বিদ্রোহী সাঁওতালদের পরিচিতি বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ

Sawtal Rebellion (1855-57)
ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই বিশেষকরে বাংলায় দীর্ঘদিন ধরে চলে বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলন। ১৭৬৩ থেকে ১৯৪৭ খ্রি. ব্যাপী ব্রিটিশ শাসনের অবসান পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে ও মাত্রায় এসব আন্দোলন চলতে থাকে। উনিশ শতকের পঞ্চম দশকে অর্থাৎ ১৮৫৫ খ্রি. সাঁওতাল বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। সাঁওতাল বিদ্ৰোহ সংঘটিত হয়েছিল তৎকালীন বাংলার বীরভূম, ভাগলপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলার সাঁওতাল উপজাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ। কোম্পানির শাসনব্যবস্থা শুরু হওয়ার পূর্বে সাঁওতালদের জীবনযাত্রা ছিলো সরল ও সাধাসিধে। কোম্পানির বাংলা দখল করার পর তারা সাঁওতাল জীবনের ওপর বাড়িয়ে দিয়েছিল শোষণ ও নির্যাতনের মাত্রা। এতে সাঁওতালরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ১৮৫৫- ৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ইতিহাস খ্যাত ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ', যেখানে সিধু ও কানু নামের দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমে পড়েছিল। প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
বিদ্রোহী সাঁওতালদের পরিচিতি
সাঁওতালদের সম্পর্কে আপনি কতটা জানেন, কিভাবে জানেন, একটু ভেবে দেখবেন কী?
মাদলের তাল, বাঁশির সুর ও হাড়িয়ার মাদকতা সহযোগে নৃত্যগীত-উৎসবে মেতে আছে নারী পুরুষ সকলে - সাঁওতাল জীবনের এরূপ চিত্রায়নের সাথে শিল্প, সাহিত্য, ছায়াছবি প্রভৃতির মাধ্যমে আপনি হয়তবা পরিচিত হয়ে থাকবেন। সাঁওতালরা দেখতে কেমন, এ সম্পর্কেও হয়ত বিভিন্ন সূত্রে আপনার একটা পূর্ব-ধারণা- থাকতে পারে। সব মিলিয়ে বাংলা অঞ্চলের প্রধান একটি ‘আদিম' জনগোষ্ঠী হিসেবে সাঁওতালদের সম্পর্কে বাঙালি জনমানসে বেশ কিছু বদ্ধমূল ধারণা রয়ে গেছে, যেগুলোর প্রধান দুটি দিক রয়েছে। একদিকে শিল্প-সাহিত্য-সংগীতে সাঁওতালদের একটা রোমান্টিক প্রতিচ্ছবি চোখে পড়ে, যেখানে তারা হয়ে দাঁড়ায় আদিম সারল্যের প্রতিমূর্তি এবং কখনোবা সুদূর অতীতে ফেলে আসা বাঙালিদের কোনো পূর্বতন সত্তা বা ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছায়া; অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনে সাঁওতালদের অনেকে বাঙালিদের কাছে অচ্ছুৎ হিসেবেও গণ্য হয়ে এসেছে, যেমন উত্তরবঙ্গের অনেক স্থানে সাঁওতালদেরকে দোকানে চা খেতে দেওয়া হতো না, এমন ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়, সে প্রবণতা এখনো পুরোপুরি ঘুচে যায়নি।
সাধারণভাবে বলা চলে, সাঁওতালদের সম্পর্কে সংখ্যাগুরু বাঙালিদের অধিকাংশের ধারণা অস্পষ্ট, অনেকক্ষেত্রে কল্পনাশ্রয়ী এবং সচরাচর অবজ্ঞাসূচক। একথা শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই সত্য তা নয়, বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বেলায়ও প্রযোজ্য, যেখানে অনেক বেশি সংখ্যায় সাঁওতালদের বসবাস রয়েছে। (ভারতে সাঁওতালদের মোট সংখ্যা অর্ধকোটির মত হতে পারে। বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক সংখ্যক সাঁওতালদের বসবাস। ছোট নাগপুর, সাঁওতাল পরগনা প্রভৃতি হচ্ছে মূল সাঁওতাল-অধ্যুষিত এলাকা। এছাড়া উড়িষ্যা, আসাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি ভারতীয় অঙ্গরাজ্যে এবং নেপালেও সাঁওতালদের বসবাস রয়েছে।) ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে দুই লক্ষাধিক সাঁওতাল রয়েছে, যাদের অধিকাংশ বাস করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়- যেমন: রাজশাহী, দিনাজপুর, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, পঞ্চগড়, নাটোর, ঠাকুরগাঁও প্রভৃতি। অবশ্য উত্তরবঙ্গে দৈহিক বৈশিষ্ট্যে সাঁওতালদের সাথে মিল রয়েছে, এমন অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্যদেরও (সংখ্যায় যারা ক্ষুদ্রতর) সাধারণভাবে সাঁওতাল বলেই মনে করা হয়। উত্তরবঙ্গের বাইরে সিলেটের চা বাগান এলাকায়ও সাঁওতালদের দেখা মেলে শ্রমিক হিসাবে। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামে খাগড়াছড়ি জেলার মত দূরবর্তী স্থানেও সাঁওতাল পল্লির অস্তিত্ব রয়েছে।
সাঁওতালদের পরিচিতি নিম্নোক্ত শিরোনামে উপস্থাপন করা যায় : বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজাতি সাঁওতাল । তাদের বাসস্থান মূলত রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, নওগাঁ নাটোর, জয়পুরহাট ও চাপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। তাদের আদি নিবাস ছিল রাঢ়বঙ্গ সংলগ্ন বিহার ও উড়িষ্যার অরণ্য অঞ্চল এবং ছোট নাগপুর। পরে সরকার নির্ধারিত সাঁওতাল পরগনায় তারা বসবাস শুরু করে। পাবনা, যশোর, খুলনা এমনকি চট্টগ্রাম জেলায়ও অল্পসংখ্যক সাঁওতালদের বসতি ছিল। নিচে সাঁওতাল উপজাতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. দেহাকৃতি : সাঁওতালরা অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর। তাদের গায়ের রং কালো, উচ্চতা মাঝারি, চুল কালো ও কোঁকড়ানো, ঠোঁট পুরু, দীর্ঘমুখ ও নাক প্রশস্ত ।
২. ভাষা, বর্ণমালা ও সংস্কৃতি : সাঁওতালদের নিজস্ব ভাষা আছে, তবে বর্ণমালা নেই। সাঁওতালরা হিন্দ-নাগরী ভাষায় কথা বলে। সাঁওতালের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, যা নানা কাহিনি, রূপকথা, উপকথা, লোকগীতি, নৃত্যগীতি ও সংগীত সমৃদ্ধ ।

৩. বাড়িঘর : সাঁওতালরা ছন বা খড় দিয়ে বাড়িঘর তৈরি করে। তাদের থাকার ঘরগুলো ছোট ছোট, একটি জানালা ও একটি দরজা থাকে। আবার কোনো কোনো ঘরে শুধু একটি দরজা থাকে। দরজাটি সুন্দর করে আল্পনা দিয়ে আঁকা থাকে। তারা ঘর ও মেঝে লেপেমুছে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখে ।
৪. পরিবার : সাঁওতাল সমাজে পরিবারের প্রধান পিতা। পরিবারের পুরুষদের প্রভাবই বেশি। পিতার মৃত্যুর পর পুত্ররা সম্পত্তির মালিক হয় ।
৫. পোশাক-পরিচ্ছদ : সাঁওতাল পুরুষেরা আগে নেংটি পরত। তবে ধনী পরিবারের পুরুষরা ধূতি, লুঙ্গি ও সার্ট পরে। মেয়েরা পরে মোটা শাড়ি। ধনী ঘরের মেয়েরা শাড়ি, ব্লাউজ ও সায়া পরে । মেয়েরা রূপার অলঙ্কার, যেমন— কানের দুল, নথ, হাঁসুলি, মালা ও তাবিজ পরে। সাঁওতাল যুবতীরা খোঁপায় জবা ও শিমুল ফুল পরতে খুবই ভালোবাসে ।
৬. বিবাহ : সাঁওতাল সমাজে একই গোত্রে বিয়ে করা যায় না। তাদের বিয়ের চার ধরনের রীতি প্রচলিত। বিয়ের অনুষ্ঠানে তারা নাচ, গান, পানাহার এবং খুবই আনন্দ-ফুর্তি করে থাকে ।
৭. ধর্ম ও উৎসব : সাঁওতালরা জড়বস্তুর পূজা করে। তাদের প্রধান দেবতা হলো সূর্য। তারা সূর্যকে বলে ‘সিংবোঙ্গা’। তাদের গ্রাম দেবতা ‘মারাংরুরু’। তাদের সকল কাজকর্মের দেবতা ‘বোঙ্গা’। সাঁওতালরা সারা বছর নানা পূজা-পার্বণ করে। ‘মোহরাই’ পূজা তাদের শ্রেষ্ঠ উৎসব। এই উৎসবের সময় সাঁওতালরা আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে উঠে । মোহরাই উৎসব চলে তিনদিন পর্যন্ত।
৮. জীবন ধারণ পদ্ধতি : সাঁওতালদের জীবিকা কৃষিকাজ। তারা ধানসহ নানা রকমের ফসল ফলায় । তারা চা বাগানে, মাটি কাটা ও কুলি কাজও করে থাকে ।
