তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬ খ্রি. পঠভূমি তেভাগা আন্দোলনের গুরুত্ব

তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬ খ্রি.) Tebhaga Movement (1946)
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে। উত্তরবঙ্গের স্থানীয় কৃষকদের প্রজন্মব্যাপী বঞ্চনার আক্রোশ বিদ্রোহ ও আন্দোলনে পরিণতি লাভ করে। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি তখন গণবিপ্লব আন্দোলনের তরঙ্গশীর্ষে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই রাজনৈতিক দল কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত সংগ্রামী মানুষ কমিউনিস্ট পার্টির পাতাকার তলায় সমবেত হন। ফলে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রেরণায় এই আন্দোলন দুর্বার গতি লাভ করে ও অন্য মাত্রা পেয়ে যায়। সময় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্তিম অধ্যায়, ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার পূর্বাহ্নে। তেভাগা আন্দোলনের বীজ পোঁতা হয়েছিল অধিয়ার আন্দোলনে। উত্তরবঙ্গের ভাগচাষি ‘আধিয়ার'রা নির্মম অভিজ্ঞতায় জানত, জোতদারের কব্জায় একবার ধান চলে গেলে তার কপালে আধি বা অর্ধেক তো জুটবেই না, বরং নানা অজুহাতে, নানা পাওনার নাম করে সেই আধি থেকে মোটা অংশ কেটে নেবে জোতদার। তাই আওয়াজ উঠল, আর জোতদারের গোলায় বা’খোলানে' ধান নয়, ‘নিজ খোলানে ধান তোলো।' যেসব এলাকায় খোলানে ধান তোলা হয়ে গেল সেখানে ঠিক হলো, জোতদারকে আইনসংগত নোটিশ দিয়ে ধান ভাগ করা হবে। যথারীতি, জোতদাররা নোটিশ অস্বীকার করে। ভাগচাষিরা তখন গায়ের দশজনকে সাক্ষী রেখে মোটা ধান তিন ভাগে ভাগ কর। তার নিজের দুভাগ, জোতদারের একভাগ। এই তেভাগা আন্দোলন কায়েমের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তরবঙ্গের সুবিস্তীর্ণ অঞ্চলে ।
তেভাগা আন্দোলন
তেভাগা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল প্রধানত বাংলা অঞ্চলে । এর স্থায়িত্ব ছিল '৪০- এর দশকের শুরু হতে মাঝামাঝি পর্যন্ত। এই আন্দোলন আপাতভাবে বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদার কিংবা জোতদারদের বিপক্ষে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে এই আন্দোলনের লড়াইকারী শক্তির বিপক্ষ ছিল ইংরেজ শাসনব্যবস্থা তথা রাষ্ট্র। বিভিন্ন অঞ্চলে তখন জমিদার শব্দটির পাশাপাশি জোতদার শব্দটি ব্যবহৃত হতো। বিশেষভাবে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে জমির খণ্ডকে জোত বলা হয়ে থাকে। জোতদার কথাটার তাই মানে দাঁড়ায় যার অনেক পরিমাণে জমি আছে। অন্য ভাষায় জমিদার। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ইতোমধ্যেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদাররা বংশপরম্পরায় জমির মালিক হয়ে গেছে। ফলে কৃষকদের জীবনের উপর আগের সময়ের তুলনায় আরও অনেক বেশি অত্যাচার নেমে এসেছিল। এই পরিস্থিতিতে কৃষকদের প্রতিবাদের মূল বিষয় ছিল ফসলের হিস্যা। এখানে আর একটি পরিবর্তনের কথা বলা প্রয়োজন । জমির মালিকানার বদলের পাশাপাশি লাভজনক শস্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এই সকল ঘটনার মধ্য দিয়ে সাধারণ কৃষকদের হাতে জমি ছিল খুব সামান্যই। ফলে বর্গাচাষ পদ্ধতির প্রচলন ঘটে। বর্গাচাষ পদ্ধতির সাথে তেভাগা আন্দোলনের যোগাযোগ খুবই নিবিড়। তাই তেভাগা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বর্গাচাষ ব্যবস্থা নিয়ে ধারণা থাকা দরকার ।
এটা খুবই পরিষ্কার যে মালিকানার নিশ্চিত ব্যবস্থা না হলে বর্গাচাষ ব্যবস্থা পোক্ত হতো না। অর্থাৎ কাগজে কলমে জমির মালিক দেখা দিল বলেই সেই মালিকের কাছ থেকে জমি বর্গা নেবার পরিস্থিতি তৈরি হ'ল। বর্গাব্যবস্থা হচ্ছে কোনো জমির মালিকের কাছ থেকে চুক্তিতে জমি নিয়ে সেই জমিতে চাষবাস করা। এখানে চুক্তির প্রধান ব্যাপার হলো ফসলের হিসাব করা। তেভাগা আন্দোলনের আগে উৎপাদিত ফসলের বড় অংশই জমির মালিক নিয়ে নিতেন। সেটার পরিমাণ ছিল মোটামুটি তিন ভাগের দুই ভাগ। এই রকম পরিমাণে ফসল দিয়ে দিতে হতো বলে চাষির অবস্থা দিন দিন নাজুক হতে থাকল। শরীরের পরিশ্রম, হালের বলদ খাটিয়ে চাষি পেতেন সামান্য পরিমাণ ফসল। আর কোনো পরিশ্রম না করেই জমির মালিক বা জোতদার পেতে থাকলেন সিংহভাগ ফসল। বর্গাচাষিদের সকলেরই পূর্বসূরীরা ছিলেন রায়ত কৃষক। আগে খাজনা দিতে হতো। নতুন ব্যবস্থায় সেটা জমির দাম বা ভাড়া হিসাবে দেওয়া লাগল। আর তাতে পরিমাণটাও আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেল। অনেক ক্ষেত্রে বর্গার উপচুক্তিও হতো। অর্থাৎ এক পরিবার বর্গা নিয়ে আরও দরিদ্র পরিবারকে সেই কাজ দিচ্ছে এবং লাভের ফসল রেখে দিচ্ছে। এই মধ্যস্বত্বভোগী কৃষক শ্রেণির কারণে চাষি কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গেল। এর মধ্যে দুর্যোগ, অনাবৃষ্টি, ফসল না হওয়ার মত প্রাকৃতিক আক্রমণ তো আছেই। এটা ঠিক যে বর্গাচাষিদের মধ্য থেকে অনেক পরিবার পরবর্তীকালে শহুরে লেখাপড়া করা সুবিধা পাওয়া শ্রেণিতে এসেছে। কিন্তু সেটা সাধারণ কোনো অবস্থা নয়। সাধারণ কৃষকদের জীবন মৃত্যুতুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে কৃষকদের মধ্যে এই জীবন বদলাবার দুর্দান্ত আগ্রহ তৈরি হয়েছিল ।
এক সময়ে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকরা বিদ্রোহ করতে শুরু করেন। খাতা কলমে প্রধান দাবি ছিল ফসলের তিন হিস্যার দুইটা দিতে হবে চাষিকে, যিনি শারীরিক পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করে থাকেন। কিন্তু এই সংগ্রাম ছিল আসলে জমির মালিক বড়লোক শ্রেণির এবং রাষ্ট্রের নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ।
কৃষকদের এই দাবি আদায়ের জন্য তাঁরা সংঘবদ্ধভাবে সভাসমিতি এবং বিক্ষোভ করতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে এই কর্মসূচি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। অবশ্য উত্তর বাংলাতে আন্দোলনটি বেগবান ছিল বলে “লিখিত ইতিহাসে এই অঞ্চলের কথাই বেশি জানা যায়। এই পদক্ষেপ নেওয়ার সাথে সাথেই জমির মালিকরা একদিকে পুলিশ এবং অন্যদিকে ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল দিয়ে কৃষকদের উপর অত্যাচার শুরু করে দিল। অত্যাচার বলতে মারধর, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, খুন, গুম এবং ধর্ষণ। পুলিশ মারধর করা ছাড়াও গ্রেফতার করে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন চালাতো কৃষকদের উপর। জমির মালিকরা আরেকটা কাজ শুরু করেছিল। লাঠিয়াল গুণ্ডা দিয়ে কৃষকদের উৎপাদিত ফসল জমি থেকে কেটে নিয়ে আত্মসাৎ করত তারা। এর জবাবে কৃষকরাও দল বেঁধে উৎপাদিত শস্য তুলে নিয়ে আসতেন নিজেদের ভাণ্ডারে। ‘লাঙ্গল যার জমি তার' ইত্যাদি স্লোগান জনপ্রিয় হয় তখন থেকেই। কৃষকদের উপর পুলিশী এবং গুণ্ডা বাহিনীর আক্রমণ এতটাই তীব্র হয়েছিল যে বহু কৃষকের তখন দিনরাত পালিয়ে থাকবার দরকার পড়ত। বিশেষভাবে যাঁরা সংগঠক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কৃষকরা তখন নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পুলিশ ও জমির মালিকদের উপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে দেয়। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশের বিরুদ্ধে কৃষকদের সাহসী লড়াইয়ের গল্প এখনও ছড়িয়ে আছে। এর সব যদিও সংরক্ষণ করা হয়নি। একদিকে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে পুলিশ, অন্যদিকে কৃষকদের জীবনযাপনের দাবি ছাড়া আধুনিক অস্ত্র বলতে কিছু নেই। কৃষক শ্রেণির মানুষজন তখন নিজেদের ঢাল, সড়কি, বল্লম নিয়েই একাধিক যুদ্ধে পুলিশকে পরাস্ত করেছে। তেভাগা আন্দোলনের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে নারীদের বা কিষানিদের শক্তিশালী অংশগ্রহণ ছিল। বহু অঞ্চলে পুরুষদের বেশির ভাগ পালিয়ে ছিলেন এবং পুলিশের সঙ্গে মূল লড়াই হয়েছে নারীদের। আর বাংলাভাষী ছাড়া অন্য জাতির মানুষ এই আন্দোলনের বড় নির্মাতা ছিলেন: সাঁওতাল, হাজং, বা খাসিয়া। এই কৃষক আন্দোলন দেখে একদিকে যেমন ব্রিটিশ শাসকরা ভীত হয়েছিল, অন্যদিকে ভীত হয়েছিল বাংলার জমি মালিক শ্রেণি এবং উঠতি শহুরে শ্রেণি। কারণ কৃষকদের এই সংগ্রাম তাদের স্বার্থের বিপক্ষে ছিল পরিষ্কারভাবে। তবে জমির মালিক শ্রেণি এবং উঠতি শহুরে শ্রেণির অনেক সদস্যই কৃষকদের এই ন্যায্য দাবির স্বপক্ষে ছিলেন। শহরের রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তাঁরা কৃষকদের দাবি দাওয়াকে সমর্থন দিতেন কেউ কেউ। এ ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার কাজ করতেন তাঁরা। এখানে প্রথমেই আসে সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কথা। এই দলের বাইরেও অনেক সমাজতন্ত্রী কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনকে সহায়তা করে গেছেন।

তেভাগা আন্দোলনের কারণেই ইলা মিত্রের মত নেত্রীর নাম উচ্চারিত হয়। কিন্তু নাম না জানা বহু কৃষান-কিষানি পুলিশের বা লাঠিয়ালদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। আর অন্য অনেকে কঠিন নির্যাতনের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন যাঁদের নাম আমাদের জানার কোনো সুযোগ হয়নি ।
লিখিত ইতিহাসে এই আন্দোলনের নাম তেভাগা আন্দোলন। যদিও বিভিন্ন অঞ্চলে এর নাম বিভিন্ন ছিল। যেমন এই আন্দোলন ছড়িয়েছিল বহু অঞ্চলে তেমনি এর ধরন, দাবি দাওয়া এবং নাম হয়েছিল বিবিধ। কোথাও সাঁওতাল বিদ্রোহ, কোথাও হাজং বিদ্রোহ, কোথাও বা টঙ্কা বিদ্রোহ। খাতা কলমে তেভাগা লড়াইয়ে কৃষকরা জিতেছেন । বাংলা অঞ্চলে ফসলের ভাগের একটা বন্দোবস্ত হয় ৷
তেভাগা আন্দোলন আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশের দাবি নিয়ে সংগঠিত বর্গাচাষিদের আন্দোলন। তেভাগা শব্দের আভিধানিক অর্থ ফসলের তিন অংশ। প্রচলিত অর্থে ভাগচাষি তাদের ভাগচাষের অধিকারস্বরূপ উৎপাদনের সমান অংশ বা দুই ভাগের এক ভাগ পাওয়ার অধিকারী। ভূমি নিয়ন্ত্রণের শর্তাদি অনুযায়ী শস্য ভাগাভাগির বিভিন্ন পদ্ধতি বর্গা, আধি, ভাগী ইত্যাদি নামে পরিচিত। ১৯৪৬-৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিমালিক এবং ভাগচাষিদের মধ্যে উৎপাদিত শস্য সমান দুই ভাগ করার পদ্ধতির বিরুদ্ধে বর্গাদাররা প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে আমন ধান উৎপাদনের সময়কালে বাংলার উত্তর এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের জেলাসমূহের কিছুসংখ্যক ভাগচাষি এবং তাদের সমর্থক নিজেদের খলানে তা ভানতে নিয়ে যায়। দুটি কারণে এটি বিদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত। প্রথমত, তারা দাবি করে যে, অর্ধেক ভাগাভাগির পদ্ধতি অন্যায়। উৎপাদনে যাবতীয় শ্রম এবং অন্যান্য বিনিয়োগ করে বর্গাচাষি; উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পুঁজি বিনিয়োগ, শ্রম এবং অবকাঠামোতে ভূমি মালিকের অংশগ্রহণ থাকে অতি নগণ্য। এ কারণে, মালিকরা পাবেন ফসলের অর্ধেক নয়, মাত্র এক তৃতীয়াংশ। দ্বিতীয়ত, বর্গাচাষিরা দাবি করেন যে উৎপাদিত শস্যের সংগ্রহ মালিকদের খলানে রাখা এবং সেখান থেকে সমান সমান খড় ভাগাভাগি করার নিয়ম আর মান্য করা হবে না, সংগৃহীত ফসল থাকবে বর্গচাষিদের বাড়িতে এবং ভূমিমালিক খড়ের কোনো ভাগ পাবেন না ।
মূলত তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন বাংলার প্রভিনশিয়াল কৃষক সভার কম্যুনিস্ট কর্মীরা। তাদের নেতৃত্বে বর্গাচাষিরা ভূমিমালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়। খুব দ্রুত নিচের স্তরে এর নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। এই তেভাগা আন্দোলন বাংলার ১৯ টি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনটি তীব্র আকার ধারণ করে দিনাজপুর, রংপুর, জলাপইগুড়ি, খুলনা, ময়মনসিংহ, যশোর এবং চব্বিশ পরগনা জেলায়। ভূমি মালিকরা ভাগচাষিদের এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করে। তারা পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের অনেককে গ্রেফতার করে এবং তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখে। কিন্তু জমিদারদের দমনপীড়ন আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারেনি। অপ্রতিরোধ্য ভাগচাষিরা পরবর্তীতে তাদের লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে জমিদারি প্রথা বিলোপের ক্ষেত্রে একটি নতুন স্লোগান যোগ করে। বর্গাচাষিদের সমর্থনে পরিচালিত তেভাগা আন্দোলনে এই স্লোগানের সূত্রে খাজনার হার কমে আসার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়।
তেভাগা আন্দোলনের অগ্রবর্তী ধাপ হিসেবে কৃষকরা কোনো কোনো জায়গাকে তেভাগা এলাকা বা ভূস্বামী মুক্ত ভূমি হিসেবে ঘোষণা করে এবং তেভাগা কমিটি স্থানীয়ভাবে সেসব জায়গায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তেভাগা আন্দোলনের চাপে অনেক ভূস্বামী তেভাগা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে নেন এবং তাদের সাথে আপস করেন। যশোর, দিনাজপুর এবং জলপাইগুড়ি তেভাগা এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে সম্প্রসারিত তেভাগা এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় মেদিনীপুর এবং চব্বিশ পরগনা। এ সকল ঘটনায় সরকার প্রাথমিকভাবে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে বিধানসভায় একটি বিল উত্থাপনে প্রণোদিত হয়। বিলটি কৃষকদের মধ্যে বিরাজমান অসন্তুষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে বর্গা প্রথা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু সমকালীন অন্যান্য রাজনৈতিক ঘটনা সরকারকে বর্গা আইন অনুমোদনে অসুবিধায় ফেলে। দেশবিভাগ এবং নতুন সরকারের অঙ্গীকার এই আন্দোলনকে সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয়।
তেভাগা আন্দোলন সফল হওয়ার ফলস্বরূপ শতকরা ৪০ ভাগ বর্গাচাষি তাদের ভূমিমালিকদের কাছ থেকে স্বেচ্ছায় তেভাগা প্রাপ্ত হন। এই আন্দোলন আবওয়াব এর নামে অন্যায় ও অবৈধভাবে জোরপূর্বক অর্থ আদায়কে অবলুপ্ত বা সীমিত করে। তবে পূর্ববাংলার জেলাসমূহে আন্দোলনটির সফল্য ছিল সীমিত। ১৯৪৮-৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তেভাগা আন্দোলনে আরেক দফা স্থবিরতা দেখা দেয়। সরকার আন্দোলনটিকে ভারতীয় দালালদের আন্দোলন বলে চিহ্নিত করে। সাধারণ মানুষও তা বিশ্বাস করে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে নিজেদের বিরত রাখে। কিন্তু আন্দোলনটি নিশ্চিতভাবে পূর্ববঙ্গ অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করেছিল ।
তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে বিভূতিগুহ বলেন, “তখন ইংরেজ আমল । গ্রামবাংলার জীবনে চলছে এক অন্ধকারময় যুগ। কৃষকের জীবন দুর্বিষহ। মাথার উপর বিদেশি শাসন । সমাজে জোতদার জমিদার মহাজনের শোষণ পীড়ন। অনাহার অর্ধাহার জোরজুলুমের সঙ্গে অশিক্ষা, অজ্ঞতা হাজারো রকমের কুসংস্কারের নাগপাশ। কিন্তু এক সময় ঝড় উঠল কৃষকের জীবনে। সারা বাংলা আলোড়িত হলো। সে ঝড় প্রবল রূপ নিল উত্তর বাংলায়। ধান, জমি, নতুন দিনের স্বপ্ন পাগল করে তুলল কৃষক সমাজকে। মূক কৃষক মুখর হলো। যুগ যুগের ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠল। বিক্ষোভ ফেটে পড়ল বিদ্রোহের রূপে। এতকালের ভীত শঙ্কিত মানুষের দল অবলীলাক্রমে, নিঃশঙ্ক চিত্তে এগিয়ে এল । ‘জান দিব তবু, ধান দিব না' । হ্যাঁ তারা রাজশক্তির হিংস্র আক্রমণে জান দিল। জান দিল হিন্দু, মুসলমান, আদিবাসী, সাঁওতাল, রাজবংশী নারী ও পুরুষ।
কৃষক
শহিদের রক্তে রচিত হলো নতুন ইতিহাস। এই হলো তেভাগা আন্দোলন। এত বড় সংগঠিত কৃষক সংগ্রাম আর কোনো দিন দেখা যায়নি বাংলায়।”
১৩.২ তেভাগা আন্দোলনের পঠভূমি
কৃষকদের এই বিরাট সংগ্রাম একদিনে ঘটেনি। এর মূলে ছিল এক দিকে বিদেশি শাসন ও জোতদারি জমিদারি সমাজ ব্যবস্থার অমানুষিক শোষণ ও জুলুম, আর অন্য দিকে শোষিত বঞ্চিত কৃষকদের জাগাবার, সংগঠিত করাবার ও আন্দোলনে নামাবার এক সুসংবদ্ধ প্রচেষ্টা। সমাজ ব্যবস্থার কথাই ধরা যাক। দেশের শাসনের গদিতে ছিল বিদেশিরাজ। আর স্থানীয় শাসনকর্তা পুলিশ আমলারা গ্রামের জোতদার জমিদারদের স্বার্থরক্ষা করতো। কারণ এই সামন্ত প্রভুরাই ছিল বিদেশি শাসকদের তল্পিবাহক। এরাই ছিল গ্রামের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। জোতদার, জমিদারদের হাতে ছিল হাজার হাজার বিঘা জমি। তাদের গোলায় পুঞ্জীভূত হতো কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনির ফল সোনার ফসল। আর জমিহারা অনশনে দুর্ভিক্ষে মন্বন্তরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। জমিদার জোতদার মহাজনের হাজারো পাওনার বোঝায় তাদের পিঠ ভেঙে যেত ।
ইংরেজ সরকার সেকালে বাংলাদেশের জন্য যে ভূমি রাজস্ব কমিশন বসিয়েছিলেন সেই ‘ফ্লাউড কমিশনের' রিপোর্টে যেটুকু সত্য প্রকাশিত হয়েছে তাও নিদারুণ। কশিনের হিসাবে দেখা যায় তখন বাংলার শতকরা ৪৬ জনেরই জমি ছিল দুই একরেরও নীচে। তার ভেতর আবার ২২.৫ ভাগের কোনো জমিই ছিল না। আর ২৮.৬ ভাগের জমি ছিল ২ থেকে ৫ একরের ভিতর। অর্থাৎ গরিব চাষি ও জমিহীন চাষির সংখ্যা ছিল শতকরা ৭৪ ভাগেরও বেশি। দিনাজপুরে এদের সংখ্যা ছিল ৫৪.৪ ভাগ আর রংপুরে ৬৪ ভাগ। দিনাজপুর, রংপুরে এদের সংখ্যা গোটা বাংলার তুলনায় কম হলেও এসে দাঁড়িয়েছিল সর্বনাশের শেষ সীমায়। খেতমজুরের অবস্থা যে কী ভয়াবহ ছিল তা দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধান কমিশনের রিপোর্টে মারাত্মক ভাবে ধরা পড়ে। কমিশন দেখেছেন ১৯৩৮-৩৯ খ্রিষ্টাব্দে খেতমজুরদের দৈনিক আয় ছিল সাড়ে তিন আনা। যে দিন কপালে কাজ জুটত শুধু সেই দিনই ছিল এই আয়। আর একশো দিনের ভেতর বত্রিশ দিনই কাজ জুটত না। অর্থাৎ বছরে প্রায় চার মাসই তারা থাকত বেকার। দেনার দায়ে কৃষকের মাথার চুল পর্যন্ত বিক্রি হয়ে যাবার অবস্থা দাঁড়িয়েছিল। সারা বাংলায় ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে কৃষকের দেনার পরিমাণ ছিল একশো কোটি টাকা ।
চাষিদের মাথার ওপর ছিল নানা স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী। সে আমলের বিচারপতি মি. ফিল্ড একটা ছক কেটে দেখিয়েছিলেন, সকলের মাথার ওপর ছিল গভর্নমেন্ট। তার তলায় জমিদার। তার তলায় তালুকদার, জোতদার পাত্তনিদার। তার তলায় পর পর নানা স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী। ফ্লাইড কমিশনের মতে এই মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা ছিল পনেরো-কুড়ি। এদের সকলের পাওনার বোঝা জগদ্দল পাষাণের মতো চেপে বসত সবার নীচেকার চাষির ওপর। এই ছিল জমিদারি জোতদারি প্রথার অভিশাপ। এই অভিশাপের ভয়ংকর শিকার ছিল ভাগচাষি বা আধিয়ার। ফ্লাইড কমিশনের মতে দিনাজপুরের ভাগচাষির সংখ্যা কৃষকদের ৬০ শতাংশেরও বেশি। এদের বেশির ভাগই ছিল জমিহারা। যাদের বা সামান্য দু-এক বিঘা জমি ছিল তাদেরও দিন গুজরানের কোনো প্রশ্নই ছিল না। জোতদারের জমি চাষ করে ফসলের আধিভাগ তাদের পাবার কথা। কিন্তু জোতদারের বর্বর আইনি-পাওনা ও আরও বর্বর বেআইনি আবওয়াব মিটিয়ে বেশির ভাগ আধিয়ারকেই শূন্যডালা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হতো। আবার এসে হাত পাততে হতো জোতদার মহাজনেরই কাছে। ফলে গলার ফাঁস আরও শক্ত হতো । আরও শত রকমের জুলুম ছিল চাষিদের ওপর। হাটে-বাজারে মালিক, জোতদার, জমিদার, ইজারাদারেরা ছোট ছোট দোকানিদের ওপর জবরদস্তি করত। খুশিমতো পয়সা আদায় করত, তরিতরকারি, শাকসবজির একটা অংশ কেড়ে নিয়ে যেত তোলাবাটি হিসেবে। উত্তরবঙ্গে বসত বিরাট বিরাট মেলা। সেই সব মেলা ছিল, জোতদার জমিদারদের লুটের উৎস। তোলাবটি খাজনা তো চড়া হারে ছিলই, তার *ওপর ছিল গরু, মোষ, ভেড়া, ছাগল বেচাকেনার জন্য রসিদ লেখাই বাবদ পশু প্রতি দু টাকা থেকে চার টাকা বা কোথাও বেশি হারে একটা পাওনা আদায় । এমনকি মেলাতে ' প্রকাশ্যে বেশ্যাপল্লি বসিয়ে চাষিদের নৈতিক অধঃপতনের পথ সাফ করে টাকা লুটতেও সামন্তপ্রভুরা কসুর করত না ৷
বিদেশি শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পথ কী? জমিদারি জোতদারি প্রথার জুলুমবাজি থেকে কৃষকদের মুক্তি কোনো পথে? এই চিন্তা জাগল একদল মধ্যবিত্ত বিপ্লবী তরুণের মনে। এই তরুণের দল এক সময় মনে করত দেশকে স্বাধীন করতে হলে চাই সশস্ত্র বিপ্লব। অবশ্য তাদের সে বিপ্লবের ধারণা ছিল গোপনে অস্ত্র জোগাড় করে কিছু রাজপুরুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে দেশে প্রেরণা জাগানো এবং একদিন পুলিশ মিলিটারির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশকে মুক্ত করা। বিদেশি শাসকের নির্মম পীড়নে অনেক বিপ্লবী তরুণকে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিতে হলো। হাজার হাজার তরুণকে বন্দি শিবিরে আটক করা হলো। বন্দি শিবিরে বসে বসে আমরা অনেক চিন্তা করলাম । আলাপ-আলোচনা করলাম অনেক বই-পত্র পড়লাম। চোখের সামনে এক নতুন পথের নিশানা দিল রাশিয়ার ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। দেখলাম পৃথিবীর বুকে একটা দেশ থেকে রাজা, জমিদার, ধনিক, বণিক, সাম্রাজ্যবাদের শাসন শোষণের অবসান হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কৃষক-মজুর রাজ। বুঝলাম বিপ্লবের প্রাণশক্তি, সর্বহারা মজুর আর তার সাথে শোষিত কৃষককুল ।
তত দিনে দেশে ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে শ্রমিকের বিপ্লবী পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছে। ভারতে গড়ে উঠেছে শ্রমিক আন্দোলন, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হলো নিখিল ভারত শ্রমিক কৃষক পার্টির প্রথম সম্মেলন ৷ তখন থেকেই এখানে সেখানে কৃষকদের সংগঠিত করার চেষ্টা শুরু হলো। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে লখনউ শহরে বসল সারা ভারত কৃষক সম্মেলন। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলার কৃষক সমিতি। কৃষক সমিতি আওয়াজ তুলল, “সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক, বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ চাই, লাঙল যার জমি তার।”
১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে বহু বিপ্লবী তরুণ নতুন পথের নিশানা নিয়ে জেল থেকে বের হয়ে এলেন। যোগ দিলেন, শ্রমিক কৃষক আন্দোলন গড়ার কাজে। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর জেলার দুজন, কালী সরকার ও বিভূতিগুহ নব মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বের হয়ে এলেন বন্দিশালা থেকে। এসে দেখেন কয়েকজন তরুণ নতুন পথের সন্ধান করছেন। তাদের পুরোভাগে ছিলেন সুশীল সেন। সবাই একত্রিত হয়ে ঠিক করলেন ছড়িয়ে পড়তে হবে দিনাজপুরের অনশনক্লিষ্ট, দুর্ভিক্ষপীড়িত, বঞ্চিত কৃষকদের মাঝে। এই কাজে বড় সাথি হলেন গুরুদাস তালুকদার। এলেন শচীন্দু চক্রবর্তী, বসন্ত চ্যাটার্জি, অজিত রায়, সুনীল সেন, জনাৰ্দ্দন ভট্টাচার্য ও আরও অনেকে। সবাই মধ্যবিত্ত ভদ্রঘরের সন্তান ।
উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে দিনাজপুর-রংপুরের আদত বাসিন্দা হচ্ছেন রাজবংশী ও মুসলমান। পরে এসেছেন সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওরাও। এঁরাই হচ্ছেন কৃষক। উচ্চবর্ণের হিন্দু ভদ্রলোকেরা বেশির ভাগই এসেছেন বাইরে থেকে বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ থেকে। উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, ব্যবসায়ী, কর্মচারী ও কিছু জোতদার, জমিদার হচ্ছেন এই উচ্চবর্ণের ভদ্রলোকেরা। অবশ্য দেশীয়দের ভেতরও অনেক জোতদার ছিল। ভদ্রলোক ও কৃষকরা যেন ছিল দুটো আলাদা জাত। তাদের বলবার ভাষা আলাদা, আচারব্যবহার, রীতিনীতি আলাদা। তার ওপর নানাভাবে বঞ্চিত কৃষকরা এই ভদ্রলোকদের দেখত সন্দেহের চোখে। তাই কৃষকদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের পথে অনেক বাধা ছিল। তখনকার দিনে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মফস্বলে, জেলায় - জেলায় প্রধান স্থান ছিল কংগ্রেসের। গাঁয়ের সাথে শহরের যেটুকু রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল তা গড়ে তুলেছিল কংগ্রেসই। সভা-সমাবেশের আয়োজন চলল গ্রামে। গড়ে উঠতে থাকল ‘কৃষক সমিতি', কংগ্রেস থেকে আলাদা সত্তা নিয়ে ৷
পুথির পাতায় কৃষকদের যে দুর্দশার কাহিনি বর্ণিত আছে, বাস্তব জীবনে তাই । কৃষকদের নিজেদেরই মাথা গুঁজবার স্থান নেই, বাইরের মানুষ এলে জায়গা দেবে কোথায়? তাই হামেশাই গরু ছাগলের সঙ্গে একই গোয়ালঘরে রাত কাটাতে হতো । উত্তরবঙ্গে প্রবল শীতে তাদের দেহে কোনো বস্ত্র নেই। পাট-প্রধান অঞ্চলে কোনো কোনো ভাগ্যবান গরিব চাষি চট গায়ে দিয়ে শীত কাটাত। পরনে তাদের কাপড় জুটত না। মেয়েরা অতিকষ্টে লজ্জা নিবারণ করত ‘বুকনি' পরে। বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত একটুকরো কাপড় জড়ানো। আর পুরুষরা আক্ষরিক অর্থেই পরত লেংটি। দেখতাম দুবেলা তাদের খাবাবু জোটে না। যা জোটে তাও শুধু পাটশাকের ঝোল আর মোটা ভাত। এই নির্মম বাস্তব জীবন কৃষকদের টেনে নিয়ে এল কৃষক সমিতিতে । কৃষক সমিতির পতাকাতলে একজোট হতে থাকল কৃষকরা। তারা শুনল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের লুণ্ঠন ও দাসত্ব শৃঙ্খলের কথা। শুনল জমিদারি প্রথার গোড়ার কথা। অবাক বিস্ময়ে তারা শুনল রাশিয়ার কৃষক-মজুর বিপ্লবের কাহিনি। শুনল, ভারতের বেশি দূরে নয়, হিমালয়ের ওপারেই এমন একটা দেশ আছে, যেখানে রাজা জমিদার নেই, কায়েম হয়েছে কৃষক-মজুর রাজ ।
এক সময় সমাজ পালটানো যাবে, ব্যাপক জাগরণ দেখা দিল কৃষকদের ভেতর; সভায় সভায় আওয়াজ উঠল, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক। জমিদারি-জোতদারি প্রথা ধ্বংস হোক । লাঙল যার, জমি তার।
ব্যাপক প্রচার অভিযানে, সভাসমিতি সমাবেশে কাজ হলো। কৃষকরা জাগ্রত হলো। সমিতি গড়ে উঠল। কিন্তু শুধু কথায় চলে না, কাজ চাই। কৃষক সমিতি প্রথমে ছোট্ট দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামল। হাটেবাজারে তোলাবটির জুলুমের বিরুদ্ধে চলল প্রথম আন্দোলন। দাবি উঠল, কৃষকের তোলাবটি নেই। অনেক হাটে কৃষকরা
তোলাবটি দিতে অস্বীকার করল। জোতদার, জমিদার হাটের মালিকরা চুপ করে বসে রইল না। জোতদার, জমিদার পুলিশের জুলুম শুরু হলো। কৃষকরা দমল না। কোথাও কোথাও কৃষকরা হাট ভেঙে নিয়ে কৃষকদের নিজেদের হাট বসাল। এমনি ঘটনা ঘটল লাহিড়ী হাটে ও আরও কয়েক জায়গায় ।
তোলাবাটি বন্ধ আন্দোলনের তরঙ্গশীর্ষে এল আলোয়াখোয়া মেলার আন্দোলন । ঠাকুরঘার উত্তর অঞ্চলে বসত বিরাট মেলা। চলত এক মাস ধরে। এই বিশাল মেলায় তোলাবটি, খাজনা, পশু বেচাকেনার লেখাই, বেশ্যা তাঁবু বসিয়ে পয়সা লোটা, সব মিলে চাষিদের লুণ্ঠনের বেশ একটা ব্যবস্থা হতো জমিদার প্রভুর ।
কৃষক সমিতি আঘাত হানল লুণ্ঠনের এই প্রাণকেন্দ্রে। তোলাবটি, লেখাইয়ের বিরুদ্ধে চলল আন্দোলন। মেলায় কৃষক সমিতির ঘাঁটি বসল। ক্যাম্প বসল জমিদার পুলিশেরও। কিছু ছোটখাটো সংঘর্ষ হলো। কৃষকরা পিছু হটল না। মেলার পাশে নদী । নদীর ওপারে জলপাইগুড়ি জেলা । জলপাইগুড়ি জেলার কৃষক সমিতির সাথে একযোগে লেখাইয়ের জুলুমের প্রতিবাদে গো-হাটি ভেঙে নিয়ে যাওয়া হলো ওপারে মেলার এলাকার বাইরে। রদ করা হলো লেখাই। প্রবল উৎসাহ দেখা দিল। জমিদার-প্রভু উপায় না দেখে শেষে একটা রফায় আসতে বাধ্য হলো। কৃষকের সে জয় সাড়া জাগাল গোটা দিনাজপুর জেলায়। এটা ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের কথা।
তোলাবটি বন্ধ আন্দোলনের পর আধিয়ার আন্দোলন। তখনকার দিনে অনেক অঞ্চলে নিয়ম ছিল, আধিয়ার যে ফসল বুনেছে সেই ফসল কেটে দিয়ে আসবে জোতদারের গোলায় বা খোলানে। ভাগচাষি নির্মম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জানে, জোতদারের কব্জায় একবার ধান চলে গেলে তার কপালে আধি তো জুটবেই না, নানা অজুহাতে, নানা পাওনার নাম করে সেই আধি থেকে মোটা অংশ কেটে নেবে জোতদার। শেষ পর্যন্ত তাকে শূন্য হাতে ফিরতে হবে। তাই আওয়াজ উঠল, আর জোতদারের খোলানে ধান নয়, নিজ খোলানে ধান তোলো। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল এই আওয়াজ। আধিয়াররা বহু স্থানে ধান তুলতে লাগল নিজ খোলানে। আন্দোলন একটা ব্যাপক সংগ্রামের রূপ নিল। হাজার হাজার ভলান্টিয়ার গড়ে উঠল গোটা দিনাজপুর জেলায় ।
