প্রতিরোধ আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সার্বিক বিশ্লেষণ

প্রতিরোধ আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র গঠনে জনগণের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত আমাদের উপর্যুক্ত জরিপে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে পূর্বতন অন্যান্য শাসনের মতো ব্রিটিশ শাসনও প্রজাসাধারণের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লাভ করেনি, বরং আমরা লক্ষ করি যে নতুন শাসককে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের প্রত্যাখ্যান নিষ্ক্রিয় ও সক্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নতুন শাককগোষ্ঠী ভিনদেশি ছিল বলেই জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করে নি, তারা কখনো তাদের শাসকদের জাতি বা বংশ (Race) নিয়ে উদ্বিগ্ন হয় নি, বরঞ্চ তাদের প্রতিবাদের কারণ ছিল এই যে নতুন শাসক এ দেশ শাসনকালে চিরাচরিত রীতিকে উপেক্ষা করে তাদের রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেনি। এ শাসন ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা, ভূমি নিয়ন্ত্রণ, আইন ও বিচারকে নগ্নভাবে উপক্ষো করেছে এবং তা সংশ্লিষ্ট সকল স্তর ও পরিস্থিতির জনগণকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে এবং জনগণের এ উদ্বেগ নিষ্ক্রিয় বিরোধিতা থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এ প্রতিক্রিয়া পূর্বতন শাসকগোষ্ঠী নৃপতি-জমিদার, সাধারণ ভূমালিক, ধর্মীয় গোষ্ঠী, উপজাতীয় জনগণ এবং সর্বোপরি, কৃষক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সমভাবে ব্যক্ত হয়েছে। অবিভক্ত বাংলার সর্বত্রই প্রতিরোধ আন্দোলনের এরূপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় ।
কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার এই যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার ভান করে যে প্রজাসাধারণ তাদের শুভ শাসনে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে। জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচারিত সরকারি প্রতিবেদনে সরকারের এ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় । উপরে বর্ণিত প্রতিরোধ আন্দোলন এবং বিদ্রোহকে ব্রিটিশ জনমতের সম্মুখে সংগঠিত ডাকাত ও লুণ্ঠনকারীদের কর্মকাণ্ড হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এবং বলা হয় যে তাদেরকে অবরোধ করে লুণ্ঠন থেকে বিরত রাখা হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে জেমস মিল (James Mill) সহ সমসাময়িক সকল ব্রিটিশ লেখক আশ্চর্যজনকভাবে স্থানীয় অস্থিরতা ও প্রতিরোধ আন্দোলন সম্পর্কে নিশ্চুপ ছিলেন এবং তাঁরা সকলেই পূর্বতন মুসলিম শাসনকে সর্বনাশা ও ব্রিটিশ শাসনকে কল্যাণকর হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
আমরা লক্ষ করেছি যে উল্লিখিত প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিদ্রোহগুলো সকল সময়ে একই ধরনের গঠনপ্রকৃতি ও অংশগ্রহণকারী নিয়ে সংঘটিত হয়নি। ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী ক্রান্তিকালে ক্ষমতাচ্যুত শাসকগোষ্ঠী দ্বারা বিদ্রোহ হয়েছে। বাংলাদেশেও কোম্পানি বাহাদুর স্থানীয় এলিটদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে প্রস্তুত ছিল না। কাজেই নবাব থেকে শুরু করে নৃপতি-জমিদার পর্যন্ত হতাশাগ্রস্ত এলিট গোষ্ঠী তাদেরকে হটানোর ব্রিটিশ পদক্ষেপ প্রতিরোধের চেষ্টা করে। মীর কাশিম শৌর্যপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি ছাড়া বাকি সকল এলিট সহজেই পরাভূত হন এবং তাঁদের সবাইকে অবসরভাতা দিয়ে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়। প্ৰধান জমিদারদের ভাগ্যেও তদ্রূপ ঘটে। তাঁরা নিজস্ব প্রসাসনিক ও সামরিক ক্ষমতা হারান, কিন্তু অধিক রাজস্ব প্রদান সাপেক্ষে কিছু সময়ের জন্য তাদের জমিদারি টিকিয়ে রাখেন ।
