ঔপনিবেশিক বাংলার প্রধান প্রধান কৃষক প্রতিরোধ বাংলার কৃষক প্রতিরোধের কারণসমূহ

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইংরেজদের বাংলা দখলের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রপাত হয়। নতুন শাসানের প্রয়োজনে বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও সংস্কার আবশ্যক হয়ে পড়ে। আর এ সকল পরিবর্তনের উপর ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে ভূমির ব্যবহার নিয়ে কৃষক শ্রেণি ও সরকারের মধ্যে কখনো বিরোধ বাঁধেনি, বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে উৎপাদনের ভাগাভাগি নিয়ে। কিন্তু এই নীতির আমূল পরিবর্তন ঘটে কোম্পানি আমলে। সর্বাধিক মুনাফা প্রত্যাশী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র দুঃসময়ে খাজনা মওকুফ এবং তাকাভি ঋণের মতো কোনো সুবিধা
প্রদান ছাড়াই সকল কৃষকের উদ্বৃত্ত ফসল আত্মসাৎ করতে ছিল বদ্ধপরিকর। সরকারের ভূমিনীতি প্রজাদেরকে সরকারি প্রতিনিধি তথা ভূস্বামীদের শোষণের শিকারে পরিণত করে। ঐতিহ্যবাহী গ্রাম পঞ্চায়েতের অবর্তমানে বিচ্ছিন্ন গ্রামসমাজ তখন অসহায়ভাবে রাষ্ট্র ও তার প্রতিনিধি যেমন- জমিদার, তালুকদার প্রমুখের শোষণের কবলে পতিত হয়। কৃষকের জন্য সরকার একটি অদৃশ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অথচ কৃষকের দেয় রাজস্বের উপরেই সরকারের সাফল্য নির্ভরশীল ছিল। এছাড়াও প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকদের কৃষক নির্যাতন সম্পর্কে সরকার জেনেও ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। স্বাভবিক কারণেই দেশের সর্বত্র ঔপনিবেশিক শাসন এবং এর পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয় অতি ঘন ঘন। যদিও বাংলার বিশেষ বিশেষ স্থান ছিল বিদ্রোহপ্রবণ। তবে মোটামুটিভাবে বিদ্রোহের ক্ষেত্র ছিল বাংলার প্রতি জেলায় ব্যাণ্ড ।
১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রি. পর্যন্ত বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী কতগুলো কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। মনে হয় কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মনোযোগের অভাব, উপাদানের স্বল্পতা ও বিশ্লেষণের জটিলতা ইত্যাদি ছিল এর অন্যতম কারণ। আমরা সরকারি নথিপত্র ও জেলা গেজেটিয়ারগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আলোচ্য সময়ে সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহের একটি নিম্নরূপ তালিকা প্রণয়ন করেছি, যেগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে ছিল প্রায় এক ও অভিন্ন।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০ খ্রি.)
• ত্রিপুরার শমসের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮ খ্রি.) সন্দ্বীপের বিদ্রোহ (১৭৬৯ খ্রি.)
• কৃষক-তাঁতির সংগ্রাম (১৭৭০-১৮০০ খ্রি.)
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭ খ্রি.)
নীল ও নীল চাষির সংগ্রাম (১৭৭৮-১৮০০ খ্রি.)
মালঙ্গীদের বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০৪ খ্রি.)
রেশম চাষির সংগ্রাম (১৭৮০-১৮০০ খ্রি.) আফিম চাষির সংগ্রাম (১৭৮০-৯৩ খ্রি.) রংপুর কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.)
যশোহর-খুলনার কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৪ ও ১৭৯৬ খ্রি.) বীরভূমের বিদ্রোহ (১৭৮৫-৮৬ খ্রি.)
বীরভূম-বাঁকুড়ার বিদ্রোহ (১৭৮৯-৯১ খ্রি.)
বাখেরগঞ্জের সুবান্দিয়া কৃষক বিদ্রোহ (১৭৯২ খ্রি.) বাংলার চোয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৮-৯৯ খ্রি.)