সরল ও আমোদপ্রিয় জনগোষ্ঠী হিসাবে সাঁওতালদের যে সাধারণ পরিচিতি রয়েছে, তার বাইরে এই উপমহাদেশের ইতিহাসে তাদের রয়েছে সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। অধিকন্তু বাঙালি জনসমষ্টির আবির্ভাবের ইতিহাস তলিয়ে দেখলেও সাঁওতাল ও অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে সুদূর অতীতের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আবিষ্কৃত হয়। কাজেই নিচে আমরা সেসব ইতিহাস সংক্ষেপে পর্যালোচনা করব।
সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট
১. ভাষা ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট : ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীদের শ্রেণীকরণ অনুসারে সাঁওতালদের ভাষা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের অন্তর্গত (Austro- Asiatic)। এই উপমহাদেশে এই ভাষা-পরিবারের দুটি শাখার প্রতিনিধি রয়েছে, একটি হলো ‘মুণ্ডা' এবং অন্যটি হলো ‘মন-খমের' (Mon-Khmer)। মুণ্ডা নামে একটি জনগোষ্ঠীও আছে, যাদের নামানুসারে প্রথমোক্ত শাখার নামকরণ করা হয়েছে, যদিও সংখ্যায় মুণ্ডাদের চাইতে সাঁওতালরাই বেশি। ‘মুণ্ডা’ ভাষাগোষ্ঠীর আওতায় সাঁওতাল ও মুণ্ডা ছাড়াও কোল, হো, খেরওয়ারি, খারিয়া প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর ভাষা পড়ে। (অন্যদিকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বাইরে এই উপমহাদেশে মন্-খমের শাখার অন্তর্ভুক্ত একটি মাত্র ভাষার বিকাশ ও প্রসারের আগে এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের মধ্যে মুণ্ডা গোষ্ঠীর ভাষাসমূহই সর্বাধিক প্রচলিত ছিল। বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটা প্রধান অংশ‍ই জাতিগতভাবেও সেই উৎস থেকেই এসেছে বলে ধারণা করা হয়। কালক্রমে সেই মুণ্ডা-ভাষীদের অনেকে ‘বাংলাৎ ভাষী তথা বাঙালি হয়ে উঠলেও বাংলা ভাষা বা বাঙালি সংস্কৃতিতে অস্ট্রো-এশিয়াটিক বহু ছাপ এখনো রয়ে গেছে। যেমন, বাংলা ব্যাকরণের বইয়ে ‘দেশি' হিসেবে যেসব শব্দ পাওয়া যায়, সেগুলোর অধিকাংশ মুণ্ডা-গোষ্ঠীর শব্দ । একইভাবে গ্রামাঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালিদের পলিত জন্ম-বিবাহ প্ৰভৃতি সংক্রান্ত অনেক লোকজ আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্বাসও একই উৎসজাত বলে নৃবিজ্ঞানীরা রায় দিয়েছেন। তবে বাঙালি ভদ্রলোকেরা বেশিরভাগই নিজেদেরকে আর্য (হিন্দুদের বেলায়) বা শেখ-সৈয়দ-মুঘল-পাঠানদের (মুসলমানের ক্ষেত্রে) বংশধর হিসাবেই কল্পনা করে আসছেন। কাজেই সাঁওতালদের মতো আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের সাথে ঘনিষ্ঠ উৎপত্তিগত বা সাংস্কৃতিক যোগসূত্র থাকা সত্ত্বেও সমষ্টিকভাবে সমকালীন বাঙালির সেই যোগসূত্রকে বিস্মৃতির গহ্বরেই ফেলে রেখেছে। কিন্তু ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সাঁওতালদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছে যা পরবর্তীতে বিদ্রোহে প্রেরণা যুগিয়েছে।
২. আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশের সাঁওতালরা অধিকাংশই দরিদ্র এবং শিক্ষাবঞ্চিত। তাদের মধ্যে সাক্ষরতার হার সম্ভবত ১০%-এর বেশি হবে না। তবে বিদ্যমান আর্থসামাজিক দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে সাঁওতাল ও তাদের প্রতিবেশী অন্যান্য আদিবাসীরা তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠিত হচ্ছে, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় । যেমন, বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বর্তমানে ‘সাঁওতাল স্কুল' পরিচালিত হচ্ছে, যে উদ্যোগের সাথে সাঁওতালরা নিজেরাও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। অবশ্য মিশনারিদের থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের একাধিক রাজনৈতিক দল ও বেশ কিছু বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ালেও ‘ডিকু’দের প্রতি সাঁওতালদের ঐতিহ্যগত অবিশ্বাস কতটা ঘুচে গেছে, তা ততটা স্পষ্ট নয় ।
নিজেদের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ থেকে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকলেও এদেশের সাঁওতালরা যেসব বিভিন্নমুখী পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা সম্ভবত বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে একাধিক দেশে ছড়িয়ে থাকা সমগ্র সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বেলায় কমবেশি প্রযোজ্য। যেমন- অর্থনৈতিকভাবে সাঁওতালরা এখন শিকারের উপর আদৌ বা তেমন নির্ভরশীল নয়, যদিও তীর-ধনুকের সাথে তাদের প্রতীকী সংশ্লিষ্টতা এখনো লক্ষ্য করা যায়। একইভাবে গোত্র-সংগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানেও বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগা স্বাভাবিক, যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দুর্লভ ।
প্রথাগতভাবে সাঁওতাল সমাজে গ্রাম পঞ্চায়েতের অস্তিত্ব ছিল, যে ব্যবস্থায় ‘মাঝি হাড়াম' (গ্রাম-প্রধান) থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদ রয়েছে। এই ব্যবস্থা বর্তমানে কতটা কার্যকর রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। সাঁওতালদের সামাজিক সংগঠনের অন্য একটি দিক হচ্ছে গোত্র-সংগঠন। এদেশের সাঁওতালদের বারটি গোত্র রয়েছে বলে জানা যায়, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে কিস্কু, হাসদা, মুর্মু, হেমব্রম, মারান্ডি, টুডু, সরেন, বাস্কি প্রভৃতি। উল্লেখ্য, এই গোত্র-উপাধিগুলোকে সাঁওতালদের নামের অংশ হিসাবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। অবশ্য অবস্থাপন্ন সাঁওতালদের অনেকে বাঙালি হিন্দুদের পদবি তথা আচার অনুষ্ঠান গ্রহণ করেছে, এমন তথ্য পাওয়া যায়। অন্যদিকে সাঁওতালদের , একটা উল্লেখযোগ্য অংশ খ্রিষ্টধর্মও গ্রহণ করেছে, যদিও এক্ষেত্রে সাঁওতাল পদবি ত্যাগ করার দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে না। বলাবাহুল্য, নিজেদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার কতটা কীভাবে তারা ধরে রাখবে, বাইরের কতটুকু কি তারা গ্রহণ বা বর্জন করবে, এসব বিষয়ে ভেবেচিন্তে সাঁওতালরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে। তারা সরল বা অজ্ঞ, এ ধরনের মূল্যায়নের ভিত্তিতে বাইরের কেউ যদি অভিভাবকসুলভ ভঙ্গিতে তাদের উপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চায়, তবে এমন ব্যক্তি হয়ত ‘ডিকু’র মতোই আচরণ করবে। এ প্রসঙ্গে একটা কথাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, অন্যান্য সকল জনগোষ্ঠীর মতোই বাংলাদেশের সাঁওতালরাও পরিবর্তনশীল পরিপার্শ্বের সাথে খাপ খাইয়ের চলার চেষ্টা করবে। কাজেই 'সাঁওতাল' জনগোষ্ঠীর কথা শুনলেই স্থির-অনড় কিছু গতানুগতিক চিত্র যদি কারো মানসপটে ভেসে ওঠে, সেগুলো অবশ্যই ঝেড়ে ফেলা দরকার। তবে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট অবস্থা এবং ডিকুদের প্রতি ঘৃণা সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট রচনায় ভূমিকা রেখেছে ।