আধিয়ার আন্দোলন জোতদারদের আতঙ্কিত করে তুলল। তারা দেখল তাদের ধান হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তারা পুলিশ ডাকল। শুরু হলো দমনপীড়ন। শত শত লুটের মামলা দায়ের হলো। বহু কৃষক গ্রেফতার হলো। তারপর এল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ । দেশ জুড়ে নামল দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া। চলল চোরাকারবারি মজুতদারের ব্যাপক তাণ্ডব। কৃষক সভা পিছিয়ে থাকল না। রিলিফ ও লঙ্গরখানার কাজে নেমে পড়ল । ফুড কমিটি গড়তে লাগল। মজুত বিরোধী অভিযান শুরু করল। আবার আন্দোলন মাথা তুলল। কৃষক ভলান্টিয়াররা হাটেবাজারে পাহারা দিত। সারারাত রাস্তায়-রাস্তায় টহল দিত। রাতের আঁধারে চলা চোরাকারবারির গাড়ি ধরত। মজুতদারের গোপন মজুত ধরে সস্তা দরে বিলি করত। এতেও সংঘর্ষ বাঁধল। আবার নেমে এল দমননীতি। এই দমনপীড়নের ভেতর দিয়ে কৃষকদের জীবনে এল এক নতুন অভিজ্ঞতা। গ্রেফতার এড়িয়ে গা-ঢাকা দিয়ে আন্দোলন চলাবার অভিজ্ঞতা। গোপন সংগঠন গড়ার অপূর্ব দক্ষতা দেখিয়েছিল কৃষক কর্মীরা ।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পাঁচ বছরের আন্দোলনের ভেতর দিয়ে কৃষকদের বিপুল সংগ্রামী চেতনা সৃষ্টি হলো। গড়ে উঠল শক্ত সংগঠন। সঞ্চিত হলো বিচিত্র অভিজ্ঞতা। যে কৃষক ঘর ছেড়ে কোনো দিন এক পা নড়েনি, তারা কাটিয়ে এল ইংরেজের কারাগারে। যে কৃষক যুবক ছিল অজ্ঞ, নিরক্ষর, তারা লিখতে পড়তে শিখল I মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের ক্লাসেও যোগ দিল। গড়ে উঠল অনেক কৃষক কর্মী। এই কৃষক কর্মীরা নিজেরাই গ্রামে গ্রামে প্রচার করত, কৃষক সমিতি গড়ত, জেলা অফিসে রিপোর্ট পাঠাত, স্থানীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিত।
কৃষক মেয়েরাও পিছিয়ে ছিল না। গোপন চিঠিপত্র আনানেওয়া করা, খবরাখবর দেওয়া, যাদের মাথার উপর গ্রেফতারি পরওয়ানা ঝুলছে সেই নেতা ও কর্মীদের সাবধানে লুকিয়ে রাখা, এই সব কাজে কৃষক বধূদের অবদান ভুলবার নয়। শুধু তাই নয়, কৃষক মেয়েরাও ক্রমে ক্রমে যোগ দিতে থাকল প্রকাশ্য আন্দোলনে। গড়তে লাগল কৃষক মেয়েদের ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি' ।
এর পরের বড় ঘটনা ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের আইনসভা নির্বাচন। দিনাজপুর জেলায় কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টি ঠিক করল এবার নির্বাচনে খাস কৃষক সন্তানকে দাঁড় করানো হবে। রূপনারায়ণ রায় হলেন কৃষকদের মনোনীত প্রার্থী। রূপনারায়ণ ছিলেন ফুলবাড়ি এলাকার কৃষক নেতা। কিছু লেখাপড়া জানতেন। প্রচারে-সংগঠনে ছিলেন দক্ষ। শুধু ফুলবাড়ি এলাকাতেই নয়, জেলার বিভিন্ন অঞ্চলেও কৃষক সমিতি ও কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ক্রমে জেলার নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
রূপনারায়ণ রায়কে ঘিরে বিরাট নির্বাচনি অভিযান চলল। আওয়াজ উঠল, আর জোতদার, জমিদারের লোককে নয়, ভোট দাও কৃষক সন্তান রূপনারায়ণকে । এতদিন পশ্চাৎপদ-অনুন্নত সম্প্রদায় হিসাবে যাঁরা কৃষকদের ভোট কুড়াতেন, কৃষকদের স্বজাতি হলেও তাঁরা ছিলেন জোতদার, জমিদার। এবার জাতি, সম্প্রদায়ের গণ্ডি ভেদ করে এল শ্রেণিচেতনা। স্বজাতির জোতদার প্রার্থী আর কৃষকদের মনে দাগ কাটতে পারল না। যে সবার পিছে, সবার নিচে, সেই বঞ্চিত অবহেলিত কৃষক শ্রেণির নামটাই উঠে এল সবার উপরে। শ্রেণিচেতনা কৃষকদের এককাট্টা করল । একই জাতের জোতদার প্রার্থীর বিরুদ্ধে কৃষক প্রার্থী রূপনারায়ণের জয়লাভ বাংলার কৃষক আন্দোলনে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিল। নয় বছরের এই বিরাট সংগ্রামী ঐতিহ্য মাথায় নিয়ে দিনাজপুরের কৃষক নেমে পড়ল তেভাগা সংগ্রামে ।
তেভাগার মরণজয়ী আন্দোলন
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ। ভারতের পটভূমি তখন বিপুল সম্ভাবনাময় । নানা ঘটনার উদ্বেল। ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার পথে পথে চলেছে রশিদ আলি দিবসের দুর্জয় অভিযান। বোম্বাইতে নৌ-বিদ্রোহ এক নতুন দিকের ইঙ্গিত দিল। ২৯ জুলাই কলকাতায় শ্রমিক শ্রেণি এলো সংগ্রামের ময়দানে। হলো সাধারণ ধর্মঘট। কিন্তু শত্রু চুপ করে বসে রইল না। সেও আঘাত হানল । আঘাত এল নির্মম দাঙ্গারূপে আগস্ট মাসে। মনে হলো সেই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা গ্রাস করবে গোটা বাংলাদেশকে। স্বাধীনতার দাবি ডুবে যাবে নিজেদের রক্ত স্রোতে। ঠিক এমনি এক সংকট মুহূর্তে বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি ডাক দিল তেভাগা সংগ্রামের। তেভাগা দাবির ফ্লাউড কমিশনও মেনে নিয়েছিল। মুসলিম লিগ মন্ত্রিসভাও বিল প্রণয়নের কথা ভাবছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তেভাগার দাবি মেনে নেবার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না ।
উত্তরবঙ্গে, বিশেষ করে রংপুর দিনাজপুরে কৃষকরা বিপুল উৎসাহে নেমে পড়ল তেভাগার অভিযানে। নেতারা বুঝলেন শাসকরা সহজে ছেড়ে দেবে না। তাই গা-ঢাকা দিয়ে গোপনে থেকে সংগ্রাম চালাবার ব্যবস্থা করা হলো। নেতারা এক-একটি এলাকা বেছে নিয়ে সংগ্রামের প্রস্তুতি চালালেন। ‘নিজ খোলানে ধান তোলো', আওয়াজ তুলে আন্দোলন শুরু হলো। ভাগচাষিরা দল বেঁধে ধান কেটে নিজ খোলানে তুলতে লাগল । তাড়াতাড়ি ধান কেটে ফেলার জন্য কৃষক ভলান্টিয়াররা সাহায্য করল ভাগচাষিদের। সকল স্তরের-বিশেষ করে খেতমজুর, গরিব চাষি, মাঝারি চাষি-ভাগচাষিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ লোল । আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল অল্পবিস্তর দিনাজপুরে ও রংপুরে। যে সব এলাকায় ধান খোলানে তোলা হয়ে গেল এবার সেকানে কী করা হবে? ঠিক হলো, জোতদারকে আইনসঙ্গত নোটিশ দিয়ে ধান ভাগ করা হবে। ভাগচাষিরা তেভাগা কায়েম করবে। জোতদারকে যথারীতি নোটিশ দেওয়া হলো। কিন্তু জোতদার সে- নোটিশ অস্বীকার করল। তখন ভাগচাষিরা গাঁয়ের দশজনকে সাক্ষী রেখে ধান ভাগ করল। ধান তিন-ভাগে ভাগ হলো। ভাগচাষি দু ভাগ নিয়ে জোতদারের জন্য রেখে দিল এক ভাগ ।
তেভাগা কায়েমের সংগ্রাম জোর বাঁধল দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহকুমায় । তেভাগার কথা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। সমিতির সংগঠিত এলাকার বাইরেও তেভাগা কায়েমের সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল কৃষক কর্মীদের অজ্ঞতসারেই। দূর গ্রাম থেকে কৃষকরা আসতে লাগল সমিতির কাছে। লাঠি হাতে তারা নিজে থেকেই কখন ভলান্টিয়ার হয়ে গেছে, সমিতির অফিসও খুলেছে। তারা অভিজ্ঞ কর্মীদের নিয়ে গেল তাদের এলাকায়। শত শত গ্রাম্য ‘কৃষক সমিতি' গড়ে উঠল। হাজার হাজার কৃষক সমবেত হলো সমিতির লাল ঝাণ্ডার নীচে। আর সেদিন সমিতির প্রতিটি সদস্যই ছিল লাঠিধারী ভলান্টিয়ার। তেভাগা দাবির আওয়াজ তুলে কৃষকরা মিছিল করে জোতদারের বাড়ি ঘেরাও করতে লাগল। পরবর্তীকালে সংগ্রামের স্বীকৃত রূপ হিসেবে যে ‘ঘেরাও’ চালু হলো, সেই ঘেরাও শুরু করেছিল তেভাগা সংগ্রামী কৃষকরা। অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বহু অঞ্চলে, বিশেষ করে ঠাকুরগাঁয়ে গ্রামের পর গ্রাম লালঝাণ্ডার গ্রামে পরিণত হলো। সর্বত্র উঠল লালঝাণ্ডার জয়ধ্বনি ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ' আওয়াজ । তেভাগার আন্দোলন সামান্য দুমুঠো ধানের আন্দোলন হলেও তার পেছনে রাজনৈতিক চেতনা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করল।
আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৬-এর ডিসেম্বরে। কিন্তু আন্দোলনের পথ কুমুমাস্তীর্ণ - ছিল না। পথে বাধা ছিল প্রচণ্ড। রাজবংশী ক্ষত্রিয় জোতদার জমিদারদের একটা জাতীয় সংগঠক ছিল ‘ক্ষত্রিয় সমিতি'। মুসলমান জোতদার, জমিদার সমবেত হলো মুসলিম লিগে। সাম্প্রদায়িকতার নাম করে এই দুটি কায়েমি স্বার্থের দল সাধারণ কৃষকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। তারা কিছুটা সফলও হলো কোথাও কোথাও বিশেষ করে লিগের প্রচার মুসলমান প্রজাদের দ্বিধাগ্রস্ত করল। সন্দেহ নেই মুসলমান কৃষকরাও অনেক অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনে এসেছিল। বিখ্যাত মুসলমান নেতা হাজি মুহম্মদ দানেশ মনে-প্রাণে যোগ দিয়েছিলেন কৃষক সংগ্রামে। মুসলমান কৃষকদের সংগঠিত করায় তাঁর অবদান কম ছিল না। বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমান কর্মীও গড়ে উঠেছিল। তবু স্বীকার করতে হবে ব্যাপকভাবে মুসলমান কৃষকরা আন্দোলনে নামেনি ৷ যেমনটি এসেছিল রাজবংশী, আদিবাসী সাঁওতাল কৃষকরা। এই সব বাধা সত্ত্বেও এ কথা নিশ্চয়ই বলা যায় শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিসংগ্রাম সেদিন সাম্প্রাদয়িকতার প্রাচীর ধ্বসিয়ে দিয়েছিল। খেতমজুর থেকে মাঝারি কৃষক তো বটেই এমনকী ধনী কৃষকরাও অনেকে ভাগচাষিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাদের আশা, তেভাগা আন্দোলন হলে, জোতদারের বিরুদ্ধে একটা লড়াইয়ে বিজয়ী হলে, পরবর্তী লড়াইয়ের পথ লাঘব হবে । তখন হবে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই। আন্দোলনের প্রথম দিকটায় জোতদাররা ঘাবড়ে গেল। ঘেরাওয়ের ভয়ে জোতদাররা গাঁয়ের বাড়ি ছেড়ে পালাল। পুলিশও মনস্থির করতে পারেনি। কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য গ্রেফতারি পরওয়ানা। কিন্তু পুলিশ গ্রামে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। এ অবস্থা বেশিদিন চলল না। রাজশক্তি আঘাত হানার পরিকল্পনা নিল । প্রথম আঘাত এল আন্দোলনের অপেক্ষাকৃত দুর্বল স্থান চিরিরবন্দরে ।
সশস্ত্র পুলিশ চিরিরবন্দরের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের গ্রেফতার করতে এগিয়ে এলো । চারশত কৃষক একজোট হয়ে প্রতিবাদ জানালেন। পুলিশ জবাব দিল গুলির মুখে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিলেন তেভাগা আন্দোলনের প্রথম শহিদ শিবরাম ও সমিরুদ্দিন। কলকাতার আত্মঘাতী দাঙ্গার প্রায়শ্চিত্ত করলেন এই দুই কৃষক সন্তান। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত রক্ত নতুন ইতিহাসের দিগন্ত রচনা করল। ২ ফেব্রুয়ারি এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল ঠাকুরগাঁও-এর রানীশংকৈলে । পুলিশ এল কর্মীদের গ্রেফতার করতে। তখন এক কৃষক বধু পুলিশের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে ঘরে আটক করে তালাবদ্ধ করেছিল। কৃষকদের অসীম সাহস জুগিয়েছে কৃষক আন্দোলন । তাই তো কৃষক মেয়েও পুলিশের বন্দুক কেড়ে নেবার স্পর্ধা রাখে। এমনি করেই তেভাগা আন্দোলনে সংগ্রামের প্রথম সারিতে এসে দাঁড়িয়েছেন কৃষক মেয়েরা । কৃষক মেয়েদের অনেকে পার্টির সর্বসময়ের কর্মীও হয়েছিলেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই সর্বসময়ের কর্মী এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়। পষ্টরাম সিং ও জয়মণি ছিলেন এমনি এক দম্পতি। শুধুই কি দম্পতি? তেভাগা আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ অনেক অজ্ঞাত কৃষক নারীকে মরণজয়ী সংগ্রামের পুরোভাগে এনে দাঁড় করিয়েছিল। এমনি বীর নারী ছিলেন খাঁপুরের যশোদারানি ও কৌশল্যা। ঠুমনিয়ার শুকুরচাঁদের স্ত্রী। পুলিশের নির্মম গুলিবর্ষণ তুচ্ছ করে তাঁরা এগিয়ে এসেছেন, প্রাণ দিয়েছেন, কিন্তু পিছু হটেননি ।
এবার পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ল তেভাগা আন্দোলন দমনে। ২০ ফেব্রুয়ারি খাঁপুরের নির্মম হত্যাকাণ্ড ইংরেজ শাসকের বর্বরতার এক চূড়ান্ত নিদর্শন রেখে গেল । আর সেই সঙ্গে চির উজ্জ্বল হয়ে রইল বীর কৃষকদের অসীম শৌর্য ও আত্মাহুতি। গাড়ি বোঝাই সশস্ত্র পুলিশ এল দমনপীড়ন চালাতে। কয়েক শত সাঁওতাল ও রাজবংশী কৃষক প্রতিরোধে এগিয়ে এল। পুলিশ খুনের-নেশায় উন্মত্ত হয়ে ১২১ রাউন্ড গুলি চালাল। প্রাণ দিলেন যশোদারানি, কৌশল্যা সহ বাইশ জন মরণজয়ী বীর। শহিদের রক্তে সিক্ত
হলো খাঁপুরের মাটি। বালুরঘাট মহকুমার খাঁপুরের পর ঠাকুরগাঁও-এর ঠুমনিয়া। ২১ ফেব্রুয়ারি সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী এল কৃষক নেতা কম্পরাম সিং ও ডোমা সিংকে গ্রেফতার করতে। ঘেরাও করল ডোমার বাড়ি। নেতাদের গ্রেফতারে বাধা দিলেন কৃষকরা। সামনে এগিয়ে এলেন শুকুরচাঁদ ও তাঁর স্ত্রী পুলিশের গুলি উপেক্ষা করে। তাঁরা রুখে দাঁড়ালেন। পুলিশ তাক করে গুলি ছুড়ল। লুটিয়ে পড়লেন বীর কৃষক- দম্পতি। শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে এলেন শকটু সিং আর নেন্দেলি সিং। বর্বর পুলিশের গুলি তাঁদেরও বুক ছিন্নভিন্ন করে দিল। চার শহিদের রক্তে লাল হলো তেভাগার পতাকা ।
এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি। বর্বর কৃষক-হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ও তেভাগার দাবিতে বিরাট সংহতি মিছিল চলল পূর্বাঞ্চল থেকে ঠাকুরগাঁও শহরে। এটা ছিল তেভাগা আন্দোলনের বৃহত্তম মিছিল। মিছিল ছিল শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল। কিন্তু রাজশক্তি তখন মরিয়া। খুনের নেশায় মত্ত। কোনো হুঁশিয়ারি দেওয়া হলো না। বন্দুক গর্জে উঠল সেই বিশাল শান্ত কৃষকজনতার উপর। বেপরোয়া গুলি চলল। হিন্দু, মুসলমান, সাঁওতালের বুকের রক্তে ঠাকুরগাঁ শহরের রাজপথ ভেসে গেল। দু জন সাঁওতাল, দু জন রাজবংশী ও এক জন মুসলমান কৃষক প্রাণ দিলেন। কৃষকরা তবু দমলেন না। শত শত কর্মী চাইলেন আন্দোলনকে সশস্ত্র প্রতিরোধের দিকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু তখন পুরোদমে পুলিশি আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। আন্দোলনকে উচ্চতর পর্যায়ে তোলার প্রচেষ্টা বৃথা। তাই পিছু হটার নীতিই গ্রহণ করা হলো। চেষ্টা হলো কর্মীদের গ্রেফতারের হাত থেকে বাঁচানো। কৃষক সাধারণকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা ।
সশস্ত্র পুলিশ জোতদার, জমিদারের গুণ্ডাদলের সাহায্যে গ্রাম চড়াও করতে লাগল। কৃষকের বাড়ি তল্লাশির নামে ভাঙচুর, লুটতরাজ চলল। সশস্ত্র পুলিশ গ্রামে ঢুকছে দেখলেই কর্মীরা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়ত। দিনের বেলায় পুরুষরা গ্রাম ছেড়ে বনেজঙ্গলে, নিরাপদ গ্রামে চলে যেত। তবু দিনাজপুর জেলায় প্রায় পনেরশো কৃষক কর্মী গ্রেফতার হলো। কৃষক বন্দিতে ঠাকুরগাঁও দিনাজপুর ও রাজশাহী জেল ভরে গেল। নেতাদের ভেতর রূপনারায়ণ রায়, সুনীল সেন, গুরুদাস তালুকদার, বসন্ত চ্যাটার্জি প্রমুখরা ধরা পড়ে গেলেন। বাকি নেতারা সেই কঠোর পিছু হটার দিনগুলোতে পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে গ্রামে গ্রামে কৃষকদের সঙ্গে তাদের সুখ দুঃখের ভাগী হয়ে রইলেন ।
এমনি করেই চলল কয়েক মাস। ওদিকে ভারতের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সূচনা দেখা দিল । ব্রিটিশ সরকার বুঝল বারুদের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আর দেশ শাসন করা চলে না। তবুও শেষ রক্ষাকবচ হিসেবে তারা ভারতকে দু'ভাগ করে দিল । দিনাজপুরের তেভাগা আন্দোলনের বিরাট এলাকা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলো। বন্দিরা মুক্তি পেলেন। বিদেশি রাজ স্বাধীনতার দাবিকে আর ঠেকাতে পারল না। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্টের শুভ দিনটিতে উড্ডীন হলো স্বাধীনতার পতাকা।
