নীল বিদ্রোহ নীল চাষের উৎপত্তির ইতিহাস

Indigo Rebellion (1859-62)
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬২ খ্রি.) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে। এটি ছিল নীল উৎপাদকদের বিরুদ্ধে নীল চাষিদের প্রতিরোধ আন্দোলন। বাংলার চাষিরা ১৮৫৯-৬২ খ্রি. ইউরোপীয় নীলকরদের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক বিদ্রোহ সংঘটন করে। তারা সকলে একতাবদ্ধ হয়ে নীল চাষ বর্জন করার আন্দোলন গড়ে তোলে ।
ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই বিশেষ করে বাংলায় দীর্ঘদিন ধরে চলে স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলন ও কৃষক বিদ্রোহ । ১৭৬৩ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনের অবসান পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে ও মাত্রায় এসব আন্দোলন চলতে থাকে। এসব আন্দোলনের মধ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলা তথা ভারতে সংঘটিত নীল বিদ্রোহ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ বিদ্রোহের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিকতার উচ্ছেদ ও বাংলায় কৃষি বিপ্লব সংঘটন। সামগ্রিক ভাবে এটা ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ৷ নীল চাষকে কেন্দ্র করে বাংলার সাধারণ কৃষককুল স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। Bipon Chandra বলেন, "Major reason for the success of the Indigo rebellion was the tremendous initiative Co-operation, organization and discipline of the ryots."
নীল বিদ্রোহ
বাংলার কৃষকেরা ১৮৫৯-৬২ খ্রি. ইউরোপীয় নীলকরদের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক বিদ্রোহ সংঘটন করে। তারা সকলে একতাবদ্ধ হয়ে নীল চাষ বর্জন করার আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষকেরা সাফল্যের সাথে ইংরেজদের নীলভিত্তিক অর্থনীতিতে আঘাত হেনেছিল। এই বিদ্রোহের ফলে নীল শিল্প ধ্বংস হয়ে যায় এবং বাংলার নীলকরেরা তাদের কুঠি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ।
উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব দ্রুতগতিতে বিকাশ লাভ করতে থাকলে ইংল্যান্ডের শিল্পোৎপাদনের জন্য সুলভে কাঁচামালের সরবরাহ আর পণ্য বাজারজাতকরণের সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। ইংল্যান্ড এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের উপনিবেশ ভারতবর্ষকে। ভারতবর্ষ শিল্পোন্নত ইংল্যান্ডের কাঁচামালের সরবরাহস্থল ও পণ্য বিক্রির বাজার হিসেবে অসাধারণ গুরুত্ব লাভ করে। এই সময়েই ইংল্যান্ডে বস্ত্রশিল্পের বিস্ময়কর অগ্রগতির সাথে সাথে বস্ত্র রং করার জন্য নীলের চাহিদা বেড়ে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ডে নীল সরবরাহ করে বিপুল মুনাফা অর্জনের পথ হিসেবে বাংলায় নীলের ব্যবসায় আরও সম্প্রসারিত করার আয়োজন করে। কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে বাণিজ্যিকভাবে নীল চাষের সূচনা হয় এ সময়ে। নীল চাষের একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিল এদেশে কোম্পানির অর্জিত টাকা ইউরোপে পাঠানো। নগদ টাকার বদলে এদেশে উৎপন্ন বাণিজ্যিক পণ্য ও কাঁচামাল রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ পাঠানো ছিল বেশি লাভজনক ও বাস্তবসম্মত। এভাবেই কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় ইউরোপীয় নীলকরেরা এখানে নীল চাষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কলিকাতার বিভিন্ন এজেন্সি হাউজ নীল উৎপাদন ও এর রপ্তানি বাণিজ্যে পুঁজি সরবরাহ করে ।
১৮৫৯ খ্রি. বাংলায় খামারের সংখ্যা ছিল ১৪৩। প্রায় পাঁচশ নীলকর এসব খামার নিয়ন্ত্রণ করতো। বাংলার মোট নীল উৎপাদনের অর্ধেক আসত দু'টো জেলা-নদীয়া ও যশোর থেকে। এই দুই জেলার কৃষক রায়তরা জমিতে যে কোনো ধরনের ফসল ফলানোর অধিকার রাখত। ভূস্বামীর নির্দেশে বিশেষ কোনো ফসল ফলাতে তারা বাধ্য ছিল না। অর্থনৈতিক কারণেই রায়তেরা প্রথমে নীল চাষ বেছে নিয়েছিল। কিন্তু পরে যখন দেখা গেল নীল চাষ অপেক্ষাকৃত কম লাভজনক, তখন এই রায়তেরা নীল চাষে অনীহা দেখাতে শুরু করে। এবার নীলকরেরা তাদের নীল চাষের জন্য বাধ্য করে । প্রাথমিক পর্যায়ে রায়তেরা নীল চাষে আকৃষ্ট হয়েছিল দাদন বা আগাম দেওয়ার ব্যবস্থার কারণে। নীলকর রায়ত কৃষককে আগাম অর্থ দিত। খাজনা শোধ করা, বীজ, কৃষি যন্ত্রপাতি ও গবাদি পশু কেনার কাজে ব্যবহার করা হতো এই আগাম টাকা । রায়তদের হাতে নগদ টাকা ছিল না। তারা নগদ টাকার প্রয়োজনে এই আগাম গ্রহণ করতো । কিন্তু নীল চাষ করে তাদের লাভ কিছুই হতো না। একবিঘা জমিতে নীল উৎপাদন করতে খরচ হতো দুই থেকে তিন টাকা, আবার ঐ পরিমাণ জমিতে আয়ও হতো দুই থেকে তিন টাকা। তাই পরবর্তী সময়ে এই নীল চাষিরা আর নীল চাষে আগ্রহ দেখাত না। কিন্তু দাদন বা আগামের টোপ যারা একবার গ্রহণ করেছিল, তাদের পক্ষে আর এর বেড়াজাল থেকে বের হওয়া সম্ভব হতো না। হিসাবের হেরফেরে এই ঋণ তার পরিবারে বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ত। ছেলেকে উত্তরাধিকারসূত্রে বাবার দাদনের হিসেব টানতে হতো। অনেক সময় নীলকরেরা সাদা স্ট্যাম্প কাগজে রায়তের সই নিত, শর্তগুলো পরে পূরণ করে নেওয়া হতো। আবার অনেক ক্ষেত্রে শর্ত লেখা থাকলেও নীলের জমির সীমানা তাতে উল্লেখ করা হতো না। এতে করে নীলকরেরা যে কোনো ভালো দামি বা ধানের জমি নীল চাষের জন্য চিহ্নিত করতে পারতো। আগাম চুক্তির
শর্তানুযায়ী নীল চাষ করতে ব্যর্থ হলে নীলকর আগাম গ্রহীতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারতো। এমনি অবস্থায় রায়তেরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নীল চাষ করতে বাধ্য হতো। নীল চাষ করতে গিয়ে তারা ধান বা খাদ্য শস্য উৎপাদনে সময় দিতে পারত না, আবার অনেক সময় ধানের জমিতে বাধ্য হয়ে নীল চাষ করতে হতো । নীল চাষে অর্থনৈতিকভাবে লাভ তো ছিলই না, এরপরও ছিল কুঠির কর্মচারীদের ঘুস দেওয়ার বিড়ম্বনা। আর কোনো রায়ত যদি নীলচাষ ছেড়ে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করতো, তাহলে তার উপর শারীরিক নির্যাতন করা হতো বা আদালতে মামলা করে হয়রানি করা হতো । নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকদের অভিযোগ ছিল অসংখ্য। এর মধ্যে রয়েছে দেশীয় লোকদের খুন, জখম, গুম, গুদামে আটকে রাখা, কৃষকদের ঘরে আগুন দেওয়া বা লুটপাট করা, নীলচাষে বাধ্য করার জন্য রায়তদের আটকে রাখা, লাঠিয়াল দিয়ে গ্রাম আক্রমণ করা প্রভৃতি। নীলকরদের বিরুদ্ধে এসব নানা অভিযোগের মধ্যে আরেকটি ছিল কৃষক কন্যা ও বধূদের অবমাননা, অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগ। কিন্তু এসব ঘটনার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকা সত্ত্বেও ইংরেজ নীলকরদের কোনো বিচার হতো না বা বিচার হলেও শুধু জরিমানা করা হতো। জেলে আটক করার রায় দেওয়ার ক্ষমতা মফস্বলের ম্যাজিস্ট্রেটের ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের সে ক্ষমতা থাকলেও এবং দু'একটি মামলায় ইংরেজরা অভিযুক্ত হলেও প্রভাব খাটিয়ে তারা খালাস পেয়ে যেতো ।
নীল চাষিদের অসহায় অবস্থা ও তাদের প্রতি অবিচারের সুযোগ করে দিয়েছিল ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের চতুর্থ আইন। এই আইনে যে কোনো ব্রিটিশ প্রজা স্থায়ীভাবে ও যে কোনো মেয়াদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে কোনো অঞ্চলে জমির মালিক হতে পারত । তখন থেকে নীলকরেরা জমিদারি কিনে তাদের জমি বৃদ্ধি করতে থাকে। ১৮৫৯-৬০ খ্রি. জিনিসপত্রের দাম পূর্ববর্তী কয়েক বছরের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ বেড়ে গেলেও নীলের দাম বাড়েনি। বছরের পর বছর নীল চাষ করেও রায়তদের দাদনের টাকা অনাদায়ি পড়ে থাকত। প্রজার হিসেবে দেনাই বাড়ত ।
নীল চাষের এ সকল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রায়তেরা যাবতীয় অত্যাচার ও অভিযোগের আইনসম্মত প্রতিকারে বঞ্চিত হয়ে হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল । তখন তাদের প্রতি দয়াশীল কয়েকজন প্রশাসকের পর্যায়ক্রমিক কিছু কার্যকলাপে উৎসাহিত হয়ে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের হেমন্তের দিকে তারা নীলচাষে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জানায় । রায়তদের অনুকূলে সরকার পক্ষের এই ধরনের অনুকম্পা প্রথম লক্ষ করা যায় কলিকাতার কাছে বারাসাত জেলায়। এর আগে বারাসাতেই তিতুমীরের নেতৃত্বে জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কলকাতার কাছাকাছি বলে বারাসাতের রায়ত শ্রেণি ছিল বেশি অধিকার সচেতন। এছাড়া একই কারণে যেসব অফিসার এখানে নিযুক্ত হয়েছিলেন তারাও প্রভাবশালী ও স্বাধীনচেতা ছিলেন। নির্যাতিত রায়তদের পক্ষে প্রথম যে সরকারি আমলা এগিয়ে আসেন, তিনি ছিলেন কলারোয়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মৌলভি আবদুল লতিফ। ১৮৫৪ খ্রি. তিনি রায়তদের উপর নীলকরের নির্যাতন বন্ধ করার জন্য এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করে। এছাড়া রায়তদের ওপর আইনানুগ আচরণ করার জন্য তিনি নীলকরদের ওপর হুকুম জারি করেন। অন্যদিকে নীলকরের বেআইনি অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করার জন্য তিনি নির্যাতিত রায়তদের উৎসাহিত করেন। এসব কারণে তিনি নীলকরদের বিরাগভাজন হন এবং প্রভাবশালী মহলের চাপে তাকে বদলি করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় প্রশাসক যিনি বারাসাতের রায়তদের পক্ষে কথা বলেছিলেন, তিনি হলেন বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট জে. এইচ. ম্যাংগল্স। তিনি ১৮৫৮ খ্রি. মত প্রকাশ করেন যে, রায়তকে দাদন নিতে বাধ্য করা এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে নীল চাষে বাধ্য করা যাবে না । এর ফলে চাষিরা সে বছর নীর চাষ করতে অস্বীকার করে। ম্যাংগলস-এর এই বক্তব্য প্রদানের জন্য সে সময়কার লেফটন্যান্ট গভর্নর হ্যালিডে তাকে তিরস্কার করেন। নীলকরদের চাপের মুখে ম্যাংগলসকেও অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। ম্যাংগলসের পর বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট এ্যাসলি ইডেন তাঁর উদারতা, সহনশীলতা ও মানবিকতার জন্য প্রজাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং তাঁর এই নীতির ফলে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের হেমন্তের দিকে প্রজারা নদীয়া-বারাসাতের নীল বিদ্রোহ শুরু করে। ইডেন নীলকরদের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন রায়তদের প্রতি মানবিক আচরণ করে এবং নীল চাষের জন্য আরও বেশি মূল্য প্রদান করে।
তবে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিক থেকেই রায়তদের অসন্তোষ বিদ্রোহে রূপ নিতে শুরু করে। বিদ্রোহের শুরু হয় বারাসাত থেকে এবং দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে নদীয়া, পাবনা, মুর্শিদাবাদ ও অন্যান্য নীলচাষভুক্ত এলাকায়। ১৮৬০ খ্রি. নীল বোনার মৌসুম শুরু হলে একযোগে সকল চাষি নীল চাষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অন্যদিকে নীলকরেরাও গ্রামে গ্রামে লাঠিয়াল পাঠিয়ে ঘরবাড়ি ভেঙ্গে, শারীরিক নির্যাতন ও আদালতে হয়রানিমূলক মামলা করে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করে ৷
