নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা

General Condition of the Subalterns or Poor People of 18th and 19th Century প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর দরিদ্রসাধারণ কিংবা নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। দরিদ্রসাধারণ মানেই নিম্নবর্গ নয়। পূর্বের অধ্যায়ে সাবলটার্ন (নিম্নবর্গ) ) সম্পর্কে বিশদ আলোচনা হয়েছে, যা নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা বুঝার জন্য খুবই সহায়ক হবে। গত দেড় দশকে নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার একটি স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল ধারা প্রচলিত হয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের (অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দী) নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চায় গবেষণা হয়েছে। রণজিৎগুহ হলেন এ গবেষণার পথিকৃত। এ অধ্যায়ে নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা বিশেষ করে তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার একটি চিত্র সহ সার্বিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। এর পাশাপাশি অন্যান্য শ্রেণির একটি সাধারণ চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে, যা নিম্নবর্গের সার্বিক অবস্থা বুঝতে সহায়ক হবে ।
নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা তথা রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা আলোচনার ক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন যে, নিম্নবর্গ মানেই গরীব মানুষ নয়। ব্রিটিশ কোম্পানি ও ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিতে ভারতীয়রাই সাবলটার্ন। এক্ষেত্রে পূর্বের অধ্যায়ে সাবলটার্ন সম্পর্কে বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক ও দরিদ্র সাধারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে ।
ঔপনিবেশিক বাংলার নিম্নবর্গের আর্থসামাজিক পটভূমি ও বিকাশধারা বিষয়ে গবেষণা অপ্রতুল। এর কারণ মূলত উপাদান-উপকরণের অপর্যাপ্ততা। তবে এ সময়ের বাংলার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাস যথেষ্ট সমৃদ্ধ। ফলে এই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসের অবকাঠামোয় এ যুগের আর্থসামাজিক পটভূমি অনুসন্ধান করা যেতে পারে। ক্ষমতাই হচ্ছে ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু। সুতরাং ঘটনার গভীরে গিয়ে বিচার

অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর দরিদ্র সাধারণ কিংবা নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা করলে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, যা কিছু রাজনৈতিক তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক। তাছাড়া রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজ-সংস্কৃতিকে পরস্পর থেকে পৃথক করে মূল্যায়নের সমস্যা অনেক। তাই সম্ভবত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জর্জ মেকলে ট্রেভেলিয়ান ( George Macaulay Trevelyan, 1962) তাঁর বিখ্যাত English Social History গ্রন্থে সামাজিক ইতিহাসের সংজ্ঞা দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। সাধারণভাবে তিনি শুধু বলেছেন যে, জনজীবনের ইতিহাসই সামাজিক ইতিহাস, এখানে রাজনৈতিক ইতিহাস অপ্রয়োজনীয়। তবে তার এই বক্তব্য যথেষ্ট বলে মনে হয় না। কেননা যে কোনো সমাজ ও অর্থনীতি কিন্তু রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়। সুতরাং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলা শাসন করেছে অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী, যাদের রাজনৈতক আধিপত্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ছিল এদেশের সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। অতএব এরূপ রাজনৈতিক প্রতিপাদ্যকে বিবেচনায় রেখে বাংলার নিম্নবর্গের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি বিচার-বিশ্লেষণ করা বাঞ্ছনীয় ।
আরও পূর্বের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, মুঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) তাঁর সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ নীতির ধারাবাহিকতায় বাংলার শেষ আফগান সুলতান দাউদ খান কররানীকে রাজমহলের যুদ্ধে (১২ জুলাই ১৫৭৬ খ্রি.) পরাজিত করে এদেশে মুঘল শাসনের সূচনা করেন। সম্রাট আকবর তাঁর রাজত্বের ২৪তম বছরে (১৫৮০ খ্রি.) সাম্রাজ্যকে সর্ব প্রথম কতকগুলো সুবায় বিভক্ত করেন, বাংলা একটি সুবায় পরিণত হয়। সুবাগুলোর জন্য এক প্রকার প্রশাসনিক কাঠামো প্রবর্তিত হয়। প্রত্যেক সুবায় একজন সুবাদার (প্রশাসক) ও একজন দেওয়ান (রাজস্ব সংগ্রাহক) এবং বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা হয়, যাদের অধিকাংশ ছিল বহিরাগত। বাংলার প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থার দিকপাল ছিলেন সুবাদার (পরবর্তীতে নবাব) এবং দেওয়ান। তারা দু'জনেই কর্মক্ষেত্রে ছিলেন পুরোপুরি স্বাধীন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি.) সুবাদার প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থায় প্রথম সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। তখন দেওয়ান ছিলেন তাঁর অধীনে দ্বিতীয় প্রধান কর্মকর্তা । সুবা বাংলার শাসন কাঠামোর এরূপ পরিস্থিতিতে মুর্শিদকুলী খান (১৭০০ খ্রি.) বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত হন। ইতোমধ্যে দিল্লিতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শাসক পরিবর্তন হচ্ছিল। তখন মুর্শিদকুলী খাঁনের নীতি ছিল যিনি দিল্লির সিংহাসন দখল করবেন তাঁর আনুগত্য মেনে তাঁকে রাজস্ব পাঠানো। ১৭১৭ খ্রি. মুর্শিদকুলী খানকে একসঙ্গে সুবাদার ও দেওয়ান নিযুক্ত করা হয়। এই দুই পদ একসঙ্গে লাভ করে মুর্শিদকুলী খান পরিণামে স্বাধীন নবাবির প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় থেকেই বাংলার প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। এর ফলে বাংলার নিম্নবর্গের জীবন ধারায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয় ।
ঔপনিবেশিক আমলের পূর্বে বাংলার আর্থসামাজিক কাঠামো নির্ধারনে তৎকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি, গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর গড়ন, শ্রেণিবিন্যাস, বর্ণ-বৈষম্য, উৎপাদন ব্যবস্থার প্রকৃতি, জমিদার ও আমলাতন্ত্রের গঠন কাঠামো এবং কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করা বাঞ্চনীয়। মুঘল শাসনামলে জমির মালিকানার প্রকৃতি, কৃষকের সঙ্গে
জমিদার ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের স্বরূপ, উদ্বৃত্ত বণ্টন প্রক্রিয়া এবং গ্রামীণ সমাজের প্রকৃতি নির্ধারণে কার্ল মার্কস (Karl Marx) তাঁর ‘Asiatic Mode of Production' বা ‘এশিয়াটিক সমাজ' এর আদর্শ (Model) নির্মাণ করেছেন। এ আদর্শের অন্যতম প্রতিপাদ্য হলো, জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অনুপস্থিতি। এ তত্ত্বের আলোকে মার্কস এশিয়াটিক সমাজকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন: (ক) শ্রেণিবিহীন গ্রামীণ-সমাজ এবং (খ) রাষ্ট্রক্ষমতা, যার মধ্যে শ্রেণি সমাজের বীজ লুকায়িত। মার্কসীয় তত্ত্বের আলোকে ভারতীয় নিম্নবর্গ গবেষক ড. গৌতম ভদ্র (১৯৮৩) বলেছেন যে, মুঘল যুগে সমাজ ছিল শ্রেণিবিহীন সাম্যসমাজ এবং শ্রেণিবিভক্ত সামন্ততান্ত্রিক সমাজের মাঝামাঝি একটি অবস্থা। এ ধরনের সমাজে ঊর্ধ্বতন গোষ্ঠী কালক্রমে একটি শোষক শ্রেণিতে রূপান্ত রিত হতে বাধ্য। কিন্তু কার্ল মার্কস ও ড. গৌতম ভদ্র-এর বিশ্লেষণ তত্ত্বকে কতিপয় ইউরোপীয় এবং ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানী গ্রহণ করতে চাননি। এদের অগ্রভাগে রয়েছেন পাশ্চাত্যের বেরি হাইন্স (Barry Hindes, 1973), ও হার্স্ট (Hirst, 1975) এবং প্রাচ্যের ইরফান হাবিব (১৯৬৩) ভারতীয় ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব মার্কসের ‘এশিয়াটিক উৎপাদন প্রণালীকে' মানতে রাজী নন। তাঁর মতে, ব্রিটিশ শাসন শুরুর আগে ভারতে ‘জমির মালিক ছিলেন রাজা' –এ বিতর্ক ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ও পর্যটকদের সৃষ্টি। তিনি মনে করেন, ভারতবর্ষে সত্যিকার অর্থে কৃষকই ছিল জমির মালিক। কিন্তু তাঁর এ বক্তব্যও বিচার সাপেক্ষ। কেননা মালিকানার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো জমি ইচ্ছামত হস্তান্তর। কিন্তু সে অধিকার কৃষকের ছিল না। কৃষক ছিল জমির মালিক এ কথা সময়সাময়িক গ্রন্থ আইন-ই আকবরী-এর কোথাও উল্লেখ নেই। ভূমির মালিকানার ধরনের উপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের চরিত্র। আর উদ্বৃত্ত মূল্য কিভাবে শোষিত হয় তার উপর নির্ভর করে উৎপাদন প্রণালী, শ্রেণিকাঠামো এবং সমাজের ভেতর বিদ্যমান শ্রেণি সংঘাত। এ নিরিখে ঔপনিবেশিক বাংলার নিম্নবর্গের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। যদিও অন্যান্য শ্রেণির তুলনামূলক আলোচনা থেকে নিম্নবর্গের প্রকৃত অবস্থা নির্ণয় করা হয়েছে। সামাজিক অবস্থা
ভূমির মালিকানার ধরন ও অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে বাংলার সমাজ কাঠামো তিনটি শ্রেণির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। নবাব ও নবাব পরিবার, অভিজাতশ্রেণি, জায়গিরদার এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে গড়ে ওঠেছিল সমাজের প্রথম শ্রেণি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল জমিদার, তালুকদার, মহাজন, ব্যবসায়ী, কুটির শিল্পের মালিক ও বিদ্বান ব্যক্তিবর্গ। আর সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, শিল্পী ও কারিগরদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল তৃতীয় শ্রেণি বা নিম্নবর্গ। সমসাময়িক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন তাবাতাবাই (১৭৮১) মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙলার ধন-বৈষম্য ও সামাজিক মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখে সমাজকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। তাঁর মতে, অভিজাতরা প্রথম, ভূ-স্বামীরা দ্বিতীয় এবং আপামর জনসাধারণ তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃত বিশ্লেষণে বাংলার সমাজ বিভক্ত ছিল একদিকে নবাব ও অভিজাতশ্রেণি এবং অন্য দিকে সাধারণ কৃষক ও অন্যান্য পেশার খেটে খাওয়া মানুষ। এই দু'য়ের মাঝামাঝি কোনো মধ্যবিত্তশ্রেণির তেমন প্রভাব ছিল না। তবে মধ্যবিত্তশ্রেণি যে একেবারে ছিল না তা কিন্তু নয়। পুরোহিত, পাঠশালার পণ্ডিত, ঘটক, কবিরাজ, হাকিম, সাধারণ বণিক, মহাজন এবং ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল মধ্যবিত্তশ্রেণি । তবে এই মধ্যবিত্তশ্রেণি ছিল জায়গিরদার ও জমিদারদের অনুগ্রহ নির্ভর। তারা আধুনিক অর্থে মধ্যবিত্ত নয়। সামাজিক অবস্থানের একটি বিশেষ স্থান দখল করেছিল নিম্নবর্গ।
