘খারিজি' বলে ঘোষণা করে একে সমূলে ধ্বংস করার জন্য এ অঞ্চলের সর্বত্র জোর প্রচার শুরু করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে বাংলাদেশে এই আন্দোলন অন্যান্য সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যেতে থাকে ৷ যদিও ফরায়েজিদের আন্তরিকতা, দেশপ্রেম ও ন্যায়নিষ্ঠার দৃষ্টান্ত ও শৌর্যবীর্য বাংলাদেশের মুসলমানদের ঊনবিংশ শতাব্দীর তিমিরাচ্ছন্ন আকাশে উজ্জ্বল ভাস্বর রূপে আশার আলোকে বিকিরণে দীপ্তমান থাকে। দুদু মিয়ার আন্দোলন নিম্নোক্ত শিরোনামে উপস্থাপন করা যায় ।
> দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন : হাজি শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র পুত্র মোহসেনুদ্দীন আহমদ ওরফে দুদুমিয়া পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। ১৮১৯ সালে বাকেরগঞ্জ জেলার মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্গত মুলফাতগঞ্জ থানায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পরে এই থানাকে ফরিদপুর জেলার সাথে সংযুক্ত করা হয়। যদিও তিনি পিতার ন্যায় তেমন পণ্ডিত ছিলেন না, কিন্তু ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি যে ভূমিকা পালন করেন তা ছিল অদ্বিতীয়, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি তাঁর পিতাকে ছাড়িয়ে যান। তাঁকে এ আন্দোলনের যৌথ প্রতিষ্ঠাতাও বলা হয়ে থাকে । ফরায়েজি ভ্রাতৃত্বকে তিনি একটি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী সমাজে রূপান্তরিত করেন। পিতার ন্যায় দুদুমিয়াও অল্প বয়সে হজ করতে যান। নেতৃত্ব নেওয়ার সাথে সাথে তিনি অনুভব করেন যে ফরায়েজি চাষিদের প্রতি জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কিছু কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। মক্কা থেকে দেশে ফিরে ফরায়েজি আদর্শ প্রচার করেন। তিনি প্রচার করেন যে, “জমি আল্লাহর দান, সুতরাং জমিদারের কর ধার্য করার অধিকার নেই .” তাঁর এ মত দরিদ্র কৃষকদের অনুপ্রাণিত করে। মুসলিম কৃষক ও তাঁত শিল্প ধ্বংস হওয়ার ফলে অসংখ্য তাঁতি বা জোলা দুদু মিয়ার ধর্মমতে তাঁদের মুক্তির ইঙ্গিত পান। অসাধারণ সাংগঠনিক গুণের অধিকারী দুদু মিয়া ফরায়েজিদের সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করে তাদের মধ্যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে ফরায়েজিরা একটি শক্তিশারী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তাঁর সময়ে প্রায় ৫০ থেকে ৮০ হাজার সদস্য এ আন্দোলনে শরিক হয়। তিনি ফরায়েজি আন্দোলনকে জমিদার, নীলকর ও সুদখোর মহাজনদের শোষণ ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলার হতো দরিদ্র কৃষক ও মেহনতি জনগণের এক দুর্বার আর্থসামাজিক সংগ্রামে পরিণত করেন। ফরায়েজিদের কাছে দুদু মিয়া ‘ওস্তাদ' ও ‘মৌলবি' হিসেবে পরিচিত ছিলেন । তিনি অনুগামীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন ।
ফরায়েজি সমাজ প্রতিষ্ঠা : ফরায়েজি সমাজ গঠনে দুদু মিঞার দুটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল । যথা : জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের রক্ষা করা এবং প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা ।
ফরায়েজিদের মধ্যে উঁচুনীচু ভেদাভেদ বিলোপ করে সামাজিক জীবনে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা ।