শেষ হলো কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা একটি উজ্জ্বলতম অধ্যায়। তেভাগা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষকদের এই বিরাট আন্দোলন দেশবাসীর সামনে ভূমিসংস্কারের প্রশ্নটি বিশেষ ভাবে তুলে ধরতে পেরেছে। আর তারই ফলশ্রুতি পরবর্তীকালে তেভাগার স্বীকৃতি, জমিদার প্রথার অবসান ও কিছু ভূমিসংস্কার।
তেভাগা আন্দোলনের ঘটনাসমূহ
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন সবচেয়ে ঘটনাবহুল। ১৯৪৬-৪৭ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ প্রাক স্বাধীনতা যুগে উত্তরবঙ্গে বিশেষত দিনাজপুর, রংপুর ও জলপাইগুড়ি জেলার তেভাগা আন্দোলন এক স্মরণীয় ঘটনা। এই আন্দোলন এত ব্যাপক, বিস্তৃত ও জঙ্গি ছিল যে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন সিপাহিবিদ্রোহের পর এত ব্যাপক আলোড়ন কৃষকদের মধ্যে পড়ে নাই। তখন উত্তরবঙ্গে কৃষক আন্দোলন বুঝতে এই তিন জেলার কৃষক আন্দোলনকে বুঝাত। সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের পুর্বে ছাড়া ছাড়া কৃষক আন্দোলন হয়েছে। শোনা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকে এই জেলায় ক্ষত্রিয় বিদ্রোহ হয়েছিল। ওই আন্দোলনের পরে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংস্কার হয়। মালদহে সাঁওতাল বিদ্রোহ, পাবনায় পল বিদ্রোহ প্রভৃতি আন্দোলন হয়। যার মূল দাবি ছিল কৃষকের অধিকারকে রক্ষা করা। শোনা যায়, এই সমস্ত আন্দোলনের মূল দাবি ছিল প্রচলিত খাজনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে প্রজার গাছকাটা অধিকার নিয়ে আন্দোলন হয়। শোনা যায়, বিখ্যাত আইনজীবী মৃত অতুলচন্দ্র গুপ্ত এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন ।
সংগঠিত কৃষক আন্দোলন ১৯৩৬-৩৭ খ্রিষ্টাব্দ হতে দিনাজপুর জেলায় আরম্ভ হয়। দিনাজপুর জেলায় কৃষক সাধারণের মধ্যে প্রধানত রাজবংশী, মুসলমান ও সাঁওতাল এই তিন সম্প্রদায় নিয়ে কৃষক সমাজ গঠিত। রাজবংশী সম্প্রদায়ভুক্ত কৃষকেরা এই কৃষক আন্দোলনে ব্যাপক সাড়া দেয়। যদিও এরা তদানীন্তন সমাজ জীবনে অবহেলিত ও নিষ্পেতিত ছিল। তবুও তাদের আঞ্চলিক অবস্থা, পরিবেশ, সামাজিক ক্রিয়াকলাপ, পালা-পার্বণ, ছড়া, যাত্রাগান, বাদ্যযন্ত্র, নিজেদের কথিত ভাষা প্রভৃতির প্রভাবে এক সুস্থ চেতনা ও সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। দরিদ্র জীবনের দুঃখ এবং বিত্তবানের সুখ ও আরাম-সামাজিক বৈষম্য তাদের চোখে নিয়ত ধরা পড়ত। ‘ধনীর স্বার্থই দেশের স্বার্থ' এই ভ্রান্ত মতাদর্শ এদের ভুলপথে চালিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এদের মধ্যে যে অজস্র প্রবাদ, ছড়া, রচনা ও গান প্রচলিত ছিল তার মূল বক্তব্য ছিল ধনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ। এই অনুভূতিই এক ব্যাপক জঙ্গি কৃষক আন্দোলনের বাস্তব ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। এই অঞ্চলে এক দিকে যেমন নিঃস্ব ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলছিল তেমনি অন্য দিকে হাজার হাজার বিঘা জমির মালিকের সংখ্যা কম ছিল না। প্রাক স্বাধীনতা যুগে দিনাজপুর জেলায় চার-পাঁচ হাজার বিঘা জমির মালিকও ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ধানের দর মন প্রতি বারো আনা থেকে এক টাকা ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে ধানের দর আরও কম ছিল। শোনা যায়, গত শতাব্দীতে ধানের দর মন প্রতি ছয় আনা থেকে আট আনা ছিল এবং খাজনার হার নির্দিষ্ট ছিল ।
ফসলের দরের সঙ্গে বা কৃষকের সাংসারিক প্রয়োজনের সঙ্গে এর কোনো সংগতি ছিল না। ফলে, কৃষকের সাংসারিক খরচ জোগাড় করতে তার সব নিঃশেষ হতো। তখন চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করত, যার ফলে কিছুদিনের মধ্যেই মোকদ্দমা, জমি থেকে উচ্ছেদ, জমি নিলাম হতো। আর এই হতভাগ্য কৃষক নিজের জমিতে বর্গাদারে পরিণত হতো। খাজনা না দিতে পারায় প্রতি বৎসর শত শত
কৃষক জমি থেকে উচ্ছেদ হতো। সেদিন দেশের চিন্তাশীল, জ্ঞানী ও বিদ্বান ব্যক্তিগণ এই সমস্যাকে আদৌ কোনো গুরুত্ব দেন নাই। এই অঞ্চলের কৃষক সমাজ, রাজবংশী, সাঁওতাল, মুসলমান চাষিরা অত্যন্ত সরল প্রকৃতির ছিল। সহজেই তাদের প্রতারণা করা যেত। কৃষকদের এই অসহায় অবস্থার সুযোগ গ্রামীণ জোতদার ও মহাজন পুরোপুরি নিত ।
সংগঠিত কৃষক আন্দোলন যখন আরম্ভ হলো তখন এই কৃষকদের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ সৃষ্টি হলো। ‘জমিদারি প্রথা ধ্বংস হউক’, ‘খাজনার হার অর্ধেক করো', 'বাকি ঋণ মওকুফ করো’, ‘বেআইনি আদায় বন্ধ করো’, ‘লাঙল যার জমি তার’-কৃষক আন্দোলনের এই সমস্ত দাবিতে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সমস্ত কৃষক সাড়া দেয়। মুসলমান, রাজবংশী, সাঁওতালি কৃষকগণ অগ্রণী হয়ে কৃষক সমিতি গঠন করতে লাগল। কৃষক সমিতি গঠিত হতে না হতেই সংঘর্ষ শুরু হলো। কোনো ছোট জমিদারের এক হাটে ইজারাদারের অত্যাচারের প্রতিবাদে সেই অঞ্চলের কৃষকরা এক দিন ওই হাট ভেঙে কৃষকের এক হাট লাগাল। বহুদিন পর্যন্ত কৃষকের হাট চলেছিল। কয়েকশো বিঘা জমি বর্ষাতে একেবারে ডুবে যেত। প্রতিবারই ফসলহানি হতো। ফলে, এই অঞ্চলের কৃষকদের দুর্দশার অন্ত ছিল না। জমিদার, ইউনিয়ন বোর্ড, সার্কেল অফিসারদের নিকট অনেক তদবির করাতেও যখন কিছু হলো না, তখন কৃষক নেতৃত্বে কয়েকটি গ্রামের কৃষক একত্রিত হয়ে মস্ত এক বাঁধ দেয়। আর একটি খাল কেটে কিছু দূরের একটি বড় খালের সঙ্গে যোগ করে দেয়। ওই বড় খালের সঙ্গে আত্রাই নদীর যোগ থাকায় জল বের হওয়ার রাস্তা হয়। এইভাবে কয়েকশো বিঘা জমি উদ্ধার করা হয়। আন্দোলনের ফলে ছোট ছোট জোতদার মহাজনেরা খুব ভীত হয় এবং বেআইনি আদায় বন্ধ করে দেয়।
রাজবংশী আর সাঁওতাল কৃষকদের জীবন-যাত্রার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হবার সুযোগ হয়। রাজবংশী ও সাঁওতাল কৃষকরা বাড়ির ভেতরে কৃষক কর্মীদের আশ্রয় দিত এবং তাদের নিজেদের পরিবারভুক্ত লোক বলে গণ্য করত। মুসলমান চাষিরা যদিও বেশ ভালোভাবেই আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিল, তবু এত ঘনিষ্ঠভাবে তাদের সামাজিক সমস্যা জানার সুযোগ হয় নাই ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুতেই ১৯৩৯-৪০ খ্রিষ্টাব্দে এই তিনটি জেলাতে হাটবাজারে ‘তোলাবন্ধ’ আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। এর সূত্রপাত হয় জলপাইগুড়ি জেলার কালীর মেলা থেকে। দেখতে দেখতে সারা দিনাজপুর জেলাতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে গেল। হাজার হাজার কৃষক ভলান্টিয়ার লাঠি কাঁধে নিয়ে মেলাতে ও হাটে নামল। আলোয়াখোয়া মেলাতে প্রায় তিন হাজার কৃষক ভলান্টিয়ার নামে । কৃষকদের মধ্যে দারুণ উৎসাহ উদ্দীপনা। জেলা ও মহকুমা শহরে লাঠি কাঁধে নিয়ে দলে দলে কৃষক ভলান্টিয়ার মিছিল করত। কৃষক মেয়েরাও পিছিয়ে ছিল না। এই রাজবংশী এবং সাঁওতাল কৃষক ঘরের মেয়েরাও যে দলে দলে লাঠি কাঁধে নিয়ে শহরে মিছিল করবে, একটা কল্পনাতীত ব্যাপার। এই আন্দোলন এত ব্যাপক ও তীব্র হয়েছিল যে অবশেষে রাজশাহী বিভাগের ইংরেজ কমিশনার ঠাকুরগাঁও শহরে এসে পনেরো হাজার কৃষক সমাবেশের নীচে দাঁড়িয়ে হাট-বাজারে ‘তোলা লেখাই' সম্বন্ধে নতুন ‘রেট' বেঁধে দিলেন। কৃষক সমিতির নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনের এটাই হলো এক বড় রকমের জয়। ‘তোলা বন্ধ’ আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গেই ‘বেআইনি আদায় বন্ধ' আন্দোলন শুরু হলো। আধিয়ার (বর্গাদার) জোতদারের জমি চাষ করে ফসলের অর্ধেক পায়। ফসল উৎপাদন খরচ, যেমন—হাল, বলদ, বিচন, সার এবং নিজেদের খাটুনি—এই সব মিলেই ফসলের অর্ধেক পেত। ধান কাটার পর জোতদারের বা জোতদারের নির্দিষ্ট খামারে ধান তুলতে হতো। অংশ ভাগের সময় আধিয়ারের অর্ধেক অংশ থেকে জোতদার তার পাওনা বাবদ আরও আদায় করত। যেমন, শ্রাবণ ভাদ্রমাসে যদি এক মন ধান কর্জা দেয় তবে ধান ভাগের সময় সুদ ও আসল হতো দেড় মন। বিচন ধান যদি কর্জা দিত, তবে সুদ ও আসল দ্বিগুণ হতো। এর উপর ছিল মহলদারি, বরকন্দাজি, গোলাপূজারি, মুরগি খাওয়া বা হাঁস খাওয়া (জোতদারের বাড়ির হাঁস মুরগির খাওয়ার জন্য ধান), থিয়েটার (জোতদারের বাড়িতে থিয়েটার যাত্রা হবার খরচ) ইত্যাদি। এই সমস্ত আদায়ের পর কোনো কোনো আধিয়ার দুই-তিন কাঠা ধান (আড়াই সেরি কাঠা) পেত । আবার কোনো কোনো আধিয়ার কিছুই পেত না। একেবারে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরত ।
এই বেআইনি আদায়ের বিরুদ্ধেও বিপুল আন্দোলন চলল। কর্জা ধানের সুদ দেড়িয়া থেকে সোয়াইয়া, বিচন ধানের সুদ নাই, নিজ খামারে ধান মাড়াই হয়ে অংশ ভাগ হবে। আন্দোলন শুরু হতেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বহু এলাকায় কৃষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন শুরু করল। রাজবংশী, সাঁওতাল ও মুসলমান কৃষকরা এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনেক ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আংশিক সাফল্য অর্জিত হয়।
পুলিশ নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিল না। তখন ভারত রক্ষা আইন বলবৎ ছিল । সভা মিছিল করা বেআইনি ছিল। ধরপাকড়, জেল, লাঠি সর্বদা লেগেই ছিল। প্রায় চার- পাঁচশো কৃষক গ্রেফতার হন। সত্তর বছরের মুসলমান কৃষক জাল মোহম্মদ আন্দোলনের এক জ্বলন্ত প্রেরণা ছিল। গরিব চাষি কলাইয়ের ডাল আর পাটের শাক দিয়ে কোনো মতে দুবেলা ভাত খেত। ‘কৃষক সমিতি'র আন্দোলনের শুরু থেকেই জাল মোহম্মদই বৃদ্ধ বয়সেও ভলান্টিয়ার নিয়ে দিনাজপুর শহরে আসত। তাঁর নিকট জানা যায় বাংলা ১৩১৯ খ্রিষ্টাব্দে কেদার ব্যানার্জি প্রজার ‘গাছকাটার স্বত্ব'-র দাবিতে আন্দোলন করে। সে সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। জাল মোহম্মদের ছয় মাসের জেল হয়। তারপর প্রায় দেড় বৎসর অন্তরিন ছিল। কৃষকের সঙ্গে পুলিশের এক বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। কয়েকজন কৃষক আহত হয়। জেলে দুই জন মারা যায় । ১৯৪০ খ্রি. মাঝামাঝি থেকে অর্থাৎ বর্ষার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেল। তখন পুলিশি সন্ত্রাস চলছে। বহু কর্মী জেলে বা অন্তরিন হয়ে আটকে আছে। প্রকাশ্যে সভা মিছিল নিষিদ্ধ। এই সময় কৃষকদের মধ্যে গোপন সংগঠন তৈরির কাজও আরম্ভ হলো। এই আন্দোলনে কৃষকের ঘরের মেয়েদের ভূমিকা কৃষক আন্দোলনের এক অপূর্ব অবদান । জোতদার ও পুলিশের সন্ত্রাসে তারা আদৌ ভীত হয় নাই। আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মীদের আশ্রয় দিতে তারা আদৌ শঙ্কিত হতো না। নিজের ছেলের মতো যত্ন করত। অসুখ হলে সেবা শুশ্রূষা করত। এই কৃষক কর্মীদের বেশির ভাগ ছিল শহরের মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। কিন্তু জোতদারের-‘এরা ভাটিয়া’ এই অপপ্রচার সত্ত্বেও নিজেদের ছেলে আর মেয়েদের সঙ্গে এই কর্মীদের পৃথক করে দেখত না
খাওয়ার মান রাজবংশী ও সাঁওতালদের খুব নিচু ছিল। অন্যান্য জেলার কৃষকদের খাওয়ার মান বোধ এত নিচু ছিল না। উত্তরবঙ্গের এই তিনটি জেলা পূর্ব বঙ্গের মতো নদীমাতৃক বা পশ্চিমবাংলার মতো খনিজ শিল্প ভিত্তিক ছিল না। উত্তরবাংলার কৃষক প্রধানত বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই এদের জীবনযাত্রা অনিশ্চয়তায় ভরা ছিল। শিক্ষার দিক থেকে এরা অনুন্নত ছিল। ১৯৩৬-৩৭ খ্রিষ্টাব্দেও একটি ইউনিয়নে দুইটি কি তিনটি প্রাথমিক স্কুল ছিল। লেখাপড়ার আগ্রহ মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশি ছিল। এই কৃষক আন্দোলন কৃষক মেয়েদের মধ্যে এক জাগরণ এনে দেয়। লেখাপড়ার আগ্রহ বেড়ে যায়। নিজেরা অগ্রণী হয়ে লেখাপড়ে শিখতে লাগল। রাজবংশী সম্প্রদায়ের বয়স্কা মহিলা ‘কণ্ঠমণি’র নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কেরোসিনের অভাবে কোনো কোনো দিন সিংটে (পাটকাঠি) জ্বালিয়ে তারা পড়ত। সাপ্তাহিক ‘জনযুদ্ধ’ এলেই মেয়েরা দল বেঁধে এসে পড়ত এবং আলোচনা করত ৷
গোপন সংগঠন মারফত ব্যাপকভাবে কৃষকদের মধ্যে গোপন আন্দোলন চলল । চৌকিদারি ট্যাক্সের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার অভিযোগে কৃষক নেতা কম্পরাম সিং সহ প্রায় বারো চৌদ্দ জন কৃষক কর্মীর ছয় মাস জেল হয়। কয়েক বছর পর ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী জেলে গুলিতে কৃষক নেতা কম্পরাম সিং মারা যায়। দুর্ভিক্ষ মহামারির বিরুদ্ধে কৃষকরা আন্দোলন করে। দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে রিলিফ কিচেন খুলে দুঃস্থদের রিলিফের ব্যবস্থা করা হয়। কলেরা, বসন্ত, যক্ষ্মা রোগের প্রতিষেধক টিকা নেবার ব্যাপক আন্দোলন হয়। এই তিন সম্প্রদায়ের কৃষকরা খুব অতিথিপরায়ণ ছিল। এই কৃষক আন্দোলন কৃষকদের সামাজিক জীবনকেও স্পর্শ করে। কৃষক মেয়েরা তাদের সামাজিক ও আর্থিক দাবি নিয়ে আন্দোলন করে ।
জোতদার ও কৃষকদের মধ্যে এতকাল যে চাপা এবং অঘোষিত সংঘর্ষ ছিল এই আন্দোলন তাকে প্রকাশ্যে মাঠের লড়াইতে পরিণত করে। এর ফলে মাতব্বর বলতে কৃষক আন্দোলনের কর্মীদের বুঝাত এবং পরবর্তীকালে যে সামাজিক সমস্যা দেখা দিত তার সমাধানের জন্য কৃষকেরা জোতদারের পরিবর্তে কৃষক কর্মীদের কাছে যেত । এই ভাবে কৃষক সমাজ থেকে জোতদাররা বিচ্ছিন্ন হতে লাগল ।
এল নির্বাচনের লড়াই। ১৯৪৫-৪৬ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে দিনাজপুর জেলাতে তপশিলি কেন্দ্রে কৃষকের ছেলে এবং কৃষক আন্দোলনের কর্মী রূপনারায়ণ রায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী, সেই কারণে এই নির্বাচন অসাধারণ গুরুত্ব পায়। কংগ্রেস তার সমস্ত শক্তি নিয়ে নামল। কংগ্রেসের সঙ্গে তখনকার কংগ্রেসভুক্ত বিভিন্ন দল, ছাত্র, অধ্যাপক, উকিল, মোক্তার, শহর অঞ্চলের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী একত্র হলো রূপনারায়ণকে হারানোর জন্য। ওই জোতদারশ্রেণি এতদিন পর যেন মুক্তির পথ পেল । কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে এতদিনের আক্রোশ এবার তারা মেটাবে। কংগ্রেস ও অন্যান্য দল কমিউনিস্ট বিরোধী এক ফ্রন্ট তৈরি করল। আর জোতদার শ্রেণি কৃষক আন্দোলন বিরোধী ফ্রন্ট করতে চাইল। সেদিনকার কংগ্রেস তাদের রাজনীতি বিসর্জন