বাংলার সমাজ কাঠামোর সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করতেন নবাব ও নবাব পরিবার । নবাব মুর্শিদকুলী খান ও তাঁর পরবর্তী নবাবগণ নামে মাত্র মুঘল সম্রাটের আনুগত্য মেনে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব দিল্লিতে পাঠালেও প্রশাসনিক ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। মুর্শিদকুলী খাঁনের পর হতে বাংলার মসনদ বংশগত হয়ে পড়ে। তখন দিল্লি থেকে সুবাদার এবং দেওয়ান নিযুক্তির প্রথা রহিত হয়। বাংলার সুবাদাররাই নিজেদের ইচ্ছে মতো দেওয়ান নিযুক্ত করতেন। সুবাদার তখন বাংলার স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হন। নবাব মুর্শিদকুলীর সময় থেকে আরম্ভ হয় প্রাসাদ যড়যন্ত্রের যুগ। এ প্রসঙ্গে সুজাউদ্দিন খান (১৭২৭ খ্রি.) ও তাঁর পুত্র সরফরাজের মধ্যে দ্বন্দ্বের উল্লেখ করা যেতে পারে। আলীবর্দী খাঁনের (১৭৪১ খ্রি.) উত্থান এবং ইংরেজদের কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় এসবও ছিল অনেকাংশে প্রাসাদ যড়যন্ত্রের ফল। তবে এসব রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও পরিবর্তন সম্পর্কে বাংলার জনগোষ্ঠী ছিল মোটামুটি নির্লিপ্ত । রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা হিসেবে নবাব ছিলেন গোটা সমাজের (হিন্দু ও মুসলমান) সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি সর্বদা বিশেষ অভিজাতশ্রেণি ও কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। বিলাসবহুল হারেম, প্রাচুর্যময় রাজপ্রাসাদ, বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্রাত্যহিক জীবন প্রণালী ও রাজকীয় রীতিনীতি নবাবকে জনগণ থেকে দূরে রাখতো। অভিজাতশ্রেণির জীবনধারা ও রীতিনীতি গঠনে নবাব ছিলেন অনুকরণীয়। এসময়ে মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। বাংলার নবাবগণ দিল্লির সম্রাটের নিকট থেকে বড় বড় উপাধি পেতেন। নবাব আলীবর্দী খান ‘মহব্বত জং' ও ‘সুজাউল মুলক' ইত্যাদি খেতাব লাভ করেছিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার উপাধি ছিল ‘শাহকুলী খান বাহাদুর' ও ‘মনসুর-উল-মুলক’। এরূপ খেতাব প্রাপ্তি ছিল জনগণের নিকট নবাবদের সম্মান বৃদ্ধির সহায়ক। নবাবদের মধ্যে মুর্শিদকুলী খান ধর্মভীরু ছিলেন। নবাব সুজাউদ্দিন জাঁকজমক পছন্দ করতেন। নবাবগণ জ্ঞানী-গুণী ও শিক্ষিতজনদের সমাদর করতেন। মুর্শিদাবাদের নবাবগণ ধর্মের দিক থেকে ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী। তাঁরা মহাউৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সব ধর্মীয় উৎসব পালন করতেন। নবাব স্বয়ং এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা হিন্দুদের
উৎসবাদিতেও যোগদান করতেন। নবাবি 'পূণ্যাহ' (রাজস্ব আদায়ের প্রথম দিন) মহা সমারোহে উদযাপিত হতো। নবাবি আমলে হারেম প্রথা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল । হারেম পরিচর্যায় একদল খোঁজা মোতায়েন থাকতো। নবাবের বেগম ছিলেন হারেমের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী।
নবাবি আমলে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত মর্যাদাবাদ এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল একটি অভিজাতশ্রেণি। এদের অধিকাংশই ছিল বহিরাগত। সামাজিক কাঠামোতে নবাবের পরেই ছিল তাঁদের স্থান। স্বাধীন নবাবদের সময়ে নিজস্ব যোগ্যতা ও প্রতিভাবলে যেমন মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়া যেতো, তেমনি রক্তের সম্পর্ক, উত্তরাধিকার, আত্মীয়তা ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমেও উচ্চ পদে লাভের সুযোগ ঘটতো। নবাবি আমলে অভিজাতশ্রেণিতে শিয়াদের প্রাধান্য ছিল লক্ষণীয় বিষয়। রাষ্ট্রীয় উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত অভিজাত কর্মকর্তারা স্ব স্ব দায়িত্ব ছাড়াও বিভিন্ন উচ্চ।দে অধিষ্ঠিত হতেন। মুর্শিদকুলী খানের সময় অনেক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা তাঁর পরিবারের সঙ্গে বিবাহ সূত্রে সম্পর্কিত ছিলেন। এই ধারা নবাব সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সকল অভিজাতদেরকে নগদ অর্থে বেতনের স্থলে জায়গির প্রদান করা হতো। এর ফলে রাষ্ট্রে গড়ে ওঠে একটি জায়গিরদার শ্রেণি। এ শ্রেণির স্বার্থ ছিল ভূমি-সংশ্লিষ্ট। আঠারো শতকের প্রথম থেকে নবাবি শাসন ব্যবস্থায় স্থানীয় লোকদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হলো মুর্শিদকুলী খান শাসনকার্য পরিচালনার জন্যে স্থানীয় প্রতিভার উপর বিশেষ জোর দেন। কিন্তু তখন থেকে অভিজাতশ্রেণি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাদের অনেকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ে। এযুগে প্রশাসনে আরও একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটে, আর তা হলো হিন্দুদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাধিক্য। এর ফলে মুসলিম অভিজাতশ্রেণির পাশাপাশি একটি হিন্দু অভিজাতশ্রেণি গড়ে উঠে। এই হিন্দু অভিজাতরা সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিল। স্বাধীন নবাবদের আনুকূল্য লাভের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। নবাব সুজাউদ্দিন তাঁর নিজামতের অনেক দায়িত্ব হাজি আহমদ, রায় আলম চাঁদ দেওয়ান এবং জগৎ শেঠ-এ তিন ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত পরিষদের উপর ন্যস্ত করেন। ফলে অতুল সুরের এই অভিযোগ সঠিক নহে যে, ‘নবাবদের হিন্দু বিদ্বেষ' ছিল। তবে হিন্দুরা সুযোগ পেলেই নবাবদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতো। তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও শক্ত আর্থিক অবস্থান নবাবদের পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল। নবাবি আমলের শেষ দিকে রাজকর্মচারীদের নৈতিক অধঃপতন বিশেষ লক্ষণীয় দিক। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পশ্চাতে এদেশের হিন্দু-মুসলিম অভিজাতশ্রেণির কার্যকর ভূমিকা এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করে ।
তৎকালীন বাংলার সমাজ কাঠামোতে অন্যতম মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন জমিদার । নবাবি শাসকগণ প্রশাসন ব্যবস্থা বিশেষত রাজস্ব আদায়ের জন্য জমিদারদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। জমিতে বহু ধরনের উচ্চতর স্বার্থের সমন্বিতরূপ হলো জমিদার। নবাবি আমলে ভূমিরাজস্ব পরিচালনায় জমিদারশ্রেণি অপরিহার্য বলে বিবেচিত হতো। সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জমিদারের ছিল দ্বৈত সত্তা। একদিকে সে
ভূমিস্বত্বভোগী প্রজা, অন্যদিকে সে মধ্যস্বত্বভোগী। আধুনিক গবেষক ড. শিরীন আখতার (১৯৮২) বাংলার জমিদারদেরকে সীমান্ত, প্রান্তিক, বড় জমিদার ও ছোট জমিদার-এ চার ভাগ করেছেন। জমিদারদের এরূপ বিভাজন থেকে অনুমিত হয় যে, বাংলার সব জমিদারদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সমান ছিল না। নবাবি বাংলায় জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিদেরকে নিয়ে একটি বিদ্বান ও ধর্মীয়শ্রেণি গঠিত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে যদিও তাঁদের উচ্চ অবস্থান ছিল না এবং তাঁদের অর্থ সম্পদের প্রাচুর্যও ছিল না, তবুও সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ তাদের শ্রদ্ধা করতেন। তাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাদের প্রচেষ্টায় বাংলায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির যথেষ্ঠ উন্নয়ন ঘটে। বাংলার নবাবগণ বিশেষ করে মুর্শিদকুলী খান ও আলিবর্দী খান অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা ছিলেন এবং তারা বিদ্বান ও গুণীজনদের বিশেষ সমাদর করতেন। এ সময়ে বিজ্ঞান ও ধর্মীয় বিষয়ে বিশেষ পণ্ডিত ছিলেন পাটনার হাজি বদিউদ্দিন। নবাব আলিবর্দীর সময়ে তাঁর দরবার অলঙ্কৃত করেন মীর মুহাম্মদ আলি ফাজিল। বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন হাকিম হাদি আলি খান। তিনি সে যুগের গ্যালেন ও প্লেটো নামে অভিহিত ছিলেন। ‘মোজাফফরনামার’ লেখক করম আলি (১৭৭২) ছিলেন আলিবর্দী খানের আত্মীয়। ‘সিয়ার-উল মুতাখখিরিন'-এর লেখক সৈয়দ গোলাম হোসেন তাবাতাবাই (১৭৮১) ছিলেন বিখ্যাত শিয়া পণ্ডিত। তিনি সিরাজউদ্দৌলা ও মীর কাশিমের নিকট থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছিলেন। বিদ্বান ও জ্ঞান-গুণী ব্যক্তিরা ছিলেন সে যুগের প্রতিনিধি। শেখ ও সুফীরা ছিলেন নৈতিক দিক থেকে আদর্শ স্থানীয়। নবাব মুর্শিদকুলী খান শেখদের অত্যন্ত সম্মান করতেন। সৈয়দগণ মহানবীর বংশধর বলে জনগণ তাদেরকে খুব সমীহ করতেন। নবাবি যুগে সুন্নীদের তুলনায় শিয়ারা ছিলেন বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত। সম্ভবত নবাবদের শিয়া-আনুকূল্যই ছিল এর প্রধান কারণ। অন্য দিকে হিন্দু সমাজে শিক্ষাদীক্ষায় ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য ছিল অক্ষুন্ন। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও সামাজিক অধিকার সকলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যান্য শ্রেণির লোকেরাও এর সদ্ব্যহার করতো। এ সময়ে বৈদ্যরা চিকিৎসা শাস্ত্র এবং কায়স্থরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিল। মুসলমানদের ন্যায় হিন্দু প্রভাবশালীরাও এ যুগে কবি-সাহিত্যিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতেন। কবি ভারতচন্দ্র ও বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার ছিলেন নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি। প্রসিদ্ধ হিন্দু গণিতবিদ শুভঙ্কর ছিলেন এ যুগের প্রতিনিধি। নবাবি আমলে শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী মহলের ভাষা ছিল ফার্সি। মুসলমান-হিন্দু উভয় শ্রেণিই আর্থসামাজিক কারণে এ ভাষা রপ্ত করতো। এ যুগে হিন্দু-মুসলিম সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মপ্রীতি। নবাবি বাংলায় শেখ, সৈয়দ, পাঠান, মুঘল ছাড়াও কাজি, মোল্লা, ওলামা, ফকির ও সন্ন্যাসীরা সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। এদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল একটি পেশাজীবী মধ্যবিত্তশ্রেণি। তবে এই মধ্যবিত্তশ্রেণিটি মূলত নবাব, অভিজাত ও জমিদারদের অনুগ্রহনির্ভর ছিল । আর নিম্নবর্গের অধিকাংশই ছিল কৃষক ।