নীল বিদ্রোহের নেতৃত্বে রায়ত, জমিদার ও শহরভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি সবাই সংশিষ্ট ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে ভূস্বামী শ্রেণি নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য রায়তকে নীলকরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। নীল প্রজাদের ওপর জমিদারের পূর্ব নিয়ন্ত্রণ পুনপ্রতিষ্ঠা করাও ছিল ভূস্বামী শ্রেণির একটি অন্যতম লক্ষ্য। এছাড়া এর আগে নীলকরদের সাথে ব্যবসায় করে বা নীলকরদের অধীনে কাজ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এমন অনেকে ভূস্বামীদের সাথে যোগ দিয়েছিল। নীল বিদ্রোহের মাধ্যমে তারা নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়। নীল বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী অন্যতম দুজন দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ছিল নীল কুঠির প্রাক্তন কর্মচারী। তারা গ্রামবাসীদের আহ্বান জানায় নীল চাষ বন্ধ রাখতে। তারা প্রজাদের দাদন মিটিয়ে দেয় এবং লাঠিয়াল এনে রায়তদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। তবে লক্ষণীয় যে, বিদ্ৰোহ চলাকালে আঞ্চলিক নেতৃত্ব একই ব্যক্তির হাতে থাকেনি ।
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে নীল বিদ্রোহ তুঙ্গে ওঠে। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে সরকার বিব্রত হয়ে পড়েন। কেননা নীলচাষের সাথে নীলশিল্প ছাড়াও জড়িত ছিল রপ্তানি বাণিজ্য ও কলিকাতার অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভাগ্য। এসব এজেন্সি হাউজ নীল চাষে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল। এদের চাপের মুখে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর পিটার গ্রান্ট গভর্নর জেনারেলের কাছে নীল শিল্পকে রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করার প্রস্তাব করেন। নীলশিল্পে জড়িত বাণিজ্যিক গোষ্ঠী এবং নীলকরদের স্বার্থরক্ষার জন্য ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের একাদশ আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের অধীনে চুক্তি অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করার অধিকার দেওয়া হয়। এই আইনের ধারা অনুযায়ী যদি কোনো রায়ত ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মার্চের পর নীলচাষের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েও নীলচাষ না করে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীর অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে পারবেন এবং অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হলে বিবাদীকে দাদনের পাঁচগুণ পর্যন্ত জরিমানা এবং তিন মাসের কারাদণ্ড দিতে পারবেন। এই আইনের আরেক ধারায় নীলচাষের বিরুদ্ধে উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। আইনে বলা হয়, ম্যাজিস্ট্রেটের রায় চূড়ান্ত এবং তার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। তবে এই আইনে গোটা নীল ব্যবস্থা সম্পর্কে তদন্ত করে দেখার জন্য একটি কমিশন গঠন করার ব্যবস্থা করা হয়। এবং এই আইনটি মাত্র ছয় মাসের জন্য বলবৎ থাকবে বলে বিধান করা হয়। কিন্তু নিপীড়িত রায়ত শ্রেণি সরকারের ওপর যে ভরসা স্থাপন করেছিল, একাদশ আইনের ফলে তাতে সন্দেহ আর অবিশ্বাস জন্ম নেয়। স্বাভাবিকভাবেই তারা মনে করতে থাকে যে, সরকার নীলকরদের দোসর। তাই রায়ত শ্রেণির সংগ্রাম শুরু হয় নীলকর এবং সরকার উভয়ের বিরুদ্ধে। যাহোক, ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ অক্টোবর এই ঘৃণ্য একাদশ আইনের মেয়াদ শেষ হয়।
নীল কমিশন তিন মাসের মধ্যে সরকারের কাছে রিপোর্ট দাখিল করে । কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আইন করা হলো যে, কোনো নীলকরই আর রায়তের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর জবরদস্তিপূর্বক রায়তদের দিয়ে নীলচাষ করাতে পারবে না; নীলের চাষ করা সম্পূর্ণভাবে চাষিদের ইচ্ছাধীন ।
১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি নাগাদ নীল বিদ্রোহ থেমে যায়। তবে নীল চাষের আগের অবস্থা আর ফিরে আসেনি। বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে যশোর, নদীয়া এবং অন্যান্য বেশিরভাগ জেলায় নীলের চাষ হয়নি। এর মধ্যে অনেক কুঠি নীল ব্যবস্থা গুটিয়ে ব্যবসায় পরিবর্তন করে ফেলে; আবার অনেকে কুঠি বন্ধ করে চলে যায়। এরপর কৃত্রিম নীলের আবিষ্কারের পর নীলচাষ এমনিতেই বন্ধ হয়ে যায়।
নীল চাষিদের পক্ষে সে সময় বাংলায় অবস্থানরত কয়েকজন খ্রিষ্টান মিশনারি কাজ করেছেন। এঁরা ছিলেন লুথারপন্থি প্রটেস্ট্যান্ট। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রেভারেন্ড জেমস লঙ। মানবিক কারণে তিনি নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। নিজে ইংরেজ হয়েও তিনি ইংরেজ নীলকরদের অত্যাচার ও শোষণের বীভৎসতা তুলে ধরে একটি পুস্তিকা লেখেন। এজন্যে তাঁকে আদালতে কারাদণ্ডের মুখোমুখি পর্যন্ত হতে হয়েছিল।
নীলচাষের নিপীড়িত রায়তের পক্ষে সামনে এগিয়ে এসেছিল হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন উৎপীড়িত রায়তের প্রকৃত বন্ধু । নীলচাষিদের প্রকৃত অবস্থা সরেজমিনে জেনে খবর পরিবেশনের জন্য তিনি নীল জেলাগুলোতে সাংবাদিক পাঠান। সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শিশিরকুমার ঘোষ এবং মনমোহন ষোষ। এরা মফস্বলের সরকারি কর্মচারিদের অযোগ্যতা নীলকরদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের ঘটনা তুলে ধরেন। শিশিরকুমার ঘোষ নীল বিদ্রোহের সময় যশোর হতে বিদ্রোহের খবর নিয়মিতভাবে হিন্দু প্যাট্রিয়টে পাঠাতেন। নীল কমিশন গঠনে এদের প্রতিবেদনের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৮৬০ খ্রি. দীনবন্ধু মিত্রের যুগান্তকারী নাটক ‘নীল দর্পণ' নীলকরদের অত্যাচার ও কৃষকদের দুর্দশা সাহিত্য মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কলিকাতার শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মহলে তুলে ধরে। পরবর্তী সময়ে এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে ইংরেজ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
নীল বিদ্রোহ বাংলার ইতিহাসে অন্যতম সফল গণবিদ্রোহ। বাংলার সকল কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে নীল বিদ্রোহ সামাজিক গুরুত্বে, ব্যাপকতায়, সংগঠনে, দৃঢ়তায় ও পরিণতিতে ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। এই নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম দেশের লোকদের রাজনৈতিক আন্দোলনে সংঘবদ্ধ হতে শিখিয়েছিল। কলিকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আলোড়িত করেছিল এই বিদ্রোহ। নীল বিদ্রোহে ধনী জমিদার থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, ভূস্বামী, রায়ত- সবাই ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার প্রয়াস পান। এই বিদ্রোহ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করেছিল এবং নীল বিদ্রোহকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

নীল চাষের উৎপত্তির ইতিহাস


প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে নীল চাষের সাথে জড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত নীল বিদ্রোহের ইতিহাস। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলা তথা ভারতে যে সকল গণবিদ্রোহ বা প্রতিরোধ সংঘটিত হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে বাংলার নীল বিদ্রোহ (The Indigo Revolt) বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ বিদ্রোহের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিকতার উচ্ছেদ ও বাংলায় কৃষি বিপ্লব সংঘটন। নীল চাষকে কেন্দ্র করে বাংলার সাধারণ কৃষককুল স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়, যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হয় ।
পৃথিবীর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের নীল উৎপাদিত হতো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন অবিভক্ত বাংলায়। বাংলায় নীল চাষ ছিল একটি লাভজনক কৃষিপণ্য । বাংলার নীল চাষিদের উপর ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় নীলকরদের অমানুষিক অত্যাচার হতেই এ বিদ্রোহের প্রথম সূচনা হয়। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে লুইস বনো (Louis Bono) নামে জনৈক এক ফরাসি চন্দননগরে সর্বপ্রথম নীল চাষ শুরু করেন। পরের বছর ক্যারেল ব্লুম (Carrel Blume) নামক একজন ইংরেজ আর একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন এবং বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে অবহিত করেন যে, নীল চাষ কোম্পানির মুনাফা লাভের একটি নতুন উৎস হতে পারে। ক্যারেল ব্লুম ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে স্বপরিষদ বড়লাটের কাছে একটি ‘মেমোরেন্ডাম' পেশ করে কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে ব্যাপকভাবে নীল চাষ শুরু করতে অনুরোধ করেন। এভাবে বাংলায় নীল চাষ শুরু হয় ৷
বাংলার বিভিন্ন স্থানে ধীরে ধীরে নীল চাষের প্রসার ঘটে। তবে ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে বাংলায় নীলের চাষ ব্যাপকভাবে আরম্ভ হয়নি। আঠারো শতকের মধ্যভাগ হতে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব শুরু হবার পর ইংল্যান্ডে উন্নত বস্ত্র শিল্প গড়ে উঠলে কাপড়ে রং করার জন্য প্রচুর নীলের প্রয়োজন হতো এবং এ রং বাংলা তথা ভারতের অন্যান্য অঞ্চল হতে ইউরোপের বাজারে চালান দেওয়া হতো। নীল নামে এক ধরনের চারাগাছ হতে রং নিংড়িয়ে তা আগুনে জ্বাল দিয়ে রং তৈরি করা হতো ঠিক যেমন আখ হতে রস নিংড়িয়ে তা আগুনে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। এ লাভজনক ব্যবসার প্রসারের উদ্দেশ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পশ্চিম-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ (West Indies) হতে ইউরোপীয় আবাদকারীদের বাংলায় এনে নীল চাষে উৎসাহ দেয়। প্রথম দিকে ভারতে নীল চাষ ছিল ইংরেজ কোম্পানির একচেটিয়া। কিন্তু ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের সনদ আইন অনুসারে ভারতে ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার বিলুপ্ত হলে ব্রিটেন হতে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা ভারতে আসে এবং ইচ্ছেমতো জমি খরিদ করে নীলের চাষ শুরু করে। এমনকি আমেরিকা হতেও ইংরেজ প্ল্যান্টার বা খেত মালিকরা ভারতে এ চাষ শুরু করে। বাংলার গ্রামে গ্রামে নীলকরদের কুঠি স্থাপিত হয়। চারদিকে পরিলক্ষিত হয় সবুজে ঘেরা নীল গাছের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ।