দিয়ে জোতদার এমনকি জমিদারের সঙ্গে মিলে রূপনারায়ণকে হারানোর জন্য এক বৃহৎ কৃষক বিরোধী ঐক্য প্রতিষ্ঠা করল। মুসলমানদের নির্বাচন পৃথক। কিন্তু সাধারণ মুসলমান চাষিরা দলে দলে রূপনারায়ণের পক্ষে প্রচারে নেমে গেল। বড় বড় মুসলমান জোতদার এবং মুসলিম লিগের পাণ্ডারা কংগ্রেসের পক্ষে নামল। নির্বাচনে রূপনারায়ণ জয়ী হলো। এই নির্বাচন লড়াইয়ের মাধ্যমে কৃষকদের অনেকেই বক্তৃতা দিতে শিখল ৷ কংগ্রেস ও জোতদারদের যুক্তির বিরুদ্ধে পালটা যুক্তি দেওয়া শিখল । আর তারা জানল যে, কৃষকদের বিরুদ্ধে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও জোতদাররা একত্রিত হয়েছে।
নির্বাচনের সাফল্য যেমন এক দিকে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করল তেমনি অন্য দিকে হতাশা ও নৈরাশ্য সৃষ্টি করল। উত্তরবঙ্গের কৃষকদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হলো মুসলমান কৃষক। প্রায় দশ বৎসর আন্দোলন করেও মুসলমান কৃষক শ্রেণিকে টানতে পারা যায়নি। এতে হতাশা দেখা দিল। কৃষক আন্দোলনে অনেক মুসলমান কর্মী ও নেতা এসেছিলেন কিন্তু আন্দোলন তাদের যেন মুসলমান সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। অথচ, মুসলমান কৃষকেরা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আর্থিক সংগতির দিক থেকে রাজবংশী ও সাঁওতাল কৃষকদের থেকে উন্নত। এরা স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ, বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী, অধিকতর বৈষয়িক জ্ঞানসম্পন্ন, উদার ও দরদি মন। এত সব গুণ থাকা সত্ত্বেও এই মুসলমান কৃষক শ্রেণিকে আন্দোলনে টানতে পারা যায় নাই। মনেপ্রাণে সহানুভূতিশীল ও সমাজসেবী হওয়া সত্ত্বেও মোল্লা-মৌলবিদের ভয়ে সাহস করে এগিয়ে আসতে দ্বিধা করত। তবু প্রচুর মুসলমান কৃষক বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে কিন্তু মুসলমান সমাজের উপর তার প্রভাব পড়ে নাই। নির্বাচনের সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসলমান কৃষকরা এসে অভিযোগ করেছে যে মুসলমান নির্বাচন কেন্দ্রে কেন মুসলমান কৃষককে দাঁড় করানো হয় নাই। অনেক গবেষণা হয়েছে কিন্তু এর প্রকৃত কারণ কী তা নির্ণয় করা সম্ভব হয় নাই। অনেক সময় মনে হতো যে, মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে বহু বিবাহের ও পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে স্ত্রী-শিক্ষা প্রবর্তন-এইরকম কিছু সমাজ সংস্কার আন্দোলন করা প্রয়োজন। কিন্তু তা কেবল জল্পনাতেই থেকে গেল। কারণ, মুসলমান কৃষক শ্রেণির মধ্যে ধনী কৃষকের প্রভাব রাজবংশী ও সাঁওতালদের চাইতে বেশি ছিল। ধানের দর যখন মন প্রতি বারো আনা থেকে এক টাকা ছিল তখন তাদের মধ্যে বিক্ষোভ ছিল। যুদ্ধের সময়ে যখন ধানের দর এক ধাপে আট-দশ টাকা উঠে গেল তখন তাদের বিক্ষোভ দূর হলো। সঙ্গে সঙ্গে এই সব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বিলোপ হলো। তখন অবশ্য কৃষি আয়কর প্রবর্তিত হলো ৷ বর্তমান অবস্থা আরও শোচনীয়। খাজনার হার যা ছিল তার চাইতে এখন শতকরা পঁচিশ ভাগ বেড়ে গেছে। জোতদার ও ধনী কৃষকের দল বর্তমান বাজারে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা করে ধান বিক্রি করে প্রভূত অর্থ রোজগার করছে অথচ তার জন্য তাদের কোনো বাড়তি ট্যাক্স দিতে হয় না। এইভাবে কালো টাকার সঞ্চয়ে এক উন্নতশীল বাজার সৃষ্টি হয়েছে। নতুন নতুন সাইকেল আর তার সঙ্গে ট্র্যানজিস্টার রেডিয়োর ছড়াছড়ি। ধনী কৃষক আর জোতদারদের টাকার অঙ্ক বছরে বছরে ফেঁপে উঠছে। এই প্রক্রিয়া যুদ্ধের সময় থেকে আরম্ভ হয়েছে।
এই সময় তেভাগা আন্দোলন আরম্ভ হয়। যুদ্ধের সময় থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দর ক্রমেই বেড়ে চলছিল। তার উপর চাষের সমস্ত খরচ আধিয়ারকে বহন করতে হয়। এই কারণে উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগ হবে-দুই ভাগ আধিয়ার পাবে আর যদি জোতদার চাষের খরচ দেয় তবে ভাগ অর্ধাংশ হবে ।
দেখতে দেখতে এই তিন জেলাতেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল। তেভাগা আন্দোলনের তীব্রতা দিনাজপুর জেলাতে সবচেয়ে বেশি ছিল। ধান কেটে নিজ খোলানে উঠাত। ‘জান দিব, ধান দিব না'—এই ধ্বনি চারিদিক ছেয়ে ফেলল। লিগ সরকার থেকে আপসের প্রস্তাব এল দশ আনা ছয় আনা অর্থাৎ আধিয়ার দশ আনা পেলে জোতদার পাবে ছয় আনা। কৃষক সমিতির প্রস্তাব ছিল তেভাগা অর্থাৎ আধিয়ার দশ আনা আট পাই আর জোতদার পাঁচ আনা চার পাই। এর এক পাই কম হবে না ! আলোচনা আর এগোল না ।
তেভাগা আন্দোলন অতি দ্রুত ব্যাপকতা লাভ করেছিল। এরূপ আর কোনো আন্দোলনের ক্ষেত্রে হয়নি। সরকার ও জোতদারের নিষেধ সত্ত্বেও আধিয়াররা ধান কেটে নিজ নিজ খোলানে উঠাল । জোতদার ও পুলিশ একযোগে কৃষকদের উপর চড়াও হলো। গুলি, লাঠি, জেল, আগুন লাগানো, মারপিট, গুণ্ডামি, খুন-জখম এই সব চলা সত্ত্বেও কৃষকদের লড়াইকে দমানো গেল না ।
যে সমস্ত অঞ্চলে সংগঠিত কৃষক আন্দোলন, সেইখানেই তেভাগা আন্দোলনের ঢেউ লাগল । মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের ঢেউ আসতেই মুসলমান কৃষকরা এক অভিনব উপায়ে তেভাগা আন্দোলন শুরু করল। ধান কেটে তারা জোতদারের খোলানে পাঁজা করে বরাবরের মতো রেখেছে কিন্তু তেভাগা আন্দোলনের কথা এসে পৌঁছোতেই মুসমান কৃষকরা সংঘবদ্ধ হয়ে মুসলমান জোতদারদের খোলান থেকে পাঁজা করা ধান ভেঙে আনল। জোতদারের সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস একযোগে তেভাগা আন্দোলনের বিরুদ্ধে নেমে পড়ল। দুই হাজারের উপর কৃষক গ্রেফতার হলো-তাদের মধ্যে কমপক্ষে তিন-চারশো মুসলমান কৃষক, পঞ্চাশ-ষাট জন কৃষক মেয়ে ছিল। তদানীন্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভ্যগণ ও সম্পাদক তেভাগা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারে নামল কিন্তু তারা একেবারে হতাশ হলো। বড় বড় মুসলিম নেতারাও ‘ইসলাম বিপন্ন’ ধুয়া তুলে মুসলমান কৃষকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করল কিন্তু যখন তারা সফল হলো না তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাবার চেষ্টা করল। তবু তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। শুরু হলো নির্যাতন, কৃষকের বাড়ি বাড়ি হানা দেওয়া, মারপিট, বাড়িতে আগুন দেওয়া এবং অবশেষে বেপরোয়া গুলি করা। হিন্দু-মুসলমান, সাঁওতাল কৃষক মেয়ে পুরুষ মিলে চল্লিশ জন নিহত হলো। জোতদাররা শঙ্কিত হলো। কংগ্রেস তখন দেশকে স্বাধীন করার জন্য দিল্লি, সিমলা ও বিলাতে নতুন কায়দায় আন্দোলন করছিল। তারা তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে উত্তরবাংলার এই জাগ্রত গণ আন্দোলনকে দমন করার জন্য উঠেপড়ে লাগল । মুসলিম লীগ তেভাগা ও কৃষক আন্দোলনের বিরোধিতা করাকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অন্যতম কর্মসূচি বলে মনে করল। এই বিরাট গণআন্দোলনকে দমন করার জন্য যে হিংস্র ও পাশবিক নির্যাতন চলছে তার বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণিও প্রতিবাদ
বা কোনো প্রতিরোধ আন্দোলন করেনি। যদিও আন্দোলনের শুরু হওয়ার সময় বিখ্যাত শ্রমিক নেতা কৃষক জনসমাবেশে আশ্বাস দিয়েছিল—‘যদি কৃষকের উপর গুলি চালানো হয়, তবে রেলের চাকা বন্ধ হবে'। পরে কৃষক কর্মীরা অনেক ঠাট্টা বিদ্রূপ করেছে। তারা নিজেরা ছড়া বানাল-‘আল্লা খ্যাম দে পানি দে; খোদা তুই এ্যালের চাকা বন্ধ কইরা দে' । নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটা প্রচ্ছন্ন অবিশ্বাসের সুর উচ্চারিত হলো ।
কৃষকদের অপূর্ব বীরত্বের কাহিনি লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হলো, অনেক কৃষক আত্মগোপন করে আন্দোলন চালিয়ে গেছে। যে সমস্ত এলাকায় আন্দোলন খুব তীব্র হয়েছে সেখানে পুলিশ ও মিলিটারির ঘাঁটি বসল। যারা আত্মগোপন করে আছে তাদের গ্রেফতার করার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। তাদের বাড়ির মেয়েদের তীক্ষ্ণ নজরে রাখা হলো। জঙ্গলে লুকিয়ে আছে সন্দেহে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। এই সময়কার অনেক ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একদিন ভোরে দুই জন সিপাহি রাইফেল কাঁধে নিয়ে টহল দিতে একটি ভাঙা জরাজীর্ণ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। বাড়ির সামনে একজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করল-‘এ বাড়ি কার'? লোকটি উত্তর দিল-‘আজ্ঞে নয়ান বর্মণের' ।
সিপাহি- ‘সে কোথায়?'
লোক— ‘সে তো আপনাদের ভয়ে পালিয়ে গিয়াছে।'
সিপাহি- ‘কেন পালিয়ে গিয়াছে?'
লোকটি— ‘ওকে দেখলেই তো ধরে নিয়ে যাবেন।'
সিপাহি— ‘পালিয়ে বেড়ানোর দরকার নেই, ওকে বলো, সে যেন হাজির হয়ে কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে আসে। বাড়ি তো একেবারে ভেঙে গেছে, এখন যদি মেরামত না করে তবে চৈত্র-বৈশাখের ঝড়ে বাড়ি পড়ে যাবে।'
কিছু দূর যেতেই তারা দেখল জোতদারের লোক তাদের দিকে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে। কাছে আসতেই— ‘ওকে ধরো, ওকে ধরো, ওই তো নয়ান বর্মণ ।' সিপাহি দুই জন আর জোতদারের লোক ছুটে এসে দেখে নয়ান বর্মণ উধাও ।
তখন দেশে গভীর রাজনৈতিক সংকট। এই রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের পথ কী? কংগ্রেস ও লীগের ঐক্য? সারা দেশে তখন শ্রমিক বিক্ষোভ। অধিকাংশই হলো আংশিক অথবা আঞ্চলিক লড়াই। সেই সময় কলিকাতায় ট্রাম শ্রমিকগণ প্রায় দুই মাস ধর্মঘট করে । সর্বনিম্ন দাবির অনেক কমে রফা করে তারা আংশিক সাফল্য লাভ করে। অর্থাৎ আপস ও লড়াই এই দুটো একইসঙ্গে চলবে। আর কৃষকদের ক্ষেত্রে হলো আপসহীন লড়াই। এই তিন মতের প্রভাবে রাগান্ধ উন্মদনার অনিশ্চয়তা এক অস্বস্তি কর বিমূঢ় ভাবের সৃষ্টি করল। আর তখনই এল দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতা। কৃষক আন্দোলনের এক অধ্যায় শেষ হলো। এক যুগের পরিসমাপ্তি। সেই সঙ্গে বাস্তব বিবর্জিত ভাবাবেগ ও উল্লাস, অভিজ্ঞতাশূন্য বক্তব্যের উপর বিশ্বাস রাখা অথবা নিজেদের দুর্বলতাকে ঢাকবার জন্য অন্যের উপর দোষারোপ করার অসুস্থ রুচির যুগেরও কি পরিসমাপ্তি হলো? সংকীর্ণ জীবনবোধের পরিবর্তে নতুন জীবনবোধের অনুভূতি আর পুরানো অকেজো মূল্যায়নের বদলে কি নতুনভাবে মূল্যায়ন করার যুগ শুরু হলো? ১৯৩৯-৪০ খ্রিষ্টাব্দে সংগঠিত কৃষক আন্দোলন সরকারের আইনকে প্রকাশ্যে অমান্য করে সশস্ত্র পুলিশের সম্মুখীন হয়। এর পূর্বে কেউ ধারণা করতে পারে নাই দিনাজপুর জেলার অবহেলিত রাজবংশী কৃষকেরা ও মুসলমান সাঁওতাল চাষিরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। এতে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম ভাগে সেতাবগঞ্জ হাটে প্রায় দুইশো- তিনশো কৃষক
ভলান্টিয়ার পুলিশ কর্ডন ভেঙে হাটে নেমে তোলাবন্ধ আন্দোলন করে। দারোগা কৃষক নেতা জাল মোহম্মদকে বলে-‘১৪৪ ধারা জারি আছে। তোমরা কেউ আইন ভেঙো না।' তাতে জাল মোহম্মদ উত্তর দেয়-‘দারোগাবাবু, এতকাল আইন করে আসছেন, এবার আমাদের আইনটা শোনেন, আপনার ১৪৪ করলেন-আমরা কৃষকরা ১৪৫ করলাম'-বলেই দারোগার মাথার টুপি খুলে নিজের মাথায় পরে সমস্ত কৃষক ভলান্টিয়ার নিয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে হাটে ঢুকে পড়ল এবং তোলা বন্ধ করে দিল। এর জন্য জাল মোহম্মদ সহ অনেকের ছয় মাসের জেল হয়। এই সময়ে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গি থানায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিটিং করতে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য-আইন ও শৃঙ্খলা যাতে ব্যাহত না হয়। তখন কৃষক নেতা রামলাল সিং, বাধাল সিং প্রভৃতির নেতৃত্বে বিরাট কৃষক বাহিনী মিটিং-এ উপস্থিত হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে তারা প্রশ্ন করেন, ‘যখন জোতদাররা বেআইনি আদায় কর ও চক্রবৃদ্ধি সুদ আদায় করত, তখন আপনার কোথায় ছিলেন? এবার যখন কৃষকেরা এই বে-আইনি আদায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে-আপনারা আসছেন। কাজেই আপনারা জোতদারদের স্বার্থে আসছেন।' পরে গোলমালে মিটিং ভেঙে যায় এবং রামলাল সিং, বাধাল সিং প্রভৃতি নেতাদের ছয় মাস করে জেল হয়। এর কিছুদিন পরে পার্বতীপুর থানার চাঁদের হাটে তোলাবন্ধ আন্দোলন চলছিল। ইউনিয়ন বোর্ড অফিসে পুলিশ ক্যাম্প বসেছিল। পুলিশ আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ করতে লাগল। কৃষক মেয়েদের সঙ্গে পুলিশের গণ্ডগোল হয়। কয়েকজন মহিলাসহ কৃষক কর্মীকে গ্রেফতার করে ইউনিয়ন বোর্ডে নিয়ে আসে, এই খবরে তিন-চারশত কৃষক কর্মী এসে ইউনিয়ন বোর্ড অফিস ঘেরাও করে রাখে। পুলিশ বেয়নেট নিয়ে তাড়া করে। খণ্ডযুদ্ধ হয়। সারা রাত সংঘর্ষ হয়। অনেক কৃষক আহত হয়। তার মধ্যে রজনী বর্মণ ও মহেশ বৰ্মণ জেলে মারা যায়। বহু কর্মী গ্রেফতার হয় ও ছয় মাস করে জেল হয়। এইভাবে কৃষকদের সাহস ও সংগ্রামী চেতনা বেড়ে যায়। কাজেই তেভাগা আন্দোলনের কথা উঠতেই এই সব কৃষক আবার জাগ্রত হলো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এবং নির্বাচনে কৃষকের ছেলে রূপনারায়ণ জয়লাভ করায় কৃষকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহ সৃষ্টি হলো।
তেভাগা আন্দোলন আরম্ভ হতেই গ্রামে গ্রামে আওয়াজ উঠল-তেভাগা চাই । নিজ খোলানে ধান তোলো। এই আওয়াজ সারা জেলায় ছড়িয়ে পড়ল। উপেক্ষিত নিভৃত গ্রামগুলো মুখরিত হলো। জোতদার সম্প্রদায় ভীত হলো। অপর দিকে লীগ মন্ত্রিসভা আস্থা রাখতে পারল না। সরকার এক প্রেস নোট বের করে সরকারের নীতি ঘোষণা করল ।
এই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে সাম্প্রদায়িক শান্তি বিঘ্নিত হয়। আড়ি ও শৃঙ্খলা বিপন্ন হয়। সরকার বর্গাদারের সমস্যা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখছে। সুতরাং সরকার আশা করে যেন প্রতি বৎসর যেভাবে ধান কাটাই ও মাড়াই হতো এবং যেভাবে ধান উঠত এবারও যেন তাই হয়। সরকারি প্রেসনোট কৃষকদের উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলল। কৃষকেরা জানেন যে, তাঁদের দাবিকে সরকার একেবারে নস্যাৎ করে দিয়েছে। সুতরাং লড়াই ভিন্ন অন্য পথ নাই ।