বাংলা চিরকারীই কৃষি প্রধান দেশ। কৃষির উপর নির্ভর করেই বাংলাতে গ্রামের পত্তন, শ্রেণিবিন্যাস এবং রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক ও অধিকারের বিকাশ ঘটেছে। ইংরেজ সমাজ বিজ্ঞানী ব্যাডেন পাওয়েলের (Baden powell, 1892) মতে, ‘প্রচলিত গ্রামীণ সমাজ কাঠমোর প্রথম উল্লেখযোগ্য রূপান্তর সাধিত হয় মুঘল আমলে । পূর্বে যারা গ্রাম-প্রধান বা হেডম্যান ছিলেন, প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্যে তারা গেল মুঘল সরকারের স্বীকৃতি'। মুঘলদের আগমনের পূর্বেই কৃষক কর্তৃক রাজ্যকে প্রদত্ত করের নিয়ম চালু ছিল। ব্রিটিশরা প্রবর্তন করলো করের নতুন পদ্ধতি । অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশদের বৃহত্তর কর প্রদানকারী ছিল কৃষক তথা নিম্নবর্গ শ্রেণি ।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলায় বেশ কয়েকটি বৃহৎ জমিদারি ছিল। এই সময় বাংলার ছয় জন জমিদার (বীরভূম, বিষ্ণুপুর, বর্ধমান, নদীয়া, নাটোর ও দিনাজপুর) ভূমিরাজস্বের প্রায় ৫০ শতাংশ আদায় করতেন। বাংলার সমাজে এবং নবাব দরবারে এই সকল জমিদারদের সম্মান ও মর্যাদা ছিল অন্যদের তুলনায় অধিক। প্রশাসনের প্রয়োজন অনুযায়ী জমিদারদের কার্যক্রম ও অধিকারের হেরফের হতো। মুর্শিদকুলী খান বাংলার জমিদারি ব্যবস্থাকে সুসংগঠিত করেন। তাঁর সময়ে জাতি, ধর্ম, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে বাংলায় জমিদারি গড়ে উঠে। বর্ণ প্রথার ওপর প্রতিষ্ঠিত হিন্দু সমাজে জমিদারি ছিল উঁচু স্তরে আরোহনের সোপান। শুধু ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ নয়, নবাবি বাংলায় তিলি, সদগোপ ও বাগদীরাও জমিদার হয়ে ওঠেন। এ সময়ে পুঁজি বিনিয়োগের সফল ও নিরাপদ ক্ষেত্র ছিল ভূমি। জেমস গ্রান্ট (James Grant, 1786 ) জানিয়েছেন যে, নবাব সুজাউদ্দিন খাঁনের (১৭২৭ খ্রি.) ‘জমা তুমারি তখশিসে' যে পনেরটি জমিদারির উল্লেখ আছে, তাদের অধিকার ছিল ৬১৫টি পরগণার ওপর। তাদের দেয় রাজস্ব ছিল বাংলার সমগ্র রাজস্বের প্রায় অর্ধেক। মুর্শিদকুলীর পর বাংলার শাসন ব্যবস্থায় শৈথিল্য দেখা দিলে জমিদাররা নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সুসংহত করেন। এ সময়ে নবাবরা বৃহৎ জমিদারদের উপর অনেক নির্ভরশীল হয়ে পড়েন ।
বাংলায় জমিদারদের অনেক দায়িত্ব পালন করতে হতো। তারা গ্রাম বাংলায় শান্তিরক্ষা, অপরাধীর বিচারসহ নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করতেন। এতে অনুমিত হয় যে, অষ্টদশ ধতকে জমিদাররা বাংলার আর্থসামাজিক জীবনে খুব প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। তারা রাজা-মহারাজা উপাধি নিতেন, প্রাসাদ ও দুর্গ তৈরি করতেন এবং সৈন্য বাহিনী রাখতেন। সরকারের সঙ্গে এদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংঘাতও ঘটতো। জমিদারি অধিকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এই অধিকার বিক্রয়যোগ্য এবং বংশানুক্রমিক। এ প্রক্রিয়ায় জমিদারি সম্পত্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হতো। রাজস্ব ধার্য ও আদায়ে জমিদারের অধিকার প্রথাসিদ্ধ হলেও এর ব্যতিক্রম যে হতো না তা কিন্তু নয়। সুযোগ পেলে জমিদাররাও বাড়তি ভূমিকর ধার্য করতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, মুর্শিদকুলী খান (১৭০০ খ্রি.) থেকে মীর কাশিম (১৭৬৪ খ্রি.) পর্যন্ত বাংলার নবাবরা নিয়মিত কর আদায় ছাড়াও মোট ১,১৭,১১,৮৫৩ টাকার আবওয়াব (অতিরিক্ত ভূমিকর) ধার্য করেছিলেন । নবাবি আমলে জমিদারদের স্বার্থে রাষ্ট্রে তালুকদার শ্রেণির সৃষ্টি হয়। তারা ছিলেন জমিদার ও প্রজা সাধারণের মধ্যে সেতুবন্ধন। প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলায় ছোট জমিদার ও তালুকদারের সংখ্যা ছিল অসংখ্য। নবাব মুর্শিদকুলী খানের সময় থেকে ইজারা প্রথার
প্রবর্তন করা হয়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের ফলে তালুকদারদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়। তাছাড়া বড় জমিদারির বিভাজন এবং ‘মদৎ-ই-মাস' (বিদ্বান ব্যক্তিবর্গকে রাষ্ট্রকর্তৃক দেয় নিষ্কর ভূমি) জমিতে ইজারা ব্যবস্থার প্রচলন ইত্যাদি কারণেও তালুকদারীর প্রসার ঘটে। বাংলার তালুকদাররা ছিলেন দু'ধরনের, যথা : হুজুরি (স্বাধীন তালুক) ও মাজকুরি (অধীন তালুক)। হুজুরি তালুকদাররা সরাসরি রাজকোষে রাজস্ব জমা দিতেন। এ জন্য তারা একটু উচ্চ মর্যাদা ভোগ করতেন। আর মাজকুরি তালুকদাররা বৃহৎ জমিদারদের কাছে তাদের রাজস্ব জমা দিতেন। নবাবি বাংলায় এই মাজকুরি তালুকদার ছিলেন ভূমিনির্ভর মধ্যবিত্তশ্রেণির প্রতিনিধি। এরা নিম্নবর্গ শ্রেণির নিকট থেকে রাজস্ব আদায় করতেন ফসলের এক তৃতীয়াংশ। মুঘল ভূমি ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এবং সাধারণ কৃষকের মধ্যবর্তী স্থানে উদ্ভূত হয় জমিদার, তালুকদার, পরগণা প্রধান, বৃহৎ জমির মালিক, অনুদানপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, কর নির্ধারক, কর-সংগ্রাহক, পাটোয়ারী, মোকাদ্দাম ও কানুনগো প্রমুখ। মোটামুটিভাবে পুরো ব্যবস্থার অস্তিত্ব যেহেতু ছিলে ভূমি-নির্ভর সেহেতু ভূমি থেকেই সরবরাহ করতে হতো রাষ্ট্রের সমস্ত রাজস্ব। রাজস্বের প্রধান যোগানদার কৃষক। জমিতে উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত থাকলো কেবল কৃষকই। মুঘল আমলে রাষ্ট্রকে রাজস্ব সরবরাহকারী কৃষক-সাধারণের পরিচয় ছিল রায়ত এবং তাদের উপরস্থ প্রধান শ্রেণিটি রাষ্ট্র কর্তৃক মনোনীত জমিদার। ইরফান হবিবের মতে, ‘মুঘল আমলের জমিদাররা ছিল আসলে চাষিদের ওপরের একটি গ্রামীণ মধ্যস্বত্ব ভোগীশ্রেণি'। তবে কৃষকদের প্রকৃত হর্তাকর্তা ছিল তারাই। আবুল ফজলের মতে, ‘বাংলার কৃষকরা অনুগত ও খারাজী' । প্রতি বছরে আট মাস ধরে তারা কিস্তিতে রাজস্ব মিটিয়ে দেয় এবং নিজেরা নির্দিষ্ট জায়গায় টাকা ও মোহর নিয়ে আসে। কিন্তু মুঘল আমলের শেষ দিকে এসেই দেখা যাচ্ছে, কৃষক শোচনীয় অবস্থার মুখোমুখি। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে (১৬৫৭-১৭০৭ খ্রি.) কৃষকের উপর প্রশাসনিক চাপ অত্যন্ত বেড়ে যায়। খাজনা পরিশোধে অক্ষম কৃষকদের অধিকার রহিতকরণসহ তাদের উপর নানারকম হয়রানি চলতে থাকে। দাক্ষিনাত্যে যুদ্ধরত আওরঙ্গজেব ১৭০০ খ্রি. মুর্শিদকুলী খানকে বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। দক্ষতা ও ব্যয় সংকোচনের দিক লক্ষ্য রেখে মুর্শিদকুলী খান ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রশাসনিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন সাধন করেন। তাঁর রাজস্ব সংগ্রহ পদ্ধতি ছিল মালজামিনী ব্যবস্থা। কিন্তু আবদুল করিমের মতে, ‘এটি ছিল মিশ্র ব্যবস্থা'। এ সময়ে খালসা (রাষ্ট্রীয়ভূমি) ভূমিতেও ‘আবওয়াব' (বাড়তি কর) ধার্য করা হতো। মুর্শিদকুলীর সময় ধার্য আবওয়াবের অংকটা তেমন বিশাল ছিল না। কিন্তু তার বাড়তি ভূমিকরের দৃষ্টান্ত বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির পক্ষে শুভকর হয়নি। পরবর্তী নবাবরা তার দৃষ্টান্ত আন্তরিকভাবে অনুশীলন করেছেন। নবাবি আমলে চাষ বেড়েছে, অথচ কৃষকদের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি হয়নি। এর অন্যতম কারণ নবাবগণ কঠোরভাবে রাজস্ব আদায় করতেন। যদুনাথ সরকারের মতে, ‘দুর্দিনে সঞ্চয়ের অভাবে মেষের মতো কৃষক দলে দলে মৃত্যুর সম্মুখীন হতো' । তবে তার এই বক্তব্য কিছুটা অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত থাকতো
কৃষক ও কারিগরশ্রেণি। কিন্তু সমাজ কাঠামোতে কৃষক ও কারিগররা ছিল নিম্নবর্গশ্রেণি। জায়গির যেহেতু ছিল পরিবর্তনশীল সেহেতু জায়গিরদারদের পক্ষে চাষাবাদের উন্নতির জন্য কখনো কোনো দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। তাৎক্ষণিক লাভের জন্য যা প্রয়োজন তাই তারা করতেন। কৃষকের খাজনা প্রদানের ক্ষমতা বা তার কল্যাণের প্রতি এদের বিশেষ কোনো লক্ষ্য ছিল না। নবাবি আমলের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বাড়তি ভূমিকর ধার্য। নবাবি প্রশাসনের মূল লক্ষ্য ছিল ক্রমবর্ধমান মাত্রায় রাজস্ব আদায় করা। সম্ভবত জায়গিরদারি প্রথার বৈশিষ্ট্যের কারণে নবাবি আমলে রাজস্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেত। এ কর সুবাদারি ‘আবওয়াব' নামে পরিচিত ছিল। মুর্শিদকুলী খান (১৭০০) থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৭৫৭) পর্যন্ত বাংলার নবাবগণ দিল্লির সম্রাটের বিনা অনুমতিতে ভূমি রাজস্বের উপর আনুপাতিক হারে বাড়তি কর ধার্য করতেন। মুর্শিদকুলী খান মাত্র একখাতেই ২,৫৮,৮৫৭ টাকার আবওয়াব ধার্য করেন। পরবর্তী নবাব সুজাউদ্দিনের সময় এর পরিমাণ ছিল ১৯,১৪,০৯৫ টাকা। বাংলার কৃষককেই এই বাড়তি রাজস্বের ব্যবস্থা করতে হতো। রাজস্ব দাবি মেটাতে ব্যর্থতার জন্য চাষিদের উপর নানা রকম অত্যাচার চলতো। এমতাবস্থায় বাংলার কৃষকরা অনেক সময় যে বিদ্রোহ করেছে এর প্রমাণ হলো ১৬৯৫ খ্রি. বরোদা ও চেতুরার জমিদার শোভাসিংহের বিদ্রোহ । এই বিদ্রোহে মুঘল বিরোধী কৃষকরা যোগ দেয় । তবে উৎপাদন ব্যবস্থায় মৌলিক কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় এবং কৃষক শ্রেণির চেতনা নিম্নস্তরে থাকায় সামন্ত সমাজের মূল চরিত্রটি অপরিবর্তিতই রয়ে যায়। তাছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সেচ ব্যবস্থার ধ্বংস, তাকাভী ঋণ প্রদান বন্ধ, জমিদারদের শোষণ এবং সরকারি কর্মচারীদের নিষ্ঠুরতার ফলে কখনো কখনো বিশাল এলাকা জনশূন্য হয়ে যেত। গৌতম ভদ্র যাথার্থই বলেছেন যে, ‘মুঘল আমলে একদিকে সাম্রাজ্যের স্ফীতি ঘটছে, অন্যদিকে কৃষকের দুর্গতি বেড়েছে। কৃষকদের শ্রমই ছিল মুঘল যুগের শাসকশ্রেণির বিপুল ঐশ্বর্যের উৎস।' বাংলার কৃষক এভাবেই নবাবি আমল থেকে প্রবেশ করে ব্রিটিশ শাসনামলে ।