মেদিনীপুরের নায়েক বিদ্রোহ (১৮০৬-১৮১৬ খ্রি.)
ময়মনসিংহের কৃষক বিদ্রোহ (১৮১২ খ্রি.) সন্দ্বীপের তৃতীয় বিদ্রোহ (১৮১৯ খ্রি.)

প্রতিরোধ আন্দোলনের সংজ্ঞা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং নিম্নবর্গ
ময়মনসিংহের প্রথম পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২৪-৩৩ খ্রি.)
ময়মনসিংহের হাতিখেদা বিদ্রোহ (১৮২৫ খ্রি.)
ওয়াহাবি আন্দোলন (১৮৩১ খ্রি.)
বাংলার তিতুমীরের বিদ্রোহ (১৮৩১ খ্রি.) ময়মনসিংহের গারো বিদ্রোহ (১৮৩৭-৮২ খ্রি.) বাংলার ফরায়েজি বিদ্রোহ (১৮৪০ খ্রি.) ত্রিপুরার কৃষক বিদ্রোহ (১৮৪৪-১৮৯০ খ্রি.) সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭ খ্রি.) নীলবিদ্রোহ (১৮৫৯-৬০ খ্রি.) পাবনা বিদ্রোহ (১৮৭২-৭৩ খ্রি.) তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬ খ্রি.)
নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ (১৯৪৯ খ্রি.)
উপর্যুক্ত কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনের মধ্যে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (অধ্যায়-৪), পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা বিদ্রোহ (অধ্যায়-৫), রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ (অধ্যায়-৬), ময়মনসিংহের পাগলাপন্থি বিদ্রোহ (অধ্যায়-৭), ওয়াহাবি আন্দোলন (অধ্যায়- ৮), ফরায়েজি আন্দোলন (অধ্যায়-৯), সাঁওতাল বিদ্রোহ (অধ্যায়-১০), নীলবিদ্রোহ (অধ্যায়-১১) পাবনা বিদ্রোহ (অধ্যায় - ১২), তেভাগা আন্দোলন (অধ্যায়-১৩) ও নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ (অধ্যায়-১৪) অত্র প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে আলোচনা করা হয়েছে। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে এগুলো সবই ছিল ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন। তাই এখানে শুধু কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনের কারণসমূহ তুলে ধরা হয়েছে ।
বাংলার কৃষক প্রতিরোধের কারণসমূহ
কোম্পানির শাসনামলে (১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রি.) বাংলার কৃষক বিদ্রোহসমূহ একক কোনো কারণে সংগঠিত হয়নি। এই বিদ্রোহসমূহের মূলে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান ছিল । নিম্ন এই কারণগুলো ধারাবাহিকভাবে বিশ্লেষণ করা হলো ।
ইতিহানে দেখা যায় যে, ১৭৬৫ খ্রি. মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের নিকট হতে কোম্পানি কর্তৃক বাংলার দেওয়ানি প্রাপ্তি ছিল এদেশের জনগণের আর্থসামাজিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। কেননা দেওয়ানি শাসনের অন্তরালে শোষণই ছিল বণিক শাসকের চীনে ব্যবসার পুঁজি গঠনের অভিপ্রায় এবং নানামুখী যুদ্ধের খরচ জোগানোর জন্য প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে যেমন- ভূমিব্যবস্থা, প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প উৎপাদনে আমূল পরিবর্তন সাধন করে। সরকারের এই উদ্যোগ প্রচলিত ব্যবস্থাকে নানাভাবে আঘাত করে এবং বিভিন্ন শ্রেণিস্বার্থের জন্ম দেয়। এ নিরিখে সরকার রাজস্বের ক্ষেত্রে বিশেষ দুইটি নীতি গ্রহণ করে, (ক) ভূমি-রাজস্ব আদায়ে · নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন অর্থাৎ ব্যক্তির নিকট থেকে রাজস্ব আদায় করা