পাবনা বিদ্রোহের পটভূমি পাবনা কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা পাবনা বিদ্রোহ (১৮৭২-৭৩ খ্রি.)

Pabna Rebellion (1872-73 )
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে পাবনা বিদ্রোহ (১৮৭২-৭৩ খ্রি.) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। পাবনা বিদ্রোহ ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের একটি বড় ধরনের বিদ্রোহ। ইউসুফ শাহী পরগনায় এ বিদ্রোহের সূচনা হয়। পরগনাটি বৃহত্তর পাবনা জেলাধীন বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। জমিদাররা সর্বদাই অবৈধ পন্থায় কৃষকদের কাছ থেকে বলপূর্বক আবওয়াব ও বর্ধিত হারে খাজনা আদায় করতো। খাজনা পরিশোধ না করার অজুহাতে প্রায়ই তারা কৃষকদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতো। বৃহত্তর পাবনার কৃষকগণ জমিদারদের এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। এ কৃষক বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে প্রচণ্ড, কিন্তু ব্যাপকভাবে অহিংস ও সুসংগঠিত। বাকল্যান্ড উল্লেখ করেছেন- ১৮৭২-৭৩ খ্রি. পাবনার কৃষক বিদ্রোহের ফলেই ব্রিটিশ সরকারকে ১৮৮৫ খ্রি. বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করতে হয়েছিল।
পাবনা বিদ্রোহ
নীলবিদ্রোহের পর প্রায় দুই দশক ধরে অব্যাহত শান্তি বিরাজ করে। কৃষক সমাজ তাদের নিজস্ব ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সুখে বাস করছিল বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু ১৮৭০ এবং ৮০ এর দশকে প্রজারা পুনরায় প্রতিরোধমুখী হয়ে ওঠে। ১৮৬০ এর দশকে বাংলা অঞ্চলে কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং ভূমির উপর বাড়তি জনসংখ্যার চাপের ফলে ভূমিমালিকরা (Iandowners ) খাজনার হার বৃদ্ধিতে তৎপর হয়। কিন্তু রায়তগণ পরগনা নিরিখ অনুযায়ী খাজনা প্রদানে তাদের রীতিসিদ্ধ অধিকারের উপর জোর দেয়। ১৮৭০ থেকে দুই দশকের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে কৃষক বিদ্রোহ লক্ষ করা যায় সুন্দরবনের তুষখালিতে (১৮৭২-৭৫), নোয়াখালীর ছাগলনাইয়ায় (১৮৭৪), উপ- পার্বত্য ময়মনসিংহে (১৮৭৪-৮২), ঢাকার মুন্সিগঞ্জে (১৮৮০-৮১) এবং মেহেদীগঞ্জে (১৮৮০-৮১)।
সবচেয়ে প্রচণ্ড কিন্তু ব্যাপকভাবে অহিংস ও সুসংগঠিত ছিল ১৮৭২-৭৩ খ্রি. পাবনা কৃষক বিদ্রোহ। পাবনার জমিদারগণ, যারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রাক্কালে নিলামক্রেতা হিসেবে ভূমি নিয়ন্ত্রণকারী ছিলেন, তারা প্রায় সকলেই ছিলেন অনাবাসিক (Non-resident)। সময়ে সময়ে খাজনা বৃদ্ধি করা ছাড়াও ভূমিমালিকরা সকল ধরনের আবওয়াব (abwab) সংগ্রহ করতেন। যখন অহরহ খাজনা বৃদ্ধি ও অবৈধ আবওয়াব সংগ্রহ থেকে বিরত থাকার জন্য আবেদনে কাজ হলোনা, তখন ক্ষুব্ধ প্রজারা ১৮৭৩ খ্রিষ্টব্দে খোলাখুলিভাবে অমান্য আন্দোলন শুরু করে। অমান্য আন্দোলন ও বিক্ষোভ প্রথমে সিরাজগঞ্জে শুরু হয়। শীঘ্রই তা অন্যান্য পরগনা ও জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।
রায়তরা নিজেদেরকে সুস্পষ্ট নেতৃত্বের অধীনে বিভিন্ন জোট ও লীগে সংগঠিত করে। আইনসম্মত যুদ্ধ করা ও সার্বক্ষণিক লাঠিয়াল বাহিনী পরিচালনার জন্য সংগঠকগণ সমগ্র কৃষক সম্প্রদায়ের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে। গ্রামে গ্রামে গিয়ে তারা নিজেদের দাবির ব্যাপারে জনগণকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা চালায়। এক গ্রামে সফল হলে তারা অন্য গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এভাবে প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধকরণের ফলে সমগ্র জেলা কৃষক লীগসমূহের সমর্থকে পরিণত হয়। প্রথম দিকে নেতৃত্ব প্রদান করেন দৌলতপুরের এক ক্ষুদে ভূস্বামী-ঈশ্বর চন্দ্র রায়। শীঘ্রই জগতুলার খুদি মোল্লা নামে এক মুসলমান জোতদার জোটগুলোর মধ্যে ব্যাপক প্রভাবশালী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি কৃষকদের মধ্যে ‘প্রধানমন্ত্রী' হিসেবে পরিচিত হন। পরবর্তীতে আরেকজন কৃষকনেতা খ্যাতি লাভ করেন। তিনি হলেন ষোলোঘরের চন্দ্রনাথ মজুমদার। এটি ছিল প্রকৃতপক্ষে অনাবাসিক জমিদারদের সাথে সাধারণ কৃষক সমর্থিত স্থানীয় খুদে ভূমালিকদের বৃহৎ প্রতিদ্বন্দ্বিতা। খাজনা প্রদান বন্ধ রাখা হয় যতক্ষণ না বৃহৎ অনাবাসিক জমিদারগণ কৃষকদের এ দাবি মেনে নেন যে ভূমির উপর তাদের অধিকার রয়েছে এবং বিনা কারণে ভূমি মালিকদের খাজনা বৃদ্ধির কোনো অধিকার নেই। এ ধারণা কৃষকদের মধ্যে সাধারণভাবে বিরাজ করছিল এবং এ ধারণা পোষণে তারা কোনো বিমূর্ত তত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত হয়নি, বরং রীতিসিদ্ধ অধিকারের ব্যাপারে তাদের সচেতনতাই এর মূলে ক্রিয়াশীল ছিল। গ্রামাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং ভূস্বামী ও কৃষকদের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সংবিধানে ঈষৎ পরিবর্তন করে ১৮৮৫ খ্রি. এক নতুন প্রজাস্বত্ব আইন প্রণীত হয়। এভাবে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা প্রজাস্বত্ব আইন কেবল অনেকের কল্পিত কোনো উদারপন্থি তত্ত্ব নয়, বরং তার চেয়ে অধিক পরিমাণে কৃষক বিদ্রোহের ফলশ্রুতি ছিল।
পাবনা বিদ্রোহের পটভূমি