ফরায়েজি সমাজ প্রতিষ্ঠায় দুদু মিয়ার আহ্বান : সংগ্রামী দুদু মিয়া বিশ্বের সকল মানুষের সমাজ অধিকারের উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি ঘোষণা করেন সকল মানুষই পরস্পরের ভাই, (এক ভাই যখন বিপন্ন হয় তখন প্রতিবেশীর কর্তব্য হলো তাকে সাহায্য করা) কৃষকদের সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় দুদু মিয়া প্রচার করেন জমির মালিক আল্লাহ। জমি থেকে খাজনা আদায় আল্লাহর আইনের পরিপন্থি। তাঁর এ মত দরিদ্র কৃষকদের অনুপ্রাণিত করে। তার এ মতবাদে মুক্তির ইঙ্গিত লক্ষ করা যায় । তিনি জনগণকে নিয়ে জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ।

ফরায়েজি খিলাফত ব্যবস্থা : হাজি শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজি সংগঠন স্থাপন করেন । দুদু মিয়ার নির্দেশনায় ৩০০ থেকে ৫০০ পরিবারভুক্ত এলাকা নিয়ে পূর্ববঙ্গকে কয়েকটি গ্রাম্য ইউনিটে বিভক্ত করা হয়। কয়েকটি ইউনিট নিয়ে আবার একটি সার্কেল গঠিত হয়। এ সমস্ত সার্কেলে একজন খলিফা বা রাজনৈতিক এজেন্ট নিয়োগ করা হয়। কোনো অঞ্চলে ফরায়েজিদের উপর কোনো অত্যাচার হলে অন্যান্য অঞ্চল থেকে তাদের সাহায্য দেওয়া হয়। খলিফাদের কাজ ছিল-
প্রথমত, নিজ নিজ থানায় ফরায়েজিদের সংঘবদ্ধ করা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ফরায়েজিদেরকে যথাযোগ্যরূপে গড়ে তুলাই ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য ।
দ্বিতীয়ত, নিজ নিজ এলাকার রাজনৈতিক সংবাদ দুদু মিয়ার কাছে নিয়মিত প্রেরণ করা। ফরায়েজি খিলাফতের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করাই ছিল এর উদেশ্য । আর ফরায়েজি খিলাফত ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যই ছিল সকল ফরায়েজিদের পদক্রমের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনা এবং কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা
পঞ্চায়েত প্রথার পুনঃপ্রবর্তন : তিনি ফরায়েজি পঞ্চায়েত প্রথার পুনঃপ্রবর্তন করেন। ফরায়েজিদের বিরোধের বিষয় ব্রিটিশদের স্থাপিত আদালতকে বাদ দিয়ে নেতার নিকট পেশ করতে হতো এবং তিনি সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে এর মীমাংসা করতেন। নিজস্ব আইন অনুযায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছিল এ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত কোর্ট কাচারির বিচারের তুলনায় দুদু মিয়ার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ফরায়েজি অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে কোর্ট কাচারিতে মামলা মোকদ্দমা দায়ের বহুগুণে হ্রাস পায়। দুদু মিয়া একটি গোয়েন্দা সংস্থাও গড়ে তোলেন। এভাবে দুদু মিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর বিকল্প ব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হন এবং ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার করেন ।
ফরায়েজি সংগঠন স্থাপন : দুদু মিয়া ফরাজি সংগঠন স্থাপন করেন। তিনি পূর্ব বাংলাকে কয়েকটি হল্কা বা অঞ্চলে ভাগ করেন। প্রতি হল্কার উপর একজন খলিফা নিয়োগ করেন। ফরায়েজিদের উপর কোনো হল্কায় আক্রমণ বা অত্যাচার হলে অন্য সকল কেন্দ্র হতে তাদের সাহায্য দান করা হয়। খলিফারা নিজ নিজ হল্কায় ফরায়েজিদের সংঘবদ্ধ করেন। মামলা-মোকদ্দমা হলে মামলা চালাবার ব্যবস্থা করা হয়। প্রতি হল্কায় নিজস্ব বিচার বিভাগ গঠিত হয়। প্রতি গ্রামের বৃদ্ধ ফরায়েজিকে নিয়ে বিচার সভা গঠন করা হয়। ইংরেজদের আদালতে বা জমিদারের কাছে বিচার প্রার্থনা নিষিদ্ধ হয়। যদি কেউ এই নির্দেশ না মেনে সরকারি আদালতে যেত তবে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হতো। ফরায়েজি কেন্দ্র থেকে লাঠিয়াল বাহিনী আত্মরক্ষার জন্য গড়া হয়। দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি সংগঠন ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে 1