৩. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও আপেক্ষিক স্বাধীনতা বজায় রেখে সাঁওতালদের মতো আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকাসমূহে বসতি স্থাপন করে আসলেও বিভিন্ন সময়ে অধিকতর শক্তিশালী জনগোষ্ঠীদের আগ্রাসনের মোকাবিলা তাদের করতে হয়েছে। এই আগ্রাসন নতুন মাত্রা ও তীব্রতা লাভ করে উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার আওতায় যখন সাঁওতাল তথা অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা ব্যাপক হারে শোষণ নিপীড়নের মুখে পতিত হয়, তাদের অনেকে চেষ্টা করেছিল রুখে দাঁড়াতে। এভাবে সংঘটিত হয়েছিল ১৮৫৫-৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ইতিহাস-খ্যাত ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ', যেখানে সিধু ও কানু, নামের দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমে পড়েছিল। বিহারের ভাগলপুর থেকে বীরভূম পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী ও তাদের সহায়ক দেশীয় জমিদার-মহাজনদের শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল, কিন্তু সাঁওতালদের প্রতিরোধকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়নি। বাঙালি ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর যেসব সদস্যরা জমিদার-মহাজন বেশে সাঁওতাল-ভূমিতে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, তাদেরকে সাঁওতালরা অভিহিত করত ‘ডিকু’ হিসেবে। এই ‘ডিকু’দের প্রতি সাঁওতালরা যে ঘৃণা ও অবিশ্বাস ঐতিহাসিকভাবে লালন করেছে, সেটাকে দেখা যেতে পারে ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের প্রতি তাদের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসাবে।
বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ তথা অন্যান্য অঞ্চলে যেসব সাঁওতালরা এখন রয়েছে, তারা মূলত এসব এলাকায় অভিবাসিত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। ঐতিহ্যগতভাবে শিকার ও কৃষিনির্ভর সাঁওতালরা এদেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রথম জনবসতি গড়ে তুলেছিল। তবে এসব জায়গায়ও তারা সংখ্যাগুরুদের আগ্রাসন ও ক্ষমতাসীনদের শোষণ নিপীড়ন থেকে রেহাই পায়নি। ১৯৪০-এর দশকে ইলা মিত্রের নেতৃত্বে রাজশাহীর নাচোলে সংঘটিত ‘তেভাগা আন্দোলনে' সাঁওতাল বর্গাচাষিরাই নেতৃত্ব দিয়েছিল। এই আন্দোলন ‘নাচোল বিপ্লব' বা ‘রাজশাহীর/ নাচোলের সাঁওতাল বিদ্রোহ' নামেও পরিচিত। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল জমির ফসলের ভাগাভাগিতে বর্গা- চাষিদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা। তবে রাষ্ট্রব্যবস্থা এগিয়ে এসেছিল জোতদারদের পক্ষে। ফলে সাঁওতাল বিদ্রোহীরা ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়। বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান কৃষকরাও এই আন্দোলনে সমর্থন-সহায়তা জোগালেও দমনমূলক ব্যবস্থা মূলত সাঁওতালদের বিরুদ্ধেই গৃহীত হয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ ধরনের বৈষম্য, অন্যায় ও নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে এদেশের সাঁওতালরা এখনো মুক্ত হয়নি ।
উপর্যুক্ত সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে অতি সংক্ষেপে বলা যায় যে, সাঁওতালরা এ উপমহাদেশের অন্যতম একটি সংখ্যাবহুল আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশে যাদের একট ক্ষুদ্রাংশ মাত্র-সংখ্যায় দুই লক্ষাধিক-বসবাস করছে। বহু শতাব্দী ধরে জাতিগত বৈষম্য ও সামন্ত-ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই সাঁওতালরা তাদের আত্মপরিচয় সমুন্নত রেখেছে। অনেক গবেষকের মতে বাংলা ভাষা তথা বাঙালি জনগোষ্ঠী ও তাদের সংস্কৃতির উৎপত্তির ইতিহাসের সাথে সাঁওতালদের মতো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পূর্বসূরিদের ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, বাংলা ভাষার ‘দেশি' শব্দভাণ্ডার সেই সাক্ষ্যই দেয়। তবে সাধারণভাবে বাঙালি ভদ্রলোকেরা তাদের জাত্যাভিমানের কারণে সাঁওতালদের সাথে তাদের এই ‘আত্মীয়তাকে রোমান্টিকতা বা অবজ্ঞা-উপেক্ষার আড়ালেই লুকিয়ে রেখেছে। অধিকন্তু ঐতিহাসিকভাবে তাদের অনেকে ‘ডিকু’র ভূমিকায় সাঁওতালদের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার আগ্রাসনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সংগ্রাম করেছে শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের সাঁওতালরা অধিকাংশই দরিদ্র ও শিক্ষাবঞ্চিত হলেও বিভিন্নভাবে তারাও প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে খাইয়ে চলার চেষ্টা করছে। আর ১৮৫৫-৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ইতিহাস খ্যাত ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ' যেখানে সিধু ও কানু নামের দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমে পড়েছিল ।

সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ


উনিশ শতকের পঞ্চম দশকে অর্থাৎ ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তৎকালীন বাংলার বীরভূম, ভাগলপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলার সাঁওতাল এলাকাগুলোতে ।
সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ। কোম্পানির শাসনব্যবস্থা শুরু হওয়ার পূর্বে সাঁওতালদের জীবনযাত্রা ছিল সরল ও সাদাসিধে। কোম্পানির বাংলা দখল করার পর তারা সাঁওতাল জনজীবনের ওপর বাড়িয়ে দিয়েছিল শোষণ ও নির্যাতনের মাত্রা। তাদের এলাকায় কোম্পানি সরকার শাসন ও শোষণ অপেক্ষাকৃত মজবুত করার উদ্দেশ্যে জমিদার, দালাল, মহাজন, সরকারি আমলা ও দারোগা সৃষ্টি করে সাঁওতাল জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল ।
মহাজনেরা সাঁওতালদের নিকট থেকে চড়া সুদ আদায় করত। ধান, চাল ধার দেবার সময় ওজনে ফাঁকি দিত। সাঁওতালরা যখন ধান-চাল পরিশোধ করত, তখন, তাদের নিকট থেকে আদায় করা হতো কয়েকগুণ বেশি। এই বেশি আদায়ের ওজনকে বলা হয় ‘কেনারাম' বা ‘বড় বউ' আর সাঁওতালদের ধার দেবার সময় যে ওজন ব্যবহার করা হতো- তাকে বলা হতো ‘বেচারাম' বা ‘ছোট বউ' ।
ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতি এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে বছরের পর বছর মহাজনের দেনা দশগুণ পরিশোধ করেও সাঁওতাল ঋণ থেকে মুক্তি পেত না। তাদের হালের গরু ও ফসল জোর করে কেড়ে নিয়ে যেত মহাজনরা। যেসব পরিবার দেনার দায়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যেত, তাদের পরিবারের সমস্ত সদস্যকে ক্রীতদাসে পরিণত করা হতো।
এক ম গজন ছাড়াও ছিল এ শ্রেণির দালাল। দালালরা নামমাত্র মূল্যে চাল, ডাল, সরিষা ও অন্যান্য তৈল জাতীয় দ্রব্য বারহাইত নামক স্থান থেকে কিনে গরুর গাড়িতে করে ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত জঙ্গীপুরে নিয়ে যেত। জঙ্গীপুর থেকে এইসব দ্রব্য চালান দিতো মুর্শিদাবাদ-মুর্শিদাবাদ থেকে নিয়ে যাওয়া হতো কলকাতায়- কলকাতা থেকে মালগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হতো জাহাজে করে বিলাতে।
জমিদাররা অশিক্ষিত, নিরীহ সাঁওতালদের কাছ থেকে চড়া হারে খাজনা আদায় করত এবং সেই সঙ্গে আরও আদায় করত বেআইনি আবওয়াব ও নজরানা।
এই অঞ্চলে শোষণ চালানোর জন্যে বসতি স্থাপন করেছিল নীলকর সাহেবরা। তারা জোর করে নীলের চাষ করাত। রেলপথ নির্মাণের জন্যে একদল ইউরোপীয় বাস করতো এই অঞ্চলে। তাদের কাজ ছিল সাঁওতাল মেয়েদের সতীত্ব নষ্ট করা। যারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাত, তাদের ওপর চালানো হতো কঠোর নির্যাতন 1
স্থানীয় সরকারি আমলা ও দারোগাদের অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ সামগ্রিক পরিস্থিতি এমনই হয়ে উঠেছিল যে সাঁওতালদের বিদ্রোহ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সাঁওতালদের জীবনে সেদিন যে দুঃখ ও দুর্দশার কালো মেঘ নেমে এসেছিল- তার একটা বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় একটি গানে
“আমরা প্রজা, সাহেব রাজা, দুঃখ দেবার যম
তাদের ভয়ে হটবো মোরা এমনি নরাধম ?
মোরা শুধু ভুখবো?
