ফরায়েজি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ

ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামী দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর এ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। এ সুযোগে জমিদারগণ তাদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালাতে থাকলে ফরায়েজিরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এছাড়া আরও বহুবিধ কারণে ফরায়েজি আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ।
: প্রথমত, দুদু মিঞার মৃত্যুর পর আর কোনো উপযুক্ত নেতা না থাকায় এ আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে। যে কোনো আন্দোলনকে গতিশীল রাখার জন্য ধারাবাহিক যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়। দুদু মিয়ার পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এটি ব্যর্থ হয় ।

দ্বিতীয়ত, সংকীর্ণ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ফরায়েজি আন্দোলন পরিচালিত হয় বলে এটি ব্যর্থ হয়। এছাড়া সাম্প্রদায়িক কোনো আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতার কোনো রেকর্ড নেই ।
তৃতীয়ত, আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের অস্পষ্ট রাজনৈতিক চেতনা, সংগ্রামে অভিজ্ঞতার অভাব, লক্ষ্য সম্বন্ধে ধারণাবশত এ সংগ্রাম উন্নত স্থানে পৌঁছতে পারেনি । কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হলে হয়তো এ আন্দোলন সফল হতো ।
চতুর্থত, ফরায়েজি আন্দোলনে সকল সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল না। সকল সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করতে না পারায় তা ব্যৰ্থ হয় ৷
পঞ্চমত, গোঁড়াপন্থি কতিপয় মুসলিম জনগণ শরীয়তুল্লাহর ধর্মসংস্কারের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে এ আন্দোলন ব্যর্থ করতে উদ্যোগী হন। এতে মুসলমানরা বিভক্ত হয় এবং বিতর্কের সৃষ্টি হয় ।
ষষ্ঠত, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবি জানানো হয়নি। এ প্রথা উচ্ছেদের দাবি জানানো হলে ফরায়েজি আন্দোলন আপামর জনতার সমর্থন লাভ করতো।
সপ্তমত, জঙ্গি মনোভাবের কারণে জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় । জনগণ আন্দোলন থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করায় ফরায়েজি আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ।

ফরায়েজি আন্দোলনের বৈশিষ্টসমূহ


ফরায়েজি আন্দোলনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন- প্রথমত, এটি একটি ইসলাম ধর্মীয় শুদ্ধি ও সংস্কার আন্দোলন । দ্বিতীয়ত, এটি একটি মুসলিম সম্প্রদায়ের আন্দোলন ।
তৃতীয়ত, ফরায়েজি আন্দোলন ছিল প্রধানত মুসলমানদের এক বিশেষ অংশের জন্য। এটি সার্বজনীন মুসলিম আন্দোলন ছিল না ।
চতুর্থত, এটি ছিল কৃষক ও দরিদ্র শ্রেণির অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন ।
পঞ্চমত, এটা একটা এলাকা ভিত্তিক জমিদার ও নীলকর বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন ।
ষষ্ঠত, এটা ছিল কৃষকদের এক পুঁজিবাদী প্রতিরোধ আন্দোলন ।
সপ্তমত, ফরায়েজি আন্দোলন ছিল ধর্মীয় আবরণে আবর্তিত ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন ।

ফরায়েজি আন্দোলনের গুরুত্ব


প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ফরায়েজি আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে ফরায়েজি আন্দোলন এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বলা যায় যে, ফরায়েজি আন্দোলন ছিল সমাজের শোষিত নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, রাখে । নিম্নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হলো : শোষিত মানুষের পক্ষে ফরায়েজি আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ আন্দোলন মূলত কৃষকদের আন্দোলন। তৎকালীন সময়ে কৃষকরা ছিল জমিদার ও নীলকরদের হাতের পুতুল। তারা নানাভাবে অত্যাচারিত হতো জমিদারদের হাতে। হাজি শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলনের মধ্যে যে তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে অত্যাচরের বিরুদ্ধে। এর ফলে ভূমিব্যবস্থাতে কিছু সংশোধন করা হয়। এতে শোষিত মানুষের অধিকার রক্ষিত হয় ।