অবিভক্ত বাংলার পাবনা বিদ্রোহ প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। বহুবিধ কারণে পাবনা বিদ্রোহের পটভূমি তৈরি হয়। বৃহত্তর পাবনার জমি ছিল খুব উর্বরা। জমিতে ধান ও পাট দুটি ফসল ফলত এবং এ জেলার চাষিরা বেশ ভালো রকম দখলিস্বত্ব জমিতে ভোগ করতো। জমিদাররা খাজনা বৃদ্ধি করায় ১৮৬০ খ্রি. থেকে তুষের আগুনের মতোই গণ্ডগোল ছড়াতে থাকে। ১৮৭৩ খ্রি. পাবনার ইউসুফশাহী পরগনার কৃষকরা একটি রায়তি সমিতি গঠন করে। এ সমিতির উদ্দেশ্য ছিল জমিদারের খাজনা বৃদ্ধির প্রতিরোধ করা। এ সমিতি কৃষকদের কাছ থেকে খাজনার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্যে চাঁদা যোগাড় করে। তারা শিঙ্গা বাজিয়ে লোকজন জড় করে জমিদারদের বেআইনি খাজনা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে। খাজনা প্রদান মাঝে মাঝে বন্ধ করা হয়। পাবনার অধিকাংশ কৃষক ছিল মুসলিম। জমিদাররা ছিল হিন্দু। কিন্তু এ আন্দোলনে কোনো সম্প্রদায়িক প্রভাব ছিল বলে মনে করা যায় না। জমিদাররা খাজনা বাকির জন্যে বহু কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করে। কৃষক সমিতিগুলো মামলা চালাতে থাকে। এ আন্দোলন ছিল প্রধানত আইনের পথে পরিচালিত। সামান্য দু'চারটি ক্ষেত্রে দাঙ্গাহাঙ্গামা ঘটে। এ আন্দোলন পূর্ব বাংলার ময়মনসিংহ, ঢাকা, ত্রিপুরা, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজশাহীতেও ছড়িয়ে পড়ে। পুরো বাংলা অঞ্চলে কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তবে জমিদারদের অহরহ খাজনা বৃদ্ধির ফলেই কৃষকরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এবং পাবনা বিদ্রোহের পটভূমি রচিত হয়, তা নিঃসন্দেহে বলা যায় ৷
প্রকৃতপক্ষে পাবনা বিদ্রোহে কৃষকরা তেমন কোনো বৈপ্লবিক ও চরমপন্থি দাবি করেনি। এ বিদ্রোহকে আইনমাফিক আন্দোলন বলাই অধিকতর সংগত। কারণ কৃষকরা খাজনা বন্ধ ছাড়া অন্য কোনো প্রতিরোধের পথ নেয়নি। তারা জমিদারের আনা মামলা লড়ে যাওয়ার চেষ্টা করে মাত্র। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল নিতান্তই সীমাবদ্ধ ৷ জমিদারের দুর্নীতিপূর্ণ জমি মাপ করার প্রথা, কৃষকদের খাজনা বৃদ্ধি, বেআইনি সেস আদায় প্রভৃতি ছিল তাদের দাবি। এমনকি এ আইনে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা দেখা যায়নি। বরং প্রজাদের দাবি ছিল যে, তারা সরাসরি মহারাণির প্রজা হতে চায় । তারা সরকারকেই খাজনার টাকা দিতে চায় । শ্রীসুমিত সরকার পাবনা কৃষকদের মধ্যে এ রাজনৈতিক চেতনার অভাবের কারণ হিসেবে বলেছেন যে, জমিদারদের প্রত্যক্ষ শোষণের হাত থেকে রক্ষাকর্তা হিসেবে তারা সাগর পারের রাণিকেই বেছে নেয় । এরকম চিন্তাধারা কোনো কোনো কৃষক বিদ্রোহের ক্ষেত্রে দেখা যায়। কিন্তু রম্পা বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুণ্ডা বিদ্রোহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে তীব্র ইংরেজ বিরোধিতা দেখা যায়, এ সকল কৃষক আন্দোলনে তার অনুপস্থিতি বেশ হতাশাজনক। মহাত্মা গান্ধির আগে সাধারণ কৃষকদের একথা বুঝান যায়নি যে, তাদের আসল মুক্তি একমাত্র ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার ফলেই ঘটতে পারে। এদিক থেকে পাবনা বিদ্রোহ নীলবিদ্রোহের তুলনায় সীমাবদ্ধ বিদ্রোহ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। যদিও ইংরেজদের প্রতি পাবনার কৃষকদের মনে সঞ্চরিত ক্ষোভ ও ঘৃণা বিদ্রোহের পটভূমি তৈরি করেছে বলে অনেকে মনে করেন ।
বাস্তবে নীলবিদ্রোহের মতোই পাবনা বিদ্রোহে ছোট জমিদার বা জোতদাররাই প্রাথমিক ও প্রধান নেতৃত্ব দেন। ঈশানচন্দ্র রায় নামে তালুকদার, প্রজারা যাঁকে “বিদ্রোহী রাজা” বলত, শম্ভুনাথ পাল এক গ্রামীণ জোতদার, ক্ষুদিমোল্লা এক মুসলিম জোতদার এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। যদিও পাবনার অধিকাংশ জমিদার ছিল হিন্দু, তাঁদের অন্যতম ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ। প্রজারা প্রায় সকলেই মুসলমান; এ বিদ্রোহে কোনো সাম্প্রদায়িক চরিত্র ছিল না। এ সকল জোতদার বা ধনী কৃষকদের এ খাজনা বন্ধ আন্দোলন চালিয়ে নিজস্ব কোনো ক্ষতির আশঙ্কা ছিল না। সুমিত সরকারের মতে, কৃষক সমর্থন পেয়ে এরা কৃষকদের নেতৃত্ব দেয় এবং পাবনার কৃষক বিদ্রোহ নতুন রূপ পরিগ্রহ করে ।
১৮৭০ খ্রি. মধ্যে খাজনা ঘটিত মামলার সংখ্যা শুধু পাবনা জেলায় ১৩৪৩ থেকে ২০৪৭ দাঁড়ায়। ১৮৭০ খ্রি. পর থেকে জমিদাররা প্রতিকূল হাওয়া দেখে জোতদারদের জমি পত্তনি বা লিজ দিতে থাকে। এর ফলে জোতদাররা লাভবান হয় । কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত সমাজের মধ্যে যাঁদের আয় জমিদারি নির্ভর ছিল তাঁরা এ বিদ্রোহে “গেল, গেল” রব তোলেন। কবিগুরুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গ্রামে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে এগিয়ে আসতে বলেন। জমিদার অধ্যুষিত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ও এ বিদ্রোহকে নিন্দা জানায়। অপরদিকে চাকরি, ওকালতি প্রভৃতির উপর নির্ভরশীল মধ্যবিত্তের প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন যাঁদের হারাবার ভয় ছিল না তাঁরা এ বিদ্ৰোহকে স্বাগত জানান। ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন বেশ কয়েকটি সভা রায়তের সমর্থনে অনুষ্ঠিত করে। কিন্তু বর্গা প্রজা ও কোর্ফ প্রজা যারা স্বত্বহীন ছিল তাদের সমর্থনে ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন কোনো চেষ্টা করেনি বলে প্রতীয়মান হয়। ফলে এসব স্বত্বহীন প্রজারা বিদ্রোহে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
উল্লেখ্য, পাবনা বিদ্রোহে সম্পন্ন জোতদার শ্রেণি তাদের জমির স্বত্ব রক্ষার জন্য ও খাজনা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আইনের লড়াই চালায়। জমিদারদের একচ্ছত্র ক্ষমতা তারা ভেঙে দেয়। প্রজাস্বত্ব আইনে ১২ বছরের রায়তি দখলদার স্থায়ী স্বত্ব পেলে তারাই প্রধানত লাভবান হয় । শহুরে ভদ্রলোক বা মধ্যবিত্তরা তাদেরই প্রতি সমর্থন জানায় । এ শ্রেণির আইনজীবীরা মফঃস্বলের আদালতে জোতদারদের সমর্থনে আইনের লড়াই চালায়। প্রজাস্বত্ব আইন দ্বারা দখলি রায়তের স্বত্ব রক্ষিত হয়, কিন্তু বেদখলি বর্গা, কোর্ফা রায়তের কথা ভাবা হয়নি। রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর লেখনী জোতদার বা সম্পন্ন চাষির স্বার্থেই ব্যবহার করেন বলে প্রতীয়মান হয়। পাবনার ক্ষুব্ধ কৃষক-প্রজারা প্রত্যক্ষভাবে আইন অমান্য করার মাধ্যমে বিদ্রোহের সূচনা করেন।
পাবনা কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা
পাবনা কৃষক বিদ্রোহ ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের বিদ্রোহ (১৮৭২-৭৩ খ্রি.)। ইউসুফশাহী পরগনায় এ বিদ্রোহের সূচনা হয়। পরগনাটি বৃহত্তর পাবনা জেলাধীন বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। জমিদাররা সবসময়ই অবৈধ পন্থায় কৃষকদের কাছ থেকে বলপূর্বক আবওয়াব ও বর্ধিত হারে খাজনা আদায় করতো। খাজনা পরিশোধ না করার অজুহাতে প্রায়ই তারা কৃষকদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতো। কৃষকগণ জমিদারদের এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে ।
সিরাজগঞ্জের ইউসুফশাহী পরগনায় নাটোর জমিদারির অংশ ক্রয়কারী নব্য জমিদারগণ বর্ধিত হারে কর আদায় এবং বিভিন্ন নামে আরোপিত অবৈধ কর আদায়ের জন্য নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকেন। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের Act X-এর বলে তিনটি সুনির্দিষ্ট কারণে জমিদারগণ জমির খাজনা বৃদ্ধি করতে পারতেন। এগুলো হচ্ছে:

(১) যদি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের একই ধরনের জমির খাজনার তুলনায় রায়ত কম খাজনা প্রদান করে, (২) যদি উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পায় এবং (৩) যদি রায়ত তার জমির যথার্থ পরিমাণের চেয়ে কম পরিমাণ জমির খাজনা প্রদান করে। জমিদারগণ এতটাই শক্তিধর ছিলেন যে, তারা এ সকল বিধি পাশ কাটিয়েও জমির খাজনা বৃদ্ধি করতেন।
উরকান্দি গ্রামের ৪৩ জন নেতৃস্থানীয় রায়তের বিরুদ্ধে দমনমূলক মোকদ্দমা দায়েরের ঘটনাই ছিল পাবনা কৃষক বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ প্রেক্ষাপট ও ঘটনা। এ রায়তগণ বর্ধিত হারে দাবিকৃত খাজনা অবৈধ বলে তা প্রদানে অস্বীকৃতি জানান। তারা আদালতে তাদের খাজনা জমা দেন। জমিদারগণ তাদের দাবির স্বপক্ষে কাগজপত্র দাখিল করে অভিযোগ করেন যে, রায়তরা বিগত এক দশক ধরে এ বর্ধিত খাজনা প্রদান করে আসছে। শাহজাদপুর কোর্টের মুন্সেফ ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে জমিদারদের পক্ষে রায় প্রদান করেন। ঐ বছর ডিসেম্বরে রাজশাহীর সিভিল জজ জমিদারদের পেশকৃত কাগজপত্র জাল ও বানোয়াট বিবেচনা করে উল্লিখিত রায় নাকচ করেন। আপিল কোর্টের রায়কে রায়তগণ জমিদারদের বিরুদ্ধে তাদের নৈতিক বিজয় বলে মনে করেন।
অর্থকরী ফসল হিসেবে পাটের উদ্ভব পাবনা বিদ্রোহে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাট অর্থনীতি একটি নতুন গ্রামীণ মধ্যবিত্ত রায়ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটায়। তারা জমিদারদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে পাটের মূল্যে বড় ধস নামার পূর্ব পর্যন্ত পাট থেকে কৃষকরা ভালো আয় করছিল। জমিদাররা কৃষকদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে তাদের উপর আরোপিত খাজনা কমাতে রাজি হননি। পাট বাজারে ধসের ফলে কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় তারা আসন্ন দুর্ভিক্ষাবস্থার মুখোমুখি হয়। এ পরিস্থিতিতে সিরাজগঞ্জের কতিপয় জমিদার খাজনার হার বৃদ্ধি করে এবং তাতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে ‘দি পাবনা রায়ত লীগ' গঠিত হয় এবং দিনে দিনে কার্যক্রম জেলার বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এ লীগের অন্যতম নেতা ছিলেন ঈশানচন্দ্র রায়। সাধারণত তিনি ‘ঈশান রাজা' নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন কুদি মোল্লা ও শম্ভুনাথ পাল। তাঁরা তাদের পরগনাকে জমিদার নিয়ন্ত্রণমুক্ত অঞ্চল বলে ঘোষণা দেন এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা একটি স্থানীয় সরকারই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। তাঁরা জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর মোকাবিলার জন্য একটি বিদ্রোহী বাহিনী গঠন করেন। বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বে বিশ্বস্ত নায়েব নিয়োগ করা হয়। কিছুসংখ্যক লোককে বিদ্রোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া হয় এবং জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাদের মোতায়েন করা হয়। গঠন পর্যায়ে পাবনা আন্দোলন আইন মান্য করে অহিংস পদক্ষেপই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ক্রমে লীগের শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা সহিংস বিদ্রোহের রূপ নেয়। লীগের কার্যক্রমে সাধারণের শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার উপক্রম হলে সরকার জেলায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে। লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জুলাই এক ঘোষণা জারি করেন। এতে সব ধরনের নিবর্তনমূলক কার্যক্রম থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য সরকারি প্রত্যয়ের কথা বলা হয় এবং জমিদারদের পরামর্শ দেওয়া হয় যে, তারা যেন আইনসম্মতভাবে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করেন। পুলিশি কার্যক্রম এবং ১৮৭৩-৭৪ খ্রিষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষের ফলে এ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।
বৃহত্তর পাবনার সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের কৃষক বিদ্ৰোহ
সিরাজগঞ্জ বৃহত্তর পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাবনা কৃষক বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সিরাজগঞ্জ। কৃষি উৎপাদনে সিরাজগঞ্জ ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সচ্ছল কৃষকের বাস ছিল এ অঞ্চলে। কৃষি সমৃদ্ধ এ অঞ্চলের জমিদার-জোতদারদের শোষণ ও নির্যাতন ছিল সীমাহীন। জমিদার শ্রেণির শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের কৃষক-প্রজারা প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ শুরু করে। মূলত একটি অভিনব পন্থায় এ অঞ্চলে জোতদার-কৃষকদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কৃষকেরা রুখে দাঁড়ায়। ক্রমশ নিঃস্ব সহায়-সম্বলহীন হয়ে কৃষকের পথে দাঁড়াতে বা জমিদার শ্রেণির সীমাহীন শোষণ-নিপীড়নের কারণেই সিরাজগঞ্জ কৃষক বিদ্ৰোহ সংঘটিত হয়। জমিদারগণ ক্রমাগতভাবে খাজনা বৃদ্ধি এবং জমি থেকে কৃষককে উৎখাতের কার্যক্রমে এতদঞ্চলের কৃষকেরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সিরাজগঞ্জ কৃষক বিদ্রোহে কৃষিভূমি থেকে কৃষককে উচ্ছেদের আইন রদ করে ‘১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন' বিধিবদ্ধ করতে ইংরেজ শাসকগণ বাধ্য হয়েছিল। জমিদারিপ্রথা প্রবর্তনের পর জমির উপর প্রজার দখলিস্বত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল উক্ত আইনে। বাকল্যান্ড উল্লেখ করেছেন—১৮৭২-৭৩ খ্রিষ্টাব্দে পাবনার কৃষক-বিদ্রোহের ফলেই ব্রিটিশ সরকারকে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের প্রবর্তন করতে হয়েছিল। পাবনার জমিদারগণ প্রজা ও কৃষকদের নিকট থেকে রাজস্ব আদায় ও বাজে জমাদি জোরপূর্বক আদায় করতো। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বপর্যন্ত জমির উপর চাষির কোনো দখলিস্বত্বই ছিল না। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের জমিদারি স্বত্ব আইন এবং ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের জমিদার প্রজা বিষয়ক সপ্তম আইনের বলে জমিদারগণ নিম্ন আদালতের অনুমতি নিয়ে ইচ্ছামাফিক করারোপ করতে এবং কৃষককে কৃষি জমি থেকে উৎখাত করতে পারত। পাবনার কৃষকদের সাথে রাজস্ব আদায় ও বাজে জমাদি আদায় সংক্রান্ত বিষয়ে জমিদারদের বিবাদ চলতে থাকে। সে সময় পাবনার নাটোরের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত জমিদারি মহাল নিলামে ওঠে। এ সকল জমিদারি কলকাতার ঠাকুর পরিবার, ঢাকার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার, সলপের সান্যাল পরিবার ক্রয় করেন। জমিদারি ক্রয় করার পর এসব নব্য জমিদার কৃষকদের উপর করের বোঝা চাপিয়ে দেয়। ছলে-বলে-কৌশলে তারা কৃষক ও প্রজাদের নিকট থেকে বিভিন্নভাবে অর্থ আদায় করতে থাকে ।
জমিদার গোষ্ঠীর সাথে কৃষক-প্রজাদের সম্পর্ক হয়ে দাঁড়াল শুধু অর্থসংগ্রহের। পাবনার জমিদারগণ নিম্নরূপ বাজে আদায় শুরু করে-তহুরী আদায়— বছরশেষে প্রজাদের হিসাবনিকাশের সময় আদায়কৃত অর্থ। জমিদার বাড়ির বিয়ে উপলক্ষ্যে আদায়। পার্বণী আদায়-জমিদার বাড়ির পূজা-পার্বণে খরচের জন্য আদায়। তীর্থ- খরচা-জমিদার পরিবার তীর্থযাত্রায় গেলে কৃষকদের নিকট থেকে অর্থসংগ্রহ করা হতো। পুলিশ খরচা-জমিদার বাড়িতে পুলিশ আসলে সেজন্য ব্যয়িত অর্থ কৃষকদের দিতে হতো। সেলামি-চাষি বসবাস করার জন্য ঘর তৈরি করলে অথবা জমি 'লিজ' নিলে তার নিকট থেকে এ বাবদ অর্থ আদায় করা হতো। এছাড়াও স্কুল খরচা, রসদ খরচা, গ্রাম খরচা, ডাক খরচা, ভিক্ষাবাবদ গ্রহণ আয়কর, তোজ খরচা, খারিজ দাখিল, নজরানা ইত্যাদি প্রকার বাজে আদায় করতো জমিদারেরা। এ প্রকার অর্থ আদায় ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি । এছাড়াও জমিদার বেগার খাটানো ও জরিমানা আদায় করতো।
নতুন পদ্ধতিতে জমি জরিপ : এতদঞ্চলের প্রজারা বা কৃষকেরা পূর্বে সাড়ে তেইশ ইঞ্চি নল দ্বারা মেপে জমি পত্তন নিয়ে ছিল। কিন্তু নতুন জমিদারেরা আঠার ইঞ্চি নল দিয়ে জমি মাপা শুরু করল। এতে অতিরিক্ত জমি প্রজার হাতছাড়া হলো। পক্ষান্তরে জমিদারগণ নতুন প্রজার কাছ থেকে সেলামি নিয়ে উদ্বৃত্ত জমি পত্তন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে থাকে ।
খাজনা বৃদ্ধি ও অবৈধ করের কবুলিয়ত গ্রহণ : নতুন জমিদারগণ প্রজার উপর অস্বাভাবিক হারে কর বৃদ্ধি করেই ক্ষান্ত হননি। তারা প্রজাদের উপর সেচ কর, পথ কর ইত্যাদি প্রকার করারোপ করে এবং কবুলিয়তির মাধ্যমে সেসব কর আদায় বৈধ হিসেবে দেখানো হয়। এ সমস্ত কবুলিয়তির অধিকাংশই কৃষকদের না জানিয়ে তাদের দস্তখত বা টিপসই নেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন স্থানে কৃষকগণ এই অস্বাভাবিক করের এবং বাজে আদায়ের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলায় অনেক কৃষক ডিক্রি লাভ করে। ফলে জমিদার কর্মচারী ও কৃষকদের মাঝে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এমন একটি মামলায় জমিদার পরাজিত হওয়ায় জমিদার কর্মচারিগণ বাদীদের অপহরণ করে লুকিয়ে রাখে । পরে সরকার অপহরণকারীর সন্ধান করে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেছিলেন ।
এ ঘটনা স্থানীয় কৃষকদের উৎসাহ জাগিয়ে তোলে। অন্যান্য জমিদারগণ যাঁরা অনুরূপ কার্যাদি করছিল তাঁদেরকেও শাস্তি দেওয়ার জন্য কৃষকেরা সমবেতভাবে দাবি করতে থাকে। কৃষকদের এই জাগরণের ফলে অত্যাচারী জমিদারগণ কৃষককে নির্যাতন না করার মুচলেকা দিতে বাধ্য হন। অন্যদিকে জমির মাপ সংক্রান্ত মামলায়ও কৃষকগণ জয়লাভ করে। এ অবস্থায় কৃষকদের মাঝে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করার মানসিকতা জাগ্রত হয় । অত্র এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকেরা সমবেতভাবে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করতে থাকে। কয়েকটি গ্রামের কৃষকেরা একতাবদ্ধ হয়ে জমিদারের অতিরিক্ত কর আদায় ও কবুলিয়ত আদায়ে বাধা দিয়ে আসছিল। স্থলচর নামক গ্রামের সকল কৃষক সমবেতভাবে জমিদারের অবৈধ কর আদায়ের চেষ্টা ব্যর্থ করেছিল এবং জমিদারের যে সকল অনুচর তরবারি ও বল্লম নিয়ে বলপূর্বক কর আদায় করতে এসেছিল তরবারি, বল্লম, সড়কি প্রভৃতি তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় এবং তাদের আটক করে। জগতলা গ্রামের কৃষকগণ দীর্ঘদিন জমিদারকে খাজনা না দিয়ে খাজনার টাকা আদালতে জমা দিত। জমিদারের সশস্ত্র বাহিনী একাজে তাদেরকে বাধা দিতে এলে তারা জমিদারের অনুচর বাহিনীকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয় । জমিদারদের অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় ও বাজে আদায়ে সংঘবদ্ধভাবে বাধাদান প্রক্রিয়ায় সমগ্র অঞ্চলের কৃষকেরা অনুপ্রাণিত হয়। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে সর্বত্র জমিদারি খাজনার চৈত্র কিস্তি বন্ধ করে কৃষকগণ লাঠি নিয়ে জমিদারদের পাইক পেয়াদাগণকে বিতাড়িত করতে থাকে। আন্দোলন ক্রমশ সংঘবদ্ধভাবে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরিত হতে থাকে।
বিভিন্ন গ্রামের কৃষকেরা সভাসমিতি ও শোভাযাত্রাসহকারে নিজেদের বিদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করতে থাকে। কৃষকগণ সংঘবদ্ধতার অমোঘশক্তি উপলব্ধি কর। তারা সমগ্র:. এলাকার কৃষককে একতাবদ্ধ করার কাজ শুরু করে। কৃষক সমিতি গঠিত হয় । বিভিন্ন এলাকায় গোপনে প্রচার কাজ চলতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে গোপন সভাসমিতি অনুষ্ঠিত হয়। এতদঞ্চলের কৃষকেরা কৃষক সমিতির সাথে সংহতি প্রকাশ করতে থাকে। জমিদারদের অত্যাচার-উৎপীড়ন ও মাত্রাতিরিক্ত কর আদায়ে কৃষক উত্তেজনায় বিস্ফোরিত হতে থাকে। ১৮৭২-৭৩ খ্রিষ্টাব্দে সর্বসমেত ২৬৯টি গ্রামের অধিবাসিগণ জমিদারদের অত্যাচার ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জ কোর্টে দরখাস্ত করেছিল। কৃষক সমিতি শাখাপ্রশাখা সমগ্র পাবনা শহরে বিস্তার লাভ করেছিল। ঈশানচন্দ্র রায় নামক একজন ভূস্বামী বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন । গঙ্গাচারণ নামক জনৈক কায়স্থ তার সহকারী ছিলেন। তিনি বিদ্রোহীদের দেওয়ান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মহিষের শিঙ্গে বাজিয়ে বিদ্রোহীদের একত্রিত করা হতো। মাছ ধরার অজুহাতে সকল বিদ্রোহীর কাঁধে একটি লাঠির আগায় একখানি পলো ঝুলিয়ে তারা সংগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতো। এ সম্পর্কে একটি ছড়া পাওয়া যায়-
লাঠি হাতে পলো কাঁধে চল্ল সারি সারি
সকলের আদা যায়ে লুটলো বিশির কাছারি ।
বিদ্রোহীরা স্থানীয় জমিদার, ভূস্বামীদের গৃহ-সম্পত্তির উপর আক্রমণ শুরু করল । তারা এগুলোতে অগ্নিসংযোগ করতে লাগল। বিদ্রোহীদের আক্রমণে ভীতসন্ত্রস্ত জমিদার ভূস্বামী-ধনী পরিবারগণ পালিয়ে পাবনা শহরে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। প্রথমে সাহাজাদপুর থানার সমস্ত গ্রামেই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া প্রভৃতি অঞ্চলেও বিদ্রোহ-আক্রমণ বিস্তার লাভ করে।
ছড়ায় ও গানে সিরাজগঞ্জ বিদ্রোহ : সিরাজগঞ্জ বিদ্রোহের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন ঈশানচন্দ্র রায়। তাঁকে উদ্দেশ্য করে তৎকালীন সময়ে এলাকার গ্রাম্য কবি যে ছড়া ও গান লিখেছেন তার উদ্ধৃতি-
“দৌলতপুরের কালী রায়ের বেটা
ঈশান রায় বাবু ॥
ছোট বড় জমিদার রেখেছেন কাবু । তার নামের জোরে গগণ ফাটে,
আষ্ট (রাষ্ট্র) আছে জগৎময় ॥”
পাবনার বিদ্রোহী কৃষকের নেতা ঈশানচন্দ্র রায়ের সহকারী ছিলেন রুদ্রগীতি গ্রামের গঙ্গাচরণ পাল । নিম্নেবর্ণিত কবিতায় গঙ্গাচরণ পালের কথা জানা যায়—
‘ও চাচা বিদ্রোহী দলের কথা কব কি,
নূতন আইন নূতন দেওয়ান, কালু পালের বেটা
সকলের আগে চলে মাথায় বাঁধা ফ্যাট।'
(গঙ্গাচরণ পালের পিতা কালী চরণ পাল পাবনার মোক্তার ছিলেন) বিদ্রোহের সময় সমাজের অবস্থার বর্ণনা পাওয়া যায় সে এলাকার জমিদার পক্ষের রচিত গানে-
‘কি বিদ্রোহী পরিত্রাহী বাপরে বাপ মলেম্‌ মলেম্‌ কি তামাসা সকল চাষা ভেবেছিল রাজা হলেম্ ॥ হাতে পলো, কাঁধে লাঠি লোটে যত ঘটিবাটি। মাংনা খাবো রাজার মাটি ভয়ে ভীরু অবাক হলেম্ ।
দেশের যত বামন ভদ্র তারা কি আর আছে ভদ্র ।
বিদ্রোহীর দল দেখা মাত্র নজর আর রাজায় সেলাম ॥'
সিরাজগঞ্জ বিদ্রোহে অত্র এলাকার জমিদারদের দোর্দণ্ড প্রতাপ, উৎপীড়নের যে দুর্দশা হয়েছিল তার চিত্র নিচের গানটিতে পাওয়া যায়-
‘গোপাল নগরের মজুমদাররা তারা কেদে ম'ল । ডেমরা থেকে রাজু সরকার বাড়ী লুটে নিল ॥ কালী কাঁদে মহেশ কাঁদে, কাঁদে তার খুড়ি। গোলামের বেটা বিদ্রুক আসে, লুটল সকল বাড়ি ॥ বিদ্রুক আসে লুটে নিল গাছে নাইক পাতা ।
জঙ্গলের মধ্যে লুকায়ে থাকে ফুচকি মারে মাথা
(রাজু সরকার : জমিদার বাড়ি লুটের নেতা, কালী ও মহেশ: মজুদার জমিদার মালিক, বিদ্রুক: জনৈক চাষি )
শেষ পর্যন্ত সরকার জমিদার-ভূস্বামী ও তাদের অনুচর বাহিনীকে রক্ষার জন্য সিপাহি ও পুলিশ বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসে এবং বিদ্রোহীদের উপর আক্রমণ শুরু করে। রাজশাহী, পাবনা, গোয়ালন্দ প্রভৃতি স্থান হতে বিপুল পুলিশ বাহিনী বিদ্রোহের নায়কদের গ্রেফতার করে পাবনা সদরে পাঠিয়ে দেয়। বিদ্রোহের নায়ক ঈশান রায়সহ ৩১২ জন কৃষক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে ঈশান রায় মুক্তিলাভ করে। ১৪৭ জনকে এক মাস থেকে দুই বছর কাল পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় সরকার এতদঞ্চলের জমিদার ও প্রজাদের উদ্দেশ্যে একটি ঘোষণা জারি করে-
‘পাবনা জেলার জমিদারগণ খাজনা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রকারের কর আদায় করবার এবং প্রজাগণ সংঘবদ্ধভাবে সে কাজে বাধা দেওয়ার কারণেই দাঙ্গাহাঙ্গামার সৃষ্টি হইয়াছে। উভয় পক্ষকেই সতর্ক করা যাইতেছে যে, কেউ বেআইনি কাজ করিতে পারিবে না। প্রজারা বহু সংখ্যায় একত্রিত হইয়া দাঙ্গাহাঙ্গামা না করিয়া শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের নিকট নালিশ করিলে সরকার সে বিষয়ে সুবিচার করিবে। সরকার বিদ্রোহীদের হাঙ্গামার দিকে নজর দিবে না। প্রজারা মহারাণির প্রজা হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করছে। কিন্তু সরকার জমিদারদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করিতে পারে না। জমিদারদের ন্যায্য পাওনা পাওয়া উচিত। আবার জমিদারদের খাজনা আদায়ে বাধা দেওয়ার জন্য প্রজাদের উপর শাস্তি প্রয়োগও ন্যায়সংগত। তবে এই বাধাদান অবশ্যই শান্তি ভঙ্গ না করিয়া আইনসম্মতভাবে করিতে হইবে।'
এভাবে সিরাজগঞ্জ কৃষক বিদ্রোহ স্তিমিত হয়। সিরাজগঞ্জের কৃষকেরা তাদের জমির কবুলতি ব্যবস্থা, অতিরিক্ত কর আদায় ব্যবস্থা রহিত করে। শাসকগোষ্ঠী কৃষকদের বিক্ষোভের কারণ দূর করার উপায় হিসেবে জমির উপর তাদের দখলিস্বত্ব স্বীকারের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে। অবশেষে এ বিদ্রোহের পরিণতিস্বরূপ ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গদেশে জমিদারি প্রথার অন্তর্ভুক্ত সকল কৃষককে জমির উপর দখলিস্বত্ব দান করা হয়। এতে পাবনা তথা সিরাজগঞ্জ কৃষক বিদ্রোহের অবসান ঘটে।
পাবনার কৃষক বিদ্রোহ ও বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন
পাবনার কৃষক বিদ্রোহের ফলেই ব্রিটিশ সরকারকে ১৮৮৫ খ্রি. বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করতে হয়েছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫ ভূমি নিয়ন্ত্রণে প্রজা ও জমিদারদের পারস্পরিক দায় ও অধিকার সংক্রান্ত কানুন। আইনটি প্রণীত হয়েছিল একটি বিশেষ প্রেক্ষপটে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর থেকে জমিদার-প্রজা সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। পরিশেষে উভয় শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব এমন চরমে ওঠে যে, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন হয়। জমিদারদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্ৰজা-অসন্তোষ প্রশমনের উদ্দেশ্যে সরকার প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়নের আবশ্যকতা অনুভব করে। স্মর্তব্য যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা জমিদারকে ভূমির একমাত্র মালিক বলে ঘোষণা করলেও রায়তের অধিকার সম্পর্কে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রেগুলেশন ছিল নিরুত্তর। তবে ভূমিতে যে প্রজার প্রথাগত অধিকার বিদ্যমান এ সম্পর্কে রেগুলেশনে অস্পষ্ট আভাস ছিল। উনিশ শতকের প্রথমদিকে কৃষকের চেয়ে ভূমি বেশি থাকায় প্রজার উপর জমিদারদের উৎপীড়ন তেমন লক্ষ করা যায়নি। কিন্তু উনিশ শতকের শেষপর্বে এসে জনসংখ্যাবৃদ্ধির ফলে ভূমির উপর পৌনঃপুনিক চাপ বৃদ্ধি পায় এবং এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় জমিদার-রায়ত সম্পর্কের উপর। ভূম্যধিকারী শ্রেণির মধ্যে ভূমির চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগে খাজনার হার বৃদ্ধি করার প্রবণতা দেখা দেয়। কিন্তু রায়তশ্রেণি জমিদারদের এহেন প্রবণতাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে এ যুক্তিতে যে, ভূমিতে তাদের প্রথাভিত্তিক অধিকার রয়েছে এবং তা ক্ষুণ্ণ করার অধিকার জমিদারের নেই। তারা দাবি করে যে, প্রত্যেক মহালের পরগনা নিরিখ বা খাজনার হার প্রথাগতভাবে নির্ধারিত রয়েছে। তাদের মতে, পরগনা নিরিখ মোতাবেক সে নির্ধারিত হার সম্পূর্ণ আইনানুগ ও বৈধ। তারা দাবি করে যে, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ঐ পরগনা নিরিখ উপেক্ষা করে খাজনা বৃদ্ধি করার অধিকার জমিদার বা সরকারের নেই। কিন্তু জমিদার শ্রেণি এ যুক্তি বরাবর অগ্রাহ্য করে পাল্টা যুক্তি দেয়ে যে, জমির একচ্ছত্র মালিক হিসেবে জমিদার ইচ্ছামতো খাজনা বৃদ্ধির অধিকার রাখে। তাদের মতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রেগুলেশন অনুসারে রায়ত হলো জমিদারের ইচ্ছাধীন প্রজা (Tenant-at-will) অর্থাৎ ভূমির মালিক হিসেবে জমিদার ইচ্ছামতো খাজনার হার পরিবর্তন করতে পারে, এমনকি রায়তকে উচ্ছেদও করতে পারে ।
জমিদার-প্রজা সম্পর্ক অবনতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে মধ্যস্বত্ব সমস্যা। সূর্যাস্ত আইনের চাপে পড়ে খাজনা সংগ্রহে সুবিধার্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রেগুলেশন লঙ্ঘন করে জমিদাররা ভূমিতে মধ্যস্বত্ব সৃষ্টি করতে থাকে উনিশ শতকের প্রথম থেকেই। এ প্রবণতার ফলে জমিদার ও প্রজার মধ্যখানে উদ্ভূত হয় উৎপাদনে ভূমিকাহীন মধ্যস্বত্বাধিকারী নামে একটি পরজীবী শ্রেণি। জমিদার ও মধ্যস্বত্বাধিকারীর আয় অটুট রাখা বা বৃদ্ধি করার জন্য খাজনা বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। ভুক্তভোগী রায়ত আইনের আশ্রয় নিলে আদালত মধ্যস্বত্বাধিকারীর অধিকার সম্পর্কে কোনো চূড়ান্ত রুলিং না দিয়ে কখনও এ সমস্যাকে বৈধ, কখনও বা অবৈধ বলে রায় প্রদান করে । ফলে রায়ত ও জমিদার শ্রেণি, তথা রায়ত ও ঊর্ধ্বতন সকল ভূস্বার্থ শ্রেণির মধ্যে বিরোধ বাড়তেই থাকে। এ বিরোধকে তীব্রতর করে আরেকটি নবোত্থিত ভূমিভিত্তিক শ্রেণি। ব্রিটিশ শাসনাধীনে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ও কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে গ্রামীণ সমাজে ধনী কৃষকের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু ভূমিতে এদের অধিকার ছিল অন্যান্য প্রজার মতোই ন্যূন যা তারা মেনে নিতে পারেনি। তাদের সচ্ছলতা ও সামাজিক প্রতিপত্তি এমন বৃদ্ধি পায় যে, তারা অধিকার আদায়ের জন্য সাধারণ প্রজাদের নেতৃত্ব দিতে থাকে। এসব ধনী কৃষককে শান্ত করার উদ্দেশ্যে শাসকশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করে প্রণীত হয়েছিল ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের খাজনা আইন, এ আইনে ভূমিতে ধনী কৃষকদের কিছু অধিকার স্বীকৃত হয়। কিন্তু এতে কৃষক অসন্তোষ প্রশমিত হয়নি ।
উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন ক্রমশ দানা বেঁধে উঠলে সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ১৮৭০-এর দশকে সারা বাংলায়, বিশেষ করে পাট উৎপাদনকারী জেলাসমূহে কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন এমন চরমে ওঠে যে, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে জেলায় জেলায় জমিদারবিরোধী প্রজাজোট গঠন করে রায়তশ্রেণি আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটায়। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সরকার ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে একটি খাজনা কমিশন গঠন করে। খাজনা কমিশনের সুপারিশের আলোকে বঙ্গীয় আইন পরিষদ ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে অষ্টম আইন প্রণয়ন করে যা, সাধারণভাবে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন নামে পরিচিত। প্রজাদের দাবিদাওয়া অনেকাংশে মেনে নিয়ে আইনটি বিভিন্ন শ্রেণির প্রজা ও মধ্যস্বত্বাধিকারীর অধিকার ও দায়দায়িত্ব সংজ্ঞায়িত করে। প্রথাগত অধিকারও এ আইনে স্বীকৃত হয় যা কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনের এক বড় অর্জন। তবে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে নিম্নশ্রেণির রায়তের অধিকার সংজ্ঞায়িত হয়নি। কোর্ফা, বর্গা, চাকরান, নানকার, কর্ষা প্রভৃতি নিম্নশ্রেণির কৃষক জমিদারের ইচ্ছাধীন প্রজারূপে চিহ্নিত হলো এবং বাকি সব প্রজা স্থায়ী ভূস্বার্থ শ্রেণি হিসেবে স্বীকৃত হলো । বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন পর্যায়ক্রমে ভূমি জরিপের জন্য একটি ম্যানুয়েলও তৈরি করে। এ জরিপের উদ্দেশ্য, জমিদার থেকে নিম্নতম প্রজা পর্যন্ত সকল শ্রেণির অধিকার, দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করে একটি Record of Right বা চকভিত্তিক স্বত্বখতিয়ান দলিল তৈরি করা ।

বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব (সংশোধনী) আইন, ১৯২৮ নিমস্বত্ব রায়তদের দাবির প্রেক্ষাপটে বঙ্গীয় আইন পরিষদ কর্তৃক গৃহীত। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে স্থায়ী রায়তদের অধিকারসমূহ স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হলেও নিম্নস্বত্ব রায়তদের অধিকার (তাদের দখলে থাকা ভূমির উপর) সংজ্ঞায়িত হয়নি বা অস্পষ্টভাবে হয়েছিল। বিভিন্ন শ্রেণির নিমস্বত্ব রায়তগণ (বর্গাদার, কর্ষাদার, কোর্ফা এবং ধানকরারি রায়তগণ) নিয়মিত বন্দোবস্তে আবাদ করতো না, করতো অস্থায়ীভাবে প্রতিযোগিতামূলক ভিত্তিতে। ভূমির প্রাচুর্যের কারণে তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী ভোগদখলকারী রায়তদের চেয়েও অল্প খাজনায় আবাদ করতে পারত। এ জাতীয় প্রতিযোগিতামূলক রায়তগণ সাধারণত নিমস্বত্ব রায়ত নামে পরিচিত হয় এবং মানুষ ও ভূমির অনুপাত মানুষের পক্ষে থাকা পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে তাদের অবস্থান খুব একটা খারাপ ছিল না। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে ভূমির উপর উল্লেখযোগ্যহারে চাপে বেড়ে যায় ৷ ভূমির অভাব এবং এর উপর বিস্ময়করভাবে রাজস্ব বৃদ্ধির কারণে নিমস্বত্ব রায়তদের নিম্নমুখী অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছিল ।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নির্বাচনি রাজনীতি প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এবং বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রসারের ফলে এ দেশের অধস্তন রায়তদের আইনগত অবস্থান সম্পর্কে জনমত ক্রমেই সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, বাংলার রায়তশ্রেণির অধিকাংশই ছিল ভূমিতে অধিকারবিহীন। যেসব রায়ত ভূমিতে এক নাগাড়ে কয়েক বছর দখলদার ছিল, তাদেরকে ঐ বিলে ভূমিতে অধিকার প্রদানের প্রস্তাব করা হয়। অধিকন্তু এই বিলে বর্গাদারকেও ভূমিতে অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব করা হয় ।