নীল সম্পর্কে নওয়াজেশ আহমদ বলেন যে, নীল (Indigo) বিভিন্ন গাছগাছালি, বিশেষত Indigofera গণের কয়েকটি প্রজাতি থেকে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক রং। ভারত, মধ্য আমেরিকা ও চীন দেশে এগুলো জন্মে। ব্রিটেনে ফলানো Woad (Isatis tinctoria) গাছের রসেও নীল রং থাকে। পুরাকালে মিশর, গ্রিস ও রোমের লোকেরাও নীলের কথা জানত । মিশরের ১৮ তম রাজবংশের মমিগুলো নীল রঙা কাগজে মোড়া থাকত ।

বাংলার ভূখণ্ডে Indigofera-এর ১৫ প্রজাতি জন্মে, তন্মধ্যে I. tinctoria নীল রঙের চাষ করা হতো ভারতে। নীল পানিতে দ্রাব্য গ্লুকোসাইড নামের এক ধরনের রাসায়নিক হিসেবে থাকে। যশোর, কৃষ্ণনগর ও বিহার রাজ্যের চাম্পারণ জেলায় নীল ভাল ফলত। গাছটি ১.২-১.৮ মিটার লম্বা ও ঝোপবিশিষ্ট। মঞ্জরি পাতার চেয়ে খাটো, পাতা যতটা লম্বা প্রায় ততটাই চওড়া। জুলাই-সেপ্টেম্বরে ফুল ফোটে। ফুল ছোট, ফলগুলো বাঁকা ।
নীল রং তৈরির পদ্ধতি নিম্নরূপ: গাছ কেটে বড় কড়াইতে পানির মধ্যে প্রায় ১২ ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখলে সবুজ রঙের নির্যাস বের হয়। তারপর এই নির্যাস নতুন পাত্রে ঢেলে নীল যাতে বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে সেজন্য অনেকক্ষণ কাঠি দিয়ে নাড়তে হয়। অদ্রাব্য নীলের তলানি নিচে জমতে থাকে এবং শেষে তা পৃথক করে শুকিয়ে টুকরা টুকরা করে কাটা হয়। ইন্ডিগোটিন ছাড়াও তাতে থাকে নানা পদার্থ, তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডিরুবাইন বা ইন্ডিগো রেড, ইন্ডিগো গ্রিন ও ইন্ডিগো ব্রাউন ।
নীল গাছের কিছুটা ভেষজগুণও আছে। প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদে (চরক সংহিতা) নীলের প্রশস্তি আছে। গাছটির কিছু পোশাকি নামও আছে: নিলিনী, রঞ্জনী, গ্রামিনিয়া, কালোকেশী, নীলপুষ্প ও মধুপত্রিকা। আধুনিক কবিরাজি চিকিৎসায় শিকড় ও পাতা নানা অসুখে ব্যবহৃত হয়। পাতার রস জলাতঙ্ক ও মৃগীরোগে উপকারী। নীল গাছ জমির আচ্ছাদন আর সবুজ সার হিসেবেও উত্তম ।
বাংলা অঞ্চলে নীলচাষ বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে । ব্রিটিশ নীলকরেরা বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করেছে নীলচাষে। নদীয়া, যশোর, বগুড়া, রংপুর, ঢাকা প্রভৃতি জেলায় নীলচাষ ছিল ব্যাপক। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ নীলচাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না থাকায় কৃষক নীলচাষের চেয়ে ধান ও পাট চাষে ঝুঁকে পড়ে। অত্যাচার উৎপীড়নের মাধ্যমে নীলচাষে বাধ্য করলে ১৮৫৯-৬০ খ্রিষ্টাব্দে নীলচাষিরা এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। ফলে বাংলায় নীলচাষ ক্রমশ বন্ধ হয়ে যায় ।
নীল চাষের ইতিহাস বাংলার কৃষকের রক্ত শোষণের ইতিহাস
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে নীল চাষের সাথে জড়িয়ে আছে কৃষকের রক্ত শোষণের করুণ ইতিহাস। বাংলায় দু'ভাবে নীল চাষ হতো—একটি 'নিজ আবাদি' অর্থাৎ নীলকরের জমিতে দিনমজুর বা খেতমজুর দিয়ে চাষ। অপরটি ‘রাইয়ত আবাদি'-অর্থাৎ রাইয়তকে দাদন (অগ্রিম টাকা) দিয়ে এর জমিতেই এরই খরচায় নীলের চাষ করান। 'নিজ আবাদি’ ব্যবস্থায় বহু দূর হতে অধিক সংখ্যক মজুর আনা হতো। নিজ আবাদের যাবতীয় খরচ নীলকরকে বহন করতে হতো। এ কারণে নিজ আবাদি ব্যবস্থা নীলকরদের পছন্দ ছিল না। এ ব্যবস্থায় প্রচুর মূলধনের প্রয়োজনও হতো। অন্যদিকে রাইয়তি বা দাদনি আবাদে সামান্য কিছু অগ্রিম দিয়ে নীলের যাবতীয় কাজ চাষিকে দিয়েই করান হতো। দাদনের এ সামান্য টাকা হতে চাষিকে লাঙল, সার, বীজ, নিড়ানি, গাছকাটা প্রভৃতি যাবতীয় খরচ চাষিকেই বহন করতে হতো। এটি ভিন্ন নীল গাছগুলো কেটে ও বান্ডিল করে নীলকুঠিতে পৌঁছিয়েও দিতে হতো। এ বাড়তি কাজের জন্য চাষি যে টাকা পেত ওতে তার তিন-চারগুণ লোকসান হতো । এক কথায় রাইয়তের লোকসান, আর নীলকরের লাভ হতো পর্বত সমান অর্থাৎ নীলকরের পৌষমাস, নীলচাষির সর্বনাশ। নীল কমিশনের হিসেব অনুযায়ী, নীলকরদের নিজ আবাদি বা নিজ এলাকার ১০ হাজার বিঘা জমিতে নীল চাষের জন্য নীলকরদেরকে ২ লক্ষ টাকা খরচ করতে হয়। তাকে চাষের জন্যে দূর থেকে শ্রমিক যোগাড় করতে হতো। অপরদিকে, রায়ত জমিতে মাত্র ২০ হাজার টাকা অগ্রিম দাদন দিয়ে ১০ হাজার বিঘা জমির নীল, নীলের কুঠিয়াল পেত। এজন্যে তার আর কোনো দায়িত্ব ছিল না। কৃষকের মানবিক দিকটি কখনো দেখা হতো না ।
নীল চাষের লাভ-ক্ষতির একটি হিসাব এখানে তুলে ধরা হলো। রায়ত চাষি কুঠিতে যে নীল জমা দিত নীলকর তার দাম দিত গড়ে ২ টাকা ৮ আনা। এ নীলের বাজারদর ছিল ১০ টাকা। ওয়াটের মতে, নীলকর মাত্র ৪০০ টাকা খরচা করে লাভ করত ১,৭৫০ টাকা। নীলের জমিতে যদি তামাক চাষ করতে পারত তবে তার খরচ পড়ত ২৪ টাকা। এ তামাক বিক্রি করে চাষি পেত ৩৫ টাকা। তার লাভ থাকত ১১ টাকা। একই জমিতে নীল উৎপাদন করতে রায়তের ব্যয় হতো ১৩ টাকা ৬ আনা । ঐ নীল বিক্রি করে সে পেত মাত্র ৪ টাকা। যদি ধান বুনতে পারত তবে রায়তের পরিবারের সারা বছরের খোরাকির সংস্থান হতো। এজন্য ম্যাজিস্ট্রেট ইডেন মন্তব্য করেন যে, “রায়ত নিজের জমিতে স্বাধীনভাবে তামাকের চাষ করলে তার যা লাভ হতো, তা যদি নীল চাষে যা ক্ষতি হয়েছে তার সাথে যোগ করা যায়, তবে রায়তের মোট ক্ষতির পরিমাণ ২০ টাকা ৬ আনা।” সুতরাং নীলকরের লক্ষ্য ছিল নিম্নতম ব্যয়ে সর্বোচ্চ মুনাফার ব্যবস্থা করা। আর মারাত্মক লোকসান হতো নীল চাষিদের ৷
সাদা চামড়ার নীলকর সাহেবরা নানা ছলছাতুরী ও প্রতারণার আশ্রয় নিত। এ কারণে বে-এলাকার অর্থাৎ যারা নীলকরের জমিদারির প্রজা নয়। যে রায়তদের ছলে- বলে-কৌশলে নীলর দাদন নিয়ে নিজ ব্যয়ে নীল উৎপাদন করতে বাধ্য করাই ছিল নীলকরের বেআইনি মুনাফার উৎস। তাছাড়া দাদনী চাষি কতটা জমিতে নীল চাষ করবে চাষের মরশুমে নীলকুঠির লোকেরা তা মেপে দিত। এ মাপের সময় যে দণ্ডটি ব্যবহার করা হতো তা ছিল জাল। গড়ে ১১ বিঘা জমিকে ৭ বিঘা জমি বলে ধরা হতো। চাষি ১১ বিঘার খরচ ন্যায্য করে মাত্র ৭ বিঘার দরুন নীলর দাম পেত । বিহারের চম্পারনে “তিন কাঠিয়ে” প্রথা ছিল এরূপ জাল মাপের প্রথা। ইউরোপীয় নীলকরদের দেখে দেশীয় জমিদাররাও জমিতে নীলের চাষ আরম্ভ করেন। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ নীলকরদের পরিপাটি ব্যবসাদারী মনোবৃত্তি, বৈজ্ঞানিক শোষণ নীতি রপ্ত করতে না পারায় তাঁরা পিছু হটেন। বেশির ভাগ জমিদার নীলকরদের সাথে এঁটে উঠতে না পেরে জমিদারি নীলকরকে লিজ দিয়ে দেন। ফরিদপুরের ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট নীল কমিশনের সামনে সাক্ষ্যে বলেন যে, “ইংল্যান্ডে নীলের যে সকল বাক্স পৌঁছায় তা বাংলার চাষির রক্তে রঞ্জিত।” এ থেকে বাংলার নীল চাষিদের করুণ পরিণতির ধারণা পাওয়া যায় । এজন্য বাংলার নীল চাষের ইতিহাস হলো বাংলার নীল চাষিদের রক্ত শোষণের ইতিহাস ।
নীল কমিশন
ইউরোপীয় নীলকরদের বিরুদ্ধে বাংলার রায়তদের আন্দোলনের ফলে ১৮৫০- এর দশকের শেষদিকে গঠিত হয়। শুরু থেকেই বাংলায় নীলচাষ নিপীড়ন ও নির্যাতনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। জমির মালিকানা লাভের পর নীলকরেরা নীল চাষে বাধ্য করার জন্য রায়তদের উপর বলপ্রয়োগ করত এবং নীলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে না পারলে করবৃদ্ধির হুমকি দিত। শুধু তা-ই নয়, তারা রায়তদেরকে উৎপাদিত নীলের ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত করত। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে যখন সোনার মূল্য হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক বাজারে নীলের দাম গড়ে যায়। ফলে রায়তেরা নীলচাষ করতে অস্বীকার করে, কিন্তু নীলকরেরা তাদেরকে নীলচাষ অব্যাহত রাখতে বাধ্য করতে থাকে ৷
এ পরিস্থিতিতে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রায়তেরা সমগ্র বাংলা জুড়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে সহিংস ও সংগঠিত আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনের মুখে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ সরকার নীল উৎপাদন ব্যবস্থা তদন্ত করবার জন্য ‘নীল কমিশন' গঠন করে। ডব্লিউ.এস সিটনকার এ কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। কমিশিনের অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন আর টেম্পল (সরকারি প্রতিনিধি), রেভারেন্ড জে. সেল (খ্রিষ্টান মিশনারিদের প্রতিনিধি), ডব্লিউ. এফ ফারগুসন (নীলকরদের প্রতিনিধি) ও চন্দ্রমোহন চ্যাটার্জী (জমিদারদের প্রতিনিধি)। ১৫ জন সরকারি চাকুরে, ২১ জন নীলকর, ১০ জন খ্রিষ্টান মিশনারি, ১৩ জন জমিদার ও ৭৭ জন রায়ত মিলে মোট ১৩৬ জন কমিশনের সামনে তাদের জবানবন্দি প্রদান করেন। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মে থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত এ সাক্ষ্যদান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে ।
নীলচাষ যে নানাবিধ নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত একথা ‘নীল কমিশনের' রিপোর্টে প্রথমবারের মতো স্বীকৃত হয়। এ রিপোর্ট থেকে জানা যায়, রায়তদের কিভাবে ঋণ নিতে ও নীলচাষের চুক্তি সই করতে বাধ্য করা হতো; কিভাবে নীলকরেরা অনিচ্ছুক রায়তদের বাড়িঘর লুট করতে ও জ্বালিয়ে দিতে লাঠিয়ালদের ব্যবহার করত; কিভাবে রায়তদের হালের বলদ ধরে নেওয়া হতো; কিভাবে তাদের সবচেয়ে, উর্বর জমি নীলচাষের আওতায় আনা হতো। পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটরা অত্যাচারী নীলকরদের সাহায্য-সহযোগিতা করত বলে যে অভিযোগ ছিল, তারও সমর্থন মেলে কমিশনের রিপোর্টে ।
কমিশন বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের জন্য ইউরোপীয় নীলকরদের দোষারোপ করলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য তাদের প্রয়োজনের কথাও একই সঙ্গে স্বীকার করে ৷ এর কারণ বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নীলকরদের উপস্থিতির রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। সংকটকালে নৈরাজ্য দমনে ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে ব্রিটিশ সরকার এদের ব্যবহার করতে পারত। কমিশন রায়তদের উপর নৃশংসতার কথা লিপিবদ্ধ করে বটে, কিন্তু তাদেরকে রক্ষা করার জন্য নতুন আইনের প্রয়োজন বিবেচনা করেনি। বিষয়টি যাতে আরও জটিলাকার ধারণ না করে সে জন্য কমিশন সরকারকে নীলসংকটে হস্তক্ষেপ না করার পরামর্শ দেয়। কমিশন গ্রামাঞ্চলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি সৎ পুলিশবাহিনী ও যোগ্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করার প্রস্তাব করে ।
নীল-আন্দোলনের তীব্রতা ও ‘নীল কমিশন' -এর রিপোর্ট, সেই সঙ্গে রাসায়নিকভাবে প্রস্তুত নীল বাজারে আসার কারণে বাংলায় নীল চাষের প্রয়োজন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যায়।
নীল বিদ্রোহের তাৎপর্য
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব অপরিসীম। নীলচাষিদের আন্দোলন বাংলার কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধী এ আন্দোলনের অনুকরণে বিহারের চম্পারণে নীল সাহেবদের বিরুদ্ধে এক প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শিশির কুমার ঘোষের কথায়, এ নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম দেশের লোককে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংঘবদ্ধ হবার প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দিয়েছিল। বস্তুত বঙ্গদেশে ব্রিটিশ রাজত্বকালে নীল বিদ্রোহই ছিল প্রথম বিপ্লব এ বিদ্রোহ ছিল সামন্ত-প্রথা ও ঔপনিবেশিকতার মূল ভিত্তির উপর প্রথম প্রচণ্ড আঘাত। এ বিদ্রোহ ছিল পূর্বের সন্ন্যাসী-বিদ্রোহ, ওয়াহাবী-বিদ্রোহ প্রভৃতি স্বাধীনতাকামী গণসংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী। এ সংগ্রাম অর্থনৈতিক শোষণ-উৎপীড়ন হতে উদ্ভূত হলেও এর জাতীয়তাবাদী আবেদন ছিল গভীর। যে সময় অন্যান্য শ্রেণি সাম্রাজ্যবাদীদের সেবায় ও মনোরঞ্জনে বৃত্ত, সে সময় বাংলার কৃষকরাই সশস্ত্র সংগ্রামের পথ গ্রহণ করেছিল। এটাই হলো নীলবিদ্রোহের রাজনৈতিক তাৎপর্য। কেননা নীল চাষকে কেন্দ্র করে যে নীল বিদ্রোহ সংগঠিত হয় তা পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হয়। একের পর এক বিদ্রোহ ও আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাংলা তথা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে।
বাংলার নীল বিদ্রোহ ছিল প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে অন্যতম সফল গণবিদ্রোহ। ব্যাপকতায়, সাংগঠনিক দৃঢ়তায় ও পরিণতিতে এটা ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণআন্দোলন। এটা ছিল সে সময়ের সামন্ত প্রথা, বিশেষ করে ইংরেজ নীলকর সাহেব ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ডতম ও সফলতম আঘাত। বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলার এটা সফল কৃষক বিদ্রোহ। সন্ন্যাসী বিদ্ৰোহ এবং তিতুমীরের ওয়াহাবি বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করতে সমর্থ হলেও, ইংরেজ শাসকগণ এ আন্দোলনের নিকট মাথানত করতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলার কৃষক শ্রেণিই দেশকে রক্ষার জন্য ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল। এ আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং অশিক্ষিত কৃষকরাও যে আন্দোলন করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে ‘নীল বিদ্রোহ' তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। সবশেষে, ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহ বা সিপাহী বিদ্রোহকে যদি বলা যায় প্রথম প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রাম, তবে নীল বিদ্রোহকে বলা চলে কৃষক শ্রেণির সর্বশ্রেষ্ঠ গণজাগরণমূলক মহাআন্দোলন। ভারতীয় বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী শিশির কুমার ঘোষ বলেছিলেন, “নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম দেশের মানুষকে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে শিক্ষাদান করেছিল। বস্তুত বাংলাদেশে ব্রিটিশ রাজত্বকালে নীল বিদ্রোহই ছিল প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহ। সুতরাং প্রতিরোধ আন্দোলনও নিম্নবর্গের ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ।
নীল বিদ্রোহের সার্বিক বিশ্লেষণ
নীল একপ্রকার গাছ। নীল গাছ থেকে নীল উৎপাদন করা হতো। নীল গাছ দেখতে অনেকটা পাট গাছের মতো। এটি চার-পাঁচ ফুট লম্বা হতো। বাংলা অঞ্চলে প্রচুর নীল গাছ জন্মাত। এই নীল গাছের নীল পৃথিবীর নানা দেশে পাঠানো হতো । এজন্যই ইংল্যান্ডে, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস ও রোমে নীলকে ‘ইন্ডিগো’ বলা হতো । বাংলার বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য নীল কুঠি ও নীল তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছিল। তবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রথমে দক্ষিণ ভারতে নীল চাষের সূচনা হয়েছিল এবং প্রথম নীল তৈরির কারখানাও সেখানেই গড়ে উঠেছিল। পশ্চিম ভারতেও নীল চাষের কেন্দ্র ছিল বলে যায় ।
অবিভক্ত বাংলা অঞ্চলে নীলের চাষ শুরু হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে, ১৭৭২ খ্রি. একজন ফরাসি বণিক এখানে নীলের চাষ শুরু করেন। তাঁর নাম মশিয়ে লুই বোনার্ড, তিনি নীল কুঠি স্থাপন করেছিলেন বর্তমান পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলার তালডাঙ্গায়, পরে তিনি তাঁর কুঠি নিয়ে আসেন চন্দননগরের কাছে গোদল পাড়ায় ৷
বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে খুব বেশি করে নীল চাষ শুরু হয় ১৭৮৮ খ্রি. পর ইংল্যান্ডে বেশিরভাগ নীল আমদানি করা হতো আমেরিকা এবং ফ্রান্স থেকে। আমেরিকা ইংরেজদের অধীনতা থেকে মুক্ত হবার পর সেখান থেকে নীল আসা বন্ধ হয়ে যায় । অন্যদিকে ১৭৮৯ খ্রি. ফরাসি বিপ্লবের পর সেখানকার চাষিরা নীল চাষ বন্ধ করে দেয় । এদিকে ইংল্যান্ডের কাপড়ের মিলগুলোতে তখন অনেক বেশি করে কাপড় তৈরি হয়েছিল। তাই নীলের চাহিদাও অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তখনকার বাংলার নদীয়া, কুষ্টিয়া, বর্ধমান, যশোর, হাওড়া, পাবনা, ফরিদপুর ও হুগলি জেলায় নীলের চাষ হতে থাকে। নীলের চাষ করত বাংলার চাষিরা। নীলের কারখানায় তা থেকে তৈরি করা হতো নীল, ইংরেজ সাহেবরা ছিল এসব কারখানার মালিক। এদের বলা হতো নীলকর ।
১৭৯৫ খ্রি. যশোরের রূপদিয়ায় নীলের কারখানা বসান মি. বন্ড নামে একজন নীলকর, এটিই ছিল পূর্ববঙ্গে প্রথম নীল কারখানা। নীলকর সাহেবরা নীলের ব্যবসা করে খুব ভালো লাভ করতে থাকে। তাই অল্প সময়ে অনেক নীল কারখানা বসানো হয়, বিশ্বের বাজারে বাংলার নীলের চাহিদা খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে যায়। নীলকরদের জন্য এটি হয়ে ওঠে খুব লাভজনক ব্যবসায়। কিন্তু ইংরেজ নীলকরা নিজেরা অনেক মুনাফা করলেও, চাষিরা নীল চাষ করতে গিয়ে ফতুর হয়ে যেতে থাকে। তারা তাদের নীলের দাম যা পেতো তাতে চাষের খরচও উঠত না ।
নীল চাষ করার জন্য নীলকররা চাষিদের বিঘা প্রতি দু'টাকা দাদন দিত । চাষিরা এ দাদন নিতে চাইত না। তখন জোর করে তাদের দাদন দেওয়া হতো। আর একবার দাদন নিলে মরণ-ফাঁস পড়ত চাষিদের গলায়। নীলকরদের দাদনের টাকা শোধ হতো কখনো। হিসাবের হেরফেরে দাদন আটকে থাকত চাষির গলায়। পিতার দাদনের ফাঁস পড়ত ছেলের গলায়। আর ভালো ধানের জমিতেও নীল চাষ করতে বাধ্য হতো; চাষিরা। নীলকর সাহেবরা ও তাদের আমলারা জোর করে এসব জমিতে দাগ দিয়ে যেত। এই দাগ দেওয়া জমিতে নীলের চাষ করতে বাধ্য হতো চাষিরা। যদি তা না ; করত তাহলে নীলকরদের অত্যাচার সহ্য করতে হতো তাদের। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হতো তাদের ঘরবাড়িতে। হালের গরু-বলদ নিয়ে যাওয়া হতো জোর করে। তারপর নীলকুঠিতে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো অবাধ্য চাষিদের। চলত তাদের উপর ভীষণ অত্যাচার। নীলকদের এসব অত্যাচার ছিল বেআইনি। কিন্তু ইংরেজ শাসকের কাছে অভিযোগ করে কোন লাভ হত না। বরং অভিযোগ করলে অত্যাচারের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতো । প্রাণও হারাতে হতো অনেক সময়।
নীলকুঠির নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই রুখে দাঁড়াতে চেয়েছিল চাষিরা। যেসব জায়গায় জোর করে নীল চাষ করানো হতো সেসব জায়গায় তারা বাধা দিতে চেষ্টা করে। অনেক জায়গায় চাষিরা সমবেতভাবে নীলকুঠিও আক্রমণ করে। তখন সেখানে আসত ইংরেজদের পুলিশ ও সেনাবাহিনী। চাষিদের উপর অত্যাচার হতো আরও বেশি করে ।
১৮৫৪ খ্রি. ছোটলাট হ্যালিডে নদীপথে পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ দেখতে বেরিয়েছিলেন। সে সময় তার স্টিমার যখন যাচ্ছিল তখন নদীর দুই তীরে হাজার হাজার মানুষ নীলকরদের অত্যাচারের কথা তাঁকে জানায়। তিনি কলকাতায় ফিরে গিয়ে নীল চাষিদের নালিশ সম্পর্কে তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু ১৮৫৭ খ্রি. সিপাহি বিপ্লব শুরু হওয়ায় নীল চাষিদের অভিযোগ নিয়ে আর কিছু করা হয়নি। বরং হ্যালিডে সাহেব নিজেই পরে ২১ জন নীলকর সাহেবকে অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেন ৷ নীল চাষিদের ভাগ্য তিমিরেই থেকে যায়। এ অবস্থায় নীল চাষিরা নীলকরদের সরাসরি বাধা দিতে শুরু করে। জেলা থেকে জেলায় এ বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ কৃষক নীল বিদ্রোহে শামিল হতে এগিয়ে আসে ।
অবশেষে ব্রিটিশ সরকার নীল চাষিদের অভিযোগ শুনতে বাধ্য হয়। ১৮৬০ খ্রি. ৩১ মার্চ তারা ‘নীল কমিশন' গঠন করে। নীল কমিশন ১৮ মে থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত নানা জায়গায় গিয়ে নীল চাষিদের অভিযোগ শুনে। তারা ১৩৬ জনের সাক্ষ্য নেয় ৷ এদের মধ্যে ১৫ জন সরকারি কর্মচারি, ২১ জন নীলকর, ১০ জন খ্রিষ্টান মিশনারি, ১৩ জন জমিদার ও ৭৭ জন নীল চাষি। ২৭ আগস্ট কমিশন তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে ৷ এই রিপোর্টের পর ব্রিটিশ সরকার নীল চাষিদের কিছু অভিযোগের প্রতিকার করে। সরকার বলে যে, জোর করে চাষিদের নীল চাষ করানো যাবে না ।
নীল বিদ্রোহ বাংলার কৃষকদের প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে এক বড় প্রমাণ। এতে হিন্দু-মুসলমান সব চাষিই এক কাতারে সামিল হয়েছিল, একই সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছিল। নীল বিদ্রোহের নেতারা ছিলেন সাধারণ কৃষক। তাদের কেউ মারা গেলে বা বন্দি হলে শত শত কৃষক এগিয়ে আসত। তাঁদের জায়গা পূরণের জন্য। বাংলার কৃষক যে ভয়কে জয় করে বার বার অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে নীল বিদ্রোহ তার বড় প্রমাণ। নীলচাষের কাহিনি নিয়ে 'নীল দর্পণ' নাটক লিখেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র। সেটি বাংলার প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ ।
‘বাংলাদেশের আন্দোলন ও বিদ্রোহ' নামক গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রাচীকাল থেকে বাংলার মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে নীল চাষ করতে শুরু করে। মধ্যযুগে ভারতবর্ষে উৎপাদিত নীল বিদেশে রপ্তানি করা হতো। ফরাসি পরিব্রাজক ১৬৫৮ থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে পরিভ্রমণ করেন। পূর্ব বাংলায় তখন নীল উৎপন্ন হতো বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ওলন্দাজ ও পর্তুগিজ বণিকরা ভারতবর্ষে উৎপাদিত নীল ইউরোপে রপ্তানি করত। ১৬০০ সালে ইংরেজ বণিকরা কোম্পানি গঠন করে ভারতবর্ষে উৎপাদিত প্রচুর নীল হল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করতে থাকে। পূর্ব বাংলায় রেশম, আফিম, বস্ত্র, লবণ প্ৰভৃতি দ্রব্যের মতোই নীল চাষ পূর্ব বাংলায় কৃষকদের শোষণের একটি প্রধান উপায় হয়ে দাঁড়ায়। প্রায় একশ বছর ধরে এ শোষণ অব্যাহত থাকে। বাংলার গ্রামাঞ্চলে এখনও কিছু কিছু নীলকুঠির ভাঙ্গাচোরা দালানকোঠা দেখতে পাওয়া যায়। এ ভগ্নাবশেষ কুঠিয়ালদের অত্যাচার-নিপীড়নের স্মৃতি বহন করছে। বাংলার অত্যাচারিত কৃষকেরা, ক্ষুধা-দারিদ্র্যে জর্জরিত তাদের জমিতে নীলচাষ না করার জন্য বিদ্রোহ করতে থাকে ৷ ফলে নীলচাষিদের উপর অধিক অত্যাচার নির্যাতন চলতে থাকে। কৃষকেরাও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চলতে থাকে সামাজিক সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। এই বিদ্রোহ ও প্রতিবাদই নীল বিদ্রোহ হিসেবে পরিচিত।
পূর্ব বাংলায় নীলচাষের প্রবর্তন শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে । ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বণিক মঁশিয়ে লুই বোনার্দ পূর্ব বাংলায় প্রথম নীলচাষ শুরু করেন। হুগলি জেলার তালডাঙ্গা অঞ্চলে তিনি প্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। তিনি পূর্ব বাংলার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে অবহিত করেন যে নীলচাষে বিপুল মুনাফা হতে পারে। অতঃপর চন্দননগরের গোদলাপাড়ায় তিনি নতুন কুঠি স্থাপন করেন। ইংরেজ বণিক ক্যারেল ব্লুমও নীলকুঠি স্থাপন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়। সেখানকার বস্ত্রশিল্পের জন্য প্রচুর নীলের প্রয়োজন দেখা দেয়। ব্লুম ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে সপরিষদ গভর্নর জেনারেলের নিকট একটি ‘মেমোরেন্ডাম' দাখিল করে কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে ব্যাপকভাবে নীল চাষের অনুরোধ জানায়। ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে কোম্পানির মাধ্যমে নীল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতে বসবাসরত ইংরেজদের নীল ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া হয়। নীলচাষের জন্য নীলকর সাহেবদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। ব্যাপক নীলচাষ করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংরেজ নীলকরদের প্রচুর অর্থ আগাম দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কোম্পানি ও নীলকর সাহেবদের প্রচেষ্টায় উনিশ শতকের শুরুতেই নীলচাষ একটি লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হয়। সে সময় পূর্ব বাংলায় উৎপাদিত নীলচাষের ওপর কোম্পানি একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার লাভ করে ।
নীলকর সাহেবরা পূর্ব বাংলায় উৎপাদিত নীল ইংল্যান্ডের বাজারে তিন-চার গুণ লাভে বিক্রি করত। সে সময় পূর্ববাংলার কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় নীলচাষ আরম্ভ হয়। ইংরেজ বণিক বন্ড ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে যশোর জেলার রূপদিয়া নামক স্থানে প্রথম নীল তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে নীলগঞ্জ, বারুন্দি, পাবনা প্রভৃতি অঞ্চলে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই পূর্ব বাংলায় প্রায় ৫০০ নীলকুঠি স্থাপিত হয়েছিল। সে সময় পূর্ব বাংলায় বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি ও জেমস হিথস কোম্পানি একচেটিয়াভাবে নীল ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করত। দিন দিন পূর্ব বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে নীল রপ্তানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবেই পূর্ব- বাংলায় ব্যাপকভাবে নীলচাষ বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন অঞ্চলে নিত্যনতুন নীল কুঠি স্থাপিত হতে লাগল। পূর্ব বাংলার নীলের বিশ্ববাজারে প্রচুর চাহিদা বাড়তে থাকে। ফলে নীলচাষে নতুন নতুন ব্যবসায়ীর এবং নীল সাহেবদের আবির্ভাব ঘটে। ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নীল চাষের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হতো তা প্রায় সবই কোম্পানি অল্প সুদে নীলকরদের আগাম দিত। যে নীল প্রস্তুত হতো তার প্রায় সবটাই কোম্পানি কিনে নিত এবং ইংল্যান্ডে চালান দিত। কোম্পানি বঙ্গদেশ হতে প্রতি পাউন্ড নীল এক টাকা দরে কিনে তা ইংল্যান্ডে বিক্রি করত পাঁচ টাকা হতে সাত টাকা দরে। ফলে নীলচাষ এত ব্যাপক হয়ে ওঠেছিল যে ১৮১৫-১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গদেশে ১২৮০০ মণ নীল প্রস্তুত হয়েছিল এবং এ নীল দিয়েই সমস্ত পৃথিবীর নীলের চাহিদা মেটানো হতো । এটা এতই লাভজনক হয়ে ওঠে যে, কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারিগণ চাকরি ত্যাগ করে নীলকুঠি খুলতে শুরু করে ।
বাংলায় নিজ আবাদি প্রথা ও রায়তি প্রথা এ দুই নিয়মে নীলচাষ করা হতো। নিজ আবাদি প্রথায় সাহেবেরা নিজেদের জমিতে নিজ খরচা ও তত্ত্বাবধানে দিনমজুর খাটিয়ে নীলচাষ করত। রায়তি প্রথায় নীলকর সাহেবদের সাথে নীলচাষিদের একটি চুক্তি সম্পাদিত হতো। চাষিরা নিজেদের জমিতে নীলচাষ করার জন্য নীলকর সাহেবদের সাথে চুক্তি করত। চুক্তি অনুযায়ী নীলকর সাহেবরা নীলচাষের জন্য চাষিদের আগাম অর্থ প্রদান করত। নীলকর সাহেবদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী নীলচাষ করাতে বাধ্য করত। কোনো কৃষক চুক্তির শর্তভঙ্গ করলে নীলকর সাহেবদের লাঠিয়াল, পাইক, বরকন্দাজ চাষিদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালাত। চাষিরা নীলচাষের জন্য আগাম পেতো অনেক কম। চাষিরা উৎপাদিত নীল বাজারদর থেকে অনেক কম দরে ইংরেজ বণিকদের নিকট বিক্রি করতে বাধ্য হতো। নীল চাষিদের নীলের দাম কম দেওয়া হতো। ওজনে কারচুপি করা হতো। গাড়ী/নৌকায় করে কুঠিতে নীল পৌছে দিতে বাধ্য করা হতো। নীলচাষিদের খাজনা দিতে হতো। চুক্তি করার জন্য স্ট্যাম্পের পয়সাও চাষিরা দিত। এছাড়াও নীল কুঠির নায়েব, গোমস্তা, পাইক-বরকন্দাজরাও চাষিদেরকে বকশিশ দিতে বাধ্য করত। চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ জমিতে নীলচাষ করার কথা তার চেয়েও অধিক পরিমাণ জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য করা হতো। নীলচাষি নিজেদের জমিতে খাদ্যশস্য/অর্থকরী ফসল বুনতে পারত না। নীলকর সাহেবদের অজান্তে কোনো চাষি তাদের জমিতে খাদ্যশস্য বা অন্য কোনো ফসল বুনলে তার উপর নীলকরদের অত্যাচার নেমে আসত। এছাড়াও নীলকর সাহেবরা তাদের পাইক-বরকন্দাজ দিয়ে উক্ত জমিতে লাঙল চালাত যাতে বুনা ফসল উৎপন্ন হতে না পারে ।

রায়তি প্রথায় নীলচাষ করে ইংরেজ বণিকরা অধিক লাভবান হতে লাগল । ফলে তারা রায়তি প্রথায় নীলচাষের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠল। বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানির বিভিন্ন কুঠিতে ১৮৫৮-১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ৩৩,২০০ জন নীলচাষি নীলচাষ করেছিল। কিন্তু ২,৪৪৮ জন চাষি নীলের মূল্য বাবদ অগ্রিমের সামান্য বেশি কিছু পয়সা পেয়েছিল। ওয়াট নামক একজন ইংরেজ তার গ্রন্থে নীল ব্যবসায়ে লাভের পরিমাণ শতকরা একশত ভাগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এমনি আশ্চর্যজনক মুনাফা হতো বলেই পূর্ব-বাংলায় নীলচাষের ওপর নীলকরদের যেমন অর্থ-পিপাসা বেড়েছিল তেমনি নীলচাষিদের ওপর তাদের অত্যাচারের মাত্রাও চরমভাবে বেড়েছিল। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানি একটি আইন পাস করেছিল। এই আইন অনুযায়ী নীলকরদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করলে সেই চাষি আইনত শাস্তি পাবে। অপরপক্ষে প্রবর্তিত সেই আইনে নীলচাষিদের স্বার্থরক্ষা করা হয়নি। নীলকর সাহেবেরা ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক চুক্তিপত্রে চাষিদের স্বাক্ষর করিয়ে নিত। নীলকর সাহেবদের নিকট থেকে দুই টাকা আগাম নিয়ে চাষিকে নীলকর সাহেবদের কাছে ক্রীতদাসের মতো থাকতে হতো। নীলচাষ প্রবর্তিত হওয়ার ফলে কুঠিসংলগ্ন এলাকার চাষিদের নিজেদের জমিতে নিজেদের ইচ্ছামাফিক ফসল ফলাবার অধিকার ছিল না। এমনকি নীলের জমি ছাড়া অন্য কোনো জমিতে কাজ করার ক্ষমতাও নীল চাষিদের ছিল না। নীল গাছ থেকে নীল উৎপাদিত করা ছিল আরও দুরূহ কাজ।
নীল উৎপাদনে প্রচুর স্বচ্ছ পানির প্রয়োজন হতো। এজন্য নীল উৎপাদনের কারখানাগুলো নদীর ধারেই প্রতিষ্ঠা করা হতো। নীল উৎপাদনে বাঙালি শ্রমিকদের ব্যবহার করা হতো। অমানুষিক পরিশ্রম করতে হতো শ্রমিকদের। নদী থেকে নীল তৈরির চৌবাচ্চায় পানি ওঠাতে হতো। নীল গাছগুলো ছোট ছোট আঁটি তৈরি করে বাঁধতে হতো। বাঁধা আঁটিগুলো স্টেপিং ভেটে সাজিয়ে রাখা হতো। এরপর বড় বড় কাঠের টুকরা দিয়ে আঁটিগুলো চাপা দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো। গাছের পাতাগুলো ঝরে পড়ে যাওয়ার পর গাছগুলো বের করে আনা হতো। এরপর শ্রমিকরা কোমর পরিমাণ পানিতে নেমে দুই সারিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঁশ বা মোটা লাঠি দিয়ে দুই/ আড়াই ঘণ্টা ঐ তরল পদার্থ নাড়ত। রং ভাল করার জন্য দ্রুত ও জোরে নাড়ার প্রয়োজন ছিল যাতে পানিতে ঢেউ ওঠে। এ সময় কৃষকেরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ত ৷ প্রচণ্ড নাড়ানাড়িতে প্রথমে সবুজ, পরে বেগুনি সর্বশেষে গাঢ় নীল রঙ ধারণ করত। নীল প্রস্তুত করতে অনেকগুলো ধাপে একের পর এক নতুন নতুন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নীল রঙ তৈরি করতে হতো। নীল প্রস্তুত প্রণালি অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও শ্রমের প্রয়োজন । এ দেশের শ্রমিক শ্রেণি নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও নিপীড়নে বাধ্য হয়েই নীল শ্রমিক হিসেবে কাজ করত ।
নীলচাষের সুবিধার জন্য ইংরেজরা বেশকিছু যৌথ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিল। এ সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কনসার্ন হিসেবে পরিচিত ছিল । প্রতিটি কনসার্নকে ঘিরে গড়ে ওঠেছিল কয়েকটি কুঠি। প্রধান কুঠির নামকরণ ছিল ‘সদর কুঠি' হিসেবে বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি যশোর-খুলনার সবচেয়ে বড় কোম্পানি ছিল। মোল্লাহাট কনসার্নে সতেরোটি কুঠিতে দুই লক্ষ নীলচাষি ও কর্মচারী কাজ করত। মোল্লাহাট কনসার্নের নীলকর সাহেবদের অত্যাচারকে অবলম্বন করে দীনবন্ধু মিত্র 'নীল দর্পণ' নাটক রচনা করেছিলেন। পূর্ব-বাংলায় ইংরেজ নীলকর সাহেবদের প্রতিষ্ঠিত হাজরাপুর, পোড়াহাট, সিন্দুরিয়া, জোড়াদহ, খড়গড়া, মহিষাকুণ্ডু, নহাটা, বাবুখালি, রামনগর, নড়াইল, শ্রীকোল, নিশ্চিন্তপুর প্রভৃতি অসংখ্য কনসার্নের অধীনে প্রচুর কুঠি স্থাপিত হয়েছিল। এই সমস্ত কনসার্ন ও কুঠিতে বাংলার লক্ষ লক্ষ নিম্নবর্গের দরিদ্র চাষি- শ্রমিককে নীলচাষ ও শ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য করা হতো। ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, ফরিদপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় মিস্টার হিলোস কোম্পানি, বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি, রবার্ট ওয়াটসন কোম্পানি প্রভৃতি বড় বড় কোম্পানি নীল ব্যবসায় করত। কোম্পানির অধীনে প্রতিষ্ঠিত কনসার্নের পুলিশি দায়িত্বে নিয়োজিত থাকত পেশাদার লাঠিয়াল বাহিনী। নীলচাষিদের নীল-শ্রমিকদের ও রায়তদের ওপর জোরজুলুম করার কাজে এবং দাঙ্গাহাঙ্গামার সময় লাঠিয়াল বাহিনী ব্যবহার করা হতো।
নীলচাষিদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার-নিপীড়নের মাত্রা ছিল বর্ণনাতীত। নীলকরেরা সামান্য দাদন বা অগ্রিমের বিনিময়ে চাষিকে নীলচাষের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করত। সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী নীলকর সাহেবরা চাষির কাছ থেকে তাদের সমস্ত কিছু পাই পাই করে বুঝে নিত। কোনো কারণে চাষি চুক্তির সামান্য বরখেলাপ করলে তার আর নিস্তার ছিল না। কৌশলে কোনো চাষির সাথে নীলচাষ করার বিষয়ে একবার চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হলে আমৃত্যু উক্ত চাষি নীলচাষ করতে বাধ্য হতো। নীলচাষ করতে অস্বীকার করলে চাষির ওপর নেমে আসত অবর্ণনীয় অত্যাচার। পূর্ব বাংলায় নীলচাষ শুরুর পর থেকে নীলচাষ বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত কতজন নীলচাষি নীলকরের অত্যাচারে জীবন হারিয়েছে তার হিসাব নেই । নীলকর সাহেবদের সাথে স্বাক্ষরকৃত চুক্তিপত্র ছিল সারা জীবনের দাসখতস্বরূপ । চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উৎপন্ন নীলের মূল্য থেকে দাদনের টাকা কেটে রাখা হতো। উৎপন্ন নীলের মূল্য থেকে দাদনের অর্থ পরিশোধ না হলে পরবর্তী বছরের উৎপন্ন নীল থেকে উক্ত দাদনের অবশিষ্ট পাওনা কেটে রাখা হতো। ফলে যে চাষি একবার নীলচাষের জন্য দাদন নিয়েছে বছরের পর বছর সে তার জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য হতো । উৎপন্ন নীল ইংরেজ নীলকর সাহেবদের নিকট বা দাদন প্রদানকারীর নিকট বাজার মূল্যের অর্ধেক বা কম মূল্যে বিক্রি করতে হতো। পূর্ব-বাংলার অনাহারী, অত্যাচারিত, ক্ষুধার্ত নীলচাষিরা নিজের জমিতে নীলচাষ করতে অস্বীকার করলে নীলকরের পাইক- বরকন্দাজরা তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত। গরু-বাছুর জোর করে নিয়ে যেত। নীলচাষিকে ধরে কুঠিতে নিয়ে শারীরিক অত্যাচার করত। চাষির বৌ-মেয়েদের ওপর
অত্যাচার নেমে আসত ।
গ্রামের এই অত্যাচারিত নীলচাষিদের প্রতিকার পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। ‘হিন্দু পেট্রিয়ট' পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নীলচাষিদের ওপর নীলকরদের অমানবিক অত্যাচারের কাহিনী কোম্পানির সাহেবদের কর্ণগোচর করেছিলেন। সে সময় বিষয়টি তদন্ত করার জন্য কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের
পাঠানো হয়েছিল। কোম্পানির কর্মচারীরা নীলকুঠি সাহেবদের আতিথ্য গ্রহণ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নীলকর সাহেবদের মতামতের ভিত্তিতে রিপোর্ট প্রদান করতেন । কখনো কখনো সত্যনিষ্ঠ কর্মচারীর কারণে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের আসল চিত্র- বেরিয়ে আসত। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড মেকলে লেখেন— “নীলচুক্তিগুলো নীতিগতভাবে অতিশয় আপত্তিকর। এসব নীলচুক্তি ও নীলকরদের বেআইনি এবং অত্যাচারজনিত কার্যকলাপের ফলে বঙ্গ দেশে কৃষক প্রায় ভূমিদাসে পরিণত হয়েছে।”
১৮৩৭ সালে ‘নীলকর সমিতি' গঠনের মাধ্যমে নীলচাষিদের ওপর অত্যাচার- নিপীড়ন করার পাকাপাকি ব্যবস্থা করা হয়। সমসময়েই প্রতিষ্ঠিত হলো 'দিল্যান্ড হোল্ডার্স এন্ড কমার্শিয়াল অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া'। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান ভূমিকায় আবির্ভূত হলো নীলকর সমিতি। অনেক সময় নীলকরেরা নিজেদের মাঝেই জমির অধিকার প্রশ্নে মারামারি ও দাঙ্গাহাঙ্গামা করত। টাওয়ার নামক ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট নীল তদন্ত কমিশনের সামনে সাক্ষী দেওয়ার সময় বলেছিলেন যে, “তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন কয়েকজন রায়তকে বর্শা দিয়ে বিদ্ধ করা হয়েছে এবং কয়েকজনকে গুলি করে মারা হয়েছে । আর কয়েকজনকে প্রথমে বর্শায় বিদ্ধ করে পরে গুম করা হয় । সিরাজগঞ্জ জেলার গাবগাছি গ্রামে চাষিরা নীলচাষ করতে অস্বীকার করায় নীলকর একশ লাঠিয়াল দিয়ে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়, গরুবাছুর ধরে আনে এবং গ্রামবাসীদের নির্মমভাবে প্রহার করে। এমনিভাবে কুষ্টিয়াতেও নীলকুঠিতে রায়তদের আটকে রেখে ষাটবার বেত্রাঘাত করা হয়। অনুরূপভাবে ইব্রাহিমপুর কুঠিতেও নীলচাষিদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হতো। ইংরেজ কুঠিয়াল ম্যাকগ্রেগর গ্রামের চাষিদের বাড়ীঘর তছনছ করে দিত। ইংরেজ কুঠিয়ালদের অত্যাচারে চাষি পূর্বপুরুষের ভিটামাটি ছেড়েছে। কিন্তু ম্যাকগ্রেগরের আঘাতে গ্রামের অনেক চাষির পিঠে, বুকে ও মুখে আঘাতের চিহ্ন বহন করতে হয়েছে। চাষিরা হয়েছে গৃহহীন। ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দে চারজন নীলকরের ভয়ংকর উৎপীড়ন প্রমাণিত হওয়ায় বঙ্গদেশে তাদের বসবাসের অনুমতি নাকচ করে দেওয়া হয়। ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জুলাই সপরিষদ গভর্নর জেনারেল নিম্নোক্ত নির্দেশ জারি করেন -
‘দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত নীলকর নামক ইউরোপীয়ানদের দ্বারা অনুষ্ঠিত অত্যাচার-অনাচারের প্রতি সরকারের দৃষ্টি সম্প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইয়াছে। এই সকল অত্যাচার-অনাচারের সংখ্যা সম্প্রতি বিশেষ বৃদ্ধি পাইলেও সপরিষদ গভর্নর জেনারেল এখনও এই আশা পোষণ করেন যে, সাধারণভাবে নীলকর শ্রেণির সকলের চরিত্র এই কলঙ্কে কলঙ্কিত নহে। কিন্তু এই শ্রেণির কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেটগণের আদালতে ও সুপ্রিমকোর্টে যেসকল অপরাধ প্রমাণিত হইয়াছে সেইগুলো এত গুরুতর যে, সপরিষদ গভর্নর জেনারেলের মতে সেই সকল অপরাধ সমানভাবেই ইংরেজ চরিত্র কলঙ্কিত করে এবং দেশিয় প্রজাবৃন্দের সুখ-শান্তি বিঘ্নিত করে।'
বাকল্যান্ড সাহেব তাহার গ্রন্থে নীলকরগণের উক্ত অপরাধসমূহকে নিম্নোক্ত কয়েকটি ভাগে ভাগ করিয়াছেন- আক্রমণাত্মক অপরাধ যেগুলো আইনগত অর্থে নরহত্যা না বলা গেলেও যাহার ফলে দেশীয়গণের মৃত্যু ঘটিয়াছে ।
প্রাপ্য বলিয়া কথিত অর্থ আদায় অথবা অন্যান্য কারণে দেশীয়গণকে বিশেষত গুদামে অবৈধভাবে আটক রাখা ।
অপর নীলকরগণের সহিত দাঙ্গাহাঙ্গামা করিবার উদ্দেশ্যে কারখানার লোকজন অথবা ভাড়াটিয়া গুন্ডা একত্রিত করা ।
চাষি ও অন্যান্য দেশীয়গণকে অবৈধভাবে বেত্রাঘাত করা ও অন্যান্য শাস্তিদান ৷
নীলকরদের আটক ও দৈহিক পীড়নের কেন্দ্রস্বরূপ নীলকরগণের গুদামগুলো ধ্বংস করিয়া ফেলি বার নির্দেশও ম্যাজিস্ট্রেটগণকে দেওয়া হইয়াছিল ।
সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার ১৮৫৯ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় নীলকরদের অত্যাচারের বিবরণ পাওয়া যায়— ‘গ্রামে গ্রামে নীলকরদের অত্যাচার বাড়িয়া চলিতেছে। দারোগা তা দেখিয়াও চুপ করিয়া থাকে। প্রথমত প্রজারা ভয়ে কোনো নালিশ করিতে সাহসী হয় না। দ্বিতীয়ত ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের সঙ্গে নীলকরদের বন্ধুত্ব খুব গভীর। তাই প্রজাদের কোনো অভিযোগ হয়তো আরও অত্যাচার ডাকিয়া আনিবে। শাসনের নামে সারা দেশে স্বৈরাচার চলিতেছে। শুধুমাত্র দু'চারটা চোর-ডাকাত ধরাকে শাসন বলে না। কোনো কুঠিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের শালা, কেহ ভাই, কেহ ভগ্নিপতি, কেহ পিসে, কেহ জ্ঞাতি, কেহ কুটুম্ব, কেহ মস্থ, কেহ সমধ্যায়, এইভাবে পরস্পরের সহিত সম্পর্ক ও সংযোগ আছে। এবং তাহা না হইলেও সকলে এক সানকির ইয়ার। কোনো মতে ছাড়াছাড়ি হইবার জো নাই। সর্বত্রই নীলকরদের জয়জয়াকার। দারোগা প্রত্যক্ষ ঘটনা দৃষ্টি করিয়াও রিপোর্ট দিতে সাহসী হয় না। তাহা হইলেও শেষ রক্ষা হয় না। বিচারপতির কোপ দৃষ্টিতে পড়িয়া সর্বশেষে কর্মরাখা দায়।' লোকে বলে-যার সর্বাঙ্গে ব্যথা, তারে ওষুধ দেবো কোথা ।
মীর মোশাররফ হোসেনের আত্মজীবনী ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা' গ্রন্থে নীলকরদের অত্যাচারের অনেক দুর্বিষহ ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। নীলকর কেনির অত্যাচার সম্পর্কে লিখেছেন-‘কেনির অত্যাচারের ছোট ছোট তালুকদার, জোতদার, নানা শ্রেণির ব্যবসাদার, মহাজন প্রভৃতি নাজেহাল হইয়া পৈতৃক গ্রাম, বাড়িঘর ছাড়িয়া নানা স্থানে লোকেরা আশ্রয় লইতেছে, জাতি, ধন, মান, প্রাণ কৌশলে বাঁচাইতেছে। একদিন প্রায় একশত প্রজা কাঁদিতে কাঁদিতে সুন্দরপুর উপস্থিত হইয়া তাহাদের একমাত্র বলভরসা, আশ্রয়দাত্রী ও রক্ষাকর্ত্রী যাহাকে জানিত তাহার (সুন্দরপুরের জমিদার প্যারী সুন্দরী) নিকট বলিতে লাগিল। ‘মা রক্ষাকর। এতদিন বাঁচাইয়াছ এখন বাঁচাও। দুরন্ত বাঘের (কেনি) মুখ হইতে তোমার গরীব প্রজার প্রাণ বাঁচাও। আগামীকল্য আমাদের বুনানী ধান ভাঙ্গিয়া সাহেব নীল বুনানী করিবে। বহুতর লাঠিয়াল সংগ্রহ করিয়াছে। মা! আমাদিগকে রক্ষা কর। দুরন্ত জালেমের হস্ত হইতে তোমার গরীব প্রজাদিগকে রক্ষা কর। এতদিন ছিলাম ভাল। এখন মারা পড়িলাম। আর বাঁচিবার পথ নাই। সম্বৎসর আশা করিয়া চাষ করিয়াছি পেটে না খাইয়া ঘরের ধান মাঠে ফেলিয়াছি। স্ত্রী-পুত্র লইয়া খাইয়া প্রাণ বাঁচাইব, আপনার রাজস্ব আদায় করিব আশাতেই সাধ্যের অতিরিক্ত পরিশ্রম করিয়া ঐ ধান ক্ষেতের দিকে চাহিয়া একটু স্থির রহিয়াছি। মা আমাদের সেই বোনা ধান ভাঙ্গিয়া সাহেব যদি নীল বুনানী করে, তবে আমরা একেবারে মারা পড়িব। ছেলেমেয়ে সমেত মারা পড়ি। মা। তুমি মুখ তুলিয়া না চাহিলে, আমাদের মুখের প্রতি একবার নজর করে এমন লোক জগতে আর কেহই নাই। মা। তুমিই আমাদের রক্ষাকর্তা। মা তোমার এই অধম সন্তানদিগকে বিপদ হইতে রক্ষা কর। দুরন্ত জালেমের হাত হইতে বাঁচাও। একটি মাত্র ইংরেজ (কেনি) আসিয়া এ দেশ উচ্ছিন্ন করিল। একেবারে ছারখার করিয়া ফেলিল। কৃষি-প্রজার জমাজমি কাড়িয়া লইয়া নীল বুনানী করিল । কাহারও যথাসর্বস্ব লুটিয়া একেবারে পথের কাঙ্গাল করিয়া ছাড়িয়া দিল। ...কেনির উৎসাহে তাহার লাঠিয়ালগণ অর্ধক্রোশ পর্যন্ত বিপক্ষগণকে তাড়াইয়া লইয়া চলিল। কেনীর নির্দেশে লুণ্ঠন আরম্ভ হইল। থালা, ঘটি, বাটি এবং কৃষকস্ত্রীদের গায়ের রূপার অলঙ্কার সর্দারগণ টানিয়া ছিঁড়িয়া খসাইতে আরম্ভ করিল। পাষণ্ডেরা স্ত্রীলোকদের পরনের কাপড় পর্যন্ত কাড়িয়া লইয়া গেল। গরু সকল কুঠির দিকে লইয়া চলিল। ঘর ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া শেষে আগুন লাগাইয়া দিল। ঘর ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া শেষে আগুন লাগাইয়া দিল ।'
১৮২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মে ‘সমাচার দর্পণ' পত্রিকার নীলকরগণের উৎপীড়নের নিম্নোক্ত বিবরণ প্রকাশিত হইয়াছিল: ‘মফস্বলে কোনো কোনো নীলকর প্রজার উপর দৌরাত্ম্য করেন তাহার বিশেষ কারণ এই যে, প্রজা নীলের দাদন না লয় তাহাদের প্রতি ক্রোধ করিয়া থাকেন ও খালাসিদিগকে কহিয়া রাখেন যে, ঐ সকল প্রজার নীলের নিকট আইলে সে গরু ধরিয়া কুঠিতে আনিবা । তাহারা ঐ চেষ্টাতে নীলের জমির নিকট থাকে। কিন্তু যখন গরু নীলের নিকট আইসে যদ্যপি নীলের কোনো ক্ষতি না করে তথাপি তখনই সে গরু ধরিয়া কুঠিতে চালান করে। সে গরু এমত কায়দায় রাখে যে তৃণ এ জন্মে দেখিতে না পায়। ইহাতে প্রজালোক নিতান্ত কারত হইয়া কুঠিতে যায় । প্রথম তাহাদিগকে দেখিয়া কেহ কথা কহে না। পরে অনাহারে গরু যথ শুকাইতে থাকে ততই প্রজার দুঃখ হয়। ইহাতে সে প্রজা দেনাদি করিয়া সরকারের লোককে কিছু ঘুষ দিয়া ও নীলের দাদন লইয়া গরু খালাস করিয়া গৃহে আইসে এবং নীলের দাদন যে প্রজা লয় তাহার মরণ পর্যন্ত খালাস কয়েদ রাখে। তাহাতে প্রজা ভীত হইয়া হাল বকেয়া বাকি লিখিয়া দিয়া দাদন লইয়া যায়। এইরূপ যাবৎ গোবৎসাদি থাকে, তাবৎ ভিটা থাকে, তাহার অন্যথা হইলে স্থান ত্যাগ করা যেহেতু দাদন থাকিতে অন্য শস্য আবাদ করিয়া নির্বাহ করিতে পারে না। '