এ আন্দোলনে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাওয়া যায় এ আন্দোলনে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর দরিদ্র, নেতৃত্ববিহীন ও বিস্ফোরন্মুখ সমাজেসংস্কারে এসব ধারণা ব্যাপক আবেদনের সৃষ্টি করে এবং সাধারণ মানুষের নিকট থেকে তাৎক্ষণিক ও স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাওয়া যায়। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কাছেও এর গুরুত্ব সমধিক বলে প্রমাণিত হয়।
মুসলমানরা একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। ফরায়েজি আন্দোলন সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে তাদেরকে সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এভাবেই গ্রামীণ মানুষের কাছে সংগঠনের গুরুত্ব তুলে ধরে। এ সংগঠনের পতাকাতলে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয় ।
ব্রিটিশ শাসক বিতাড়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি থেকেই প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার মুসলমানদের অসন্তোষের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। হাজি শরীয়তুল্লাহর দেশকে ‘দারুল হারব' হিসেবে আখ্যাদান এবং দুদু মিঞার পাল্টা প্রশাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এর ফলে দেশে শোষিত জনগণের মধ্যে বিদেশি শাসকদের বিরোধিতা করার মনোভাব গড়ে ওঠে। পরে এ মনোভাব ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হয় ।
ফরায়েজি আন্দোলন ছিল ওয়াহাবি আন্দোলনের অগ্রদূত একজন ধর্মীয় সংস্কারক হিসেবে শরীয়তুল্লাহর প্রচেষ্টা যে সাফল্য লাভ করে তা মহান নেতা সাইয়েদ আহমদ শহীদের জন্য আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। অতএব দেখা যাচ্ছে ওয়াহাবি আন্দোলনের অগ্রদূত হিসেবেও এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
ফরায়েজি আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের সংস্কার সাধন করা হয়েছে। মুসলমানগণ এদেশে অনেক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল। অনেক ভুল ধারণা ছিল তাঁদের মধ্যে। তাঁরা কেবলমাত্র নামেই মুসলমান ছিল। হাজি শরীয়তুল্লাহ তাঁর ফরায়েজি আন্দোলনের মাধ্যমে এসব কুসংস্কার দূর করেন। বাংলার মুসলমানগণের মধ্যে কোরআনের সঠিক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে কুসংস্কার মুক্ত করেন। এক্ষেত্রেও ফরায়েজি আন্দোলনের গুরুত্ব বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশে জমিদার, মহাজন, আমলা এবং নীলকরদের অত্যাচার হতে মুসলমানদের রক্ষা এবং তাদের স্বাধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে ফরায়েজি আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত ধর্মীয় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এটি আন্দোলনের রূপ নেয়। বাংলার প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে ফরায়েজি আন্দোলন তথা হাজি শরীয়তুল্লাহ ও দুদু মিয়ার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। সুতরাং, প্রতিরোধ আন্দোলনও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ফরায়েজি আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ।

ফরায়েজি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের সম্পর্ক ও পার্থক্য


প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ফরায়েজি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য রয়েছে। ফরায়েজিরা নিজেেেদর তিতুমীর বা ওয়াহাবিদের থেকে আলাদা বলে মনে করতেন। কিন্তু ড. মুনিউদ্দিন খান তিতুমিরের সাথে ফরায়েজিদের সম্পর্কের কথা বলেছেন। ড. অভিজিত দত্তের মতে, যদিও তিতুমিরের আন্দোলনের সাথে দুদু মিয়ার ফরায়েজি আন্দোলনের কিছু সাদৃশ্য ছিল তথাপি ইসলামীয় মতবাদের দিক থেকে উভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য দেখা যায়।
যেমন- বাংলার তিতুমীরের মতবাদে সৈয়দ আহমদের তরিখকা-ই-মহম্মদিয়ার প্রভাব ছিল বলে প্রতীয়মান হয় ।
দৃশ্যত তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীরা সৈয়দ আহমদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন । তাঁকেই তাঁদের গুরু বলে মান্য করেন। কিন্তু ফরায়েজি নেতা শরীয়তুল্লাহ আরব দেশ থেকে তাঁর মতবাদের প্রেরণা পান। তাঁরা সৈয়দ আহমদের গুরু শাহ ওয়ালিউল্লাহের মতাবলম্বী ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় ।