না, না মোরা রুখবো।'
সুতরাং, উপর্যুক্ত কারণেই প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসের বিখ্যাত
সাঁওতাল বিদ্রোহ সংগঠিত হয় ।
সাঁওতাল বিদ্রোহীদের প্রভাব
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে সাঁওতালদের ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের কাহিনি লিপিবদ্ধ রয়েছে। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন তারিখে ভাগনাদিহির মাঠে দশ হাজার সাঁওতাল সিধু ও কানুর নেতৃত্বে সমবেত হয়েছিল। এই সমাবেশেই সিধু ও কানু সাঁওতালদেরকে বিদ্রোহ করার জন্য নির্দেশ দেন। বিদ্রোহের বাণী চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাঁওতাল (কখনো ১০ হাজার, কখনো ৩০ হাজার) বিদ্রোহীদের দলে যোগদান করে ।
প্রথম দিকে বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল ভাগলপুর থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত। বিদ্রোহীদের তৎপরতার ফলে এই অঞ্চলে সরকারের ডাক চলাচল বন্ধ হয়ে যায় । ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে এগিয়ে এলে বিদ্রোহীরা তাদেরকে প্রতিরোধ করে। বিদ্রোহের আগুন শুধু ভাগলপুর তেকে মুঙ্গের পর্যন্ত জ্বলে ওঠেনি, জ্বলে উঠেছিল গোদা, পাকুড়, মহেশপুর, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে। জমিদাররা ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। শুধু জমিদাররা নয়- দেওঘর থেকে ম্যাজিস্ট্রেটও পালিয়ে গিয়েছিলেন। মহেশপুর পঞ্চাশ হাজার সাঁওতাল কোম্পনী সৈন্যের গতিরোধ করে। কোম্পানি বিদ্রোহ দমন করার জন্যে ৩৭শ, ৭ম, ৩১শ রেজিমেন্ট, হিল রেঞ্জার্স এবং ৪০, ৫২ ও ১৩ রেজিমেন্ট নিয়োগ করেছিল। কিন্তু তবুও বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়নি। কোম্পানি সরকার বিদ্রোহী নেতাদের ধরিয়ে দেবার জন্য মাথাপিছু দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ইংরেজ বড়কর্তারা আতঙ্কিত হয়ে লিখেছিলেন যে সাঁওতালরা সশস্ত্র হয়ে ঘোরাফেরা করছে, তাদের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০,০০০ হাজার । তাদের আত্মসমর্পণ করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না ।

ইংরেজরা ভেবেছিল, তাদের সৈন্যবাহিনীর আক্রমণে হয়তো সাঁওতাল বিদ্রোহীদের শক্তি ভেঙে পড়বে, কিন্তু পরিণামে দেখা গিয়েছিল উল্টো। সেপ্টেম্বর মাসের শেষাদিকে আবার আগুন দ্বিগুণ জ্বলে উঠেছিল সাঁওতাল অঞ্চলে । হাজার হাজার বিদ্রোহী সাঁওতালের পদধ্বনিতে কেঁপে উঠেছিল কোম্পানির শাসন। নিরুপায় হয়ে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চলে জারি করতে বাধ্য হয়েছিল সামরিক আইন ।
বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে সিধু ও কানুর সহিযুক্ত একটা ইশতেহারের নকল স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছিল। এই ইশতেহারটিতে আবেদন জানানো হয়েছিল সমস্ত ‘গরিব জনসাধারণের কাছে।'
ইশতেহারে লেখা ছিল- 'যুবা ঠাকুর নিজে যুদ্ধ করবে, কেষ্টা ঠাকুর ও রামচন্দ্র সহযোগী হবে। ঠাকুরের নির্দেশে কৃষকরা ভেরী বাজাবে এবং ঠাকুর ইউরোপীয় সৈনিক ও ফিরিঙ্গিদের মস্তক ছেদন করবে। সাহেবরা যদি বন্দুক ও বুলেট নিয়ে যুদ্ধ করে, তাহলে সেই বন্দুক ও বুলেট ঠাকুরের ইচ্ছায় নিষ্ফল হবে।
ঠাকুরের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে সাঁওতালেরা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিদ্রোহের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিল। মানুষের মুখে মুখে শোনা যেতো একটি গান:
শিধো, শিধো ভাই তোর কিসের তরে রক্ত ঝরে
কি কথা রইল গাঁথা, ও কানহু তোর হুল হুল স্বরে,
দেশের লেগে অঙ্গে মোদের রক্তে রাঙা বেশ
জান না কি দুস্যবণিক লুটলো সোনার দেশ।'
সাঁওতাল নেতারা এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে একটা স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। তারা ঘোষণা করেছিল আমলাদের পাপে সাহেবরাও পাপাচারে লিপ্ত হয়েছে, এই পাপের ফলে তারা যে দেশটিকে বেআইনিভাবে দখল করেছে, তা হাতছাড়া হয়ে যাবে ।
তারা আরও ঘোষণা করেছিল তাদের রাজ্যে কাউকে খাজনা দিতে হবে না । প্রত্যেকে সাধ্যমতো জমি চাষ করার অধিকার পাবে। সমস্ত ঋণ মওকুফ করে দেওয়া হবে। বলদ চালিত লাঙলের উপর দু'পয়সা আর মহিষ চালিত লাঙলের উপর দু'আনা খাজনা ধার্য হবে।
এই বিদ্রোহের সময় স্থানীয় কামার-কুমার, তেলী, চামার, ডোম এবং মুসলমান তাঁতিরা সাঁওতালদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল। বিদ্রোহীরা বাংলা বিহার ও ছোট নাগপুরের কয়েকটি অঞ্চলে ইংরেজ শাসনকে উচ্ছেদ করেছিল এবং নিজেদের শাসন ছ'মাস কাল ব্যাপী পরিচালনা করেছিল। এভাবেই বিদ্রোহী সাঁওতালরা ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ।
সাঁওতাল বিদ্রোহের ঘটনাসমূহ
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহের ঘটনা বিবৃত হয়েছে। এতে দেখা যায় যে, রাজমহলের পার্বত্য অঞ্চলে সাঁওতাল নামে এক আদিম জাতির বসবাস ছিল। বিহারের ভাগলপুর জেলার অন্তর্গত দামিন-ই-কো (অর্থাৎ পাহাড়ের প্রান্তদেশ) অঞ্চল থেকে বীরভূম পর্যন্ত বিস্তৃত সাঁওতাল ভাষাভাষী ও কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠীর ইংরেজ শাসনবিরোধী অভ্যুত্থানকে ‘খেরওয়ারী হুল' বা সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭ খ্রিঃ) বলা হয়। এ সাঁওতালরা ছিল গোষ্ঠীপতি বা ‘মাঝিদের অধীনে বাংলা, বিহার সীমান্তের জঙ্গলময় পার্বত্য অঞ্চলের কৃষিজীবী । এরা ছিল অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু ও কর্মঠ। চাষ আবাদ করা ছাড়াও, এরা নানাভাবে ধন সম্পত্তির অধিকারী হতো। এরা অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন স্থানে দাপটের সাথে বসবাস করতো।
১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে সাঁওতালদের উপর শুরু হয় নতুন জমিদারদের উৎপীড়ন। ইংরেজ সরকারের ক্রমবর্ধমান খাজনার দাবি ও জমিদারদের প্রয়াসে জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষি আয়তন বৃদ্ধির ফলে বেশিরভাগ সাঁওতাল কৃষিজমি হারিয়ে ‘ডিকু’ মহাজনদের কাছে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। এ ভিন্ন নতুন জমিদারদের অতিরিক্ত খাজনার দাবিতে অতিষ্ঠ হয়ে সাঁওতালরা নিজেদের ঘর বাড়ি ও খেত খামার পরিত্যাগ করে রাজমহলের অরণ্য অঞ্চলে নতুন করে বসতি স্থাপন করে। কিন্তু এতেও তাদের দুঃখদুর্দশার মোচন হলো না। স্থানীয় তথা পরদেশী জমিদার, মহাজন, দুর্নীতিপরায়ণ দারোগা, নতুন রেললাইনের ঠিকাদার, নীলকর ও ইজারাদার সাহেবদের অত্যাচার সাঁওতাল বিদ্রোহের ক্ষেত্র রচনা করে। পূর্ব দশকের জঙ্গলমহল, রাঁচী ও পালামৌ অঞ্চলের চুয়াড় ও কোল উপজাতিদের বিদ্রোহ সাঁওতালদের অনুপ্রেরণা জোগায়। সাঁওতালরা বাংলার বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে । সিধু ও কানুর নেতৃত্বে ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে বহু প্রতিরোধের ঘটনা ঘটে ।
জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচারে সাঁওতালদের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়। অবশেষে তাদের এ ক্ষোভ বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করে। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে ‘মাঝি' ও ‘পরগনাইত' নামে সাঁওতাল সর্দাররা নিজেদের মধ্যে বিদ্রোহের সম্ভাবনা নিয়ে গোপনে আলাপ আলোচনা শুরু করে। ইতোমধ্যে জমিদার ও মহাজনদের বিক্ষিপ্তভাবে হত্যার ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন গোক্কো ও বীরসিংহ নামে গোষ্ঠীপতিদের উপর উৎপীড়নের প্রতিবাদে প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল ভাগানিদিহি সমবেত হয় এবং পরদেশী ও ঔপনিবেশিক প্রভুদের বিতাড়িত করে ‘সত্যযুগের’ .প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। এরপর সাঁওতালরা নির্বিচারে লুটতরাজ এবং দারোগা, মহাজন ও নতুন ইজারাদারদের হত্যা শুরু করে দেয়। সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায় । ক্রমেই বিদ্রোহ বীরভূম অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। সাঁওতাল বিদ্রোহীরা হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটাতে থাকে ।