এবং (খ) ফসলের পরিবর্তে কর প্রদানের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার প্রবর্তন। সরকারের এইরূপ নীতি ছিল কৃষকদের নিকট সম্পূর্ণভাবে নতুন। এর সাথে কৃষককের পূর্ব পরিচয় ছিল না। এই নীতির ফলে অল্প দিনের মধ্যেই বাংলার গ্রাম সমাজের কাঠামো ভেঙে পড়ে। সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয় যার প্রাথমিক শিকার কৃষক ও কারিগর শ্রেণি। এতে তারা ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে ।
পূর্বের মুঘল-নবাবি আমলেও আমরা লক্ষ্য করেছি যে কৃষকের উপর ভূমি রাজস্বের রাষ্ট্রীয় দাবি ছিল ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। তবে সে সময় দুর্দিন তাকাভি ঋণ সুবিধা, প্রয়োজনে জলসেচ ও ঋণ মওকুফেরও সুযোগ পেত কৃষক। এ সকল সুবিধা প্রাপ্তি কৃষকের এক ধরনের অধিকারে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ শাসনে এ সকল সুযোগ সুবিধা থেকে কৃষককে বঞ্চিত করা হয়। এ সময়ে কৃষককে সহায়তা না করে শুধুমাত্র শোষণ করা ঔপনিবেশিক সরকারের নীতি হয়ে ওঠে। ফলে শুরু থেকেই কৃষক ও সরকার সম্পর্কে বৈরী পরিস্থিতির তৈরি হয়। এতে কৃষকরা ব্রিটিশ বিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু করে।
অবিভক্ত বাংলায় মুঘল আমলে রাজস্ব ধার্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও গ্রাম সমাজর মধ্যে একটি সহনশীল নীতি মেনে চলা হতো। তখন জমিদার কৃষকের নিকট হতে পরগনা হারের চেয়ে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে পারতেন না। কিন্তু কোম্পানি শাসনে এই নীতি পরিহার করা হয়। বণিক সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল মুনাফাভিত্তিক আর্থিক নিয়মনীতির অনুশীলন। কোম্পানি সরকারের মূল লক্ষ্য শোষণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিবাদই ছিল এদেশের ফকির-সন্ন্যাষী বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০ খ্রি.) শমসের গাজী বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮ খ্রি.) এবং সন্দ্বীপ বিদ্রোহ (১৭৬৯ খ্রি.) ইত্যাদি। এরা সম্মিলিতভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে । কৃষকদের ভূমি রাজস্ব ব্যক্তিগত দায়িত্বে মুদ্রায় প্রদানের মধ্য দিয়ে কোম্পানি সরকার কৃষক শোষণের আরও একটি নতুন সুযোগ তৈরি করে নেয়। এ প্রক্রিয়ায় কৃষককে অর্থসংগ্রহের জন্য বাধ্যতামূলকাভাবে ফসল বিক্রি করতে হতো। অথচ ক্রেতা বলতে ছিল একমাত্র ইংরেজ সৃষ্ট দালাল ও মহাজন। বাড়তি মুনাফার লোভে ইংরেজরা ১৭৬৯ খ্রি. দুর্ভিক্ষ আসন্ন জেনেও বাংলার খাদ্যশস্য স্বল্পমূল্যে ক্রয় করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। এরই পরিণতি হলো ১৭৭০ খ্রি. ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ। ইংরেজি সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষ বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোকের মৃত্যু হয়, যাদের অধিকাংশ ছিল কৃষক, তাঁতি ও কারিগর শ্রেণি। ইংরেজ লেখকদের অনেকে কোম্পানির অর্থ লালসাকেই এর জন্য দায়ী করেন। এই দুর্ভিক্ষে ব্যাপক সংখ্যক কৃষক, শিল্পী ও কারিগরের মৃত্যুর ফলে বাংলার অর্থনীতিতে ধ্বংস নেমে আসে। এত ভোগান্তির শিকার হয় সাধারণ মানুষ যারা ব্রিটিশ বিরোধিতায় এগিয়ে আসেন এবং ক্রমেই ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন তুঙ্গে উঠে ।