এ যুগে নিম্ববর্গের শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাও ছিল বিপুল। এসময়ের তাদেরকে চার ভাগে ভাগ করা যায় যেমন, কৃষি শ্রমিক, শিল্প শ্রমিক, বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক ও গৃহভৃত্য। অনেক কৃষক ছিল ভূমিহীন। তৎকালীন সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা ভূমিহীন কৃষককে আমরণ ভূমিহীন রেখেছে। ইরফান হবিবের মতে, কৃষি উৎপাদনের স্বার্থে সংরক্ষিত শ্রমবাহিনী তৈরীতেই জাতিভেদ প্রথা অপ্রতিরোধ্য গতিতে কাজ করেছে। ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকেরা অবসর সময়ে শিল্প শ্রমিক হিসেবেও কাজ করতো। লবণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মালঙ্গিরা বর্ষাকালে চাষের কাজে যোগ দিত। এছাড়াও শ্রমিকদের একটি বিশাল অংশ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল। অভ্যন্তরীণ, আন্তঃপ্রাদেশিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ব্যাপকতার কারণে বিভিন্ন স্তরে প্রচুর শ্রমিক নিযুক্ত ছিল। এদের সংখ্যা ছিল দুই থেকে তিন লাখ। আলোচ্য সময়ের বাংলার সমাজে দাসদের অস্তিত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে গ্রীস বা রোমের দাস ব্যবস্থার সাথে বাংলার দাস প্রথার কোনো মিল ছিল না। কেননা বাংলার দাসরা ছিল তুলনামূলকভাবে স্বাধীন। তারা বংশ ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় মুঘল-নবাবি শাসনের পতন ঘটিয়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যার প্রভাব ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। কোম্পানির শাসনে এদেশের জনজীবনে বিশেষত তাদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানামুখী বিপর্যয় ঘটে। পরিণামে সংগঠিত হয় কৃষক প্রজার অসংখ্য বিদ্রোহ। সরকারের ভূমি, রাজস্ব, ব্যবসায় ও শিক্ষানীতির কারণে বিকাশ ঘটে নিম্নবর্গ শ্রেণির। এই শ্রেণির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ছিল অভিনব। ভাবনার জগতে ঘটে নানান পরিবর্তন । বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই শাসনকাল ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল ও চমকপ্রদ। আর গবেষণার প্রান্তসীমা হিসেবে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দকে বেছে নেওয়ার কারণ হলো ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দটি ভারতীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে এক যুগ-সন্ধিক্ষণ। কোম্পানির বিরুদ্ধে ঐ সময়ে ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো ব্যাপক বিদ্রোহ (মহা বিদ্রোহ) সংগঠিত হয়। এই বিদ্রোহের দিক ছিল তিনটি। প্রথমত; ব্যাপক আকারে কোম্পানির নীতি ও কর্মযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়, যেখানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ এতে যোগদান করে। দ্বিতীয়ত; এই বিদ্রোহের ফলে এরূপ ধারণার সৃষ্টি হয় যে, ইংরেজ শাসন একেবারে অমোঘ নয়। এর বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহ সম্ভব। এই বিদ্রোহ পরবর্তীকালে পরোক্ষভাবে হলেও ঔপনিবেশিক সরকার-বিরোধী আন্দোলন ও সংগ্রামে প্রেরণা যুগিয়েছিল। তৃতীয়ত; ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহের ফলেই মূলত এদেশে কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং সেই সাথে প্রশাসনিক রদবদল অপরিহার্য হয়ে পড়ে অর্থাৎ ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক শাসনভার গ্রহণ নিম্নবর্গের মনেও অভিঘাতের সৃষ্টি করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নবর্গের অবস্থা বিবেচনার দাবি রাখে। এছাড়া এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহসমূহ, ক্রিয়াশীল নিম্নবর্গ শ্রেণি, তাদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত আন্দোলনের প্রভাব আলোচ্য সময়সীমার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ঔপনিবেশিক শাসনের আদর্শ, তাদের চিন্তার পরিসর, বিকাশমান নানানশ্রেণি, যার মধ্যে ক্রিয়াশীল শ্রেণিচেতনা ও সুবিধাবাদ এসব কিছুকেই আমরা বুঝবার চেষ্টা করেছি আলোচ্য সময়সীমার কাঠামোতে দাঁড়িয়ে ।
মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে প্রথাগত ও আইনসম্মতভাবে বাংলার কৃষককুলকে বোঝানোর জন্য ‘রায়ত' শব্দটি ব্যবহৃত হতো। কিন্তু ব্যাপক অর্থে এটি রাষ্ট্রের প্রজাসাধারণ ও শাসকশ্রেণির অধীনস্থাদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হতো। সম্ভবত মুঘল অর্থ বিশারদ টোডরমলের বন্দোবস্তে (১৫৮২ খ্রি.) শব্দটি প্রথম ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এবং তখন থেকে ‘ইস্ট বেঙ্গল এস্টেট একুইজিশন অ্যাক্ট (১৯৫০ খ্রি.)' প্রণয়নের মাধ্যমে আইনগত ও ব্যবহারিকভাবে বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এ শব্দটি প্রচলিত ছিল । এ আইনে রায়তদের নতুন নাম হয় 'মালিক'। কিন্তু এ নামটি কখনোই জনস্বীকৃতি পায়নি। বিভিন্ন শ্রেণির কৃষকদের বোঝানোর জন্য বর্তমানে জোতদার (অতি ধনাঢ্য চাষি), গৃহস্থ (মোটামুটি ধনাঢ্য চাষি), কৃষক (সাধারণ চাষি), চাষি (প্রান্তিক চাষি),
বর্গাদার (ভাগ চাষি) ও মজুর (কৃষি শ্রমিক) প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মুঘল রাজস্ব ব্যবস্থায় রায়ত ছিল একজন রাজস্ব ইজারাদার। কৃষি উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত যে সকল লোক জমির মালিকদের মাধ্যমে অথবা অন্যভাবে রাষ্ট্রের খাজনা পরিশোধ করতো তারাই ছিল রায়ত । মুঘল শাসনামলে জমির উপর রায়তদের অধিকার ছিল। এ অধিকার প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতি দ্বারা সংরক্ষিত হতো। মুঘলদের ভূমি ব্যবস্থায় দু'ধরনের রায়ত ছিল, যথা- খুদকাশত (স্থায়ী) ও পইকাশত (অস্থায়ী) রায়ত । খাদকাশত রায়ত ছিল গ্রামের স্থায়ী আবাসিক চাষি। মুসলিম ও হিন্দু উত্তরাধিকার আইনানুযায়ী তাদের উত্তরাধিকারীরা ভূমিস্বত্ব লাভ করতো। পইকাশত রায়তরা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় স্থায়ীভাবে জমি চাষ করতো না। তারা খুদকাশতদের তুলনায় সাধারণত অনেক নিম্নহারে কর দিতো। জমির ওপর তাদের অধিকার ছিল মাত্র একটি মওসুমের জন্য এবং এ কারণে উত্তরাধিকারসূত্রে তা হস্তান্তর হতো না। পইকাশত রায়তদের সামাজিক মান-মর্যাদা ছিল একটু নিচু স্তরের। যতোদিন কৃষকের চেয়ে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বেশি ছিল, ততোদিন পর্যন্ত পইকাশত পদ্ধতির চাষাবাদই কৃষি সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করতো। ঊনিশ শতকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পইকাশত রায়তদের আর্থিক সুবিধাগুলো দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন'- এ বিভিন্ন শ্রেণির রায়তদের অধিকার সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এ আইনে রায়তদের তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন, আবাসিক রায়ত (পূর্বেকার খুদকাশত রায়ত), দখলি রায়ত (১২ বছর বা তারও অধিককাল জমিতে অব্যাহত দখলদার) এবং অদখলি বা অধীনস্থ রায়ত (ব্যাপকার্থে পইকাশত রায়তদের অবশিষ্টাংশ)। এ আইনানুসারে প্রথম দুই শ্রেণির রায়তরা জমিদারকে সেলামি প্রদান করে তাদের রায়তি জমি হস্তান্তরের অধিকার লাভ করে।
এটা অবশ্যই লক্ষ্যণীয় যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিধিবিধানের আওতায় রায়তদের আইনত প্রজা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হলেও ভূমিতে অধিকারহীন প্রজা হওয়ার ধারণার সাথে তারা কখনোই আপোস করেনি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শুরু থেকে কৃষক সম্প্রদায়ের সচেতন অংশ যুক্তি দিয়ে আসছিল যে, প্রথা ও রীতিনীতি অনুযায়ী জমির ওপর তাদের অধিকার আছে এবং নিজস্ব খেয়ালখুশি মতো তাদের উৎপাদন কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো অধিকার জমিদারদের নেই। জমির ওপর নিজেদের অধিকার প্রমাণের জন্য রায়তরা প্রায়শই জমিদারদের মালিকানা দাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকের শুরুতে কয়েক দফা কৃষক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার জমির উপর সকল পক্ষের অধিকার ও দায়িত্ব নিরূপণ করে ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৮৮৫' প্রণয়ন করতে সম্মত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর জমিদারগণ রায়তদের সব সময় তাদের প্রজা ভাবতেন। পক্ষান্তরে প্রজারা তাদেরকে রায়ত হিসেবে অভিহিত করার দাবি করতেন। অবশ্য বিশ শতকের গোড়ার দিকে ‘প্রজা' শব্দটি পুনরায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং রায়তের পরিবর্তে প্রজা নামে কৃষক সংগঠনগুলোর নামকরণ করা হয়— যেমন, নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি, ত্রিপুরা প্রজা সমিতি, কৃষক প্রজা পার্টি ইত্যাদি । এভাবে মুঘল আমল
ও ব্রিটিশ আমলের বেশিরভাগ সময়ে যে ‘রায়ত' শব্দটির একটি মর্যাদাসম্পন্ন অভিধা ছিল, বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে এটি অর্থ ও গুরুত্বের দিক থেকে সেকেলে হতে “থাকে এবং ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে সংবিধান থেকে মুছে ফেলার পর এটি একসময় বিস্তৃত শব্দে পরিণত হয়। এর পর থেকে ‘কৃষক' শব্দটি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বর্তমানে কৃষক শব্দটি বহুল প্রচলিত থাকায় গবেষণায় কৃষক শব্দের প্রয়োগ সঠিক বলে মনে করা হয়েছে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে যার সিংহভাগই অন্তর্ভুক্ত ছিল নিম্নবর্গ শ্রেণির ।
আধুনিক সামাজিক শ্রেণিসমূহ প্রধানত দুইটি ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে। একটি ভূমি, অন্যটি পুঁজি। ইতিহাসে যা প্রাচীন সমাজ হিসেবে পরিচিত অর্থাৎ প্রাচীন ইউরোপের গ্রিক ও রোমে দুইটি শ্রেণি বিদ্যমান ছিল। একটি দাস-মালিক এবং অন্যটি দাস। প্রাচীন ভারতে এ ধরনের শ্রেণিবিন্যাস ছিল না। এখানে যে বিশাল রাজ্য গড়ে ওঠেছিল এগুলোর ভিত্তি ছিল প্রধানত ভূমিকেন্দ্ৰিক গ্রাম সমাজ। ভারতবর্ষের গ্রামীণ সমাজে কৃষক ও কৃষিকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের উৎপাদক ও কারিগরশ্রেণির অস্তিত্ব দেখা যায়। তারা গ্রামীণ সমাজে নিজেদের অধিকার নিয়ে বাস করত। সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন আদিম সাম্য সমাজের পরে যখন সভ্যতার বিকাশ ঘটে তখন থেকেই মানব সমাজ শ্রেণিবদ্ধ। সামাজিক শ্রেণিকে কেন্দ্র করে দুইজন তাত্ত্বিক কার্ল মার্ক্স ও ম্যাক্স ওয়েবার ব্যাপক গবেষণা করেছেন। কার্ল মার্ক্সের মতানুসারে মানব সভ্যতার ইতিহাস প্রধানত শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি সমাজ বিবর্তনে যে সব শ্রেণির কথা বলেছেন তারা হলেন, দাস মালিক এবং দাস, সামন্ত প্রভু এবং ভূমিদাস, পুঁজিপতি শ্রেণি এবং শ্রমিক। মার্ক্সীয় তত্ত্বে উৎপাদন ব্যবস্থাই শ্রেণি সমাজের স্তর নির্ণয় করে। ম্যাক্স ওয়েবার মার্ক্স-এর তত্ত্বের পরিপূরক হিসেবে আরও কিছু নির্দেশিকার উল্লেখ করেছেন, যেমন সামাজিক মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, সামাজিক স্তর বিন্যাসের ভিত্তি তিনটি যথা- শ্রেণি, সামাজিক মর্যাদা এবং ক্ষমতা। আমরা প্রাচীন বা বর্তমান যে কোনো সমাজই বিশ্লেষণ করি না কেন, সব সমাজেই দাস, ভূমিদাস, কৃষক, কারিগর, অন্ত্যজ শ্রেণি প্রভৃতি নিম্নবর্গ শ্রেণিভূক্ত। এ অর্থে বাংলার ইতিহাসে একটি সামাজিক শ্রেণি হিসেবে নিম্ববর্গের অবস্থান বিবেচ্য, যা অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকেও চলমান ছিল ।
অর্থনৈতিক অবস্থা
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক অবস্থা ও তুলনামূলক আলোচনা নির্ণয় করা হয়েছে। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সময় (১৫৪০ খ্রি.) সুবা বাংলাকে জান্নাতাবাদ বা স্বর্গ রাজ্য বলে অভিহিত করা হতো। নবাবি আমলেও অর্থনৈতিক জীবনে সম্পদ ও শ্রীবৃদ্ধির অনুকূল অবস্থা বাংলায় পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। এ সময়ে বাংলার কৃষিজ সম্পদ ছিল বিচিত্র ও অফুরন্ত। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে বাংলার সম্পদ ও সমৃদ্ধি শুধু কৃষি-নির্ভর ছিল না। কৃষির পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্প পণ্য ছিল এই যুগে বাংলার জাতীয় আয়ের উল্লেখযোগ্য উৎস। পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্প পণ্য ছিল এই যুগে বাংলার জাতীয় আয়ের উল্লেখযোগ্য উৎস। তখন বাংলার শিল্পের বস্ত্র, রেশম, লবণ, চিনি, কাগজ, লোহা, নীল, মদ, নৌকা নির্মাণ ও মৃৎশিল্প ছিল বিখ্যাত। বাংলার শিল্পোৎপাদনে এই সময়ে তিন ধরনের ব্যবস্থা চালু ছিল যেমন- (ক) হস্তশিল্প; এ ববস্থায় পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে কারিগর ছিল স্বাধীন। (খ) কুটির শিল্প; এ ব্যবস্থায় কারিগর ‘দাদন' নিয়ে শর্ত সাপেক্ষে পণ্য উৎপাদন করতো এবং (গ) কারখানা শিল্প; এ ব্যবস্থায় কারিগর নিজে ইউরোপীয় বা এদেশীয় বণিক-মহাজনের ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকরূপে কাজ করতো। এছাড়াও ছিল সরকার নিয়ন্ত্রিত শিল্প কারখানা। এই শিল্পগুলো মহাজনি ব্যবস্থার নিগড়ে আবদ্ধ ছিল। এমতাবস্থায় শিল্পে নিয়োজিত বাংলার কারিগরদের পক্ষে উৎপাদন প্রক্রিয়ার রূপান্তর ঘটানো সম্ভব ছিল না ।
অষ্টাদশ শতকে বাংলার শিল্প জগতে বস্ত্র শিল্প ছিল নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ । এতে নিম্নবর্গের ভূমিকা গৌরবময়। অর্থনীতির উপর বস্ত্র শিল্পের প্রভাব ছিল তখন অসামান্য। বাংলায় উৎপাদিত বস্ত্র-পণ্য জনগণের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশে প্রচুর রপ্তানি হতো। বাংলাবস্ত্রের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এই শিল্পের অসাধারণ উন্নতির কারণ । তখন প্রতিটি গ্রামে নিম্নবর্গের নারী, পুরুষ ও শিশুরা বস্ত্র বয়নে নিযুক্ত থাকতো । বাংলার বস্ত্র শিল্পে ঢাকার স্থান ছিল শীর্ষে। এ সময়ে একজন দক্ষ ও পরিশ্রমী মহিলা সারা মাসে সুতো কেটে তিন টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারতো। সাধারণত গড়ে একজন শ্রমিকের ১২-১৪ আনা থেকে ২ টাকা পর্যন্ত মাসিক আয় দাঁড়াতো। অষ্টাদশ শতকে এই আয় নেহাত কম ছিল না, যখন একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের জীবনধারনের জন্য মাসিক ব্যয় হতো দুই টাকা ।
ঔপনিবেশিক বাংলায় সব ধরনের বস্ত্র উৎপন্ন হতো। এশিয়ায় ও ইউরোপের বাজারে বাংলার বস্ত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিল। এর প্রধান কারণ হলো বাংলার বস্ত্র ছিল গুণগতমানে উন্নত এবং দামে সস্তা। ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের সময় বা এর আগে সমগ্র বিশ্বে বাংলার পরিচয়ের মূলে ছিল এর বস্ত্রশিল্প। বিশ্ব বাজারের সঙ্গে বাংলার যে সংযোগ তা কখনো কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে নষ্ট হয়নি। ফলে বিশ্ববাজারে বাংলার পণ্যের ব্যাপক চাহিদা এবং সে মোতাবেক বিপুল রপ্তানি দেশের অর্থনীতিতে যুগান্তর সৃষ্টির কথা ছিল। কেননা বিশ্ববাজারে ব্রিটিশ পণ্যের ক্রমপ্রসারের ফলেই মূলত ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু বাংলার পণ্য অনুরূপ বিশ্ববাজার পেলেও এখানে কোনো শিল্প বিপ্লব ঘটেনি। এর কারণ হলো বাংলার শিল্প ছিল মহাজনি ও দাদনি ব্যবস্থা নির্ভর। এর প্রযুক্তিগত কোনো বিকাশ ঘটেনি। এতে পুঁজি সৃষ্টি হয়নি, সৃষ্টি করতে পারেনি উৎপাদকের মধ্যে কোনো উদ্যোগ। অভিনবত্ব ও উদ্যোগের অভাবে বাংলার শিল্প পণ্য ক্রমে ঐতিহ্যনির্ভর হয়ে পড়ে। আর শিল্পের মালিক, কারিগর ও নিম্নবর্গ সবাই আটকা পড়ে খোরাকি অর্থনীতির আবর্তে। ফলে এখানে শিল্প বিপ্লব ঘটার কোনো সম্ভাবনাই তৈরি হয়নি ।
অষ্টাদশ শতকে নিম্নবর্গ শ্রেণি নিয়ে গঠিত বণিক সমাজ বাংলার আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্য পরিচালনা করতো। আর মহাদেশীয় বাণিজ্য ছিল মূলত ইউরোপীয়দের দখলে। বাংলার আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণকারী দেশি-বিদেশি বণিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গুজরাটি, মাড়োয়ারি, ভোজপুরি, আর্মেনীয়, মির্জাপুরি, বেনারসি, লাহোরি, মুলতানি, কাশ্মিরি ও পারসিক প্রভৃতি। এ যুগে বাংলার বণিক সমাজ বড়, মাঝারি ও ছোট এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। বড় ব্যবসায়ী ও মহাজনদের হাতে সব সময় বিশাল পুঁজি মজুদ থাকতো। তারা সাধারণত বড় বড় শহরে যেমন- ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, পাটনা ও হুগলী ইত্যাদি স্থানে বাস করতো। এদের সংগঠন ও ব্যবসায়ের পরিমাণ ছিল বিশাল । মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে এরা সরাসরি উৎপাদকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতো। পুঁজির স্বল্পতার কারণে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে ব্যবসায় বাণিজ্য সীমাবদ্ধ রাখতো । বাংলার এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে তারা যাতায়াত করতো। কোনো কোনো সময় তারা বিদেশি বণিকশ্রেণির গোমস্তা হিসেবে কাজ করতো। তাছাড়া বড় বড় ব্যবসায়ীদের কমিশন এজেন্ট হিসেবেও অগ্রিম বা দাদন নিয়ে তারা পণ্য সরবরাহ করতো। নিজেদের মূলধন কম বলে অধিকাংশ সময় মহাজনদের নিকট থেকে এদের সুদে টাকা ধার নিতে হতো। বড় বণিকশ্রেণির মধ্যে অবৈধভাবে বা অসাধু উপায়ে টাকা রোজগারের ঝোঁক থাকলেও সাধারণ বণিকসমাজ কঠোরভাবে ব্যবসায়ী রীতিনীতি মেনে চলতো। ঔপনিবেশিক যুগে তারাই ছিল ব্যবসা নির্ভর নিম্নবর্গ শ্রেণির প্রতিনিধি ।
বাংলার স্থানীয় বণিকদের ব্যবসায় ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে লভ্যাংশ নির্ভর। তারা স্থানীয় শিল্প উদ্যোগে পুঁজি বিনিয়োগ করতো। তবে উৎপাদনের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। সাধারণভাবে প্রত্যেক ব্যবসায়ী পরিবারের একজন দালাল (broker) থাকতো। তার নীচে থাকতো পাইকাররা। সপ্তদশ শতকে এদেশে এটাই ছিল প্রচলিত প্রথা যে, দালাল ছাড়া কেউ কিছু করতে পারতো না। বণিকরা নানা দ্রব্যের ব্যবসা করতো। কিন্তু কোনো বিশেষ দ্রব্যে বিশেষভাবে মূলধন বিনিয়োগ করে তার উন্নতি বা বিশেষীকরণ করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। অর্থাৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মূলধন বিনিয়োগ করে অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটানোর কোনো প্রচেষ্টাই গৃহীত হয়নি। এতে করে বাজারের চাহিদা ও দামের ওঠা-নামার খপ্পড়ে কৃষি- অর্থনীতি জড়িয়ে পড়েছিল। উৎপাদন কাঠামোর পরিবর্তনে অন্য একটি অন্তরায় ছিল বণিক ও উৎপাদকের মধ্যে নানা স্তর। ‘দাদনি’ ব্যবস্থা এবং বিপুল মধ্যবর্তীর অস্তিত্বের ফলে ব্যবসায়ী মূলধন বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থেকেছে। মূলধন কেন্দ্রীভূত হতে পারেনি। ফলে উৎপাদন ব্যবস্থার প্রক্রিয়াগত কোনো পরিবর্তন ও চরিত্রগত রূপান্তর ঘটেনি। রাষ্ট্র আহরিত সামাজিক সম্পদে বণিকদের অবদানও আশানুরূপ ছিল না। এ সময়ে রাষ্ট্রের কাছে বাণিজ্যের লাভ বা ক্ষতি ছিল ভূমি রাজস্বের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কৃষকরা যেখানে কমপক্ষে অর্ধেক উৎপাদন রাজস্ব হিসেবে রাষ্ট্রকে প্রদান করতো সেখানে বণিকরা মাত্র ২.৫০% থেকে ৫% শুল্ক, এবং কিছু অন্তঃশুল্ক ও উৎকোচ দিয়েই রেহাই পেতো। উৎপাদন অপেক্ষা লাভের দিকে সব ঝোঁক তাকায় বণিকদের সাথে রাষ্ট্র বা ভূমিজ স্বার্থের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেনি, যা নতুন কোনো সমাজের দিক নিদের্শনা দিতে পারত। ফলে অষ্টাদশ শতকের পট পরিবর্তনে বণিক গোষ্ঠী কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি এবং রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে কোনো সামাজিক উত্তরণের পথও নির্দেশ করতে পারেনি। অথচ ইউরোপে ছিল বিপরীত অবস্থা। সেখানে যে সকল বণিক সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিল, তারা ছিল নিম্নবর্গ শ্রেণিভুক্ত। তারা নিজেদের তদারকীতে ক্ষুদে কারখানা রাখতো এবং সেখান থেকে পণ্য তৈরি করে স্বাধীনভাবে বিক্রি করতো। কিন্তু বাংলার বণিককূলের আওতায় সেরকম কোনো কারখানা গড়ে উঠেনি। ফলে সামাজিক নেতৃত্ব দেবার শক্তি যেমন এদেশের বণিকদের ছিল না তেমনি কৃষক বিদ্রোহের ব্যাপারেও তারা ছিল উদাসীন। সুতরাং ইউরোপে যে প্রক্রিয়ায় সামন্তবাদী কাঠামো ভেঙ্গে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছিল, বাংলার ক্ষেত্রে তা ছিল অনুপস্থিত।
