উত্তর ভূমিকা : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এ তিনটি নিয়েই মানবজীবন। মানব সভ্যতার বিবর্তনের পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিক বর্ণনাই হলো ইতিহাস। ইতিহাসের ধারা চির প্রবহমান। মানুষের প্রত্যেকটি বর্তমানের পিছনেই কোনো না কোনোভাবে অতীত লুকিয়ে থাকে। সুখের হোক আর দুঃখেরই হোক এসব অতীত ঘটনা প্রবাহই আমাদের ইতিহাস । জ্ঞানের অন্যতম শাখা হিসেবে অন্যান্য শাখার মতোই ইতিহাসের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্র রচনাশৈলী ও উপস্থাপন পদ্ধতি যাকে এককথায় ইতিহাসের স্বরূপ বলে আখ্যায়িত করে থাকি ।
ইতিহাসের সংজ্ঞা : নিম্নে ইতিহাসের সংজ্ঞা দেওয়া হলো :
সাধারণ সংজ্ঞা : ইতিহাস কী তা এক কথায় বলা কঠিন। কারণ অনেক ঐতিহাসিক ইতিহাসের সংজ্ঞা বিষয়ে নিজেদের মতো করে মত দিয়েছেন। তাই সহজেই নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় পৌঁছা যায় না। তবে পণ্ডিতগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতসমূহ বিশ্লেষণ করে ইতিহাসের একটি সাধারণ সংজ্ঞা তৈরি করা সম্ভব। অতীতে যা কিছু ঘটেছে সাধারণভাবে তাকেই ইতিহাস বলা হয়, কিন্তু অতীতের সবকিছুকেই ঢালাওভাবে ইতিহাস বলা যায় না। শুধুমাত্র অতীতের যেসব ঘটনা প্রবাহ মানুষের দ্বারা নির্মিত ও সংঘটিত বলে জানা যায় তার সত্যনিষ্ঠ লিখিত বিবরণকেই ইতিহাস বলা যায়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : ইতিহাসের বিষয়বস্তু বা মাত্রাগত ভিন্নতার কারণে একেক ঐতিহাসিক একেকভাবে ইতিহাসের সংজ্ঞা প্ৰদান করেছেন। নিম্নে অন্যতম কয়েকটি সংজ্ঞা দেওয়া হলো :
ঐতিহাসিক জনসনের (Johnson) মতে, “যা কিছু ঘটে তাই ইতিহাস; যা ঘটে না তা ইতিহাস নয়। তাই বলা যায়, মানবসমাজের অনন্ত ঘটনাপ্রবাহই ইতিহাস ।”
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের (R. C. Majumdar) মতে, “মানবসমাজের অতীত কার্যাবলির পূর্ণ বিবরণীই হলো ইতিহাস ।” ঐতিহাসিক র্যাপসনের (Rapson) মতে, “ইতিহাস হলো ঘটনার বৈজ্ঞানিক এবং ধারাবাহিক বর্ণনা ।”
ইতিহাসবেত্তা ই. এইচ. কারের (E. H. Carr) মতে, “ইতিহাস হলো বর্তমান ও অতীতের মধ্যে এক অন্তহীন সংলাপ । ” ইংরেজ ইতিহাসবেত্তা আর্নল্ড টয়েনবির (Arnold Toynbee) মতে, “মানবসমাজের সার্বিক ঘটনাপ্রবাহই ইতিহাস।” উপর্যুক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, অতীত ঘটনাবলির সাধারণ বর্ণনা নয়; বরং তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানবজাতির অগ্রগতির বিবরণই ইতিহাস ।
• ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ : নিম্নে ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. উৎস ও তথ্যভিত্তিক : ইতিহাসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি উৎস ও তথ্যভিত্তিক। বস্তুর উৎস ছাড়া ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর যেকোনো যুগের, যেকোনো স্থানের বা যেকোনো বিষয়ের ইতিহাস রচনা করতে অবশ্যই ঐতিহাসিককে উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়।
২. অনুসন্ধানমূলক : অনুসন্ধিৎসুতা ইতিহাসের অপর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কারণ 'Historia' শব্দের অর্থ হলো সত্য প্রকাশ করার জন্য পরিকল্পিত অনুসন্ধান (An inquiry, designed to elicit truth.)। সুতরাং ইতিহাস মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত কর্মের ওপর অনুসন্ধান পরিচালনা করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে ।