১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দের বিধি অনুযায়ী ইংরেজ নীলকরদের বিচার মফস্বল বিচারালয়ে করা যেত না। এ দেশে বসবাসরত ইংরেজদের বিচার কলকাতার সুপ্রীম কোর্টে করা হতো। ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ নম্বর বিধি অনুযায়ী নীলকর সাহেবদের মফস্বল আদালতের আওতায় আনা হয়। নীলকুঠি স্থাপনের পর থেকেই নীলকরেরা রায়তের ওপর অত্যাচার আরম্ভ করেছিল। ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে দু'জন মুসলমান জমিদার জেলা জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশ করলেন যে, নীলকরেরা তাদের প্রজাদের খাদ্যশস্য লাঙল চষে নষ্ট করেছে এবং সে জমিতে জোর করে নীলচাষ করিয়েছে। সাহেবরা রায়তদের বেদম প্রহারও করেছে। নীলগাছ কাটার পর তারা রায়তকে শর্তানুযায়ী দাম দিতেও অস্বীকার করেছে। ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে এবং ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের আইন অনুযায়ী রায়ত চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের পর নীল চাষ করতে অস্বীকার করলে নীলকর কোর্টে মোকদ্দমা করে নীলচাষিকে জেলে পাঠাতে পারত। যশোর জেলার কলারোয়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল লতিফের আদালতে কয়েকজন রায়ত ঝিকরগাছার নীল কারখানার ম্যাকেঞ্জির বিরুদ্ধে নালিশ দায়ের করে। আদালতের সমনে বলা হয়-‘কাঁচপুর গ্রামের আকবর দফাদার, তোতাগাজী, আসাদুল্লাহ মণ্ডল, গোলাপ মণ্ডল ও জাকের মণ্ডল অত্র কোর্টে অভিযোগ করেছে যে ফ্যাক্টরির আমিন, খালাসী ও দেওয়ান লাঠিয়াল নিয়ে রায়তদের জোর করে নীলচাষ করতে এবং দাদন নিতে বাধ্য করেছে। যারা দাদন নিতে রাজি নয়, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের মারধর করেছে এবং কাউকে হত্যাও করেছে। কাজেই এই সমন মারফত নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে, ভবিষ্যতে লোক যেন কৃষকের সঙ্গে এমনধরনের আচরণ না করে। কৃষকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা আদালতে পেশ করতে পারেন। এই আদেশ অমান্য করে কৃষকের উপর আবার অত্যাচার করলে জবাবদিহি করতে হবে।' সমন পাওয়ার পর ম্যাকেঞ্জি সরকারের সচিব গ্রে'র নিকট আবদুল লতিফের জাহানাবাদে বদলি করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রায়তের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে রায়তের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হতো। নীলচাষ করতে অস্বীকার করলে রায়তকে তিন মাস সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হতো। ১৮৫৯-৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রায়তরা সংঘবদ্ধ হয়েছিল। অসময়ে যশোরের অস্থায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ই. ডাব্লিউ মলোনি কালপোন থানায় নীলচাষে অনিচ্ছুক গ্রাম্য মোড়লদের গ্রেফতার করে হাজতে পাঠিয়ে অত্যাচার করেন। এতদসত্ত্বেও গ্রামবাসীরা নীলচাষ করতে অস্বীকার করলে প্রত্যেককে বিশ টাকা জরিমানা ও ৩ সপ্তাহের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে কুষ্টিয়ার রায়তরা সংঘবদ্ধ হয়ে বর্শা, লাঠি ও বাঁশ দিয়ে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতিনিধিসহ পুলিশকে ১২০০ রায়ত ঘেরাও করে। পুলিশ কোনোমত প্রাণে বেঁচে আসে। দু'জন পুলিশ আহত হয় ।
পূর্ব বাংলার নীলচাষিরা প্রায় একশ' বছর যাবৎ নীলকুঠির সাহেবদের অত্যাচার- নিপীড়ন সহ্য করে আসছিল। অত্যাচার-নির্যাতনের সীমা ছাড়িয়ে গেলে নীলচাষিরা ১৮৫৯-১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বিদ্রোহ করতে শুরু করল। নীলচাষির এ বিদ্রোহ ছিল নীলকরদের শতবর্ষের অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন ও ধর্ষণের চরম বহিঃপ্রকাশ। যশোর জেলার চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস নীল বিদ্রোহে নীলচাষিদের সংঘবদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তারা গ্রামে গ্রামে যেয়ে নীলচাষিদের সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য বোঝাতে লাগল। প্রথমেই তারা নিজেদের গ্রামের কৃষকদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করালেন যে জীবন গেলেও নীলচাষিরা জমিতে নীলচাষ করবে না। এরপর বিষ্ণু বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস নিজেদের সহায়-সম্পত্তি নীলচাষিদের সংঘবদ্ধ করার কাজে ব্যয় করলেন। তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামের নীলচাষিদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করালেন। নীলবিদ্রোহকে শানিত করতে নীলচাষিদের লাঠি চালানোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। বরিশাল থেকে দক্ষ লাঠিয়াল ভাড়া করে আনা হলো। লাঠিয়ালরা এলাকার নীলচাষিদের লাঠি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করল। নীলকরেরা সহস্রাধিক লোক নিয়ে রাতের আঁধারে চৌগাছা গ্রাম আক্রমণ করল। তারা গ্রামের চাষিদের বাড়িঘর লুট করল ও জ্বালিয়ে দিল। একজন কৃষক নিহত হলো। কিন্তু বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসকে নীলকরেরা ধরতে পারল না। বিশ্বাস ভাইয়েরা রাতের আঁধারে গ্রামে গ্রামে ঘুরে নীলচাষিদের সংঘবদ্ধ করার কাজ চালিয়ে যেতে লাগল। কৃষকরা নীল বুনা বন্ধ করতে লাগল। কৃষকের এই পদক্ষেপে কাঠগড়া কনসার্ন বন্ধ হয়ে গেল। নীলকরদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গের দরুন নীলচাষিদের বিরুদ্ধে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করে নীলকরেরা ডিক্রি পেল। বিশ্বাস ভাইয়েরা নীলচাষিদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল। তখন নীলচাষিদের বিদ্রোহের নেতৃত্বে এগিয়ে এসেছিলেন ফরায়েজী নেতা রফিক মণ্ডল। এ সময়ে ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড' নামক পত্রিকায় নীল বিদ্রোহের কিছু বিবরণী পাওয়া যায়। সে সময় কৃষকেরা ছয়টি দলে নিজেদের বিভক্ত করেছিল । তীর ধনুক দল
ফিঙ্গা দিয়ে গোলক নিক্ষেপকারী দল
প্ৰথমে ছিল
দ্বিতীয় স্থানে
তৃতীয় ছিল
ছোট ছোট ইটপাটকেল নিক্ষেপকারী দল
চতুর্থ ছিল
পঞ্চম স্থানে
ষষ্ঠ স্থানে ছিল
শক্ত কাঁচা বেল নিক্ষেপক দল
পিতলের থালা ও বাটি নিক্ষেপক দল এবং
পোড়ামাটি ও ভাঙ্গা মাটির বাসন নিক্ষেপক দল ।
ষষ্ঠ দলে শুধু মেয়েরাই নিয়োজিত ছিলেন। উপরন্তু লাঠি চালানো দল ও বল্লম নিক্ষেপকারী দুটি বিশেষ দলও ছিল। শেষের দুটি দলকে ‘যুধিষ্টির কোম্পানি' নামকরণ করা হয়েছিল। এমনি সব দল বিদ্রোহী এলাকায় গঠিত হয়েছিল। পাবনা অঞ্চলের বিদ্রোহীরা কিছু বন্দুক যোগাড় করেছিল। এ সমস্ত বন্দুক চালনাকারীদের নিয়ে একটি ‘বন্দুকধারী দল' গঠিত হয়েছিল । নীলকরদের লাঠিয়াল বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য প্রত্যেক গ্রামে নিযুক্ত করা হয়েছিল ‘ঢোল বাদক দল'। নীলকরদের লাঠিয়াল বাহিনী আক্রমণের জন্য গ্রামগুলোতে আসার মুহূর্তেই বাদক দল ঢোল বাজিয়ে গ্রামবাসীকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিত। প্রত্যেক গ্রামে ঢোল বাজানোর ফলে গ্রামবাসীরা পরস্পর সংঘবদ্ধ হয়ে লাঠিয়াল বাহিনীকে প্রতিহত করত। গ্রামবাসীদের আক্রমণে নীলকরের লাঠিয়াল পাইক-বরকন্দাজরা আহত হয়ে কুঠিতে ফিরে যেতে বাধ্য হতো ।'
নীল বিদ্রোহ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। দীর্ঘদিনের অত্যাচারিত-নিপীড়িত নীলচাষিরা আপনাতেই সংঘবদ্ধ হয়েছিল। যশোর, পাবনা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা, নদীয়া, চব্বিশ পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলের প্রায় ষাট লক্ষ নীলচাষি এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল । নীল বিদ্রোহের প্রাথমিক প্রতিবাদ শুরু হয় মামলা-মোকদ্দমা-নালিশ ইত্যাদির মাধ্যমে। নীলচাষিরা অত্যাচার-নিপীড়ন ঘরবাড়ি জ্বালাও ইত্যাদির জন্য নীলকরদের বিরুদ্ধে আদালতে নালিশ, মোকদ্দমা করে প্রতিকার চাইত। নীলচাষিরা বিচার না পেয়ে জমিতে নীলচাষ করতে অস্বীকার করে। বছরের পর বছর নীলচাষিদের উপর নীলকরদের নিপীড়ন-অত্যাচার নীলবিদ্রোহকে ক্রমান্বয়ে সংগঠিত করেছিল। নীলকরদের লাঠিয়াল, পাইক, পেয়াদা, বরকন্দাজ, গারো সৈন্য ও পুলিশ বাহিনী কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করায় ক্ষুধার্ত, সহায়-সম্বলহীন মৃত্যুপথযাত্রী নীলচাষিরা প্রত্যক্ষ ও সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। নীলকরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অধিকাংশ কনসার্নসমূহের এলাকাধীন জমিতে কৃষকেরা নীলচাষ বন্ধ করে দেয়। কৃষকেরা নীলকুঠির ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। বাংলার নীলচাষের আওতাভুক্ত গ্রামাঞ্চলের অবস্থা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে থাকে। নীল বিদ্রোহের সময় লর্ড ক্যানি বলেছিলেন-নীল চাষিদের বর্তমান বিদ্রোহের ব্যাপারে প্রায় এক সপ্তাহকাল আমার এতই উৎকণ্ঠা হইয়াছিল যে, দিল্লির ঘটনার (১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহিবিদ্রোহ) সময়ও আমার ততখানি উৎকণ্ঠা হয় নাই। আমি সকল সময় ভাবিয়াছি যে, কোনো নির্বোধ নীলকর-যদি ভয়ে বা ক্রোধে একটিও গুলি ছোড়ে তাহা হইলে সেই মুহূর্তেই দক্ষিণবঙ্গের সকল কুঠিতে আগুন জ্বলিয়া উঠিবে।
Calcutta Riview থেকে জানা যায়- ‘সে সময় গ্রামবাসীদের মধ্যে একটা আকস্মিক ও অত্যাশ্চর্য পরিবর্তন এসেছিল। এতদিন রায়তদের সাথে ক্রীতদাস অথবা ভূমিদাসের মতো ব্যবহার করত এখন সেই রায়তরাই জেগে ওঠেছে। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের নীলকরেরা বাংলার ছোটলাটের নিকট একটা স্মারকপত্র দেন। তা' থেকে জানা যায় কৃষকগণ সংগঠিতভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। তাদের দিয়ে নীলচাষ করা সম্ভব হচ্ছে না।'
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে রাজশাহী, যশোর, পাবনা, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ বিস্তার লাভ করে। এই বিদ্রোহ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নীলকুঠির ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। পাবনার বিদ্রোহ দমনের জন্য ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। উক্ত দলের একজন পুলিশের বর্ণনায় পাওয়া যায়—‘সকাল বেলায় আমরা অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রস্তুত হয়ে বিদ্রোহীদের গ্রামে পৌঁছামাত্র লাঠি ও তীর-ধনুক সজ্জিত হয়ে দুশো কৃষক আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলল। তাদের বল্লমের আঘাতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের ঘোড়া আহত হলো। এরপর খবর এলো যে পার্শ্ববর্তী বাহান্নটি গ্রাম থেকে কৃষকেরা সমবেত হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজনের কাছে বন্দুকও ছিল এবং গুলির শব্দও শোনা যাচ্ছিল। নীলকরের প্রায় জনা-পঁচিশেক পুলিশ মল্লিকপুরের কৃষক পাচু শেখকে গ্রেফতার করতে গেলে নীলবিদ্রোহীদের সাথে তাঁদের সংঘর্ষ হয়।' উভয় পক্ষেই আহত হয়। নীলকরের লাঠিয়াল বাহিনীর আঘাতে পাচু শেখ মারা যায়। কুষ্টিয়া জেলায় ছিল টমাস আইভান কেনীর নীলকুঠি। কেনীর নীলকুঠির আওতায় কোনো নীলচাষি জমিতে নীলচাষ করতে অস্বীকার করলে সে চাষির মাথার উপর মাটি রেখে তাতে নীলচাষ বপন করা হতো। নীলচাষে রাজি না হওয়া পর্যন্ত সে চাষির ওপর চলত এমনতর নানাবিধ অত্যাচার-