বাংলায় ব্যবসায় বাণিজ্যের জন্য বহু ইউরোপীয় কোম্পানি এসেছিল। এদেশের কৃষি অর্থনীতিতে তারা ছিল বহিঃশক্তি। আর নিম্নবর্গ ছিল অভ্যন্তরীণ শক্তি । বহিঃশক্তি সরকারের কাছ থেকে বাণিজ্যের অনুমতি নিয়ে বহু দুর্গ ও শহর গড়ে তুলেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলার বাণিজ্যের সিংহভাগ তিনটি ইউরোপীয় কোম্পানি অর্থাৎ ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে ছিল । ওলন্দাজদের চূচুড়া ও ফোর্ট গুস্ত াভাস, ফরাসিদের চন্দননগর ও ফোর্ট-অরলিও আর ইংরেজদের ছিল কলকাতা ও ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ । এছাড়াও ঢাকা, কাশিম বাজার, মালদহ, রাজমহল, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও হুগলিতে এই তিনটি কোম্পানির ফ্যাক্টরি ছিল। ইউরোপীয় পর্যটক বার্ণিয়ারের মতে, বাংলার উর্বর ভূমি, মূল্যবান কৃষিসম্পদ ফ্যাক্টরি ছিল। ইউরোপীয় পর্যটক বার্ণিয়ারের মতে, বাংলার উর্বর ভূমি, মূল্যবান কৃষিসম্পদ ও দক্ষ কারিগরশ্রেণির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিল জাগ্রত ইউরোপীয় শক্তি সমূহ। ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে পর্তুগীজরা সর্বাগ্রে বাংলায় আসে। কিন্তু তারা ছিল ইউরোপীয় জাতিসমূহের সংস্কার বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রতিনিধি। বাজার বাণিজ্য নয় বরং ধর্ম প্রচার ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের বাণিজ্যের বিশাল অংশ ছিল দাস ব্যবসায়ে নিয়োজিত । ফলে বাংলার ব্যবসায় বাণিজ্যে তারা অবদান রাখতে পেরেছিল অল্প। ডাচ জাতি ছিল ইউরোপীয় প্রগতিবাদী শক্তি। বাংলার রেশমের জন্য পাশ্চাত্য বাজার উন্মুক্ত করার গৌরব তাদের প্রাপ্য। কিন্তু দূর প্রচ্যের মসলার ব্যবসায়ে একচেটিয়া কৰ্তৃত্ব থাকায় বাংলার প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যে তারা সম্পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করেনি। তদুপরি এখানে ২.৫০% হারে শুল্ক দিয়ে তারা মুঘল সরকারের নিকট হতে বাড়তি কোনো সুবিধাও আদায় করতে পারেনি। অন্যদিকে ফরাসি জাতি তখনো পুরোপুরি বেনেবাদী আদর্শ গ্রহণ করেনি। তাদের কোম্পানি সামন্তবিধি ব্যবস্থায় আড়ষ্ট ছিল। ফলে ফরাসি যোগ্য সেনাপতি ও সংগঠক ডুপ্লে (Duplay, 1741) বাংলায় এসেও ইরেজ কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেননি। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় আসে সবশেষে কিন্তু তারা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই পলাশীর পটভূমি রচনা করতে সক্ষম হয় এবং বাংলার সমাজ বিকাশে এক নতুন দিক নির্দেশ করে। ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ বাণিজ্য প্রতিনিধি জব চার্ণক সুতানুটিতে এলে হুগলির মুঘল কর্মকর্তারা তাঁকে স্বাগত জানান। এভাবে কলকাতায় ইংরেজদের বাণিজ্যকুঠি গড়ে উঠে। একই সময়ে ফরাসিরাও বাংলায় তাদের বাণিজ্যাধিকার প্রতিষ্ঠার অনুমতি লাভ করে। আঠারো শতকের প্রারম্ভে দিনেমার, ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ফরাসিদের আগমনে বাংলার, অর্থনীতি ও সমাজ-কাঠামোয় বিশেষ পরিবর্তনের সূচনা হয়। দিনেমাররা ১৭১৪ খ্রিষ্টাব্দে এদেশ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তারপরই ইংরেজ ও ওলন্দাজদের বাণিজ্যিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের ফরমানের মাধ্যমে ফরাসি ও ওলন্দাজরা বাংলার বাণিজ্যে সুবিধালাভ করে। পরবর্তীতে সুবাদার আজিম-উশ-শান (১৬৯৮ খ্রি.) ও বাদশাহ ফররুখশিয়ারের ফরমানবলে (১৭১৭ খ্রি.) ইংরেজরাও এদেশে অনেক বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ করে।
ইংরেজরা ১৬৯৮ খ্রি. শাহজাদা আজিম-উশ-শানকে ১৬,০০০ টাকা উপঢৌকন দিয়ে সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রামের ইজারা লাভ করে। কোম্পানির প্রতিনিধি জব চার্ণক সুতানুটি গ্রামে তাঁর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে ভবিষ্যত কলকাতা নগরী ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। এভাবে ব্যবসার পাশাপাশি এদেশের ভূমিতে ইংরেজদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট ফররুখশিয়ারের ফরমানবলে ইংরেজ কোম্পানি পূর্বেকার তিনটি গ্রামের (সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা) ইজারা অনুমোদন ছাড়াও আরও ৩৮টি গ্রাম ক্রয়ের অনুমতি লাভ করে। আঠারো শতকের প্রথম দিকে ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্য দেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করে। বাণিজ্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গ তারা নবাবের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করতে থাকে। ইতোমধ্যে ইংরেজ কোম্পানির কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হওয়ায় দেশীয় লোকদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। ১৭০০ খ্রি. মুর্শিদকুলী খানের দরবারে ওলন্দাজদের বাণিজ্য প্রতিনিধি ছিলেন রাজবল্লভ এবং ইংরেজদের ছিলেন রাজারাম । প্রাক ঔপনিবেশিক বাংলায় বিদেশি বণিকদেরকে বিশেষ করে ইংরেজদেরকে তাদের ব্যবসায় বাণিজ্যের ব্যাপারে নবাবকে প্রচুর অর্থ দিতে হতো। অনেক সময়ে তাদের ব্যবসাক্ষেত্রে নবাবের প্রশাসন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতো, যা ছিল নবাবদের সাথে বিদেশি কোম্পানির দ্বন্দ্ব সৃষ্টির অন্যতম কারণ
নবাবি বাংলার বাণিজ্যে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়ের ধরন ছিল অভিন্ন। বিদেশি বণিকরা এদেশীয় ব্যবসায়ী ও দালালদের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়ের আগাম ব্যবস্থা করতো। একে ‘দাদনি' ব্যবস্থা বলা হতো। অগ্রিম পুঁজি দিয়ে দাদনিরা নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট দামে ও গুণগতমানে কোম্পানিগুলোকে পণ্য সরবরাহ করতে চুক্তিবদ্ধ থাকতো। এজন্য এরা কমিশন পেতো। বিদেশিরা এদেশের ভাষা, মাপ-প্রণালী, মুদ্রা ব্যবস্থা ও বাজার ইত্যাদি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকায় এদেশীয় ব্যবসায়ী বা এক শ্রেণির নব্য বানিয়ার উপর নির্ভরশীল ছিল। এই সকল বানিয়ারা দ্রব্য সামগ্রী ক্রয়ের বিষয়ে প্রতিনিধির ভূমিকা পালন করতো। এই নব্য বানিয়ারা বিদেশি কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট থেকে ক্রমাগত প্রচুর অর্থ বিত্তের মালিক হয় এবং একটি প্রভাবশালী পুঁজিপতি শ্রেণিতে পরিণত হয়। ১৭৩৬-৪০ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে কলকাতার ৫২ জন স্থানীয় ব্যবসায়ী, কাশিমবাজারের ২৫ জন হিন্দু ব্যবসায়ী এবং ঢাকার ১২ জন ব্যবসায়ীর (এদের মধ্যে ২ জন মাত্র মুসলমান) বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। এই নব্য পুঁজিপতিশ্রেণি পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজেদের শ্রেণি স্বার্থে ইংরেজ কোম্পানির পক্ষে সব কিছুই করতে সক্ষম হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলার ক্রমবিকাশমান বাণিজ্যের সাথে সামন্ত সরকারের মুদ্রানীতির সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। কোম্পানি ও সরকারের মধ্যে মুদ্রাজনিত দ্বন্দ্ব দীর্ঘকাল যাবত বিদ্যমান ছিল। এ সময়ে বিভিন্ন টাকশাল হতে মুদ্রিত টাকা প্রচলিত থাকায় স্বাভাবিকভাবে জটিলতা বৃদ্ধি পায় এবং এই সুযোগে পোদ্দার শিরমণি ফতেহ চাঁদ বাংলার মুদ্রা বাজারের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেন। এছাড়াও হিম্মাৎ সিং, লক্ষণ সিং, লালাজী ব্রীজা বকুন, মনেশ্বর নাথ, শিবদত্ত ও মিত্রসেন প্রমুখ ছিলেন মুদ্রা বাজারে অতি পরিচিত নাম। এদের মধ্যে কেবল শিবদত্ত ও মিত্রসেন ছিলেন বাঙালি, বাকী সবাই ছিলেন উত্তর ভারতের। এই অবাঙালি ব্যাংকিং হাউসগুলো উদ্বৃত্ত অর্থকে যেমন বাংলার বাইরে পাচার করতেন তেমনি তারা বাংলার সামন্তদের মধ্যকার অভ্যন্ত রীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে উৎসাহিত করতেন। এই ধনিক-বণিকশ্রেণি ক্রমশ এতই শক্তিশালী হয়ে উঠে যে, তাদের ধনের ওপর রাষ্ট্রের আর্থিক নিরাপত্তা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। উচ্চশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত এই ব্যবসায়ীশ্রেণি ছিল হিন্দু প্রাধান্যনির্ভর। মুসলমানরা তখন ব্যবসায় বাণিজ্যের চেয়ে সামরিক চাকরি ও উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত হতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ফলে মুসলমানদের মধ্যে কোনো ব্যবসায়ীশ্রেণি গড়ে ওঠেনি। ব্যবসায় বাণিজ্যের পাশাপাশি এ ধনিকশ্রেণি নবাব দরবারে রাজনীতিতে ক্রমাগত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। নবাব সুজাউদ্দিনের (১৭২৭ খ্রি.) সময়ে রায় রায়ান আলম চাঁদ ও জগৎশেঠ ফতেহ চাঁদের হাতে অনেক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল। ১৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দে নবাব আলীবর্দী খান উমিচাঁদকে দেওয়ান নিযুক্ত করেন। জগৎশেঠ, দুর্লভ রায় ও উমিচাঁদ তাদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই ক্লাইভের সঙ্গে মিলে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। অতএব যে নবাবদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা নিছক সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছু নয় ।
বাংলা সরকার যতোদিন কেন্দ্রীয়ভাবে শক্তিশালী ছিলেন ততোদিন বিদেশি কোম্পানিগুলো ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে কোনো বিরোধে জড়ায়নি । কিন্তু নবাবদের দুর্বলতা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগে বিদেশি বণিকশ্রেণি সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিবাদে লিপ্ত হতে থাকে। ১৭২৭ ও ১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে লবণের ব্যবসা নিয়ে প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির বিরোধ দেখা দেয়। এ সময়ে ইউরোপীয় কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসাকে কেন্দ্র করে নবাব ইংরেজ কোম্পানির দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। এরূপ ব্যবসার কারণে সরকার রাজস্ব হতে বঞ্চিত হতো এবং দেশীয় বণিকগণ অভ্যন্তরীণ বাজারে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতো। আঠারো শতকে বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, শঠতা ও কপটতার আবর্তে বিদেশি বণিকরাও নিজস্ব স্বার্থে আর নিরপেক্ষ থাকতে চায়নি। এরূপ প্রেক্ষাপটে নবাব আলীবর্দী খানের সময় ইংরেজদের সঙ্গে এদেশীয় শেঠ ও বানিয়াগোষ্ঠীর সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল নবাবকে উৎখাত করে একজন অনুগত নবাব প্রতিষ্ঠা করা। সে সুযোগ আসে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনে আরোহণের পর ৷

অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর দরিদ্র সাধারণ কিংবা নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা ৭৯
এ যুগে বাংলার বাজারে জিনিসের দাম ছিল কম। শ্রমিক এবং কারিগরদের বেতন এবং মজুরিও ছিল কম। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের আগে ও ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় একজন কারিগরের দৈনিক মজুরির হার ছিল নিম্নরূপ : উপর্যুক্ত বিশ্লেষণ থেকে নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক অবস্থার একটি চিত্র পাওয়া যায় । নবাবি বাংলায় টাকা ছিল দুষ্প্রাপ্য এবং টাকার ক্রয় ক্ষমতা ছিল বেশি। এরূপ পরিস্থিতি দেশের গতিহীন অর্থনীতির লক্ষণ। এধরনের গতিহীন অর্থনীতিতে মানুষ খেতে পায় তবে আর্থিক অগ্রগতি হয় না। ১৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে হতে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পায়। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে এই বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৩০ ভাগ। এ সময়ে মুর্শিদাবাদ, ঢাকা, কলকাতা, হুগলি ও বর্ধমান ছিল বাংলার বড় শহর। তবে এগুলো নাগরিক অর্থনীতির উৎস। ‘বণিক শহর' বলতে যা বুঝায় তা ছিল না। এই শহরগুলোর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল গ্রামগুলোর সম্পদ শোষণ করে। তখন শহরের লোকসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম। অথচ সমগ্র রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ খরচ হতো সৈন্যদের জন্য, চার ভাগের এক ভাগ খরচ হতো অভিজাতশ্রেণির পেছনে । আর পণ্ডিত, চিকিৎসক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও নর্তকীদের জন্য খরচ হতো দশ ভাগের এক ভাগ। এছাড়া নবাবের পরিবার-পরিজন, হারেম, অসংখ্য কর্মচারী ও প্রতিনিধির জন্য বিপুল রাজস্ব ব্যয় হতো। এভাবেই গ্রামের কৃষকের উদ্বৃত্ত মূল আত্মসাৎ করে গড়ে তোলা হয়েছিল শহরকে। আর শাসকশ্রেণি এ শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিল তাদের বিলাসী জীবন। সুতরাং "spending not hoarding, was the dominant feature of the time." ব্যারিংটন মুরের এ উক্তিটি এক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যময় বলে মনে হয়। এ অবাধ বিলাসিতা ও আভিজাত্যের পিছনে অপচয়ের ফলেই বাংলার সমাজের অভ্যন্তরে জাতীয় পুঁজি যেমন বিকশিত হয়নি, তেমনি ধনতন্ত্রের সম্ভাবনাও জাগেনি এবং একই কারণে সাধারণ জনগণের জীবনমানও উন্নত হয়নি। অথচ এ সময়ে বাংলাতে শাসক বিরোধী ব্যাপক কোনো বিদ্রোহ আমরা দেখি না। এর অন্যতম কারণ হলো লৌকিক ধর্মের ভূমিকা, যা কৃষকদের মানসিকতাকে
সেভাবে বিদ্রোহমুখী করে তুলেনি। এছাড়া প্রাক ব্রিটিশ যুগে নবাব, জমিদার ও কৃষকের মধ্যে ভূমির বণ্টন ও রাজস্বের ব্যাপারে একটি সামঞ্জস্য মেনে চলা হতো, যা কৃষক শ্রেণিকে কিছুটা হলেও স্বস্তি যোগাতো। সর্বোপরি বর্ণ প্রথার কঠোরতা ও অদৃষ্টবাদ এ অঞ্চলে কৃষকদের নিম্নবর্গের শ্রেণিচেতনাকে গড়ে উঠতে দেয়নি ।
নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থার প্রকৃতি
সুপ্রাচীনকাল থেকে বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজে ভূমিই সমস্ত সম্পদের উৎস আদিম সমাজে প্রচলিত পরিবার ও স্থানীয় গোত্র প্রথা এখানে বিবর্তিত হয়েছে ভূমিকেন্দ্রিকতায়। বিভিন্ন শাসনামলে ভূমির ওপর শাসকগণের কর্তৃত্ব এবং শাসক কর্তৃক ভূমি সম্পর্কিত উদ্যোগে বিবর্তিত হয়েছে কৃষকের জীবন। বাংলা চিরকালই কৃষিনির্ভর। দীর্ঘকাল ধরে বাংলা ছিল ভারতবর্ষের অন্তর্গত একটি অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এবং বিদেশি শাসনের প্রাণকেন্দ্র। বিদেশি শাসন শুধুমাত্র বিজিত রাজ্যকে পরাভূত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তারা বিপুল ভূসম্পত্তি-নির্ভর বাংলার প্রচলিত ভূমিব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটায়। ফলে ভূমি সংশ্লিষ্ট কৃষকের ভূমিকার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী। প্রচলিত গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর প্রথম উল্লেখযোগ্য রূপান্তর সাধিত হয় মুঘল আমলে (১৫২৬-১৭৫৭ খ্রি.)।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হলে এর প্রভাব কৃষকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাসকদের উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যের রাজস্ব বাড়ানো। ভিন্ন ভিন্ন শাসকের ভূমি সম্পর্কিত ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগের ভেতর দিয়ে কৃষকের অবস্থান বিবর্তিত হতে থাকে। কোনো কোনো শাসকের পদক্ষেপ কৃষকের জন্যে সাময়িক আনুকূল্য বয়ে আনলেও তার ফল সুদূরপ্রসারী হয়নি । শেরশাহ ও তার উত্তরসূরিদের আমলে (১৫৪১-১৫৫৫ খ্রি.) রাজস্বের জন্যে ফসলের পরিমাণের চাইতে জমির মাপের উপর অধিকতর গুরুত্বারোপ; প্রশাসনিক কাঠামোয় রাজ্যকে পরগনা ও সরকারে বিভক্তিকরণ; আকবরের রাজত্বকালে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) জমির উর্বরতা অনুসারে রাজস্ব নির্ধারণ ইত্যাদি কর্মসূচি কৃষককে কিছু স্বস্তি যোগালেও মুঘল আমলের শেষদিকে এসেই দেখা যাচ্ছে, কৃষক শোচনীয় অবস্থার মুখোমুখি। মুঘল আমলে একদিকে সাম্রাজ্যের স্ফীতি ঘটেছে। অন্যদিকে কৃষকের দুর্গতি বেড়েছে। অথচ কৃষকদের শ্রমই ছিল মুঘল যুগের শাসকশ্রেণির বিপুল ঐশ্বর্যের উৎস। শ্রমজর্জর কৃষক এভাবেই মুঘল আমল থেকে প্রবেশ করে ব্রিটিশ শাসনামলে ।
১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় ইংরেজদের প্রথম ফ্যাক্টরি ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনার সূচনা বিন্দু। এরপর ক্রমশ বালাসোর, কাশিমবাজার ও পাটনায়, ১৬৯৮ খ্রি. গোবিন্দপুর, সুতানুটি ও কলকাতার স্বত্বপ্রাপ্তি, ১৭৫৭ খ্রি. পলাশীর যুদ্ধ ইত্যাদি ঐতিহাসিক ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৭৬৫ খ্রি. ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা করে। ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে (১৭৬০-১৭৭২ খ্রি.) বাংলার অধিকাংশ অঞ্চলই ছিল জমিদারদের অধীনে। মুঘল আমলে রাষ্ট্রের রাজস্বের মূল উৎস ছিল ভূমি। ব্রিটিশ আমলে এসেও দেখা যাচ্ছে, ভূমিই লাভ করলো শাসকদের প্রধান মনোযোগ। তাই ব্রিটিশ আমলের শুরু থেকেই কর্তৃপক্ষের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, একটি কার্যকর ভূ-সম্পত্তি নীতির প্রণয়ন। এ লক্ষেই নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৭৯৩ খ্রি. লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনামলে প্রণীত হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এই বন্দোবস্তের লক্ষ্য ছিল বহুমাত্রিক। প্রথমত; এর মাধ্যমে একটি জমিদারশ্রেণি গড়ে তোলা, যারা জমির প্রকৃত মালিকরূপে গণ্য হবে এবং তারা রাষ্ট্র ও কৃষকের মধ্যবর্তী হিসেবে জমি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব সংগ্রহ করে তা রাষ্ট্রকে নিয়মিতভাবে প্রদান করবে। দ্বিতীয়ত; দেশের অধিকাংশ মানুষ শ্রম প্রদান করবে, কিন্তু সেই শ্রমের ফল ভোগ করবে অল্পসংখ্যক মানুষ। সেই অল্পসংখ্যক মানুষকে পৃষ্ঠপোষকতা যোগাবে রাষ্ট্র। বলাবাহুল্য, ব্রিটিশ শাসকদের ছকে বাঁধা অল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে সাধারণ কৃষকদের কোনো স্থান ছিল না। মুঘল আমলে যেখানে রাষ্ট্রই ছিল জমির মূল মালিক, সেখানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্টি হলো জমির হস্তান্তরযোগ্যতা। জমির মালিক পেল জমির ওপর একচেটিয়া অধিকার। ইংরেজরা তাদের দেশের অনুকরণে ভূমিতে যে ব্যক্তিগত মালিকানার রীতি প্রতিষ্ঠিত করলো তাতে ভূমিজাত সম্পদই আসল। কৃষকের শ্রম নিংড়ে জমি থেকে যতটা সম্ভব সম্পদ আদায়ের চেষ্টা চলতে লাগলো। রাষ্ট্রের পাওনা ও নিজেদের অর্থের প্রয়োজনে কৃষকের ওপর জমিদারের নিপীড়ন ও নির্যাতন প্রভৃতি বেড়ে গেল। জমিতে অত্যধিক উৎপাদনের জন্যে নিম্নবর্গ কৃষকের ওপর জোর খাটিয়ে, দৈহিকভাবে নির্যাতন করে জমিদারশ্রেণি বাংলার গ্রামাঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলো। এছাড়া নিম্নবর্গ কৃষক শোষণের আরও একটি মধ্যস্বত্বের নাম ছিল পত্তনি প্রথা। বর্ধমানের মহারাজ তেজচন্দ্র ছিলেন এর প্রবর্তক। এ প্রথার ফলে কৃষকের উপর কোথাও কোথাও আট, বাইশ বা পঞ্চাশটি পর্যন্ত মধ্যস্বত্ব সৃষ্টি হলো। সুতরাং এতগুলো মধ্যস্বত্ব একই জমির উপর জীবিকার জন্য নির্ভর করায় নিম্নবর্গ কৃষকের দুঃখ-দুরবস্থা আরও বেড়ে গেল। জমিদারদের শোষণের প্রতিকার করে প্রজাদের রক্ষা করার পরিবর্তে ব্রিটিশ শাসক বরং জমিদারশ্রেণির পক্ষেই বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করলেন। এমতাবস্থায় বাংলার গ্রামাঞ্চলে জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে থাকে নিম্নবর্গ কৃষকদের অসন্তোষ ।
ব্রিটিশ শাসনামলে ভূমি-ভিত্তিক বাংলার গ্রামীণ স্তরবিন্যাস ছিল সংখ্যালঘু জমিদারদের নিয়ন্ত্রণে। সেই সাথে তাদের অধীন ছিল রাষ্ট্রের প্রায় সমস্ত জমি । আর জমি চাষকারী কৃষক সংখ্যায় অতি বিপুল হয়েও পড়ে রইলো সমাজের অতি নিম্ন স্তরের জীবনযাপনের বৃত্তে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের যে ভূমিকে সম্পদের প্রধান উৎস বলে অভিহিত করে, কালক্রমে সেই ভূমির বাণিজ্যিক মূল্য হয়ে ওঠে অপরিসীম। ভূমির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হলো বাণিজ্যের। দেশব্যাপী বিস্তার ঘটলো বাণিজ্যিক কৃষির। কৃষি ও বাণিজ্যের যোগসূত্রে জমিদারশ্রেণির পাশাপাশি গ্রামে উদ্ভূত হলো ব্যবসায়ীশ্রেণি। এসব ব্যবসায়ীর অধিকাংশই থাকতো শহরে, কিন্তু নিজেদের পুঁজির মাধ্যমে গ্রামের কৃষিপণ্যের উপর তারা প্রতিষ্ঠা করে নিয়ন্ত্রণ। জমিদারদের মতো তারাও জমির মালিক হয়ে ওঠে অর্জিত পুঁজি ভূমিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে। ১৮৫৭ খ্রি.