ফরায়েজিগণ জুম্মা বা ঈদের প্রার্থনায় আপত্তি করতেন। কারণ তাঁদের মতে, ইংরেজ শাসনের ফলে ভারত ছিল দারুল হারব। এখানে পবিত্র জুম্মা বা ঈদের প্রার্থনা করা উচিত নয় বলে তাঁরা বিশ্বাস করতেন। তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীরা নামাজ ও জুম্মা প্রার্থনা করতেন। এজন্য ফরায়েজিদের “বে-জুম্মাওয়ালা” বলা হতো এবং ওয়াহাবিদের নাম ছিল “জুম্মাওয়ালা” । ধর্মীয় প্রার্থনার দিক থেকে এ বৈসাদৃশ্য স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় ৷
উপর্যুক্ত পার্থক্য সত্ত্বেও কয়েকটি দিক থেকে উভয় আন্দোলনের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষণীয়। যেমন—
বাংলায় সংগঠিত উভয় আন্দোলন ইসলামের পুনরুজ্জীবনের লক্ষ নয়। উভয় আন্দোলন ইসলামের শুদ্ধিকরণ দ্বারা তার আদি পবিত্রতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে । বলে প্রতীয়মান হয়।
দৃশ্যত উভয় আন্দোলনের মতবাদ প্রচারের জন্যে স্বধর্মাবলম্বী মুসলিমদের মধ্যে প্রচার, জোরজুলুম করা হয়। সন্ত্রাসের সাহায্যে বিরোধী মুসলিমদের দমিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়, যা উভয় আন্দোলনেই দেখা যায় ।
দৃশ্যত সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে উভয় আন্দোলন ছিল সমাজতন্ত্র বিরোধী। দরিদ্র কৃষক ও জোলা সম্প্রদায় উভয় আন্দোলনে ধর্মীয় জাগরণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির পথ খোঁজেন । ফলে উভয় আন্দোলন তাদের সমর্থন লাভ করে ।
বাংলার সর্বত্র উভয় আন্দোলনের মধ্যে পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক প্রভাব বৃদ্ধি পায় বলে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
উভয় আন্দোলনের মধ্যে মেসিয়ানিক চরিত্র বা অবতারবাদী ভাব দেখা যায়। তিতুমীরের মতই দুদু মিয়াকেও অলৌকিক শক্তির অধিকারী বলে অনেকে মনে করতেন। উভয়েই মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন ।
উভয় আন্দোলনে প্রচলিত সমাজ ও ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জেগে ওঠে। ধর্মসংস্কারের দাবি থেকে আসে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি। সর্বোপরি, উভয় আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হয় ৷
উপর্যুক্ত সাদৃশ্যগুলো উল্লেখের পরে একথা বলা প্রয়োজন যে, তিতুমীরের আন্দোলনে যে ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা দেখা যায়, ফরাজি আন্দোলনে তা ছিল না। তিতুমীরের ইংরেজ শাসনকে অস্বীকার করে স্বাধীন ওয়াহাবি রাজ্য ঘোষণা করেন, তা যতই ক্ষুদ্র অঞ্চলে হোক না। অপর দিকে দুদু মিয়া সরকারের কাছে এক আর্জিতে জানান যে, “জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে ফরায়েজিদের সংগ্রাম ব্রিটিশরাজ সম্পর্কে তাদের কোনো বিদ্বেষ নেই।” অপরদিকে, ড. অভিজিৎ দত্তের মতে, যেহেতু ফরায়েজিরা সরকারের বিচার বিভাগ, কোর্ট কাচারিকে মান্য করতেন না এবং তাঁদের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থাকেই সমর্থন করেন সেহেতু মনে করা যায় যে, “ওয়াহাবি আন্দোলন” ও ফরায়েজি আন্দোলন ছিল নিশ্চিতভাবে ইংরেজ বিরোধী। The Faraidi leader desired the summary ouster of the English from Bengal. te ফরায়েজি নেতারা বাংলা থেকে ইংরেজদের পত্রপাঠ বহিষ্কার করতে চান। এতে উভয় আন্দোলনে ব্রিটিশ বিরোধী চরিত্র ফুটে উঠে
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে পরিশেষে বলা যায় যে, ফরায়েজি আন্দোলন ওয়াহাবি আন্দোলনের মতই শুদ্ধি ও মৌলিক সংস্কারের দ্বারা ইসলাম ধর্মকে গণধর্মে পরিণত করার লক্ষ্য নেয় এবং এ ধর্ম আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষক ও দরিদ্র শ্রেণির অর্থনৈতিক মুক্তির কথা প্রচার করে। ফরায়েজি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য এই যে, এই আন্দোলনে কেবলমাত্র মুসলিম কৃষকরা আকৃষ্ট হননি, হিন্দু কৃষকরাও এ আন্দোলনকে সমর্থন জানান। রক্ষণশীল মুসলিম ও হিন্দু মুসলিম জমিদারদের এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে দেখা যায়। ড. বিনয় চৌধুরীর মতে, প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন থেকে ফরায়েজি আন্দোলন হিসেবে কৃষক আন্দোলনে পরিণত হয়। কিন্তু জমিদারি প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তির জন্যে ফরায়েজিরা ঘোষণা দেননি। নীলচাষ প্রথারও সম্পূর্ণ বিলোপ তাঁরা চাননি। তাঁদের লক্ষ্য ছিল সীমিত। ফরায়েজিদের সংহতির প্রধান উৎস ছিল তাঁদের ধর্মীয় ও নৈতিক বিশ্বাস। এ নৈতিক বিশ্বাসে এক সর্বজনীনতা ছিল। ফরাজিদের ব্রিটিশ বিরোধিতা ছিল খুবই অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে। ড. অভিজিত দত্তের মতে, ইংরেজের বিচার বিভাগ ও আইনকে অস্বীকারই ছিল এ বিরোধিতার দৃষ্টান্ত। সুপ্রকাশ রায়ের মতে, “এজন্য ফরায়েজি আন্দোলন জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণ বৈপ্লবিক রূপ দান করেছিল।” সুতরাং ফরায়েজি ও ওয়াহাবি উভয় আন্দোলনই প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