নভেম্বর মাসের শেষ ভাগে গ্রামে গ্রামে ভলান্টিয়ার বাহিনী গড়া হলো । কৃষক মেয়েরাও ভলান্টিয়ার হলো। দিন-রাত ধান পাহারা দেওয়া চলল-জোতদারের দল যেন অসতর্ক মুহূর্তে ধান কাটতে না পারে। ঠাকুরগাঁও মহকুমার অধীন আটোয়ারি, বালিয়াডাঙ্গি ও রানীশংকৈল থানার লাগালাগি পুর্নিয়া জেলার চোপড়া, ইসলামপুর এবং গোয়ালপোখর থানায় (বর্তমান থানাগুলো পশ্চিম দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর মহকুমার অধীন) হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বড় বড় জোতদারের দল বিহার অঞ্চল থেকে গুণ্ডা এনে জোর করে ধান কাটবে এই গুজব রটতেই দলে দলে কৃষক মেয়ে-পুরুষ ভলান্টিয়ার পাহারা দেওয়া আরম্ভ করল। কৃষক কর্মীর আত্মীয়রা বিহার অঞ্চলের এই সমস্ত জায়গায় থাকায় তাদের সঙ্গে দেখা করে তেভাগা আন্দোলনে যাতে তাদের সহানুভূতি ও সমর্থন পাওয়া যায় তার চেষ্টা চলতে থাকে ।
দূরন্ত শীতের রাত্রে পাহারা দেওয়া চলল । আরও ঠিক হলো, যে আধিয়ারের ধান কাটার উপযুক্ত হবে তখন দলে দলে ভলান্টিয়ার গিয়ে ধান কেটে আধিয়ারের খোলানে উঠিয়ে জোতদারকে সংবাদ দেবে আধিয়ারের খামারে ধান মাড়াই হবে। ধান তিন ভাগ হয়ে দুই ভাগ আধিয়ার আর এক ভাগ জোতদারকে দেওয়া হবে। জোতদারের দল এস. ডি.ও-র কাছে কৃষক কর্মীদের বিরুদ্ধে ফৌঃ কাঃ বিঃ ১০৭/১৪৪ ধারায় দরখাস্ত দায়ের করতেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো। বালিয়াডাঙ্গি থানায় যখন ভলান্টিয়াররা আধিয়ারের ধান কাটছে তখন পুলিশ গিয়ে উপস্থিত হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে সকলকে গ্রেফতার করল। পরদিন যথারীতি অন্য ভলান্টিয়াররা এসে অবশিষ্ট ধান কেটে আধিয়ারের খোলানে উঠাল। এই ঘটনার পর ঠিক হলো, গ্রেফতার এড়াতে হবে। যদি পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তবে আন্দোলনে বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে। সুতরাং গ্রামে প্রবেশের রাস্তার মুখে ভলান্টিয়াররা পাহারা বসাল পুলিশ দেখলেই খবর পাঠাবে। অপরিচিত লোক গ্রামে আসলেই তার উপর নজর রাখতে হবে। পরিচিত অপরিচিত ঠিক হবে কী করে? অন্য অঞ্চলের কৃষক কর্মীও তো আসতে পারে! ১৯৩৯- ৪০ খ্রিষ্টাব্দে যে রীতি চালু করা হয়েছিল সে রীতিই প্রবর্তন করা হলো। ‘কমরেড ইনক্লাব' বলে মুঠি তুলে সকলে অভিনন্দন জানাবে-এই পরস্পরের পরিচিতির সংকেত। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তেভাগা আন্দোলন যখন পুরোদমে চলছিল তখন লন্ডন থেকে ‘ডেইলি টেলিগ্রাফে'র বিশেষ সংবাদদাতা দিনাজপুর জেলায় যে সমস্ত অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন বিশেষ তীব্র হয়েছিল সেই সমস্ত অঞ্চলের কয়েকটি জায়গা ঘুরে ঘুরে যে রিপোর্ট দেয়, তাতে উল্লেখ আছে যে, কৃষকদের মধ্যে এই ধারণা এত ব্যাপক ও বদ্ধমূল ছিল যে তাকে কিছুটা সংস্কার-প্রবণ বললেও চলে। ‘কমরেড ইনক্লাব' মুষ্টি তুলে এই অভিবাদনে যে সাড়া দেবে না সে কৃষক আন্দোলনের সমর্থক নয়। এর কয়েকদিন পরেই আবার এক দল সশস্ত্র পুলিশ রানী শংকৈল থানার এলাকায় হানা দিয়ে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন কৃষক কর্মীকে গ্রেফতার করে। এক জায়গায় এসে কর্মীদের মারধর করে। সঙ্গে সঙ্গে এই খবর ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে কৃষক ভলান্টিয়ার এসে জুটল ।
কৃষক
এক কৃষক মেয়ের নেতৃত্বে ভলান্টিয়ার দল পুলিশকে ঘিরে ফেলে তাদের হাত থেকে বন্দুক, লাঠি আর দারোগার রিভলবার কেড়ে নিয়ে দারোগাকে এক ঘরে আটকিয়ে রাখে এবং ভাণ্ডনী বর্মণী নিজে পুলিশের রাইফেল কাঁধে নিয়ে পাহারা দেয় । প্রায় দুই ঘণ্টা পুলিশকে আটকে রেখে তারা ধৃত কর্মীদের ছাড়িয়ে নেয়। যাওয়ার সময় পুলিমের বন্দুক, লাঠি, রিভলবার ফেরত দেয়। সন্ধ্যার আগে আগেই দলে দলে পুলিশ বাহিনী আসে। সারা রাত ধরে গ্রেফতার আর খানা তল্লাশি চলল। কিন্তু যাদের প্রথমে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের কাউকেই পুলিশ ধরতে পারল না। চল্লিশ জন লোককে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। ‘জান দিব তবু ধান দিব না’, ‘তেভাগা চাই'! জোতদারেরা ভীত হলো। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি হতেই ব্যাপক ধান কাটা শুরু হলো। জোতদারদের গোলায় ধান উঠল না। দলে দলে জোতদারেরা সেদিন কোর্ট, এস. ডি. ও., ম্যাজিস্ট্রেট এবং থানা পুলিশের কাছে অনবরত ধরনা দিতে লাগল । তপশিলি ফেডারেশনের জনৈক নেতার উক্তি—‘পঙ্গপালের মতো ভলান্টিয়ারের দল ধান খেতের উপর পড়ছে আর ধান কেটে তুলছে।' ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারি মাসের কয়েকদিন থাকতেই পুলিশ চিবির বন্দর থানার তালপুকুরে কৃষক নেতাদের উপর চড়াও করে । পুলিশ এসেছে খবর রটতেই শীতের সেই ভোররাত্রেই দলে দলে হিন্দু, মুসলমান, সাঁওতাল ভলান্টিয়াররা এসে পুলিশকে জিজ্ঞেস করল—‘কৃষক নেতারা কী করেছে যে তাদের গ্রেফতার করছ?' এক বাড়ির ষোলো-সতেরো বৎসরের একটি ছেলে কুয়ার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। গুলি ছুড়ল পুলিশ-সেই গুলি তার বুকে এসে লাগল। গুলি থামতেই পুলিশ লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ।
কৃষকেরা বুঝতে পারল জোতদারদের সুবিধার জন্যই তাদের ধরা হচ্ছে । ‘আমরা ধরা দিব না।' তাতে কথা কাটাকাটি থেকে উত্তেজনা বাড়তে লাগল। লোকও ক্রমশ বাড়তে লাগল। মুহুমুহু স্লোগান-‘পুলিশি জুলুম বন্ধ করো’, ‘জোতদারদের দালাল পুলিশ’, ‘কৃষকের শত্রু পুলিশ’, ‘জান দিব, তবু ধান দিব না’, ‘তেভাগা চাই' । কাঁধের উপর রাইফেল হাতে পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল—যে পুলিশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের একমাত্র ভরসা! সুরাবর্দি লীগ সরকারের একমাত্র ভরসা আর সেদিনকার কংগ্রেস ও লীগের মিলিত ইনটেরিম গভর্নমেন্টেরও ভরসা। তাদের পিছনে জনসমর্থন নাই-তাই তারা চায় তাজা রক্ত। যখন জায়গায় জায়গায় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা হচ্ছে আর তখন কি না এই অবহেলিত উপেক্ষিত উত্তরবাংলার গ্রামে রাজবংশী, মুসলমান, সাঁওতাল কৃষক মেয়ে পুরুষেরা একত্রিত হয়ে বিরোধিতা করছে। হত্যার উৎসবে মেতে উঠল। কৃষকদের মৃত্যুর মুখে পাঠাব। রাইফেল উঠল। কয়েক রাউন্ড গুলি চলল । অনেকেই আহত হলো। সাঁওতাল যুবক শিবরাম ও মুসলমান কৃষক কর্মী সমিরুদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল । পুলিশের এই উন্মত্ততার থেকে আত্মরক্ষার জন্য সাঁওতালরা তির ছুড়তে লাগল। তাতে একজন পুলিশ মারা গেল। পুলিশ যাদের গ্রেফতার করতে
এসেছিল তাদের অধিকাংশকেই তারা ধরতে পারেনি। তারা আহত ছেলেমেয়েদের নিয়ে গেল। উত্তেজনা বাড়তে লাগল । জোতদাররা ভীত হলো। তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে উঠল। গুলি চালিয়ে এবং বেপরোয়া গ্রেফতার করেও কৃষকদের দমানো গেল না। উপরন্তু, কৃষকদের মধ্যে উৎসাহ উত্তেজনা আরও বেড়ে গেল। যাদের ধরে নিয়ে গেল তাদের জমির ধান যাতে জোতদার না পায় তার জন্য সেদিন থেকে দলে দলে ভলান্টিয়ার এসে ধান কেটে আধিয়ারের খোলানে পাঁজা করল। আহতদের মধ্যে পোহাতু বর্মণ কোনো মতে বেঁচে উঠল তবে তার একটি পা কেটে ফেলতে হলো। তালপুকুরে গুলি ও কৃষক হত্যার সংবাদ যতই ছড়িয়ে পড়তে লাগল ততই আন্দোলনের পরিধি বাড়তে লাগল । নতুন নতুন জায়গায় কৃষকরা একত্র হয়ে সেদিন তেভাগা জারি করে ধান কেটে নিজেদের খোলানে উঠাল। পার্বতীপুর থানা মুসলমান অধ্যুষিত জায়গা। সেখানকার অধিকাংশ জোতদার আধিয়ার মুসলমান-মুসলিম লীগের প্রভাবিত অঞ্চল। ধান কাটার কয়েকদিন আগে বায়কানা হাটে যে বিরাট কৃষক-সভা হয় তাতে আধিয়াররা (যারা অধিকাংশই মুসলমান) তেভাগা দাবি করে। তারা আন্দোলন করবে বলে ঘোষণা করে। জোতদারের দল ‘মুসলিম ন্যাশন্যাল গার্ড' দেয়। নানারূপ হুমকি ও ভয় দেখায়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক প্রচার শুরু করে। তাতে নতুন নতুন মুসলমান কর্মীরা আদৌ ভীত হলো না ।
ছোট মিঞাজান, বড় মিঞাজান, হাকিমুদ্দিন, গিয়াসুদ্দিন প্রভৃতি কৃষক কর্মীরা গ্রামে গ্রামে বিশেষত-মুসলমান কৃষকদের মধ্যে প্রচার আরম্ভ করল। মুসলমান নেতারা আর ‘মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডরা'ও তাদের বিরুদ্ধে প্রচারে নামল। এক দিকে স্লোগান চলল ‘তেভাগা চাই’, ‘নিজ খামারে ধান তোলো'। অন্য দিকে লীগের নেতারা ও ‘মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড’-রা ‘তেভাগা নয়, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান'—এই স্লোগান আরম্ভ করল। এক বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হলো। এর সুযোগ জোতদাররা নিল অর্থাৎ ধান তাদের গোলায় উঠল ।
দেখতে দেখতে এই পুঁজভাঙা আন্দোলন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলল। এই নতুন পরিস্থিতিতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, জোতদার, মুসলিম লীগের নেতারা এক অভাবনীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো। আর কোনো উপায় না দেখে মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য প্ররোচনা দিতে লাগল । গ্রামাঞ্চলে এই হিন্দু মুসলমান কৃষকের অভূতপূর্ব মিলিত লড়াইয়ের সামনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক প্রচার কাজে তো লাগলই না বরং এই সাম্প্রদায়িক জিগির যে জোতদাররা তুলল তাদের বিরুদ্ধে তো এই আন্দোলন ৷
যুদ্ধে পৃথিবীর অবস্থার পরবর্তন হয়েছে। তারা প্রাক যুদ্ধকালীন অবস্থার দিকে যেতে চায় না। তাদের এই নবচেতনাকে মুসলিম লীগের নেতারা আদৌ বুঝতে চায় নাই। কিন্তু এর থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পথ কী? মুসলিম কৃষকদের কাছে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাশবাদ-ঘেঁষা জাতীয়তা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র প্রকাশ হতে চলেছে তাই তারা মরিয়া হয়ে শহরে দাঙ্গা লাগাতে চেষ্টা করতে লাগল । উত্তেজনামূলক সাম্প্রদায়ক জিগির তুলে খোলা তরবারি নিয়ে ‘মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড' মিছিল করতে লাগল। উত্তেজনা বাড়িয়ে এক সন্ধ্যায় মিছিলের কয়েকজন খোলা তরবারি নিয়ে সদর রাস্তায় অবস্থিত মন্দিরের বারান্দায় উঠে পড়ল-কিন্তু এতেও দাঙ্গা হলো না । গোটা জেলাতে তীব্র জঙ্গি কৃষক আন্দোলন চলছে। সমস্ত লোকের মনে এক সাড়া জাগিয়ে তুলেছে। এই সঙ্গে বহুকালের অপ্রকাশিত ঘটনা ও তথ্য প্রকাশিত হলো। কীভাবে কৃষকদের বঞ্চনা করা হয়েছে। জালখত লিখে মিথ্যা মামলা করে-সাদা কাগজে টিপসহি নিয়ে জমি বিক্রয়ের কবলা তৈরি করে। মিথ্যা ঋণ দেখিয়ে এমনি করে আরও কত রকমের জুয়াচুরি করে থানা-পুলিশ কোর্ট-কাচারির সাহায্যে কৃষকদের জমি থেকে ছিন্নমূল করে। একশত বৎসরের ধারাবাহিক তথ্য প্রকাশ হলো। এর সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রকাশ পেল যে আজকাল যারা বড় বড় জোতদার কি হিন্দু মুসলমান-তিন পুরুষ আগে তাদের কেউ দারোয়ান ছিল, কেউ কেউ ডাকাত ছিল। ডাকাতি করে, চুরি করে, চোরাই মালের মজুতদার হয়ে প্রচুর টাকা আয় করে কৃষকদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে তাদের মেরে ফেলে জমি গ্রাস করেছে। কীভাবে তারা গুণ্ডা লাগিয়ে কৃষক মেয়েদের জোর করে ইজ্জত লুট করে বর্বরোচিত অত্যাচার করেছে। কিন্তু এর প্রতিকারের কোনো চেষ্টা করা হয় নাই। এই সমস্ত ঘটনা প্রকাশিত হলো এবং জোতদারদের অন্যায় জুলুম ও অত্যাচারে স্বভাবতই সাধাররণ মানুষের সমর্থন ও সহানুভূতি কৃষকদের উপরে পড়ে। শহরের সাধারণ মুসলমান বাসিন্দারা ন্যাশনাল গার্ডদের এই উস্কানি সমর্থন করল না বরং সমালোচনা করল। এছাড়া এমন একটি ঘটনা ছিল যে তেভাগা আন্দোলনের জন্য অন্যান্য জেলা থেকে প্রচুর পুলিশ আনতে হয়েছে। এদের মধ্যে এক বৃহৎ অংশ হিন্দু পুলিশ ছিল। অনেক পুলিশ অফিসারকেও আনতে হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেক হিন্দু অফিসারও ছিল। এই সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার ফলে যদি দাঙ্গা লাগে তখন এই পুলিশ বাহিনীর মধ্যেও বিভাজন আসতে পারে। এই আশঙ্কায় স্থানীয় ও প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ এই সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিতে চাইল না। ফলে, মুসলিম লীগের এই চেষ্টা ব্যর্থ হলো। দলে দলে মুসলমান কৃষক আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় মুসলিম লীগের নেতারা আতঙ্কিত হলো। কংগ্রেস নেতারা কমিউনিস্ট বিরোধী কুৎসার অভিযানে মেতে উঠল। কিন্তু কয়েক মাস আগে নির্বাচনের সময় বুদ্ধিজীবীদের বৃহৎ অংশকে তাদের পক্ষে পেয়েছিল-কিন্তু তারা এবার তা পেল না। প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতারা এলেন এবং শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ডাকলেন; তাদের কাছে কমিউনিস্ট বিরোধী কুৎসা প্রচার করে এক কুৎসিত দৃষ্টান্তের পরিচয় দিলেন। কিন্তু সে বৈঠকেও কেউ কেউ প্রশ্ন তুললেন—কৃষকদের তেভাগা দাবি সম্বন্ধে কংগ্রেসের কী মত? সুরাবর্দি মন্ত্রিসভার দমন নীতির বিরোধিতা কংগ্রেস করল না কেন? কংগ্রেস নেতারা এর সদুত্তর দিতে পারেন নাই। আন্দোলন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলল। ধানকাটা শেষ হয়ে গেল । জোতদারদের নির্দিষ্ট খোলানে ধান উঠল না । অনেক অঞ্চলে যেখানে প্রথম দিকে আন্দোলন হয় নাই এই আন্দোলনের ঢেউ আসতেই কৃষকরা নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়ে জোতদারদের পুঁজ থেকে ধান ভেঙে আনল ।
মিলিটারি ও পুলিশ আমদানি হলো। যে সমস্ত অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন তীব্র সে সব এলাকায় পুলিশ ও মিলিটারির ঘাঁটি বসল। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে পুলিশি অভিযান আরম্ভ হলো। অনেক কৃষক কর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো। তাদের ধরার নাম করে বাড়ি বাড়ি পুলিশি হানা চলল । ঠাকুরগাঁও মহকুমার বালিয়াডাঙ্গি থানা জুড়ে তেভাগা আন্দোলন চলছিল। পুলিশ বিখ্যাত কৃষক কর্মী ডোমারায় সিং-এর বাড়িতে হানা দিন। পুলিমের সঙ্গে জোতদার আর তাদের ভাড়া করা গুণ্ডারা থাকত। কোনো কোনো বাড়ি হানা দিতে হবে, কারা স্থানীয় কৃষক কর্মী, কাদের বাড়িতে কৃষক সমিতির বৈঠক হয়—এই সমস্ত তথ্য জোগাড় করে দিত। কমরেড ডোমা সিং, কাজবর সিং এই অংঞ্চলের বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। এদের বাড়ির মেয়ে পুরুষরা ‘চল্লিশ’-এর আন্দোলন সক্রিয় অংশ নিয়েছিল। তাদের । পুলিশ ধরতে পারে নাই। তাদের উপর জোতদারদের সবচাইতে বেশি আক্রোশ ছিল । এক দিন ভোরবেলা সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল। যে i কৃষকদের পুলিশ খোঁজ করছিল, তাদের কেউ কেউ সে রাত্রে ওই বাড়িতে ছিল । পুলিশ
আসছে সংবাদ পেয়ে তারা আগেই সরে পড়ল। পুলিশ গিয়ে তাদের কাউকেই পেল S না। পুলিশ বিরক্ত হয়ে বাড়ির লোকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। গুলি চালাল। সঙ্গে সঙ্গে