সিধু ও কানুর নেতৃত্বে সাঁওতালরা সংগঠিত হয় এবং ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সিধু ও কানু নামে দুই নেতার নেতৃত্বে প্রায় দশ হাজার সাঁওতালদের এক সমাবেশ হয় এবং তারা সমগ্র পার্বত্য অঞ্চল দখল করে নিজেদের সরকার গঠনের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে। সরকারের উদ্দেশ্যে একটি প্রচারপত্রে সিধু ঘোষণা করেন যে, “ঠাকুর (ঈশ্বর) তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন যে এ দেশ সাহেবদের নহে.... ঠাকুর নিজেই সাহেবদের সাথে যুদ্ধ করবেন। সুতরাং হে সাহেবগণ! তোমাদের সেনাদের ঠাকুরের সাথেই যুদ্ধ করতে হবে।” এর পর শুরু হয়ে যায় সাঁওতালদের বিক্ষিপ্ত লুটতরাজ এবং ইংরেজ কর্মচারী, জমিদার ও মহাজনদের ঘরবাড়ি, খেতখামারে অগ্নিসংযোগ। এ বিদ্রোহে প্রায় ৬০ হাজার সাঁওতাল যোগ দেয়। এটি ভিন্ন এদের সাথে যোগ দেয় অন্য উপজাতির গরিব মানুষ ও গোয়ালা। এরা বিদ্রোহী সাঁওতালদের নানাভাবে সাহায্য করে। বহু লৌহকারও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিদ্রোহীদের দলে যোগ দেয়। বিদ্রোহী সাঁওতালরা রাজমহল ও ভাগলপুরের মধ্যে রেল যোগাযোগ বিধ্বস্ত করে। সমগ্র অঞ্চল সাঁওতালদের দখলে চলে যায়। বহু ইংরেজ, বাঙালি পরিবার, মহাজন ও বিহারী জমিদার ধন সম্পত্তি ও প্রাণ হারায়। বিদ্রোহীরা ইংরেজ শাসনের অবসান ও নিজেদের ‘সুবা রাজত্বের' কথা ঘোষণা করে। মেজর বুরাফ নামে এক ইংরেজ সেনাপতি সাঁওতালদের নিকট পরাস্ত হন। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাহিরে চলে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেনা বাহিনীকে তলব করা হয়। এভাবেই সাঁওতাল প্রতিরোধ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে ।
সাঁওতালরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একের পর এক লড়াই করতে থাকে। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দুই পক্ষে প্রচণ্ড লড়াই হয়। শেষ পর্যন্ত সাঁওতালদের পরাজয় ঘটে। প্রায় ২৫,০০০ সাঁওতাল প্রাণ হারায় ও কয়েক হাজার গ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়। প্রতারণার ফলে সিধু গ্রেফতার হন ও তাঁকে হত্যা করা হয়। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কানুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ও’ম্যালি সাঁওতালদের বীরত্বের প্রশংসা করে বলেছেন যে তাদের সাহস ছিল দুর্দমনীয় এবং পরাস্ত হয়েও তারা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেছিল, কুঁড়েঘরের ভিতর হতেই তারা সিপাহিদের সহিত আমরণ সংগ্রাম চালিয়ে যায়। সিপাহিদের গোলাগুলির বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল তীর-ধনুক ও বাঁশের লাঠি। বিদ্রোহের অবসান হলে ইংরেজ সরকার একটি স্বতন্ত্র সাঁওতাল পরগনা গঠন করেন যদিও ভূমি রাজস্বের হার হ্রাস করা হয়নি। সাঁওতাল বিদ্রোহের পরেই সম্পন্ন সাঁওতাল চাষিদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়। অন্যদিকে ভূমিহীন সাঁওতাল কৃষি শ্রমিকরা কাজ ও জমির সন্ধানে বাংলার জেলাগুলোতে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে। এতে ঘটনায় সাঁওতাল বিদ্রোহের চূড়ান্ত অবসান ঘটে ।

সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭)
প্রতিরোধ আন্দোলনের নিম্নবর্গের ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহ বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। এ বিদ্রোহ ছিল জমিদার, মহাজন ও পুলিশের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের সশস্ত্র বিদ্রোহ। অপরাপর বেশির ভাগ আদিম সমাজের লোকদের মতো নিরীহ ও শান্তিকামী হলেও সাঁওতালরা তাদের উপর নিপীড়নকারী জমিদার, মহাজন, পুলিশ, রেলওয়ে ঠিকাদারসহ অন্য যারা তাদের এলাকায় গিয়ে বিত্তশালী হবার চেষ্টা করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে এক সুসংগঠিত সশস্ত্র বিদ্রোহ গড়ে তোলে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের উদ্ভব এবং রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত আইন ও বিধিবিধান, খাজনা প্রবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলে প্রথম দিকে সাঁওতালরা তাদের আদি বাসভূমি কটক, ধলভূম, মানভূম, বড়ভূম, ছোটনাগপুর, পালামৌ, হাজারীবাগ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, ও বীরভূমের পার্বত্য এলাকা ছেড়ে রাজমহল পাহাড়ের সমতলভূমিতে বসতি স্থাপন করে। বিস্তীর্ণ এলাকার জঙ্গল কেটে স্থানটিকে তারা চাষাবাদের উপযোগী করে তোলে। কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সেখানেও তাদের মালিকানার দাবি নিয়ে হাজির হয়। সাঁওতালরা এই ঔপনিবেশিক অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এবং নিজেদের স্বাভাবিক অধিকার বজায় রাখার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হয়। সাঁওতালরা বিশ্বাস করত, যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম জঙ্গল কেটে জমি চাষের উপযোগী করে, জমির মালিকানা তারই। মুঘল সরকার এই ঐতিহ্যকে সম্মান করায় তখন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে জমিদাররা জমির উপর তাদের মালিকানার দাবি নিয়ে হাজির হয়। এই স্বাভাবিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ১৮১১, ১৮২০ ও ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে সাঁওতালদের অভ্যুত্থান ঘটে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ, সুসংগঠিত ও ব্যাপক বিদ্রোহটি সংঘটিত হয় ১৮৫৫-৫৬ খ্রিষ্টাব্দে এবং তা দমন করতে সরকারকে কয়েক দফা সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হয়।
সাঁওতালরা বাঙালিদের ‘মইরা' ও ডিকু নামে ডাকত এবং তাদের শত্রু মনে করত, কেননা এই বাঙালিরাই ছিল জমিদার, মহাজন, দোকানদার ও রেলওয়ে শ্রমিক- ঠিকাদার, যারা কমবেশি সবাই ছিল নির্যাতনকারী। এইসব মইরা ও ডিকুর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সাঁওতালরা ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে সংগঠিত হতে শুরু করে। যখন সাঁওতাল নেতা বীর সিংহকে পাকুড় রাজের কাচারিতে তলব করে তার অনুসারীদের সামনে নিষ্ঠুরভাবে মারধর করে শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়, তখনই শুরু হয় মূল বিদ্রোহ। একতা ও শক্তির প্রতীক হিসেবে গৃহীত শাল বৃক্ষ স্পর্শ করে সাঁওতালরা শপথ গ্রহণ করে। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাস থেকে বিদ্রোহ দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ গণঅভ্যুত্থানের মতো সাঁওতালরাও গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে। ডাক ও রেলওয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, তাদের এলাকা থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের তাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং রেলওয়ে শ্রমিক নিয়োগকারী ঠিকাদার, যারা সাঁওতাল মেয়েদের বলপূর্বক শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করত, তাদেরকে পাওয়ামাত্র হত্যা করা হয়। জমিদারকে খাজনা প্রদান পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং মহাজনের তমসুক বা বন্ধকিপত্র এক ঘোষণার দ্বারা বাতিল করা হয়।
পিরপলিতে সাঁওতালরা মেজর বারোজের নেতৃত্বে পরিচালিত সামরিক অভিযানকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করে। এই বিজয়ে উৎসাহিত হয়ে সাঁওতালরা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুলাই সামরিক আইন জারি করা হয়। সাঁওতালদের দমনের জন্য তিনটি সৈন্যদল পাঠানো হয়। সাঁওতালদের রক্তে সিক্ত হয় রাজমহল পার্বত্য এলাকা। তাদের সবকটি গ্রাম ধ্বংস করা হয়। বন্দি সাঁওতালদের শিকলবদ্ধ অবস্থায় রেলপথ নির্মাণের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে নেতৃস্থানীয় সাঁওতালদের অধিকাংশই ধরা পড়ে এবং তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে। ভবিষ্যতে সাঁওতালদের পক্ষ থেকে অনুরূপ কোনো বিদ্রোহ যাতে না হয়, সেজন্য জমির মালিকানা স্বত্ব দিয়ে রাজমহল পাহাড়ে বিপুল সংখ্যক মইরা ও ডিকুদের বসতির ব্যবস্থা করা হয় ।
সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । নিম্নে সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো :
১. কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন : উনিশ শতকের পঞ্চম দশকে অর্থাৎ ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তৎকালীন বাংলার প্রধানত বীরভূম, ভাগলপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলার সাঁওতাল এলাকাগুলোতে। এসব অঞ্চলের কৃষকরা ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এ বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষক বিদ্ৰোহ ৷ এ কৃষক বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।
২. স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য : সিধু ও কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল নেতারা এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। কৃষক শ্রেণি ছাড়াও স্থানীয় কামার, কুমার, তেলী, চামার, ডোম ও মুসলিম তাঁতিরা সাঁওতালদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল। বিদ্রোহীরা বাংলা, বিহার ও ছোট নাগপুরের কয়েকটি অঞ্চলে ইংরেজ শাসনকে উচ্ছেদ করেছিল এবং নিজেদের শাসন ছ'মাস কাল ব্যাপী পরিচালনা করেছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত তাদের স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়নি। তবু তাদের এ প্রতিরোধ আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ বিদ্রোহের মাধ্যমে তাঁরা ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারকে বিপদে ফেলে দিয়েছিল।
৩. ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম : ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার আওতায় যখন সাঁওতাল তথা অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা ব্যাপকহারে শোষণ নিপীড়নের মুখে পতিত হয়, তাদের অনেকে চেষ্টা করেছিল রুখে দাঁড়াতে। এভাবে সংঘটিত হয়েছিল ১৮৫৫-৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ইতিহাস খ্যাত ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ', যেখানে সিধু ও কানু নামের দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমে পড়েছিল। বিহারের ভাগলপুর থেকে বীরভূম পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়। ভারতের স্বাধীনতার পথ সুগম হয় ।
৪. জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম : কোম্পানির বাংলা দখলের পর জমিদার ও মহাজনরা সাঁওতাল জনজীবনের উপর বাড়িয়ে দিয়েছিল শোষণ ও নির্যাতনের মাত্রা। কোম্পানি সরকার শাসন ও শোষণ অপেক্ষাকৃত মজবুত করার উদ্দেশ্যে জমিদার, দালাল, মহাজন, সরকারি আমলা ও দারোগা সৃষ্টি করে সাঁওতালেেদর জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এ পরিস্থিতিতে সিধু ও কানু সাঁওতালদেরকে বিদ্রোহ করার জন্য নির্দেশ দেন। বিদ্রোহের বাণী চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাঁওতাল (কখনো ১০ হাজার, কখনো ৩০ হাজার) বিদ্রোহীদের দলে যোগদান করে জমিদার ও মহাজনদের নির্যাতন প্রতিরোধ করে। ইংরেজ বড়কর্তারা এতে আতঙ্কিত হয়ে লিখেছিলেন যে, সাঁওতালরা সশস্ত্র হয়ে ঘোরাফিরা করছে, তাদের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০,০০০ হাজার। তাদের আত্মসম্পূর্ণ করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এতে ব্রিটিশ কোম্পানির সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সাঁওতালরা নিজেদের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হয়।
৫. নাচোল বিপ্লব : সাঁওতাল বিদ্রোহের পথ ধরেই বিংশ শতকের চল্লিশের দশকে নাচোল বিপ্লব সংঘটিত হয়। ১৯৪০ এর দশকে ইলামিত্রের নেতৃত্বে রাজশাহীর নাচোলে সংঘটিত ‘তেভাগা আন্দোলনে' সাঁওতাল বর্গা চাষিরাই নেতৃত্ব দিয়েছিল। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল জমির ফসলের ভাগাভাগিতে বর্গাচাষিদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা ৷
সাঁওতাল বিদ্রোহের সার্বিক বিশ্লেষণ
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের তথাকথিত সিপাহি বিদ্রোহের অজুহাতে ইংরেজ সরকার দুদু মিয়াকে বন্দি করেন। বিনা বিচারে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত কারাগারে আবদ্ধ রেখে ফরায়েজি আন্দোলনের অগ্রগতি ব্যাহত করেন। নেতার অবর্তমানে ফরায়েজিরা মহাবিদ্রোহে (১৮৫৭) সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে দুদু মিয়া মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিগণ এবং শিষ্যরা তাঁর মতো বিপ্লবী ভূমিকা করতে না পারায় ফরায়েজি আন্দোলন ক্রমেই স্থিমিত হয়ে পড়ে। Dr. Tajul Islam Hashmi মনে করেন যে, "So it would be difficult to establish that peasant insurgencies in the name of Islam was purely a by-product of the pesants, outonomous domain. " দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর জমিদার, নীলকর, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর উৎপীড়নে ফরায়েজিদের সংগ্রাম শক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়ে। আতঙ্কগ্রস্ত মুসলমান কৃষকরা ফরায়েজি গোষ্ঠী ত্যাগ করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে যোগদান করে। ফরায়েজি আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল সাধারণ অবস্থার মুসলমানদের আনুগত্য । কিন্তু এ নতুন ধর্মমতে আদি ইসলামের সঙ্গে সংগতিহীন যে আচার অনুষ্ঠান ও বিশ্বাস বর্জনের কথা ছিল তার অনেকগুলোই শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল। ফরায়েজি প্রভাবের দ্রুত প্রসার সম্পর্কে সমসাময়িক ধারণাও কিছুটা অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়। ফরায়েজি অনুগামীদের একটা নগণ্য অংশই মাত্র নতুন জীবন চর্চা সম্যক অনুসরণ করত। তাদের নিকট বরং বেশি আকর্ষণীয় ছিল নেতার ভ্রাতৃত্বের বাণী এবং আদর্শ। তবে নেতার
প্রচার থেকে তাদের ধারণা হয়েছিল যে, তাদের নতুন বিশ্বাসে জমিদারদের হস্তক্ষেপ অন্যায়। অন্যদিকে জমিদারশ্রেণির নিকট এরূপ সংস্কার ছিল অগ্রহণীয় এবং অমার্জনীয়। সংঘর্ষ ও সংঘাত তাই ক্রমেই অনিবার্য হয়ে ওঠে। শুরুতেই সংঘাতের রূপ ছিল একরকম, কিন্তু পরে তা ক্রমেই জটিল হয়ে পড়ে। ফরায়েজি আন্দোলনে ধর্মবিশ্বাস এভাবেই শ্রেণিচেতনার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। আর ধর্মবিশ্বাসের আদিরূপও তাতে অনেকখানি পাল্টে যায় ৷
পরিশেষে বলা যায় যে, ফরায়েজি আন্দোলনটি নতুন ধর্মীয় (Sect) গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। আন্দোলনের দ্রুত বিস্তারের সময় গোষ্ঠী বহির্ভূত অনেক কৃষক ও কারিগরশ্রেণি এতে যোগদান করেছিল। এ আন্দোলনের প্রাথমিক প্রেরণা কিন্তু স্থানীয় পরিবেশ থেকে আসেনি। এর উৎস ছিল এ অঞ্চল বহির্ভূত এবং বৃহত্তর ধর্মসংস্কার আন্দোলন যাকে ইসলামের পুনরুজ্জীবন (Islamic Revival) বলা হয়। যে দর্শনের উপর ‘ইসলামিক রিভাইভ্যাল' আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত ইহা একটি সামগ্রিক জীবন দর্শন I ফরায়েজিরা এরূপ দর্শনের আলোকে প্রকৃত অর্থে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন যেখানে তারা থাকবেন স্বাধীন। কিন্তু ঔপনিবেশিক শক্তির মহা দাপটের কবলে পতিত হয়ে ফরায়েজি আন্দোলনের মতো একটি সংস্কারাশ্রয়ী আন্দোলন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তাই ধীরে ধীরে এই আন্দোলন ধর্মের নামে শুরু হলেও এর মূল উদ্দেশ্য ছিল এর অনুসারীদেরকে ইংরেজ সরকারের আর্থিক শোষণ থেকে মুক্ত করা ।
১৭৫৭-১৮৫৭ সাল পর্যন্ত বাংলার কৃষক সমাজ কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে যে সকল আন্দোলন পরিচালনা করে সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭ খ্রি.) তাদের অন্যতম । তবে এটাই সাঁওতালদের সংগ্রামী ইতিহাসের একমাত্র মাইল ফলক নয়। এর আগেও সাঁওতালরা অনেকবার প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ন হয়েছিল। এগুলোকে ‘খেরওয়াড়ি’ নামে অভিহিত করা হয়। তবে ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধু বিশেষ জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম ছিল না। চেতনা ও পরিধির দিকে থেকে তা ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বকীয় নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় সংগ্রাম ।