আইনসভায় ভূম্যধিকারী গোষ্ঠী প্রস্তাবটির চরম বিরোধিতা করে, কিন্তু তা মুসলমান সদস্যগণসহ কৃষকদরদি দলগুলোর দ্বারা সমর্থিত হয় । কয়েকটি সংশোধনীসহ প্রস্তাবটি আইন পরিষদে পাস হয়। বস্তুত এ সংশোধনীগুলোর ফলে আইনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। এ আইনের অধীনে একজন নিমস্বত্ব রায়ত কোনো নির্দিষ্ট জমি ক্রমাগত বারো বছর ভোগদখল করে থাকলে প্রতিযোগিতামূলক হারে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের ভিত্তিতে সেই জমির ওপর অধিকার লাভ করে। এই রায়তদের রাজস্ব বৃদ্ধি করার এবং রাজস্ব না দেওয়ার জন্য তাদের উৎখাত করার অধিকার জমিদারদের হাতে সংরক্ষিত থাকে। এর ফলে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব (সংশোধনী) আইন, ১৯২৮ নিমস্বত্ব রায়তদের বাস্তব সুবিধা প্রদান ছাড়াই কাগজ পত্রে একটি রাজনৈতিক দলিল হিসেবেই থেকে যায়। এ.কে ফজলুল হক এর মন্ত্রিসভা ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব (সংশোধনী) আইন পাস করে আইনটির দুর্বলতা দূর করার চেষ্টা করে ৷
পাবনা কৃষক বিদ্রোহের সার্বিক বিশ্লেষণ
অবিভক্ত বাংলার কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে পাবনার কৃষক বিদ্ৰোহ স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এটি ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের বিদ্রোহ। বৃহত্তর পাবনা জেলার ইউসুফশাহী পরগনায় এ বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। পরগনাটি বৃহত্তর পাবনা জেলাধীন বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। জমিদাররা সবসময়ই এই অঞ্চলের কৃষকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক আবওয়াব ও বর্ধিত হারে খাজনা আদায় করতো। সঠিক সময়ে খাজনা পরিশোধ না করলে কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতো এবং অত্যাচার ও নির্যাতনের স্টিম রোলা চালাত। পাবনার কৃষকরা জমিদারদের এরূপ অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে ।
বাংলায় নীলবিদ্রোহের পর প্রায় দুই দশক ধরে অব্যাহত শান্তি বিরাজ করে । কৃষক সমাজ তাদের নিজস্ব ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সুখে বাস করছিল বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু ১৮৭০ এবং ১৮৮০ এর দশকে পাবনার কৃষক প্রজারা পুনরায় প্রতিরোধমুখী হয়ে ওঠে। কিন্তু রায়তগণ পরগনা নিরিখে খাজনা প্রদানে তাদের রীতিসিদ্ধ অধিকারের উপর জোর দেয়। এতে বৃহত্তর পাবনার ইউসুফশাহী পরগনায় (সিরাজগঞ্জ)-এর কৃষকরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এ প্রতিবাদের ঢেউ বাংলার অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে পাবনা বিদ্রোহে কৃষকরা কোনো বৈপ্লবিক ও চরমপন্থি দাবি করেনি ।
জমিদারদের খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে ইউসুফশাহী পরগনায় কৃষকরা একটি রায়তি সমিতি গঠন করে। এ সমিতির উদ্দেশ্য ছিল জমিদারদের খাজনা বৃদ্ধির প্রতিরোধ করা। খাজনার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য এ সমিতি কৃষকদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে। তারা শিঙ্গা বাজিয়ে জমিদারদের বেআইনী খাজনার বিরুদ্ধে কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে। কৃষকরা বর্ধিত হারে খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেয়। হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে মুসলিম প্রজাদের এ বিদ্রোহ সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করেনি বলে প্রতীয়মান হয় ।
ইউসুফশাহী পরগনা তথা পাবনা কৃষক বিদ্রোহের নায়েক ছিলেন ঈশানচন্দ্র রায় । প্রজারা যাকে “বিদ্রোহী রাজা' বলে ডাকত। কৃষকদের ব্যাপক সমর্থন পেয়ে ঈশান বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন বলে সুমিত সরকার মত পোষাণ করেন ৷
পাবনার কৃষক বিদ্রোহ দমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্ৰহণ করে। ১৮৭৩ খ্রি. ৪ জুলাই এক ঘোষণা জারি করে। এতে সব ধরনের নিবর্তনমূলক কার্যক্রম থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য সরকারি প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয় এবং জমিদারদের পরামার্শ দেওয়া হয় যে, তারা যেন আইনসম্মতভাবে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং ভূস্বামী ও কৃষকদের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সংবিধানে ঈষৎ পরিবর্তন করে ১৮৮৫ এক নতুন প্রজাস্বত্ব আইন প্রণীত হয়। এছাড়া পুলিশি কার্যক্রম এবং ১৮৭৩-৭৪ খ্রি. দুর্ভিক্ষের ফলে পাবনার প্রতিরোধ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]