ফরায়েজি আন্দোলনের সার্বিক বিশ্লেষণ
বাংলার ফরায়েজি আন্দোলন ছিল প্রথমত একটি ইসলামি সংস্কারমূলক আন্দোলন। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল এর অনুসারীদের ব্যষ্টিক ও সমষ্টিক জীবনকে ইসলাম বহির্ভূত আচার আচরণ থেকে মুক্ত করে সহজসরল ইসলামের পথে আনয়ন। এ জন্যই এই আন্দোলনের নাম হয়েছিল ‘ফরায়েজি' আন্দোলন। প্রাথমিক পর্যায়ে এই আন্দোলন সংগঠনে ধর্মের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে পরবর্তীতে আর্থসামাজিক সংস্কারের প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়। ফলে একে ইসলম ধর্ম সংস্কারের আন্দোলন না বলে তখন কৃষক-আন্দোলন বলাই যুক্তিযুক্ত। আমাদের আলোচনায় আন্দোলনের এই চরিত্র পরিবর্তনের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হবে ।
বাংলার ফরায়েজি-আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাজি শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১- ১৮৪০ খ্রি.)। তিনি তদানিন্তন ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার বাহাদুপুর গ্রামে ১৭৮১ খ্রি. এক তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি পিতামাতাকে হারান। অতপর চাচা আজিমুদ্দীনের সাথে কিছুকাল বসবাস করে তিনি হুগলি জেলার ফুরফুরায় মৌলভি বকরতো আলীর সান্নিধ্যে এসে ইসলামি শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। ১৭৯৯ খ্রি. উভয়ে হজ পালন উপলক্ষ্যে মক্কায় যান। সেখানে ২০ বছর যাবৎ শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ শেষে হাজি শরীয়তুল্লাহ ১৮১৮ খ্রি. স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি যখন মক্কায় ধর্মীয় শিক্ষালাভের জন্য অবস্থান করছিলেন তখন সেখানে স্বনামধন্য ইসলামি ব্যক্তিত্ব আবদুল ওয়াহাব নজদের নেতৃত্বে ‘মুয়াহিদুন বা একত্ববাদের' আন্দোলন জনজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছিল। মক্কায় তিনি আবদুল ওয়াহাব নজদের ‘মুয়াহিদুন বা একত্ববাদের' আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হন। এর আলোকে তিনি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন এবং দেশে এসে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু ড. আই. এইচ কোরেশী ফরায়েজি নেতার উপর ওয়াহাবি প্রভাব মেনে নিতে রাজি হননি। কারণ তিনি মনে করেন যে, হাজি শরীয়তুল্লাহ কখনো নিজেকে ওয়াহাবি (Wahabi) বলে পরিচয় দেননি। তবে ফরায়েজি আন্দোলন গবেষক ড. মঈন উদ্দিন আহম্মদ খান জোর দিয়ে বলেছেন যে, হাজি শরীয়তুল্লাহ আরবের ‘মুয়াহিদুন’ আন্দোলন দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, যদিও তিনি ‘মুয়াহিদুন' আন্দোলনের সকল নীতি আদর্শ গ্রহণ করেননি ।
ফরায়েজি আন্দোলনের মূল বক্তব্য ছিল আল্লাহকে একমাত্র প্রভু বলে স্বীকার করা এবং তাঁরই ইবাদত করা। এতদসঙ্গে সকল প্রকার শিরিক ও বিদআত থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং ইসলামের অবশ্য কর্তব্যগুলো সঠিক সময়ে যথা নিয়মে পালন করা। পাশাপাশি ধর্মে কোনো বাহ্যিক বিষয়ের সংযোজন করা থেকে বিরত থাকা, পীরবাদে বিশ্বাস না করা এবং পীর ও মুরিদ শব্দের স্থলে ওস্তাদ (শিক্ষক) ও সাগরেদ (ছাত্র) শব্দের ব্যবহার করা। এছাড়া হাজি শরীয়তুল্লাহ কুসংস্কার ও বর্ণবাদমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে পেশাভিত্তিক শ্রেণিকরণকে নিরুৎসাহিত করেন। তিনি শ্রমলব্ধ উপার্জনকে হালাল উপার্জন হিসেবে অভিহিত করেন। শিল্পকর্মে নিয়োজিত নিচু বিত্তের লোকজনকে তিনি 'কারিগর' উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর এরূপ সংস্কার কার্যে সনাতনপন্থি মুসলমানরা অসন্তুষ্ট হয়। কারণ এরূপ সংস্কারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের তথাকথিত আভিজাত্য ও ঐতিহ্য যেমন ধ্বংস হবে তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ।