সাঁওতাল জনগোষ্ঠী প্রাক-ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত স্বাধীন কৃষি জীবনে অভ্যস্ত ছিল। অরণ্য সম্পদের উপর নির্ভরশীলতা এবং আদিম পদ্ধতিতে উৎপাদিত কৃষি ফসল ছিল তাদের জীবিকার মূলসূত্র। তাদের এই সম্পদের মালিকানা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে সম্পর্কের যোগসূত্র খাজনা প্রথার অস্তিত্ব তখন ছিল না। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩) সামগ্রিক কাঠামোটিকে ভয়ংকরভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলে জমিদার ও সাঁওতাল কৃষকদের সম্পর্কের মধ্যে এক জটিলতার সৃষ্টি হয়। এতদিন যাবৎ স্বাধীনভাবে ভোগ করে আসা জমিতে জমিদারের স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে একমাত্র চড়াহারে খাজনার বিনিময়ে সাঁওতাল কৃষক তা ভোগের সুযোগ পায়। এই পরিস্থিতি দরিদ্র সাঁওতালকে ক্রমাগত অভুক্ত রাখে। করের বোঝা তাদের স্বাধীন সত্তাকে বিক্ষুব্ধ করে। এছাড়া জমির প্রতি আন্তরিক মমত্ববোধ বা ভূমিস্নেহ সাঁওতালদেরকে বিদ্রোহী করে তোলে ।
ইংরেজদের মুদ্রা অর্থনীতির নব্যসৃষ্টি জমিদার ও মহাজনশ্রেণির অভূতপূর্ব শোষণ ব্যবস্থা ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। বাঙালি-অবাঙালি মহাজনশ্রেণির ও সুদের কারবারীরা সাঁওতালদের উৎপাদন ব্যবস্থা ও পণ্য বিপণনের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। বারহাইত ও হিরণপুর এই দু'টি স্থান ছিল মহাজনদের প্রধান কেন্দ্র। এই মহাজনরা ছিল সুদের কারবারি। তারা হিসাবের ব্যাপারে দুর্নীতির আশ্রয় নিত। সাঁওতালদের অভিযোগ ছিল তাদের মূল ঋণের দশগুণ শোধ দিলেও মহাজন মুক্তি দিত না। তাদের পরিবার পরিজনকে একই দাবিতে ক্রীতদাসে পরিণত করা হতো। মহাজন ব্যতীত দালালদের বিরুদ্ধেও তাদের ছিল তীব্রক্ষোভ। মহাজন ও দালালেরা দ্রব্য সামগ্রী বিক্রয়ের সময় কম দাম দিত এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয়ের সময় বেশি দাম নিত। এই অবস্থা হতে সাঁওতালদের পরিত্রানের কোনো উপায় ছিল না। কেননা ইংরেজ শাসনে পুলিশ-পাইক-পেয়াদার সহায়তায় জমিদার মহাজনদের এই অবাধ ও সামগ্রিক লুণ্ঠনের প্রতিকার আশা করা বৃথা। এমতাবস্থায় সাঁওতালরা জমিতে সনাতনী অধিকার প্রতিষ্ঠার, অত্যাচারী ঠকবাজ-মহাজন ও বিদেশি অপশাসন থেকে মুক্তির আশায় বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয় ।
ইতোমধ্যে ভারতবর্ষে কোম্পনি সরকার কর্তৃক রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু হয়। রেলপথে যে সকল ইংরেজ কর্মচারী কাজ করতো তারা সাঁওতাল লোকালয় হতে জোর করে গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে যেত, সাঁওতালদেরকে বেগার খাটাত, মহিলাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালাতো এবং প্রতিবাদ করলে অত্যাচার নেমে আসত । Calcutta Review-পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, ইংরেজদের এরূপ অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় দু'জন স্ত্রীলোকের উপর পাশবিক অত্যাচার ও একজন সাঁওতালকে হত্যা করা হয়েছিল। এসবের যে কোনো একটিই যে কোনো জনগোষ্ঠীর রুখে দাঁড়ানোর জন্য যথেষ্ট কারণ। সাঁওতালদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল সবগুলো দুরবস্থার বিষাক্তময় সমন্বয়। এই বন্ধ্যত্ব অবস্থায় পড়ে অসহ্য মৃত্যু-যন্ত্রণায় চিৎকার করে সাঁওতালরা বলতে বাধ্য হলো, ‘ঈশ্বর মহান, কিন্তু তিনি থাকেন বহু বহু দূরে, আমাদের রক্ষার কেউ নেই'। সুতরাং আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসেবে সাঁওতালদের জন্য বিদ্রোহ করা ভিন্ন অন্য কোনো উপায় ছিল না। সাঁওতালরা এ বিদ্রোহে একা ছিল না। এদের সাথে যোগ দিয়েছিল বাংলার বীরভূম, মুর্শিদাবাদসহ পার্শ্ববর্তী জেলার অসংখ্য দরিদ্র কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ। কারণ সকলেরই শত্রু ছিল এক অর্থাৎ ইংরেজ শাসনসৃষ্ট-শোষক শ্রেণি। ফলে সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়ে উঠেছিল সকল বঞ্চিত শ্রেণির এক মুক্তিযুদ্ধ। বাংলা সরকারের সচিবের নিকট ভাগলপুরের তৎকালীন কমিশনারের প্রেরিত এক পত্রে এর সত্যতা স্বীকার করা হয়েছে।
সাঁওতালী ভাষায় বিদ্রোহকে বলা হয় 'হুল'। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে এ বিদ্রোহ দাবাগ্নির মতো চারদিকে বিস্তৃত হয়। সাঁওতাল পরগনার ধূমায়িত বিদ্রোহের মধ্য হতেই বের হয়ে আসেন ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব। সিধু ও কানু উভয়েই জানতের যে, অশিক্ষিত ও পশ্চাৎপদ সাঁওতালদের মধ্যে ধর্মের ডাক সর্বাপেক্ষা কার্যকরী শক্তি। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন সিধু-কানুর গ্রাম ভাগনাদিহিতে চারশ গ্রামের প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল এক সভায় তাদের করণীয় নির্ধারণের জন্য সমবেত হয়। এ সভায় সিদু-কানু সাঁওতালদের নিকট ভগবানের নিকট থেকে স্বপ্নযোগে নির্দেশনা পাওয়ার ইঙ্গিত দেন এবং এই নির্দেশের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেন যে, ভগবান সকল অত্যাচারীদের উচ্ছেদ করে সাঁওতালদের স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার নির্দেশ পাওয়ার ইঙ্গিত দেন এবং এই নির্দেশের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেন যে, ভগবান সকল অত্যাচারীদের উচ্ছেদ করে সাঁওতালদের স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। এ রাজ্যে কাউকে কর দিতে হবে না। সাধ্যমতো জমিচাষ ও মহাজনি ঋণ মওকুফ করে দেওয়া হবে। চিরন্তন গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত হবে তাদের জীবন যাত্রা। সমাজে থাকবেন একজন সর্দার, যার পদবি মাঝি। গ্রামে তিনিই সর্বেসর্বা। এছাড়াও থাকবেন পরামানিক, গোরাইত, যোগমাঝি ও দেশমাঝি সবার উপর থাকবেন পরগনাইত। সবমিলিয়ে সেদিনের সমাবেশে অতি সংক্ষেপে ঘোষিত হলো স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্যের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপরেখা ।
এ সমাবেশের পর সিধুর নির্দেশে কির্তা, ভাদু ও সন্নোমাঝি ইংরেজ সরকার, কমিশনার, কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট, দারোগাসহ কতিপয় জমিদারের নিকট পত্র প্রেরণ করে সাঁওতাল অঞ্চলে স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করা হয়। ক্যালকাটা রিভিউতে এই পত্রগুলোকে চরমপত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন সাঁওতালরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অগ্নিমূর্তিতে ইংরেজ, জমিদার ও মহাজন গোষ্ঠীর সংঘবদ্ধ শাসন ও শোষণ-ব্যবস্থা চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে। বিদ্রোহের আঘাতে অবশেষে এ অঞ্চলে নিযুক্ত ১২শ নিয়মিত সৈন্যকে আশি মাইলব্যাপী বিদ্রোহী অঞ্চলের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ সময়ে ইংরেজদের বহু ঘাঁটি ও ফ্যাক্টরি (নীলকুঠি) লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়। বারহাইত বাজারের বহু মহাজনকে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহীদের ভয়ে সমস্ত মহাজন ও দালাল ধনসম্পদ রেখে গৃহত্যাগ করে। ডাকহরকরা, চৌকিদার, থানার পুলিশ এবং জমিদারগণ চাকরি ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। বিদ্রোহীরা ঘোষণা করল যে, কোম্পানির রাজত্ব শেষ, এখন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই বিদ্রোহ ইংরেজদেরকে স্তম্ভিত করে দেয়। স্মরণকালের মধ্যে আর কোনো ঘটনা ইংরেজদেরকে এত বিপদগ্রস্ত করে তোলেনি। অবশেষে বড়লাট লর্ড ডালহৌসি “মার্শাল'ল” জারি করে সাঁওতাল অঞ্চলটিকে সামরিক শাসনাধীনে ন্যস্ত করেন। বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়। সরকারের নির্দেশকে বিদ্রোহীরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে ৷
