নিম্নবর্গ Subalterns নিম্নবর্গ আন্দোলন নিম্নবর্গ বিশেষজ্ঞ রণজিত গুহের অভিমত

নিম্নবর্গ
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাস আলোচনার ক্ষেত্রে ‘নিম্নবর্গ' সম্পর্কে ধারণা থাকা অপরিহার্য। নিম্নবর্গের ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে (Subalterns) এর ব্যবহার বর্তমানে সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও ইংরেজি ডিকশনারিতে Subalterns শব্দের বাংলা অর্থ দেওয়া হয়েছে ক্যাপেনের চেয়ে নিম্নপদস্থ সনদপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা; অধস্তন অফিসার। ব্রিটিশ লেখকদের লেখনীতে কোম্পানিও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোষ্ঠী ও কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনে বাঁশের লাঠি হাতে অংশগ্রহণকারী প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে ইংরেজ ক্যাপ্টেনের চেয়ে নিম্নপদস্থ হিসেবে Subalterns বলা হয়েছে। রাজশেখর বসু Subalterns শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘নিম্নবর্গ' ব্যবহার করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত নিম্নবর্গ গবেষক রণজিৎ গুহ Subalterns এর বাংলা প্রতিশব্দ করেছেন ‘নিম্নবর্গ'। নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার একটি স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল ধারা প্রচলিত হয়েছে গত দেড় দশকে। ১৯৮২ খ্রিষ্ট্রাব্দে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ' এর প্রথম প্রকাশ, ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম সাবলটান স্টাডিজ সম্মেলন ও গত বারো বছরে আট খণ্ড ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ' সংকলন প্রকাশিত হওয়ার ঘটনা এই ইতিহাস চর্চার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহপথটি চিহ্নিত করে। গত পনেরো বছরে জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, ডেভিড হার্ডিম্যান, শাহিন আমিন, ডেভিড আর্নল্ড, রণজিৎ গুহ প্রমুখ গবেষকদের স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণী ইতিহাসবোধ এই ধারাটিকে পুষ্ট করেছে। সাম্যবাদী দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামসির দর্শনে যে-সাবলটার্ন হিস্ট্রির সূত্রপাত, তারই নানা অব্যাখ্যাত ইঙ্গিত ও সূত্রের সময়োপযোগী পরিমার্জন ও বিশ্লেষণের মধ্যে থেকে উঠে আসা নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার এই ধারটি, নিঃসন্দেহ বিবর্তনশীল সামাজিক বিন্যাস ও সামাজিক সম্পর্কের জটিল ও বহুস্তর বাস্তবতাটিকে সত্যের অনেক কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘সাবলটার্ন' শব্দটির (বাংলা প্রতিশব্দ নিম্নবর্গ) প্রথম প্রয়োগ পাওয়া যায় গ্রামসির রচনায়। কখনও প্রলেতারিয়েত, কখনও বা আরও ব্যাপক সাধারণ অর্থেও শব্দটি ব্যবহার করেছেন তিনি। তাঁর চিন্তায় নিম্নবর্গের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাসের এক সমান্তরাল পাঠান্তর রচনার প্রয়োজন প্রথম অনুভূত হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা যেন অতিসরলীকরণে দুষ্ট, কোথাও কোথাও অস্পষ্টও। বাংলার মতো কৃষিপ্রধান দেশে, যেখানে বুর্জোয়া বিপ্লব ও ধনতন্ত্রের বিকাশ সুসমভাবে ঘটেনি, সেখানে অবশ্যই রয়ে গেছে শ্রেণিবৈষম্যের আরও জটিল স্তরভেদ।
Subalterns ইংরেজি ভাষায় এই শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় সামরিক সংগঠনের ক্ষেত্রে। ক্যাপ্টেনের অধস্তন অফিসারদের ‘সাবলটার্ন' বলা হয়। তবে শব্দটির সাধারণ অর্থ হলো অধস্তন বা নিম্নস্থিত। আরিস্ততেলীয় ন্যায়শাস্ত্রে এর অর্থ এমন একটি প্রতিজ্ঞা যা অন্য কোনো প্রতিজ্ঞার অধীন, যা বিশিষ্ট, মূর্ত, সার্বিক নয় । সাধারণ অর্থে ইংরেজিতে এর সমার্থক শব্দ হলো ‘সাবর্ডিনেট' ।
মার্কসীয় আলোচানায় এই শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায় ইতালির কমিউনিস্ট নেতা ও দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামসির (১৮৯১-১৯৩৭) বিখ্যাত কারাগারের নোটবই- তে। এই নোটবইতে বিভিন্ন শব্দের প্রয়োগ সম্পর্কে কিছু জটিলতা আছে। এটি রচিত হয়েছিল ১৯২৯ থেকে ১৯৩৫ এর মধ্যে, গ্রামসি যখন মুসোলিনির কারাগারে বন্দি। সেন্সরের শ্যেনদৃষ্টি এড়ানোর জন্য বহুক্ষেত্রে প্রচলিত মার্কসীয় পরিভাষা বর্জন করে অন্য শব্দ ব্যবহার করেন গ্রামসি। যেমন— ‘মাকর্সবাদ' কথাটা তিনি কোথাও ব্যবহার করেননি, বলেছেন ‘প্রাক্সিসের দর্শন'। মার্কসের নামও ব্যবহার করেননি, বলেছেন, ‘প্রাক্সিসের দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা' । কিন্তু উল্লেখযোগ্য, এই ধরনের প্রতিশব্দ উদ্ভাবন করার মধ্য দিয়ে প্রচলিত মার্কসীয় ধারণাগুলো সম্পর্কে গ্রামসির নিজস্ব চিন্তা, তাদের তাৎপর্য সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বোধ, প্রায় অনিবার্যভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। ‘মার্কসবাদ' এর প্রতিশব্দ খুঁজতে গিয়ে তিনি যখন বেছে নেন ‘প্রাক্সিসের দর্শন' তখন মার্কসবাদের তত্ত্বজগতের বিশেষ একটা দিক বেশি প্রাধান্য পেয়ে যায় তাঁর লেখায়। পরিভাষায় প্রচলিত অর্থের সঙ্গে যুক্ত হয় নতুন ব্যঞ্জনা। কারাবাসের পর্যায়ের রচনাগুলো পড়ার সময় আমরা এই রূপকসমৃদ্ধ ভাষার জায়গায় প্রচলিত পরিভাষাগুলো বসিয়ে নিয়ে পড়তে পারি নিশ্চয়। কিন্তু তাতে গ্রামসির চিন্তার জটিলতা, তার অভিনবত্ব, বহুলাংশেই হারিয়ে যাবে ।
সাবলটার্ন (ইতালীয়তে সুবলতের্নো) শব্দটি গ্রামসি ব্যবহার করেছেন অন্তত দুটি অর্থে। একটি অর্থে এটি সরাসরিভাবে ‘প্রলেটারিয়াট’ এর প্রতিশব্দ। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ‘সাবলটার্ন শ্রেণি' হলো শ্রমিকশ্রেণি। সামাজিক ক্ষমতার এক বিশেষ ধরনের বিন্যাস ও প্রক্রিয়ার মধ্যে শ্রমিক শ্রেণি শোষিত ও শাসিত হয়। এই বিশেষ অর্থে সাবলটার্ন হেগেমনিক শ্রেণির সামাজিক সম্পর্কের বিষয়ে গ্রামসির বিশ্লেষণ আধুনিক মার্কসবাদী আলোচনায় এক বিশিষ্ট অবদান। এই বিশ্লেষণে গ্রামসি গুরুত্ব দিয়েছেন সেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটির উপর যায় মাধ্যমে বুর্জোয়াশ্রেণি কেবল শাসনযন্ত্রে তার প্রভুত্বই প্রতিষ্ঠা করে না, সৃষ্টি করে সার্বিক সামাজিক কৰ্তৃত্ব বা ‘হেগেমনি’ । কেবল রাষ্ট্রীয় শক্তিকে অবলম্বন করে এই সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের জগতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ‘হেগেমনিক' বুর্জোয়া শ্রেণি তার শাসনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে ‘সাবলটার্ন' শ্রমিক শ্রেণির কাছ থেকে সামাজিক সম্মতিও আদায় করে নেয়। গ্রামসির বিশ্লেষণে তাই গুরুত্ব পায় রাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের সম্পর্ক, জাতি, জনগণ, বুর্জোয়া শ্রেণি ও অন্যান্য শাসকগোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক, জাতীয় জীবনের একচ্ছত্র প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, বুর্জোয়া শ্রেণির সার্বিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, ইত্যাদি প্রশ্ন।
কিন্তু আরও সাধারণ অর্থেও ‘সাবলটার্ন' কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে গ্রামসির লেখায় । কেবল পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় নয়, শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অন্যান্য ঐতিহাসিক পর্বেও ‘সাবলটার্ন' শ্রেণির কথা বলেছেন গ্রামসি। স্পষ্টতই এখানে ‘সাবলটার্ন-এর অর্থ শিল্পশ্রমিক শ্রেণি নয়। বরং যে কোনো শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ক্ষমতা বিন্যাসের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা উঠছে এখানে। এই বিন্যাসকে গ্রামসি দেখেছেন একটি সামাজিক সম্পর্কের প্রক্রিয়ার মধ্যে, যার এক মেরুতে অবস্থিত প্রভুত্বের অধিকারী ‘ডমিন্যান্ট’ শ্রেণি, অপর মেরুতে যারা অধীন সেই 'সাবলটার্ন' শ্রেণি। বহুক্ষেত্রেই অবশ্য গ্রামসি বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব, শাসন এই শব্দগুলোকে সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ফলে কর্তৃত্বের অধিকার, প্রভুত্বের অধিকার, শাসনের অধিকার, এই ধারণাগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি না, গ্রামসির আলোচনা থেকে তা বোঝা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় ।
শুধু তাই নয়, যে কোনো শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রভুত্ব ও অধীনতার এই সম্পর্কের সাধারণ চরিত্র নির্ধারণ করতে গিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান কিছু মন্তব্য করা সত্ত্বেও গ্রামসি এমন কয়েকটি তাত্ত্বিক সমস্যার মধ্যে পড়েছেন যার নির্দিষ্ট সমাধান তাঁর লেখার পাওয়া যায় না। উৎপাদন-সম্পর্কের দিক দিয়ে বিচার করলে এই প্রভুত্ব ও অধীনতা সম্পর্কে স্বভাবতই নানা প্রকারের উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে গ্রথিত থাকতে পারে। তবে
বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ইতালীয় সমাজে পুঁজিবাদী বিকাশের অসম্পূর্ণতার পটভূমিতে সামন্তশ্রেণির প্রভুত্ব ও কৃষক শ্রেণির অধীনতার চরিত্রই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে এসেছে গ্রামসির লেখায়। প্রভুত্ব ও অধীনতা সম্পর্কের সাধারণ চরিত্রটির সন্ধান করেছেন তিনি প্রধানত সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের ক্ষেত্রগুলোতে। দুটি মূল ঝোঁক কাজ করেছে তাঁর মধ্যে। একদিকে ইউরোপীয় মার্কসবাদের আদিপর্বে সাধারণ কৃষকদের প্রাত্যহিক সংস্কৃতি, ধ্যানধারণা, আচার আচরণ ও রাজনৈতিক সম্ভাবনা সম্পর্কে যে তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞার বার ছিল, তার বিরুদ্ধে গ্রামসি বলে গেছেন ‘সাবলটার্ন’ কৃষকদের প্রাত্যহিক জীবনযাপন, ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক ধ্যারধারণার বিশিষ্ট লক্ষণগুলোর কথা এবং বিপ্লবী নেতৃত্ব তথা বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে এই লক্ষণগুলোকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করা ও বোঝার প্রয়োজনের কথা। অথচ একই সঙ্গে তিনি ক্রমাগত জোর দিয়েছেন কৃষক শ্রেণির চেতনার সীমাবদ্ধতার উপর। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রভুত্বের অধিকারী যে শ্রেণি, তার চেতনার সমগ্রতা, মৌলিকতা, সক্রিয় ইতিহাস বোধের তুলনায় কৃষকচেতনা একান্তভাবেই খণ্ডিত, নির্জীব, পরাধীন । এমনকি বিদ্রোহের মুহূর্তেও তার চেতনা বহুলাংশেই আচ্ছন্ন থাকে শাসকশ্রেণির মতাদর্শের আবরণে। কৃষকের ইতিহাসবোধ, ধর্মবিশ্বাস ও লোকসংস্কৃতির যে বিবরণ গ্রামসির লেখায় পাওয়া যায় তা থেকে এটা মনে হওয়া কিছু অস্বাভাবিক নয় যে বৈপ্লবিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর মতে কৃষক চেতনার মূল চরিত্র মোটামুটিভাবে নেতিবাচক ।
তা হলে গ্রামসি এত জোরের সঙ্গে কৃষকের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা ও ভাবাদর্শের জগতটিকে পুঙ্খানুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন কেন? খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, ঘটনাটা অত সরল নয়। গ্রামসি কৃষক চেতনার সীমাবদ্ধতা এবং পরনির্ভরতার কথা বলেছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও বলেছেন যে যে- কোনো শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রভুত্ব বা অধীনতার সম্পর্কটা হলো বিরোধিতার সম্পর্ক। ফলে তার পরনির্ভরতার মধ্যেও কৃষক চেতনা সামন্তশ্রেণির চেতনার বিপরীত বিন্দুতে অবস্থিত থাকে। এই বিরুদ্ধতার জন্য কৃষক চেতনার বাস্তব প্রকাশ সময় সময় ইতিবাচক ভূমিকাও গ্রহণ করতে পারে। লোকমানসের কিছু কিছু উপাদান যেমন আশ্চর্য রকমের শক্তিশালী-বিশেষ করে এক ধরনের স্বাভাবিক নীতিবোধ কাজ করে তার মধ্যে যা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, ন্যায়শাস্ত্র বা আইনের তুলনায় অনেক সহজ অথচ গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী। দৈনিক জীবনযাত্রার রীতিতে নানা পরিবর্তন ঘটলেও এই স্বাভাবিক ন্যায়-অন্যায় বোধ অক্ষুণ্ণ থাকে। এমনকি নতুন নতুন পরিস্থিতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের নানা অভিনব পন্থার জন্ম দিতেও তা সক্ষম। সংস্কৃতিতে বা ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে লোকসংস্কৃতি যদিও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চাপে ভারাক্রান্ত থাকে, তা সত্ত্বেও ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণিগুলো তাদের নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সেই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির কিছু কিছু উপাদানকেই মাত্র বেছে নেয়, সবটুকু নেয় না। ফলে ধর্মীয় জীবনের সার্বিক প্রাতিষ্ঠানিক চেহারার মধ্যেও এক ধরনের স্তরবিন্যাস দেখা দেয়। শাসক শ্রেণির ধর্মবিশ্বাস আর তাদের অধীন শ্রেণিগুলোর ধর্মবিশ্বাস প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে এক হলেও তাদের আকার ও চরিত্র পৃথক, এমনকি বিরোধী রূপও ধারণ করতে পারে। এই বিরুদ্ধতা থেকেই জন্ম নেয় ‘সাবলটার্ন' শ্রেণির প্রতিরোধ, যা বহুসময়ই ক্ষমতাশীল শ্রেণিগুলোকে বিপদে ফেলতে সক্ষম হয় ৷
সুতরাং ‘সাবলটার্ন' চেতনার সীমাবদ্ধতার কথাই যদিও গ্রামসির লেখায় প্রাধান্য পেয়েছে, তা সত্ত্বেও এই চেতানার স্বতন্ত্র অভিব্যক্তির সম্ভাবনার ইঙ্গিতও তাতে যথেষ্ট পরিমাণেই আছে। মার্কসীয় তত্ত্বের কাঠামোর মধ্যে এই ইঙ্গিতগুলোর সঠিক তাৎপর্য কী, তার উত্তর কিন্তু গ্রামসির আলোচনয় খুব স্পষ্টভাবে পাওয়া যাবে না । এমনকি এই সম্ভাবনাগুলোকে তাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবেও গ্রামসি নির্দিষ্টভাবে উপস্থিত করতে পারেননি ।
সম্প্রতিকালে বাংলার সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণির ধারণাটিকে নতুনভাবে উপস্থিত করা হয়েছে। রনজিৎ গুহ এর বাংলা প্রতিশব্দ করেছেন ‘নিম্নবর্গ'। সাবলটার্ন স্টাডিজ নামক প্রবন্ধ সংকলনগুলোতে এবং জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, ডেভিড হার্ডিম্যান, রণজিত গুহ, শাহিদ আমিন প্রমুখ ঐতিহাসিকদের গ্রন্থে এই ধারণাটি ব্যবহৃত হয়েছে। গ্রামসির ইঙ্গিতগুলোকে অনুসরণ করেই ‘নিম্নবর্গ' ধারণাটির উদ্ভব। কিন্তু তার প্রয়োগ ও বিস্তার করা হয়েছে ভারতবর্ষের সমাজ-ইতিহাসের ক্ষেত্রে এর ফলে মার্কসীয় তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ পদ্ধতিতেও কয়েকটি নতুন সম্ভাবনায় সৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে আবার দেখা দিয়েছে কিছু নতুন সমস্যাও ।
বাংলার ইতিহাসে যাকে ‘আধুনিক’ পর্ব বলে অভিহিত করা হয়, মার্কসীয় পদ্ধতি অনুযায়ী তার মূল চরিত্রটির অনুসন্ধান করা প্রয়োজন প্রাব্ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্যে। ইউরোপের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের উদ্ভব সম্পর্কে কিছু ধারণা মার্কসাবাদী আলোচনায় প্রচলিত আছে। সামন্তশ্রেণির আধিপত্য ও কৃষকের অধীনতাকে কেন্দ্র করে যে উৎপাদনব্যবস্থা, তার ভঙ্গুর অবস্থা; জমি ও উৎপাদনের উপরকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন এক সর্বহারা শ্রেণির সৃষ্টি; একই সঙ্গে শহরাঞ্চলে পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ায় শিল্পোৎপাদনের প্রসার-মোটামুটি এইভাবেই সামাজিক উৎপাদনের সামগ্রিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদের উদ্ভবকে দেখা হয়ে এসছে। এরই সমান্তরাল প্রক্রিয়া হিসেবে যুক্ত হয়েছে বুর্জোয়া শ্রেণির সামাজিক কর্তৃত্ব বিস্তার- ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও যুক্তিবাদী সমাজদর্শন, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার গণতান্ত্রিক আদর্শ, প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইত্যাদি। এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার যে প্রতিকল্পটি মার্কসীয় তত্ত্বে নির্মিত হয়েছিল, বলাবাহুল্য তার অবলম্বন ছিল পশ্চিম ইউরোপের অভিজ্ঞতা। উৎপাদন সম্পর্ক, রাষ্ট্রক্ষমতা বিন্যাস, সাংস্কৃতিক জীবন-প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই পুঁজিবাদের উদ্ভব ও বুর্জোয়া শ্রেণির প্রাধান্য বিস্তারের একটা সংগতিপূর্ণ চেহারা তুলে ধরা হয়েছিল এই প্রতিকল্পে । অর্থাৎ তত্ত্বের দিক দিয়ে এটাই ছিল বিশুদ্ধ রূপ-সুবিন্যস্ত, সুসামঞ্জস্য ও নির্দিষ্ট।
কিন্তু বিশ্বের যে-সমস্ত অঞ্চলে পুঁজিবাদের উদ্ভব ঘটেছে দেরিতে, অর্থাৎ মধ্য, পূর্ব কিংবা দক্ষিণ ইউরোপে অথবা ঔপনিবেশিক তত্ত্বাবধানে-যেমন- আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকায়-সেখানে ঐতিহাসিক বিবর্তনের এই সুসামঞ্জস্য রূপটি আদৌ দেখতে পাওয়া যায় না। একদিকে তাত্ত্বিক প্রতিকল্পের নির্দিষ্ট রূপ, অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে )
ঐতিহাসিক বিবর্তনের বিভিন্নতা- এই সমস্যাটির তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয় মার্কসের শেষজীবনের লেখাগুলোতে। তারপর লেনিনের রচনাতে পাওয়া গেল এই তাৎপর্যগুলোর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কয়েকটি ইঙ্গিত। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ধারণাটি, সেটি হলো সামাজিক সম্পর্কের পুনরাবর্তনের প্রক্রিয়ায় দ্বন্দ্বের অসম বিকাশের সম্ভাবনা।
দ্বন্দ্বের অসম বিকাশ তখনই দেখা দেয় যখন সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন অংশে পুনরাবর্তনের প্রক্রিয়া সমান্তরালভাবে এগোয় না। অর্থাৎ অর্থনীতির ক্ষেত্রে শ্রেণিদ্বন্দ্বের প্রক্রিয়ায় কোনো বিশেষ শ্রেণির প্রাধান্য সমান্তরালভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা বা সাংস্কৃতিক জগতে প্রাধান্যে পরিণত নাও হতে পারে। তেমনি আবার এই শ্রেণিদ্বন্দ্বের বিকাশ ভৌগোলিক ক্ষেত্রেও ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে। ফলে শ্রেণিদ্বন্দ্বের মৌলিকতা, বৈরিতা, প্রাধান্য ইত্যাদি গুণগুলো এক জটিল ও পরিবর্তনশীল কাঠামোয় বিন্যস্ত হয়ে থাকে এবং পশ্চিম ইউরোপের অভিজ্ঞতা থেকে আহৃত প্রতিকল্পের সাহায্যে এই দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক উত্তরণের পথ নির্দেশ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে ।
এই অনির্দিষ্টতার জন্য ইতিহাসের আলোচনায় উচ্চবর্গ বা নিম্নবর্গের ধারণাটি তার তাৎপর্য লাভ করেছে। শুধু পূর্ব ইউরোপ, কিংবা এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় নয়, সাম্প্রতিক গবেণায় দেখা গেছে, পশ্চিম ইউরোপের ক্ষেত্রেও পুঁজিবাদের উদ্ভব অথবা বুর্জোয়া শ্রেণির সামাজিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা কোনো একটি সুনির্দিষ্ট উপায়ে ঘটেনি। বরং পুঁজিবাদে উত্তরণের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটির অন্তর্গত যে শ্রেণিসংগ্রাম, তার বিশিষ্ট রূপ, শ্রেণিতে শ্রেণিতে বৈরিতা, মৈত্রী, সমঝোতার বিশিষ্ট রাজনৈতিক চেহারা, এক-এক দেশে এক একভাবে প্রকাশ পেয়েছে এবং সম্ভাবনার এই বিভিন্নতার কারণ সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন অংশে দ্বন্দ্বের অসম বিকাশ। সুতরাং উৎপাদন-রীতির বিন্যাসমূলক ও বিমূর্ত বিশ্লেষণ শুরু করামাত্রই প্রয়োজন হয়ে পড়ে উৎপাদন-সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতা, ধর্মীয় জীবন, সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের জগতে শ্রেণিদ্বন্দ্বের চরিত্রটিকে চিহ্নিত করা। যদি ধরে নিই, সমাজ কাঠামোর প্রত্যেকটি অংশে এই দ্বন্দ্বের বিকাশ সমান্তরালভাবে এগোয়নি, তাহলে উৎপাদন-রীতির চরিত্র অনুযায়ী উৎপাদন-সম্পর্কের ধারণাটি ছাড়াও আরও কতগুলো ধারণার প্রয়োজন দেখা দেয় যার সাহায্যে রাষ্ট্র কিংবা সংস্কৃতি-ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বের বিকাশকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে ।
এই প্রয়োজনেই ‘উচ্চবগ'বা নিম্নবর্গ' ধারণাটি উদ্ভব। এর সংজ্ঞা নির্ণয় করা হয়েছে সামাজিক সম্পর্কের সেই সমতল যেখানে ক্ষমতাই হলো মূল কথা। অর্থাৎ যেখানে প্রভুত্ব বা অধীনতার এক বিশিষ্ট কাঠামোর মধ্যে সামাজিক সম্পর্কটি বাঁধা থাকে। সুতরাং উচ্চবর্গ বা নিম্নবর্গ ধারণাটির অবস্থান উৎপাদন-সম্পর্কে সমতলে নয়, কিংবা সেটি সামাজিক শ্রেণির কোনো বিকল্প সংজ্ঞা নয়। বরং বলা যায়, ঐতিহাসিক বিবর্তন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে শ্রেণিদ্বন্দ্বের অসম বিকাশকে চিত্রিত করার প্রয়োজনে উৎপাদন-সম্পর্কের সম্পূরক একটি ধারণা এটি। ফলে উচ্চবর্গ বা নিম্নবর্গের বিশ্লেষণ পদ্ধতি উৎপাদন রীতির ধারণটিকে বাদ দিয়ে চলতে পারে না। ঐতিহাসিক বিবর্তনের কোনো বিশেষ পর্ব বা পরিস্থিতিতে এই রীতির জটিল বিন্যাস, অসমতা ও উত্তরণের সম্ভবনার বিভিন্নতাকে বোধগম্য করে তুলতে সাহায্য করে মাত্র।
প্রতিরোধ আন্দোলনের সংজ্ঞা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং নিম্নবর্গ উচ্চবর্গ বা নিম্নবর্গ শব্দ দুটিকে শাসক শ্রেণি বা শাসিত শ্রেণির প্রতিশব্দ হিসেবেও সব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা চলে না। কারণ অসম বিকাশের অবস্থায় সামাজিক ক্ষমতা সবসময় আইনবদ্ধ রাষ্ট্রীয় শাসনক্ষমতা হিসেবে প্রতিপন্ন নাও হতে পারে। ফলে অনেক সময় সামাজিক ক্ষমতার এমন সম্পর্কেরও হদিস পাওয়া যাবে যেখানে উচ্চবর্গ বা নিম্নবর্গের সম্পর্ক রাষ্ট্রক্ষমতার বিন্যাসের তুলনায় সম্পূর্ণ পৃথক
সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক ক্ষমতার বিন্যাস ও পুনারবর্তনের প্রক্রিয়াগুলোকে তাদের মৌলিক উপাদানে বিভক্ত করে দেখাই উচ্চবর্গ বা নিম্নবর্গের বিশ্লেষণের লক্ষ্য। এই বিশ্লেষণ পদ্ধতির যেটি মূল অবলম্বন সেই ধারণাটি আমরা গ্রামসির রচনাতেও পাই। সেটি হলো শ্রেণি বিভক্ত সমাজে প্রভুত্ব বা অধীনতার সম্পর্কের অন্তর্নিহিত বিরোধিতা। এই বিরোধিতার তাৎপর্য কী, সে বিষয়ে গ্রামসির লেখাতে কিছু কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় বটে, কিন্তু কোনো স্পষ্ট তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ভারতবর্ষ নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনায় সমস্যাটিকে আরও নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক ভিত্তি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে ।
বলা হয়েছে, সমাজবিন্যাসের দিক থেকে প্রভুত্ব বা অধীনতা সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন-সম্পর্কে কাঠামোর মধ্যে। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থাৎ ঐতিহাসিক বিবর্তনের সম্ভাবনাগুলো প্রকাশ পায় দুটি পরস্পরবিরোধী চেতনার বৈপরীত্যে। যেমন— সামন্ততান্ত্রিক সমাজে সামন্তপ্রভু বা ভূমিদাস কৃষকের সম্পর্কটির রাজনৈতিক চরিত্র নিহিত রয়েছে উচ্চবর্গীয় সামন্তচেতনা ও নিম্নবর্গীয় কৃষক চেতনার বৈপরীত্য। এই সম্পর্কের বিন্যাসগত রূপটি স্বভাবতই প্রকাশ পায় উচ্চবর্গের প্রভুত্ব ও নিম্নবর্গের অধীনতায়। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা যতদিন টিকে থাকে, উৎপাদন-প্রক্রিয়ার গতিতে এই প্রভুত্ব বা অধীনতা সম্পর্কটাই পুনরাবর্তিত হয়। কিন্তু ইতিহাসের বিবর্তনের েেক্ষত্রে আমরা দেখি, প্রভুত্ব বা অধীনতার সম্পর্কে সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ও সম্পূর্ণ স্থিতিশীল সমান্তরাল, সুবিন্যস্ত রূপ ধরে এগোয় না। তাতে দেখা দেয় রাজনৈতিক বিরোধ, বিদ্রোহ, দমন, শ্রেণিদ্বন্দ্বের নানা অসম অভিব্যক্তি। এই শ্রেণিদ্বন্দ্বের জন্য সামন্তপ্রভু ও কৃষকের পারস্পরিক সম্পর্কের রাজনৈতিক, আইনগত, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সবদিক থেকেই ঘটে নানা পরিবর্তন। এবং এই শ্রেণিদ্বন্দ্বের মধ্যেই নিহিত থাকে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের সামগ্রিক বিবর্তনের সম্ভাবনা ।
ফলে সামন্ততন্ত্রের ইতিহাস আলোচনা ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়ে পড়ে উচ্চবর্গ বা নিম্নবর্গের চেতনার বৈপরীত্যকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। যেহেতু প্রভুত্ব বা অধীনতা সম্পর্কটির বিপরীত মেরুতে অবস্থিত দুটি পরস্পরবিরোধী শ্রেণি এবং যেহেতু এই শ্রেণিদ্বন্দ্বের রাজনৈতিক প্রকাশের ক্ষেত্রে দুটি শ্রেণিই সক্রিয়, কেবল উচ্চবর্গই সক্রিয় আর নিম্নবর্গ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় এমন নয়, সুতরাং ধরে নিতে হয় উচ্চবর্গের চেতনার বিপরীত অবস্থানে নিম্নবর্গের চেতনাও কোনো না কোনোভাবে তার স্বকীয়তা, তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়। তা যদি না হতো, তাহলে শ্রেণিদ্বন্দ্বের কোনো রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটা সম্ভব হতো না। বস্তুত তাহলে কোনো দ্বন্দ্বই থাকত না, নিম্নবর্গের অস্তিত্ব উচ্চবর্গের চেতনার সার্বিকতায় সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যেত।
কিন্তু উচ্চবর্গ বা নিম্নবর্গ সম্পর্কের মধ্যে দুটি চেতনার স্বাতন্ত্র্যও যেমন সত্য, উচ্চবর্গের প্রভুত্ব ও নিম্নবর্গের অধীনতাও তেমনি সমানভাবেই সত্য। অর্থাৎ নিম্নবর্গের চেতনা স্বতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও পরাধীন। এই দ্বান্দ্বিক রূপটিকে অবলম্বন করেই নিম্নবর্গের ইতিহাস রচিত ও রক্ষিত হয়ে ওঠে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের ঐতিহাসিক মালমশলা স্বভাবতই রচিত ও রক্ষিত হয় উচ্চবর্গের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে। এই মালমশলার মধ্যে নিম্নবর্গের চেতনার স্বতন্ত্র রূপটির আবির্ভাব ঘটে কদাচিৎ। অধিকাংশ সময়ই নিম্নবর্গকে দেখা যায় নিষ্ক্রিয়, ভীরু, একান্ত অনুগত একটি জীব হিসেবে। অন্যে চালিত করলে তবেই যেন সে চলে। একমাত্র প্রকাশ্য রাজনৈতিক বিরোধ, বিশেষ করে বিদ্রোহের সময়ই শাসকগোষ্ঠী তাকে সক্রিয় প্রতিপক্ষ হিসেবে গ্রাহ্য করে। এই ধরনের ঐতিহাসিক বিবরণগুলোর মধ্য থেকে নিম্নবর্গের চেতনার আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য,
অর্থাৎ স্বাতন্ত্র্য বা পরাধীনতার দ্বৈত চরিত্রটি উদ্ঘাটন করাটা নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনার একটা বিশেষ দিক হিসেবে গৃহীত হয়েছে। রণজিৎ গুহ-র এলিমেন্টারি আসপেক্টস অফ পেজান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া গ্রন্থটি প্রধানত এই সমস্যা নিয়ে। এতে তিনি দেখিয়েছেন, কৃষকবিদ্রোহকে কতকগুলো অর্থনৈতিক শর্ত দিয়ে সরাসরি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আপাতদৃষ্টিতে যে বিদ্রোহকে মনে হয় আকস্মিক, কিছু অবাস্তব কল্পনার দ্বারা চালিত, আসলে তা কিন্তু এই অর্থে ‘স্বতঃস্ফূর্ত' নয়। তার পেছনে থাকে প্রস্তুতি, সংগঠন, রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের নির্দিষ্ট একটা ছক। এই ছক নিহিত রয়েছে কৃষক চেতনায়। বিদ্রোহের উদ্দেশ্য, তার অলীক চরিত্র এবং রাজনৈতিক পরিণতি হিসেবে তার অনিবার্য ব্যর্থতা, এসবেরই যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে কৃষক চেতনার আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে, অর্থাৎ স্বাতন্ত্র্য বা বৈপরীত্যের দ্বান্দ্বিক রূপটিতে
নিম্নবর্গের ইতিহাসের অপর আলোচ্য বিষয় হলো ঐতিহাসিক উত্তরণের সমস্যা। এর অন্তত দুটি দিক আছে। একটি হলো, উচ্চবর্গ বা নিম্নবর্গের রাজনৈতিক সংগ্রামের ফলস্বরূপ সমাজ কাঠামোয় মৌলিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা কতদূর? অন্যটি হলো, নিম্নবর্গের চেতনার পৃথক ও স্বতন্ত্র রূপটিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে কি? পরিবর্তন ঘটলে তা কীভাবে ঘটে? প্রথম প্রশ্নটির বলাবাহুল্য কোনো সরল কিংবা সাধারণভাবে প্রযোজ্য উত্তর নেই। কারণ এই সম্ভাবনাগুলো একান্তই নির্ভর করে বিশেষ ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের অসম বিকাশের ফলে সৃষ্ট বিরোধগুলোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণি, গোষ্ঠী বা জনসমষ্টির রাজনৈতিক ভূমিকা ও পারস্পরিক শক্তির উপর। উত্তরণ-প্রক্রিয়ার কোনো সাধারণ নিয়ম এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার করা যায়নি। তবে উচ্চবর্গ বা নিম্নবর্গ বিশ্লেষণ পদ্ধতি যাঁরা অনুসরণ করেন, তাঁদের বিশ্বাস উত্তরণ-প্রক্রিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত শ্রেণিসংগ্রামের রাজনৈতিক প্রকাশ ও শ্রেণিচেতনার বৈপরীত্য গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে এই সাধারণ নিয়মগুলো নির্ধারণ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। বিশেষ করে, শ্রেণিসম্পর্কের জটিল বিন্যাস এবং সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে ও ভৌগোলিক ব্যাপ্তিতে শ্রেণিদ্বন্দ্বের অসম বিকাশকে আরও স্পষ্টভাবে বোধগাম্য করে তোলা যাবে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটিও সমস্যাকণ্টকিত। উচ্চবর্গের চেতনার স্বরূপ ও তার নিজস্ব বিবর্তনের ধারা ঐতিহাসিকদের কাছে অনেক বেশি সহজবোধ্য। নিম্নবর্গের চেতনার সন্ধান জানা যায় নানা জটিল বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে। এই মুহূর্তে এই বিশ্লেষণ
পদ্ধতিগুলো যে অভিনব এবং অপেক্ষাকৃত অনির্দিষ্ট, তাতে কোনো সন্দেহ নেই । বিশেষ দেশ-কালের সীমানার মধ্যে এই বিশ্লেষণ নিম্নবর্গের চেতনার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে সাহায্য করছে কি না, তা বিচার করার একমাত্র মানদণ্ড হলো সমাজ পরিবর্তনের বৈপ্লবিক রাজনীতির মানদণ্ড। পুঁজিবাদী উৎপাদন-প্রক্রিয়া ও রাষ্ট্রের অধীন যে আধুনিক সমাজব্যবস্থা, তার ঐতিহাসিক উত্তরণের ক্ষেত্রে কৃষক চেতনার একক, এমনকি প্রধান ভূমিকাও থাকা সম্ভব নয়। বুর্জোয়া চেতনার সমগ্রতা, তার ঐতিহাসিক নিশ্চয়তা, ক্ষমতা ব্যবহারের নানা জটিল প্রক্রিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, এমন কোনো শ্রেণিচেতনার নেতৃত্বে বৈপ্লবিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা ছাড়া কৃষক শ্রেণির ঐতিহাসিক পরাধীনতার অবসান সম্ভব নয়। মার্কসবাদের আদিযুগ থেকেই এ সত্য সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদনের বিশ্বব্যাপী প্রসারের পরেও যে বহু দেশে এক বিশাল কৃষক শ্রেণি তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব দীর্ঘদিন বজায় রেখে চলবে, এমন সম্ভাবনার কথা উনিশ শতকের ইউরোপীয় মার্কসবাদীরা ভাবেননি। তখন মনে করা হতো, কৃষক শ্রেণির অবলুপ্তি পুঁজিবাদী উৎপাদনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি- নির্মম, রক্তক্ষয়ী, কিন্তু অনিবার্য। অথচ ১৯১৭-র রুশ বিপ্লব থেকেই দেখা গেছে, তথাকথিত অনুন্নত দেশগুলোতে ঐতিহাসিক উত্তরণ সম্ভব হয়েছে ব্যাপক কৃষক জনসমষ্টির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এক বৃহত্তর সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণির অঙ্গীভূত হয়ে নয়, তাদের জীবিকা, জীবন ধারণ ও চেতনার আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে বৈপ্লবিক ঐক্যের মধ্য দিয়ে ।
সুতরাং বাংলার ভারতবর্ষের মতো কৃষিজীবীবহুল অঞ্চলে কৃষক চেতনার পরিবর্তনের সমস্যা কোনো ঐতিহাসিক অনিবার্যতার ধারণা দিয়ে সমাধান করা যাবে না। আধুনিক পুঁজিবাদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম এমন শ্রেণিচেতনার সঙ্গে বৈপ্লবিক ঐক্যের সম্ভাবনার মধ্যেই এর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। এইজন্যই আন্তোনিও গ্রামসি বলেছিলেন, সাবলটার্ন শ্রেণির জীবনযাত্রা, আচার আচরণ, ভাবাদর্শ গভীরভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন । আজকের বাংলাদেশ তথা ভারতের ক্ষেত্রেও সেই কারণে বৈপ্লবিক নেতৃত্ব তথা বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, উচ্চবর্গ বা নিম্নবর্গ দ্বন্দ্বের জটিল বিন্যাস ও অসমতার, বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলে সেই দ্বন্দ্বের নানা ধরনের বহিঃপ্রকাশ এবং এই অসমতার মধ্যে বৈপ্লবিক ঐক্যের সন্ধান করা ।
১৯৭০-এর দশকে ভারতের মার্কসবাদী রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে উত্তপ্ত বাদানুবাদ ঘটে যায়, সাবলটার্ন স্টাডিজ'-এর শিকড় খুঁজে পাওয়া যাবে সেই অসম্পূর্ণ বিতর্কে। উপরে উদ্ধৃত প্রবন্ধটিতেও তার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে বিতর্ক জমে উঠেছিল ওই সময়। একটিতে অংশ নেন প্রধানত অর্থনীতিবিদেরা, যাঁদের আলোচ্য ছিল ভারতবর্ষের কৃষি-অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী উৎপাদনরীতির উদ্ভব। এক পক্ষের বক্তব্য ছিল, ঔপনিবেশিক আমলের শেষ পর্ব থেকেই ভারতের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। কৃষিপণ্যের বিশ্বব্যাপী বাজার এবং বড়মাপের সংগঠিত অর্থলগ্নি ব্যবস্থার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়ে চলতে শুরু করেছে। অন্য পক্ষে দেখাবার চেষ্টা করে যে কোনো কোনো এলাকায় সীমিত কিছু পরিবর্তন সত্ত্বেও ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধা- > সামন্ততান্ত্রিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এখনো অটুট রয়েছে। বৃহত্তর বাজার বা লগ্নি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েও প্রাক-ধনতান্ত্রিক সমাজের মৌলিক রূপান্তরের কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। অন্য বিতর্কটি হয় প্রধানত ঐতিহাসিকদের মধ্যে। সেখানে আলোচ্য ছিল উনিশ শতকের বাংলায় তথাকথিত নবজাগরণ। জাতীয়তাবাদী, এমনকি মার্কসবাদী ইতিহাসেও দীর্ঘদিন ধরে ‘নবজাগরণ'-এর মনীষীদের ‘প্রগতিশীল' ভূমিকা একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অধিকার করে ছিল। সত্তর দশকে অশোক সেন, রণজিৎ গুহ, সুমিত সরকার ইত্যাদি ঐতিহাসিক প্রশ্ন তুললেন, রামমোহন-বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীদের ঐতিহাসিক ভূমিকা প্রগতিশীল কোনো অর্থে? তাঁদের সংস্কার চিন্তা তো ঔপনিবেশিক অর্থনীতি-রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে এগোতে চেষ্টা করেনি। বস্তুত ব্রিটিশ শাসনের প্রগতিশীলতার উপর আস্থা রেখেই তো তাঁদের সমাজসংস্কার প্রচেষ্টা শুরু, আর সেই শাসনক্ষমতার সীমাবদ্ধতাই তাঁদের সংস্কার-প্রচেষ্টার সীমা। ঔপনিবেশিক ভারতে ক্ষমতার বিন্যাস নিয়ে কোনো মৌলিক প্রশ্ন ‘নবজাগরণ' এ নায়কেরা তোলেননি, বরং সেই ক্ষমতা বিন্যাসকে অবলম্বন করেই তাঁরা সামাজিক প্রগতি আনার চেষ্টা করেছেন । সে চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া অনিবার্য ছিল ।
সমাজবিজ্ঞান-ইতিহাস নিয়ে লেখাপড়ার জগতে এই দুটি বিতর্ক যে সময় ওঠে, তার অল্প কদিন আগেই ভারতের বামপন্থি রাজনীতি আর-একটি বিতর্ক আন্দোলিত হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের নকশালবাড়ি কৃষক-সংগ্রামের ঘাত প্রতিঘাত শুধুমাত্র কিছুটা ক্ষণস্থায়ী চাঞ্চল্য, রক্তক্ষয় আর রাজনৈতিক ব্যর্থতাতেই নিঃশেষ হয়ে যায়নি। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রব্যস্থায় ক্ষমতা বিন্যাসের প্রশ্নটি জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে এমনই নাটকীয়ভাবে উপস্থিত করতে পেরেছিল সেই আন্দোলন, যে সেই প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করা ছিল অসম্ভব। রাজনৈতিক সংগ্রাম পর্যুদস্ত হয়ে যাওয়ার অনেক পরেও তাই সে- প্রশ্নটি সমাজবিজ্ঞানে, ইতিহাসে, শিল্পকলায়, সাহিত্যে, নাটকে, সিনেমায় নানাভাবে প্রতিফলিত হতে থাকে। যে দুটি পণ্ডিত বিতণ্ডার কথা উপরে বললাম, তাতেও যে বিভিন্ন দিক থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা চলেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই অসম্পূর্ণ বিতর্কের পটভূমিতে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ' আবার ওই ক্ষমতা বিন্যাসের প্রশ্নটিকে নতুনভাবে তুলতে সক্ষম হয় ।
সাবলটার্ন স্টাডিজ প্রথম খণ্ডের গোড়ায় রণজিৎ গুহ রচিত একটি ক্ষুদ্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যাকে পরবর্তীকালে অনেকে নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার ‘ম্যানিফেস্টো' বলে অভিহিত করেছেন। এই প্রবন্ধের প্রথম লাইনেই বলা হয়, ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস-রচনায় দীর্ঘদিন ধরে ঔপনিবেশিক উচ্চবর্গ আর বুর্জোয়া-জাতীয়তাবাদী উচ্চবর্গের আধিপত্য চলে আসছে।' নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার উদ্দেশ্য হলো এই দুই ধরনের উচ্চবর্গীয় আধিপত্যের বিরোধিতা করা। স্মরণ করা যেতে পারে, ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে দুটি বিবদমান গোষ্ঠীর ঝগড়া এই সময় তুঙ্গে। এক দিকে কিছু ব্রিটিশ ও মার্কিন-ঐতিহাসিক দেখাবার চেষ্টা করছিলেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আসলে মুষ্টিমেয় কিছু উচ্চবর্গের নীতিহীন আদর্শহীন ক্ষমতা দখলের কৌশল মাত্র। চিরাচরিত জাতি-ধর্ম-সাম্প্রদায়িক আনুগত্যের বন্ধনকে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সেখানে শুধুমাত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্যদিকে
জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা এর তুমুল প্রতিবাদ করে বলছিলেন জাতীয়তাবাদী আদর্শের কথা, জাতীয়তাবাদী নেতাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কথা, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ব্যাপক জনসাধারণের অংশগ্রহণের কথা। রণজিৎ গুহ-র প্রবন্ধে ঘোষণা করা হয়, এই দুটি ইতিহাস আসলে উচ্চবর্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত, কারণ দুটি ইতিহাসইে ধরে নিয়েছে যে জাতীয়তাবাদ হলো উচ্চবর্গের ক্রিয়াকলাপের ফসল। বিবাদ শুধু সেই ক্রিয়াকলাপের নৈতিক চরিত্র নিয়ে- তা সংকীর্ণ ব্যক্তি বা শ্রেণিস্বার্থের সাময়িক যোগফল, নাকি আদর্শ আর স্বার্থত্যাগের জাদুকাঠির স্পর্শে ব্যাপক জনসাধারণের চেতনার উন্মেষ। এই দুটি ইতিহাসের কোনোটাতেই জনগণের নিজস্ব রাজনীতির কোনো স্থান নেই ।
সাম্রাজ্যবাদী আর জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের বিরোধিতার পথ ধরেই নিম্নবর্গের ইতিহাসের প্রথম কর্মসূচি নির্দিষ্ট হয়। আগেই বলেছি, দুটি বিষয় এখানে প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছিল। এক, ঔপনিবেনিবেশিক আর দেশীয়, দু-ধরনের উচ্চবর্গের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আর পদ্ধতির সঙ্গে নিম্নবর্গের রাজনীতির পার্থক্য। দুই, নিম্নবর্গীয় চেতনার নিজস্বতা। প্রথম বিষয়টি অনুসরণ করতে গিয়ে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ'-এর ঐতিহাসিকেরা দেখালেন যে শুধুমাত্র দেশীয় উচ্চবর্গের অঙ্গুলি হেলনে নিম্নবর্গের দল জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়েছিল, সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসের এই অভিযোগ যেমন সত্য নয়, তেমনি জাতীয়তাবাদী নেতাদের আদর্শ আর অনুপ্রেরণার স্পর্শ পেয়ে তবে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক চেতনা জেগে উঠল, এই দাবিও সত্য নয় । উচ্চবর্গ পরিচালিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মঞ্চে নিম্নবর্গে প্রবেশ করেছিল ঠিকই। আবার বহুক্ষেত্রে নানা অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও তারা সেখানে প্রবেশ করতে আদৌ রাজি হয়নি, অথবা একবার প্রবেশ করে পরে সরে এসেছিল। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা, পদ্ধতি ছিল উচ্চবর্গের তুলনায় পৃথক। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ক্ষেত্রেও নিম্নবর্গের জাতীয়তাবাদ ছিল উচ্চবর্গের জাতীয়তাবাদের তুলনায় ভিন্ন ।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি এসেছে প্রথমটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। নিম্নবর্গের রাজনীতির ধরনধারণ যদি স্বতন্ত্র হয়, সেই স্বাতন্ত্র্যের সূত্র কোথায়? তা নির্ধারিত হচ্ছে কোনো নিয়মে? উত্তর হলো, নিম্নবর্গের রাজনীতির চরিত্র নির্ধারিত হচ্ছে নিম্নবর্গের নিজস্ব চেতনার রূপরেখা অনুসারে। সেই চেতনা গড়ে উঠেছে অধীনতার অভিজ্ঞতা থেকে । দৈনন্দিন দাসত্ব শোষণ আর বঞ্চনার মধ্যেও নিজের অস্তিত্বটুকু বজায় রাখার সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। সে চেতনার পরিচয় পাওয়া যাবে কোথায়? ঐতিহাসিক নথিপত্রে নিম্নবর্গের চেতনার সরাসরি সাক্ষ্য প্রায় কোথায়ও পাওয়া যায় না। কারণ সেই নথি তৈরি করেছে উচ্চবর্গেরা। সাধারণ অবস্থায় নিম্নবর্গকে সেখানে কেবল প্রভুর আদেশ পালন করতেই দেখা যায়। একমাত্র একটি মুহূর্তেই শাসককুলের মানসপটে নিম্নবর্গ আবির্ভূত হয় স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে। সেই মুহূর্তটি হলো বিদ্রোহের মুহূর্ত। নিম্নবর্গ যখন বিদ্রোহী তখনই হঠাৎ শাসকবর্গের চেতনার খোঁজ করতে হয়, তবে তা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে পাওয়া যাবে বিদ্রোহ আর বিদ্রোহদমনের ঐতিহাসিক দলিলে ।
এই কারণেই প্রথম পর্বের সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর গবেষণায় একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে কৃষক বিদ্রোহের ইতহাস। রণজিৎ গুহ-র এলিমেন্টারি আসপেক্টস গ্রন্থের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু এছাড়াও সাবলটার্ন স্টাডিজ সংকলনে এবং তার বাইরে অন্যান্য জায়গায় নানা প্রবন্ধ নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকেরা কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস অনুসন্ধান করে বিদ্রোহী কৃষক চেতনার পরিচয় দেবার চেষ্টা করলেন। এই চেষ্টার ফলে অল্প কিছু নতুন সূত্র আবিষ্কার হলো, বিদ্রোহী কৃষক যেখানে তার নিজের কথা বলে গেছে। কিন্তু জানাই ছিল, এমন সূত্র খুব বেশি পাওয়া যাবে না। ইতিহাস-রচনার প্রকরণ হিসেবে অনেক বেশি ফলপ্রসূ হয়ে দেখা দিল কৃষক বিদ্রোহের পরিচিত নথিপত্রগুলোকেই নতুনভাবে পড়ার কৌশল। শাসকবর্গের প্রতিনিধিরা যেখানে কৃষকবিদ্রোহের রিপোর্ট দিচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সেই সরকারি রিপোর্টের বর্ণনাকেই বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উল্টো করে পড়লে বিদ্রোহী কৃষক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়-নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকেরা এর অনেক উদাহরণ এনে হাজির করলেন। তাঁরা আরও দেখালেন উচ্চবর্গের ঐতিহাসিকেরা, এমনকি প্রগতিশীল এবং শোষিত শ্রেণির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ঐতিহাসিকেরাও যখন তাঁদের যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার বশবর্তী হয়ে কৃষক চেতনায় উপস্থিত ধর্মবিশ্বাস, অলৌকিকতা, মিথ, দৈবশক্তিতে আস্থা, অলীক কল্পনা প্রকৃতিকে অযৌক্তিক মনে করে উপেক্ষা করেন বা সেসবের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা খাড়া করে একরাশ মিথ্যার ভেতর থেকে সঠিক ইতিহাসটুকু বের করে আনার চেষ্টা করেন, তখন তাঁরা কৃষক চেতনার বিশিষ্ট উপাদানগুলোকেই আসলে হারিয়ে ফেলেন। হয়তো নিজেদের অগোচরেই তাঁরা নিম্নবর্গের রাজনীতিকে উচ্চবর্গের চেতনার ছকে ফেলে বোধগম্য করার চেষ্টা করেন। নিম্নবর্গের নিজস্ব ইতিহাস, অথবা অন্যভাবে বললে, ইতিহাসে নিম্নবর্গের কীর্তির স্বাক্ষর কিন্তু সেখানে হারিয়ে যায় । ”
‘সাবলটার্ন স্টাডিজ' নিয়ে গোড়ার দিকে সমালোচনাতে দুধরনের আপত্তি উঠেছিল। একটি আপত্তির লক্ষ্য ছিল উচ্চবর্গের আর নিম্নবর্গের রাজনৈতিক ক্ষেত্রের পৃথকীকরণ। দুটি ক্ষেত্র কি সত্যিই ততটা পৃথক? অথবা কোনো এক প্রাক- জাতীয়তাবাদী বা প্রাক-ধনতান্ত্রিক প্রভাবে দুটি ক্ষেত্র কি ক্রমশ এক অপরের সঙ্গে মিলেমিশে যায়নি? বিশ্লেষণের লক্ষ্য হিসেবে উচ্চবর্গের আর নিম্নবর্গের রাজনীতির পার্থক্যের উপর অতটা জোর দেওয়ার তাৎপর্য কী? তাতে কি নানা ধরনের বিভেদকামী বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিকেই পরোক্ষে সমর্থন জানানো হচ্ছে না?
দ্বিতীয় আপত্তি নিম্নবর্গের চেতনা নিয়ে। প্রগতিশীল ইতিহাসের চিন্তার প্রথম উপপাদ্য হলো, মানবচেতনার বিকাশ, চেতনার অনুন্নত বা আদিম অবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে উন্নত চেতনার দিকে অগ্রসর হওয়া। এই প্রগতির তত্ত্ব যেমন একটা গোটা সমাজ বা সভ্যতার বেলায় খাটে, তেমনি সমাজের আভ্যন্তরীণ বিভাজনের ক্ষেত্রেও খাটে। অর্থাৎ শ্রেণিবিভক্ত সমাজে আর্থিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে ক্ষমতাভোগী শ্রেণির চেতনার স্তরও অপেক্ষাকৃত উন্নত হয়। সামাজিক আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে সেই শ্রেণি বা তার কোনো অংশ যদি অগ্রগামী ভূমিকা নেয়, তাহলে তার চেষ্টায় অন্যান্য শ্রেণির চেতনার মানও ক্রমশ উন্নত হয়ে উঠতে পারে। নিম্নবর্গের চেতনার স্বাতন্ত্র্যের কথা তুলে নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকেরা কী চৈতন্যের স্তরভেদ, তার ঐতিহাসিক
ক্রমবিকাশ, এবং সামাজিক প্রগতির ক্ষেত্রে উন্নত চেতনার অধিকারী অগ্রগামী শ্রেণির ভূমিকাকে অস্বীকার করছেন? তাঁরা কি উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গের চেতনার বিচারে উন্নত বা পশ্চাৎপদ, এই তুলনাটাই মানতে চাইছেন না? তাঁরা কি বলছেন, ওই দুটি চেতনা ভিন্ন, স্বতন্ত্র নিয়ম অনুযায়ী গঠিত, অতএব তাদের মধ্যে তুলনার কোনো সাধারণ মাপকাঠি নেই?
জাতীয়তাবাদী এবং মার্কসবাদী, দুটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এই প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছিল। এবং দুটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই প্রশ্নগুলো অত্যন্ত ন্যায্য প্রশ্ন ছিল। জাতীয়তাবাদী অবস্থান থেকে নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখার প্রস্তাবকে ঐক্যবদ্ধ জাতি-রাষ্ট্রের জীবনবৃত্তান্তের পরিপন্থি বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আর প্রগতিবাদী-বামপন্থি অবস্থান থেকেও নিম্নবর্গের চৈতন্যের নিজস্ব গড়ন আর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক উদ্যমের উপর জোর দেওয়ার মানে অগ্রগামী বুর্জোয়া-বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী এবং বৈপ্লবিক পার্টি সংগঠনের প্রগতিশীল ভূমিকা একরকম অস্বীকার করা। দুটি ক্ষেত্রেই নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের উত্তর ছিল, নিম্নবর্গের অবস্থান থেকে দেখলে জাতীয়তাবাদী আর প্রগতিবাদী-বামপন্থি ইতিহাসের কর্মসূচির ভেতরে যে নিম্নবর্গের কোনো স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক ভূমিকা থাকছে না, এটা প্রমাণ করাই নিম্নবর্গের ইতিহাসের উদ্দেশ্য। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের কাজ হলো প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস-রচনার সমালোচনা করা। নিম্নবর্গের ইতিহাস তাই সবসময়ই বিরোধী ইতিহাস। বিকল্প ইতিহাস রচনা-পদ্ধতি কোনো পরিপূর্ণ কর্মসূচি নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক দিতে পারে না। সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর তৃতীয় খন্ডের ভূমিকা লিখতে গিয়ে রণজিৎ গুহ তাই লিখলেন, ‘একজন সমালোচক আমাদের তিরস্কার করে বলেছেন, আমরা নাকি সব প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস রচনা-পদ্ধতিরই বিরোধী। এ অভিযোগ সত্যি। যে তার নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারে, এ-কথা স্বীকার করে না বলে ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞান চর্চার অধিকাংশ রীতি-নীতি পদ্ধতিরই আমরা বিরোধিতা করি। এই বিরোধিতাই আমাদের প্রকল্পের চালিকাশক্তি ।'
বিরোধী বা ক্রিটিকাল ইতিহাস রচনা বা প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস রচনায় পদ্ধতি আছে, থাকবে। উচ্চবর্গের আধিপত্যও আছে, থাকবে। অন্তত ইতিহাস লিখে সে-আধিপত্যের অবসান ঘটানো যাবে না। নিম্নবর্ষের ঐতিহাসিক তাহলে কী করতে পারেন? তিনি বিরোধী ইতিহাস লিখতে পারেন, যেখানে উচ্চবর্গের আধিপত্য অস্বীকার করে নিম্নবর্গ তার নিজের ঐতিহাসিক উদ্যমের কথা বলতে পারে। নিজের ক্রিয়াকলাপের কর্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করতে পারে। সে ইতিহাস কখনোই পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ইতিহাসের সামগ্রিকতা অর্জন করতে পারবে না। নিম্নবর্গ কখনোই গোটা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারবে না। নিম্নবর্গের ইতিহাস তাই অনিবার্যভাবে আংশিক, অসংলগ্ন অসম্পূর্ণ ।
বলাবাহুল্য, এই রকম খন্ডিত, প্রায়শই অসংলগ্ন ইতিহাস রচনার পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে অনুসরণ করে যাওয়া সহজ নয়। পেশাদার গবেষণার জগতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বভাবতই পঠনপাঠনের জগতে রাজনৈতিক বাদানুবাদের জগতে নতুন লেখকদের কাছে একটা প্রত্যাশা থাকে যে তাদের মৌলিক গবেষণার কাজ প্রচলিত ভাবনাচিন্তাকে একটা নতুন দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাবে। যেসব সমস্যার সমাধান প্রচলিত বাকবিতণ্ডার ভেতর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তবে একটা নতুন সমাধান ইঙ্গিত দেবে। তারা যদি প্রতিষ্ঠিত মতবাদের বিরোধিতা করে, তবে বিকল্প কোনো মতবাদকে এখনই উপস্থিত করতে না পারলেও, তেমন এক সামগ্রিক বিকল্প নির্মাণ করার প্রচেষ্টাটুকু অন্তত তারা সমর্থন করবে, এমন আশা করা নিশ্চয় অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ' এই প্রত্যাশা পূরণ করতে রাজি হয়নি ।
বিষয়টা নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে, তাই খানিকটা বিশদ আলোচনা করলে হয়তো সুবিধা হয়।
সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর প্রথম পর্বের কাজে এমন একটা বিকল্প মতবাদের ইঙ্গিত অনেকে দেখেছিলেন। আগেই বলেছি, সাবলটান স্টাডিজ-এর গবেষণা প্রধানত কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে শুরু হয়। রাজনৈতিক চেতনাহীন নিষ্ক্রিয় কৃষকের ধারণার বিরোধিতা করে সাবলটান স্টাডিজ-এর ঐতিহাসিকেরা দেখাবার চেষ্টা করেন যে বিদ্রোহী কৃষক আসলে এক স্বকীয়, সৃজনশীল এবং বিশিষ্ট চৈতন্যের অধিকারী। বলাবাহুল্য, ঔপনিবেশিক এবং জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের উচ্চবর্গীয় পক্ষপাতিত্বের বিরোধিতায় এই পদ্ধতি খুব উপযোগী ছিল। কিন্তু উলটো এক বিপদের সম্ভাবনাও তাতে নিহিত ছিল। তা হলো কৃষক সমাজ নিয়ে এক ধরনের রোমান্টিকতা, যা রাশিয়ার নারদনিক দলগুলো থেকে শুরু করে এদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে কৃষক বিপ্লবের বিভিন্ন প্রচেষ্টায় বহুবার দেখা গিয়েছে। অস্বীকার করে লাভ নেই ১৯৬০-এর আর ১৯৭০-এর দশক দুটির রাজনৈতিক বাদানুবাদ এবং নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের আপাত বিপর্যয়ের পটভূমিতে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ'-এর কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসচর্চা প্রায় অনিবার্যভাবেই এক ধরনের নকশালি রাজনীতির রোমান্টিক রোমখন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। এও সত্যি যে প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনাকে সমালোচনা করতে গিয়ে সাবলটার্ন অবস্থানকে অবলম্বন করেছিলেন। আর এক সম্ভাবনাও গোড়ার দিকের সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর লেখায় অনেকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তা হলো এক ধরনের রোমন্টিক স্বদেশিয়ানা-বিদেশ থেকে আমদানি করা যন্ত্রসভ্যতা আর আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিধ্বংসী ইতিহাসের হাত থেকে যা আমাদের নিষ্কৃতি দিতে পারে, যার নিরাপদ ছায়ায় মনে হয় দেশজ কৃষি সমাজের জ্ঞানভান্ডার এবং ব্যবহারিক জীবনের ঐতিহ্যই আমাদের প্রকৃত আদর্শ সমাজ গঠনের পথ বাতালে দিতে পারে। সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর কোনো লেখায় ঠিক এইরকম ইঙ্গিত কখনও করা হয়েছিল বলে আমার জানা নেই, কিন্তু পরবর্তী সময়ে একাধিক সমালোচক সাবলটার্ন স্টাডিজ- এর মধ্যে এই জঙ্গি স্বদেশিয়ানার গন্ধ পেয়েছেন। তার কারণ তাঁদের ঘ্রাণশক্তির অসাধারণ প্রখরতা না কি ওরকম একটা তকমা এঁটে দিতে পারলে গালাগাল করতে সুবিধা হয়, এর উত্তর নিশ্চিতভাবে জানি না ।
আসলে প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস চর্চার মহলে যে-ভূমিকায় সাবলটার্ন স্টাডিজ সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ছিল, সেটা হয় এক ধরনের র‍্যাডিক্যাল সামাজিক ইতিহাস কিংবা ‘হিসট্রি ফ্রম বিলো'- তল থেকে দেখা ইতিহাস। সত্তর-আশির দশকে ইউরোপে এই ধরনের ইতিহাস লেখার খুব চল হয়েছিল। ক্রিস্টোফার হিল, এডয়ার্ড টমসন, এরিক হসবম প্রভৃতি ইংরেজি মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের ধারা অনুসরণ করে অনেকেই তখন ইউরোপের পুঁজিবাদ আর যন্ত্রসভ্যতার অগ্রগতির ঢক্কানিনাদে চাপা পড়ে যাওয়া বিস্মৃত
অবহেলিত জনগোষ্ঠী ও তাদের ভিন্নতর জীবনযাত্রার কথা লিখছিলেন। এই ‘তল থেকে দেখা ইতিহাস' প্রধানত ইতিহাস রচনায় বাদ পড়ে যাওয়া অনেক ঘটনা, মতাদর্শ, স্মৃতি খুঁজে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল। বিশেষ করে যে সব ঘটনা বা আন্দোলন ছিল নিতান্তই আঞ্চলিক এবং ক্ষণস্থায়ী, সেই সব ঘটনার পৃথক পৃথক কাহিনি এবং বিশিষ্ট তাৎপর্যকে চিহ্নিত করে বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মূলধারার বর্ণনাটিকে অনেক বেশি জটিল ও বর্ণাঢ্য করে তুলেছিল এই নতুন সামাজিক ইতিহাস । ইতিহাসচর্চার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই ধারাটি তখন প্রচলিত ছিল বলে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ' এর লেখাগুলোতে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়াটা কিছু অস্বাভাবিক ছিল না। ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ'-এর লেখকেরাও যে ইউরোপের র‍্যাডিক্যাল সামাজিক ইতিহাসের কাজ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই ।
কিন্তু এক জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ তফাত ছিল। পশ্চিমী দুনিয়ার আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের বিশাল ইমারতের তল থেকে খুঁজে খুঁজে এইসব বিস্মৃত কাহিনি বের করে আনার ফলে সেই ইমারত কী করে তৈরি হলো, তার বর্ণনাটি আরও বিশদ ও পরিপূর্ণ হলো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ইমারতের অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব এবং ঐতিহাসিক ন্যায্যতা সম্বন্ধে কোনো মৌলিক প্রশ্ন সেখানে ওঠার সম্ভাবনা ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘তল থেকে দেখা' ইতিহাসের কাহিনি বাঁধা হতো ট্র্যাজেডির সুরে । শোষিত অবহেলিত মানুষের বঞ্চনা আর নিপীড়নের গল্প সেখানে মর্মান্তিক, তাদের প্রতিরোধ হয়তো বা সহনীয়, কিন্তু গল্পের শেষে তাদের পরাজয় অনিবার্য। এসব গল্পের প্রভাবে ইতিহাসের মূল গতিপথ একচুলও এদিক-ওদিক নড়ার সম্ভাবনা ছিল না ।
বাংলা তথা ভারতবর্ষের মতো দেশের ক্ষেত্রে ‘তল থেকে দেখা' ইতিহাসকে কিন্তু এরকম কোনো ছকের ভেতর বেঁধে রাখা কঠিন ছিল। ভারতে পুঁজবাদী আধুনিকতার বিবর্তনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে গল্পের শেষটা অত নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়নি । বিশ্বের অন্যত্র যা ঘটেছে, ভারতে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে, এই ফর্মুলাটা যদি মাথায় চেপে বসে না থাকে, তাহলে ‘তল থেকে দেখা' ভারতীয় ইতিহাসের লেখক সহজেই দেখতে পাচ্ছিলেন যে তাঁর গবেষণার উপাদান থেকে বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে অনেক মৌলিক প্রশ্ন তোলার সুযোগ খোলা রয়েছে। আগেই বলেছি, লিবারাল জাতীয়তাবাদ এবং মার্কসবাদ, দুধরনের ইতিহাস রচনার প্রতিষ্ঠিত ছক সম্বন্ধেই ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ' এর লেখকদের মনে সংশয় ছিল। র‍্যাডিকাল সামাজিক ইতিহাসের চর্চায় নেমে তাঁরা তাদের বর্ণনাকে কোনো নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে বেঁধে রাখতে চাইলেন না। ভারতবর্ষের ইতিহাসের পরিণতি আধুনিক সমাজের কোনো নির্দিষ্ট ও পরিচিত ধারণার বাস্তবায়ন, এই কাহিনি সূত্রটি তাঁরা বারে বারেই অস্বীকার করতে লাগলেন তাঁদের লেখায়। তাই ‘তল থেকে দেখা' ইতিহাস হিসেবেও ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ'-এর লেখা বেশ অস্বস্তির কারণ হয়ে রইল ইতিহাস চর্চার মহলে ।
সাবলটার্ন স্টাডিজ- এর প্রথম পর্বের কাজের সবচেয়ে মৌলিক সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভ্যাক-এর দুটি প্রবন্ধে। ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ'-এর গবেষণার দুটি বৈশিষ্ট্যের দিকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো যে, ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের যা পরিধি, নিম্নবর্গের নাজনীতি তার বাইরেও বটে, আবার ভেতরেও বটে। যে অর্থে তা বাইরে, সেই অর্থে নিম্নবর্গের রাজনীতি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থা অথবা ভাবদর্শের তুলনায় স্বতন্ত্র। কিন্তু তা আবার ভেতরেও বটে, কারণ বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে নিম্নবর্গের রাজনীতি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, তাকে সুবিধামতো ব্যবহার করছে, হয়তো বা একরকমভাবে আত্মস্থ করছে। এই গবেষণার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, একদিকে নিম্নবর্গীয় সত্তা বা চৈতন্যের একটা বিশুদ্ধ আকৃতির ধারণা, অন্যদিকে ঐতিহাসিক মালমশলায় বারেবারেই এটা আবিষ্কার করা যে নিম্নবর্গের উপস্থিতি ঘটছে বিভিন্ন আকারে, বিভিন্ন চেহারায়। এমনকি নিজের ভেতরেই বিভাজিত অবস্থায়। গায়ত্রী স্পিভ্যাক প্রশ্ন তুললেন, ইতিহাস রচনার প্রতিটি উপাদানই যখন দেখিয়ে দিচ্ছে যে নিম্নবর্গ মানেই ‘কোনো এক আদর্শ থেকে বিচ্যুতি, তখন নিম্নবর্গের ঐতিহাসিককে অত ঘটা করে বিশুদ্ধ কৃষকচৈতন্য অথবা একান্তভাবে স্বতন্ত্র নিম্নবর্গের রাজনীতির স্লোগান আওড়াতে হচ্ছে কেন? বুর্জোয়া ইতিাহস রচনায় ‘মানব’ অথবা ‘নাগরিক' নামে যে সার্বভৌম কর্তাটি অধিষ্ঠিত হয়েছিল, নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক তো দেখিয়েছেন যে সেই কর্তাটির আসল পরিচয় হলো সে উচ্চবর্গ। এখন আবার সেই জায়গায় ‘নিম্নবর্গ' কে আর একটি সার্বভৌম কর্তার পোশাক পরিয়ে ইতিহাসের নায়ক হিসেবে উপস্থিত করার প্রয়োজন কী? আসলে ইতিহাসের কোনো একটি কর্তা আছে, এবং তার একটি বিশুদ্ধ পূর্ণাবয়ব চৈতন্য আছে, এই ধারণাকেই তো নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক তাঁর গবেষণার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করেছেন। সেই ধারণাকেই আবার তাঁরা ফেরত আনার চেষ্টা করছেন কেন? ঐতিহাসিকের লেখার ভেতর দিয়ে নিম্নবর্গ তার নিজের কথা বলবে, এটা তো নিতান্তই গল্পকথা খুব বেশি হলে সেটা ঐতিহাসিকের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রকাশ। আসলে তো ঐতিহাসিক নিম্নবর্গের প্রতিনিধিত্ব করছেন মাত্র। নিম্নবর্গকে ইতিহাসের পাতায় উপস্থিত করছেন। নিম্নবর্গ তার নিজের কথা কখনওই বলতে পারে না ।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে লেখা প্রবন্ধ দুটিতে গায়ত্রী স্পিভ্যাক প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘সবার উপরে নিম্নবর্গের সত্য' এরকম মন্ত্র না আউড়ে নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের চেষ্ট করা উচিত উচ্চবর্গের অপর হিসেবে নিম্নবর্গকে কীভাবে নির্মাণ করা হয়, সেই প্রক্রিয়াগুলোকে আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করা। হাজার আওয়াজের ভেতর থেকে নিম্নবর্গের নিজস্ব কণ্ঠস্বরই শুনি না কেন, তা নিম্নবর্গের কথা নয়, অন্যের নির্মাণ। এই নির্মাণের সামাজিক পদ্ধতিগুলো কী, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ভেতর দিয়ে তা তৈরি হয়, কোনো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তা ব্যাপক সামাজিক স্বীকৃতি পায়, সেসব প্রক্রিয়াগুলো আবিষ্কার করাই নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাঁদের কাছে সেটাই সবচেয়ে বাস্তব প্রত্যাশা ।
মোটামুটিভাবে পঞ্চম-ষষ্ঠ খণ্ড থেকে সাবলটার্ন স্টাডিজ- এ প্রকাশিত গবেষণায় নতুন ঝোঁক দেখা দিতে শুরু করে। আগের সঙ্গে পরের পর্বের প্রধান তফাত এইখানে যে ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে নিম্নবর্গের সত্তা বা চৈতন্যের একটা বিশুদ্ধ পরিপূর্ণ চেহারার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব, এই অতি সরল ধারণাটি এখন পরিত্যক্ত হলো। নিম্নবর্গের ইতিহাস আংশিক, অসংলগ্ন, অসম্পূর্ণ, তার চেতনাও বহুধাবিভক্ত, ক্ষমতাশীল আর ক্ষমতাহীন নানা শ্রেণিচৈতন্যের বিভিন্ন উপাদানের তা সংমিশ্রণ- এই সিদ্ধান্তগুলোকেও এখন এখন গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকার করা হলো। ফলে বিদ্রোহের মুহূর্তে কৃষক চৈতন্যের স্বকীয়তার পাশাপাশি দৈনন্দিন অধীনতার জীবনযাপনে কৃষক চৈতন্যের স্বরূপ সন্ধান জরুরি হয়ে পড়ল। এবং এই প্রশ্নগুলো এসে পড়তে দেখা গেল, প্রচলিত সমাজবিজ্ঞান ইতিহাসচর্চার প্রায় প্রতিটি বিষয় নিয়েই ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ'-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটা নতুন অনুসন্ধানের পথ খুলে যাচ্ছে। কারণ প্রশ্নটা এখন আর এই রইল না যে ‘নিম্নবর্গের প্রকৃত স্বরূপ কী?' প্রশ্নটা হয়ে গেল ‘নিম্নবর্গকে রিপ্রেসেন্ট করা হয় কীভাবে? ‘রিপ্রেসেন্ট' কথাটা এখানে প্রদর্শন করা আর প্রতিনিধিত্ব করা, উভয় অর্থেই প্রযোজ্য। উচ্চবর্গের অপর হিসেবে নিম্নবর্গের ধারণার নির্মাণ- এই বিষয়টি ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ'- এর গোড়া থেকে চর্চিত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তখন অনুমানটি এমন ছিল যে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারলে উচ্চবর্গের নির্মাণের খোলশটা খসে পড়বে, প্রকৃত নিম্নবর্গের স্বরূপ চোখের সামনে ভেসে উঠবে। এই অনুমানটি যে ভুল রিপ্রেসেন্টেশন-এর গণ্ডি অতিক্রম করে কোনো এক প্রত্যক্ষ বাস্তবের উপলব্ধিতে পৌছনো যে অসম্ভব, এটা একবার স্বীকার করে নেওয়ার পর খাঁটি আগমার্কা নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখার সদিচ্ছাটুকুও আর পোষণ করা সম্ভব ছিল না। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের চোখের সামনে রোমান্টিকতার মোহজাল থেকে থাকলে তা এবার নিশ্চিতভাবে খসে পড়ল ।
রিপ্রেসেন্টেশন প্রক্রিয়াগুলোই যেহেতু এখন বিশ্লেষণের লক্ষ্য, তাই গবেষণার পদ্ধতিও অনেকাংশে বদলে গেল। একদিকে ঝোঁক গিয়ে পড়ল টেক্সট্ বা পাঠ্যবস্তুর খুঁটিনাটি বিশ্লেষণে। ক্ষমতাশীল উচ্চবর্গের দ্বারা নিম্নবর্গের নির্মাণ- এর নিদর্শন আমরা পাই ইতিহাসের দলিলে। হাজার হাজার দলিল, সেই দলিলের ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকের বর্ণনা, তার পাশাপাশি অন্য নানাবিধ জ্ঞানচর্চা, ধর্মচর্চা, সমাজবিধি, এসবের সংমিশ্রণে তৈরি হয় এক-একটি প্রভাবশালী ডিসকোর্স যার মাধ্যমে ক্ষমতাশীল শ্রেণির মতাদর্শ সামাজিক আধিপত্য বিস্তার করে। এইসব ডিসকোর্সের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিম্নবর্গকে চিহ্নিত করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। 'নিম্নবর্গের নির্মাণ' এই প্রশ্নটিকে সামনে রাখার ফলে এবার ঔপনিবেশিক ভারতে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা এবং আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠান গড়ার জটিল ইতিহাসের দলিল সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে পড়ার প্রয়োজন দেখা দিল। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের প্রসার, ইংরেজি শিক্ষা, তথাকথিত নবজাগরণ, জাতীয়তাবাদের উন্মেষ- এইসব বহুচর্চিত বিষয় নিয়েও সাবলটার্ন স্টাডিজ-এ নতুন করে আলোচনা শুরু হলো।' সেই সঙ্গে নজর গিয়ে পড়ল আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যস্থার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর, যার মাধ্যম নতুন জ্ঞানবিজ্ঞান সঞ্চারিত মতাদর্শ এবং আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্র. ঔপনিবেশিক এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতবর্ষে তার জাল বিস্তার করেছে। অর্থাৎ, স্কুল-কলেজ, সংবাদপত্র, প্রকাশনসংস্থা, হাসপাতাল-ডাক্তার-চিকিৎসাব্যবস্থা, জনসংখ্যা গণনা, রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স, আধুনিক শিল্প উৎপাদনে দৈনন্দিন শ্রমসংগঠন, বিজ্ঞান-সংস্থা, গবেষণার- এইসব প্রতিষ্ঠানের বিশদ ইতিহাসও এবার 'সাবলটার্ন স্টাডিজ' এর বিষয় হয়ে পড়ল ।
এই দিক পরিবর্তনে সব পাঠক সন্তুষ্ট হননি। নিম্নবর্গকে নায়ক হিসেবে দাঁড় করিয়ে এক ধরনের সাদাসাপটা ঐতিহাসিক রোমান্সের বদলে পাঠকের সামনে এবার এসে পড়ল সরকারি দলিল, ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক, জাতীয়তাবাদী নেতার বক্তৃতা, সমাজবিজ্ঞানের প্রবন্ধের খুঁটিনাটি চুলচেরা। অনেকেই বললেন, নিম্নবর্গের ইতিহাস এবার ভদ্রলোকের ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। আলোচনার লক্ষ্যবস্তু নিম্নবর্গের ক্রিয়াকলাপ থেকে ছড়িয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের অন্য সব এলাকাতে পৌঁছে যাওয়ার একটা অসুবিধা অবশ্য হচ্ছিল। সমাজবিজ্ঞান চর্চার জগতে প্রথম আলোড়নটা কেটে যাওয়ার পর ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ' এর জন্য একটা প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা যেন নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়তে গিয়ে ঔপনিবেশিক, জাতীয়তাবাদী, মার্কসবাদী ইতিহাস রচনার পাশাপাশি ‘সাবলটার্ন স্কুল' নিয়ে খানিকটা পড়িয়ে দেওয়া শুরু হয়েছিল। এখন দেখা গেল, ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ' এর কোনো নির্দিষ্ট বিষয়গত সীমারেখা থাকছে না সব বিষয় নিয়েই সেখানে লেখাজোকা শুরু হয়ে গিয়েছে। আপত্তিটা অনেকটা এরকম হয়ে দাঁড়াল- বেশ তো তোমরা চাষাভুষো কুলিকামিন নিয়ে লিখছিলে। এখন হঠাৎ বঙ্কিম-গান্ধি-জওহরলাল বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্য নিয়ে লিখতে শুরু করলে কেন? এই আপত্তি এখনো শুনতে পাই ।
আসলে 'নিম্নবর্গের নির্মাণ' এই পদ্ধতিগত আবিষ্কারটির পর নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের কাজ আর কেবল নিম্নবর্গের স্বতন্ত্র ক্রিয়াকলাপের বিবরণ দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমগ্র সমাজ-প্রতিষ্ঠান-ভাবদর্শের জগতকেই এখন নিম্নবর্গের ইতিহাসের দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আবিষ্কারটি একান্তই পদ্ধতিগত। যে কোনো প্রতিষ্ঠিত সামাজিক বা রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং ক্রিয়াকলাপ যা প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাতন্ত্রের অঙ্গ বা তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তার বিশ্লেষণ এবং সমালোচনা করার সরঞ্জাম এই পদ্ধতি থেকে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কোনো বিকল্প রাষ্ট্রক্ষমতা নির্মাণের কর্মসূচি তা থেকে পাওয়া যাবে না। বরং যে কোনো প্রতিষ্ঠিত অথবা প্রতিষ্ঠার অভিলাষী ক্ষমতাতন্ত্রের সমালোচনাই ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ'-এর ভেতর সম্ভব।
তার মানে কিন্তু এই নয় যে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ'- এর লেখক বা পাঠক হিসেবে সমসাময়িক রাজনৈতিক বাদানুবাদে যোগ দেওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, উচ্চবর্গের রাজনীতি বা মতাদর্শের ভেতর নিম্নবর্গের প্রতিকল্পটি কীভাবে নির্মিত হয়েছে, সেই বিষয়টি এখন অনেক স্পষ্টভাবে নজরে আসার ফলে উচ্চবর্গীয় রাজনীতির বিবাদ ভিন্নতর অবস্থান নেওয়াও অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে। সাম্প্রতিক পর্যায়ের ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ'-এর আলোচনায় অন্তত তিনটি সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনা হয়েছে বলে আমি মনে করি। তিনটি ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি রাজনৈতিক গোষ্ঠীদের পারস্পরিক বিতর্কে নিম্নবর্গীয় রাজনীতিও বামপন্থি রাজনৈতিক গোষ্ঠীদের পারস্পরিক বিতর্কে নিম্নবর্গীয় রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন মাত্রা যোগ করা গিয়েছে ।
প্রথম বিষয়টি হলো সাম্প্রদায়িকতা এই নিয়ে অধিকাংশ আলোচনাই দুটি বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে হয়েছে- একটি হিন্দুত্ববাদী, অন্যটি সেকুলারপন্থি। ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ' এ আলোচনা থেকে যে-দিকটা অনেক স্পষ্ট হয়েছে, সেটা হলো যে এই
প্রতিরোধ আন্দোলনের সংজ্ঞা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং নিম্নবর্গ সেকুলার কমিউনাল ঝগড়া কোনো অর্থেই আধুনিকতা বনাম পশ্চাৎপদতার ঝগড়া নয় । দুটিই সমানভাবে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অঙ্গীভূত। দ্বিতীয়ত, দুই পক্ষ আসলে আধুনিক রাষ্ট্রক্ষমতা বিস্তারের দুধরনের কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করে চলেছে। দুটিই উচ্চবর্গীয়, কিন্তু তাতে নিম্নবর্গের নির্মাণ দুরকমের। তৃতীয়ত, নিম্নবর্গেরাও এই দুধরনের আধিপত্যের সামনে পড়ে নিজেদের মতো, কিন্তু বিভিন্নভাবে, তার মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। দরিদ্র এবং শোষিত হলেই তারা সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরোধী এবং সেকুলার রাজনীতির সমর্থক হবে, এই অতিসরল সিদ্ধান্ত নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক প্রথমেই খারিজ করে দেবেন ৷
দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’- এ উল্লেখযোগ্য আলোচনা- হয়েছে, তা হলো জাতিভেদ প্রথা। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে মণ্ডল কমিশন বিরোধী আন্দোলনের পর এই নিয়ে তুমুল হট্টগোল হয়ে গেছে। ডিসকোর্স হিসেবে দেখার ফলে জাতপাত নিয়ে সাম্প্রতিক রাজনীতির একটি দিক কিন্তু অনেক স্পষ্ট হয়েছে। তা হলো যে জাতিভেদ প্রথার ধর্মীয় ভিত্তি এখন প্রায় সম্পূর্ণ লুপ্ত। কেউ তা নিয়ে আর কথা বলে না। এখন সমস্ত বিরোধেরই কেন্দ্র হলো আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর অবস্থান নিয়ে। দ্বিতীয়ত, তথাকথিত সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতিগত পরিচয় গণ্য করা বা না করার মধ্যেও আবার উচ্চবর্গের আধিপত্য বিস্তারের দুধরনের কৌশল কাজ করছে। এবং নিম্নবর্গও তার সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্নভাবে এই ক্ষমতাতন্ত্রের বিরোধিতাও করছে, আবার সুযোগও নিচ্ছে ।
তৃতীয় বিষয়টি হলো মহিলাদের সামাজিক অবস্থান সংক্রান্ত আলোচনা । পুরুষশাসিত সমাজে সব নারীই এক অর্থে নিম্নবর্গ। কিন্তু তাই বলে নারীর কোনো শ্রেণিগত, জাতিগত, সম্প্রদায়গত পরিচয় নেই, এও সত্য নয়। সুতরাং নিম্নবর্গের নির্মাণ দেখতে হলে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অধীনতাও যেমন বিশ্লেষণের বিষয়, তেমনি অন্যান্য ক্ষমতার সম্পর্ক, যেমন শ্রেণি, জাতি, সম্প্রদায়, ইত্যাদি কীভাবে সেই নিম্নবর্গীয় নারীর নির্মাণটিকে আরও জটিল করে তোলে, তাও বিশেষ গবেষণার বিষয় । সাম্প্রতিক বিতর্কে সমাজসংস্কার এবং বিশেষ করে নারীর অধিকার রক্ষার জন্য আইনের সংস্কার নিয়ে প্রচুর আলোচনা চলেছে। কিন্তু সামগ্রিক অর্থে নারীর অধীনতা আর বিশেষ অর্থে নিম্নবর্গীয় নারীর অধীনতার পরস্পর সম্পর্কিত হলেও যে দুটি ভিন্ন বিষয়, এই সত্যটি তুলে ধরার ফলে সাম্প্রতিক কাজে ভারতের নারীবাদী রাজনীতির বিতর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে ।
এই তিনটি ক্ষেত্রেই নিম্নবর্গের রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী এবং প্রতিষ্ঠিত বামপন্থি রাজনীতির সমালোচনা তৈরি হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর সিংহভাগ ধরে যে উচ্চবর্গীয় রাজনীতি বাংলা তথা ভারতের রাষ্ট্রয়ন্ত্রকে কেন্দ্ৰ করে গড়ে উঠেছিল, আগামীদিনে তার বিরোধী শক্তি হয়তো এইসব সমালোচনাকে অবলম্বন করেই সংগঠিত হবে। বামপন্থি ভাবনাচিন্তার জগতে অন্যদের তুলনায় ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ' যে সেই সম্ভাবনাকে অপেক্ষাকৃত বেশি তাত্ত্বিক স্বীকৃতি দিতে পেরেছে, তার প্রধান কারণ হয়তো এই যে, পদ্ধতির দিক দিয়ে অত্যন্ত মৌলিক
সমালোচনার এবং দিক পরিবর্তনও এখানে নিষিদ্ধ হয়নি। নিম্নবর্গের ইতিহাস যেমন অসম্পূর্ণ, পরিবর্তনশীল, নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চারও ঠিক তেমনই অবদ্ধ আর সচল থাকার চেষ্টা করা প্রয়োজন। এই অর্থে এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এই ইতিহাস চর্চায় নিম্নবর্গের সংগ্রামের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব দেওয়ার প্রয়াস চলেছে।
নিম্নবর্গ আন্দোলন
সমগ্র ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী জুড়েই বাঙালি সমাজ প্রধানত হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। সে অর্থে হিন্দু সমাজের অভ্যন্তরীণ বিভাজনগুলোর প্রবণতা ছিল নেহাৎ অবহেলিত। ফলে বাংলার সামাজিক রূপরেখার প্রকাশিত বৈশিষ্ট্যগুলো স্বল্পসংখ্যক মুসলি। বসতিপূর্ণ মধ্যভারত ও দাক্ষিণাত্যের কোনো কোনো অংশের থেকে ছিল যথেষ্ট ভিন্নতর। যার ফলে ব্রাহ্মণ-বিরোধী আন্দোলনগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।
বাংলায় অস্পৃশ্যদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের রূপ ছিল মহারাষ্ট্র বা দক্ষিণ ভারতের চেয়ে ভিন্নতর। এখানে বর্ণ-কঠোরতা কখনও অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীকে অন্তহীনতার দাসত্বের অবস্থায় রাখার মতো প্রবল ছিল না। এ প্রসঙ্গে অনুন্নত বা তপশিলি সম্প্রদায়ের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের মতো নেতাদের মহারাষ্ট্রের আম্বেদকরের মতো বিশেষ কোনো বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়নি ।
বাংলার ক্ষেত্রে তপশিলি সম্প্রদায়ের তালিকা শুধু অস্পৃশ্যদেরই অন্তর্ভুক্ত করেনি, সেখানে ধর্মীয় আচারে তাদের চেয়ে এক ধাপ উপরে থাকা বহু অজলচল বর্ণও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র তপশিলি সম্প্রদায়ের অধীনে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে তালিকাভুক্ত করতে তাদের ধর্মীয় আচারগত মর্যাদাতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি, সমাজে নিজেদের অর্থনৈতিক মর্যাদাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে তারা এ তালিকা তৈরি করেছিল। সুতরাং এমন ভিন্নমত পোষণ করা হয়েছে যে, বাংলায় অস্পৃশ্যতার তীব্রতা ভারতের অন্যান্য কিছু অঞ্চলের তুলনায় দুর্বল হওয়ায় মন্দিরে প্রবেশর মতো আন্দোলনগুলো অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের আন্দোলনের কর্মসূচির প্রধান দফা হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে নিম্নবর্গের প্রতিবাদ সব সময় অস্পৃশ্যতার পূর্ণ দূরীকরণ দাবি করেনি। এসব আন্দোলন ছিল সমাজের কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সামাজিক পশ্চাৎপদতা দূরীকরণের প্রচেষ্টার অংশমাত্র। মাসাউকি উসুদার মতো বিদ্বজ্জনরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এসব আন্দোলন যৌথ প্রচেষ্টার রূপ নিয়েছিল যেখানে সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ বর্ণের মানুষও অংশগ্রহণ করেছিল। সমাজে ‘ছোট লোক’ (নীচ জন্মের) এবং ধনী ‘ভদ্রলোক' দের (ধর্মীয় আচারের কারণে মর্যাদা, শিক্ষা ও অন্যান্য গুণাবলির কারণে সমাজে উচ্চতর মর্যাদাভোগী মানুষ) মধ্যে বিরাজমান সক্রিয় বিরোধিতায় অস্পৃশ্যতা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো সমস্যাগুলোর প্রতিফলন ঘটেছিল। কোনো কোনো সময় বাঙালি অস্পৃশ্যদের মধ্যে আন্দোলন শ্রেণির দ্যোতনা ধারণ করত। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন দুইভাবে এ ধরেনের আন্দোলনগুলোকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, কখনো
কখনো এ ধরনের আন্দোলনগুলোকে কোনো কোনো অধস্তন গোষ্ঠীকে অযোগ্য ও বঞ্চিত করার অনুমোদন দানকারী কর্তৃত্বময় সামাজিক সংগঠন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রকাশরূপে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে এ যুক্তিও দেখানো হয়েছে যে, এ ধরনের আন্দোলনগুলোকে উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রকাশরূপেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যা ক্ষমতা ও মর্যাদা চেয়েছিল। এ যুক্তি প্রদর্শন করা সময়োপযোগী হবে যে এ ধরনের অস্পৃশ্য সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন স্তরের সামাজিক সচেতনতা এবং বিভিন্ন আকারের রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগের আবির্ভাব ঘটে যা অপরিহার্যভাবে মাত্র একটি আন্দোলনের পরিধির মধ্যে একীভূত হয়ে পড়ে
বাংলায় নিজেদের আর্থসামাজিক পশ্চাৎপদতার কারণে নিম্ন শ্রেণির অথবা ‘অস্পৃশ্যদের’ কারও মধ্যে জাতীয়তাবাদীদের চেয়ে মূলগতভাবে ভিন্নতর বৈশ্বিক লক্ষ্যের বিকাশ ঘটে যার ফলে তারা রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে এ ধরনের আচারগত ‘নিম্ন’ বর্গের সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিবাদী, কেউ কেউ আপসকামী এরকম প্রবণতার ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কিছু মৌলিক পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটানোর প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নিম্ন বর্গের সামাজিক প্রতিবাদ তাদের সযত্নে লালিত লক্ষ্যে পৌছুতে ব্যর্থ হয় ।
উনিশ শতকের শেষের দশকগুলো থেকে নিম্নবর্গের আন্দোলন প্রধানত পূর্ববঙ্গের নমঃশূদ্র ও উত্তরবঙ্গের রাজবংশীদের দ্বারা সংগঠিত ও পরিচালিত হয় । তারাই বাংলার নিম্নবর্ণদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি আন্দোলন সংগঠিত করে। ১৯৩০- এর দশকে এ প্রদেশে নিম্নবর্গের রাজনীতির আবির্ভাব ঘটলে তারা এর নেতৃত্ব এবং জন- সমর্থনের ভিত্তি দুটিই জোগায়। উপরন্তু, এ দুটি সম্প্রদায় মোটামুটিভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে দূরে ছিল। পূর্ববঙ্গে নমঃশূদ্ররা (১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে আদমশুমারি অনুযায়ী ২,০৮৭১৬২ জন) ছিল ভূমি-সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত সবচেয়ে বড় বর্ণ এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করে ফেলেছিল। একইভাবে উত্তরবঙ্গের প্রধান বর্ণ রাজবংশীরা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেছিল এবং সম্ভবত এ থেকে এ অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দুর্বলতার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ৷
আগে চণ্ডাল (অস্পৃশ্যদের বোঝাতে ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দ) রূপ পরিচিত নমঃশূদ্ররা প্রধানত বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে বাস করত। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে আদমশুমারি অনুসারে নমঃশূদ্র জনগোষ্ঠীর ৭৫% এরও বেশি বাস করত বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোর এবং খুলনা জেলায়। বহু গবেষণায় এটাও নির্দেশ করা হয়েছে যে, উত্তর-পূর্ব বাকেরগঞ্জ, দক্ষিণ ফরিদপুর এবং সন্নিহিত নড়াইল, মাগুরা, খুলনা এবং বাগেরহাট জেলায় এ এক অংশ, যারা উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে নিজেদের রাজবংশীরূপে নির্দেশ করা যায় এমন এলাকায় বাস করতো। বিশ শতকের প্রথম বছরগুলোর মধ্যেই রাজবংশী জনসংখ্যার ৮৮% এরও বেশি বাস করতো রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি এবং ক্ষুদ্র রাজ্য কুচরিবহারে। উভয় সম্প্রদায়ের এ ধরনের ভৌগোলিক সংঘবদ্ধতা ছিল তাদের শক্তির প্রধান উৎস। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে এ ধরনের ভৌগোলিক আবাসভূমি হারানো তাদের আন্দোলনের অবনতিতে অবদান রাখে ।
নমঃশূদ্র এবং রাজবংশী উভয়েরই ছিল অস্পৃশ্যতার কালিমা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা নানাবিধ সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় জর্জরিত ছিল। এসব কারণেই ব্ৰাহ্মণ, কায়স্থ এবং বৈদ্যদের মতো বাংলার সুবিধাভোগী উচ্চতর বর্ণের সাথে তাদের যথেষ্ট সামাজিক দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। নিচু সামাজিক অবস্থান ছাড়াও নমঃশূদ্রদের অধিকাংশই ছিল দখলিস্বত্বসহ বা দখলিস্বত্ব ছাড়া ভাগচাষি এবং তাদের কয়েকজন ছিল বর্গাচাষি, যাদের সংখ্যা ১৯২০- এর দশকের শেষের দিকে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে বাংলার কৃষি সম্বন্ধীয় মৌলিক দ্বি-বিভাজন নমঃশূদ্রদের ক্ষেত্রে বর্ণ- ক্রমাধিকারতন্ত্রের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। অবশ্য নমঃশূদ্রদের এক অতি ক্ষুদ্র শ্রেণি সে অঞ্চলে শুরু হওয়া ভূমি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে (অধিকাংশই পূর্ববাংলার ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম- এ তিন বিভাগে) অর্থনৈতিক উন্নতি করে। ফলে কিছু সংখ্যক নমঃশূদ্র বর্গচাষি বা ভোগদখলকারী, অন্য কিছু সংখ্যক মহাজনি কারবারি ও ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে। কিছুকাল পরে কেউ কেউ শিক্ষকতা ও অন্যান্য পেশা গ্রহণ করেছিল ।
ভূমি সম্বন্ধীয় কাঠামোতে পদমর্যাদায় নমঃশূদ্রদের চেয়ে অধিকতর ভালো অবস্থানের কারণে রাজবংশীরা ছিল খাজনা লাভকারী জনসংখ্যার প্রায় ১০.৬৮%। রাজবংশী কৃষকদের মধ্যে অনেকেই বর্গাচাষি বা ‘আধিয়ার' হলেও তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ধনী কৃষক যারা জোতদার এবং চুকমিদার হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ের ভোগদখলের ন্যায়সম্মত অধিকার ভোগ করত। প্রসঙ্গক্রমে, উত্তর বঙ্গের বিশাল অংশে ব্যাপক মাত্রায় জঙ্গল-ভূমি পরিষ্কার করার ফলে রাজবংশীদের দ্বারা কিছু বড় জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তবে এটা মনে রাখা দরকার যে, নমঃশূদ্র ও রাজবংশী অভিজাতরা নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র পরিচিতি লাভ করতে না পারায় এবং কৃষক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার ফলে ১৯৩০-এর দশকের সমাপ্তির আগে অভ্যন্তরীণ এসব স্ব-বিরোধিতা প্রধান হয়ে ওঠেনি।
কিছু উদারপন্থি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রভাবে নমঃশূদ্রদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধের বিকাশ ঘটে। কেবল পাগল বা সাহালাল পীরের মতো ভগবৎ ও আধ্যাত্মিক শক্তিধর গুরুর নেতৃত্বে এসব উদারপন্থি ও প্রগতিবাদী সম্প্রদায় ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ বিশিষ্ট হিন্দু বর্ণপ্রথাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল এবং ভক্তি ও আধ্যাত্মিক আবেগের (ভাব) উপর প্রতিষ্ঠিত সহজ আচরিত নীতিমালার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিল। ১৮৭২-৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মণ্ডলের নেতৃত্বে নমঃশূদ্ররা উচ্চ বর্ণগুলোর সঙ্গে আর্থসামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের আত্মসম্মানবোধকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল। এ আন্দোলনের ব্যর্থতা শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রভাবে একটি সংগঠিত ধর্মীয় উপদল মতুয়া সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে। ধনী কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণকারী গুরুচাঁদ বর্ণপ্রথার উচ্ছেদ, পুরুষ ও মহিলাদের মমতা এবং পার্থিব দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক মুক্তির সম্ভাবনার বাণী প্রচার করেন। পরবর্তীকালে ‘হাতে কাম মুখে নাম' (হাতে কাজ কর, মুখে নাম জপ কর) স্লোগানের মাধ্যমে এ আন্দোলনের বাণী অভিব্যক্তি লাভ করে। প্রায় একই সময়ে প্রভু জগদ্‌বন্ধুর মতো (১৮৭১-১৯২১) আরও অনেক নিম্নবর্গের আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি ফরিদপুর ও যশোরে নমঃশূদ্রদের মধ্যে তাদের শিক্ষাবলির প্রসার ঘটিয়েছিলেন। জগদ্বন্ধুর শিক্ষাবলি মহান্ত সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তৈরি করেছিল ।