১৭৬০-এর দশকের শেষে শাসক অভিজাত শ্রেণি ও নৃপতি-জমিদারদের প্রতিরোধের সমাপ্তি ঘটে। অতঃপর সাধারণ জমিদারদের প্রতিরোধ শুরু হয়। পঞ্চবার্ষিক (১৭৭২) ও দশবার্ষিক (১৭৯০) বন্দোবস্তের রাজস্ব সংক্রান্ত নীতির ফলে তাদের স্বার্থ ও মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছিল। ১৭৭২ সালে দীউয়ানি ক্ষমতা রেজা খানের হাত থেকে নতুন শাসকের হাতে চলে যাওয়ার পর কৃষক সমাজ ও ধর্মীয় গোষ্ঠী নতুন শাসকের উৎপীড়ন (Pinch) প্রত্যক্ষ করতে শুরু করে এবং উক্ত সময় থেকে কৃষক ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিরোধ আরম্ভ হয়। ঐ একই সময়কাল উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে নতুন শাসকের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যদিও তাদেরকে স্বাধীনভাবে বসবাসের অনুমতি প্রদান করা হয়, তথাপি তাদের অনেক ঐতিহ্যগত অধিকার খর্ব করা হয়। সর্বশেষ প্রতিরোধ ঘটে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক শতাব্দী পর। ১৮৭০-এর দশকে কৃষক বিদ্রোহ সর্বত্র লক্ষ করা যায় এবং এই বিদ্রোহ ছিল পরগনা নিরিখ বাতিল করে প্রচলিত খাজনাহার বৃদ্ধির জমিদারি প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। প্রজারা তখন নিজেদের অধিকার ও দাবি আদায়ের জন্য সংগঠিত হতে থাকে এবং তাদের বিপক্ষে সরকার জমিদারদের পক্ষ নিতে আর আগ্রহী ছিল না। এভাবে ভূস্বামী-কৃষক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং পরোক্ষভাবে ব্রিটিশরাজ ও প্রজাদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৮৮৫ সালের বিখ্যাত বাংলা প্রজাস্বত্ব আইন প্রণীত হয় ।
বিংশ শতকের চল্লিশের দশকে ব্রিটিশ শাসনের অন্তিম সময়ে উত্তরবঙ্গের স্থানীয় কৃষকদের প্রজন্মব্যাপী বঞ্চনার আক্রোশ বিদ্রোহ ও আন্দোলনের পরিণতি লাভ করে। এটি ছিল তেভাগা কায়েমের আন্দোলন (১৯৪৬)। ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ কৃষক ও এক ভাগ জোতদার পাবে। এই ন্যায্য দাবিতে সার্বিক প্রতিরোধের অঙ্গীকার সত্ত্বেও কৃষকরা পিছু হটতে বাধ্য হয়ে। কিন্তু যে মরণজয়ী সংগ্রামের স্মৃতি তারা রেখে যায়, তা শুধু গোটা সামন্ত ব্যবস্থাকেই নাড়িয়ে দেয়নি, এক নব জাগ্রত শ্রেণিচেতনাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। সেই সঙ্গে ভাবীকালের জন্য রেখে গিয়েছিল এক গৌরবময় বিপ্লবী ঐতিহ্য। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামলেও উত্তরবঙ্গের চাষিরা ‘তেভাগা ও সাত আড়িজিন' এই দাবিতে বিদ্রোহ করে। মূল দাবি অর্জিত না হলেও নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ (১৯৪৯ খ্রি.) বাংলার কৃষক প্রতিরোধের ইতিহাসে অবদান রেখেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই । কৃষক প্রতিরোধই শেষ পর্যন্ত জমিদার প্রথাকে উচ্ছেদ করেছে। আর উপর্যুক্ত প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো বাংলার প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসকে গৌরবময় ও সমৃদ্ধ করেছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]