একজন মহিলাসহ চার জন মারা গেল আর আট-দশ জন আহত হলো। দলে দলে অসংখ্য পুলিশ আসতে লাগল। বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে আধিয়ারদের বাড়ি থেকে জোর করে ধান, চাল, গরু-বাছুর, ছাগল, হাঁস, মুরগি নিতে লাগল। দেখতে দেখতে পুলিশ আর জোতদারদের এই সম্মিলিত অভিযান গোটা জেলাতে ছড়িয়ে পড়ল। পুলিশের এই নগ্ন হিংস্রতার তাণ্ডব চলল। জঙ্গলে কৃষক কর্মীরা পালিয়ে আছে সন্দেহে গ্রামের জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, যখন পুলিশের তাণ্ডব চলছিল সেইসময় একদিন দুপুরে একজন কৃষক প্রতিনিধি মোটরে দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগাঁও যাওয়ার পথে এই ঘটনা নিজ চোখে দেখে যায়। কৃষক কর্মীদের বাড়িতে হানা দিয়ে যখন তাদের খোঁজ পেত না তখন পুলিশের সামনেই জোতদারের দল বাড়ির লোকদের উপর মেয়ে পুরুষ নির্বিশেষে লাঠি ও লোহার ডাণ্ডা দিয়ে অমানুষিক মারধর করত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ নীরব নিষ্ক্রিয় দর্শক হতো। কখনও কখনও পুলিশ এদের সঙ্গে যোগ দিয়ে লুটের ভাগ নিত। চিরিরবন্দর থানা এলাকার মধু বর্মণকে প্রচণ্ড মার দিয়ে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। মধু বর্মণ মরে গেছে মনে করে ঝোপের ভেতর ঠেলে দিয়ে পুলিশ ও জোতদারের গুণ্ডারা পালিয়ে যায় । পরে গ্রামের মেয়েরা ওই ঝোপের থেকে তাকে নিয়ে সেবা শুশ্রূষা করে। এরপর এক কৃষক আন্দোলনের সমর্থক দীর্ঘদিন তাকে চিকিৎসা করে। মধুর বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ছিল কিন্তু এই ঘটনার পর পুলিশ তাকে চালান করার সাহস পায় নাই। এই হিংস্র অত্যাচার ও বর্বরতার মিছিল শহরে ঢোকার আগেই পুলিশ সেই নিরস্ত্র শান্তিপ্রিয় মিছিলের উপর গুলি চালায়। চার জন সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। নিয়ামত সহ কয়েকজন মুসলমান কর্মী গুরুতর আহত হয় । পরে নিয়ামতের একটি পা কেটে ফেলতে হয়।
এক দিকে পুলিশ আর জোতদারেরা নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে আর অন্য দিকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা সভা করে সুরাবর্দি মন্ত্রিসভায় এই দমননীতিকে সমর্থন করে কমিউনিস্ট বিরোধী কুৎসার অভিযান চালায়। এই সময় সুরাবর্দি মন্ত্রিসভা তেভাগা আইনের খসড়া বিল প্রকাশ করল। ফেব্রুয়ারি মাসের কুড়ি তারিখে পুলিশ বালুরঘাট থানার খাঁপুর গ্রামের কয়েকজন কৃষক কর্মীকে গ্রেফতার করে ট্রাকে উঠাল। মুহূর্তে শত শত হিন্দু মুসলমান কৃষক মেয়ে পুরুষ এসে যায়। তারা এই কৃষক কর্মীদের মুক্তির দাবি করে। পুলিশ তাদের দাবিতে কর্ণপাত করে না। ট্রাক
" চালানোর চেষ্টা করতেই কৃষকেরা ট্রাক ঘিরে ফেলে; তখন পুলিশ বেপরোয়া গুলি চালাতে লাগল। চিয়ার সাই শেখ ও যশোদাদেবীর নেতৃত্বে একদল কৃষক কৰ্মী এই গুলির মধ্যে ট্রাকের টায়ার নষ্ট করার জন্য বল্লম ছুড়তে থাকে। পুলিশের গুলিতে যশোদাদেবী মারা যায়। চিয়ার সাই শেখ পড়ে গেল এবং বল্লম হাতে মাটির উপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে এগিয়ে চলল। টায়ার লক্ষ্য করে বল্লম ছুড়তেই বুকে তার গুলি লাগে। সে গুলির আঘাতে আরও মারা যায় বারো জন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। পরে আহতদের মধ্যে আটজন হাসপাতালে মারা যায়। এভাবে তেভাগা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি হলো। জোতদার ও পুলিশের চাপে ছোট ছোট জোতদার ও মাঝারি কৃষকগণ প্রথম দিকে নিরপেক্ষ ছিল। পরে তারা বড় জোতদারদের সঙ্গে যোগ দিল। তার ফলে, তাদের উপর খেপে গিয়ে কৃষকরা তাদের ধান তেভাগা করল। ছোট জোতদার ও মাঝারি কৃষকের ধান তেভাগা করা হবে না-এই নীতি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা যায়নি ৷
এই বিরাট আর ব্যাপক কৃষক আন্দোলন অতীতে আর এত বড় হয় নাই। আভিজাত্যের উপর এত বড় প্রচণ্ড আঘাত যে আসতে পারে, আভিজাত্যাভিমানিগণ ও বুদ্ধিজীবীগণ আদৌ ধারণা করতে পারে নাই। বুদ্ধিজীবীদের এক বড় অংশ সাংবাদিক, সাহিত্যিকেরা কৃষকদের বিরুদ্ধে জোতদারদের কাজে সায় দিল। মুক্ত মন দিয়ে আন্দোলনের বিচার করবার চেষ্টা তারা আদৌ করেনি। এক প্রচণ্ড শক্তির বিরুদ্ধে কৃষকরা একাই লড়াই করল অথচ ধনিক কৃষকরাও কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়ায় নাই! শ্রেণিগত চেতনা উদ্ভূত হয়ে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করার অনুভূতিও সেদিনকার শ্রমিক শ্রেণির ছিল না ।
সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী এতবড় গণ-আন্দোলন হলো। বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ এর মূলকথা বিশ্লেষণ করে বুঝবার চেষ্টা না করে নিজেদের সংস্কৃতির দীনতার পরিচয় দিল। ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাস বাদ দিয়ে এতবড় প্রচণ্ড আন্দোলন সবরকম সামাজিক কুসংস্কারের মূলে আঘাত হেনে, এক তপ্ত আলোড়ন সৃষ্টি করে, অভিজাত শ্রেণির মর্যাদা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। তার কৃষ্টিগত ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন ছিল। এটা সত্য যে, সাম্রাজ্যবাদ সামঞ্জস্য রেখে গণচেতনামূলক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। আভিজাত্যের শাসনে বাঁধা সাংস্কৃতিক প্রভাব মুক্ত হয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অর্থাৎ দায়িত্ব সম্বন্ধে চেতনা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা সৃষ্টি না হওয়ায়-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে-দিশেহারা ভাব দেখা দিয়েছিল। দেশের প্রকৃত রূপ, ঐতিহ্য যেন মুছে গেল। ঐতিহ্য গেলে থাকল কী? কিন্তু জীবনের উত্তাপ কোনো দিন নিঃশেষ হয় না। এক যুগের ব্যর্থতা নিষ্প্রভতা মেহনতি মানুষকে কখনও নিষ্ক্রিয় ও নির্জীব করতে পারে না। এই আন্দোলন বিশেষত তেভাগা আন্দোলন এক সৃজনশীল প্রতিভার জন্ম দিয়েছিল। এক দিকে ছিল সংগ্রামী উন্মাদনা অন্যদিকে ছিল হিংস্র পাশবিকতা। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, উত্তরবাংলার এই কৃষকরা এত শক্তি পেল কোথায়? এই আন্দোলন কি একটি অর্থনৈতিক দাবি আদায়ের আন্দোলন? সম্ভবত তা নয়! নিছক অর্থনৈতিক দাবি আদায়ের আন্দোলন এত ব্যাপক, এত জঙ্গি, এত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে কি না সন্দেহ জাগে। সংগ্রামী কৃষকদের দৃঢ়তা, ঐক্য বোধ এবং > ৪৬৭০০.০০% অপূর্ব আত্মত্যাগ এক অনুপ্রেরণাময় ঘটনা। এর মূলে ছিল এক বাস্তব জীবনাদর্শ আর সেই আদর্শবোধ সংগ্রামের এই প্রেরণা ও উন্মদনা জাগিয়েছিল। ছাড়া ছাড়া কৃষক আন্দোলন এর আগে আরও হয়েছে। এক নতুন আদর্শবাদ এই আন্দোলনের প্রেরণা । ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর জেলায় যে সংগঠিত কৃষক আন্দোলন হয় তার একটা মূল বক্তব্য ছিল-কৃষক-মজুররাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কৃষক-মজুররাজ কৃষক মজুরের সমস্ত দাবি পূরণ করে দেবে। ধনীর পরিবর্তে কৃষক-মজুরের রাজ-এই রাজবংশী, সাঁওতাল ও মুসলমানরা সর্বপ্রথম জানল যে রাশিয়ার কৃষক-মজুর, বড়লোকের রাজত্ব খতম করে কৃষক-শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে জমিদার, মুনাফাখোর, জোতদার, চোরাকারবারি এই সব রক্ত শোষকের দল নাই, তাদের নির্মূল করা হয়েছে । ধনীর রাজত্বের বদলে কৃষক মজুরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করাই হলো তাদের আদর্শ। অক্টোবর বিপ্লবের কুড়ি-বাইশ বছর পর অক্টোবর বিপ্লবের বার্তা এসে পৌঁছাল উত্তরবাংলার নিভৃত পল্লীর এই অবহেলিত উপেক্ষিত মানুষের দরবারে। সমগ্ৰ কৃষক সমাজ এক উন্নত চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। তেভাগা আন্দোলনের পর ত্রিশ বৎসর পার হয়ে গেছে। মানুষের মূল্যায়নে এ যেন এক জীবন্ত দলিল, অপূর্ব প্রেরণাময় ইতিহাস ।
তেভাগা আন্দোলন ব্যক্তিপূজার মূলে প্রচণ্ড আঘাত দেয়। সে সময় দেশে ব্যক্তিপূজার প্রাধান্য ছিল। তেভাগা আন্দোলন সমগ্র দেশের সামনে কৃষি সংস্কারকে তুলে ধরেছিল। কৃষকদের রাজনৈতিক চেতনা যে কত উন্নত তেভাগা আন্দোলন তার জ্বলন্ত স্বাক্ষর। অন্য দিকে জমিদার, জোতদারদের নিকৃষ্ট জঘন্য চেহারা জনসমাজে প্রকাশিত হলো। খাজনা আদায়, বে-আইনি আদায়, সুদ প্রভৃতির জন্য পুরুষানুক্রমে কৃষকদের উপর যে কী জুলুম অত্যাচার হতো, তা প্রকাশ করার মতো নয়। শীতের রাতে জলের চৌবাচ্চার মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হতো। বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিত। বউ, মেয়েদের লুট করত! আর কথায় কথায় মারপিট তো ছিলই। তখন জোতদারদের সকলেরই বন্দুক ছিল। অধিকাংশ জোতদার তাদের বন্দুক ডাকাতদের ভাড়া দিত ডাকাতি করবার জন্য। ফলে তারা ডাকাতির একটা বখরা পেত। তেভাগা আন্দোলন যে নবচেতনা সৃষ্টি করেছিল সে চেতনা ভবিষ্যতে কতদূর যাবে তা কেবল ভবিষ্যতের সংগ্রামী কৃষকরাই উত্তর দেবে। বাস্তব বিবর্জিত, ভাবাবেগ, সংকীর্ণ জীবনবোধের পরিবর্তে এক নতুন জীবনবোধের কি শুরু? ভবিষ্যতের সংগ্রামী মেহনতি মানুষ এর উত্তর দেবে।
১৩.৫ তেভাগা আন্দোলনে কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ কয়েকটি বিশেষ ঘটনা
ভারত উপমহাদেশে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছিল। ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে জমিদার ও মধ্যবিত্তদের অনেকেই ভারতের স্বাধীনতার কথা বলত ঠিকই, কিন্তু সাধারণ কৃষক মজুরের অর্থনৈতিক মুক্তির কোনো কথা তাদের মুখ থেকে বেরুত না। স্বাধীনতার যেমন প্রয়োজন ছিল কৃষক-মজুরের, তেমনি জমির মধ্যবিত্ত মালিক ও বড় বুর্জোয়াদেরও। অবশ্য বড় বুর্জোয়াদের প্রয়োজন ছিল এই অর্থে যে মেহনতি মানুষকে শোষণের পথকে নিজেদের জন্য সুগম করতে। সে সময় কৃষকদের অবস্থা বড়ই
শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। সারা বছর খেটে বর্গা কৃষকদের সামন্ত প্রভুদের গোলায় ধান তুলে দিতে হতো। বিভিন্ন কৌশলে কৃষকদের কাছ থেকে ধান নিয়ে নেওয়া হতো। দিয়ে-থুয়ে চাষি যা পেত তাতে তাদের তিন-চার মাসের বেশি চলা কঠিন হয়ে পড়ত। আবার তাদের সামন্ত প্রভু বা জোতদারদের কাছে হাত পাততে হতো। এক মন ধান নিলে ধান কাটার সময় দুই থেকে তিন মন ধান জোতদারদের হাতে তুলে দিতে হতো। তখন বর্গাচাষিদের এ রকম শূন্য হাতে বাড়ি ফেরা ছাড়া কোনো উপায় থাকত না । এরই বিরুদ্ধে উত্তরবঙ্গের কৃষকসমাজ, বিশেষ করে দিনাজপুর রংপুর জেলার কৃষকরা জোর আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এই আন্দোলনের মূল কথা ছিল: জোতদার পাবে উৎপন্ন দ্রব্যের তিন ভাগের একভাগ। কৃষক পাবে দুই ভাগ। তবে যদি জোতদার ফসল উৎপন্ন করার বীজ, বলদ এবং অন্যান্য খরচ দেয় তা হলে কৃষক পাবে আধাআধি । কিন্তু জোতদাররা বীজধান, চাষের খরচ, বলদ এ সব দেবার জন্য কষ্ট স্বীকার করত না। ফসলের আধা ভাগও ছাড়ত না। চাষিরা বুঝতে পেরেছিল যে লড়াই না করলে জোতদারের কবল থেকে তাদের রক্ষা নেই। তাই তারা লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়েছিল । এই সংগ্রামই তেভাগার লড়াই বলে পরিচিত।
দিনাজপুর জেলার প্রথম আন্দোলনের সূচনা হয় ১৩৫৩ বঙ্গাব্দের ১৪ পৌষ। এই দিন থেকে কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ধান কাটা শুরু হয়। সেই সময় কৃষকরা ‘নিজ খোলানে ধান তোলো' স্লোগান দিয়ে ধান তুলতে আরম্ভ করে। আগে কৃষকবা জোতদারের খোলানে ধান তুলত। কিন্তু যখন কৃষকরা নিজ খোলানে ধান তোলে তখন প্রথম পাঁচ-ছ' দিন জোতদাররা কৃষকদের বাধা দিতে দাঁড়ায়। কিন্তু হাজার হাজার কৃষক ভলান্টিয়ারের সামনে তাদের ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল কিছুই করতে পারেনি। জোতদারেরা আর্মড পুলিশ আনবার ব্যবস্থা করে। এই ফৌজের সাথে কৃষক পুরুষ ও মেয়ে ভলান্টিয়ারদের বাবরবার সংঘর্ষ বাঁধে। ২০ পৌষ আটোয়ারি থানার রামপুর মলানি গ্রামে সংঘর্ষের সময় পুরুষেরা ধান কেটে এবং মেয়েরা চারিদিকে *আলের উপর দাঁড়িয়ে দা-কুঠার, বঁটি, ঝাড়ু প্রভৃতি নিয়ে পাহারা দেয়। আর্মড ফৌজ মেয়েদের বাধা সত্ত্বেও এগিয়ে আসার চেষ্টা করে। কৃষক মেয়েরা তখন দা-কুঠার যা পারে তাই নিয়ে ফৌজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গাইন দিয়ে পিটিয়ে ফৌজের পাঁচ- ছটি বন্দুক ভেঙে দেয়। হাজার হাজার মেয়ে ভলান্টিয়ারদের সাথে না পেরে আর্মড ফৌজ পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই মেয়ে বাহিনী পরিচালনা করেন রোহিনী বর্মণ ও জয়মণি বৰ্মণ ।
এই ঘটনার পরে কৃষকদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু কৃষকদের ধরার জন্য দারোগা সাহেব গ্রামে ঢুকতে সাহস করেনি। জোতদাররা ভীত হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যায়। গ্রামে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য গ্রামে গ্রামে
1 কৃষক আদালত বসে। এই আদালত কমরেড কম্পরাম সিং (যিনি ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপরা ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন), কমরেড আভারণ সিং, কমরেড রাজেন সিং, কমরেড ডোমী সিং, কমরেড বিভীষণ সিং ও কমরেড তিলক সিংকে নিয়ে গঠিত হয়। এরপর সব কৃষকরা দলে দলে কৃষক আদালতের কাছে
সাহায্য চায়। তখন জোতদাররা গ্রামাঞ্চল ছেড়ে শহরে বা কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয় । কৃষক আদালত আদেশ জারি করে: বাড়ি প্রতি এক ভাই, এক লাঠি ও এক টাকা জমা দিতে হবে।
ঘটনার পরদিন থেকে আবার কৃষকরা জোতদারের ধান কাটতে আরম্ভ করে। এ সময়ে এক জোতদার বাধা দেয় এবং গুলি করে। কৃষক ভলান্টিয়াররা ক্ষিপ্ত হয়ে জোতদারকে ঘিরে ফেলে এবং বন্দুকসহ তাকে গ্রেফতার করে। সেই জোতদারকে কোমরে দড়ি বেঁধে কৃষক আদালতে হাজির করা হয়। তারপর বিচারে ২০০ টাকা জরিমানা হয়; ২০০ টাকা জরিমানা দিয়ে জোতদার সাহেব মুক্তি লাভ করে। এর পরেই পুলিশের এক জমাদার সাহেব গ্রামে আসামি ধরার জন্য যায় এবং বাঘা বর্মণ নামে এক কৃষক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করে। তখন হাজার হাজার মেয়ে ও পুরুষ লাঠি, দা, কুডুল, গাইন, তিরধনুক প্রভৃতি নিয়ে জমাদার ও পুলিশদের ঘেরাও করে। দারোগা কোনো উপায় না দেখে পুলিশকে গুলি করার হুকুম দেয়। পুলিশ গুলি চালালে তিন- চার জন আহত হয়। তাগুনী রোহিনী বাহিনী তখন গাইন চালাতে আরম্ভ করে। এর ফলে পাঁচ-ছয় জন পুলিশ বন্দুক ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং জমাদার গ্রেফতার হয়। তাকে একটা ইস্কুলে ধরে আটকে রেখে মেয়েরা বন্দুক লাঠি ও গাইন নিয়ে পাহারা দেয়।