৩. আত্মোপলব্ধিমূলক : নিজেকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ ইতিহাসের পাতা থেকেই আমরা আমাদের জাতীয় তথ্যাবলি সম্পর্কে অবগত হতে পারি। আমরা অতীত কর্ম পর্যালোচনা করতে ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে থাকি। ইতিহাস আমাদের অতীত কর্মের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে মানুষকে আত্মোপলব্ধিতে অনুপ্রাণিত করে ৷
৪. সর্বজনীনতা : সর্বজনীনতা ইতিহাসের অপর একটি বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সমভাবে সবার কর্মের একটি বিবরণী প্রদান করে। যেকোনো গোত্র বা বর্ণের লোক ইতিহাস রচনা করুক না কেন, তাকে অবশ্যই সর্বজনীনভাবে গ্রাহ্য ইতিহাস রচনা করতে হবে।
৫. নিরপেক্ষতা : নিরপেক্ষতা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সাদা, কালো অনিষ্টকারী, কল্যাণকামী, স্বৈরাচারী, গণতান্ত্রিক, উৎপীড়ক, প্রজারঞ্জক প্রভৃতি সব ব্যক্তি ও রাজনৈতিক প্রশাসকের প্রতি ইতিহাস নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে । নিরপেক্ষ অবলম্বনের কারণেই এখন পর্যন্ত ইতিহাস জ্ঞানের অন্যতম শাখা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
৬. ধারাবাহিকতা : অনেক বৈশিষ্ট্যের মতো ধারাবাহিকতা ইতিহাসের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস অবশ্যই এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলে। অর্থাৎ জন্ম বা সূচনা, ক্রমবিকাশ, চরমোৎকর্ষ ও পতনের বিবরণ ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে
ধারণ করে থাকে ।
৭. মানবীয়তা : ইতিহাস মানুষের অতীত কার্যাবলির ওপর উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করে। এটি মানুষের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে। অর্থাৎ ইতিহাসের বিষয়বস্তু অবশ্যই মানবীয়, কোনো অবস্থাতেই তা অতি মানবীয় নয় ।
৮. যোগসূত্র স্থাপন : ইতিহাসের বর্তমান ভিত বা শিকড় সুদূর অতীতের অতি গভীরে গ্রোথিত। এটি আমাদের পূর্বের বর্ণনা তুলে ধরে অতীতের আলোকে বর্তমানকে সাজাতে সাহায্য করে। এভাবে ইতিহাস সব যুগের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে সেতুবন্ধকারী হিসেবে কাজ করে ।
৯. ইতিহাস দৃষ্টান্তের মাধ্যমে শিক্ষা দেয় : ইতিহাসের ব্যবহারিক গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ ইতিহাস পাঠ করে অতীত ঘটনাবলির দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে পারে। ইতিহাসের শিক্ষা বর্তমানের প্রয়োজনে কাজে লাগানো যেতে পারে। ইতিহাস দৃষ্টান্তের মাধ্যমে শিক্ষা দেয় বলে ইতিহাসকে শিক্ষণীয় দৰ্শন বলা হয় ।
১০. বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্ক : ইতিহাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ততা। আমরা যখন ইতিহাসের কোনো একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করি তখন ঐ বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত অনেক বিষয় আমাদের আলোচনায় চলে আসে যা পরিহার করা অসম্ভব। যেমন কোনো একটি সমাজ নিয়ে যখন ঐতিহাসিক গবেষণা শুরু হয় তখন তার সাথে দর্শন, অর্থনীতি, ভূগোল এমনকি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো জড়িয়ে পড়ে। একইভাবে ইতিহাসের সাথে বিজ্ঞানের গভীর সম্পর্ক বিরাজমান ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানবজাতির অতীত কর্মের দলিল হলো ইতিহাস। আর এজন্যই ইতিহাসের স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য জানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ইতিহাসের বিষয়বস্তু, আলোচনা পদ্ধতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং এর পরিধির জন্য একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য সূচক শাস্ত্র হিসেবে ইতিহাস পরিচিতি লাভ করেছে। তাই বলা যায়, ইতিহাসের সকল বৈশিষ্ট্য ইতিহাসকে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত