ইতিহাসের বিষয়বস্তু ও পরিধি সম্পর্কে বর্ণনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : মানবসমাজের অনন্ত ঘটনা প্রবাহই ইতিহাস। ইতিহাস মানবীয় কর্মকাণ্ড তথা অতীত ঘটনাবলি বিজ্ঞান সম্মতভাবে অনুসন্ধানের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে। আর তাই ইতিহাস হলো মানুষ ও তার রাষ্ট্রীয়ও সমাজব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশকে নিয়ে মহাকালের এক অনন্ত স্রোতধারা। মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত সব বিষয় ইতিহাসের আওতাভুক্ত । মানুষের চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা, কার্যক্রম যত শাখাপ্রশাখায় বিস্তৃত, ইতিহাসের সীমাও ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ।
• ইতিহাসের বিষয়বস্তু ও পরিধি : নিম্নে ইতিহাসের বিষয়বস্তু ও পরিধি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ক. ইতিহাসের বিষয়বস্তু : মানুষ, তার সমাজ ও সভ্যতার ধারাবাহিক পরিবর্তনের প্রমাণ ও লিখিত দলিল হলো ইতিহাস । ইতিহাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আধুনিক ঐতিহাসিক ভিকো মনে করেন, মানবসমাজ ও মানবীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপত্তি ও বিকাশই হচ্ছে ইতিহাসের বিষয়বস্তু । সার্বিকভাবে ইতিহাসের বিষয়বস্তুকে নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করা যায় ।
১. মানুষের উৎপত্তি ও বিবর্তন : ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে সর্বাগ্রে মানুষের উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তনকে উল্লেখ করা যায়। কখন, কীভাবে মানুষের উৎপত্তি হলো এবং কোন কোন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ আজ বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তা ইতিহাসের উপজীব্য বিষয় ।
২. সভ্যতার ক্রমবিবর্তন : সভ্যতার ক্রমবিবর্তন ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আদি গুহাবাসী মানুষ কী করে জীবন ধারণ করতো, তাদের ক্ষুধাবৃত্তি নিবারণের জন্য ফল ও শিকারি পশুর ওপর নির্ভর করতো এবং তাদের গুহাচিত্র থেকে শুরু করে বিশ্বের সব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের তথ্য-উপাত্ত ইতিহাসের বিষয়বস্তু ।
৩. অর্থনৈতিক জীবন : মানুষের উৎপাদন ব্যবস্থার সামগ্রিক দিক অর্থাৎ কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, মুদ্রা, রাজস্ব ইত্যাদি সব বিষয়কে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থা। তাই অতীতকালে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের আলোচনাও ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য বিষয় ।
৪. রাজনৈতিক জীবন : মানব সভ্যতার ক্রমোন্নতির একটি পর্যায়ে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক ভাবনার উদ্ভব হয় । বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মাধ্যমে মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও ভাবনায় এসেছে নানা ধরনের পরিবর্তন । কীভাবে মানুষ নগর সভ্যতার যুগে রাষ্ট্র গঠন করেছে, শাসনব্যবস্থার পত্তন করেছে তা সবই ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচিত । ৫. যুগ বিভাজন : ধারাবাহিকতা ও সময়ানুক্রম যেমন ইতিহাসের মূলসূত্র তেমনি যুগ বিভাজন ইতিহাসের অপরিহার্য আলোচ্য বিষয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগ, ঐতিহাসিক যুগ তথা পুরাতন প্রস্তরযুগ, নব্য প্রস্তরযুগ, তাম্র প্রস্তরযুগ, প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ ইতিহাসের বিশেষ বিষয়বস্তু ।
এছাড়াও মানুষের সামাজিক ক্রমবিবর্তন, অর্থনৈতিক প্রভাব ও সংগঠন, ধর্মীয় ক্রমবিকাশ, অতীতের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কর্মকাণ্ড, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, নদনদী ও সমুদ্র, লেখক, দার্শনিক, আবিষ্কারক ও তাদের কর্ম, সংস্কার ও সংস্কারক, উত্থানপতন, আন্দোলন ও যুদ্ধবিগ্রহ, সম্মেলন ও চুক্তি প্রভৃতিও ইতিহাসের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত।
খ. ইতিহাসের পরিধি : মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত সব বিষয় ইতিহাসের পরিধির আওতাভুক্ত। মানুষের চিন্তাভাবনা, কার্যক্রম, পরিকল্পনা যতদূর বিস্তৃত ইতিহাসের সীমাও ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে ইতিহাসের পরিধির এ বিস্তৃতি স্থিতিশীল নয়। মানুষের চিন্তভাবনা, কর্মধারা পরিবর্তনের সাথে সাথে ইতিহাসের পরিধিও সম্প্রসারিত হচ্ছে। নিম্নে ইতিহাসের পরিধি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. প্রাগৈতিহাসিক যুগে ইতিহাসের পরিধি : প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের কর্ম শুধু খাদ্য সংগ্রহমূলক চিন্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এসময় মানুষ খাদ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন হাতিয়ার ও কৌশল ব্যবহার করে যা ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়। উল্লেখ্য, প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের কর্ম শুধুমাত্র খাদ্য সংগ্রহমূলক হওয়াতে ইতিহাসের পরিধিও ততদূর পর্যন্তই পরিব্যাপ্ত ছিল।
২. ঐতিহাসিক যুগে ইতিহাসের পরিধি : ঐতিহাসিক যুগে ইতিহাসের পরিধি আরও দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হয়। ইতিহাস চর্চায় হেরোডোটাস, থুসিডিডিস প্রমুখ ঐতিহাসিকের আগমন ঘটে। ফলে ইতিহাস চর্চা নতুন মাত্রা পায়। এসময়ে গোত্র, রাষ্ট্রসমূহের মধ্যকার যুদ্ধ ও রাজনীতি ইতিহাসের পরিধিভুক্ত হয়।
৩. প্রাচীন যুগে ইতিহাসের পরিধি : প্রাচীন যুগে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র শাসন নীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সভ্যতা সংস্কৃতি ও স্থাপত্যকর্ম ইতিহাসের পরিধিভুক্ত হওয়ার পাশাপাশি ধর্মও ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে থাকে ।
৪. মধ্যযুগে ইতিহাসের পরিধি : মধ্যযুগে ইতিহাসের পরিধিতে সমকালীন ইউরোপের পাশাপাশি এশিয়া ও আফ্রিকার ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি ও ইতিহাসের পাতায় গুরুত্বের সাথে স্থান করে নেয়। ভারতের ঐতিহাসিক কলহণের ‘রাজতরঙ্গিণী', ইবনে খালদুনের ‘কিতাব আল ইবার’, ‘আল মুকাদ্দিমা' প্রভৃতি গ্রন্থ ইতিহাসের পরিধিকে আরও ব্যাপক করে তোলে । ৫. আধুনিক যুগে ইতিহাসের পরিধি : মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপে পোপতন্ত্রের দুর্নীতি মানুষকে ধর্মীয় ব্যবস্থা সংস্কারে অনুপ্রাণিত করে। ফলে ধর্মসংস্কার আন্দোলন ইতিহাসে গুরুত্ব পায়। মধ্যযুগে শুরু হওয়া মানুষের ব্যবসায়িক কার্যক্রম আধুনিক যুগে এসে নতুন মাত্রা পায় এবং এর সাথে ভৌগোলিক আবিষ্কারসমূহ ইতিহাসের পরিধিকে বিস্তৃত করে । এভাবে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ইতিহাসের নিরন্তর বয়ে চলার নতুন নতুন বিষয়াবলি যুক্ত হয়ে ইতিহাস জ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা হিসেবে স্বীকৃত হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাসের বিষয়বস্তুর মূলে যেমন মানুষ ও তার কর্মকাণ্ড রয়েছে তেমনি মানুষের অসংখ্য কর্মকাণ্ড ইতিহাসের পরিধিতে যুক্ত হয়েছে। সময়ের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের শাখাপ্রশাখা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি ইতিহাসের সীমানাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে অর্থনীতি, সমাজ ও শিল্পকলাসহ একের পর এক বিষয় ইতিহাসভুক্ত হচ্ছে। ফলে সম্প্রসারিত হচ্ছে ইতিহাসের পরিধি ও পরিসর। এর ফলে ইতিহাস যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি নির্ভরযোগ্য পাঠ্য হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ইতিহাসের শিক্ষা এজন্য প্রত্যেকটি মানুষের জীবনেই অপরিহার্য।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]