এক হিসেবে দেখা যায় যে, বাংলার দুই-তৃতীয়াংশ জমির মালিক কলকাতায় বসবাসকারী ব্যবসায়ীশ্রেণি। কৃষকের আর নিজের ইচ্ছামতো ফসল ফলানোর উপায় রইলো না। বাংলার নিম্নবর্গের কৃষকের অন্যের উপর নির্ভরতার সীমানাও এভাবে বেড়ে যেতে থাকে। ব্রিটিশ শাসনামলে জমির মালিকের পাশাপাশি কৃষককে পুঁজির মালিক বা মহাজনশ্রেণির নিকটেও বহুবিধ কারণে হাত বাড়াতে হলো ।
পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে বাংলার কৃষির যোগাযোগের ফলে বাংলার নিম্নবর্গের কৃষক বিশ্ববাজারে পণ্য ও কাঁচামাল যোগান দিতে শুরু করলো। ষোড়শ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত কালপরিসরে বিশ্বের অন্যত্র যেরকমটি ঘটেছে, সেরকম কোনো বিপ্লব ঘটেনি বাংলার কৃষির ক্ষেত্রে। এর পাশাপাশি শাসক তার নিজ দেশের পণ্যের স্থানীয় বাভার হিসেবে গড়ে তোলে উপনিবেশকে। নিজেদের দেশ থেকে তারা নানারকম পণ্যের আমদানি করতে থাকে; পরিণামে ভেঙে পড়ে বাংলার গ্রামীণ কুটিরশিল্প, যে কুটিরশিল্প গড়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষের শ্রমে। স্থানীয় কারিগরদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াল বিদেশি যন্ত্রশিল্প। স্থানীয় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পক্ষে বিদেশি বাণিজ্যিক আগ্রাসনের মোকাবিলা হয়ে পড়ল অসম্ভব। ১৮৪০-এর দিকে ভারতের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল ও শহরগুলোর সঙ্গে স্থাপিত হলো জাহাজ যোগাযোগ। এতে বাংলার কৃষকদের যোগান দেওয়া কাঁচামাল ও পণ্য বিদেশে পৌঁছানোর পথও সুগম হলো। ব্রিটেনের কলকারখানায় নিয়মিত পৌঁছাতে থাকলো বাংলার কাঁচামাল । উপনিবেশবাদীদের উদ্দেশ্য ঠিকই বাস্তবায়িত হতে থাকে, কিন্তু বাংলার কৃষি আর কুটিরশিল্পের অবস্থা হয়ে পড়ে শোচনীয়। বাংলা থেকে নিংড়ে নেওয়া সম্পদ শেষ পর্যন্ত সহায়তা যোগায় ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লবে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদী প্রভাবে পূর্বে ভারতের তাঁতশিল্প যে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা কার্ল মার্কসও উল্লেখ করেছেন। এর নেতিবাচক পরিণাম সমাজের উচ্চবর্গীয়দের জীবনে খুব বেশি দেখা দেয়নি। বরং এদেশের কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কুটিরশিল্পের কর্মী ও সংগঠক প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষের জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়, যা থেকে উত্তরণের পথ তাদের জানা ছিল না । অথবা তাদের জানাতে কেউ এগিয়ে আসেনি ।
ঔপনিবেশিক আমলেই যে বাংলার কৃষকদের চরম সংকটের সূচনা, বিভিন্ন ঐতিহাসিক-সমাজতাত্ত্বিকের গবেষণায় তার প্রমাণ মেলে। ব্রিটিশ শাসনামলে দশকের পর দশক ধরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে জমির বিভাজন, ভূমিহীনশ্রেণির বৃদ্ধি, মহাজনের নিয়ন্ত্রণে অধিকাংশ জমি, জটিল ভূমিব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীশ্রেণির আবির্ভাব প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য ভূমিব্যবস্থার বৈষম্যকে প্রকট থেকে প্রকটতর করেছে এবং বাড়িয়ে তুলেছে সামাজিক সংকট, যে সংকটের সর্বাধিক শিকার কৃষক। উনিশ শতকে বাংলার ক্ষুদ্র চাষির জীবন রপ্তানিনির্ভর ঔপনিবেশিক অর্থনীতির কবলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এসবের পরিণামে কৃষক সমাজ মূলত সরকার, জমিদার ও নানামাত্রায় আধিপত্যবাদী শ্রেণির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয় এবং বাংলার নানা স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই বিদ্রোহসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০ খ্রি.), শমসের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮ খ্রি.), পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা-বিদ্রোহ (১৭৭৬-

অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর দরিদ্র সাধারণ কিংবা নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা ৮৩ ৮৭ খ্রি.) রংপুর কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.), বাংলার ফরায়েজি বিদ্রোহ (১৮৩৮-৪৭ খ্রি.) ও সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.) ইত্যাদি। এসব বিদ্রোহে নিম্নবর্গের অসন্তোষের প্রতিফলন ঘটে।
আঠারো শতকের শেষার্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক জয়ের মাধ্যমে বাংলায় যে শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় কালক্রমে তা আরও সুসংহত হয়। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোম্পানি সরকারের গৃহীত নানামুখী প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপের ফলে বাংলার ইতিহাসে একটি নিম্নবর্গ শ্রেণির বিকাশ ঘটে ।
বাংলায় নিম্নবর্গ শ্রেণির উদ্ভব সমাজের ক্রম বিবর্তনের ফল। ১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলায় ব্রিটিশ প্রশাসন কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এগুলোর মধ্যে ভূমিব্যবস্থার নতুন বিন্যাস, ব্যবসায় বাণিজ্যে পুঁজিবাদী চেতনার বিকাশ, ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার, আইন-আদালত স্থাপন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
বাংলার নিম্নবর্গের সমাজ ও অর্থনীতির বিকাশ ধারার প্রকৃতি বিশ্লেষণে একথা প্রতীয়মান হয় যে বাংলার ঐতিহ্যবাহী কৃষি ব্যবস্থার মূল ধারাটিই অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের বাংলায় বিদ্যমান ছিল। এ সময়ে ব্রিটিশরা বাংলায় বহুবিধ প্রশাসনিক স্তর ও পদের সৃষ্টি করেছিল। কৃষক তথা নিম্নবর্গ শোষণই ছিল এদের সকলের জীবিকানির্বাহের উপায়। আবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জমিদারি প্রথাটিও ছিল অক্ষুণ্ণ, জমিদারদের সহযোগীরূপে শোষকের তালিকায় যুক্ত হয়েছিল তালুকদার, ইজারাদার ও মহাজনশ্রেণি, এমনকি সরকারের নীতিও ছিল বাড়তি রাজস্ব প্রাপ্তির দিকে। অথচ বাড়তি রাজস্ব সংস্থানের জন্য কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির পক্ষে প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়নি। এরূপ পরিস্থিতিতে নিম্নবর্গ কৃষক সমাজ উপকৃত হয়নি বরং অত্যাচারিত হয়েছে। মনে হয় এ কারণেই অনেকটাই বাংলার নিম্নবর্গ কৃষক শ্রেণি ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর ঘটনাপ্রবাহ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখে। অন্যদিকে মুঘল-নবাবি শাসকদের বিলাসী জীবন, বর্ণপ্রথা, কৃষি, কৃষক ও জমির সাথে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন এখানে ইউরোপের মতো কোনো বণিক সংঘ গড়ে উঠতে দেয়নি। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে বণিকদের মতামতকে কখনোই প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। এ কারণে দেশীয় বণিকগণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে এগিয়ে আসেনি। ফলে সমাজে নতুন কোনো উৎপাদন ব্যবস্থাও বিকশিত হতে পারেনি। উপরন্তু এই সমাজ কাঠামোর মধ্যে ইউরোপের মতো এখানে কোনো শক্তিশালী মধ্যবিত্তশ্রেণি বিকশিত হয়নি। এই মধ্যবিত্তশ্রেণি না থাকার কারণে রাজশক্তি তাদের কর্মকাণ্ডের দোষত্রুটি বুঝে উঠতে পারেনি। সুতরাং মধ্যবিত্তশ্রেণির অনুপস্থিতি এবং ব্যবসায়ীদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে স্থান না দেওয়ার কারণে এ সমাজ পরিবর্তনশীল জগতের সকল প্রকার নতুনত্ব ও পরিবর্তন থেকে ছিল অনেক দূরে। এরূপ প্রেক্ষপটে ইউরোপীয় বণিকরা বিশেষত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আধুনিক ধ্যানধারণা নিয়ে বাংলায় আসে। এ সমাজের দুর্বলতায় আঘাত করে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীতে জয়ী হয়। সুতরাং ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ শেষে, বাংলা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার জন্যে মীরজাফর, জগৎশেঠ বা এ জাতীয়
কতিপয় ব্যক্তির উপর দোষ চাপিয়ে ইংরেজ আধিপত্যের ব্যাখ্যা দেওয়া নানা কারণে অযৌক্তিক। সুতরাং কোনো ব্যক্তি বিশেষের ভুলের জন্য নয় বরং সামগ্রিক ব্যর্থতার পরিণতিই ছিল পলাশীর বিয়োগান্ত ঘটনা। পলাশী যুদ্ধোত্তর কোম্পানিও ব্রিটিশ শাসনামলে নিম্নবর্গ কৃষক শ্রেণি তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলে। ১৯৪৭ খ্রি. পর্যন্ত তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]