দৃশ্যত ১৭৭০ খ্রি. দুর্ভিক্ষ বণিক রাজের মনে কোনো প্রকার রেখাপাত করেনি। ফলে এই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের রেশ না কাটতেই ইংরেজ শক্তি বাড়তি রাজস্বের জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে। রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ওয়ারেন হেস্টিংস সমুদয় জমি প্রথমে পাঁচবছর ও পরে একবছরের জন্য নিলামের মাধ্যমে ইজারা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এত সর্বোচ্চ দরদাতার নিকট জমি ইজারা দেওয়া হয়। এ সুযোগে জমি ইজারা যারা গ্রহণ করেন তারা ছিলেন উঠতি পুঁজিপতি, বানিয়া ও মুতসুদ্দি। প্রকৃত অর্থে এদের সাথে জমি বা কৃষকের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বল্প সময়ের মধ্যে অধিক মুনাফা প্রাপ্তি। ফলে তারা পরগণা হার অগ্রাহ্য করে ইচ্ছামতো কৃষকের উপর খাজনা ধার্য করেন। এর সাথে যুক্ত হতো নানা প্রকার আবওয়াব। রাজস্বের এই বাড়তি চাপ পড়ত কৃষকের উপর। এরূপ পরিস্থিতিতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতো এবং পরিণামে বিদ্রোহ করতে বাধ্য হতো। পুরো ঔপনিবেশিক শাসনামলে এসব বিদ্রোহ আর প্রতিরোধ চলতে থাকে ।
ব্রিটিশ কোম্পানির শাসনের সফলতার মাপকাঠি ছিল লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন, কৃষকের কল্যাণ বা দেশের উন্নয়ন নয়। যথাসম্ভব অধিক রাজস্ব সংগ্রহ করাই ছিল সরকারের নীতি। এই উদ্দেশ্যেই মূলত ১৭৯৩ খ্রি. ইংল্যান্ডের ভূমিব্যবস্থার অনুকরণে বাংলায় “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” প্রবর্তন করা হয় । এই বন্দোবস্তে জমিদারদেরকে জমির চিরস্থায়ী মালিকরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । ইউরোপীয় ঐতিহাসিক বি. এইচ. ব্যাডেন পাওয়েল (B. H. Banden Powell, 1892) এই ব্যবস্থাকে ‘ভূমি বিপ্লব' বলে অভিহিত করেছেন। এই বন্দোবস্তে লাভবান হয়েছিল জমিদার শ্রেণি আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কৃষক শ্রেণি। তবে প্রথম হতেই চিরস্থায়ী-বন্দোবস্তের দোষত্রুটি ধরা পড়তে থাকে। শীঘ্রই দেখা গেল জমিদার কৃষি ও ভূমিতে পুঁজি বিনেয়োগ না করে বরং মহাজনি ব্যবসায়, সরকারি বন্ড (Bonds) ক্রয় ইত্যাদি লাভজনক ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করছেন। ফলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ভূমি ও কৃষির উন্নয়ন এবং কৃষির সম্প্রসারণ ঘটানো সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয় সে সাথে জমিদার শ্রেণি কৃষি-প্রকৌশল, কৃষকের জন্য জলসেচ এবং তাকভি ঋণ প্রদানের দায়িত্বও বেড়ে গেল। একে অপরের শত্রুতে পরিণত হলেন। এতে কৃষকরা প্রতিরোধমুখী হয়ে উঠে।
বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটি অন্যতম শর্ত ছিল, জমিদার নির্ধারিত সময়ে রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হলে তার জমিদারি কেড়ে নেওয়া হবে বা প্রয়োজনীয় জমি বিক্রি করে বাকি রাজস্ব আদায় করা হবে। এই শর্ত পূরণ করতে না পেরে অনেক জমিদার স্বেচ্ছায় অথবা বাধ্য হয়ে তাদের জমিদারি বিক্রি করে দেন। এদের স্থান দখল করে শহরের চতুর ফড়িয়া ব্যবসায়িগণ । এই নতুন জমিদারশ্রেণি ছিল শহরাবাসী। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বৃত্তি ছিল শহরকেন্দ্রিক। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে এক হিসেবে দেখা যায়, বাংলার দুই-তৃতীয়াংশ জমির মালিক কলকাতার বসবাসকারী ব্যবসায়ী শ্রেণি সুতরাং ক্রয়কৃত জমিজমায় ফসল না হলেও যাতে তাদের অভীষ্ট মুনাফা সঠিক সময়ে আদায় হতে পারে সে জন্য তারা নির্দিষ্ট শর্তে অধিক জমায় স্থানীয় সম্পদশালী ব্যক্তিদের নিকট জমি পত্তনির ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এতে পত্তনিদার নামক এক নতুন ভূমিস্বত্বের সৃষ্টি হয়। এই নীতির ফলে বাংলার কৃষিভূমিতে কোথাও সাতটি, কোথাও সতেরটি এবং কোথাও বা পঞ্চশটি পর্যন্ত উপস্বত্বের বা স্তরের সৃষ্টি হয়েছিল। এই প্রতিটি স্তর ছিল কৃষক শোষণের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং এতগুলো মধ্যস্বত্ব একই জমির উপর যদি জীবিকার জন্য নির্ভর করে তাহলে কৃষকের আর্থসামাজিক জীবনে যে বিপর্যয় নেমে আসে এর ফলেই দেখা দেয় অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ যেমন— চোয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৮-৯৯ খ্রি.), মেদিনীপুরের নায়েক বিদ্রোহ (১৮০৬-১৮১৬ খ্রি.), ময়মনসিংহের কৃষক বিদ্রোহ (১৮১২ খ্রি.), ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২৪-৩৩ খ্রি.), ময়মনসিংহের হাতিখেদা বিদ্রোহ (১৮২৫ খ্রি.), বাংলার তিতুমীরের বিদ্রোহ (১৮৩১ খ্রি.), বাংলার ফরায়েজি বিদ্রোহ (১৮৩৮-৪৮ খ্রি.) এবং সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.) ইত্যাদি। এসব প্রতিরোধ আন্দোলন অবিভক্ত বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্রিটিশ শাসনের অবসান (১৯৪৭ খ্রি.) পর্যন্ত চলতে থাকে ।
ঊনবিংশ শতকে পদার্পণ করার পূর্বেই সরকারের সঙ্গে জমিদার- মহাজনের স্বার্থ-সমন্বয় ঘটার ফলে কৃষকের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ৮ নং প্রবিধানে কৃষকদের কাছ থেকে জমিদারদের বাড়তি কর আদায় নিষিদ্ধ করা হয় এবং কৃষকদের ‘পাট্টা' দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্ত বাস্তবে জমিদার নিজ স্বার্থে কখনই কৃষককে খুব সহজে ‘পাট্টা’ দেয়নি এবং দিলেও তাতে উল্লেখিত শর্তাদি পালনের প্রয়োজন মনে করেনি। নানা কারণে কৃষকও তা গ্রহণে বিশেষ আগ্রহী হয়নি। ফলে উভয়ের (জমিদার ও কৃষক সম্পর্কই থাকত পারস্পরিক সন্দেহযুক্ত ও বৈরিতাপূর্ণ। অন্যদিকে কোম্পানির সরকার ছিল এ বিষয়ে উদাসীন। জমিদারের কাছ থেকে পূর্ব নির্ধারিত রাজস্ব আদায় হলেই সরকার নিজেকে দায় মুক্ত মনে করতো। সরকারি রিপোর্টেও এর সত্যতা স্বীকার করা হয়েছে। এতে সংগত কারণেই কৃষকরা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে ।
অবিভক্ত বাংলায় জমিদার-কৃষক সম্পর্কের নানা অস্পষ্টতার সুযোগ নিতো জমিদারশ্রেণি। তারা নানা অজুহাতে কৃষকের উপর অতিরিক্ত করারোপ করতেন। কিন্তু কৃষকের পক্ষে বাড়তি কর প্রদান সম্ভব হতো না। জমিদার এখানেই বসে থাকতেন না। তিনি তাঁর দাবির পক্ষে সরকারের উপর নানা চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ৭ নং ('হপ্তম' বা সাত) এবং ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে ৫ নং (‘পঞ্জাম' বা পাঁচ) প্রবিধান জারি করেন। এই আইনে খাজনা অনাদায়ে কৃষককে বন্দি, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত এবং দৈহিক নির্যাতন করা যেত। এই আইনের ভয়ংকর পরিণাম সম্পর্কে ইংরেজ বিচারক Dr. Field (১৮৭০) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন যে, "There is scarcely a country in the civilized world in which a landlord is allowed to evict his tenant whithout having recourse to the regular tribunals." বস্তুতপক্ষে উল্লিখিত দুটি আইন ছিল কৃষকদের স্বার্থের বিরোধী। এই ‘হপ্তম’ এবং ‘পঞ্জাম’ প্রবিধানসমূহ বাংলার কৃষকের আর্থসামাজিক দুর্গতিরও যে অন্যতম কারণ ছিল তা ইংরেজ ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করেছেন । ফলে জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে যেমন, তেমনি সরকারের বিরুদ্ধেও বাংলায় অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান দেখা দেয়। এর অন্যতম উদাহরণ হলো, ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২৪-৩৩ খ্রি.), ময়মনসিংহের হাতিখেদা বিদ্রোহ (১৮২৫ খ্রি.), বাংলার তিতুমীরের বিদ্রোহ (১৮৩১ খ্রি.), বাংলার ফরায়েজি বিদ্রোহ (১৮৩৮-৪৮ খ্রি.) এবং সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.) ইত্যাদি ।
লর্ড কর্নওয়ালিসের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’ জমিদারদের দেয় খাজনা বৃদ্ধির কোনো সুযোগ ছিল না। অথচ কোম্পানির প্রয়োজন ছিল বাড়তি আয় । ফলে ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে ১১ নং আইনে জমিদারদেরকে অবৈধভাবে কৃষকদের উপর খাজনা বৃদ্ধির অধিকার এবং স্থায়ী কৃষককে (খোদকাশত) ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে নতুনভাবে ভূমি বন্দোবস্ত প্রদানেরও অনুমতি দেওয়া হয় । এভাবে সরকারি ভাষ্যেই দ্ব্যর্থহীনভাবে কৃষকের অধিকার হননের প্রমাণ রয়েছে। সুতরাং দেশের উন্নতি ও কৃষকের তথাকথিত কল্যাণের নামে বিভিন্ন আইনে তাকে বেঁধে রাষ্ট্র যেখানে সর্বগ্রাসী হয়, সেখানে কৃষক শ্রেণি রাষ্ট্রের দুর্গতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হয় এবং ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পূর্ব পর্যন্ত কোনো না কোনো প্রতিরোধ চলতে থাকে । এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ খ্রি. পর্যন্ত সরকারি নিয়মনীতি, খাজনা সংগ্রাহক জমিদার এবং তৎ-নিম্নবর্তী মধ্যস্বত্বভোগী ও অসংখ্য বাড়তি করারোপ ছিল কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। ড. কুমুদ কুমার ভট্টাচার্য জমিদার কর্তৃক কৃষকের নিকট হতে একত্রিশ প্রকার বাড়তি কর আদায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। আর কেশব চন্দ্র সেন (১২৮০ বঙ্গাব্দ) সম্পাদিত সমসাময়িক সুলভ সমাচার পত্রিকায় এ জাতীয় আরও ভিন্নধর্মী করের কথা উল্লেখ রয়েছে যা যুগপৎ কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে এক নতুন পথ নির্দেশ করে শমসের গাজীর বিদ্রোহের অবসান ঘটে। এই বিদ্রোহের ফলে ইংরেজি সরকার রওশনাবাদ চাকলায় বাড়তি রাজস্ব ধার্য না করতে ত্রিপুরার রাজাকে নির্দেশ দেন। এভাবে এই অঞ্চলে শক্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো হয়। তবে ব্রিটিশের রাজত্বের অন্তিম পর্যায়ে তেভাগার দাবিতে কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন তুঙ্গে উঠে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]