ইতোমধ্যে বিদ্রোহের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। বিশাল এলাকা জুড়ে বিদ্রোহীদের .আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারও বিদ্রোহের প্রতি বিশেষ নজর দেয়। বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ এবং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোকে সংরক্ষণের জন্য বড়লাটের নির্দেশে অশ্বারোহী, পদাতিক ও হস্তী বাহিনী সমবেত করা হয়। নীলকর ও জমিদাররা অস্ত্র, সৈন্য, হস্তী, রসদ ও অর্থ দ্বারা ইংরেজ বাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে আসে। চতুর্দিকে হতে পনেরো সহস্রাধিক সুশিক্ষিত সৈন্য ছুটে আসে সাঁওতাল অঞ্চলের দিকে। সে সাথে আসে সর্বাপেক্ষা অভিজ্ঞ ইংরেজ সেনাপতিগণ। অন্যদিকে এই কামান-বন্দুকে সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে টাঙ্গি, তরবারী ও তীর-ধনুক নিয়ে সাঁওতাল মুক্তি বাহিনী মহাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংগ্রামপুরের নিকটবর্তী এক যুদ্ধে দেবতার আশীর্বাদকে পুঁজি করে সাঁওতালরা ইংরেজ বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইংরেজ সেনাপতি কর্নেল ফার্গুসনের আধুনিক অস্ত্রের প্রচণ্ড আঘাতে বিশ হাজার সাঁওতাল মুক্তিবাহিনীর অধিকাংশ‍ই মৃত্যুবরণ করেন । সাঁওতালদের শত-সহস্র কুটির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। পরপর কয়েকটি যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে সাঁওতালদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। সিধু এক রাতে ইংরেজ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ভবিষ্যৎ বিপদের আশঙ্কায় তাকে হত্যা করা হয়। এরপর বিদ্রোহের অপর শ্রেষ্ঠ নায়ক কানু বীরভূমে মৃত্যুবরণ করেন। অবশিষ্ট সাঁওতালরা প্রাণ ভয়ে বনে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। এভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহের অবসান ঘটে ।
সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রচণ্ড আঘাতে শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল যে, এই সাঁওতালদেরকে ভারতীয় জনজীবন হতে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। সে প্রয়াসে সাঁওতাল পরগনাকে একটি স্বতন্ত্র জেলা গঠন করে এটি শাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয় একজন ডেপুটি কমিশনারের উপর। সেখানে কেবলমাত্র ইউরোপীয় মিশনারি ব্যতীত অন্য সকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। এর সাথে সাথে সাঁওতালদেরকে একটি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ বাহিনীকে অপসারিত করা হয়। নতুন আদালত স্থাপিত হয়। বাঙালি মহাজনদের বসবাস নিষিদ্ধ হয়। এভাবে সাঁওতাল পরগনায় শান্তি প্রতিষ্ঠার নিরলস প্রয়াস চালানো হয়। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে খ্রিষ্টাব্দে সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহগুলো ছিল বাংলা ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অধ্যায় ৷ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় যে মুহূর্তে গ্রামীণ কাঠামো ভেঙে পড়েছিল, দেশ যখন সম্মুখীন হয়েছিল এক অজ্ঞাত শত্রুর, যাদের শক্তি ছিল অপ্রতিরোধ্য তখন এই কৃষক বিদ্রোহগুলো ছিল কোম্পানি সরকারের নির্বিচার শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ্ধ সশস্ত্র প্রতিবাদ। অর্থাৎ বাংলার কৃষক বিদ্রোহগুলো ছিল কতিপয় জটিল পরিস্থিতির প্রতি কৃষকদের প্রতিক্রিয়া। এ প্রতিক্রিয়ার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল সরকার, জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ ও নির্যাতন থেকে মুক্তিলাভ করা। এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো কৃষক শ্রেণি কিন্তু সরকারের রাজস্ব না দেওয়ার দাবি তোলেনি বরং তাদের উপর জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের আরোপিত অতিরিক্ত করের অবসান ঘটানো ছিল তাদের বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। অর্থাৎ নিম্নশ্রেণির মানুষদের দ্বারা পরিচালিত বিদ্রোহসমূহে রাজশক্তির অবসান ঘটানোর চেয়ে আত্মরক্ষার প্রশ্নটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। এ নিরিখে বাংলার কৃষক বিদ্রোহগুলো কখনো আঞ্চলিক ও আন্তআঞ্চলিক রূপ লাভ করে। বিদ্রোহের ব্যাপকতা থেকে দাবি ওঠে ইংরেজ সরকারের নির্মম-নিষ্ঠুর শাসন থেকে বের হয়ে এসে একজন সনাতন ভূস্বামীর শাসন প্রতিষ্ঠার। কিন্তু প্রয়োজনে আনুগত্য হস্তান্তর কৃষকের অধিকার-এ শর্ত মেনে নিতে জমিদার ও সরকার ছিল অপ্রস্তুত। কারণ এতে জমিদারশ্রেণির মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয় আর সরকার তাতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার তত্ত্ব আবিষ্কার করে। এছাড়া বিদ্রোহীদের সাফল্য নবগঠিত সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করতো যা শাসকশ্রেণির কাম্য ছিল না। আর অনুগত জমিদার ও মধ্যবিত্তশ্রেণির স্বার্থ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের সঙ্গে একীভূত ছিল। এর বিপরীত হওয়ার অর্থই ছিল তাদের পতন। ফলে সরকার উপনিবেশ ও রাষ্ট্রকাঠামোর উপর দখল সুদৃঢ় করার লক্ষে বিদ্রোহ দমনের জন্য সকল প্রকার শক্তি প্রয়োগ করে এবং নানা কৌশল অবলম্বন করে। ঔপনিবেশিক শক্তির মহাদাপটের বিপক্ষে সহজ সরল রণনৈপুন্যপুষ্ট কৃষক শ্রেণির পক্ষে যুদ্ধে জয়লাভ ছিল অসম্ভব ব্যাপার। এছাড়া দুর্বার শক্তি নিয়ে বিদ্রোহী কৃষকের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও সংগঠিত কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও মতাদর্শের অভাবের কারণে তারা স্থায়ী সাফল্য লাভে সমর্থ হয়নি। সে সাথে কৃষকদের মধ্যে শ্রেণিচেতনা ও সংগঠনের অভাব, অনভিজ্ঞতা, ধর্মীয় ভেদাভেদ এবং অন্যান্য শ্রেণির স্বার্থপর নীতির কারণে কৃষক বিদ্রোহগুলোর দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে। তবে এটাও সত্য যে, কোনো কোনো বিদ্রোহের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কৃষকদের বিদ্রোহের ফলে সরকার বিদ্রোহীদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। সুতরাং বিভিন্ন শ্রেণির অংশগ্রহণে ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে সংগঠিত এই বিদ্রোহগুলোর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই সকল প্রতিবাদের মাধ্যমে কৃষক শ্রেণির মধ্যে জেগে উঠে সাংগঠনিক শক্তি, ভ্রাতৃত্ববোধ, সমবেদনা, চেতনা এবং অধিকার আদায়ের দৃঢ়তর ঐক্য। ফলে একথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, এই সকল বিদ্রোহের পথ বেয়েই পরবর্তীতে এদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারা প্রবাহিত হয়েছে। এই নিরিখে বাংলার কৃষক বিদ্রোহগুলোকে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালের গণতান্ত্রিক চেতনা ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রাথমিক উপকরণ ও গৌরবময় প্রেরণার উৎস বলা যেতে পারে। কোম্পানি-শাসনাধীন বাংলার অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দী কৃষক বিদ্রোহগুলোর অনবদ্য গুরুত্ব এখানেই নিহিত।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উনিশ শতকের পঞ্চম দশকে যে সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, তা পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপ নেয়। বিহারের ভাগলপুর থেকে বীরভূম পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এ বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সহায়ক দেশীয় জমিদার ও মহাজনদের শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল, কিন্তু সাঁওতালদের প্রতিরোধকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়নি। সাঁওতালদের এ বিদ্রোহ ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। ভারতের স্বাধীনতার পথ সুগম হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]