জমাদার একদিন একরাত আটক থাকার পর দারোগা সাহেব মেয়েদের কাছে এসে বলেন, ‘মা, পুলিশ গুলি ছুড়ে খুবই অন্যায় করেছে। আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি, জমাদারকে নিয়ে তোমরাও এস. ডি. ও. সাহেবের কাছে চলো। সাক্ষী দিতে হবে ।' ভাণ্ডনী পরিষ্কার জবাব দেয়, ‘তোমরা চালাকি করে আমাদের গ্রেফতার করতে চাও। তা হবে না, আমরা যাব না এবং তোমাকে ও তোমার জমাদারকে গুলি ছোড়ার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। আর কোনো দিন যেন ফৌজ নিয়ে গাঁয়ে না ঢোকে তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যেতে হবে। তবেই আমারা তোমার জমাদারকে বন্দুক ফেরত দেব।' অগত্যা জমাদার সাহেব ক্ষমা চেয়ে জীবন নিয়ে ফিরে যায়। এই ঘটনা ঘটে রানীশংকৈল থানার গুয়া গাঁয়ে। পক্ষান্তরে চিরিরবন্দর থানায় আসামি ধরতে গিয়ে এক দারোগাকে মেয়েদের হাতের ঝাড়ু খেতে হয় এবং ঝাড়ুর বাড়িতে দারোগা সাহেবের মাথা ফেটে যায়। বাধ্য হয়ে দারোগা সাহেব গুলি ছোড়ার হুকুম দেয় এবং শিবরাম ও সমিরউদ্দিন শহিদ হয় ৷
পতিরাম থানা খাঁপুরে আসামি ধরার জন্য আর্মড ফৌজ পাঁচখানা পুলিশ ভ্যান নিয়ে যায় এবং কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। কৃষক পুরুষ ও মেয়েরা পুলিশ ভ্যান যাতে না পালিয়ে যেতে পারে সেজন্য রাস্তা খুঁড়ে গর্ত করে পুলিশভ্যান আটকায়। এবং তির ধনুক দিয়ে চাকা ফুটো করে দেয়। ফৌজ গুলি চালায় এবং চিয়ারসাই শেখ ও যমুনা সহ ২১ জন শহিদ হয় ।
পুলিশ ঠুমনিয়া লোকাল অফিস ও কৃষক আদালতের হেড অফিস বালিয়াডাঙ্গি থানা আক্রমণ করে। কমরেড মনকটু সিং দুই হাতে লাঠি ঘুরিয়ে পুলিশদের বাধা দেয় । গুলিতে তার পেটের নাড়িভুড়ি বের হয়ে যায়। তবুও সে বাঁ হাতে পেট চেপে ধরে ডান হাতে লাঠি চালায় । দুইজন পুলিশের মাথা ফেটে যায়। কমরেড নিজেও শহিদ হয় ।
এই রকম অসংখ্য বীরত্বের-গাথা তেভাগার লড়াই এক সময় গাঁয়ে গাঁয়ে ঘটেছিল। তখনকার লীগ মন্ত্রিসভা তেভাগা দাবির ন্যায্যতা মেনে নিয়েছিল এবং তেভাগার বিল আইনসভায় উপস্থিত করেছিল। কিন্তু ইংরেজ শাসকেরা দেশ বিভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কংগ্রেস সভায় উপস্থিত করেছিল। কিন্তু ইংরেজ শাসকেরা দেশ বিভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কংগ্রেস ও লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় ৷ ফলে তখন বিল আর আলোচনা হয়নি ।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় তেভাগা আন্দোলন
দীনেশ লাহিড়ী তেভাগা আন্দোলনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবে, সালটা আমার মনে নেই, খুব সম্ভব ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে হবে। আমাদের রংপুর জেলায় সেইবার কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশ অনুযায়ী তপশিলি আসনে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামি। আমাদের প্রার্থী ছিল দু'জন, হরিশ্চন্দ্র সরকার ও নির্মলেন্দু বর্মণ। নির্বাচনের পূর্বদিনের ঘটনা বলছি। কলকাতা থেকে ‘স্বাধীনতা' পত্রিকার সংবাদদতা কমরেড নিখিল চক্রবর্তী ডিমলা নির্বাচনি শিবিরে ঘোর সন্ধ্যার সময় রংপুর থেকে বরাবর এসে উপস্থিত হলেন। তিনি এসেই চা পানের পর জানালেন, আজ রাত্রেই দূরবর্তী গ্রামে পৌঁছতে হবে। গয়াবাড়ি হরিকান্ত সরকারের বাড়ি এবং নির্বাচন কেন্দ্র । রাত্রেই মোটর যোগে যে কোনোভাবেই হোক, তাঁকে পৌঁছতে হবে। সর্বনাশ, আমরা প্রত্যেকেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। কারণ, গয়াবাড়ি পর্যন্ত ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের যে কাঁচা সড়ক আছে, তাতে মানুষ ও গোযান চলতে পারে, কিন্তু মোটর চলাচল করতে পারে না। নিখিলবাবুও নাছোড়বান্দা; বললেন, ‘কমরেড, আজ রাত্রিতে যদি আমি গয়াবাড়ি পৌঁছাতে না পারি, তাহলে পার্টির সমূহ ক্ষতি হবে।' কৃষক কমরেডদের তখন যেন চৈতন্যের উদয় হলো। একজন বললেন, ‘রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাব কমরেড।' ভাঙা রাস্তা মেরামত করে যে কোনোভাবেই হোক মোটর পৌঁছে দেয়। দু'জন কমরেড তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে মোটরে উঠে বসল। পরদিন খবর পেলাম সারারাত্রি খেটে গ্রামবাসীদের সাহায্য নিয়ে তারা জায়গায় ভাঙা রাস্তা মেরামত করে মোটর চালাবার ব্যবস্থা করেছেন। রাত্রি তিনটার সময় নিখিলবাবু ও তাঁর সহযোগী বন্ধু গয়াবাড়ি পৌঁছান ।
এখনও মাঝে মাঝে আমার কানে যেন প্রতিধ্বনিত হয়, ‘কমরেড! রাস্তা নেই, তাতে কী? রাস্তা তৈরি করে অগ্রসর হতে হবে।' নিখিলবাবু ‘স্বাধীনতা'র রিপোর্টে লিখেছিলেন, ‘হ্যাঁ’ একেই বলে সংগঠন।' রংপুর জেলার আরও একটি ঘটনার কথা বলছি। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তেভাগা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে। আমাদের মধ্যে অনেকেই গ্রেফতার এড়াবার উদ্দেশ্যে গোপন আশ্রয়ে বসে আছি। এমন সময় সংবাদ এলো পুলিশ আমাদের কর্মী মহেশ বর্মণের বাড়ির দিকে আসছে। অতএব আমাকে তাড়াতাড়ি সরে পড়তে হবে। আর যাব কোথায়? ধারে কাছে কৃষক কর্মী মথুরা মিস্ত্রির শোয়ার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। ঘরের দরজার কাছে মথুরা মিস্ত্রির ভাইপোর বউ উরুন গাইনে (কাঠের উদূখল ও দণ্ড) ধান ভানছিল। নিমেষে আমার ঘরে ঢুকবার কারণটা বুঝে নিল, তারপর নিম্নস্বরে বলল, ‘কমরেড, মাচার ‘তলোয়’ সোঁদাও (ঢোকা)।' আমি বাধ্য হয়ে মাচার তলোয় প্রবেশ করলাম। সে তৎক্ষণাৎ একটা ধানের ডোল আমার সম্মুখভাগে রেখে দিয়ে তারপর ‘উরুন-গাইন' দিয়ে ধান ভানবার কাজ শুরু করে দিল। আমি মৃদু হাস্য করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যদি পুলিশ টের পেয়ে এই ঘরে ঢুকে আমাকে গ্রেফতার করে, তা হলে তুমি কী করবে বউমা?' কৃষক মহিলা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, ‘অ্যাঁ, পুলিশের বাবার শক্তি হবে না, তোমাকে গ্রেফতার করবার। এই গাইন দিয়া উয়ার ঠ্যাং ভাঙ্গি দিমো, হ্যাঁ।' আমি ওর কথা শুনে অবাক ।

তেভাগা আন্দোলন ব্যর্থতাও ত্রুটি


তেভাগা আন্দোলন সেদিন তার সফল পরিণতিতে পৌঁছাতে পারেনি। তার কারণ, এই আন্দোলনে কয়েকটি বড় ত্রুটি ছিল। প্রথমত এই আন্দোলন দেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে স্বতন্ত্র ভাবে অগ্রসর হয়েছিল। দেশের সর্বস্তরের স্বাধীনতাকামী মানুষ এই আন্দোলনকে নিজেদের আন্দোলন বলে মনে করতে পারেনি। এর বিপ্লবী গণতান্ত্রিক চরিত্র উপলব্ধি করতে পারেনি। এই আন্দোলন যে মধ্যবিত্তদের টানতে পারেনি তার একটি কারণ শহরের উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, মধ্যবিত্তদের অনেকেরই গ্রামে অল্প-বিস্তার জমি ছিল এবং সে জমি ভাগচাষি দিয়ে চাষ করানো হতো। তাই তারা অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকে এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে এবং অনেকে নির্বিকার থেকেছে। নেতৃত্বের দিক থেকে এই ছোট জোতদার ও স্বাধীনতাকামী মধ্যবিত্তদের টেনে আনার উপযুক্ত পথ গ্রহণ করা হয়নি।
প্রয়োজন ছিল তেভাগার দাবি যে ন্যায্য, এই আন্দোলন যে মূলত সামন্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক প্রকৃতির, এটা যে স্বাধীনতা সংগ্রামেরই সহায়ক, সে বিষয়ে প্রদেশব্যাপী প্রচার অভিযান চালানো ।
দ্বিতীয়ত আন্দোলনের প্রথম দিকে শ্রমিক নেতৃত্ব কৃষকদের এই আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানালেও কার্যক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণি কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। কৃষকদের দাবি নিয়ে প্রচার ও সংহতিমূলক সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেনি। শ্রমিক কৃষকের মিলিত সংগ্রাম-অভিযানই এই আন্দোলনে প্রাণশক্তি জোগাতে পারত। আর
শ্রমিক-কৃষক সংহতির জোয়ার মধ্যবিত্তদেরও টেনে আনতে পারত। শ্রমিক-কৃষক- মধ্যবিত্তের মিলিত আন্দোলনই তেভাগা আন্দোলনকে জয়যাত্রার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত ।
তৃতীয়ত এই আন্দোলন দেশের স্বাধীনতাকামী অন্যান্য শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নানা অপপ্রচারের সুযোগ পেয়েছে, কমিউনিস্ট বিরোধিতার জিগির তুলেছে। আর তারই ফলে বিদেশি রাজের হাত শক্ত হয়েছে। তারা নির্বিবাদে দমনপীড়ন চালাতে পেরেছে। এই হলো আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ও ত্রুটির দিক ।
তেভাগা আন্দোলনের গুরুত্ব
ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের পথে তেভাগা আন্দোলন কয়েকটি উজ্জ্বল দিক তুলে ধরেছে। এতে এর গুরুত্ব প্রমাণিত হয় ।
প্রথমত তেভাগা আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে কৃষককুলের ভিতর কী প্রচণ্ড শক্তি নিহিত। এই শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারলে কী বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলতে পারা যায়!
দ্বিতীয়ত কৃষক আন্দোলন গড়তে হলে চাই, কৃষকদের নিজস্ব গণসংগঠন । গ্রামে গ্রামে কৃষক সমিতির জাল বিস্তার করতে হয়। শুধু প্রচার অভিযানই নয়, সময়মতো উপযুক্ত দাবি নিয়ে আন্দোলনই কৃষকদের সংগঠিত করার শ্রেষ্ঠ উপায় । আবার সংকটের দিনে গঠনমূলক সংগ্রামও কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে ।
তৃতীয়ত এটাও দেখা গেছে বাইরে থেকে বিপ্লবী কর্মীরা যদি গ্রামে এসে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে পারে কৃষকদের সাথে একাত্ম হয়ে উঠতে পারে—তবেই কৃষকদের আস্থা অর্জন করা যায়—তাদের সংগঠিত করা যায়।
চতুর্থত শুধু মধ্যবিত্ত কর্মী থাকলেই চলে না; কৃষকদের ভেতর থেকে কর্মী ও নেতা গড়ে তুলতে পারলে তবেই সে আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে ও সত্যকারের কৃষক আন্দোলনে পরিণত হয় ।
পঞ্চমত আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠলে কর্মীর অভাব হয় না। টাকা পয়সার অভাব হয় না, আর অনেক অজানা, অখ্যাত কর্মী অপূর্ব বীরত্ব দেখায়, দুর্জয় সাহসে এগিয়ে আসে, নির্ভয়ে প্রাণ দেয়। তাই কৃষকদের এই বিরাট আন্দোলন-এই অসীম আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়নি ।
তেভাগা আন্দোলনের দাবি সামান্য অর্থনৈতিক দাবি ছিল সন্দেহ নেই কিন্তু গোটা পটভূমি, তার গতি ও পরিণতি নিছক অর্থনৈতিক প্রকৃতির ছিল না। তখনকার দিনের কৃষক আন্দোলনের প্রায় এক দশকের পরিণতিতে যে তেভাগার লড়াই শুরু হয়েছিল, সেই কালপর্ব জুড়ে কৃষকদের ভেতর এসেছিল এক নব জাগরণ, এক নব চেতনা, শ্রেণিচেতনা। ইংরেজ আমলে ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের সামনে প্রধান
লক্ষ্য ছিল দুটি। রাজনৈতিক দিক থেকে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল ছিন্ন করে দেশ স্বাধীন করা আর সামাজিক দিক থেকে মধ্যযুগীয় প্রতিক্রিয়াশীল জোতদারি, জমিদারি ব্যবস্থা, যা দেশের অগ্রগতির পথে ছিল প্রধান বাধা—সেই সামন্ত ব্যবস্থার উচ্ছেদ করে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়া ।
আন্দোলন সফল হলো, কি সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলো তাই দিয়ে কোনো আন্দোলনের বিপ্লবী ভূমিকার বিচার হয় না। যতদিন শোষণ ব্যবস্থা কায়েম থাকে—ততদিন নানা কারণে আন্দোলনের সাময়িক পরাজয় হতেই পারে। কিন্তু তাতে আন্দোলনের প্রকৃতি বদলে যায় না। আন্দোলনকে বিচার করতে হয় সে যুগের বিপ্লবের পটভূমিতে। কোনো শ্রেণি প্রধান শত্রু, কোনো শ্রেণি সেই শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাচ্ছে-আন্দোলন প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থাকে আঘাত করছে কি না-প্রভৃতির নিরিখে সেই আন্দোলনের চরিত্র বিচার হয়। সেই বিচারে তেভাগা আন্দোলন ছিল সামন্ত শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলন। সে দিনের বোম্বাইয়ের নৌ-বিদ্রোহ যেমন পরাজিত হলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে কাঁপিয়ে তুলেছিল- স্বাধীনতার আন্দোলনে তার ছিল বড় একটা অবদান, তেমনি তেভাগা আন্দোলন পরাস্ত হলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তার তল্পিবাহক সামন্তপ্রভুদের জোর ধাক্কা দিয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনে তার অবদান পরোক্ষ হলেও নিশ্চয়ই অনস্বীকার্য।
তেভাগা আন্দোলন সামান্য তেভাগার দাবিতে শুরু হলেও দাবিটা আধিয়ার বা ভাগচাষির দাবি হলেও-যেহেতু এই আন্দোলন, গোটা সামন্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই ছিল বিদ্রোহ, তাই প্রায় সর্বস্তরের কৃষকই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে এই বিদ্রোহী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। বড় জোতদার, জমিদার দলও শ্রেণি হিসেবে এই আন্দোলনের প্রতিরোধে নেমেছিল। যাদের কৃপায় পুষ্ট এই শোষক শ্রেণি-সেই বিদেশি ইংরেজ প্রভুদের রাষ্ট্রশক্তির আশ্রয় তারা নিয়েছিল। ফলে সামন্তবাদ বিরোধী তেভাগার আন্দোলন কৃষকদের একেবারে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রশক্তির মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে, এই আন্দোলনকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক রূপ দিয়েছিল। তাই শেষ বিচারে তেভাগার লড়াই ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, সামন্তবাদ বিরোধী বিপ্লবী প্রকৃতির। তখনকার মতো পরাজিত হলেও শহিদের রক্তস্নাত তেভাগা আন্দোলন ভাবীকালের জন্য রেখে গেছে এক গৌরবময় বিপ্লবী ঐতিহ্য। উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে তেভাগা আন্দোলনের গুরুত্ব প্রতীয়মান হয় ।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে অতি সংক্ষেপে বলা যায় যে, এই তেভাগা কায়েমের সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তরবঙ্গের সুবিস্তীর্ণ অঞ্চলে, ব্রিটিশ সরকারের সশস্ত্র পুলিশ তেভাগা আন্দোলন দমনের জন্য সব রকম ব্যবস্থা নিয়েছিল। ফলে সার্বিক প্রতিরোধের অঙ্গীকার সত্ত্বেও কৃষকরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। কিন্তু যে-মরণজয়ী সংগ্রামের স্মৃতি তারা রেখে যায়, তা শুধু গোটা সামন্ত ব্যবস্থাকেই নাড়িয়ে দেয়নি, এক নবজাগ্রত শ্রেণিচেতনাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। সেই সেঙ্গ ভাবীকালের জন্য রেখে গিয়েছিল এক গৌরবময় বিপ্লবী ঐতিহ্য।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]