কানাইপুরের জমিদারের বিরুদ্ধে অভিযান : কানাইপুরের হিন্দু জমিদারগণ মুসলমান প্রজাদের উপর নানারকম অত্যাচার করতো বলে দুদু মিয়া এর প্রতিবাদে কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেন। ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কয়েকশ অনুগামী নিয়ে জমিদার বাড়িতে উপস্থিত হলে ভয় পেয়ে জমিদার তাদের সাথে সন্ধিশর্তে আবদ্ধ হন এবং তাদের উপর বেআইনি কর প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেন। এতে প্রজাদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।
ফরিদপুরের জমিদারের বিরুদ্ধে অভিযান : ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুরের ঘোষ জমিদারের সাথে তার সংঘর্ষ হলে মদন ঘোষ নিহত হয়। এর ফলে দুদু মিয়াসহ ১১৭ জন গ্রেফতার হন। এর মধ্যে ১০৬ জনের আদালতে বিচার হয় এবং তন্মধ্যে ২২ জনের ৭ বছরের জন্য কারাদণ্ড হয় । দুদু মিঞার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না পাওয়ায় তিনি বেকসুর খালাস পান। এরপর দুদু মিয়া ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন ।
জমিদার নীলকর বিরোধী আন্দোলন : যে সকল নীলকর কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করতো, তাদের বিরুদ্ধে দুদু মিয়া প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন। দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য হিন্দু জমিদারেরা নীলকরদের প্ররোচিত করে। মাদারীপুরের প্রভাবশালী নীলকর মি. ডানলপের সাথে ফরায়েজিদের সংঘর্ষ হয়। এনড্রিও এন্ডারসন ডানলপ এর লোকজন দুদু মিঞার কাচারি ধ্বংস করে এবং ডাকাতির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তারা খালাস প্রাপ্ত হন। জেমস ওয়াইজ-এর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মি. ডানলপ তাঁর প্রভাব খাটিয়ে দুদু মিয়াকে দুবার গ্রেফতার করান। তাঁর বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে অভিযোগ বাতিল হয়ে যায়। কালি প্ৰসাদ, কাঞ্জিলাল নামক জনৈক ব্রাহ্মণ গোমস্তা ডানলপের পঞ্চচর নীলকুঠির দেখাশুনা করতো। কালি প্রসাদ কাঞ্জিলালের দৌরাত্ম্যে প্রজাগণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল । ইংরেজদের ছত্রছায়ায় থেকে এই গোমস্তা দুদু মিয়ার সাথে চরম শত্রুতা শুরু করে এবং অধিকাংশ ফরায়েজি কৃষকদের সে নীল চাষ করতে বাধ্য করে। এই গোমস্তা দুদু মিয়ার বাহাদুরপুরের বাড়িতে তার দলবল নিয়ে ডাকাতি করে অর্ধলক্ষ টাকার মালামাল লুণ্ঠন করে এবং ৪ জন চৌকিদারকে হত্যা করে। ডানলপ সাহেবের প্রভাবে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট এই ডাকাতির কেস উপেক্ষা করে। অগত্যা দুদু মিয়া নিজেই কাঞ্জিলালের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। জেমস ওয়াইজ লিখেছেন, “১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর এক বিরাট সশস্ত্র বাহিনী পঞ্চচরের কুঠি আক্রমণ ও ধূলিসাৎ করে। তারা পার্শ্ববর্তী গ্রাম লুণ্ঠন করে এবং ব্রাহ্মণ গোমস্তাকে বন্দি করে আনে; পরে বাকেরগঞ্জ জেলায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।” এ ব্যাপারে দুদু মিয়া ও অন্যান্য ৬৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। জেলা কোর্টে তাঁদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পরে সদরে নিজামত আদালতে আপিল করা হয় এবং এর বিচারে তাঁরা খালাস পান। এই ঘটনার পর থেকে জমিদার ও নীলকরগণ দুদু মিয়াকে সমীহ করে চলতেন এবং ফরায়েজি প্রজাদের নিকট থেকে অবৈধ কর আদায় ও তাদেরকে অযথা হয়রানি করা থেকে বিরত হন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহিবিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ সরকার দুদু মিয়াকে গ্রেফতার করে কলিকাতার জেলে আটক রাখে। কারণ সরকারের আশঙ্কা হয় যে, তিনি এ বিদ্রোহ অংশগ্রহণ করতে পারেন। জেমস ওয়াইজ লিখেছেন যে, “দুদু মিয়া আদালতে বলেছিলেন যে, তাঁর আহ্বানে ৫০,০০০ লোক সাড়া দিবে এবং তিনি তাদেরকে যেখানে যেতে বলবেন তারা সেখানেই যাবে। দু'বছর পর দুদু মিয়া জেল থেকে ছাড়া পান। বাড়িতে ফেরার পর ফরিদপুরের পুলিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে আবার গ্রেফতার করে। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ছাড়া পান এবং ঢাকার ১৩৭ নম্বর বংশাল রোডে বসতি স্থান করেন। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে
তিনি এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং বাসস্থানের সংলগ্ন স্থানে সমাহিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে এক দূরদর্শী ও উজ্জ্বল নেতৃত্বের অবসান ঘটে।
ফরায়েজি আন্দোলনের অন্যান্য নেতৃত্ব
ফরায়েজি আন্দোলনের আরও কতিপয় নেতার নাম জানা যায়, দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর তিন পুত্র গাজিউদ্দীন হায়দর (১৮৬২-৬৪ খ্রি.), আবদুল গফুর ওরফে নয়ামিয়া (১৮৬৪-৮৩ খ্রি.) এবং খান বাহাদুর সইফউদ্দীন আহমদ (১৮৮৩-১৯০৬ খ্রিঃ) যথাক্রমে ফরায়েজিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। খান বাহাদুর সইফউদ্দীন আহমদের পর তাঁর পুত্র আবু খালিদ রশিদউদ্দীন ওরফে বাদশা মিয়া নেতা নির্বাচিত হন। সইফউদ্দীন ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেন। বাদশা মিয়া খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁকে কিছু দিন অন্তরিন রাখা হয়। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন। এরপর আর কোনো নেতার পরিচয় পাওয়া যায় না ৷
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর থেকেই যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ফরায়েজি আন্দোলনের গতি স্তিমিত হয়ে পড়ে। এ সময় জমিদারেরা ফরায়েজিদের উপর অত্যাচার শুরু করে। জৌনপুরের মাওলানা কেরামত আলী ফরায়েজি আন্দোলনের বিরোধিতা করেন এবং তাঁদের মতবাদকে ‘খারিজি' বলে ঘোষণা করে একে সমূলে ধ্বংস করার জন্য এ অঞ্চলের সর্বত্র জোর প্রচার শুরু করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে বাংলাদেশে এ আন্দোলন অন্যান্য সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যেতে থাকে। “যদিও ফরায়েজিদের আন্তরিকতা, দেশপ্রেম ও ন্যায়নিষ্ঠার দৃষ্টান্ত ও শৌর্যবীর্য বাংলাদেশের মুসলমানদের ঊনবিংশ শতাব্দীর তিমিরাচ্ছন্ন আকাশে উজ্জ্বল ভাস্কর রূপে আশার আলোক বিকিরণে দীপ্তমান থাকে।” ফরায়েজি আন্দোলনে মুসলিম জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় তা শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপ নেয় ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]