নিপীড়ন। কুষ্টিয়ার সদরপুরে রায়তদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের বিষয়টি সেখানকার জমিদার প্যারী সুন্দরী প্রতিবাদ করেন। এক পর্যায়ে কেনীর ও প্যারী সুন্দরীর লাঠিয়াল বাহিনীর সংঘর্ষ বেঁধে যায়। কেনীর লাঠিয়ালরা প্যারী সুন্দরীর কাচারি লুট করলে প্যারীর লাঠিয়ালরা কেনির শালঘর মধুয়ার কুঠি আক্রমণ করে। এছাড়াও প্যারী সুন্দরীর লাঠিয়ালরা দারোগা মামুদ বখশকে সড়কি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এ বিষয়ের মোকদ্দমায় প্যারী সুন্দরী আর্থিক দিক দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যান। আর্থিক কারণে তাঁর জমিদারি নিলামে ওঠে। প্যারী সুন্দরীর পক্ষের অনেক নিরপরাধ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, দ্বীপান্তর ইত্যাদি শাস্তি হয়েছিল ।
১৮৬০ খ্রি. জুলাই মাস থেকে কুষ্টিয়ার শালঘর মধুয়া অঞ্চলের নীলচাষিরা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ঘটনাটি সরেজমিনে খতিয়ে দেখার জন্য কলকাতা থেকে আই.সি.এস.জি. মরিসকে কুষ্টিয়ায় পাঠানো হয়। নীলকর অত্যাচার বন্ধ করলে রায়তরা সরকারকে খাজনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। ঘটনার পর ছোট লাট স্যার জে.পি. গ্রান্ট পাবনা অঞ্চলের নীল বিদ্রোহের বিষয় তদন্তের জন্য আগমন করলে প্রজারা ছোট লাটের নিকট নীলচাষ বন্ধের অনুরোধ জানায়। গ্রান্ট নীল চাষিকে নীল চাষে বাধ্য না করার প্রতিশ্রুতি দেন। এ সময় খুলনার মোড়লগঞ্জের নীলকর মোড়লের তিনশত লাঠিয়াল সে এলাকার নীল চাষি রহিমউল্লাহর গ্রাম বারুইখালিতে আক্রমণ চালায়। গ্রামবাসীর সাথে মোরেল বাহিনীর সংঘর্ষ রহিমউল্লার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মোকদ্দমা হলে চৌত্রিশজন আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। ঘটনার পর মোরেল এ দেশে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ফেলে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেয়। অবশেষে ব্রিটিশ সরকার ১৮৬০ খ্রি. নীল বিদ্রোহ ও নীল চাষ সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য ‘নীল কমিশন গঠন করে । বাংলার ছোট লাটের নিকট প্রেরিত স্মারক থেকে জানা যায়-
‘রায়তগণ বর্তমানে খুবই উত্তেজিত অবস্থায় আছে। তারা ক্ষেপে গিয়েছে। তারা যে কোন দুষ্কর্মের জন্য প্রস্তুত। প্রতিদিন তারা আমাদের কুঠি ও বীজের গোলাগুলিতে আগুন লাগিয়ে দিবার চেষ্টায় থাকে। আমাদের অধিকাংশ চাকর-চাকরাণী আমাদের ত্যাগ করে চলে গেছে। কারণ রায়তরা তাদের দেখিয়েছে যে, তারা তাদেরকে হত্যা করবে, নতুবা তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিবে। যে দুই একজন চাকর আমাদের সাথে আছে, তারাও শীঘ্রই চলে যেতে বাধ্য হয়। কারণ পার্শ্ববর্তী বাজারে তারা খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারছে না। সমস্ত স্থানে বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। উক্ত স্মারকলিপিতে তারা নিম্নোক্ত ঘটনাসমূহের উল্লেখ করেছিল-
• বিদ্রোহী রায়তরা মোল্লাহাটির কুঠির সহকারী ম্যানেজার সাহেবকে আক্রমণ ও প্রহারের পর মৃত্যু ভেবে মাঠের মধ্যে ফেলে রেখে যায় ।
রায়তরা খাজুরার কুঠি লুণ্ঠন করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা কুঠি আক্রমণ করেছিল।
চাঁদপুরের গুলদায় কুঠির গোলায় আগুন দেওয়া হয়েছিল ।
• বামনদি কুঠির চাষিরা অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করছে এবং অন্যান্য কুঠিতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ছে। সমস্ত কৃষ্ণনগর (নদীয়া) জেলাই নীলকরদের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে ।
১৮৬০ খ্রি. ‘ইন্ডিয়া ফিল্ড' নামে একটি মাসিক পত্রিকা থেকে জানা যায়— কৃষকরা ৬টি ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানিতে নিজেদের বিভক্ত করেছিল। একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছিল কেবল তীর-ধনুক নিয়ে। প্রাচীনকালে ডেভিডের মতো ফিতা দ্বারা গোলক নিক্ষেপকারীদের নিয়ে আরেকটি কোম্পানি। ইটওয়ালাদের নিয়ে আরেকটি কোম্পানি তারা আমার বাড়ির প্রাঙ্গণ হতেও ইটপাটকেল কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। আর এক কোম্পানি হলো বেলওয়ালাদের। তাদের লক্ষ হলো শক্ত কাঁচা বেল নীলকরদের মস্তক লক্ষ করে নিক্ষেপ করা। থালাওয়ালাদের নিয়ে আরেকটি দল তারা তাদের ভাত খাবার পিতলের থালাগুলো অনুভূমিকভাবে শত্রুকে লক্ষ করে ছুড়ে মারে। তাতে শত্রু নিধন উত্তমরূপেই হয়। আরও একটি কোম্পানি থালাওয়ালাদের নিয়ে, যারা খুব ভালো করে পোড়ানো খন্ড কিংবা অখণ্ড মাটির পাত্র নিয়ে শত্রুকে অভ্যর্থনা জানায়। বিশেষত বাঙালি স্ত্রীলোকেরা এ অস্ত্র উত্তমরূপে ব্যবহার করতে জানে। একদিন নীলকরের লাঠিয়ালরা যখন দেখতে পেল যে স্ত্রী লোকেরা এ সকল অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদের দিকে ছুটে আসছে, তখন তারা ভীত হয়ে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিল। এইসব ছাড়াও আরও একটি কোম্পানি গঠিত হয়েছে যারা লাঠি চালাতে পারে তাদের নিয়ে । তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বাহিনী হলো ‘যুধিষ্ঠির কোম্পনি' অর্থাৎ বল্লমধারী বাহিনী। একজন বল্লমধারী একশত লাঠিয়ালকে পরাজিত করতে পারে। এর সংখ্যায় অল্প হলেও এরা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ এবং এদের ভয়ে নীলকরের লাঠিয়ালরা এরূপ ভীত যে, এখনও পর্যন্ত তারা আক্রমণ করতে সাহসী হচ্ছে না।
১৮৬০ খ্রি. ১৮ মে নীলকমিশনের প্রথম অধিবেশন বসেছিল নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। কমিশনের সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ জন। কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বাংলা সরকারের সেক্রেটারি ডাবলিউ. এস. সিটনকার। সদস্য ছিলেন ও. আর. টেম্পল আর পাদ্রিদের প্রতিনিধি ছিলেন জমিদার চন্দ্রমোহন চট্টপাধ্যায়। কিন্তু নীলচাষিদের কোনো প্রতিনিধি ছিল না কমিশনে। নীল কমিশন বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪-৫ মাস ঘুরে ১৩৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছিলেন। সাক্ষীদের মধ্যে ১৫ জন ছিলেন সরকারি কর্মচারী, ২১ জন নীলকর, ১০ জন খ্রিষ্টান মিশনারি, ১৩ জন জমিদার ও ৭৭ জন নীলচাষি । কমিশন ১৮৬০ খ্রি. ২৭ আগস্ট রিপোর্ট পেশ করে।
নীল কমিশনে প্রজারা যেসব অভিযোগ তুলে ধরেছিল তা নিম্নরূপ—
কৃষক ও তাদের স্ত্রী লোকদের উপর নীল কুঠির কর্মচারীদের অমানুষিক অত্যাচার ও জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ঋণ নীল কৃষককে ক্রীতদাসে পরিণত করেছে।
অবস্থার বিপাকে কৃষক বাধ্য হয়েই নীলকরদের কাছে ঋণী হয়ে পড়ে এবং সেই ঋণের বোঝা পুরুষানুক্রমে চলতে থাকে ৷
নীল কুঠির আমলারা কৃষককে তাদের সবচাইতে ভালো জমিতে নীল বুনতে বাধ্য করে। এমনকি জমিতে অন্য ফসল থাকলেও তা নষ্ট করে নীল বুনতে হয় ।
নীলকাটা ও গাড়ি বা নৌকায় করে কুঠিতে আনা পর্যন্ত সবই কৃষকের জন্য বেগার খাটুনি ।
যে সকল কৃষক নিজের প্রয়োজন ও লাভের কাজে নিয়োজিত থাকতে চায় সেই সময়েই তাদের নীল বপনে বাধ্য করা হয়। কৃষক স্বেচ্ছায় নীল বপন করে না ।
অন্যদিকে নীলকরেরা কমিশনকে জানাল যে, তারা বাংলায় থাকলে ব্রিটিশ সরকার ও বাঙালি প্রজা উভয়েরই মঙ্গল হবে। নীলকরদের মুখ্য উদ্দেশ্য বাংলা তথা ভারতবর্ষের জনসাধারণকে সভ্যতার সংস্পর্শে আসতে সাহায্য করা। এছাড়াও গরিব কৃষককে জমিদারের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব তারা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছে।
তারা আরও জানাল যে সরকারি কর্মচারীদের অসহযোগ, পুলিশের অসাধুতা ও আদালতের দূরত্ব তাদের বিশেষ অসুবিধার কারণ ।
নীল চাষের ব্যাপারে বিভিন্ন রকমের অসুবিধা তাদের জমিদারি করতে বাধ্য করেছে । কৃষকদের উপর নীলকরের সুশৃঙ্খল ব্যবহার বাঙালি জমিদারের অত্যাচারে চেয়ে অনেক ভাল ।
নীল বিদ্রোহের সময় ছোটলাট গ্রান্টের ভূমিকা ও নীলকমিশনের রিপোর্টের উপর তাঁর মন্তব্য সে সময়ের লন্ডনের বুদ্ধিজীবী সমাজকে নীল চাষির করুণ পরিণতির বিষয়ে সচেতন করে তুলতে সহায়ক হয়েছিল। গ্রান্ট সাহেব কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজকে ও তাঁর পেছনে সমবেত করতে কিছুটা সক্ষম হয়েছিলেন। ভারত সচিব চার্লস উড ছোট- লাট গ্রান্টের মন্তব্যে সন্তোষ প্রকাশ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, বাংলায় প্রচলিত চাষ ব্যবস্থার অনিবার্য পরিবর্তন প্রয়োজন। যদিও এর ফলে অনেক ইউরোপীয় নীলকর সাহেব ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং সে জন্য তিনি দুঃখিত। তথাপি এ ব্যবস্থা চলতে দেওয়া যায় না ৷
কৃষক উপলব্ধি করল যে, ঐক্যবদ্ধ শক্তিই তাদের একমাত্র সম্বল । চাষিরা দলবদ্ধভাবে ১৮৬০ খ্রি. হৈমন্তিক চাষ বন্ধ করে দিল। বিদ্রোহের দু'বছরের মধ্যে নদীয়া, যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা, ঢাকা ও অন্যান্য জেলা ধীরে ধীরে নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায় । জমজমাট নীল কুঠিগুলো কালক্রমে পোড়া বাড়িতে পরিণত হয়।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে পরিশেষে বলা যায় যে, ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে কাঁচামাল সংগ্রহের একটি ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয় ব্রিটেনের বাংলা উপনিবেশ। বস্ত্র শিল্পের রঞ্জক হিসেবে নীলের চাষ ও তা ইংল্যান্ডের রপ্তানি করে প্রচুর মুনাফার সম্ভাবনা সূত্র খুঁজে পায় নীলকরেরা। রায়তদের জোর করে নীল চাষে বাধ্য করে তারা। কিন্তু অলাভজনক হওয়ায় রায়তেরা নীলচাষে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। নীলকরদের অত্যাচারে ঐক্যবদ্ধ কৃষক সমাজ ১৮৫৯-৬২ খ্রি. পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত সময়ে নীল বিদ্রোহ গড়ে তোলে। সরকার ১৮৬০ খ্রি. নীল কমিশন গঠন করে। কমিশনের সুপারিশে রায়তের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে নীলচাষে বাধ্য করাকে আইনত নিষিদ্ধ ষোষণা করা হয়। নীল আন্দোলনের তীব্রতা ও নীল কমিশনের রিপোর্ট, সেই সঙ্গে রাসায়নিকভাবে প্রস্তুত নীল বাজারে আসার কারণে বাংলায় নীল চাষের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। সেই সাথে অবসান ঘটে নীল বিদ্রোহের। কিন্তু চাষি তথা আপামর জনসাধারণের মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় তা পরে ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]