ইসলামের বিশুদ্ধ নীতির অনুসরণে হাজি শরীয়তুল্লাহ মানুষের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যবাদ নীতির উপর জোর দেন। তিনি একমাত্র আল্লাহকেই জমির প্রকৃত মালিক বলে ঘোষণা করেন এবং একমাত্র শ্রমকেই মানুষের অধিকার ও সম্পদের বৈধ উৎস বলে ঘোষণা করেন। এই নীতি অনুযায়ী তিনি জমির উৎপন্ন ফসল কৃষকের প্রাপ্য বলে রায় দেন এবং এ সম্পর্কে মধ্যস্বত্বের দাবিদার জমিদারকে অবৈধ শোষক ও অত্যাচারী বলে প্রতিপন্ন করেন। তাঁর এই সংস্কার দাবি ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর ও বাকেরগঞ্জের গরিব চাষি ও তাঁতিদেরকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে বলে ঢাকার তৎকালীন কমিশনার ডানবার (Dunber) দাবি করেছেন। আর জেমস টেইলরের মতে, শরীয়তুল্লাহর সাফল্য এখানেই যে, তিনি ফরিদপুর অঞ্চলের অনেক মানুষকে ফরায়েজি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তবে শহরাঞ্চলে যেখানে উঁচুশ্রেণির মুসলমানরা বসবাস করতো সেখানে এই মতবাদ কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি ।
আদি ইসলামের পুনরুজ্জীবন প্রত্যাশী হাজি শরীয়তুল্লাহ বাংলার ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সমাজজীবনে প্রচলিত নানা প্রকার অনুষ্ঠান যেমন- মহররম, ফাতেহা, ওরস, মিলাদ, খতনা, কানছেদনী, অন্নপ্রাশন, গায়ে হলুদ, নওরোজ জন্মদিন, বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠানাদি জাঁকজমকভাবে পালন ইসলাম বহির্ভূত বলে এসবেরও বিরোধিতা করেন এবং এগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এ কারণে একদিকে যেমন ইংরেজসৃষ্ট নব্য জমিদারশ্রেণি ফরায়েজিদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন, অন্যদিকে এদেশের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সমাজপতিরাও ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে মারমুখী হয়ে ওঠে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৮৩১ খ্রি. সংস্কারবাদী ফরায়েজি ও রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থিদের মধ্যে ঢাকা জেলার রামনগর নামক স্থানে এক সংঘর্ষ বাঁধে। স্থানীয় হিন্দু জমিদারেরা এই সুযোগ গ্রহণ করে সরকারের সহায়তায় হাজি শরীয়তুল্লাহ ও তাঁর অনুসারীদেরকে তাদের ধর্মপ্রচারের কেন্দ্র ঢাকার নয়াবাড়ী থেকে বিতাড়িত করেন। তিনি (শরীয়তুল্লাহ) সেখান থেকে নিজ গ্রাম বাহাদুরপুরে এসে ফরায়েজি আন্দোলন পরিচালনার নতুন কেন্দ্র স্থাপন করেন। ড. জেমস ওয়াইজ-এর মতে, পূর্ববঙ্গে বহু দেবদেবী অধ্যুষিত হিন্দুধর্মের সংশ্রবের বাইরে থেকে ইসলামের শুদ্ধি আনয়নে তার প্রয়াস বিশেষ প্রশংসনীয় এবং অসাধারণ ঘটনা । হাজি শরীয়তুল্লাহ ইসলামে নানা প্রকার কুসংস্কার অনুপ্রবেশের মূলে ইংরেজ শাসনকে দায়ী করেন। তিনি এদেশে ইংরেজ রাজত্বকে ঘৃণার চোখে দেখতেন এবং মক্কায় হিজরতের অন্যান্য কারণের মধ্যে ইহাও অন্যতম কারণ ছিল। তাঁর সংস্কারের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এদেশে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো। যে কারণে তিনি ফতোয়া দেন যে, হানাফি মাজহাব অনুসারে ইংরেজাধীন এদেশে জুমার নামাজ পড়া বৈধ নয়। কারণ এদেশের কোথাও ইসলামি হুকুমত বলবৎ নেই। অথচ ইসলামি প্রশাসকের উপস্থিতি জুমার নামাজের আবশ্যক শর্ত। অতএব ইসলামি প্রশাসন চালু সাপেক্ষে তিনি বাংলাতে জুমার নামাজ এবং একই কারণে দুই ঈদের নামাজ নিষিদ্ধ করে জনগণকে জুমার বদলে জোহরের নামাজ পড়ার উপদেশ দেন। হাজি শরীয়তুল্লাহর এই ঘোষণাটি ছিল তরিকা-ই মোহাম্মদিয়ার অনুরূপ। আর এই ঘোষণার মধ্যে পাটনার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট টি, ই, রাভিনশো (T. E. Revenshow) ফরায়েজি’ ও ‘ওয়াহাবি’- সম্প্রদায়ের মধ্যে সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু জিহাদের প্রশ্নে ওয়াহাবিরা ছিল ফরায়েজিদের অগ্রবতী। তবে হাজি শরীয়তুল্লাহ এদেশকে শত্রু রাষ্ট (দারুল হরব) ঘোষণা করলেও সৈয়দ আহমদ শহীদের মতো (তরিকা-ই মোহাম্মদিয়ার নেতা) ব্রিটিশদের বিতাড়নে বিদ্রোহাত্মক কোনো কর্মসূচি বা নীতিমালা গ্রহণ করেননি। তাঁর এই ঘোষণাটি ছিল সরাসরি ইংরেজ সরকারের প্রতি একটি অনাস্থা এবং জনগণকে ইংরেজ বিতাড়নের নিয়মতান্ত্রিক জেহাদে উদ্বুদ্ধকরণের আহ্বান মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী এই ধরনের নীতির বিরোধিতা শরীয়তুল্লাহকে বাংলার খারিজি (চরমপন্থি) হিসেবে অভিযুক্ত করেন। তবে এটাও সত্য যে, ব্রিটিশ শাসন ফরায়েজিদের আধ্যাত্মিক জীবনে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি। তবে তাদের অর্থনৈতিক জীবন