প্রতিরোধ আন্দোলনের সংজ্ঞা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং নিম্নবর্গ নমঃশূদ্রদের খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরণ ছিল অন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ব্যাপটিস্ট, অ্যাংলিকান এবং রোমান ক্যাথলিকদের মতো খ্রিষ্টান সম্প্রদায়গুলো ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নমঃশূদ্রকে ধর্মান্তরিত করেছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রাথমিক বছরগুলো থেকে নমঃশূদ্র সমিতির প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং বর্ণ আন্দোলনের বার্তা প্রচার ও একে সংগঠিত করার জন্য নিয়মিতভাবে ‘আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন সভার' আয়োজন করা হয়। একই সঙ্গে যাত্রা এবং মুষ্টি সংগ্রহের মতো ব্যাপক জনসংযোগ প্রচেষ্টা প্রায়ই চালানো হয়েছিল। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বঙ্গীয় নমঃশূদ্র সমিতি আন্দোলনে একটি অধিকতর আনুষ্ঠানিক বিস্তৃত সাংগঠনিক কর্মপদ্ধতি জুগিয়েছিল। এভাবে আন্দোলনের অগ্রগতির সাথে সাথে এটা সচেতনতা ও প্রক্রিয়ার দুটি স্বতন্ত্র স্তরকে নিজের মধ্যে বেষ্টন করেছিল। এ একটির প্রতিনিধিত্ব করেছিল অভিজাতরা এবং অন্যটির প্রতিনিধিত্ব করেছিল তাদের কৃষক অনুসারীরা ।
রাজবংশীদের ক্ষেত্রে আত্মসম্মানের জন্য আন্দোলন সে সম্প্রদায়ের ধনী সদস্যরা সংগঠিত করেছিল। ১৮৯০- এর দশক থেকে সংস্কৃতায়নের স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায় এবং রাজবংশীদের ব্রাত্য (পতিত) ক্ষত্রিয় রূপে চিহ্নিত করার একটা প্রচেষ্টা চলেছিল । একই সঙ্গে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে থেকে শুরু করে অভিজাত রাজবংশীরা তাদের ক্ষত্রিয় মর্যাদা প্রদর্শনের দম্ভে উপবীত ধারণ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। উপরন্তু ভারতীয় ক্ষত্রিয় মহাসভার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টাও চালানো হয় ।
বিংশ শতাব্দীর প্রাথমিক বছরগুলো থেকে নমঃশূদ্র এবং রাজবংশী উভয়েই তাদেরকে প্রাধিকারমূলক আচরণের আওতার আনার জন্য ঔপনিবেশিক আমলাদের অনুরোধ জানায়। শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে তাদের প্রতি প্রাধিকারমূলক আচরণ প্রসারিত করা ছাড়াও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ব্যাপারেও ঔপনিবেশিক আমলাদের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করা হয়েছিল। স্থানীয় সংস্থাগুলতে নমঃশূদ্র ও রাজবংশী অভিজাতাদের অবস্থার উন্নতির চিহ্ন দেখা গেলেও প্রাদেশিক আইনসভায় তাদের প্রতিনিধিত্ব তখনও ছিল ন্যূনতম। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল এই যে, বিশেষ রাজনৈতিক সুবিধাবলি লাভের উদ্দেশ্যে নিম্নবর্গের অভিজাত ব্যক্তিরা সচেতনভাব কংগ্রেসবিরোধী ও ব্রিটিশদের সমর্থনের মনোভাবের প্রবক্তা হয়েছিল। একই সঙ্গে নিম্নবর্গের ‘এলিট’ বিশেষ করে নমঃশূদ্র, যারা কংগ্রেসের স্বদেশি আন্দোলনের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল তারা ১৯১০ ও ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবগুলোর পরপরই উচ্চকণ্ঠে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মধারার সমর্থন করেছিল। তারা ভারতীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে অধিকতর ক্ষমতার বণ্টন চেয়েছিল। মন্টফোর্ড প্রস্তাবগুলোর প্রায় পরপরই রাজবংশী ও নমঃশূদ্র অভিজাতরা বাংলায় অনুন্নত সম্প্রদায়গুলোর জন্য অধিকতর প্রতিনিধিত্বের জন্য চাপ দিয়েছিল। এসব দাবির ফলে ১৯১৯-এর আইনে বঙ্গীয় আইনসভায় অনুন্নত শ্রেণির একজন প্রতিনিধির মনোনয়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল ।
১৯২০-এর দশকের প্রথম ভাগ থেকে ব্রিটিশদের প্রতি সমর্থনের মনোভাব আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠে এবং নিম্নবর্গের এলিটগণ অধিকতর রাজনৈতিক সুবিধা লাভের চেষ্টায় জাতির পক্ষে কংগ্রেসের বক্তব্য রাখার নীতির বিরুদ্ধে আরও বেশি সমালোচনামুখর হয়ে পড়ে। ফলে এসব এলিটের কাছে জাতীয়তাবাদ ভিন্ন অর্থে দেখা দেয় । হিন্দুসমাজ ব্যবস্থার সমালোচক এবং কংগ্রেস বিরোধী অবস্থানের সমর্থন হলেও তারা কিন্তু জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে ছিল না। অন্য কথায় বলা যায় যে, নিম্নবর্গের এলিটগণ কংগ্রেস প্রদত্ত নামে মাত্র নাগরিকত্ব দানের নীতির পরিবর্তে প্রকৃত নাগরিকত্বের নীতির ভিত্তিতে একটি জাতির সন্ধান করেছিল।
অবশ্য, নিম্নবর্গের অভিজাতরা পূর্বাপর একই রকমভাবে জাতীয়তাবদী মূলধারা থেকে পৃথক রাজনৈতিক পথ সমর্থন করেছিল এমনটা অনুমান করা ভুল হবে। মাঝে মাঝে সমকেন্দ্রিকতা ঘটেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২০-এর দশকে কেশচন্দ্র দাস, মোহনী দাস এবং উপেন্দ্রনাথ বর্মণের মতো বিশিষ্ট নমঃশূদ্র ও রাজবংশী এলিটগণ জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি অবলম্বন করার পক্ষে ছিলেন । বোধগম্যভাবে স্বল্প সুবিধাভোগী নমঃশূদ্র ও রাজবংশী কৃষকদের মধ্যে কংগ্রেস বিরোধী মনোভাব ছিল প্রবল। কৌতূহলোদ্দীপকভাবে, আর্থসামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে নমঃশূদ্র ও রাজবংশী কৃষকরা উচ্চবর্ণ হিন্দু ও মুসলমান উভয় নিয়েই গঠিত প্রধান ভূস্বামী শ্রেণির বিরুদ্ধে তীব্র দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিল।
১৯৩০- এর দশকের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষ সুবিধাদি আসতে শুরু করলে নিম্নবর্গের এলিটগণ তাদের সমর্থকদের সম্পর্কে ক্রমে অধিকতর অমনোযোগী হয়ে পড়ে এবং আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত রাজনীতি ও শাসনতান্ত্রিক বির্তকে অধিকতর আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের গ্রামীণ সমর্থকদের উপর প্রভাব বজায় রাখতে এ সকল এলিট মাঝে মাঝে কৃষকদের জীবনযাত্রার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত বিষয় তুলে ধরত। আম্বেদকরের ধারার বিচ্ছিন্নতাবাদী নিম্নবর্গের রাজনীতির প্রতি স্পষ্টভাবে ঝুঁকে পড়ার ফলে ১৯৩০- এর দশকে তাদের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু কৃষকদের সঙ্গে স্পষ্ট সম্পর্কযুক্ত কৃষক প্রজা পার্টির মতো রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয়ের কারণেই প্রধানত ১৯৩০- এর দশকের মধ্যবছরগুলোতে নিম্নবর্ণের এলিটগণ জনসমর্থন হারাতে শুরু করে। তবে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচনের প্রাক্কালে কৃষক প্রজা পার্টি নিম্নবর্গ অধ্যুষিত নির্বাচনি এলাকাগুলো থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিলে এলিটগণ আবার তাদের হৃত রাজনৈতিক ভিত্তি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই যে, এ সময়কালে কংগ্রেসও নিম্নবর্গের এলিটদের একাংশের সমর্থন লাভে সক্ষম হয়েছিল।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে নিম্নবর্গের সদস্যরা বঙ্গীয় আইন পরিষদে ১৫৬টির মধ্যে ৩২টি আসনে জয়লাভ করে। সফল ৩২ জনের এই সদস্যদল রাজনৈতিক আনুগত্যের পরিবর্তন প্রকাশ করে। ২৩ জন স্বতন্ত্র সদস্য ছাড়াও ৭ জন নির্বাচিত হয়েছিল কংগ্রেসের সমর্থনে এবং হিন্দু মহাসভা সমর্থন করেছিল ২ জনকে। শ্রেণি বিভক্তি দেখা দিলে ১৯৩০- এর দশকের শেষার্ধ থেকে নিম্নবর্গের আন্দোলন তার গতি ও স্বশাসনের অনেকটাই হারিয়ে ফেলে। নিম্নবর্গের এলিটগণ তাদের গ্রামীণ সমর্থকদের সঙ্গে আর যোগাযোগ বজায় রাখতে পারেনি। বাজার-মন্দার সূত্রপাত এবং এর ফলে কৃষকদের দুর্দশা বর্ণ নির্বিশেষে গ্রামীণ শ্রমজীবী শ্রেণির এক বৃহৎ অংশকে কিষাণ সভার আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করে তোলে। ১৯৪০- এর দশকের প্রথমার্ধের সমস্তটা জুড়েই জলপাইগুড়ি-দিনাজপুর এলকায় একই বর্ণপরিচয় রাজবংশী জোতদার ও আধিয়ারদের মধ্যে সংঘাত বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি। আধিয়ারগণ ফসলের আরও বেশি অংশ দাবি করছিল। বিরোধ শেষ পর্যন্ত ১৯৪৬-৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তেভাগা আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯৪৯ খ্রি. তেভাগার দাবিতে নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ তুঙ্গে উঠে । তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এই যে, কৃষক প্রজা পার্টি মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার সঙ্গে ইনডিপেন্ডেন্ট সিডিউল কাস্ট পার্টির সখ্য স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। বঙ্গীয় প্রাদেশিক সিডিউল কাস্ট ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাও তৃতীয় বিকল্পের উদ্ভব ঘটায়নি ।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ যুক্তি প্রদর্শন করা যায় যে, নিম্নবর্গের সম্প্রদায়-পরিচিতিতে সব সময়ই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সচল ছিল, যার ফলে এর খণ্ডকরণ ঘটেছিল। বস্তুত, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দল ও উপদলগুলো অন্য বড় চিহ্নিত জাতি, ধর্ম বা শ্রেণিগুলোর অঙ্গীভূত হয়ে যায়। সে অর্থে বিশেষত ১৯৪০- এর দশকে নিম্নবর্ণগুলো কংগ্রেসের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদ বা হিন্দু মহাসভা প্ররোচিত সাম্প্রদায়িক অথবা কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন কিষাণ সভার মতো বিভিন্ন আন্দোলনের ধারায় অঙ্গীভূত হয়, যাকে এ ধরনের আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে ।
১.৯ নিম্নবর্গ বিশেষজ্ঞ রণজিত গুহের অভিমত
সবশেষে রনজিৎ গুহের নিম্নবর্গ সম্পর্কে বিখ্যাত অভিমত তুলে ধরা হলো-
“নিম্নবর্গের চিন্তায়ও অলীক রাষ্ট্রবাদ ওইরকম দোটানায় এবং পরস্পরবিরোধী অর্থের দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ। এক দিকে আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে বাস্তবে ও চৈতন্যে সেই আকাঙ্ক্ষা সফল করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদনের অভার ও তজ্জনিত দুর্বলতা। একদিকে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, সিদো কানহুর হাতে-গড়া সাঁওতাল ফৌজ, ভারতের নানা স্থানে সারা ঔপনিবেশিক যুগ ধরে হঠাৎ এক একটি জঙ্গি সমাবেশকে উপলক্ষ্য করে কয়েকদিনের জন্য বিদ্রোহীদের স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা—এক দিকে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা ও অসাধ্যতার ভাবমূর্তি হিসেবে তাই বিদ্রোহীদের অসম্পূর্ণ রাষ্ট্রদর্শন কখনও কখনও তাঁদের পরোয়ানা, জবানবন্দি, গোয়েন্দা পুলিশ বা মিলিটারি রিপোর্টে তাঁদের কথার টুকরো টুকরো উদ্ধতি মারফত আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব। তাঁরা নিরক্ষর, কোনো বঙ্কিম ভূদেব গান্ধী তাঁদের হয়ে কলম ধরেননি, সুতরাং তাঁদের বক্তব্য কখনও তাঁদের নিজের ভাষায় শোনা যায় না। কিন্তু তাঁদের শত্রুপক্ষীয় সরকার-সাহুকার-জমিদারদের লেখা নানা বিবরণে ওই রাষ্ট্রচিন্তার রূপটিকে বারে-বারেই বর্ণনা করা হয়েছে, কারণ নিম্নবর্গ যখন ক্ষমতার লড়াই-এ লিপ্ত হয় তখন যারা ক্ষতাবান তাদের শুনতে হয় নিম্নবর্গ কী বলতে চাইছে, তা লিখে রাখতে হয় সরকারি বেসরকারি কাগজপত্রে ।
এই সব সাক্ষ্য থেকে এ কথাটা বেশ পরিষ্কার হয় ওঠে যে নিম্নবর্গের আকাঙ্ক্ষা ও অসাধ্যতার এই দ্বন্দ্বই তাঁদের চিন্তায় ধর্মভাবকে কায়েম করে রেখেছে। তাই সাঁওতাল হুলের একটি বিখ্যাত যুদ্ধের মধ্যেই সিদো কানহু পূজায় বসেন এবং বন্দুকের টোটা ঠাকুরের দয়ায় গলে জল হয়ে যাবে এই বিশ্বাসের ফলে তাঁদের পরাজয় ঘটে। এইভাবেই অলীক রাষ্ট্রবাদের যে দিকটা আকাঙ্ক্ষার তা নিম্নবর্গকে উৎসাহিত করেছে তার রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ও মৌলিকতা নিয়ে জমায়েত হতে, আর যে দিকটা অসাধ্যতার তা তাকে বাধ্য করেছে দৈব ও পারলৌকিকতার আশ্রয় নিতে। নিম্নবর্গের চৈতন্যকে যখন আমরা ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উদ্যোগী হব তখন যেন তার এই ধর্মাশ্রয়ী দোটানা চরিত্রের গুরুত্ব ও জটিলতা স্বীকৃতি পায় আমাদের গবেষণায়,

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]