ধ্বংসের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল নিঃসন্দেহে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩ খ্রি.) আশীর্বাদে জমিদারদের অসীম ক্ষমতা এবং সে সুযোগে প্রজাদের উপর আসল জমা ছাড়া ও কুড়ি-ত্রিশ প্রকারের আবওয়াব বা সেস ধার্য করা ছিল ফরায়েজি বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। হাজি শরীয়তুল্লাহ জমিদারদের আইন, সেলামি ও শীতের কাপড় খরচ ইত্যাদি সেসকে অবৈধ এবং কালীপূজা, দুর্গাপূজা, শ্রাদ্ধখরচ, ইত্যাদিকে শিরিকের পর্যায়ে ফেলে তাঁর শিষ্যদেরকে এগুলো প্রদান হতে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। অথচ এ সকল পন্থায় কর আদায় জমিদারদের অভ্যাসে ও অধিকারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ফরায়েজি কৃষকরা নেতার নির্দেশ অনুসারে বিভিন্ন প্রকার সেস প্রদান বন্ধ করে দেয়। ফলে তাদের সাথে জমিদারদের (অধিকাংশ জমিদার ছিলেন হিন্দু) বিরোধ ও সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে। হিন্দু জমিদাররা কৌশলে রক্ষণশীল মুসলিম ভূস্বামীদেরকেও তাদের সাথে যুক্ত করতে সক্ষম হন। এই জমিদারশ্রেণি নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য ইংরেজ নীলকরদের হাত করেন এবং তাদের মাধ্যমে ইংরেজ কর্মকর্তা ও বিচারকমণ্ডলীকে ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে সচেষ্ট হন। কলকাতার কিছু কিছু প্রেস এসময়ে তাদের সহায়তা এগিয়ে আসে এবং ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে প্রচারণায় সোচ্চার হয়। এদিকে ইংরেজ প্রশাসন ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হলেও জমিদার, জোতদার নীলকরদের দ্বারা নিপীড়িত রায়ত-চাষিরা ন্যায় বিচারের আশায় সম্প্রদায় ও ধর্ম নির্বিশেষে ফরায়েজিদের পক্ষে যোগদান করে। ইত্যবসরে ১৮৪০ সালে হাজি শরীয়তুল্লাহর মৃত্যু হলে ফরায়েজি সম্প্রদায়ভুক্ত রায়ত ও চাষিরা তাঁর সুযোগ্য পুত্র ও উত্তরসূরি মুহসীন উদ্দিন ওরফে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয় এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য নিবেদন করে।
হাজি শরীয়তুল্লাহ আন্দোলনের প্রকৃতি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু মত পার্থক্য বিদ্যমান। এ আর মল্লিকের মতে, হাজি শরীয়তুল্লাহর আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু মঈন উদ্দিন আহমদ খান ও জেমস ওয়াইজ মনে করেন তার আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল মূলত ধর্মীয়। কিন্তু আমরা মনে করি যে, ধর্মের ভিত্তিতে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রবর্তন এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলেও শরীয়তুল্লাহ কৃষকদের অর্থনৈতিক শোষনের বিষয়টিতে বেশি মনোযোগী ছিলেন। ফলে ক্রমাগতভাবেই ফরায়েজি আন্দোলন অর্থনৈতিক চরিত্র ধারণ করে। নেতার জীবদ্দশাই অনুগামীদের অর্থনৈতিক শোষণই তাকে জমিদারদের সাথে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। জমিদার বিরোধী প্রতিরোধ এক অর্থে সরকার বিরোধীও বটে। সে কারণে এই আন্দোলনকে আর্থরাজনৈতিকও বলা যেতে পারে। কেননা জমিদারদের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছে সরকার। এ ক্ষেত্রে গবেষক Dr. M. Mujeeb এর বক্তব্যটি প্রণধানযোগ্য যে "Because of its (the Faraizi Movement) opposition to exploitation, it also worked for the establishment of a political nucleus."
পিতার নমনীয় নীতি ত্যাগ করে দুদু মিয়া খোলাখুলিভাবে ফরায়েজি নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রবৃত্ত হন। তাঁর নেতৃত্বে ফরায়েজি সংগঠন ক্রমাগত বিকাশ লাভ করে। নিজেদের ধর্মমত প্রসারের জন্য ফরায়েজিরা সংঘবদ্ধ প্রচারের উপর গুরুত্বারোপ করেন। এক ধরনের সংগঠন ব্যতীত এরূপ প্রচার কার্য চালানো সম্ভব ছিল না। এছাড়া ফরায়েজি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নানা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুপ সমালোচনা ও অপপ্রচার এবং ফরায়েজিদের অন্যতম শত্রু জমিদার ও নীলকরদের প্রতিহত করার জন্যও সংগঠন ক্রমেই অপরিহার্য হয়ে ওঠে। দুদু মিয়া তাঁর ফরায়েজি সংগঠনের দুটি লক্ষ্য স্থির করেন, প্রথমত; শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ভ্রাতৃসংঘ গঠন ও সংরক্ষণ এবং দলের সংহতি রক্ষার পক্ষে একটি ক্রমোচ্চ কাঠামো গঠন। দ্বিতীয়ত; দলের কোনো সদস্য মামলা মোকদ্দমায় জড়ালে সকলের চাঁদায় তাকে রক্ষার প্রচেষ্টা স্বরূপ একটি তহবিল গঠন। প্রথম লক্ষ্য সম্পর্কে শরীয়তুল্লাহ নিজেই সচেতন ছিলেন। যে কারণে তিনি ফরিদপুরের জালাল উদ্দিন মোল্লাকে এক শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তবে দুদু মিয়ার আমলেই প্রতিরোধের এ ব্যবস্থা পূর্ণতা লাভ করে ।
সংকটের সময় দলীয় সংহতি রক্ষার ক্ষেত্রে দরকার হয় কঠোর শৃঙ্খলার। এই শৃঙ্খলার একটা প্রধান ভিত্তি ছিল নেতার উপর নিঃশর্ত এবং অবিচল আস্থা স্থাপন । আন্দোলনের শুরুর দিকে শরীয়তুল্লাহ চাইতেন শিষ্যদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের মধ্যে প্রভুত্বের কোনো স্পর্শ যাতে না থাকে। কারণ প্রভুত্ববোধের অবিচ্ছেদ্য অংশ অনুসারীদের অধীনতাবোধ। গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের প্রচলিত নাম পীর-মুরিদ তাঁর পছন্দ ছিল না। কিন্তু দুদু মিয়ার সময়ে সংগঠনের নতুন পর্যায়ে এ সম্পর্কের মূল ধারণা পাল্টে যায়। তার কাছে অনুগামীদের নির্বিচার আনুগত্য প্রকাশের ফলে গুরু-শিষ্যের সম্পর্কে পুরানো কাঠামোর প্রবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ফরায়েজি অধ্যুষিত অঞ্চলকে কতিপয় এলাকায় বিভক্ত করে ওস্তাদ আলাদাভাবে তার শিষ্যদের (খলিফা উপাধি প্রদান করে) উপর দায়িত্ব অর্পণ করতেন। ওস্তাদের নির্দেশ ছিল অকাট্য। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ছিল শুধুমাত্র ওস্তাদের। ফরায়েজিদের সংহতিবোধের অন্য একটি মাধ্যম ছিল ধর্মীয় ও নৈতিক বিশ্বাস। গোড়াকার ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে এ নৈতিক বিশ্বাসের প্রত্যক্ষ কোনো সংযোগ নেই। এই বিশ্বাসের মূল বক্তব্য ছিল গোষ্ঠীর স্বার্থ অভিন্ন। কোনো ফরায়েজির স্বার্থ বিপন্ন হতে পারে এমন কোনো কাজ অন্যরা করবে না। এমনকি আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে হলেও গোষ্ঠী বা যেতে পারে। তিনি প্রয়োজনে কৃষকদেরকে জমিদারদের জমি ত্যাগ করে সরকারি খাস জমিতে বসবাসের জন্য নির্দেশ দেন। এমতাবস্থায় জমিদাররা ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ‘পঞ্চম’ আইন ও ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দের ‘সপ্তম’ আইন অনুযায়ী ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে তাদের লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে জোর করে কর আদায় করতে আসেন। জমিদার বাহিনী অবৈধ করের জন্য কৃষকদের উপর নিপীড়ন চালাতে থাকে। দুদু মিয়া সকল ফরায়েজি রায়ত চাষিদেরকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। দুই বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন স্থানে একাধিক সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। ঔপনিবেশিক সরকার নিজ স্বার্থেই এই কৃষক অভ্যুত্থান দমনে জমিদার ও নীলকরদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। ১৮৪০-৪৭ খ্রি. পর্যন্ত জমিদার ও ফরায়েজি সংঘর্ষ এক ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সরকার সেনাবাহিনী তলব করতে বাধ্য হয়। এক সরকারি হিসেবে দুদু মিয়া ৮০,০০০ ফরায়েজি অনুসারীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। তবে ফরায়েজিদের মতে এ সংখ্যা ছিল ২,৫০,০০০ । কিন্তু শক্তি প্রয়োগে এই বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব নয় ভেবে সরকার নতুন কৌশল অবলম্বন করে । ১৮৪০ খ্রি. শেষভাগে নানান অভিযোগে বিদ্রোহীদের নেতা দুদু মিয়াকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে আবদ্ধ রাখা হয়। সরকার ভেবেছিল এতে বিদ্রোহী কৃষকরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে। কিন্তু সরকার কর্তৃক কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি মুক্তি লাভ করেন। এভাবে বিদ্রোহের মিথ্যা অভিযোগে তাকে কয়েকবার বন্দি করা হয়। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি ।
ইতোমধ্যে দুদু মিয়ার স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম অনেক দূর অগ্রসর হয়। ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুরের পাঁচচর নীলকুঠির কুখ্যাত ম্যানেজার ডানলপের অত্যাচারে অতিষ্ঠ কৃষকগণ নীলকুঠি আক্রমণ করে এবং এর গোমস্তাকে হত্যা করে। এই ঘটনায় এ অঞ্চলে এক বিশাল সেনাবাহিনী এসে হাজির হয়। কৃষকদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালানো হয়। দুদু মিয়াকে বন্দি করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে ফরিদপুরের দায়রা আদালতে দুদু মিয়া ও তাঁর ৬২ জন অনুসারী বিচারে দোষী সাব্যস্ত হন। কিন্তু দুদু মিয়ার পক্ষ থেকে জমিদার নীলকরদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আদালতে দাখিল করা হয়েছিল তা অগ্রাহ্য হয়। দীর্ঘ বিচারের পর বিদ্রোহীদের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের বিচারে সকলেই মুক্তিলাভ করেন। কলকাতার নিজামত আদালত ফরিদপুরের নিম্ন আদালতে ভাবমূর্তির সংকটে পড়ে। তবে এতেও নিম্ন আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং দুদু মিয়াকেও মিথ্যা মামলায় জড়ানো বন্ধ হয়নি। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের তথাকথিত সিপাহিবিদ্রোহের অজুহাতে ইংরেজ সরকার দুদু মিয়াকে বন্দি করেন। বিনা বিচারে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত কারাগারে আবদ্ধ রেখে ফরায়েজি আন্দোলনের অগ্রগতি ব্যাহত করেন। নেতার অবর্তমানে ফরায়েজিরা মহাবিদ্রোহে (১৮৫৭) সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে দুদু মিয়া মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিগণ এবং শিষ্যরা তাঁর মতো বিপ্লবী ভূমিকা করতে না পারায় ফরায়েজি আন্দোলন ক্রমেই স্তিমিত হয়ে পড়ে। Dr. Tajul Islam Hashmi মনে করেন যে, "So it would be difficult to establish that peasant insurgencies in the name of Islam was purely a by-product of the pesants, outonomous domain." দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর জমিদার, নীলকর, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর উৎপীড়নে ফরায়েজিদের সংগ্রাম শক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়ে। আতঙ্কগ্রস্ত মুসলমান কৃষকরা ফরায়েজি গোষ্ঠী ত্যাগ করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে যোগদান করে। ফরায়েজি আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল সাধারণ অবস্থার মুসলমানদের আনুগত্য। কিন্তু এ নতুন ধর্মমতে আদি ইসলামের সঙ্গে সংগতিহীন যে আচার অনুষ্ঠান ও বিশ্বাস বর্জনের কথা ছিল তার অনেকগুলোই শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল। ফরায়েজি প্রভাবের দ্রুত প্রসার সম্পর্কে সমসাময়িক ধারণাও কিছুটা অতিরঞ্চিত বলে মনে হয়। ফরায়েজি অনুগামীদের একটা নগণ্য অংশই মাত্র নতুন জীবন চর্চা সম্যক অনুসরণ করতো। তাদের নিকট বরং বেশি আকর্ষণীয় ছিল নেতার ভ্রাতৃত্বের বাণী এবং আদর্শ। তবে নেতার প্রচার থেকে তাদের ধারণা হয়েছিল যে, তাদের নতুন বিশ্বাসে জমিদারদের হস্ত ক্ষেপ অন্যায়। অন্যদিকে জমিদারশ্রেণির নিকট এরূপ সংস্কার ছিল অগ্রহণীয় এবং অমার্জনীয়। সংঘর্ষ ও সংঘাত তাই ক্রমেই অনিবার্য হয়ে উঠে। শুরুতেই সংঘাতের রূপ ছিল একরকম, কিন্তু পরে তা ক্রমেই জটিল হয়ে পড়ে। ফরায়েজি আন্দোলনে ধর্ম বিশ্বাস এভাবেই শ্রেণিচেতনার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। আর ধর্মবিশ্বাসের আদিরূপও তাতে অনেকখানি পাল্টে যায় ।
পরিশেষে বলা যায় যে, ফরায়েজি আন্দোলনটি নতুন ধর্মীয় (Sect) গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল । আন্দোলনের দ্রুত বিস্তারের সময় গোষ্ঠী বহির্ভূত অনেক কৃষক ও কারিগরশ্রেণি এতে যোগদান করেছিল। এ আন্দোলনের প্রাথমিক প্রেরণা কিন্তু স্থানীয় পরিবেশ থেকে আসেনি। এর উৎস ছিল এ অঞ্চল বহির্ভূত এবং বৃহত্তর ধর্মসংস্কার আন্দোলন যাকে ইসলামের পুনরুজ্জীবন (Islamic Revival) বলা হয়। যে দর্শনের উপর ‘ইসলামিক রিভাইভ্যাল' আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত এটি একটি সামগ্রিক জীবন দর্শন । ফরায়েজিরা এরূপ দর্শনের আলোকে প্রকৃত অর্থে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন যেখানে তারা থাকবেন স্বাধীন। কিন্তু ঔপনিবেশিক শক্তির মহা দাপটের কবলে পতিত হয়ে ফরায়েজি আন্দোলনের মতো একটি সংস্কারাশ্রয়ী আন্দোলন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তাই ধীরে ধীরে এই আন্দোলন ধর্মের নামে শুরু হলেও এর মূল উদ্দেশ্য ছিল এর অনুসারীদেরকে ইংরেজ সরকারের আর্থিক শোষণ থেকে মুক্ত করা। তবে ব্রিটিশ সরকারের এরূপ দমনপীড়ন ও হয়রানির ফলে জনমনে ব্রিটিশ বিরোধী ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তাই পরবর্তীতে এ আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হয়।
সুতরাং, প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে ফরায়েজি আন্দোলন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]